সংগঠনের
ইতিহাসে এমন কিছু ঘটনাবহুল দিন ও সময় থাকে যা কখনো স্মৃতির পাতা থেকে
হারিয়ে যায় না। দুঃখ ও বেদনাভরা ঐ সময়গুলো বারবার মনোজগতকে বেদনাবিধুর করে
তোলে। অতীত স্মৃতি রোমন্থনে শিউরে ওঠে সমস্ত শরীর। অবিশ্বাস্য মনে হয় ঘটে
যাওয়া সে সব ইতিহাস। যার অন্যতম হ’ল ২০০৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী দিবাগত রাতের
লোমহর্ষক ঘটনা। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের শান্তিপ্রিয় দ্বীনী সংগঠনের উপর
ন্যাক্কারজনক রাষ্ট্রীয় হামলা। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম
আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব সহ ‘আন্দোলন’ ও
‘যুবসংঘে’র চারজন শীর্ষ নেতাকে বিনা মামলায় বিনা ওয়ারেন্টে সন্দেহজনক ৫৪
ধারায় গ্রেফতার করার অপ্রত্যাশিত অনাকাঙ্খিত ও অনভিপ্রেত সেই ঘটনা। যা কিনা
শুধু আহলেহাদীছ আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের নয়, গোটা মুসলিম উম্মাহকে করেছিল
বাকরুদ্ধ। বিশ্ব বিবেককে করেছিল স্তম্ভিত। একটি ঘোর অমানিশা যেন হিমাদ্রিসম
বিপদ-মুছীবত নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল নির্ভেজাল ও নিষ্কলংক এই দ্বীনী সংগঠনের
উপরে। যা চলতে থাকে দিন থেকে মাস অতঃপর বছরের পর বছর। গীবত-তোহমত,
মামলা-হামলা, বাধা-বিপত্তি সব হায়েনার ন্যায় আক্রমণাত্মকভাবে এগিয়ে আসে।
গলাটিপে হত্যা করতে চায় তাওহীদ ভিত্তিক সমাজ গঠনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নির্ভেজাল
এই সংগঠনের গতিধারাকে। অতঃপর ব্যর্থ হয়ে আদর্শচ্যুত করার মিশন নিয়ে মাঠে
নামে কুচক্রীরা। তাতেও ব্যর্থ হয়ে বিভক্তির অস্ত্র প্রয়োগে সাময়িক
প্রশান্তি লাভ করলেও ব্যর্থতার গ্লানিই হয় তাদের শেষ প্রতিফল। যা এখন
দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট।
পক্ষান্তরে যাবজ্জীবন কারাদন্ড অথবা ফাঁসির হুমকি থাকা সত্ত্বেও মুহতারাম আমীরে জামা‘আত মহান আল্লাহর অপার অনুগ্রহে স্বার্থশিকারীদের সকল ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রথমে ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পর যামিনে কারামুক্ত হন। অতঃপর দীর্ঘ ৮ বছর ৮ মাস ২৮ দিন পর গত ২০ নভেম্বর’১৩ তারিখে সর্বশেষ মামলার রায়ে বেকসুর খালাস পেয়ে সকল মিথ্যা মামলা থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। ফালিল্লা-হিল হাম্দ। আলোচ্য নিবন্ধে ঘটনাবহুল দীর্ঘ পৌনে নয় বছরের উল্লেখযোগ্য কিছু স্মৃতিকথা পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপনের প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
পূর্বকথা : সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের খারেজী আক্বীদাপুষ্ট নবোদ্ভূত একটি দলের সংবাদ ১৯৯৮ সাল থেকেই শোনা যাচ্ছিল। ফলে তখন থেকেই এই ভ্রান্ত আক্বীদার বিরুদ্ধে বক্তব্য ও লেখনী জনসমক্ষে তুলে ধরা হয় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে। উদ্দেশ্য ছিল, তথাকথিত জিহাদের লোভনীয় টোপে পড়ে সরলপ্রাণ তরুণরা যেন বিভ্রান্ত না হয়। বিশেষ করে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ও ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র কোন কর্মী যেন বিভ্রান্তিতে পড়ে পথচ্যুত না হন। বলা চলে যে, দেশে একমাত্র এই সংগঠনই উক্ত বিষয়ে অত্যন্ত সাহসিকতার সাথে প্রকাশ্যে বক্তব্য-বিবৃতি ও লেখনী অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৯৮ সালের ২৫ মে সাতক্ষীরার চিলড্রেন্স পার্কে প্রদত্ত আমীরে জামা‘আতের ভাষণ, ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী ও ২০০৩ সালের ১৪ মার্চ রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় তাবলীগী ইজতেমায় প্রদত্ত ভাষণ, একই বছরের ২৫ মে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ কর্তৃক আয়োজিত দ্বি-বার্ষিক কর্মী সম্মেলনে প্রদত্ত ভাষণ এবং নওদাপাড়ার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ৫ নভেম্বর ২০০৪ ও গ্রেফতারের ৪ দিন পূর্বে ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০০৫ তারিখে প্রদত্ত জুম‘আর খুৎবা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। তাছাড়া ১৩.০৮.২০০০ তারিখে ৬৬/১-৩৮/২০০০ নং স্মারকে ও ০৯.১১.২০০১ তারিখে ২২৩(২)/২০০১ নং স্মারকে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র সকল স্তরের কর্মীদের উদ্দেশ্যে প্রেরিত কেন্দ্রীয় বিজ্ঞপ্তি এবং সংগঠনের মুখপত্র মাসিক ‘আত-তাহরীক’-এর ২০০০ সালের আগষ্ট সংখ্যার ৫৫ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ২৪/৩২৪ নং প্রশ্নোত্তরটি আরও জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে যে, এই সংগঠন জঙ্গীবাদ সহ যেকোন নেতিবাচক আন্দোলনের ঘোর বিরোধী।
