হাদীছ অনুসরণে চার ইমামের গৃহীত নীতি ও কিছু সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা

কোন হাদীছ মুহাদ্দিছদের শর্তসাপেক্ষে ছহীহ প্রমাণিত হ’লে তা আমলযোগ্য হওয়ার ব্যাপারে সকল যুগের মুহাদ্দিছ, ফক্বীহ এবং উছূলবিদগণ একমত পোষণ করেছেন। কেননা হাদীছ যদি কুরআনের মত আল্লাহর পক্ষ থেকে অহী হয়ে থাকে, তবে অবশ্যই তা সর্বক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হ’তে হবে এবং মুসলিম জীবনের সর্বক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হ’তে হবে। কারণ ইসলাম দলীলভিত্তিক ধর্ম। আর এই দলীল স্বয়ং আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত। এই দলীলের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যই মুসলিম উম্মাহ আদিষ্ট হয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ أَيُّ شَيْءٍ أَكْبَرُ شَهَادَةً قُلِ اللَّهُ شَهِيدٌ بَيْنِي وَبَيْنَكُمْ وَأُوحِيَ إِلَيَّ هَذَا الْقُرْآنُ لِأُنْذِرَكُمْ بِهِ وَمَنْ بَلَغَ ‘বলুন (হে মুহাম্মাদ!) সাক্ষী হিসাবে কোন জিনিস সর্বশ্রেষ্ঠ? আপনি বলে দিন, আল্লাহই আমার এবং তোমাদের মধ্যে (শ্রেষ্ঠ) সাক্ষী। আর এই কুরআন আমার নিকট প্রেরিত হয়েছে, যেন তোমাদেরকে এবং যার নিকট এটি পৌঁছবে তাদেরকে এ দ্বারা আমি সতর্ক করি’ (আন‘আম ৬/১৯)। তদুপরি মু‘তাযিলাদের অতি যুক্তিবাদী ও ভ্রান্ত চিন্তাধারার দূরবর্তী প্রভাবে আহলে সুন্নাহর কিছু বিদ্বান ‘খবরে ওয়াহিদ’ হাদীছকে শরী‘আতের দলীল হিসাবে গ্রহণ করার ব্যাপারে কখনও কখনও সীমাবদ্ধতা প্রকাশ করেছেন। নিম্নে হাদীছ সম্পর্কে ইসলামের সুবিখ্যাত ৪ জন ইমামের অবস্থান উল্লেখ করা হ’ল এবং কিছু ক্ষেত্রে তাদের সীমাবদ্ধতার কারণ পর্যালোচনা করা হ’ল।

(১) ইমাম আবূ হানীফা রহঃ (৮০-১৫০হি.) :

তিনি বলেন, إذا صح الحديث فهو مذهبي ‘যখন কোন হাদীছ বিশুদ্ধ হবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে’।[1] তিনি আরও বলেন যে,حرام على من لم يعرف دليلي أن يفتي بكلامي، ‘যে ব্যক্তি আমার গৃহীত দলীল সম্পর্কে জানে না তার জন্য আমার কথা উদ্ধৃত করে ফৎওয়া দেওয়া হারাম’।[2] অন্যত্র তিনি বলেন,لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه، ‘কারও জন্য বৈধ হবে না, আমাদের কোন বক্তব্যকে গ্রহণ করা যতক্ষণ না সে জানে যে আমরা কোথা থেকে তা গ্রহণ করেছি’।[3] তিনি আরও বলেন,فإننا بشر نقول القول اليوم ونرجع عنه غدا، ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষ, আজ যে কথা বলি, কাল তা থেকে প্রত্যাবর্তন করি’। অন্য বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন,ويحك يا يعقوب (هو أبو يوسف) لا تكتب كل ما تسمع مني فإني قد أرى الرأي اليوم وأتركه غدا وأرى الرأي غدا وأتركه بعد غد، ‘তোমার ধ্বংস হোক হে ইয়াকূব (আবূ ইউসুফ)! আমার নিকট যা-ই শুনো, তা-ই লিখ না; কেননা আমি আজ যে মত প্রকাশ করি, কাল তা পরিত্যাগ করি, আবার আগামীকাল যে মত পোষণ করি, পরশুদিন তা পরিত্যাগ করি’।[4]

