প্রখ্যাত
তুর্কী ইতিহাসবিদ ড. ফুয়াদ সেযগীন (১৯২৪-২০১৮খ্রি.) গত ৩০শে জুন মৃত্যুবরণ
করেছেন। আরবী ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনায় অসামান্য কৃতিত্বের
অধিকারী এই কিংবদন্তী অধ্যাপক ৯৫ বছর বয়সে তুরষ্কের রাজধানী ইস্তান্বুলের
একটি হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ইস্তাম্বুলের আল-ফাতেহ মসজিদে অনুষ্ঠিত
তাঁর জানাযায় উপস্থিত ছিলেন তুরষ্কের প্রেসিডেন্ট রেসিপ তাইয়েপ এরদোগান,
প্রধানমন্ত্রী বিন আলী ইয়ালদারাম, সাবেক প্রধানমন্ত্রী আহমাদ দাউদ উগলুসহ
তুরস্কের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাগণ এবং লাখো সাধারণ মানুষ। তুর্কী প্রেসিডেন্ট
এ সময় তাঁর সম্মানে ২০১৯ সালকে ‘ফুয়াদ সেযগীন ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞান বর্ষ’
হিসাবে ঘোষণা করেন। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ অবদান হ’ল ১৮
খন্ডে রচিত তাঁর ‘তারীখুত তুরাছ আল-আরাবী’ গ্রন্থটি। এটি মুসলিম
জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাস সংরক্ষণে এমন এক অমূল্য অবদান যে, বিশ্বের প্রত্যেক
ইসলাম গবেষকের জন্য এটি একটি অপরিহার্য আকর গ্রন্থে পরিণত হয়েছে। এই
অবদানের জন্য ১৯৭৮ সালে তিনি কিং ফয়ছাল আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হন।
১৯৪৭ সনে তিনি গ্রন্থটির রচনাকর্ম শুরু করেন এবং ১৯৬৭ সালে প্রথম খন্ডটি
জার্মান ভাষায় প্রকাশ পায়। পরবর্তীতে এটি আরবী ভাষায় অনূদিত হয়। মৃত্যুর
পূর্ব পর্যন্ত তিনি এই গ্রন্থের ১৮শ খন্ড রচনায় লিপ্ত ছিলেন। এই গ্রন্থে
তিনি বিশ্বের বিভিন্ন লাইব্রেরী থেকে ধর্ম, সাহিত্য, ইতিহাস, বিজ্ঞান
প্রভৃতি বিষয়ে মুসলিম লেখকদের লিখিত দুষ্প্রাপ্য ও অমূল্য পান্ডুলিপিসমূহ
উদ্ধার করে তার পরিচয় ও প্রাপ্তিস্থান বিষদভাবে উল্লেখ করেছেন। উল্লেখ্য
যে, ১৯৫৪ সালে তিনি ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন
করেন এবং একই সালে ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। ১৯৬০
সালে তুরষ্কে সামরিক অভ্যুত্থান হ’লে তিনি জার্মানীতে গমন করেন। অতঃপর ১৯৬৫
সালে তিনি জার্মানীর ফ্রাংকফুর্টস্থ গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২য় বার
পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। একই সালে তিনি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রফেসর’
হিসাবে যোগদান করেন। অবসরের পর তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়েই প্রফেসর এমিরিটাস
হিসাবে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮২ সালে তিনি ফ্রাংকফুর্টে The Institute of the
History of the Arab Islamic Sciences প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে এটি বিশ্বে
আরব ও ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রাচীন পান্ডুলিপি ও নমূনাসমূহের সবচেয়ে বড়
সংগ্রহশালা। এই ইনিস্টিউটের মধ্যে তিনি একটি ব্যতিক্রমধর্মী জাদুঘর
প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের স্বর্ণযুগের প্রায় ৮০০
যন্ত্রপাতি, মানচিত্র প্রভৃতির রেপ্লিকা উপস্থাপন করা হয়। ২০০৮ সালে
তৎকালীন তুর্কী প্রধানমন্ত্রী রেসিপ তাইয়েপ এরদোগানের অনুরোধে ইস্তাম্বুলেও
তিনি একই ধরনের একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। কর্মময় জীবনে তিনি দৈনিক ১৭
ঘন্টা গবেষণাকর্মে ব্যাপৃত থাকতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। বার্ধক্যের প্রান্তে
এসেও তিনি ইস্তাম্বুলের লাইব্রেরীসমূহে প্রাচীন পান্ডুলিপির সন্ধানে
ব্যস্ত থাকতেন। কেননা তিনি ইসলামী জ্ঞান ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য তুরষ্কে
একটি নতুন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর একটি দুঃখ
ছিল যে, জার্মানী থেকে তুরস্কে ফিরে আসার সময় তাঁর বহু ভাষার প্রাচীন
দলীলপত্র ও পান্ডুলিপি সমৃদ্ধ ব্যক্তিগত লাইব্রেরীটি জার্মান সরকারের
হস্তাগত হয়ে যায়। কেননা তিনি জার্মানীর ন্যাশনাল আর্কাইভস্-এর নামে
লাইব্রেরীটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ফলে তিনি তুরস্কে ফিরে এসে পূর্বের আদলে
একটি লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। গবেষণাকর্মের প্রয়োজনে তিনি হিব্রু,
ল্যাটিন, সুরিয়ানী সহ প্রায় ২৭টি ভাষা শিক্ষা করেছিলেন। তাঁর একটি বিখ্যাত
উক্তি হল, ‘ইসলামী সভ্যতার মহান উত্তরাধিকার সম্পর্কে পশ্চিমাদের বুঝানোর
চেয়ে স্বয়ং মুসলমানদের বুঝানোই অধিকতর কঠিন’। ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের
ইতিহাস সংরক্ষণে তাঁর এই ব্যতিক্রমী প্রয়াস এবং কালোত্তীর্ণ গবেষণা
নিঃসন্দেহে তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমরত্ব দান করবে।