এরি মধ্যে এসে যায় ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারী মাস। এ মাসের মাঝামাঝি সময়ে দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ধৃত জঙ্গীদের কথিত স্বীকারোক্তির বরাতে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের নাম পরিকল্পিতভাবে শিরোনামে আনা হয়। নাটোরে ধৃত ফরমান আলী ও বগুড়ায় ধৃত শফীকুল্লাহ স্ব স্ব জবানবন্দীতে নাকি তাদের নেতা হিসাবে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের নাম বলেছে। নীলনকশা অনুযায়ী যে সবকিছু হচ্ছে তা প্রথমে আমরা বুঝতে পারিনি। ফলে বারংবার চেষ্টায়ও সূত্র মিলাতে পারছিলাম না। এরকম জঘন্য মিথ্যাচার কিভাবে হ’তে পারে? আমরা সার্বক্ষণিক যাঁর সাথী এবং নির্দেশ পালনকারী, তাঁকে কোথাকার কোন ফরমান আলী ও শফীকুল্লাহর নেতা ও আদেশ দাতা হিসাবে চিত্রিত করার এ ন্যাক্কারজনক অপপ্রয়াস কেন? তিনি তো জঙ্গীবাদের নির্দেশ দিলে সর্বাগ্রে আমাদেরকেই দিবেন, এ রকম অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল মনের গহীনে। অবশেষে জাতির সামনে আমাদের অবস্থান স্পষ্ট করার জন্য ১৭ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার রাজশাহী মহানগরীর ‘স্বপ্নিল কমিউনিটি সেন্টারে’ সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। প্রায় সকল প্রেস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকগণ সেখানে উপস্থিত হন। সকাল ১০টায় শুরু হয় সাংবাদিক সম্মেলন। আমীরে জামা‘আত লিখিত বক্তব্য পাঠ শেষে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন। কিন্তু দেখা গেল যে, পরদিন প্রায় সকল পত্রিকায় আমীরে জামা‘আতের বক্তব্য বিকৃত করে রিপোর্ট প্রকাশিত হ’ল। এতে আমাদের কাছে পরিষ্কার হ’ল যে, সবকিছুই পূর্বপরিকল্পিত। অদৃশ্য ইঙ্গিতেই ঘটছে সবকিছু। পরদিন শুক্রবার। কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে জুম‘আর খুৎবায় আমীরে জামা‘আত দুঃখ-ভারাক্রান্ত মনে আবেগময় ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ খুৎবা প্রদান করেন।
يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنْ جَاءَكُمْ فَاسِقٌ بِنَبَإٍ فَتَبَيَّنُوا أَنْ تُصِيبُوا قَوْمًا بِجَهَالَةٍ فَتُصْبِحُوا عَلَى مَا فَعَلْتُمْ نَادِمِينَ ‘হে ঈমানদারগণ! যদি কোন পাপাচারী তোমাদের নিকটে কোন সংবাদ নিয়ে আসে, তবে তোমরা তা যাচাই করে দেখ, যেন অজ্ঞতাবশে কোন সম্প্রদায়কে তোমরা ক্ষতিগ্রস্ত না কর এবং তোমাদের কৃতকর্মের জন্য তোমাদের অনুতপ্ত হ’তে না হয়’ (হুজুরাত ৪৯/৬) এই আয়াতকে কেন্দ্র করে তিনি খুৎবা শুরু করেছিলেন এবং শেষ পর্যায়ে মিথ্যাবাদী সাংবাদিক ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকদের উদ্দেশ্যে উষ্মা প্রকাশ করেন। তিনি সাংবাদিক সম্মেলনে প্রদত্ত বক্তব্য বিকৃত করে প্রকাশের তীব্র নিন্দা জানান এবং তাদেরকে আল্লাহর আদালতে সোপর্দ করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে বলেন, ‘হে সাংবাদিক! তোমাকেও মরতে হবে। কবর তোমাকেও ডাকছে। আল্লাহপাকের কাছে তোমাকেও কৈফিয়ত দিতে হবে। অতএব সাবধান! তোমার জিহবা আল্লাহর দেওয়া দান। তোমার লেখনীর ক্ষমতা আল্লাহর দেওয়া দান। আল্লাহর দেওয়া অনুগ্রহকে, আল্লাহর দেওয়া এই দানকে অশ্রদ্ধা করলে তোমাকেও পুরামাত্রায় তার শাস্তি ভোগ করতে হবে। যে কথা আমি বলেছি তা লিখিত আছে, রেকর্ড করা আছে। তার বাইরে তুমি লিখলে কেন? আল্লাহ পাকের কাছে বিচার দিলাম। একদিন দেখা হবে ক্বিয়ামতের মাঠে। এই মিথ্যাচারিতার বিচার সেদিন হবে’।
আমীরে জামা‘আতের সেদিনের জুম‘আর খুৎবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠ এখনো আমাদের হৃদয়তন্ত্রীতে ঝংকার তুলে। হৃদয়ের গভীর থেকে প্রচন্ড কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে খুৎবার শেষাংশে দৃঢ়চিত্তে তিনি বলেছিলেন, ‘হে মিথ্যাবাদী সাংাদিকেরা, হে মিথ্যাবাদী সরকারী লোকেরা, হে মিথ্যাবাদী গোয়েন্দার লোকেরা! তোমাকে ও আমাকে একদিন মাটির তলে দাফন হয়ে যেতে হবে। সেখানে আমরা একাকার হয়ে যাব, একই সঙ্গে একই সৃষ্টিকর্তার সামনে জওয়াবদিহী করতে হবে। মিথ্যা থেকে দূরে থাক, সত্য বলার অভ্যাস কর’ (ধারণকৃত অডিও টেপ থেকে)। তাঁর এই দৃঢ় বক্তব্যই তাঁর নিষ্কলুষতার প্রমাণ বহন করে।