তিনি আরও বলেন,إذا قلت قولا يخالف كتاب الله وخبر الرسول صلى الله عليه وسلم فاتركوا قولي، ‘আমি যদি এমন কোন কথা বলি যা আল্লাহর কিতাব এবং রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর বিপরীত হয়, তাহ’লে আমার কথা তোমরা পরিত্যাগ করবে’।[5] তিনি বলতেন,لم يزل الناس في صلاح ما دام فيهم من يطلب الحديث فإذا طلبوا العلم بلا حديث فسدوا، ‘মানুষ ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের ওপর থাকবে যতদিন তারা হাদীছের অনুসন্ধানে থাকবে। যখনই তারা হাদীছ ব্যতীত জ্ঞান অর্জন করবে, তখন তারা বিপর্যস্ত হবে’।[6] অন্যত্র তিনি বলেন,لا ينبغي لأحد أن يقول قولا حتى يعلم أنّ شريعة رسول الله صلى الله عليه وسلم تقبله، ‘কারো জন্য উচিৎ নয় (শরী‘আত সম্পর্কে) এমন কোন কথা বলা, যতক্ষণ না সে জানে যে, রাসূল (ছাঃ)-এর শরী‘আত তা গ্রহণ করে’।[7]

ইমাম আবূ হানীফা (মৃঃ ১৫০হি.)-এর দু’জন প্রধান ছাত্র আবূ ইউসুফ (মৃঃ ১৮২হি.) এবং মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান (মৃঃ ১৮৯হি.) তাঁদের ওস্তাদ তথা ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ)-এর দুই-তৃতীয়াংশ মতের বিরোধিতা করেছিলেন সুন্নাহের অনুসরণের নিমিত্তেই। দলীলের সম্মুখে তাঁরা কখনও নিজের ওস্তাদের মত পরিত্যাগে দ্বিধা করতেন না।[8] ইমামুল হারামাইন আল-জুওয়াইনী (৪৭৮হি.) বলেন,استنكف محمد بن الحسن وأبو يوسف عن متابعته في ثلثي مذهبه ووفقا الشافعي في أكثر المسائل، ‘মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান এবং আবূ ইউসুফ ইমাম আবূ হানীফার মাযহাবের দুই-তৃতীয়াংশই অনুসরণ করেননি এবং অধিকাংশ মাসআলায় ইমাম শাফেঈর সাথে একমত পোষণ করেছেন’।[9]

আহমাদ ইবনু ইউনুস (১৩২হি.) তাঁর পিতা থেকে বণর্না করেন যে,كان أبو حنيفة شديد الاتباع للأحاديث الصحاح، ‘আবূ হানীফা (রহঃ) ছহীহ হাদীছের কট্টর অনুসারী ছিলেন’। অনুরূপভাবে ফুযায়েল ইবনু ইয়ায (১৮৭হি.) বলেন,وكان إذا وردت عليه مسألة فيها حديث صحيح اتبعه، ‘যখনই তাঁর (আবূ হানীফা) নিকটে ছহীহ হাদীছভিত্তিক কোন মাসআলা উল্লেখ করা হ’ত, তিনি তা অনুসরণ করতেন’।[10]

হেদায়ার ব্যাখ্যাগ্রন্থ الأشباه عن شرح الهداية لابن الشحنة -এ আল্লামা ইবরাহীম ইবনু হুসাইন আল-বীরী আল-মাক্কী (১০৯৯হি.) বলেন, إذا صح الحديث وكان على خلاف المذهب عمل بالحديث، ويكون ذلك مذهبه ولا يخرج مقلده عن كونه حنفيا بالعمل به، فقد صح عنه أنه قال: إذا صح الحديث فهو مذهبي، ‘যদি হাদীছ ছহীহ হয় এবং তা মাযহাবের বিরুদ্ধেও যায়, তবে হাদীছের উপরই আমল করতে হবে। আর সেটাই হবে তার মাযহাব। মুক্বাল্লিদ সেই হাদীছের উপর আমলের দরুন মাযহাব থেকে বেরিয়ে যাবে না। কেননা (ইমাম আবূ হানীফা) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত হয়েছে যে, যখন হাদীছ ছহীহ হবে, তখন সেটাই আমার মাযহাব’।[11]

