রাজশাহী বিভাগের নাটোর যেলাধীন সদর থানার বালিয়াডাঙ্গা গ্রাম। এই গ্রামেরই সন্তান আমরা পাঁচজন। আমি নূর হোসাইন, পিতা- মুহাম্মাদ বাচ্চু প্রধান। বাকী চারজন হচ্ছেন, মুহাম্মাদ জাহিদ হোসাইন, পিতা- মৃত মোত্তালেব খাঁ, আব্দুল বারেক, পিতা-মৃত আব্দুছ ছামাদ ব্যাপারী, মুহাম্মাদ আল-আমীন, পিতা- মুহাম্মাদ আলী ও রবীন, পিতা- শাহীনুর রহমান। আমাদের গ্রামটি সম্পূর্ণ হানাফী মাযহাবভুক্ত। আমরাও সে মোতাবেকই আমল করে আসছিলাম। হুযুর যা বলতেন অন্ধের মত তাই বিশ্বাস করতাম। শিরক-বিদ‘আতে আচ্ছন্ন আমাদের সমাজ। মহান আল্ল­াহর অগণিত শুকরিয়া যে, তিনি আমাদেরকে হক পথের পথিক হিসাবে কবুল করেছেন। আমরা ছহীহ আক্বীদা ও আমল সম্পর্কে যৎসামান্য জ্ঞান লাভ করে বুঝতে পারলাম যে, রাসূল (ছাঃ)-এর শিখানো পদ্ধতি অনুযায়ী আমাদের আমল হচ্ছে না। আমাদের ছালাত, ছিয়াম, হজ্জ, যাকাত সব কিছুই যেন ভেজালযুক্ত। অথচ রাসূল (ছাঃ) সুস্পষ্টভাবে বলে দিয়েছেন, ‘যে কেউ এমন আমল করবে, যার মধ্যে আমার কোন নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত বা বাতিল’ (মুসলিম হা/১৭১৮)। ছালাতের ক্ষেত্রে তাঁর দ্ব্যার্থহীন বক্তব্য হচ্ছে- ‘তোমরা ছালাত আদায় কর সেভাবে, ঠিক যেভাবে আমাকে আদায় করতে দেখেছ’ (মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৬৮৩)। সেকারণ আমরা হক-এর অনুসন্ধানে ব্রতী হই এবং এদেশের হকপন্থী জামা‘আত ‘আহলেহাদীছ’-এর সন্ধান লাভ করি।

অতঃপর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্ল­াহ আল-গালিব রচিত ছালাতুর রাসূল সহ অন্যান্য আহলেহাদীছ আলেমদের লিখিত বই-পুস্তক পড়ে আমাদের অন্তরচক্ষু খুলে যায়। আমাদের মধ্যে জাহিদ চাচা সবার আগে ২০০৬ সালে আহলেহাদীছ আক্বীদা গ্রহণ করেন। তখন তিনি একাই ছিলেন। তেমন বাধার সম্মুখীন হননি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে যখন আমরা বাকী তিন জন আহলেহদীছ হয়ে প্রকাশ্যে আমল শুরু করি তখনই দেখা দেয় যাবতীয় সমস্যা। আমাদের উপর নেমে আসে হিমাদ্রি সম বাধা। নেমে আসে মানসিক ও শারিরীক নির্যাতন।

আমরা গ্রামের মসজিদেই নিয়মিত ছালাত আদায় করি। যখন সশব্দে আমীন বলি, বুকের উপর হাত বাঁধি ও রাফ‘উল ইয়াদায়েন করি তখন অন্যান্য মুছল্ল­ীগণ আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকেন ও নানা প্রশ্ন করেন। আল-হামদুলি­ল্লাহ আমরা দলীল ভিত্তিক জবাব দিলে অনেকে সমর্থন না করলেও চুপ থাকেন ও বুঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু বাধ সাধে গ্রামের কতিপয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। যারা সাধারণ সরলপ্রাণ মুছল্লীদেরকে আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলে। নানা অপবাদে আমাদেরকে জর্জরিত করে ফেলে। আমরা শুধু ধৈর্যের সাথে শ্রবণ করি ও সাধ্যপক্ষে সুযোগ মত বিনয়ের সাথে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করি।

