আমার নিয়ম ছিল যেখানে জালসার দাওয়াত নিতাম, সেখানে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ গঠনের শর্ত দিতাম। এছাড়া নিয়ম ছিল যাতায়াত খরচের অতিরিক্ত কোন টাকা নিতাম না। জোর করলে ‘যুবসংঘে’র রসিদ কেটে দিতাম। এমনি এক সফরে ১৯৮৩ সালে আমি জয়পুরহাট সদরের পলিকাদোয়া হাফেযিয়া মাদরাসার জালসায় যাই। অতঃপর জালসা শেষে সংশ্লিষ্ট সবার পরামর্শক্রমে মাহফূযুর রহমানকে আহবায়ক করে ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ‘যেলা আহবায়ক কমিটি’ গঠন করি। যিনি এখন যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি। জালসার এক পর্যায়ে মাহফূয সাথে করে এনে একজন যুবককে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল, স্যার ছেলেটি গান গেয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। আপনি ওর একটা হাম্দ শুনুন। শুনলাম ঘরের মধ্যে। মুগ্ধ হ’লাম ওর দরায কণ্ঠে। বললাম নাম কি? বলল, শফীউল আলম। বললাম, এ নাম চলবে না। বললাম, শফীকুল ইসলাম। সে রাযী হ’ল। বললাম, শফীকুল! আল্লাহ তোমাকে যে কণ্ঠ দিয়েছেন তা দিয়ে তুমি জান্নাত খরীদ করতে পার। বলল, স্যার আমি আনছার বাহিনীতে চাকুরী করি। সফীপুর (গাযীপুর) আনছার একাডেমীতে আমাকে দিয়ে থিয়েটারে গান করানো হয়। স্বল্প বেতনের চাকুরী। বাড়ীতে বৃদ্ধ পিতা একটা মুদিখানার দোকান করেন। বেচাকেনা খুবই কম। কোনমতে সংসার চলে। বললাম, বাজে গান ছাড়তে হবে। দোকানে বিড়ি-সিগারেট, তামাক-জর্দা বেচাকেনা চলবে না। বলল, স্যার এগুলি না থাকলে তো গ্রামে ব্যবসাই বন্ধ হয়ে যাবে। তাছাড়া আববা হয়ত মানবেন না। পরদিন আসার সময় আমি ওর দোকানে গেলাম। বৃদ্ধ পিতাকে বুঝালাম। হালাল পথে কম আয় করুন। তাতেই আল্লাহ বরকত দিবেন। সেদিন থেকে শফীকুলের যেন সব রূযীর দুয়ার বন্ধ হয়ে গেল। কিন্তু তার খুলূছিয়াত ও দৃঢ়তার কারণে আল্লাহর রহমতের দুয়ার খুলে গেল। এলাকায় এমন কোন সভা-সমিতি হয় না, যেখানে শফীকুলের ডাক পড়ে না। আমার নির্দেশ ছিল তুমি কারু কাছে কিছু চাইবে না। এমনকি চাওয়ার কথা মনেও আনবে না। তাতে আল্লাহ নারায হবেন। তুমি কেবল বলবে, আল্লাহ তোমার দেওয়া কণ্ঠকে আমি তোমার পথে ব্যয় করছি। তুমি আমাকে শক্তি দাও’! সে আজীবন আমার সে নির্দেশ মেনে চলেছে। প্রকাশ্য জালসাতে বহুবার এজন্য সে তার আমীরের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করেছে। আমরা আশা করি আল-হেরার জাগরণী গেয়ে সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে সে যত নেকী অর্জন করেছে, তার একটা অংশ আল্লাহ এ অধমকে দান করবেন।

‘যুবসংঘে’র গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতার কারণে ছয় মাসের মধ্যে জয়পুরহাটে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সিরাজুল ইসলামকে পাঠানো হয়। সে ঐ সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামের ইতিহাস বিভাগের বি.এ সম্মানের ছাত্র ছিল। বর্তমানে ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। জয়পুরহাট সদরের কোমরগ্রাম জামে মসজিদে প্রোগ্রাম হয়। সেখানে সকলের পরামর্শক্রমে নবগঠিত জয়পুরহাট যেলা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র প্রচার সম্পাদক হিসাবে শফীকুলকে মনোনয়ন দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৯৪ সালে জাতীয় সংগঠন হিসাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আবির্ভাব ঘটলে সে জয়পুরহাট যেলা ‘আন্দোলন’-এর অর্থ সম্পাদক নিযুক্ত হয়। তখন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সাথে উক্ত দায়িত্ব পালন করে। যেলা সভাপতির ভাষ্যমতে মৃত্যুর ছ’দিন আগে টাকা-পয়সা হিসাব করে ৩৬,১০০ (ছত্রিশ হাযার একশ’) টাকা তার কাছে রয়েছে বলে জানায়। মৃত্যুর একদিন পরে যেলা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সভাপতি আবুল কালাম এবং শফীকুলের বড় ছেলে ও আরও কয়েকজন তার রেখে যাওয়া সংগঠনের টাকা রাখার প্লাস্টিক বয়েম থেকে টাকা ঢালে। গুণে দেখা গেল হিসাব মত উক্ত টাকাই রয়েছে। একটি টাকাও কম-বেশী নেই। ফালিল্লাহিল হাম্দ। উল্লেখ্য যে, শফীকুল তার প্রথম সন্তানের নাম আমার নামে রেখেছিল এবং তার জন্য দো‘আ চেয়েছিল। সম্ভবতঃ ১৯৯৫ সালের দিকে কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক হাফীযুর রহমান (বর্তমানে মৃত)-এর মাধ্যমে আমরা তার ঘরটি পাকা করে দেই। যেখানে তার পরিবার এখনও বাস করছে।

আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠীর সূচনা :

