গ্রন্থাগার শব্দটি শুনলেই মনের কোণে ভেসে ওঠে সারি সারি বই আর পিনপতন নিস্তব্ধতা। বইপ্রেমীদের মধ্যে গ্রন্থাগারের পরিবেশ একধরনের স্বর্গীয় অনুভূতিরই সৃষ্টি করে। আর যদি সেই গ্রন্থাগারটিতে লক্ষ লক্ষ বই থাকে? তাহলে তো যেকোনো রুচিশীল মানুষকেই হতবাক করে দিতে বাধ্য!
এবছর তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় অবস্থিত তুর্কী রাষ্ট্রপতির আবাসস্থল প্রেসিডেন্সিয়াল কমপ্লেক্সে এমনই এক গ্রন্থাগারের যাত্রা শুরু করেছে। বর্তমানে এটি দেশটির বৃহত্তম গ্রন্থাগার। গ্রন্থাগারটিতে বইয়ের পাশাপাশি রয়েছে প্রচুর একাডেমিক জার্নাল, সংবাদপত্র, ম্যাগাজিন, অডিও ফাইল, মানচিত্র, ডাকটিকিট, চিত্র এবং পান্ডুলিপি।
সুবৃহৎ এই গ্রন্থাগারটিতে রয়েছে বিশ্বে প্রচলিত ১৩৪টি ভাষায় লিখিত ৪০ লক্ষাধিক বই, প্রায় ১২ কোটি ইলেক্ট্রনিক সংস্করণ, প্রায় সাড়ে ৫ লাখ ই-বুক ও দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ, প্রায় ১২ কোটি আর্টিকেল ও প্রতিবেদন এবং প্রায় ৬৫ লক্ষ ই-ডিসার্টেশন (গবেষণামূলক প্রবন্ধ)। তদুপরি, তুর্কী রাষ্ট্রীয় আর্কাইভের ৪ কোটি ৫০ লক্ষ ডকুমেন্ট, তুর্কী পান্ডুলিপি সংস্থা থেকে সংগৃহীত প্রায় ৩ লাখ পান্ডুলিপি, তুর্কী রেডিও ও টেলিভিশন কর্পোরেশনের আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত প্রায় ১২ লাখ অডিও ফাইল এবং ৪৬টি ডাটাবেজ থেকে সংগৃহীত ৬০ হাযার ই-ম্যাগাজিন রয়েছে এই গ্রন্থাগারটিতে। এছাড়া নিয়ম অনুযায়ী তুরস্কে প্রকাশিত প্রতিটি বইয়ের একটি কপি এখানে জমা রাখতে হয়।
২০২০ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উপস্থিতিতে এটি উদ্বোধন করা হয়। ২০১৬ সালে তিনি গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন এবং তুরস্কের শীর্ষ বুদ্ধিজীবী, গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপক ও বেসরকারী সংস্থাগুলোর প্রায় ৩ হাযার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রন্থাগারটি গড়ে ওঠে।
গ্রন্থাগারটি ১৫ লাখ বর্গফুট জায়গায় নির্মিত হয়েছে। এখানে যতগুলো বইয়ের তাক রয়েছে, সেগুলোকে এক সারিতে দাঁড় করালে তা ২০১ কি.মি. দীর্ঘ হবে! গ্রন্থাগারটি দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা সবার জন্য উন্মুক্ত এবং একসঙ্গে প্রায় ৫ হাযার পাঠক অধ্যয়ন করতে পারে। গ্রন্থাগারটির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিশ্বের কোন গ্রন্থাগারেই প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এত বেশী সংখ্যক বই ছিল না।
গ্রন্থাগারটির অন্যতম একটি আকর্ষণীয় অংশ হচ্ছে সিহান্নুমা হল। এখানে বিশ্বে প্রচলিত ১৩৪টি ভাষায় লিখিত প্রায় ২ লক্ষ বই রয়েছে। এখানে আরো রয়েছে একটি ‘মাল্টিমিডিয়া গ্রন্থাগার’, যেখানে ৪টি ডিজিটাল কক্ষ এবং সেগুলোর অভ্যন্তরে ১২টি পাঠকক্ষ রয়েছে। ডিজিটাল কক্ষগুলোতে রয়েছে টাচস্ক্রিন মনিটর, যেগুলোর মাধ্যমে টিআরটি-এর আর্কাইভ থেকে সংগৃহীত লক্ষ লক্ষ অডিও ফাইল এবং আরো প্রায় ১০ হাযার অডিও-ভিজুয়াল ম্যাটেরিয়াল দেখা ও শোনা যাবে।
এছাড়া গ্রন্থাগারটিতে একটি ‘সাময়িকী হল’ রয়েছে। এখানকার সংগ্রহে রয়েছে ১,৫৫০টি ম্যাগাজিন ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন সংস্করণ। তদুপরি, এখানে টাচস্ক্রিন মনিটরে ১২০টি দেশের ৬০টি ভাষায় লিখিত ৭ হাযার দৈনিক পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন পড়ার সুযোগ রয়েছে।
শিশু-কিশোরদের জন্যও গ্রন্থাগারটিতে পৃথক দুইটি অংশ রয়েছে। এখানে প্রায় ২৫ হাযার বই এবং একটি মাল্টিমিডিয়া সেকশন রয়েছে। ১১ থেকে ১৫ বছর বয়সীদের জন্য রয়েছে ‘যুব গ্রন্থাগার’ এবং সেখানে প্রায় ১২ হাযার বই রয়েছে।
শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্যও গ্রন্থাগারটিতে বিশেষ ব্যবস্থা রয়েছে। দৃষ্টিহীন ও শ্রবণশক্তিহীন ব্যক্তিদের পড়াশোনার জন্য বিশেষ ধরনের কক্ষ নির্মিত হয়েছে।
লাইব্রেরীটি এখন পর্যন্ত তুরস্কে নির্মিত সবচেয়ে বড় গ্রন্থাগার। কিন্তু এই অবস্থান বেশী দিন ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কারণ তুর্কী সরকার তুরস্কের বৃহত্তম শহর ইস্তাম্বুলে নতুন একটি গ্রন্থাগার নির্মাণ করতে যাচ্ছে, যেটিতে থাকবে ৭০ লক্ষাধিক বই! কিন্তু অনন্য নির্মাণশৈলীতে সৃষ্ট প্রেসিডেন্সিয়াল লাইব্রেরী যে তুর্কী পাঠকদের জ্ঞানার্জন ও গবেষণার জন্য বিরাট এক সুযোগ হিসাবে থেকে যাবে, সেটি বলাই বাহুল্য।