এরপরেই তিনি ‘মিথ্যাচার ও সাংবাদিকতা’ শিরোনামে হলুদ সাংবাদিকতার মুখোশ উন্মোচন করে কঠোর ভাষায় আত-তাহরীক মার্চ’২০০৫-এর সম্পাদকীয় লেখেন। এটাই ছিল জেলে যাওয়ার আগে তাঁর লেখা সর্বশেষ সম্পাদকীয়।
উল্লেখ্য যে, সাংবাদিক সম্মেলনের দু’দিন আগে নাটোরের ফরমান আলীর রিপোর্টের পর আমীরে জামা‘আতের বক্তব্য নেওয়ার জন্য একটি ইংরেজী ও একটি বাংলা জাতীয় দৈনিকের স্থানীয় সাংবাদিকরা নওদাপাড়া মারকাযে আসেন। আমীরে জামা‘আত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিরে মারকায চত্বরে পা দিয়েছেন মাত্র। ওরাও এসে হাযির। তিনি সাক্ষাৎকার দিতে অস্বীকৃতি জানালেও তাদের অনুরোধে শেষতক রাযী হ’লেন। বসলেন আত-তাহরীক কার্যালয়ের আমার কক্ষে। ইন্টারভিউ শেষে ওরা একটা ছবি উঠিয়ে নিয়েছিল। সেই ছবিটিই পরবর্তীতে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বারবার ছাপা হয়েছে। কিন্তু এখানেও হয়েছে চরম বিকৃতি। কেননা এরা এসেছিলই নেতিবাচক মনোভাব নিয়ে। ফলে রিপোর্টও করেছিল নেতিবাচক ভঙ্গিতে। সাংবাদিকদের এহেন কর্মকান্ডে সাংবাদিক সততা যেমন প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, তেমনি মযলূম আলেম-ওলামা কর্তৃক এরা অভিশপ্ত হয়েছে। যার ফলে পরবর্তীতে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে ঐ সাংবাদিকেরা বিভিন্ন ভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্থ হয়েছে।
২২ ফেব্রুয়ারীর ঘটনা : দু’দিন পরই ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর ১৫ তম বার্ষিক কেন্দ্রীয় তাবলীগী ইজতেমা। সকল প্রস্ত্ততি সম্পন্ন প্রায়। মূল প্যান্ডেল সহ অন্যান্য কাজও শেষ পর্যায়ে। এবারের ইজতেমা একটু ব্যতিক্রমধর্মী হবে এটিই ছিল স্বাভাবিক। কেননা আমীরে জামা‘আতকে ঘিরে পত্র-পত্রিকায় মিথ্যা প্রপাগান্ডার কারণে সারা দেশের নেতা-কর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ধূমায়িত হয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল ইজতেমার দ্বিতীয় দিন সকালে সমবেত হাযার হাযার মুছল্লী বিশাল মিছিল নিয়ে গোটা রাজশাহী শহর প্রদক্ষিণের মাধ্যমে দেশবাসীকে সুস্পষ্টভাবে সংগঠনের অবস্থান জানিয়ে দেওয়া এবং সেই সাথে হলুদ সাংবাদিকতা ও মিথ্যা গোয়েন্দা রিপোর্টের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো। সে লক্ষ্যে ফেস্টুন, ব্যানার, বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড তৈরীও প্রায় সম্পন্ন। কিন্তু হঠাৎ করে দেখা গেল যে, মারকায চত্বরে নতুন লোকের আনাগোনা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের সরল মনের সহজ চিন্তা ছিল যেহেতু আমীরে জামা‘আতকে ঘিরে পত্র-পত্রিকায় কিছু বিভ্রান্তিকর রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, সেকারণ এবারের ইজতেমার গুরুত্বও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেকারণেই অচেনা লোকজনের আনাগোনা বৃদ্ধি পেতে পারে। অবশেষে ঘটনার দিন সন্ধ্যার দিকে বুঝতে পারলাম যে, অচেনা ঐ মুখগুলো সরকারী বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য। ধরা দিলেন মাগরিবের ছালাতের পরে। আমার অফিস কক্ষে এসে বসলেন ও নিজেদের পরিচয় দিলেন। সুন্দর বচনে আমাদের জানালেন, ডঃ গালিব স্যারকে নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখির কারণে ওনার যেন নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় সেজন্য আমরা খোঁজ-খবর নিতে এসেছি। আপনারা কোন সমস্যা অনুভব করলে আমাদেরকে জানাবেন। এ সময় ইজতেমার প্রস্ত্ততি সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় জানতে চাইলেন। আমরাও সরল মনে সবকিছুই বললাম। আমরা তাদের চা-নাশতার ব্যবস্থা করলাম। এভাবে দু’তিন দফায় একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার অন্তত ১০/১৫ জন বিভিন্ন পদের কর্মকর্তার সাথে কথা হলো। আমাদের ধারণা এটাই ছিল যে, পত্র-পত্রিকায় আমীরে জামা‘আতকে নিয়ে লেখালেখির কারণে সরকার এবার বিশেষ নযর দিয়েছে। তাবলীগী ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের জন্য গোয়েন্দা সংস্থার লোকদেরকে অধিক পরিমাণে পাঠানো হয়েছে। এটা আমাদের জন্য ভাল। এরূপ পজেটিভ চিন্তা ও মানসিক প্রশান্তি নিয়ে রাত প্রায় ১১-টার দিকে বাসায় ফিরে গেলাম। তখনো ঘূর্ণাক্ষরেও ভাবিনি যে, বাহ্যিক এই খোলসের অন্তরালে ওঁৎ পেতে আছে মানবরূপী হায়েনারা। চিন্তা আসবেই বা কেন? আমরা তো অপরাধী নই। আমরা তো সর্বদা ইতিবাচক আন্দোলন করি। মানুষকে আখেরাতের দিকে ডাকি। সমাজ সংশোধনের জন্য সার্বিকভাবে চেষ্টা করি মাত্র।