১৯৯১ সালের ২৫ ও ২৬শে এপ্রিল বৃহস্পতি ও শুক্রবার রাজশাহী মহানগরীর নওদাপাড়াতে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর ২য় জাতীয় সম্মেলন ও তাবলীগী ইজতেমার ১ম দিন বাদ আছর  রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপযেলাধীন ঝিনা এলাকা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ‘কর্মী’ যীনাত আলী রচিত ‘জাগরে যুবক নওজোয়ান’ গানটি পূর্ণ দরদ ঢেলে দিয়ে দরায কণ্ঠে গেয়ে সে মানুষকে পাগল করে দেয়। সেদিন সে ‘ভন্ড পীরে’র বদলে ‘ভক্ত পীর’ বলেছিল। পরে সংশোধন করে দেই। কিন্তু তাতে জোশ যেন কিছুটা কমে যায়। আসলে ওর ভুলটাই ভালো লাগছিল। এরপর থেকে সম্ভবতঃ এমন কোন বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা যায়নি, যেখানে সে জাগরণী গায়নি। ১ম নওদাপাড়া তাবলীগী ইজতেমায় ওর গান শুনে আমার হৃদয়ে আশার প্রদ্বীপ জ্বলে ওঠে। বহুদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের দীপশিখা দেখতে পাই। ফলে কিছুদিনের মধ্যেই শফীকুলকে প্রধান ও সাতক্ষীরার আব্দুল মান্নান ও জাহাঙ্গীর আলমকে সাথী করে কেন্দ্রীয়ভাবে ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’ গঠন করি। এভাবে শুরু হয় ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’র পদযাত্রা। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে বিজাতীয় অপসংস্কৃতি এবং ইসলামের নামে শিরক ও বিদ‘আত মিশ্রিত আক্বীদা বিধ্বংসী গান-গযলের বিপরীতে তাওহীদ ও ছহীহ সুন্নাহ ভিত্তিক ইসলামী কবিতা ও গানের মাধ্যমে দ্বীন প্রচারের সংকল্প বাস্তবায়ন শুরু হয়। সেই সাথে শুরু হয় আমার বিরুদ্ধে ফৎওয়ার তীরবৃষ্টি। সবকিছু মুখ বুঁজে সহ্য করে ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’কে সাধ্যমত পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এগিয়ে নিয়েছি। যা এখন সমাজ পরিবর্তনে মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে শত্রু-মিত্র সকলের নিকট সমাদৃত হয়েছে। শফীকুলের গাওয়া গান এখন দেশে ও বিদেশে সর্বত্র সর্বাধিক পরিচিত। গানের মাধ্যমে সমাজ সংস্কারে তার অবদান সকলের নিকটে স্বীকৃত। তার গাওয়া গানে ঈমানদারগণের হৃদয়ে ঢেউ ওঠে। এমনকি ছোট্ট শিশুরাও শিহরিত হয়। সে চলে গেছে, কিন্তু তার জাগরণী গ্রামে-গঞ্জে এমনকি পর্ণকুটিরে সর্বত্র গুঞ্জরিত।

আমি জেলখানায় গেলে দু’দিন পরেই সে আমাকে রাজশাহী কারাগারে দেখতে আসে। পরে তাকেও জেলখানায় যেতে হয়। জয়পুরহাট জেলখানায় তার কারারক্ষীরা বদলী হয়ে বগুড়া কারাগারে গেলে আমার সঙ্গে শফীকুলের গল্প করত। জেলখানায় তার তাক্বওয়া-পরহেযগারী-উপদেশ ও গানের মাধ্যমে সংস্কারমূলক বক্তব্যে সবাই ছিল মোহিত। পরে আব্দুর রহীম (যেলা সভাপতি) যখন বগুড়া জেলখানায় এল। তখন তার ব্যবহার ও আচরণে মুগ্ধ একই কারারক্ষীরা এসে বলত, স্যার! আপনার কর্মীরা সবাই কি এরকম? আপনারা ভোটে দাঁড়ান না কেন? আপনাদেরই দেশের ‘প্রেসিডেন্ট’ হওয়া উচিৎ।

কেন্দ্রীয় শিল্পী গোষ্ঠী গঠনের সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সংগঠনভুক্ত ২৩জন শিল্পী অংশগ্রহণ করে। তাদের মধ্যে শফীকুলসহ পূর্বোক্ত ৩জনকে কেন্দ্রীয় দায়িত্বে রেখে বাকীদের স্ব স্ব যেলায় কাজ করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতঃপর কেন্দ্রীয় দায়িত্বশীলদের প্রশিক্ষণের জন্য রেডিও বাংলাদেশ রাজশাহী কেন্দ্র থেকে দক্ষ ২জন প্রশিক্ষক আনা হয়। রাণীবাজার মাদরাসার ৩য় তলায় তখন আমাদের অফিস ছিল এবং সেখানেই প্রশিক্ষণ হয়। অতঃপর প্রশিক্ষণ শুরু হ’লে শফীকুলের কণ্ঠে প্রথম গানটি শুনেই প্রশিক্ষক দ্বয় বলে ওঠেন, আপনাদের প্রশিক্ষণের দরকার নেই। আল্লাহ প্রদত্ত কণ্ঠই যথেষ্ট। এতে আমাদের ঘষামাজার প্রয়োজন নেই। অতঃপর তারা সামান্য কিছু উপদেশ দিয়ে বিদায় নিলেন।

