ছিদ্দীক হাসান খান কানূজী ‘আবজাদুল উলূম’ গ্রন্থে বলেন, শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হ’ল-

প্রথমতঃ

শিক্ষার্থীদের উপর দয়া প্রদর্শন করা। শিক্ষক তাদেরকে নিজের সন্তানের মত পরিচালনা করবেন। এজন্য পিতামাতার অধিকার অপেক্ষা শিক্ষকের অধিকার অনেক বড়। যদি শিক্ষক না থাকত, তাহ’লে শিক্ষার্থী পিতার নিকট থেকে যা শিখেছে অবশ্যই তা স্থায়ী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হ’ত। আর নিশ্চয়ই শিক্ষক পরকালীন স্থায়ী জীবনের জন্য উপকারী যেমনিভাবে পিতা ধ্বংসশীল দুনিয়াবী জীবনে আগমনের একমাত্র মাধ্যম।

দ্বিতীয়তঃ

শিক্ষকের উচিত শরী‘আত প্রবর্তকের [মুহাম্মাদ (ছাঃ)] অনুসরণ করা। সুতরাং তিনি জ্ঞান বিতরণের বিনিময়ে কোন প্রতিদান চাইবেন না এবং কোন পুরষ্কার ও কৃতজ্ঞতা কামনা করবেন না। বরং তিনি আল­াহ তা‘আলার সন্তুষ্টির জন্য এবং তাঁর নৈকট্য কামনায় শিক্ষা দান করবেন। শিক্ষা দেয়াকে নিজের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীর প্রতি কোনরূপ করুণা ভাববেন না, যদিও তাদের জন্য করুণা আবশ্যক। বরং তিনি এটাকে তাদের জন্য মর্যাদাপূর্ণ মনে করবেন। আর শিক্ষার্থীর শিক্ষা গ্রহণের চেয়ে শিক্ষকের শিক্ষা দেওয়ার ছওয়াব আল­াহর নিকটে অনেক বেশী। শিক্ষা নেওয়ার প্রক্রিয়া না থাকলে এ ছওয়াব অর্জিত হ’ত না। তাই তিনি (শিক্ষক) যেন এর প্রতিদান আল­াহ ছাড়া অন্য কারো কাছে কামনা না করেন।

তৃতীয়তঃ

শিক্ষার্থীকে সামান্য কোন বিষয়ে উপদেশ দিতেও ছাড়বেন না। আর এটা শিক্ষার্থীকে কোন বিষয়ে যোগ্য হওয়ার পূর্বে সে পদ গ্রহণের চ্যালেঞ্জ নেয়া থেকে বিরত রাখবে এবং প্রকাশ্য জ্ঞানার্জন থেকে অবসর হওয়ার পূর্বে অস্পষ্ট জ্ঞানার্জনে ব্যস্ত হওয়া থেকে বিরত রাখবে।

অতঃপর তাকে সতর্ক করবে যে, কোন প্রকার নেতৃত্ব, গৌরব ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই কেবল আল­াহর নৈকট্য লাভে জ্ঞান অর্জন করতে হবে এবং নিজ থেকেই সাধ্যমত এগুলোর মন্দ দিক পেশ করবেন। আর পাপাচারী আলেম যতটা না কল্যাণকর কাজ করেন তদপেক্ষা ক্ষতিকর কাজ অধিক করেন।

যদি শিক্ষক গোপন উদ্দেশ্য জানতে পারেন যে, শিক্ষার্থী শুধু দুনিয়ার জন্যই জ্ঞানার্জন করছে, তাহ’লে তার (শিক্ষার্থীর) কাঙ্ক্ষিত জ্ঞানের প্রতি লক্ষ্য করবে, যদি তা ইলমে ফিক্হে মতভেদ, ইলমে কালামে কূটতর্ক, মুকদ্দমা ও আহকামের ক্ষেত্রে ফৎওয়াবাজি হয়, তবে তা থেকে তাকে বিরত রাখবেন। কেননা এগুলো আখেরাতের জ্ঞান নয়। আর ঐ জ্ঞানেরও অন্তর্ভুক্ত নয়, যার কথা নিম্নোক্ত হাদীছে বলা হয়েছে, ‘আমরা গায়রুল­াহর জন্য জ্ঞানার্জন করলাম, কিন্তু জ্ঞান আল­াহ ছাড়া অন্যের জন্য হ’তে অস্বীকৃতি জানায়’। আর এ জ্ঞান হ’ল ইলমুত তাফসীর, ইলমুল হাদীছ এবং পূর্ববর্তীগণ পরকাল বিষয়ক, ব্যক্তি চরিত্র বিষয়ক ও তা বিন্যস্তকরণের পদ্ধতি বিষয়ক যে জ্ঞানচর্চায় ব্যস্ত থাকতেন।

