(১) দ্বীনী ইলম প্রসঙ্গে : (ক) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, لَيْسَ الْعِلْمُ بِكَثْرَةِ الرِّوَايَةِ، إِنَّمَا الْعِلْمُ الْخَشْيَةُ ‘অধিক হাদীছ জানাই প্রকৃত জ্ঞানার্জন নয়। বরং প্রকৃত জ্ঞানার্জন হ’ল আল্লাহভীতি অর্জন করা(ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ফাওয়ায়েদ ১৪৭ পৃঃ)

(খ) জনৈক আরবী কবি বলেন,

لَو كانَ لِلعِلمِ دونَ التُقى شَرَفٌ - لَكانَ أشرَفُ خَلقِ اللهِ إبليسُ

‘যদি তাক্বওয়া বিহীন ইলমের কোন মর্যাদা থাকত,

তবে ইবলীস আল্লাহর সৃষ্টিকুলের সেরা বলে গণ্য হ’ত’।

(গ) ইবনুস সাম্মাক (রহঃ) বলেন, كَمْ مِنْ شَيْءٍ إِذَا لَمْ يَنْفَعْ لَمْ يَضُرَّ، لَكِنَّ العِلْمَ إِذَا لَمْ يَنْفَعْ ضَرَّ ‘অনেক কাজ রয়েছে যা উপকার না করলেও ক্ষতি করে না। কিন্তু দ্বীনী ইলম দ্বারা যদি (পরকালীন) উপকার না হয়, তবে তা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়’ (শামসুদ্দীন যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/৩৩০)

(ঘ) ইমাম মালেক (রহঃ) বলেন, جُنَّة العَالِمِ: لاَ أَدْرِيْ، فَإِذَا أَغفَلَهَا أُصِيْبَتْ مَقَاتِلُهُ ‘আলেমের রক্ষাকবচ হ’ল ‘আমি জানি না বলা’। যদি সে এ রক্ষাকবচ ব্যবহারে গাফেল হয়, তাহ’লে সে ধ্বংসে নিক্ষিপ্ত হবে’ (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৭/১৬৭)

(ঙ) ইমাম মালেক (রহঃ) বলতেন, الْمِرَاءُ وَالْجِدَالُ فِي الْعِلْمِ يَذْهَبُ بِنُورِ الْعِلْمِ مِنْ قَلْبِ الرَّجُلِ ‘দ্বীনী ইলমের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, মানুষের হৃদয় থেকে জ্ঞানের আলো দূরীভূত করে’। ইবনু ওয়াহহাব বলেন, ইমাম মালেক আরো বলতেন, الْمِرَاءُ فِي الْعِلْمِ يُقَسِّي الْقَلْبَ، وَيُؤَثِّرُ الضَّغْنَ  ‘দ্বীনী ইলমে ঝগড়া অন্তরকে কঠিন করে এবং বিদ্বেষ জাগিয়ে তোলে’ (জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ১/২৪৮)

(চ) ওয়াহাব বিন মুনাবিবহ (রহঃ) বলেন, المُؤْمنُ يَنْظُرُ لِيَعْلَمَ وَيَسْكُتُ لِيَسْلَمَ ويَتَكَلَّمُ لِيَفْهَمَ وَيَخْلُوْ لِيَغْنَمَ ‘মুমিন জ্ঞানার্জনের জন্য দেখে, আত্মসমর্পণের জন্য চুপ থাকে, উপলব্ধির জন্য কথা বলে ও নেকী লাভের উদ্দেশ্যে নিরিবিলি হয়’ (ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক ৬৩/৩৮৯)

(২) উপদেশ প্রদানের পদ্ধতি সম্পর্কে : (ক) ইমাম মুযানী (রহঃ) বলেন, আমি ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি তিনি বলেন,مَنْ وَعَظَ أَخَاهُ سِرًّا فَقَدْ نَصَحَهُ وَزَانَهُ، وَمَنْ وَعَظَهُ عَلاَنِيَةً فَقَدْ فَضَحَهُ وَخَانَهُ ‘যে ব্যক্তি তার ভাইকে গোপনে উপদেশ দিল, সে তাকে নছীহত করল এবং সৌন্দর্যমন্ডিত করল। আর যে প্রকাশ্যে উপদেশ দিল, সে তাকে লজ্জিত করল ও তার সাথে খেয়ানত করল’ (হিলয়াতুল আউলিয়া ৯/১৪০)

(খ) ইমাম শাফেঈ (রাঃ) বলেন,

تَعَمَّدَني بِنُصْحِكَ في انْفِرَادِي + وَجَنِّبْنِيْ النَّصِيْحَةَ فيِ الْجَمَاعَه فَإِنَّ النُّصْحَ بَيْنَ النَّاسِ نَوْعٌ + مِنَ التَّوْبِيْخِ لاَ أَرْضى اسْتِمَاعَه