(২) ইমাম মালিক ইবনু আনাস রহঃ (৯৩-১৭৯হি.) :

তিনি বলেন, ليس أحد بعد رسول الله صلى الله عليه وسلم إلا وهو يؤخذ من قوله ويترك ‘রাসূল (ছাঃ)-এর পর এমন কেউ নেই যার কথা গ্রহণযোগ্য কিংবা বর্জনযোগ্য’।[12] তিনি আরও বলেন, إنما أنا بشر، أخطئ وأصيب فانظروا في رأيي فكلما وافق الكتاب والسنة فخذوا به، وكلما لم يوافق الكتاب والسنة، فاتركوه، ‘নিশ্চয়ই আমি মানুষ; আমি ভুলও করি, ঠিকও করি। সুতরাং আমার বক্তব্যের প্রতি নযর রেখ। যখন তা কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক হয়, গ্রহণ কর; আর যখন তা কুরআন ও সুন্নাহর বিপরীত হয়, পরিত্যাগ কর’।[13]

অনুরূপভাবে তাঁর সাথীরাও তাঁর অন্ধ অনুসরণ করেননি। আব্দুল্লাহ ইবনু ওয়াহ্হাব (মৃঃ ১৯৭হি.), ইবনুল মাজিশূন (মৃঃ ২১৩হি.) প্রমুখ খ্যাতনামা মালিকী বিদ্বানগণ অনেক মাসআলায় তাঁদের ওস্তাদের বিপরীত মত পোষণ করেছেন।[14]

(৩) ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু ইদরীস আশ-শাফেঈ রহঃ (১৫০-২০৪হি.) :

তিনি বলেন, إذا وجدتم في كتابي خلاف سنة رسول الله صلى الله عليه وسلم فقولوا بسنة رسول الله صلى الله عليه وسلم ودعوا قولي، ‘যদি তোমরা আমার কিতাবে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহবিরোধী কোন কথা পাও, তাহ’লে তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর কথাকে গ্রহণ কর এবং আমার কথা বর্জন কর’। অপর বর্ণনায় এসেছে,إذا صح الحديث خلاف قولي فاعملوا بالحديث واتركوا قولي، ‘যদি আমার কথার বিপরীতে কোন ছহীহ হাদীছ পাও, তাহ’লে তোমরা হাদীছের উপর আমল কর এবং আমাদের কথাকে পরিত্যাগ কর’।[15] তিনি আরও বলেন, إذا رأيتم كلامي يخالف كلام رسول الله صلى الله عليه وسلم فاعملوا بكلام رسول الله صلى الله عليه وسلم واضربوا بكلامي الحائط (أو وإذا رأيتم كلامي يخالف الحديث فأعملوا بالحديث واضربوا بكلامي الحائط) ‘যদি তোমরা দেখো যে, আমার কথা রাসূল (ছাঃ)-এর কথার (বা হাদীছের) বিপরীত, তাহ’লে তোমরা রাসূল (ছাঃ)-এর কথা মোতাবেক আমল করবে এবং আমার কথাকে দেয়ালে ছুড়ে মারবে’।[16]

তিনি আরও বলেন, أجمع المسلمون على أن من استبانت له سنة من رسول الله صلى الله عليه وسلم لم يحل له أن يدعها لقول أحد، ‘সকল মুসলমান ঐক্যমত পোষণ করেছেন যে, যার নিকট রাসূল (ছাঃ)-এর কোন সুন্নাহ স্পষ্ট হয়েছে, তার জন্য এটা বৈধ নয় যে, কারও কথায় সে সেটাকে পরিত্যাগ করবে’।[17] অন্যত্র তিনি বলেন, ما من أحد إلا وتذهب عليه سنة لرسول الله صلى الله عليه وسلم وتعزب عنه فمهما قلت من قول أو أصلت من أصل فيه عن رسول الله صلى الله عليه وسلم خلاف ما قلت فالقول ما قاله رسول الله صلى الله عليه وسلم وهو قولي، ‘কারো জন্য এটা শোভনীয় নয় যে, সে রাসূল (ছাঃ)-এর কোন সুন্নাহ পাওয়ার পর তা থেকে দূরে থাকবে। সুতরাং আমি যা-ই বলি না কেন কিংবা যে মূলনীতিই অবলম্বন করি না কেন, যদি সে বিষয়ে রাসূল (ছাঃ) থেকে কোন ভিন্নমত থাকে, সেক্ষেত্রে রাসূল (ছাঃ)-এর কথাই হ’ল মূল কথা। আর সেটাই আমার কথা’।[18]