আমরা সমাজ সংস্কারমূলক বিভিন্ন কবিতা আহবান করি।  যেগুলো আমি নিজেই বাছাই করতাম। ভাষা ও বিষয়বস্ত্ত সংশোধন করতাম। কিছু ওরা নিজেরা মুখস্ত করে এসে আমাকে শুনাতো। অনেক ক্ষেত্রে সুরের তাল ও লয় এবং ছন্দ ও অন্তমিল ঠিক করে দিতাম। এরপর সেটা জালসায় বলার অনুমতি দিতাম। আমার সঙ্গে থাকলে যখন ওরা জালসায় সেগুলি গাইত, তখনও অনেক সময় সংশোধন করে দিতাম। শ্রোতাদের উৎসাহ দেখে ও সুধীদের প্রশংসাবাণী শুনে আমি এর নাম রাখলাম ‘জাগরণী’। এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য ছিল গান ও সঙ্গীত নাম দু’টি পরিহার করা। কারণ এই নামগুলি ধর্মনিরপেক্ষ ও বিদ‘আতী ইসলামী দলগুলি ব্যবহার করে থাকে। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে। এখন দেশে জাগরণী অর্থ হ’ল ‘আল-হেরার জাগরণী’। কোন অনুষ্ঠানের শুরুতে কুরআন তেলাওয়াতের পরই ‘জাগরণী’ এখন বিষয়বস্ত্ত হয়ে উঠেছে। এমনকি এক সময় শফীকুলের নামই হয়ে ওঠে, ‘জাগরণী’। জালসায় গিয়ে লোকেরা জিজ্ঞেস করে ‘জাগরণী’ এসেছে কি? শুনেছি পশ্চিম বঙ্গের লালগোলা সহ বিভিন্ন শহরে ও বাজারে এমনকি আইসক্রীম বিক্রেতারাও ‘আল-হেরা’র জাগরণী বাজিয়ে থাকে। এভাবে আল-হেরার জাগরণী সমাজের তৃণমূল পর্যায়ে দেড় হাযার বছর পূর্বেকার আল-হেরার শিহরণ জাগিয়ে তোলে। যা আগামী দিনে আল-হেরার জান্নাতী পথে সমাজ পরিবর্তনে বড় অবদান রাখবে বলে আমরা আশা করি। এভাবে শফীকুল ও তার সাথী লেখকবৃন্দ ও শিল্পীগণ আল্লাহকে যে ‘উত্তম ঋণ’ দিয়েছে, তার সর্বোত্তম বদলা যেন তারা আল্লাহর নিকটে পান, আমরা সেই দো‘আ করি।

৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পর ২০০৮ সালের ২৮শে আগস্ট বগুড়া যেলা কারাগার থেকে যামিনে মুক্তি লাভ করার পর শফীকুল ও তার সাথী জাহাঙ্গীর, আব্দুল মান্নান ও আমানুল্লাহর কাছে নতুন অনেকগুলি গান শুনি। যেগুলির বিষয়বস্ত্ত ছিল আমার কারামুক্তি। বিভিন্ন সফরে যাতায়াতকালে মাইক্রোর মধ্যে যখনই ওদের প্রাণখোলা গানগুলি শুনতাম, তখনই বলতাম, তোমরা দ্রুত এগুলি রেকর্ড কর। জানিনা কে কখন বিদায় নেব। অন্যেরা না শুনলেও শফীকুল শুনেছিল। তাই গত ২৭ ও ২৮শে আগস্ট’১৫ ‘আন্দোলন’-এর বার্ষিক কর্মী সম্মেলনের একদিন পূর্বে এসে সে একক কণ্ঠে ৫৩টি গান রেকর্ড করায়। এক পর্যায়ে ‘আমেলা’ চলাকালে সে ‘দারুল ইমারতে’ এসে একটা গান শুনাবার আবদার করে। ওর আবেগ দেখে ‘আমেলা’ স্থগিত করে অনুমতি দিলাম। তারপর সে দাঁড়িয়ে গানটি শুনালো। বললাম, এটা চলবে না। খুশী হয়ে বলল, স্যার! এটা কাউকে শুনাইনি। বাদ দিলাম। পরের দিন পুনরায় এলে আমি তাকে বললাম, আমার সাড়ে এগার মাস বয়সী যমজ নাতি-নাতনী জাওয়াদ-জুমানা তোমার জাগরণী শুনে কান্না বন্ধ করে। তারপর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের কভু মরণ নাই’ জাগরণী শুনে ওরা হেলতে-দুলতে শুরু করে। যতক্ষণ জাগরণী চলে, ততক্ষণ ওরা হেলতেই থাকে। ঠাট্টা করে আমরা বলি এরা এখুনি শফীকুলের শিষ্য হয়ে গেল। একথা শুনে আমার ছেলেদের মাধ্যমে ওদেরকে নীচে এনে কোলে নিয়ে সে আদর করে এবং তাদের জন্য দো‘আ করে। এটাই ছিল ‘দারুল ইমারতে’ শফীকুলের সর্বশেষ আগমন এবং আমাদের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা। এভাবেই গান রেকর্ড করার মাধ্যমে সে যেন নিজের অজান্তেই তার মৃত্যুর আগে তার আমীরের আদেশ পালন করে গেল।...

তার জাগরণীর বৈশিষ্ট্য :