চতুর্থতঃ

শিক্ষা দান একটি সূক্ষ্ম শিল্পকর্ম হিসাবে এর বৈশিষ্ট্যগুলো হ’ল, তিনি শিক্ষার্থীকে মন্দ চরিত্র থেকে নিবৃত্ত করবেন যথাসম্ভব সুন্দরভাবে তা উপস্থাপনের মাধ্যমে, ধমকের মাধ্যমে নয়; অনুগ্রহমূলক পদ্ধতিতে, তিরষ্কারের মাধ্যমে নয়। কেননা ধমক শ্রদ্ধা-ভক্তির আবরণ নষ্ট করে দেয়, বিপরীতে প্রতিবাদ বা হামলার দুঃসাহস সৃষ্টি করে এবং যিদ গ্রহণে প্ররোচিত করে।

পঞ্চমতঃ

কতিপয় জ্ঞানের শিক্ষাদাতাগণ যেন অন্যান্য জ্ঞানসমূহকে শিক্ষার্থীর নিকট মন্দ বলে উপস্থাপন না করে। যেমন ভাষার শিক্ষকের অভ্যাস হচ্ছে ফিক্হের জ্ঞানকে মন্দ বিবেচনা করা। আর ফিকহের শিক্ষকের স্বভাব হ’ল ইলমে হাদীছ ও তাফসীরের জ্ঞানকে মন্দ বিবেচনা করা। এটাই নির্ভেজাল বর্ণনা এবং প্রকৃত প্রচলন। এটা হ’ল অক্ষমদের অবস্থা। সে এ ব্যাপারে বিবেক খাটায় না। আর ইলমে কালামের শিক্ষক ফিকহ থেকে দূরে থাকেন এবং বলেন এটা শাখা-প্রশাখা। এটা নারীদের হায়েয বিষয়ক কথা। সুতরাং রহমানের বিশেষণ বর্ণনায় ইলমে কালামের তুলনায় এর অবস্থানই বা কোথায়? এগুলো শিক্ষকদের জন্য নিন্দিত চরিত্র। তার উচিত এগুলো পরিহার করা।

ষষ্ঠতঃ

শিক্ষার্থীর বুঝ অনুপাতে তিনি (বিষয়কে) সংক্ষিপ্ত করবেন। তার নিকট এমন কিছু পেশ করবেন না, যা তার মেধায় পৌঁছতে পারে না। ফলে সে ভীত হবে অথবা তার মেধা বিষয়টিতে কষ্ট অনুভব করবে। যেমন বলা হয়, ‘মানুষের সাথে কথা বল তাদের বুদ্ধি অনুপাতে’। আলী (রাঃ) তাঁর বক্ষের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘নিশ্চয়ই এখানে পুঞ্জীভূত জ্ঞানবিজ্ঞান রয়েছে, যদি তা আমি বহন করতে পারি’।

সপ্তমতঃ

নিশ্চয়ই ছোট/শিশু শিক্ষার্থীর নিকট স্পষ্টভাবে তার উপযোগী করে পেশ করতে হবে এবং তাকে এটা বলবে না যে, এর পিছনে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিষয় রয়েছে। কেননা এটা তার বড় বিষয় শেখার আগ্রহকে দুর্বল করে দিবে, তার অন্তরে বিরক্তি সৃষ্টি করবে এবং বিষয়টি সম্পর্কে বিভ্রান্তিতে নিপতিত হবে। ফলে প্রত্যেকেই ভাবতে থাকবে, সে সকল সূক্ষ্ম জ্ঞানের অধিকারী। আর সকলেই তার মেধার পূর্ণতার ক্ষেত্রে আল­াহর উপর খুশী থাকবে। সে ব্যক্তিই সবচেয়ে বড় নির্বোধ ও মেধায় দুর্বল, যে তার মেধার পূর্ণতার ব্যাপারে অধিক খুশি।

অষ্টমতঃ

শিক্ষক তার ইলম অনুসারে আমলকারী হবেন। তার কথা যেন তার কর্মকে মিথ্যায় পরিণত না করে। কেননা ইলম অর্জিত হয় দূরদর্শিতার মাধ্যমে আর আমল অর্জিত হয় অন্তর্দৃষ্টির মাধ্যমে। আর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লোকের সংখ্যা অধিক। যখন আমল ইলমের বিপরীত হয়, তখন সঠিক পথ থেকে সে বঞ্চিত হয় (ছিদ্দীক হাসান কানূজী, আবজাদুল ঊলূম, বৈরূত: দারু ইবনু হাযম, ১ম প্রকাশ ২০০২, ৭৫-৭৭ পৃ.)







বিষয়সমূহ: নীতি-নৈতিকতা
আরও
আরও
.