ইসমাঈল ইবনু ইয়াহইয়া আল-মুযানী (মৃঃ ২৬৪হি.), ইবনু খুযায়মাহ (মৃঃ ৩১১ হি.), ইবনু সুরাইজ (মৃঃ ৩০৬হি.) প্রমুখ শাফেঈ মাযহাবের বিখ্যাত বিদ্বানগণ প্রত্যেকেই সুন্নাহর অনুসরণ করতে গিয়ে ইমাম শাফেঈর অনেক ফৎওয়া অনুসরণ করেননি।[19]

(৪) ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল রহঃ (১৬৪-২৪১হি.) :

তিনি বলেন, لا تقلدني ولا تقلد مالكا ولا الثوري ولا الأوزاعي، وخذ من حيث أخذوا (أو لا تقلدني ولا تقلدن مالكا ولا الأوزاعي ولا النخعي ولا غيرهم وخذ الأحكام من حيث أخذوا من الكتاب والسنة) ‘তোমরা আমাকে অন্ধভাবে অনুসরণ করো না। মালিক, আওযাঈ, নাখঈ বা অন্য কারোরও অন্ধ অনুসরণ করো না। বরং শরী‘আতের আহকাম সেখান থেকেই গ্রহণ কর, যেখান থেকে তারা গ্রহণ করেছেন, অর্থাৎ কিতাব ও সুন্নাহ থেকে’।[20]

কিছু ক্ষেত্রে হাদীছের প্রতি আমলে ইমামদের সীমাবদ্ধতা ও তার কারণ :

হাদীছের প্রতি দ্ব্যর্থহীনভাবে আমলের কথা বলা হ’লেও আমরা লক্ষ্য করি যে, পূর্ববর্তী ইমামগণের কেউ কেউ শরী‘আতের কোন কোন হুকুমের ব্যাপারে নিজস্ব রায়ের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন এবং ছহীহ হাদীছ পাওয়া সত্ত্বেও তার বিপরীত সিদ্ধান্ত প্রদান করেছেন। ইমাম ইবনু তায়মিয়া রহঃ (মৃঃ ৭২৮হি.) এর পিছনে ১০টি কারণ উল্লেখ করেছেন।[21]

যেমন :