কথা, কণ্ঠ ও ছন্দ মিলিয়ে গান হয়। কিন্তু যখন সেটা হৃদয় থেকে উৎসারিত হয়, তখন তা অন্যের হৃদয়কে প্রভাবিত করে। এদিক দিয়ে শফীকুল ছিল অনন্য ও অতুলনীয়। আল্লাহপাক তাকে কেবল কণ্ঠ দেননি, দিয়েছিলেন মানুষের প্রতি দরদভরা প্রাণ। আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান এবং ইমারতের প্রতি নিখাদ আনুগত্য ও শ্রদ্ধাবোধ। গানের কথার মাধ্যমে নিজের আদর্শ চেতনা মিশিয়ে তাতে প্রাণের মাধুরী ঢেলে দিয়ে যখন সে গাইত, তখন তা অন্যের হৃদয়তন্ত্রীতে আঘাত হানত। মরিচা ধরা অন্তর পরিচ্ছন্ন হয়ে জেগে উঠত। জান্নাতহারা আদম সন্তান জান্নাতের ডাক পেয়ে যেন পাগলপারা হয়ে যেত। ৫৮ বছরের জীবনের শেষদিকে যখন সে তার পুরানো গানগুলি গাইত, তখন শেষ হলেই শ্রোতারা বলে উঠত, আরও একটা চাই। তাদের আবেগ অনেক কষ্টে থামাতে হ’ত। বয়সের পরিবর্তন হ’লেও তার আবেগে ও কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন আসেনি। সম্মেলন সমূহে আমি উঠার আগে সে আমার পসন্দ মত জাগরণী গাইত। বার্ষিক কেন্দ্রীয় তাবলীগী ইজতেমায় ১ম দিন বাদ আছর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এবং ১ম ও ২য় দিন বাদ এশা যখন সে জাগরণী গাইত, তখন দূর থেকে শ্রোতারা বুঝে নিত যে, এবার ‘আমীরে জামা‘আত’ ভাষণ দিবেন। কাজ-কাম বন্ধ করে তখন সবাই ময়দানে ছুটে আসত। গভীর রাতে ইজতেমা প্যান্ডেলে মানুষ ঘুমিয়ে গেলে যদি শফীকুল উঠত, সাথে সাথে শ্রোতারা ঘুম থেকে জেগে উঠে বসে যেত। আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা এমনকি অবুঝ শিশুরাও তার গানে মুগ্ধ হ’ত। মূলতঃ এখানেই ছিল শফীকুলের জাগরণীর স্বার্থকতা। আজ হয়তোবা কণ্ঠ পাওয়া যাবে, কিন্তু সেই প্রাণ পাওয়া যাবে কি? শফীকুলের স্থান তাই পূরণ হবার নয়। এরপরেও আমরা আল্লাহর নিকট আশাবাদী।

শেষদিকে সে হয়ে উঠেছিল একজন জনপ্রিয় বক্তা। বক্তৃতা শিল্পে সে এমনই দক্ষতা অর্জন করেছিল যে, বিরোধীদের মজলিসে দাঁড়িয়েও সে হাসতে হাসতে সংগঠনের দাওয়াত দিত। মৃত্যুর দু’দিন আগে ১১ই ডিসেম্বর শুক্রবার এমনই এক পরিবেশে পাবনার কুলনিয়াতে দেওয়া ভাষণের শেষ দিকে যেলা সভাপতি শিরীন বিশ্বাসের ভাষ্যমতে যখন সে শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করে, ভাইয়েরা অন্তর থেকে বলুন, যদি কেউ মানুষকে দাওয়াত দেয়, ‘আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি’ তাহ’লে দাওয়াতটা কি অন্যায় হবে? তখন সকলে বলল, না। তখন সে বলল, ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’ ‘সোনামণি’ ও ‘আহলেহাদীছ মহিলা সংস্থা’ জনগণের কাছে এই দাওয়াতই দিয়ে থাকে। এতে কি আপনাদের কোন আপত্তি আছে? সকলেই বলল, না। ভাইয়েরা আমার! আগামী ২৫ ও ২৬শে ফেব্রুয়ারী’১৬ বৃহস্পতি ও শুক্রবার ২৬তম বা©র্র্ষক তাবলীগী ইজতেমা অন্যান্য বারের ন্যায় এবারও রাজশাহীর নওদাপাড়াতে অনুষ্ঠিত হবে ইনশাআল্লাহ। আপনারা সবাই সেখানে যাবেন। কুরআন ও ছহীহ হাদীছের ওয়ায শুনবেন’। পাশেই বসা বিরোধী নেতারা থ’ হয়ে তার কথা শুনলো। কিন্তু কিছুই বলার ছিল না। এর দু’দিন পর ১৩ই ডিসেম্বর রবিবার বগুড়ার মেন্দীপুর মাদরাসার জালসায় যেলা সভাপতি আব্দুর রহীমের ভাষ্যমতে সে সর্বশেষ জাগরণী গায় ‘কত ইসলামী দল ঘুরছে বাংলার পরে, শোন বন্ধু রে’..। এখানে দেওয়া তার জীবনের সর্বশেষ প্রায় দেড় ঘণ্টার ভাষণের মাধ্যমে আল্লাহর পথে দাওয়াত দিয়ে আল্লাহর পথের এ দাঈ আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে আল্লাহর নিকটে চলে গেল। কিন্তু তার স্মৃতি রইল চির অমলিন। আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নছীব করুন। -আমীন!

২. ইসলামী জাগরণীর প্রাণভোমরা শফীকুল ইসলামের ইন্তেকালে স্মৃতি রোমন্থন

-মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান*

* অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (বিসিএস) এবং গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রধান উপদেষ্টা; বয়স ৮০।


১৪ই ডিসেম্বর ২০১৫। বার্ধক্যজর্জরিত জবুথবু শরীরটা গত কয়েক দিনের শীতে আরও কাহিল হয়ে পড়েছে। ফজর ছালাতান্তে শরীরে লেপ চাঁপিয়ে তাসবীহ পাঠ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠল। আতংকিত হয়ে উঠল প্রাণটা। কারণ ইতিপূর্বে ভোর বেলায় যত ফোন পেয়েছি তার সবটিতেই পেয়েছি দুঃসংবাদ। মোবাইল চাপলাম। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ গাইবান্ধা-পশ্চিম যেলার সভাপতি ডাঃ আউনুল মা‘বূদ-এর কল। শংকা আরও বেড়ে গেল। হ্যাঁ, আমার ধারণা সঠিক। আহলেহাদীছ আন্দোলনের সভা-সমিতিতে যার দরায কণ্ঠের জাগরণী সভার লোকজনকে আপ্লুত করে তোলে এবং ‘আন্দোলন’-এর কঠোর বিরোধী লোকটিকেও তার জাগরণী মুহূর্তের মধ্যে পাল্টাতে বাধ্য করে সেই জাগরণীর প্রাণভোমরা শফীকুল ইসলাম গত ১৩ই ডিসেম্বর’১৫ বগুড়ার গাবতলী থানাধীন মেন্দীপুর-চাকলা সালাফিইয়াহ হাফেযিয়া মাদরাসায় বক্তৃতারত অবস্থায় রাত্রি পৌনে এগারটায় অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে রাত্রি দেড় ঘটিকায় বগুড়া শহরের জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লা-হি ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন)

‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব-এর একনিষ্ঠ ভক্ত, হৃদয়গ্রাহী ও সুললিত আপোষহীন কণ্ঠের ইসলামী জাগরণীর অনেকগুলির রচয়িতা এবং গায়ক শফীকুল ইসলাম-এর মৃত্যুর সংবাদে তাৎক্ষণিকভাবে বেদনা ভারাক্রান্ত হৃদয়ে  উচ্চারিত হ’ল, ‘দয়াময় আল্লাহ! তুমি তাকে জান্নাতুল ফেরদাঊসে স্থান দান কর। তার পরিবার-পরিজনকে তোমার মহান অভিভাবকত্বের আবরণে ঢেকে দাও’। মাত্র সপ্তাহখানেক আগে যখন আমি তার সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলাম যে, হরতালজনিত কারণে ২৩শে নভেম্বরের সভা স্থগিত হওয়ায় আগামী ২৭শে জানুয়ারীতে পুনরায় সম্মেলনের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে। আপনি ঐ সভায় অবশ্যই আসবেন। টিএ্যান্ডটি সংলগ্ন আহলেহাদীছ জামে মসজিদটিকে দোতলা করার মনস্থ করেছি। আপনার দরায কণ্ঠের মধুর আহবানে প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা আদায় করতে পারবেন আশা করি। বিগলিত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘ভাই প্রধান ছাহেব, আপনার ওখানে যাবার জন্য সর্বদাই শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্ত্তত আছি। আপনার সৎ ইচ্ছাটিও পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ। বাকীটা আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছা’। হ্যাঁ, আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাই কার্যকর হয়েছে। তিনি যে ‘আলা কুল্লি শাইয়িন ক্বাদীর’। আমার মোবাইলে ধারণ করা তার জাগরণী-

‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের কভু মরণ নাই,

সকল পথের মরণ হলেও হকের পতন নাই’...

শুনতে শুরু করলাম আর চোখ বেয়ে অঝোরে অশ্রু ঝরতে লাগল। স্মৃতি বড় বেদনাদায়ক। বিশেষ করে যখন কোন একান্ত আপনজনকে বিদায় জানাতে হয়। কবির ভাষায় তাই বলতে হয়,

যেতে নাহি দিব হায়

তবুও যেতে দিতে হয়

তবু চলে যায়।

৩. শফীকুল ভাইয়ের বিদায় : শেষ মুহূর্তের কিছু স্মৃতি

                                                                                                                                                                                            -ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন

১৩ই ডিসেম্বর রবিবার। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বগুড়া যেলার গাবতলী থানাধীন মেন্দিপুর-চাকলা সালাফিইয়া হাফেযিয়া মাদরাসা ও ইয়াতীমখানার উদ্যোগে বার্ষিক জালসা। বিগত কয়েক বছর যাবত নিয়মিতভাবেই এই জালসায় যোগদান করে আসছি। কখনো সভাপতি, আবার কখনো প্রধান অতিথি হিসাবে। সেকারণ এ বছর যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু জালসার ঠিক আগের দিন বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি ও উক্ত মাদরাসার প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুর রহীম ভাইয়ের ফোন ও অনুরোধ পেয়ে আমীরে জামা‘আতকে জানালাম। অনেকটা অনিচ্ছা থেকেই স্যারকে বললাম না যাওয়ার কথা। রাজশাহীতেও অনেক ব্যস্ততা। ভেবেছিলাম স্যার নিষেধ করলে তাঁর দোহাই দিয়ে হয়তবা বাঁচা যাবে। কিন্তু না, তিনি বরং যাওয়ার জন্যই উৎসাহিত করলেন। অতঃপর অনুমতি পেয়ে বেলা ২-টায় মাইক্রোযোগে রওয়ানা হ’লাম। সফরসঙ্গী ছিল রাজশাহী মহানগরী ‘যুবসংঘে’র সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ নাজিদুল্লাহ ও অর্থ সম্পাদক মুকাম্মাল হোসাইন। মেন্দিপুর মাদরাসায় পৌঁছলাম মাগরিবের ছালাতের শেষ সময়ে। অতঃপর মাদরাসা মসজিদে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও কছর করে জামা‘আতে আদায় করলাম। মুক্তাদী হিসাবে তখন ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’র প্রধান শফীকুল ইসলাম ভাই পিছনে এসে দাঁড়ালেন। ছালাত শেষে কুশল বিনিময় হ’ল। অতঃপর একসঙ্গে মাইক্রোতে চড়ে মেহমানদের বিশ্রামের স্থান গাবতলী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জনাব আব্দুল লতীফ আকন্দ ছাহেবের বাসায় গেলাম। সেখানে চা-নাশতা খেতে খেতে সাংগঠনিক বিভিন্ন দিক নিয়ে গল্প হ’ল। অতঃপর ওনাকে রেখে চলে গেলাম মঞ্চে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন যেলা ‘যুবসংঘে’র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম।