অতঃপর ভোর প্রায় চারটার দিকে ঘুম ভাঙ্গল যুবসংঘের তৎকালীন দফতর সম্পাদক মুযাফফর বিন মুহসিনের ফোন পেয়ে। মুযাফফর ভয়ার্ত কণ্ঠে জানাল- ‘পরিস্থিতি খুবই ঘোলাটে। যৌথ বাহিনী (র্যাব ও পুলিশ) গোটা মারকাযকে ঘিরে রেখেছে। আমীরে জামা‘আত, সালাফী ওস্তাদযী, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ও আযীযুল্লাহ ভাইকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেছে’। এই সংবাদ শুনে যেন মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। দু’দিন পরে ইজতেমা। আর আজ এ কি মর্মান্তিক সংবাদ! অপ্রস্ত্তত অবস্থায় লোমহর্ষক এই সংবাদ শুনে সমস্ত শরীরটা যেন হিমশীতল হয়ে গেল। পদযুগল যেন একত্রিত হয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে আমার প্রতিবেশী ও সহকর্মী জনাব শামসুল আলম ভাইকে ফোন করলাম এবং মসজিদে আসতে বললাম। আরও অনেককে জানালাম। ফজরের আযান হ’ল। ওযূ করে মসজিদে গেলাম। বাসার পাশেই ওয়াক্তিয়া মসজিদ। ফজরের ছালাত শেষে জানতে পারলাম যে, আমাদের অন্যতম প্রতিবেশী ও মারকাযের শিক্ষক জনাব আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ছাহেবের বাসায়ও যৌথ বাহিনী হানা দিয়েছিল। তন্ন তন্ন করে সারা বাসা খুঁজেছে। ভাগ্যগুণে তিনি রক্ষা পেয়েছেন। রাজশাহী যেলার তাহেরপুরে জালসা শেষ করে আসতে বিলম্ব হওয়ায় বেঁচে গেলেন। র্যাব-পুলিশ ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পরপরই তিনি বাসায় পৌঁছেন। তাঁর নিকট হ’তে এই বিবরণ শুনে আরও শঙ্কিত হয়ে পড়লাম। ভেবে নিলাম সরকারের টার্গেট হয়ত পূরণ হয়নি। আমাদের যে কাউকে যেকোন সময়ে গ্রেফতার করতে পারে। তাৎক্ষণিক পরামর্শ করে আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ছাহেবকে তখুনি বাসা ত্যাগ করতে বললাম। পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সময়ক্ষেপণ না করে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। অতঃপর আমরা কেউ থানায় ও কেউ কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এদিকে মারকাযের পরিস্থিতি চরম ভীতিকর। শত শত র্যাব ও পুলিশ মারকাযকে ঘিরে রেখেছে। অস্ত্র তাক করে মহড়া দিচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন বীর সৈনিকেরা রণাঙ্গনে কোন শক্তিশালী বাহিনীকে মোকাবেলা করার জন্য প্রস্ত্তত হয়ে আছে। দৃশ্য দেখলে যে কারও পিলে চমকে যাবে। এলাকাবাসীও হতবাক। হচ্ছেটা কি? যারা এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান। ইসলাম ও দেশ-মাতৃকার পক্ষে যাদের কথা, কলম ও সংগঠন, তাদেরকে নিয়ে সরকার কি খেলা শুরু করেছে?
যেভাবে গ্রেফতার করা হয় : ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল ইসলাম ছাহেবের ভাষ্য অনুযায়ী- তখন রাত প্রায় ১-টা ২০ মিনিট। তিনি দারুল ইমারতে আমীরে জামা‘আতের কক্ষে বসে ইজতেমার বক্তব্য ঠিক করছেন। রুমের দরজা ও বারান্দার লোহার গেইট খোলা। সন্ধ্যার কিছু পর থেকেই গেইটে পুলিশ পাহারারত আছে। গেইট বন্ধ করতে গেলে পুলিশ বলছে, আমরা তো আছি, গেইট বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। ফলে সে রাতে আর গেইট বন্ধ হয়নি। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভাই মেহেরপুরের গাংণী ডিগ্রী কলেজের ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষক। ইজতেমার জন্যই একদিন আগে এসেছেন। রাত ৮-টার দিকে যখন তিনি নওদাপাড়া পৌঁছেন তখন মেইন গেইটে ১০-১২ জন পুলিশের অবস্থান প্রত্যক্ষ করেন এবং মনে মনে আশঙ্কাবোধ করেন। ঢোকার সময়ই পুলিশ তাঁর পরিচয় জেনে নেয় যে, তিনি ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল।