এরি মধ্যে আমাদের গ্রামের সাবেক চেয়ারম্যান জনাব ওমর ফারূক গত রামাযান মাসের আগের শুক্রবার মাগরিবের ফরয ছালাত শেষে ঘোষণা দেন যে, সুন্নাত পড়ে আপনারা সকলে বসবেন কিছু যরূরী কথা আছে। দেখা গেল যরূরী বিষয় আর কিছু নয়, বিষয় হচ্ছি আমরা। চেয়ারম্যান ছাহেব আমাদেরকে সম্বোধন করে বলতে লাগলেন যে, ‘তোরা যা শুরু করেছিস, তাতে গ্রামের মুছল্লীদের সমস্যা হচ্ছে। তোরা যে আমল করছিস, তা মিথ্যা। এগুলো ছেড়ে দিয়ে সমাজের সবার সাথে মিলে মিশে চল’। রাফ‘উল ইয়াদায়েন সম্পর্কে বলেন, ‘এটি করা হ’ত ইসলামের প্রথম যুগে, যখন নতুন মুসলমানরা নামাযের সময় হাতের ফাঁকে ও বগলের নীচে মূর্তি রাখত’। আমাদের মধ্য থেকে আল-আমীন হাদীছের রেফারেন্স সহ কিছু কথা বললে কোন জবাব দিতে না পেরে রাগত স্বরে চেয়ারম্যান বললেন, ‘তোরা যা পারিস কর’। স্থানীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জনাব রূহুল আমীন সর্বৈব মিথ্যাচার করে বলতে লাগলেন, ‘এরা জেএমবি, এরা শিবির, এরা কাফের, এরা মসজিদে বোমা মারে। এরা মুছল্ল­ীদের নামাযে সমস্যার সৃষ্টি করে...’ ইত্যাদি অনেক কিছু। আমরা শুধু ধৈর্যের সাথে শ্রবণ করেছি। অতঃপর পরের জুম‘আয় ইমাম ছাহেব খুৎবায় আমাদেরকে শয়তান, কাফের, নিম্নশ্রেণীর মুসলিম ইত্যাকার নানান কটুক্তি করে মারাত্মকভাবে বিষোদগার করে।

চেয়ারম্যানের ভাতিজা খোরশেদ মুছল্লীদের বলে যে, নূর হোসাইন যদি বুকে হাত বেঁধে নামায পড়ে তাহ’লে পিছন থেকে লাথি মেরে ফেলে দিবেন। তাতেও না থামলে প্রয়োজনে খুন করব এবং থানায় গিয়ে মামলা করে দিব যে, এরা জেএমবির লোক।

এভাবেই নানা সমালোচনা ও বাধা-বিপত্তির মধ্যে চলতে থাকে আমাদের দিন। উপস্থিত হয় ২০১৩ সালের পবিত্র ঈদুল আযহা। যথারীতি ঈদের ছালাত আদায় করি স্থানীয় ঈদগাহতেই। সামাজিক নিয়ম অনুযায়ী কুরবানীর গোশতের তিনভাগের একভাগ সমাজে প্রেরণ করলে আমাদের গোশত গ্রহণ না করে ফেরত দেওয়া হয়। ফলে সে গোশত আমরা নিজেরাই গরীব-মিসকীনদের মধ্যে বন্টন করে দেই। অতঃপর ঈদের পরদিন ১৭ অক্টোবর তারিখে গ্রাম্য পুলিশ দিয়ে শালিস ডাকা হয়। প্রসঙ্গ আর কিছু নয়, আমরা যারা নতুন আহলেহাদীছ হয়েছি তারা। অতঃপর সন্ধ্যা ৭-টায় উপস্থিত হ’লাম। সাবেক চেয়ারম্যান আমাদের বিভিন্নভাবে প্রশ্ন করতে লাগলেন, আর আমরা সাধ্যমত জবাব দিতে লাগলাম। আমাদের অপরাধ হচ্ছে বুকে হাত বাঁধা, রাফ‘উল ইয়াদায়েন করা, জোরে আমীন বলা ইত্যাদি ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক আমল। এতে নাকি তাদের ছালাতে সমস্যা হয়। আমাদের মধ্যেকার একজনের পিতা রেগে তার সন্তান সম্পর্কে  মজলিসের  উদ্দেশ্যে  বলেন,  ‘সে আমার অবাধ্য সন্তান, কু-সন্তান। সে যদি আমার সন্তান হ’ত তাহ’লে আমরা এবং আমাদের বাপ-দাদারা যেভাবে নামায পড়েছি, সেও ঠিক সেভাবেই নামায পড়ত। এরা শয়তান, কাফের, এদের জুতাপেটা করতে হবে’ ইত্যাদি অনেক কিছু। স্থানীয় আরেক নেতা রূহুল আমীন বলেন, আমরা প্রায় ৪০০ ঘর লোক এক সমাজে বসবাস করি। অথচ এরা ফিৎনা সৃষ্টি করে সমাজকে বিভক্ত করছে। এদের শাস্তি অনিবার্য। একপর্যায়ে চেয়ারম্যান বললেন, ‘তোরা যে বই পড়িস সে বইগুলি নিয়ে আয়’। তখন আমরা বঙ্গানুবাদ ছহীহ বুখারী, ছহীহ মুসলিম, তাফসীরে ইবনে কাছীর হাযির করলে বলেন, ‘এগুলি ইহুদী-নাছারাদের বই। এগুলি খুলবেন না। খুললে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবেন। এরা ড. আসাদুল্লাহ আল-গালিবের লোক। এরা সংগঠন থেকে অনেক টাকা পায়’। মিথ্যাচার আর কাকে বলে! দুর্ভাগ্য যে, আমরা কুরআন-হাদীছ থেকে রেফারেন্স সহ বললে সেটা হয় মিথ্যা, আর চেয়ারম্যান কিচ্ছা-কাহিনী বললে সেটা হয় সত্য! নির্বুদ্ধিতা আর কাকে বলে! দুর্ভাগ্যজনক হ’লেও সত্য যে, আমাদের সমাজের অধিকাংশ লোকই নেশাদ্রব্যে আসক্ত। জুয়া-লটারী তাদের নিত্যসঙ্গী। ছালাত-ছিয়ামের ধারে কাছেও এরা নেই। অনেকে শুধু সাপ্তাহিক ও দুই ঈদের ছালাতে অভ্যস্ত। অথচ এদের নিয়ে সমাজ নেতাদের কোন মাথা ব্যাথা নেই। সমাজ রসাতলে গেলেও এ সকল নেতাদের তাতে কিছু আসে যায় না। আর আমরা যারা নিয়মিত মসজিদে জামা‘আতের সাথে পাঁচওয়াক্ত ছালাতে অভ্যস্ত, ছহীহ আক্বীদা ও আমলের পাবন্দী, আমাদেরকে নিয়েই তাদের যত মাথা ব্যাথা।