রাত প্রায় সাড়ে ৯-টা। প্যান্ডেল প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। সভাপতি হিসাবে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে শফীকুল ভাইয়ের নাম ঘোষণা করা হ’ল। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী জনাব বাদশা ভাই খাবারের জন্য ডাকলে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললাম, পরে খাব। ভাবলাম, শফীকুল ভাইয়ের বক্তব্য শেষ হ’লে প্রধান বক্তা জনাব আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ছাহেবের বক্তব্য শুরু করে দিয়ে একেবারে উঠে যাব এবং খাওয়ার পর রাজশাহী রওয়ানা হব। সে লক্ষ্যে মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনছি। আমার বাম পাশের চেয়ারে বসে বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি। প্রাণভরে দীর্ঘ বক্তব্য দিলেন। শ্রোতাদের মনোযোগ ও নীরবতা ছিল উল্লেখযোগ্য। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট জাগরণী শ্রোতাদের হৃদয় তন্ত্রীতে যেন ঝংকার তুলছিল। বক্তব্যের শেষ মুহূর্তে পরিচালকের স্লিপ ‘কালেকশন সহ সাড়ে ১০-টার মধ্যে বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ’ পেয়ে সাথে সাথে বক্তব্যের মোড় ঘুরিয়ে চলে গেলেন কালেকশনের দিকে। চলল আরো প্রায় আধা ঘণ্টা। টেবিলে নগদ টাকার স্তূপ। উপস্থিত জনতা স্রোতের মত দান করছেন। তিনিও সেই আনন্দে অধিক উচ্ছ্বাসের সাথে কুরআন-হাদীছ ও ছন্দ-কবিতার মাধ্যমে কালেকশন করছেন। রাত প্রায় পৌনে এগারটা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। শ্রোতাদের মোবাইলের আলোতে আলো-অাঁধারি পরিবেশ। তিনি বললেন, ভাই! ভাল লাগছে না, বক্তব্য শেষ করে দেই। বললাম, ঠিক আছে মাইকের কানেকশন দিলে যারা এখনো দান করতে আগ্রহী তাদেরকে মঞ্চে এসে অথবা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের নিকটে দান পৌঁছে দেওয়ার আহবান জানিয়ে শেষ করে দিন। ইতিমধ্যে আরো প্রায় পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হ’ল। দেখছি শফীকুল ভাই টেবিলে মাথা এলিয়ে চুপ করে আছেন। ভাবলাম দীর্ঘ সময় উচ্চকণ্ঠে বক্তব্য দেওয়ার কারণে হয়ত ক্লান্তিবোধ করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই পানি খাবেন? বললেন, না। তখনও ইলেকট্রিক লাইন ঠিক হয়নি। তিনি বললেন, ভাই! আমার শরীর ভাল লাগছে না, আমি চলে যাই। অনুমতি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে, যান। এই ছিল তার সাথে আমার জীবনের শেষ কথা। কে জানে এই বিদায়ই শফীকুল ভাইয়ের শেষ বিদায়? কে জানত বক্তব্যের শেষ মুহূর্তে আলো বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তার জীবনের আলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া।

শফীকুল ভাই চলে গেলেন। আমরা অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। আলো নেই, মাইক নেই সবমিলিয়ে একটা বিব্রতকর পরিবেশ। সেকারণ তিনি মঞ্চ থেকে কিভাবে গেলেন সে বিষয়টি মাথায় নেই। তাছাড়া এতটা খারাপ অবস্থা, তা তো ভাবতেও পারিনি। প্রত্যক্ষদর্শী ও শেষ মুহূর্তের সাথী বগুড়া যেলা ‘যুবসংঘে’র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম, সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামূন ও অন্যান্য কর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি মঞ্চ থেকে নামার মত শক্তি পাচ্ছিলেন না। মাদরাসা কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ও ‘যুবসংঘে’র কর্মী রাশেদুল ইসলাম (রংপুর) ধরাধরি করে তাকে মাদরাসায় নিয়ে যান। সেখানে মাথায় পানি ঢালা হ’ল। ঘামে ভিজে যাওয়া জামা-কাপড় খুলে শরীর মুছে দেওয়া ও শরীর মালিশ সবই চলল। সাথে সাথে ডাক্তার আনা হ’ল। ডাক্তারের পরামর্শে নেওয়া হ’ল পার্শ্ববর্তী গাবতলী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে পাঠানো হ’ল বগুড়া শহরের জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আব্দুস সালাম ভাই সহ বেশ কিছু দায়িত্বশীল গেলেন সাথে। পথে আব্দুস সালামকে সম্বোধন করে বলছেন, আব্দুস সালাম! আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করবে না, ডাক্তার দেখিয়ে আবার নিয়ে এসো, হাসপাতাল খুব ভাল জায়গা না’। কিছুটা স্বাভাবিকের মতই কথা বলছিলেন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যেলার শাহজাহানপুর থানাধীন বৃ-কুষ্টিয়ার অধিবাসী তার জামাই ও মেয়ের সাথেও স্বাভাবিক ফোনালাপ হ’ল। তাদেরকে বললেন, আমার তেমন কিছু হয়নি। একটু শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার দেখিয়ে আবার ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই।

হাসপাতালে নেওয়ার পর দ্রুত ভর্তি এবং প্রেসার, হার্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই করা হ’ল। কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন, ওনি হার্ট এ্যাটাক করেছেন। এই ঔষধগুলো নিয়ে আসুন। আব্দুস সালাম ভাই ছুটলেন ঔষধ আনতে। যাওয়ার সময় শফীকুল ভাই বলছেন, আব্দুস সালাম! আমি তো রাতে ভাত খাইনি, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। আব্দুস সালাম বললেন, চাচা! আমি আপনার জন্য গরম দুধ, পাউরুটি ইত্যাদি নিয়ে আসব। আমিও কিছু খাইনি। দু’জন এক সঙ্গে খাব। অতঃপর আব্দুস সালাম ভাই একজনকে সাথে নিয়ে নিচে চলে গেলেন ঔষধ ও খাবার আনার জন্য। ঔষধ  কিনে তিনি সাথীকে দিয়ে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে খাবার-দাবার ক্রয় করছেন। এমন সময় হঠাৎ ওয়ার্ড থেকে ফোন আব্দুস সালাম ভাই! আপনি দ্রুত আসুন। শফীকুল ভাই কেমন যেন করছেন।