  • তাঁর নিকট হাদীছটি পৌঁছেনি। বিশেষত প্রাথমিক যুগে হাদীছ বিস্তৃতভাবে সংকলিত না হওয়ায় অনেক হাদীছ ইমামদের নিকটে অজ্ঞাত ছিল। ফলে তাঁরা কখনও ক্বিয়াসের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। কখনও ক্বিয়াসটি হাদীছের অনুকূলে হয়েছে, কখনও প্রতিকূলে হয়েছে। ইমামদের ক্ষেত্রে কিছু হাদীছ বিরোধী আমল ও ফৎওয়া পাওয়ার কারণ মূলতঃ এটিই।
  • হাদীছটি তাঁর নিকটে পৌঁছেছিল, কিন্তু তঁার কাছে ছহীহ সাব্যস্ত হয়নি। হয়ত তাঁদের নিকটে প্রাপ্ত সূত্রে কোন বর্ণনাকারী যঈফ ছিল কিংবা সূত্র বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অন্য সূত্রে সেটি ছহীহ পাওয়া গেছে কিংবা মুতাবা‘আত ও শাওয়াহিদের কারণে হাদীছটি শক্তিশালী হয়েছে। এজন্য কোন কোন ইমাম বলতেন,قولي في هذه المسألة كذا وقد روي فيها حديث بكذا؛ فإن كان صحيحا فهو قولي، ‘এই বিষয়ে আমার ফৎওয়া হ’ল এটি এবং হাদীছে বর্ণিত হয়েছে এভাবে। যদি হাদীছটি ছহীহ হয়, তবে সেটিই আমার ফৎওয়া’।
  • কোন হাদীছ তাঁর নিজস্ব ইজতিহাদে যঈফ ছিল, যদিও তা অপরের নিকট ছিল ছহীহ। এর কারণ ছিল এই যে, হাদীছের বর্ণনাকারী সম্পর্কিত বিজ্ঞানের সীমানা অনেক বিস্তৃত। ফলে তাঁর নিকট প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক হাদীছটিকে যঈফ হিসাবে ধারণা করেছিলেন, যা আদতে যঈফ নয়। আবার অনেক সময় এমন হয়েছে যে হিজাযের অধিবাসীরা ইরাক বা শামের অধিবাসীদের হাদীছ গ্রহণ করতেন না। কেননা তারা মনে করতেন, এ সমস্ত এলাকার অধিবাসীগণ হাদীছ সংরক্ষণে যত্নবান নন। অনুরূপভাবে কোন কোন ইরাকবাসী শামবাসীদের হাদীছ গ্রহণ করতেন না। এসব কারণে তাদের ইজতিহাদে মতপার্থক্য ঘটেছিল।
  • খবরে ওয়াহিদ গ্রহণে শর্তারোপের বিভক্তিও তাদের কাউকে হাদীছ গ্রহণ থেকে বিরত রেখেছিল। যেমন তাদের কেউ শর্তারোপ করেছিলেন যে, হাদীছকে কুরআনের ভিত্তিতে যাচাই করতে হবে। কেউ শর্তারোপ করেছিলেন যে, জনসম্পৃক্ত বিষয় হ’লে হাদীছটিকে সর্বজনের মাঝে সুপ্রসিদ্ধ হ’তে হবে। কেউ শর্তারোপ করেছিলেন হাদীছটির ওপর মদীনাবাসীদের আমল থাকতে হবে প্রভৃতি।
  • হাদীছটি তাঁর নিকটে পৌঁছেছিল এবং ছহীহ সাব্যস্তও হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি হাদীছটি সম্পর্কে বিস্মৃত হয়েছিলেন।
  • কখনও কোন হাদীছের দুর্বোধ্য শব্দসমূহের প্রকৃত অর্থ নির্ণয় করতে সক্ষম হননি অথবা রাসূল (ছাঃ) যে অর্থ গ্রহণ করেছেন, তিনি সে অর্থ বোঝেননি অথবা শব্দগত অর্থ বুঝলেও পরিভাষাগত অর্থ বোঝেননি। যেমন ‘আল-খামর’, ‘আন-নাবীয’ প্রভৃতি শব্দ।
  • কখনও কোন হাদীছের শাব্দিক ও পারিভাষিক অর্থ বুঝলেও সঠিক মর্ম বুঝতে পারেননি। যেমন হাদীছের সাধারণ কোন নির্দেশ বিষয়টিকে ফরয করে দেয় কি-না প্রভৃতি।
  • কখনও হাদীছের মর্মার্থটি অপর হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক ভেবে সেটি হাদীছের প্রকৃত উদ্দেশ্য নয় মনে করেছেন। যেমন হাদীছটির কোন আম বিষয়কে খাছ করা বা মুত্বলাক বিষয়কে মুক্বাইয়াদ করা।
  • কখনও হাদীছের মর্মার্থটি সাংঘর্ষিক ভেবে তা দুর্বল কিংবা মানসূখ মনে করেছেন। অথবা কোন হাদীছ ইজমার সাথে সাংঘর্ষিক ভেবে পরিত্যাগ করেছেন এই ভেবে যে, হাদীছটি গ্রহণ করলে তা হবে ইজমার বিপরীত। অথচ আদতে বিষয়টিতে ইজমা‘ হয়নি।
  • কোন হাদীছ সাংঘর্ষিক মনে করে দুর্বল বা মানসূখ ভাবা। অথচ সেটি অন্যদের নিকট সাংঘর্ষিক নয়। যেমন অনেক কুফাবাসী কুরআনের প্রকাশ্য অর্থের বিরোধী কোন ছহীহ হাদীছ গ্রহণ করতেন না। তারা মনে করতেন যে, কুরআনের প্রকাশ্য অর্থ হাদীছের উপর অগ্রগণ্য। ফলে শাফেঈ বিদ্বানগণ যখন কোন হাদীছ কুরআনকে খাছ করে মনে করেন, তখন একই হাদীছ হানাফী বিদ্বানগণ কুরআনকে নাসেখ (রহিতকারী) ধারণা করেন।