যাই হোক গভীর রাতের নীরব পরিবেশে নিবিষ্ট মনে তিনি বসে বসে লিখছেন। এমন সময় দুই জন পুলিশ পর্দা ফাঁক করে তাকে দেখে গেল। তিনি সন্দেহে পড়ে গেলেন। এত রাতে কেন পুলিশ রুমে উঁকি মেরে গেল? এর কিছুক্ষণ পরই ১০-১২ জন পুলিশের একটি বহর বাইরের গেইট মাড়িয়ে ভিতরে প্রবেশ করল। গভীর রাতে এত পুলিশ দেখে তিনি ভীত-বিহবল হয়ে পড়লেন। তাদের মধ্য থেকে একজন পুলিশ অফিসার জিজ্ঞেস করলেন, স্যার কোথায়? তিনি বললেন, উপরে বাসায়। পুলিশ অফিসার বললেন, আপনাদের ইজতেমার পারমিশন নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। স্যারকে ডিসি ছাহেব ডেকেছেন। অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভাই বললেন, এত রাতে না গিয়ে সকালে গেলে হয় না। ওনারা বললেন, না এখনি যেতে হবে। অতঃপর তিনি শঙ্কিত হৃদয়ে ধীর পদে দোতলায় গিয়ে কলিং বেল টিপলেন। তার পিছনে পিছনে দু’জন পুলিশ অফিসারও উপরে ওঠে গেলেন। স্যার দরজা খুলতেই একজন পুলিশ অফিসার সালাম দিয়ে বললেন, স্যার আপনাদের ইজতেমা নিয়ে একটু সমস্যা হয়েছে। এজন্য ডিসি স্যার আপনাকে ডেকেছেন। আমীরে জামা‘আত তখন বললেন, এত রাতে কেন সকালে কথা বলি। সাথের পুলিশ অফিসারটি তখন আমীরে জামা‘আতকে সালাম দিয়ে বললেন, ‘স্যার আমাদের কিছুই করার নেই। সবই উপরের নির্দেশ’। আমীরে জামা‘আতের আর কিছুই বুঝতে বাকী রইল না। তিনি বললেন, ঠিক আছে একটু থামুন আসছি। বলেই তিনি ভিতরে গিয়ে ৮-১০ মিনিটের মধ্যেই ওযূ সেরে ঘুমন্ত স্ত্রী-সন্তানদের কাউকে না জাগিয়ে মহান আল্লাহর উপর সর্বোচ্চ তাওয়াক্কুল করে নির্দ্বিধায় স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে এলেন।
আমীরে জামা‘আত পুলিশের সাথে চলে গেলেন। আর নূরুল ইসলাম ভাই দারুল ইমারতে রয়ে গেলেন। ৫ মিনিট পর কয়েক জন পুলিশ ফিরে এসে বললেন, স্যার একা একা ফিরবেন কি করে তাই আপনাকেও যেতে বললেন। অতঃপর তিনিও যেতে বাধ্য হ’লেন। কিন্তু মাদরাসার গেইট পার হয়ে রাস্তায় উঠতেই তার মাথায় হাত। এ কি ব্যাপার! চারদিকে শুধু পুলিশ আর পুলিশ। মসজিদের ছাদে, মাদরাসার ছাদে, গেইটে, সামনে পিছনে সর্বত্র পুলিশের সশস্ত্র অবস্থান। এদিকে ‘আন্দোলন’-এর নায়েবে আমীর আব্দুছ ছামাদ সালাফী ছাহেবকে মারকাযের নিকটবর্তী তার বাসা থেকে এবং ‘যুবসংঘ’-এর সাংগঠনিক সম্পাদক এ.এস.এম. আযীযুল্লাহকে মারকাযের পশ্চিম পার্শ্বস্থ ভবনের ৩য় তলার অফিস থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। আমচত্বরে তখন চারটি মাইক্রো দাঁড়িয়ে আছে। একটি মাইক্রোর নিকটে আমীরে জামা‘আত, একটির নিকটে সালাফী ছাহেব ও একটির নিকটে আযীযুল্লাহ ভাই দাঁড়িয়ে আছেন। অতঃপর আমীরে জামা‘আত ও আযীযুল্লাহ ভাইকে রাজপাড়া থানায় এবং সালাফী ছাহেব ও নূরুল ইসলাম ভাইকে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে যাওয়া হ’ল। এভাবেই রাত ২-টায় সমাপ্ত হ’ল গ্রেফতার নাটকের কলঙ্কিত প্রাথমিক অধ্যায়টি।
গ্রেফতারের ১ম দিন : ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে সকালে তাদেরকে কোর্টে চালান করা হয়। আমরা চলে যাই কোর্টে। ইতিমধ্যে মিডিয়ার লোকজনে কোর্ট এলাকা ভরে যায়। আমরা যামিনের জন্য এডভোকেটদের সাথে যোগাযোগ করি। এডভোকেট শাহনেওয়াজ ভাই এসময় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি সুন্দর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে যামিন প্রার্থনা করেন। পক্ষান্তরে সরকারী উকিলরা যামিনের বিরোধিতা করে। অতঃপর আদালত যামিন নামঞ্জুর করে তাঁদেরকে জেল-হাজতে প্রেরণের নির্দেশ দেন।
রায় শ্রবণে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। ৫৪ ধারার সন্দেহজনক গ্রেফতারের তাহ’লে উদ্দেশ্য কি? এতক্ষণ আশান্বিত ছিলাম যে, গ্রেফতার হয়েছে তো যামিন নিয়ে নেতৃবৃন্দ সহ সানন্দে মারকাযে ফিরে যাব। এখন দেখছি সবকিছু অন্য রকম। উপস্থিত সকলের চোখে-মুখে কেবলই বিষন্নতার ছাপ। নেতা হারানোর বেদনায় ক্লান্ত-অবসন্ন মনে এক ঝাঁক প্রশ্ন উকি-ঝুঁকি মারছে বারবার। এ কি হ’তে চলেছে? পরিস্থিতি কোন দিকে গড়াচ্ছে? বিনা অপরাধে কেন এই গ্রেফতার? ইতিমধ্যে সংবাদ আসল তাবলীগী ইজতেমার প্যান্ডেল ভেঙ্গে দিয়েছে যৌথ বাহিনী। ইজতেমা এলাকায় জারি করা হয়েছে ১৪৪ ধারা। অথচ মাত্র ১ দিন পরই ইজতেমা। লাখো জনতার বিশাল সমাবেশ। সারা দেশের আহলেহাদীছদের প্রাণের সমাবেশ। সর্ববৃহৎ তাওহীদী সমাবেশ। অথচ এক নিমিষেই সব পন্ড! কেন নিরপরাধ নেতা-কর্মীদের উপর এই অযাচিত যুলম-নির্যাতন? এর শেষ কোথায়? ইসলামী মূল্যবোধের সরকারের (বিএনপি-জামায়াত) এই নিষ্ঠুর আচরণ কেন?