শফীকুল ভাই সাথীদের সাথে কথা বলতে বলতে বাথরুমে যেতে চাইলেন। এমনকি একাই যেতে পারবেন বলে দাঁড়িয়ে গেলেন ও হাঁটতে শুরু করলেন। ডাক্তার দেখে বললেন, সর্বনাশ! এই রোগী হাঁটতে পারবে না। দ্রুত হুইল চেয়ারে বসান। হুইল চেয়ার আনা হ’ল। বসতে শুরু করলেন হুইল চেয়ারে। কিন্তু না, আর বসতে পারলেন না। বসতে গিয়ে ঢলে পড়লেন মাটিতে। জীবনের সুইচ এখানেই চিরতরে অফ হয়ে গেল। ডাক্তার খুব চেষ্টা করলেন। কিন্তু সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে কুরআনের চিরন্তন বাণীই সত্য ‘নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে, তখন কিছু আগেও (জান কবয) করা হবে না বা কিছু পরেও না’ (আ‘রাফ ৭/৩৪)। শফীকুল ভাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই নির্মম সত্যই বাস্তবায়িত হ’ল।

রাত ১-টা পার হয়েছে। তখনো আব্দুল লতীফ ছাহেবের বাসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা হব। বইগুলো গাড়ীতে ওঠানোর জন্য অপেক্ষা করছি মাত্র। ফোনে আব্দুস সালাম ভাইয়ের সাথে কথা হ’ল। খোঁজ-খবর নিলাম শফীকুল ভাইয়ের। জানা গেল তিনি মোটামুটি ভাল আছেন। ওনাকে হাসপাতালে দেখে রাজশাহী রওয়ানা হব, এই ভেবে আব্দুর রহীম ভাইকে মোবাইলে বলছি, বইগুলো উঠানো হ’লে আপনিও গাড়ীতে ওঠে চলে আসেন শফীকুল ভাইকে দেখতে যাব। কি মর্মান্তিক! ফোন কানে থাকতেই অপর প্রান্তে কান্নার শব্দ। আব্দুর রহীম ভাইয়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ডুকরে কেঁদে ওঠে বললেন, শফীকুল ভাই চলে গেছেন...। রাত তখন ১-২৬ মিনিট। আকস্মিক এই দুঃসংবাদ বহন করার মত শক্তি হারিয়ে ফেললাম। সকলে হতবাক হয়ে গেলাম। নীরব কান্না বেরিয়ে আসল হৃদয়ের গভীর থেকে। এ কান্না যে থামতে চায়না। হৃদয়তন্ত্রীতে শুধুই টান পড়ছে, পাশের মানুষটি না হয়ে হতে পারতাম আমিও। মৃত্যু কত নির্দয়! আর আমরা কত উদাসীন! অতঃপর আব্দুর রহীম ভাই ও যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রচার সম্পাদক ছহীমুদ্দীন ভাইসহ দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম কি করব, এত রাতে কাকে জানাব। পরিবারকে আপাতত জানাতে নিষেধ করলাম। কিন্তু অন্য মাধ্যমে তারা জেনে গেলেন। আমীরে জামা‘আতকে জানানোর জন্য তাঁর মেজ ছেলে আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীবকে ফোন দিলাম। কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসল। কথা বলতে পারছি না। দুঃসংবাদটি জানিয়ে বললাম, স্যারকে এখন বল না। উনি আর ঘুমাতে পারবেন না। তাহাজ্জুদের ছালাতে উঠলে জানাবে। ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভাইকে জানালাম। পর্যায়ক্রমে ফোন আসতে থাকল। চারদিকে রাতের মধ্যেই সংবাদ পৌঁছে গেল।

সফরসঙ্গী নাজিদুল্লাহ ও মুকাম্মালকে দিয়ে রাজশাহীর মাইক্রো ছেড়ে দিলাম। এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ নিয়ে রাত প্রায় আড়াইটার দিকে রওয়ানা হ’লাম তার বাড়ী জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে। হাসপাতাল থেকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে বৃ-কুষ্টিয়া গ্রাম থেকে তার মেয়ে ও জামাইকে নেওয়ার জন্য সেখানে পৌঁছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অঝোর নয়নে কাঁদছেন সবাই। অতঃপর সেখান থেকে তাঁর মেয়ে, জামাই, বেয়াই এবং যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক হাফেয নজীবুল ইসলাম, যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি আব্দুর রাযযাক, সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম সহ আমরা কয়েকজন চললাম লাশের সাথে। অতঃপর রাত সাড়ে চারটায় লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সটি জয়পুরহাটের কমরগ্রামে তার বাড়ীর সামনে পৌঁছল। এ সময় স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল। প্রিয়জনের আকস্মিক বিদায় কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। কি করে পারবেন! শুধুই দ্বীনি বন্ধন, আত্মীয় তো নয়ই, যেলারও নয়। তারপরও নিজেদের সামলাতে অপারগ অবস্থা প্রায়। আর যেখানে পরিবার অপেক্ষায় আছে বক্তব্য শেষে বাড়ি ফিরবেন। অথচ তিনি ফিরলেন লাশ হয়ে! কি করে ভুলবেন জ্বলজ্বলে স্মৃতিগুলো।