وَإنْ خَالَفْتنِيْ وَعَصَيْتَ قَوْلِيْ + فَلاَ تَجْزَعْ إذَا لَمْ تُعْطَ طَاعَه

‘আপনি আমাকে উপদেশ দিন যখন আমি থাকি একাকী। আর বিরত হৌন মানুষের সামনে উপদেশ দেওয়া থেকে’। ‘কেননা মানুষের মাঝে কাউকে উপদেশ দেয়া এক প্রকার ধমক সদৃশ, যা আমি শুনতে পসন্দ করি না’। ‘যদি আপনি আমার কথার বরখেলাফ করেন এবং বিরুদ্ধাচরণ করেন, তবে আপনার উপদেশ অনুসরণ করতে না দেখলে উত্তেজিত হবেন না’। (দিওয়ানুল ইমাম শাফেঈ ১৫ পৃঃ)

(৩) আল্লাহভীরু আত্মা বিষয়ে : ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন,اُطْلُب قلبَك في ثلاثةِ مَوَاطنٍ : عندَ سماعِ القرآنِ، وفي مجالسِ الذِّكرِ، وفي أوقات الخُلْوَة، فإنْ لم تَجِدْهُ في هذه المَوَاطِن، فَسَلِ اللهَ أن يَمُنَّ عليك بِقَلْب، فإنه لا قلبَ لك ‘তুমি স্বীয় আত্মাকে তিনটি স্থানে খোঁজ কর। (১) কুরআন শ্রবণের সময় (২) যিকির-আযকারের মজলিসে এবং (৩) নিরিবিলি সময়। যদি এই তিন স্থানে আত্মাকে খুঁজে না পাও, তবে আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা কর, তিনি যেন তোমাকে আত্মা দান করেন। কেননা এরূপ অবস্থায় তোমার মাঝে কোন আত্মা নেই’ (আল-ফাওয়ায়েদ ১৪৯ পৃঃ)।

(৪) কুরআনের আয়াতের প্রভাব বিষয়ে : ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেন,آية من القرآنِ هي سَهْمٌ في قلبِ الظالم وبَلْسَمٌ على قلب المظلوم ‘কুরআনের একটি আয়াত যুলুমকারীর হৃদয়ে তীরের ন্যায় আঘাত করে এবং মাযলূমের হৃদয়ের ক্ষত উপশম করে। তাকে জিজ্ঞেস করা হ’ল, সেটা কি? তিনি বললেন, وَمَا كَانَ رَبُّكَ نَسِيًّا ‘তোমার প্রতিপালক ভুলে যান না’ (মারিয়াম ১৯/৬৪)

(৫) পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে : (ক) জা‘ফর বিন মুহাম্মাদ (রহঃ) বলেন,إِذَا بَلَغَكَ عَنْ أَخِيْكَ الشَّيْءُ تُنْكِرُهُ فَالْتَمِسْ لَهُ عُذْرًا وَاحِدًا إِلَى سَبْعِيْنَ عُذْرًا، فَإِنْ أَصَبْتَهُ وَإِلاَّ قُلْ: لَعَلَّ لَهُ عُذْرًا لاَ أَعْرِفُهُ ‘যখন তোমার ভাইয়ের পক্ষ থেকে তোমার প্রতি অপসন্দনীয় কিছু পৌঁছে, তখন এর পিছনে তার এক থেকে সত্তরটি ওযর খোঁজ কর। যদি না পাও, তবে নিজেকে বল, হয়তো তার এমন কোন ওযর রয়েছে, যা আমি জানি না’ (বায়হাক্বী, শু‘আবুল ঈমান হা/৭৯৯১)

(খ) ওমর বিন আব্দুল আযীয (রহঃ)-এর শাসনামলে জনৈক ব্যক্তি তাঁকে উপদেশ দিয়ে বলেছিল, اجْعَلْ كَبِيْرَ الْمُسْلِمِيْنَ عِنْدَكَ أَبًا، وَصَغِيْرَهُمُ ابْنًا، وَأَوْسَطُهُمْ أَخًا، فَأَيُّ أُولَئِكَ تُحِبُّ أَنْ تُسِيْءَ إِلَيْهِ؟ ‘আপনি বয়স্ক মুসলমানদেরকে পিতা, ছোটদেরকে সন্তান এবং সমবয়সীদেরকে ভাই হিসাবে গ্রহণ করুন। তাহ’লে কার সাথে আপনার মন্দ আচরণ করার ইচ্ছা হবে? (ইবনু রজব, জামেঊল উলূম ওয়াল হিকাম ২/২৮৩)

(গ) ফুযায়েল বিন আয়ায (রহঃ) বলেন, الْمُؤْمِنُ يَسْتُرُ وَيَنْصَحُ، وَالْفَاجِرُ يَهْتِكُ وَيُعَيِّرُ ‘মুমিন সেই যে (অপর মুসলিমের) দোষ গোপন রাখে এবং তাকে নছীহত করে। আর পাপী সেই যে অন্যের মানহানি করে এবং লজ্জিত করে’ (জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ১/২২৫)