উপরোক্ত কারণসমূহ পর্যালোচনা করলে বোঝা যায় যে, প্রাথমিক যুগে বিস্তৃতভাবে হাদীছের সংকলন শুরু না হওয়ায় তাঁদের নিকট অনেক হাদীছ পৌঁছেনি কিংবা পৌঁছলেও হাদীছটি দুর্বল প্রতীয়মান হওয়ায় তারা হাদীছটি গ্রহণ করেননি। এটি তার নিজস্ব অপারগতা বা বোঝার ভুল হ’তে পারে, কিন্তু দলীল কখনও ভুল হয় না এবং কারো ভুল ইজতিহাদের কারণে হাদীছ পরিত্যক্ত হয় না। সেজন্য তারা সকলেই বলে গেছেন যে, কোন হাদীছ ছহীহ প্রমাণিত হ’লে তার উপর নিঃশর্তভাবে আমল করতে হবে। চার ইমামেরই প্রসিদ্ধ মন্তব্য- إذا صح الحديث فهو مذهبي ‘যখন কোন হাদীছ ছহীহ প্রমাণিত হবে, তখন সেটিই আমার মাযহাব’। ইমাম আবূ হানীফা (১৫০হি.), ইমাম আবূ ইউসুফ (১৮২হি.), ইমাম যুফার (১৫৮হি.) প্রমুখ বলেন,لا يحل لأحد أن يأخذ بقولنا ما لم يعلم من أين أخذناه، ‘কারো জন্য বৈধ নয় যে, আমাদের কোন ফৎওয়া গ্রহণ করা, যতক্ষণ না কোথা থেকে আমরা সেটি গ্রহণ করেছি তা না জানে’।[22] ইমাম মালিক (১৭৯হি.) বলেন,ما من أحد إلا وهو مأخوذ من كلامه ومردود عليه إلا رسول الله صلى الله عليه وسلم ‘রাসূল (ছাঃ) ব্যতীত সকল ব্যক্তিরই কথা গৃহীত আবার পরিত্যাজ্যও হয়’।[23] ইমাম শাফেঈ (২০৪হি.) অত্যন্ত চমৎকারভাবে বলেছেন, وأما أن نخالف حديثا عن رسول الله ثابتا عنه: فأرجو أن لا يؤخذ ذلك علينا إن شاء الله، وليس ذلك لأحد، ولكن قد يجهل الرجل السنة فيكون له قول يخالفها، لا أنه عمد خلافها، وقد يغفل المرء ويخطئ في التأويل، ‘আমরা যদি রাসূল (ছাঃ)-এর কোন ছহীহ হাদীছের খেলাফ কাজ করি, তবে আশা করি সেটি আমাদের বিরুদ্ধে গ্রহণ করা হবে না ইনশাআল্লাহ। এটি কারো ক্ষেত্রেই নয়। কেননা ব্যক্তির কোন সুন্নাহ সম্পর্কে অজানা থাকতে পারে এবং সেই কারণে তার ফৎওয়াটি সুন্নাহর খেলাফ হ’তে পারে। এমন নয় যে, সে ইচ্ছাকৃতভাবে কাজটি করেছে। কখনও অসতর্কতার দরুন ব্যাখ্যাতেও ভুল করে বসতে পারে’।[24] ইমাম আহমাদ (২৪১হি.) বলতেন, ليس لأحد مع الله ورسوله كلام، ‘আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর সাথে অন্য কারও কথা থাকে না’।[25]