ফজরের আযান হ’ল। ওযূ করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। এমন সময় রাজশাহী হ’তে নাজীবের ফোন। অপরপ্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসল। ‘সাখাওয়াত! তুমি এ কী সংবাদ শুনালে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুমি তো যেতে চাচ্ছিলে না। তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে থাকল শফীকুল’। আমীরে জামা‘আতের এই ফোন পেয়ে ভাবলাম, সত্যিই এটি আমার জীবনের এক মর্মান্তিক স্মৃতি। এভাবে একজন তরতাযা সাথী ভাইকে হারাতে হবে কখনো কল্পনায়ও আসেনি। পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকা দু’জনের একজন আজ শুধুই স্মৃতি। মনের আয়নায় শুধুই তার আল্পনা।

বাদ ফজর শফীকুল ভাইয়ের বাড়ী সংলগ্ন ওয়াক্তিয়া মসজিদে মৃত্যু ও দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত দরস শেষে যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি আবুল কালাম আযাদের বাসায় গিয়ে পরামর্শে বসলাম। যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মুহাম্মাদ মাহফূযুর রহমান সহ আরো অনেকে আসলেন। ফজরের পূর্বেই আমীরে জামা‘আতের সাথে আলোচনায় বাদ আছর জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কেননা তার বড় ছেলে সাতক্ষীরা থেকে পৌঁছতে যোহর পার হয়ে যাবে। সুদূর পঞ্চগড়, লালমণিরহাট, নীলফামারী থেকেও কর্মী ও দায়িত্বশীলগণ রওয়ানা হয়েছেন জানাযার উদ্দেশ্যে। পার্শ্ববর্তী  বগুড়া থেকে ৪টি বাস ও অন্যান্য মাধ্যম, রাজশাহী হ’তে ২টি বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার যোগে, এভাবে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সকল যেলা থেকে বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার, ট্রেন যোগে বিপুল সংখ্যক কর্মী ও সুধী জানাযার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র নেতৃবৃন্দ আগত কর্মী ও সুধীবৃন্দের জন্য দুপুরে আপ্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলেন।

অতঃপর বাদ আছর বিকাল ৪-টায় আমীরে জামা‘আতের ইমামতিতে জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। হাযার হযার মানুষের উপস্থিতিতে জানাযাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কোন জানাযায় এত মানুষের উপস্থিতি আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। আমার মতো হয়ত অনেকেই দেখেননি। শফীকুল ভাই সত্যিই ভাগ্যবান। এত মানুষের আন্তরিক দো‘আ নিয়ে কবরে শায়িত হ’লেন। আরও সৌভাগ্য যে, জীবনের শেষ মুহূর্তেও দ্বীনে হক-এর প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর অমর বাণী- ‘নিশ্চয়ই আমলের ভাল-মন্দ নির্ভর করে তার শেষ অবস্থার উপরে’ (বুখারী) তাঁর জীবনে কার্যকর হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ

দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাগরণী শিল্পী ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ জয়পুরহাট যেলার অর্থ সম্পাদক শফীকুল ইসলাম ভাই এভাবেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। কাঁদিয়ে গেলেন গোটা জাতিকে। রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি। মৃত হৃদয়কে জাগিয়ে তোলার মত অসংখ্য তেজস্বী জাগরণী। প্রথম রাতে যিনি অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে হাযার হাযার শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখলেন, মধ্যরাতে তিনিই লাশ হয়ে ফিরছেন এই নির্মম সত্য মেনে নেওয়া যে কতটা কঠিন, কতটা মর্মান্তিক, কতটা বেদনাবিধুর তা বলে বা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আর তাবলীগী ইজতেমা ময়দান, যেলা সম্মেলন, দেশের আনাচে-কানাচের সভা-সমাবেশ শফীকুল ইসলামের সুললিত কণ্ঠের জাগরণী দ্বারা ঝংকৃত হবে না। হয়ত অনেকেই গাইবেন। কিন্তু শফীকুল ভাইয়ের সেই কণ্ঠ আর সরাসরি শুনা যাবে না। সদা হাস্যোজ্জল প্রিয় শিল্পীর চিরবিদায়ে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও বেদনাহত। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন-এটিই আমাদের হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা। আল্লাহ তুমি কবুল কর-আমীন!!

[আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী প্রধান শফীকুল ইসলামের স্মৃতিতে প্রেরিত লেখনী সমূহ লেখকের নামে এই কলামে প্রকাশিত হবে। -সম্পাদক] 


[আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী প্রধান শফীকুল ইসলামের স্মৃতিতে প্রেরিত লেখনী সমূহ লেখকের নামে এই কলামে প্রকাশিত হবে। -সম্পাদক]




এক পিতার ঘরে ফেরা... - শরীফা বিনতে আব্দুল মতীন
জেল-যুলুমের ইতিহাস (৩য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
আমীনুলের কিছু স্মৃতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমাদ খান : কিছু স্মৃতি - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
ইসলামী জাগরণীর প্রাণভোমরা শফীকুল ইসলামের ইন্তেকালে স্মৃতি রোমন্থন - মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম প্রধান
তাবলীগী ইজতেমার সেই রজনী! - শামসুল আলম
জেল-যুলুমের ইতিহাস (২য় কিস্তি) - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
স্মৃতির দর্পণে আমীনুল ভাই - ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন
স্মৃতির আয়নায় তাবলীগী ইজতেমা
তাবলীগী ইজতেমা ২০০৫ : প্রসঙ্গ কথা - শামসুল আলম
তাবলীগী ইজতেমা ২০১৮ : টুকরো স্মৃতি - মুহাম্মাদ বেলাল বিন ক্বাসেম
দায়িত্বশীলতা ও আদর্শিকতার এক মূর্ত প্রতীক - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.