(৬) অনর্থক কাজ সম্পর্কে : হাসান বছরী (রহঃ) বলেন,مِنْ عَلاَمَةِ إِعْرَاضِ اللهِ تَعَالَى، عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَجْعَلَ شُغْلَهُ فِيمَا لاَ يَعْنِيْهِ ‘কোন বান্দা থেকে আল্লাহর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার আলামত হ’ল তাকে অনর্থক কাজে ব্যস্ত করে দেওয়া’ (জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম ১/২৯৪)

(৭) কয়েকটি বিষয়ের মূল লক্ষ্য ও ফলাফল সম্পর্কে : আছমাঈ বলেন, আমি ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি,أَصْلُ العلمِ التَّثَبُّتُ وثَمَرَتُه السلاَمةُ، وأَصلُ الوَرع القَنَاعةُ وثَمَرتُه الراحَةُ، وأَصلُ الصَّبْرِ الحَزْمُ وثَمَرتُه الظَّفْرُ، وأَصلُ العَملِ التَّوفِيْقُ وثَمَرتُهُ النَّجَحُ، وَغَايَةُ كُلِّ أَمْرٍ الصِّدْقُ- ‘জ্ঞানার্জনের মূল বিষয় হ’ল নিশ্চিত হওয়া এবং তার ফলাফল হ’ল নিরাপত্তা। পরহেযগারিতার মূল বিষয় হ’ল অল্পে তুষ্ট হওয়া এবং তার ফলাফল হ’ল প্রশান্তি। ছবরের মূল বিষয় দৃঢ়তা এবং তার ফলাফল হ’ল বিজয়। সৎ আমলের মূল বিষয় সক্ষমতা এবং তার ফলাফল হ’ল সফলতা। আর সব কিছুর মূল লক্ষ্য হ’ল সত্যবাদিতা’ (ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক ৫১/৪০৮)

(৮) সৎকর্ম বিষয়ে : (ক) আব্দুল্লাহ বিন মুবারক (রহঃ) বলেন, رُبَّ عَمَلٍ صَغِيرٍ تُعَظِّمُهُ النِّيَّةُ، وَرُبَّ عَمَلٍ كَبِيرٍ تُصَغِّرُهُ النِّيَّةُ ‘অনেক তুচ্ছ আমল রয়েছে, যা সৎ নিয়তের কারণে (নেকী লাভের দিক দিয়ে) বৃহদাকৃতি ধারণ করে। আবার অনেক বড় বড় আমল রয়েছে যা নিয়তের কারণে তুচ্ছ বিষয়ে পরিণত হয়’ (জামেঊল উলূম ওয়াল হিকাম ১/৭১)

(খ) বিশর বিন হারেছ (রহঃ) বলেন, يَا أَصْحَابَ الْحَدِيثِ أَدُّوا زَكَاةَ الْحَدِيثِ হে আহলেহাদীছগণ! তোমরা হাদীছের যাকাত আদায় কর। তাকে বলা হ’ল, কিভাবে আমরা তা আদায় করব? তিনি বললেন, اعْمَلُوا مِنْ كُلِّ مِائَتَيْ حَدِيْثٍ سَمِعْتُمُوْهَا بِخَمْسَةِ أَحَادِيْثَ ‘তোমরা যে সমস্ত হাদীছ শ্রবণ করেছ তার প্রতি দু’শ হাদীছের মধ্যে অন্ততঃ পাঁচটি হাদীছের উপর আমল কর’ (খলীল ক্বাযভীনী, আল-ইরশাদ ফী মা‘রেফাতে ওলামাইল হাদীছ ৩/৮৬৭)

(৯) সর্বদা আল্লাহকে স্মরণ করা প্রসঙ্গে : ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেন, আমি ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-কে বলতে শুনেছি,الذِّكْر لِلْقَلْبِ مثلُ المَاء لِلسَّمَكِ فَكَيْفَ يَكُوْنُ حَالُ السَّمَكِ إِذَا فَارَقَ الماءَ؟ ‘সর্বদা আল্লাহ্কে স্মরণ করা আত্মার জন্য সেরূপ, মাছের জন্য পানি যেরূপ। মাছ যখন পানি থেকে পৃথক হয় তখন তার অবস্থা কিরূপ হয়? (ইবনুল ক্বাইয়িম, আল-ওয়াবেলুছ ছাইয়িব ৪২ পৃঃ)

(১০) হাদীছের গুরুত্ব প্রসঙ্গে : ইমাম মালেক বিন আনাস (রহঃ) বলেন, السنَّةُ سَفِيْنَةُ نُوْحٍ مَنْ رَكِبَهَا نَجَا وَمن تَخَلَّفَ عَنْهَا غَرِقَ ‘সুন্নাহ বা হাদীছ নূহ (আঃ)-এর কিশতীর ন্যায়। যে ব্যক্তি তাতে আরোহণ করবে সে নাজাত পাবে। আর যে ব্যক্তি তা থেকে দূরে থাকবে সে (অজ্ঞতার অাঁধারে) ডুবে থাকবে’ (সৈয়ূতী, মিফতাহুল জান্নাহ ৭৬ পৃঃ)

সংকলন : আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব

এম.ফিল গবেষক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।






আরও
আরও
.