অতঃপর চেয়ারম্যান একপর্যায়ে আমাকে বলেন যে, ‘তোর আববা আমাদের মত নামায পড়ে, তুই তোর বাবার কথা শুনিসনা কেন’? তখন আমি বললাম, পিতা-মাতার কুরআন-হাদীছ ভিত্তিক কথা শুনা যাবে। কিন্তু কুরআন-হাদীছ বিরোধী বা শিরক-বিদ‘আত ভিত্তিক কোন নির্দেশ মানা যাবে না। উদাহরণ হিসাবে আমি হযরত ইবরাহীম (আঃ)-এর কথা তুলে ধরলাম। তখন হঠাৎ চেয়ারম্যান ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, ইবরাহীম (আঃ)-এর পিতা ছিলেন মুশরেক। তোর পিতা কি মুশরেক? এই বলে তিনি আমার উপর চড়াও হ’লেন এবং উপস্থিত জনতার সামনে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করলেন। পরিবেশ তখন থমথমে। আমার সাথী তিনজনও হতবাক ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ল। অতঃপর তিনি বললেন, তোরা এই গ্রামের সন্তান, এই গ্রামেই থাকতে হবে। এই গ্রামে প্রচলিত হানাফী মাযহাবের তরীকা অনুযায়ীই নামায পড়তে হবে। ইমাম আবু হানীফার কথা মত চলতে হবে। এর বাইরে কোন কিছু মানা যাবে না। আমাদেরকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, ইমাম আবু হানীফার কথা মানব কি-না? উপায়ান্তর না দেখে ইমাম আবু হানীফা (রহঃ)-এর দ্ব্যার্থহীন বাণী إذا صح الحديث فهو مذهبى ‘যেটা ছহীহ হাদীছ, সেটাই আমার মাযহাব’ (রাদ্দুল মুহতার ১/৬৭ পৃঃ) স্মরণ করে স্বীকারোক্তি দেই যে, হ্যাঁ আমরা ইমাম আবু হানীফার কথাই মানব। অর্থাৎ ইমাম আবূ হানীফার নির্দেশ অনুযায়ী ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক আমল করব। অতঃপর শালিস থেকে আমাদের মুক্তি মেলে। এই রায়ের মাধ্যমেই তথাকথিত এই শালিস বৈঠক শেষ হয়।

নূর হোসাইন

বালিয়াডাঙ্গা, নাটোর।






হক-এর পথে টিকে থাকা বড় চ্যালেঞ্জ - .
হকের উপরে অবিচল থাকতে দৃঢ় প্রত্যয়ী
তোমাকে দাওয়াতী কাজের জন্য ঘর ভাড়া দেইনি - ডা. মুহাম্মাদ ফযলুল হক, সফিপুর, গাযীপুর।
‘তোমাকে সঊদী আরবের ভূতে ধরেছে’ - নূরুল ইসলাম, নাটোর
ভ্রান্ত আক্বীদার বেড়াজাল ছিন্ন হ’ল যেভাবে - -আরিফ হাসান আল-গালিব, শার্শা, যশোর।
দলীল-টলিল বুঝি না, তোর মসজিদেই আসার দরকার নেই
স্রেফ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হোক আমাদের পথচলা
‘সকলের সামনে কান ধরে দাঁড়িয়ে বল, এখন থেকে ইমাম আবু হানীফার আদর্শ অনুযায়ী জীবন-যাপন করব’ (!)
এই মসজিদে এসো না, আসলে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিব। - কাউছার, মাদারগঞ্জ, জামালপুর।
হকের পথে যত বাধা - মুহাম্মাদ ইসমাঈল হোসাইন - মাইজদী, নোয়াখালী
থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব - -আব্দুল্লাহ, গাযীপুর।
হক-এর পথে যত বাধা - হাসান আলী ঈশ্বরদী,পাবনা
আরও
আরও
.