ইমামদের এ সকল বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয় যে, তারা প্রত্যেকেই সুন্নাহর অনুসরণের ব্যাপারে অত্যন্ত দৃঢ় ছিলেন। তাদের কোন ফৎওয়া ছহীহ হাদীছ বিরোধী হওয়ার অর্থ সে বিষয়ে ছহীহ হাদীছ তাঁদের নিকট পৌঁছেনি। আর যে সকল ছহীহ হাদীছ পাওয়ার পরও তঁারা গ্রহণ করেননি, তা হয় তাঁদের দৃষ্টিতে ছহীহ ছিল না কিংবা তাঁদের ইজতিহাদ মোতাবেক মানসূখ ছিল।[26] সেই সাথে তাঁরা নিজেদের ভুল ইজতিহাদের ব্যাপারে পূর্ণ সচেতন ছিলেন এবং এ ব্যাপারে অনুসারীদের সতর্ক করে দিয়েছিলেন যেন তাঁদের কোন বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হ’লে তার অনুসরণ না করা হয়। সুতরাং তাঁদের ব্যাপারে এরূপ ধারণা করা অসম্ভব যে, তাঁরা নিজেদের কথা বা নীতিকে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাহর ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। নতুবা তাঁরা অনুসরণীয় ইমাম হিসাবেই পরিগণিত হ’তেন না। [ক্রমশঃ]


[1]. ইবনু আবিদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার আলাদ দুর্রিল মুখতার (বৈরূত : দারুল ফিকর, ১৯৯২ খ্রি.), পৃ. ১/৬৭-৬৮, ৩৮৫।

[2]. মুহাম্মাদ ইবনু আলী থানভী, কাশ্শাফু ইহতিলাহিল ফুনূন ওয়াল উলূম (বৈরূত : মাকতাবাতু লুবনান, ১৯৯৬খ্রি.), ১/১৪৬।

[3]. ইবনু আব্দিল বার্র, আল-ইনতিকা ফী ফাযাইলিছ ছালাছাহ আল-আইম্মাহ আল-ফুক্বাহা (বৈরূত : দারুল কুতুবিল-ইলমিয়াহ, তাবি), পৃ. ১৪৫; ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন আন রাবিবল আলামীন (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিইয়াহ, ১৯৯১খৃঃ), ২/১৪৭; ছালিহ আল-ফুল্লানী, ইকাযু হিমামি ঊলিল আবছার (বৈরূত : দারুল মা‘রিফাহ. তাবি), পৃ. ৫৩; ইবনু নুজাইম, আল-বাহরুর রাইক ও ইবনু আবিদীন, মিনহাতুল খালিক (একত্রে প্রকাশিত) (কায়রো : দারুল কিতাবিল-ইসলামী, তাবি), ৬/২৯৩।

[4]. আহমাদ বিন সুলায়মান আইয়ূব, মুনতাহাল আমানী বি ফাওয়ায়েদে মুছত্বালাহিল হাদীছ লিল মুহাদ্দিছ আল-আলবানী (কায়রো : আল-ফারূক আল-হাদীছিয়াহ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ৬০।

[5]. ইকাযু হিমামি ঊলিল আবছার, পৃ. ৬২।

[6]. কাশ্শাফু ইছতিলাহিল ফুনূন ওয়াল উলূম, ১ম/১৪৬; যাফর আহমাদ ওছমানী থানভী, ই‘লাউস সুনান (বৈরূত : দারুল কুতুব আল-ইলমিয়াহ, ১ম প্রকাশ : ২০১৮খ্রি.), ১৯/৫৮।

[7]. কাশ্শাফু ইসতিলাহিল ফুনূন ওয়াল উলূম, ১ম/১৪৬; যাফর আহমাদ ওছমানী থানভী, ই‘লাউস সুনান, ১৯/৫৮।

[8]. ইবনু খাল্লিকান, ওফায়াতুল আ‘ইয়ান (বৈরূত : দারু ছাদির, ১৯৯৪খ্রি.), ৬ষ্ঠ/৩৭৯; তাজুদ্দীন আস-সুবকী, ত্বাবাক্বাতুশ শাফিঈয়্যাহ আল-কুবরা (জীযা, মিসর : দারু হিজর, ২য় প্রকাশ : ১৪১৩হি.), ২/১০২; রাদ্দুল মুহতার আলাদ দুর্রিল মুখতার, পৃ. ১/৬৭।