যামিন নামঞ্জুরের পরই আমরা কারাগারের গেইটে চলে যাই প্রিয় নেতাদের শেষ বিদায় জানানোর জন্য এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাঁদের নিয়ে প্রিজন ভ্যান রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের গেইটের একেবারে সম্মুখে গিয়ে থামে। ফলে দূর থেকে এক ঝলক দেখা ও ইশারায় সালাম বিনিময় ব্যতীত কিছুই করার সুযোগ হ’ল না। অপলক নেত্রে শুধু তাকিয়ে থাকলাম। অতঃপর গ্রেফতার আতংকে নিজেদের নিরাপত্তার বিষয় চিন্তা করে জেলখানার গেইট থেকেই দু’তিন জন করে ভাগ হয়ে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হ’লাম। মারকায এলাকা ও পার্শ্ববর্তী নওদাপাড়া বাজারের রাস্তা-ঘাট, দোকান-পাট সবখানেই র্যাব-পুলিশের সশস্ত্র মহড়া। এই পরিস্থিতিতে মারকাযে আসা মোটেও নিরাপদ ছিল না। সেকারণ শহর থেকে প্রধান সড়ক ছেড়ে গলিপথ ধরে মারকায থেকে প্রায় ১ কিঃ মিঃ উত্তর-পশ্চিমে ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি অধ্যাপক আমীনুল ইসলাম-এর ভায়রা ভাই সেলিম হাজী ছাহেবের বাসায় আশ্রয় নেই। পৃথক পৃথকভাবে এসে আমরা ৫/৬ জন এখানে একত্রিত হই।
যতদূর মনে পড়ে এ সময় সাথীদের মধ্যে ছিলেন ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় সভাপতি আমীনুল ইসলাম (রাজশাহী), সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম (গোপালগঞ্জ), প্রশিক্ষণ সম্পাদক আব্দুল ওয়াদূদ (কুমিল্লা), দফতর সম্পাদক মুযাফফর বিন মুহসিন (রাজশাহী), রাজশাহী যেলা ‘যুবসংঘে’র সাবেক সভাপতি মুহাম্মাদ এরশাদ আলী খান (রাজশাহী) ও আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর অফিস সহকারী ডাঃ সিরাজুল হক (কুড়িগ্রাম) প্রমুখ। সারা দিন রেডিও বা টিভির কোন সংবাদ আমাদের কানে নেই। সেলিম হাজী ছাহেবের বাসায় এসে শুনতে পেলাম সরকারী প্রেস নোটের কথা। যা রেডিও-টিভিতে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে। যেখানে বলা হচ্ছে- দু’টি জঙ্গী সংগঠন ‘জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ’ (জেএমবি) ও ‘জাগ্রত মুসলিম জনতা বাংলাদেশ’ (জেএমজেবি)-কে সরকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আমীর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবী বিভাগের শিক্ষক প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবকে শীর্ষ ৩ নেতা সহ গ্রেফতার করা হয়েছে। কি চমৎকার ধোঁকাবাজি! নিষিদ্ধ করা হ’ল এক সংগঠনকে, আর গ্রেফতার করা হ’ল অন্য সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের। যে দু’টি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হ’ল সে সব সংগঠনের কোন নেতাকে গ্রেফতার করা হ’ল না। এটি যে স্রেফ প্রতারণা ও সাজানো নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, তা আমাদের কারো আর বুঝতে বাকী থাকল না।
অতঃপর সেখানে রাতের খাবার গ্রহণের পর বিভিন্নজন বিভিন্ন স্থানে থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। কেউ চলে গেল প্রায় ২ কিলোমিটার দূরবর্তী সন্তোষপুর গ্রামে। কেউবা পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন অজানা অচেনা বাসায়। আমি ও আমীনুল ভাই সেলিম হাজীর বাড়ীর নিকটবর্তী এক ভাইয়ের টিনশেড মাটির খুপড়ি ঘরে আশ্রয় নিলাম। ঐ বাড়ীতে যাওয়ার তেমন কোন রাস্তাঘাট নেই। দু’তিন বাড়ী মাড়িয়ে সেখানে পৌঁছতে হয়। তাই আশ্বস্ত হ’লাম এই ভেবে যে, আর যাই হোক আজ রাতে অন্তত র্যাব-পুলিশের সাধ্য নেই আমাদের খুঁজে পায়।