[9]. আল-জুওয়াইনী, মুগীছুল খালক ফী তারজীহিল ক্বওলিল হাক্ক (কায়রো : আল-মাত্ববা‘আতুল-মিছরিয়াহ, ১৯৩৪খ্রি.), পৃ. ৪৪।

[10]. আলাউদ্দীন বুখারী, কাশফুল আসরার শারহু উছূলিল বাযদূভী, ১/১৭।

[11]. ইবনু আবেদীন শামী, রাদ্দুল মুহতার আলাদ দুর্রিল মুখতার, ১/৬৭।

[12]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ২/৯২৬।

[13]. ইবনু আব্দিল বার্র, জামেঊ বায়ানিল ইলমি ওয়া ফাযলিহি, ১/৭৭৫।

[14]. দ্র. ছালাহুদ্দীন মাক্ববূল আহমাদ, যাওয়াবি‘ ফী ওয়াজহিস সুন্নাহ, পৃ. ৩০০-৩০১।

[15]. আন-নববী, আল-মাজমু‘ শারহুল মুহায্যাব, ১ম/৬৩; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০৩।

[16]. যাইনুদ্দীন আল-ইরাক্বী, আল-মুসতাখরাজ আলাল মুসতাদরাক লিল হাকেম (কায়রো : মাকতাবাতুস সুন্নাহ, ১৪১০ হি.), পৃ. ১৬; ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/২০১; শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, ইক্বদুল জীদ ফী আহকামিল ইজতিহাদ ওয়াত-তাক্বলীদ (কায়রো : আল-মাতবা‘আতুস-সালাফিয়াহ, ১৩৪৫হি.), পৃ. ৩২।

[17]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ১/৬; ইকাযু হিমামি ঊলিল আবছার, পৃ. ৫৮।

[18]. ইকাযু হিমামি ঊলিল আবছার, পৃ. ১০০।

[19]. যাওয়াবি‘ ফী ওয়াজহিস সুন্নাহ ক্বাদীমান ওয়া হাদীছান, পৃ. ৩০০-৩০১।

[20]. ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২/১৩৯; শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী, হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/২৬৮ ও ইক্বদুল জীদ, পৃ. ২৮,৩২; ইকাযু হিমামি ঊলিল আবছার, পৃ. ১১৩।

[21]. রফ‘ঊল মালাম আন আইম্মাতিল আ‘লাম, পৃ. ৯-৩৪।

[22]. ইবনুল ক্বাইয়িম, ই‘লামুল মুওয়াক্কিঈন, ২য়/১৪৭।

[23]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১ম/২৫৭, ২৬৮।

[24]. ইমাম শাফেঈ, আর-রিসালাহ, পৃ. ২১৯।

[25]. হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ, ১/২৬৮।

[26]. দ্র. আবূ যাহূ, আল-হাদীছ ওয়াল মুহাদ্দিছূন, পৃ. ২৭-৩১।






জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লাহ ও রাসূল (ছাঃ) সম্পর্কে কতিপয় ভ্রান্ত আক্বীদা - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
আল্লামা আলবানী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব আরনাঊত্বের সমালোচনার জবাব (৫ম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৪র্থ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
আদর্শ পরিবার গঠনে করণীয় (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (২য় কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
ইসলামে পোশাক-পরিচ্ছদ : গুরুত্ব ও তাৎপর্য (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আবু তাহের, পরিচালক, কিউসেট ইনস্টিটিউট, সিলেট।
আদর্শ শিক্ষকের গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
সীমালংঘন ও দুনিয়াপূজা : জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত হওয়ার দুই প্রধান কারণ (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
প্রাক-মাদ্রাসা যুগে ইসলামী শিক্ষা (শেষ কিস্তি) - আসাদুল্লাহ আল-গালিব (শিক্ষার্থী, ইংরেজী বিভাগ, ২য় বর্ষ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।
হতাশার দোলাচলে ঘেরা জীবন : মুক্তির পথ - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
পবিত্রতা অর্জন সম্পর্কিত বিবিধ মাসায়েল (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
আরও
আরও
.