রাত প্রায় সাড়ে ১০-টা। সারা দিনের ক্লান্তি দূর করতে কেবলমাত্র বিছানায় পিঠ লাগিয়েছি। হঠাৎ একটি জাতীয় দৈনিকের রাজশাহী ব্যুরো প্রধান আমার পরিচিত শুভাকাংখী সাংবাদিকের ফোন। ভিতরে নেটওয়ার্ক নেই, তাই বের হয়ে কথা বলছি। তিনি আমাদের খোঁজ-খবর নিলেন এবং বললেন, ঢাকা থেকে একজন আপনাকে ফোন করবে। আপনি ওনার চাহিদা মত তথ্য জানাবেন। ঠিক পাঁচ মিনিট পরই ওনার ফোন। পরিচয় জানতে চাইলে আসল পরিচয় গোপন করে তিনি বললেন, আপনাকে যিনি আগে ফোন করেছিলেন তার মতই আমি একজন সাংবাদিক। এই পরিচয় যে সত্য নয় তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম এবং এটাও উপলব্ধি করেছিলাম যে, তিনি উচ্চপদস্থ কোন ব্যক্তি হবেন। যাই হোক তিনি জানতে চাইলেন, ঢাকায় আমাদের উচ্চপর্যায়ের কেউ আছেন কি-না? যার সাথে সরকারী কোন প্রতিনিধি কথা বলতে পারেন। ওনার কথা ভাল বুঝতে না পেরে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যেকার প্রভাবশালী আহলেহাদীছ দু’একজনের নাম বললাম। যেমন ঢাকার মেয়র হানীফ, এম.পি. রহমতুল্লাহ প্রমুখ। তখন তিনি পুনরাবৃত্তি করে বললেন, ওনারা নন, আপনাদের সংগঠনের এমন কে ঢাকায় আছেন যিনি এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে কথা বলতে পারেন। তখন আমি ‘আন্দোলন’-এর সমাজকল্যাণ সম্পাদক ডঃ মুছলেহুদ্দীন ছাহেবের কথা বললে তিনি তার মোবাইল নম্বর চাইলেন। মোবাইল নম্বর দেওয়ার পর কথা শেষ হ’ল। সাথে সাথে আমি বিষয়টি মুছলেহুদ্দীন ভাইকে অবহিত করলাম। উল্লেখ্য যে, ডঃ মুছলেহুদ্দীন (ঢাকা), ডঃ লোকমান হোসাইন (কুষ্টিয়া), বাহারুল ইসলাম (কুষ্টিয়া) প্রমুখ ‘আন্দোলন’-এর নেতৃবৃন্দ ইজতেমা উপলক্ষে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে পরিস্থিতি জেনে কেউ মাঝ পথ থেকে কেউবা রাজশাহীতে বাস থেকে নেমে ফিরে চলে যান। ফোনকারী ঐ ব্যক্তির পরিচয় পরে জানতে পারলাম যে, তিনি একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান। পরবর্তীতে নেতৃবৃন্দের মুক্তি নিয়ে একাধিকবার তার সাথে আমাদের বৈঠক হয়েছে। এই ঐতিহাসিক ফোনালাপের মাধ্যমে বেদনাময় প্রথম দিনের অবসান ঘটল। দো‘আ-দরূদ পড়ে মহান আল্লাহর নামে ঘুমিয়ে পড়লাম।
গ্রেফতারের ২য় দিন : সকালের নাশতা সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সন্তোষপুর গ্রামের উদ্দেশ্যে। কেননা নওদাপাড়া ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকায় অচেনা মুখের বিচরণ এত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে যে, যেকোন সময় যে কারও উপর বিপদ আসতে পারে। বিভিন্ন বেশ ধারণ করে গোয়েন্দারা মাঠে নেমেছে। এমনকি বৃদ্ধ ভিক্ষুকের বেশ ধারণ করে একজনকে বেশ কিছুদিন ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগের বাসার আশ-পাশে ঘুরাফেরা করতে দেখা গেছে। সন্তোষপুর ‘যুবসংঘ’ রাজশাহী যেলার সাবেক সভাপতি এরশাদ ভাইয়ের বাড়ী। ঐ গ্রামের মসজিদে ২০০১-২০০২ সালের দিকে কিছুদিন আমি নিয়মিত জুম‘আর খতীব ছিলাম। সেকারণ কিছুটা নিরাপদ মনে করে সেখানে চলে গেলাম। অতঃপর সেখানে আমরা কয়েকজন বসে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে করণীয় সম্পর্কে পরামর্শ করছি, এমন সময় একজন এসে খবর দিল যে, মসজিদের কাছ থেকে পুলিশের গাড়ী ঘুরে গেল। খবরটি শুনে আর কাল ক্ষেপণ না করে উঠে পড়লাম। কিন্তু যাব কোথায়? এসময় আমীনুল ভাই দু’এক জায়গায় ফোন করে বললেন যে, আপনারা প্রস্ত্তত হন। বাগধানীতে আমার এক আত্মীয় আছেন, সেখানে চলে যাব। বাগধানী এখান থেকে প্রায় ৭/৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পবা থানাধীন একটি এলাকা। সেখানে আমীনুল ভাইয়ের মামা শ্বশুর জনাব হায়দার আলী ছাহেবের বাড়ী।
আমাদের সাথে যানবাহন বলতে আমীনুল ভাইয়ের একটি সিংগার মটরসাইকেল এবং এরশাদ ভাইয়ের হোন্ডা-১১০ মডেলের একটি মটরসাইকেল। দুই মটর সাইকেল যোগে আমরা রওয়ানা হ’লাম বাগধানীর উদ্দেশ্যে। কিন্তু মনের ভিতর অজানা ভয়। চোখে-মুখে আতঙ্কের ছাপ। অবশেষে নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার অসমাপ্ত পরামর্শ নিয়ে বসলাম। এসময় আমি, আমীনুল ভাই, কাবীরুল, মুযাফ্ফর ও এরশাদ আমরা পাঁচজন ছিলাম। নেতাশূন্য বাধাসংকুল পরিবেশে সংক্ষিপ্ত পরামর্শে প্রথমতঃ এই সিদ্ধান্তে পৌঁছলাম যে, অন্তত এই প্রহসনটি জাতিকে জানানো উচিত। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া যেভাবে আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে এ অবস্থায় আমাদের কোন রিপোর্ট এরা ছাপবে না। তাই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর একটি আবেদন আমরা বিজ্ঞপ্তি আকারে ২/১টি পত্রিকায় প্রকাশ করতে পারি। এতে জাতি আমাদের সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারবে। অপরদিকে সরকারেরও বিষয়টি নযরে আসবে। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল সরকার কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। অতএব কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে বসলাম। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে দীর্ঘ সময় ধরে সাথীদের সহযোগিতা নিয়ে একটি বিজ্ঞপ্তি দাঁড় করালাম। শিরোনাম দিলাম ‘প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সম্পর্কে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ’। অতঃপর প্রকাশের জন্য প্রথমতঃ দৈনিক ‘প্রথম আলো’-কে বেছে নিলাম এ কারণে যে, এই পত্রিকাটির প্রচার সংখ্যা বেশী। তাছাড়া বাম ঘরানার এই পত্রিকাটিই আমাদের বিরুদ্ধে প্রথম লেখালেখি শুরু করেছিল। কিন্তু রাজশাহী ব্যুরোর সাথে বিজ্ঞাপন নিয়ে যোগাযোগ করা হ’লে তারা ঢাকার সাথে যোগাযোগ করে নেগেটিভ উত্তর জানিয়ে দিল। অর্থাৎ ‘প্রথম আলো’ আমাদের বিজ্ঞাপন ছাপবে না। আসলে ছাপবেইবা কেন এরাই তো এসাইনমেন্ট নিয়ে মাঠে নেমেছে। অবশেষে যোগাযোগ করলাম দৈনিক ইনকিলাবের রাজশাহী ব্যুরো চীফ রেজাউল করীম রাজু ভাইয়ের সাথে। ফোনে ওনাকে বিজ্ঞাপনের বিষয়টি জানালে উনি সম্পাদক এ.এম.বাহাউদ্দীন ছাহেবের সাথে কথা বলে জানাবেন বললেন। এখান থেকে পজেটিভ উত্তর পাওয়া গেল। বাহাউদ্দীন ছাহেব নাকি বলেছেন, সকলেরই মত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে। অতএব তাদের বিজ্ঞাপন ছাপতে আমাদের কোন আপত্তি নেই। ফলে বাগধানী থেকে এরশাদ ভাইয়ের মাধ্যমে বিজ্ঞাপনটি এবং এর ছাপানোর খরচ রাজু ভাইয়ের নিকট পাঠিয়ে দেই। উল্লেখ্য যে, আমরা যে স্থানে অবস্থান করছি সেখানে বা পার্শ্ববর্তী কোন স্থানে কম্পিউটারের ব্যবস্থা ছিল না বিধায় এরশাদ ভাইয়ের সহযোগিতায় শহরের কোন কম্পিউটার থেকে কম্পোজ করে এবং একাধিকবার যাতায়াতের মাধ্যমে এটি ফাইনাল করে তারপর পাঠানো হয়। অতঃপর ২৮ ফেব্রুয়ারী’০৫ তারিখে দৈনিক ইনকিলাবের ৩য় পৃষ্ঠায় তিন কলাম ব্যাপী ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র যৌথ নামে এটি প্রকাশিত হয়।
উল্লেখ্য, এটিই ছিল আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতারের পর সংগঠনের পক্ষ থেকে কোন জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত আমাদের প্রথম বক্তব্য। বিজ্ঞপ্তিটি শুধুমাত্র আবেদন ছিল না; বরং এতে ছিল জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে সংগঠনের দৃঢ় অবস্থানের প্রমাণপঞ্জী। এই বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের ফলে কর্মীদের মনে কিছুটা হ’লেও প্রাণের সঞ্চার হয়।
উল্লেখ্য যে, যার বাসায় বসে আমরা বিজ্ঞপ্তিটি লিখলাম, মাত্র এক মাস ২৩ দিন আগে ৪ জানুয়ারী’০৫ তারিখে ৮ বছরের একমাত্র কন্যাকে রেখে তাঁর স্ত্রী বিয়োগ ঘটেছে। তার সমস্ত মুখাবয়বে স্ত্রী হারানোর বেদনার ছাপ। শিশু মেয়েটি সারাক্ষণ পিতার সাথেই থাকছে। তার অসহায়ত্বে আমাদেরই মন কাঁদছিল। প্রতিবেশী এক মহিলার সহযোগিতায় তিনি নিজেই রান্না-বান্নার ব্যবস্থা করেছেন। হায়দার আলী ছাহেবের সেদিনের আন্তরিকতা ও সহযোগিতা আমাদের আমৃত্যু স্মৃতির পাতায় গেঁথে থাকবে। বিপদ মুহূর্তে এই উপকারের পরিমাপ করা সত্যিই দুঃসাধ্য।
এভাবে ২য় দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হ’ল। বাসায়ই আমরা জামা‘আত করে মাগরিবের ছালাত আদায় করলাম। কেননা বাসায় ঢোকার পর আমরা আর বের হইনি। কেউ যেন জানতে না পারে যে, এখানে নতুন কিছু লোক অবস্থান করছে। রাত্রে আর এখানে থাকব না এই সিদ্ধান্ত নিলাম সকলে। তাই মাগরিবের ছালাত শেষে পার্শ্ববর্তী টেমা গ্রামে আমীনুল ভাইয়ের শ্বশুর টেমা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জনাব আযীযুর রহমান সরকারের বাসায় যাই এবং রাতের খাবার গ্রহণ করি। অতঃপর সেখান থেকে একই স্কুলের সহকারী শিক্ষক পার্শ্ববর্তী জনাব মোযাহার মেম্বারের বাড়ীতে গমন করি এবং অনেকটা নিশ্চিন্তে রাত্রি যাপন করি।
[ক্রমশঃ]