পরবর্তী দিনগুলো :
নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের দ্বিতীয় দিনের পর কয়েকদিন আমরা মোহনপুর থানার
টেমা গ্রামের মোযাহার মেম্বারের বাড়ীতেই রাত্রি যাপন করি। কেননা লোকালয়
থেকে দূরে চারিদিকে মাটির ঘর বেষ্টিত এই বাড়িটি আমাদের জন্য ছিল অনেকটা
নিরাপদ। সেকারণ দিনের বেলা এদিক সেদিক কাজ করে রাতে আপাতত কয়েকদিন সেখানেই
থাকি। এদিকে মারকাযের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে শান্ত্ব হ'তে শুরু করেছে।
আসা-যাওয়া করা যাচ্ছে। পুলিশ পাহারাও ক্ষাণিকটা হ্রাস পেয়েছে। যে
যুদ্ধংদেহী পরিবেশ ছিল তা কিছুটা শিথিল হয়ে আসছে।
এ সময়ে মারকাযের শিক্ষকমন্ডলী ও ছাত্রদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। আমীরে জামা‘আত সহ নেতৃবৃন্দের বিয়োগ ব্যথায় কাতর ছাত্ররা শিফটিং পদ্ধতিতে সার্বক্ষণিক পাহারার মাধ্যমে গোটা মারকাযের নিরাপত্তা দানে তৎপর থাকে। যে পরিবেশে ভয়ে ভীত হয়ে ছাত্রদের পালিয়ে যাওয়ার কথা, সে পরিবেশে দৃঢ় মনোবল নিয়ে মারকাযে অবস্থানকে খাট করে দেখার কোন উপায় নেই। শিক্ষকগণও ক্লাস বন্ধ না করে সাহসের সাথে যথারীতি ক্লাস চালু রাখেন।
মারকাযে পুলিশী তল্লাশি : এরি মধ্যে ২রা মার্চ বুধবার পুলিশের একটি বিশাল বহর আমীরে জামা‘আতের বাসা, কেন্দ্রীয় আন্দোলন অফিস, মাসিক আত-তাহরীক অফিস ও কেন্দ্রীয় যুবসংঘ অফিসে তল্লাশি চালায়। দুপুর ১টায় স্থানীয় শাহ মখদুম থানার ৮/১০টি গাড়ীর একটি বিশাল বহর এসে এসব অফিস ঘিরে ফেলে। অতঃপর দীর্ঘ ৩ ঘন্টা ধরে চলে চিরুনী অভিযান। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের তৎকালীন ডেপুটি কমিশনার লোকমান হাকীমের নেতৃত্বে শ্বাসরুদ্ধকর এ অভিযান চালানো হয়। এসময় পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ এবং র্যাব সদস্যরাও আশপাশের এলাকায় সশস্ত্র টহল দেয়। আমীরে জামা‘আতের বাসার বিভিন্ন কক্ষ, তাঁর ব্যক্তিগত লাইব্রেরী, কম্পিউটার রুম ইত্যাদি তন্ন তন্ন করে তল্লাশি চালানো হয়। অবশেষে কিছু না পেয়ে কম্পিউটারের হার্ডডিস্ক, মোবাইলের সিম কার্ড, কিছু বই-পুস্তক, পত্রিকা, পাসপোর্ট, টেলিফোন ইনডেক্স ইত্যাদি জব্দ করে নিয়ে যায়। যা অদ্যাবধি পাওয়া যায়নি।
আমীরে জামা‘আতের বেতন-ভাতা বন্ধ : ৪ঠা মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমীরে জামা‘আতের বেতন-ভাতা সাময়িকভাবে স্থগিত করে দেয় মর্মে সংবাদ প্রকাশিত হয়। এ বিষয়ে রিপোর্টের ভিত্তিতে জানা যায়- বিভাগীয় চেয়ারম্যান প্রফেসর আব্দুল হক সাংবাদিকদের বলেন, ফেব্রুয়ারী’০৫ মাসের বেতন-ভাতার বিলের সঙ্গে ড. গালিব ছাহেবের বিলের কাগজপত্র বিভাগে না আসায় তিনি হিসাব পরিচালকের দফতরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন যে, ড. গালিব গ্রেফতার থাকায় তার বেতন-ভাতা স্থগিত করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিষ্ট্রার অধ্যাপক আব্দুস সালাম বলেন, তিনি পুলিশী হেফাযতে থাকায় তার বেতন-ভাতা সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে। তবে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়নি। সাংবাদিকদেরকে রেজিষ্ট্রার আরও জানান, বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এখনো কোন তদন্ত করেনি। পত্র-পত্রিকা মারফত জানতে পেরে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কি চমৎকার আইন! কেউ গ্রেফতার হলেই তার সবকিছু শেষ! তিনি দোষী না নির্দোষ এ ব্যাপারে কি কিছুই ভাববার নেই। তার পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব কে নিবে? দুর্ভাগ্য, এই ধরনের অমানবিক আইনেই চলছে দেশ, চলছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ।
ব্যাংক একাউন্ট ফ্রিজ : নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারের পর একের পর এক বিপদ যেন ধেয়ে আসতে থাকে। এরি মধ্যে আমীরে জামা‘আতের নিজস্ব একাউন্ট সহ ‘আন্দোলন’-এর সকল একাউন্ট ফ্রিজ করা হয়। এ সম্পর্কে ৫ই মার্চ’০৫ রোজ শনিবারের দৈনিক ‘যুগান্তর’ সহ একাধিক দৈনিক পত্রিকায় রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। একটি গোয়েন্দা সংস্থা ব্যাংক একাউন্টগুলোর খোঁজ-খবর নিচ্ছে বলেও সংবাদে উল্লেখ করা হয়। এতে ‘আন্দোলনে’র আর্থিক মেরুদন্ড ভেঙ্গে যায়। দেশ-বিদেশের শুভানুধ্যায়ীরা মযলূম নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে ব্যর্থ হন।
একশ্রেণীর সাংবাদিকের নেতিবাচক ভূমিকা: মারকাযের পরিবেশ ক্রমান্বয়ে স্বাভাবিকের দিকে ফিরে আসতে শুর করলেও সাংবাদিকদের দৌরাত্ম মোটেও কমেনি। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন সাংবাদিকের আগমন, ছবি উঠিয়ে নেওয়া, ছাত্রদের জিজ্ঞাসাবাদ, এলাকার লোকদের জিজ্ঞাসাবাদ ইত্যাদি চলতে থাকে অনেকদিন। এমনকি ঢাকা থেকে বিশেষ রিপোর্টারদের মারকাযে এসে তথ্য সংগ্রহ করতেও দেখা গেছে। দুঃখজনক হচ্ছে- অধিকাংশ সাংবাদিকই আসতেন নেতিবাচক মানসিকতা নিয়ে। ফলে বাস্তবে যাই তারা দেখুন বা শুনে যান না কেন, নিজ ডেস্কে বসে আকর্ষণীয় একটি গল্প বানিয়ে তা পত্রিকায় ছেপে দিতেন।
‘হলুদ সাংবাদিকতা’ শব্দটির সাথে পূর্বপরিচিতি থাকলেও এর বাস্তবতা ইতিপূর্বে ততটা উপলব্ধি করিনি, যতটা আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতারের পর তাঁকে ও আহলেহাদীছ আন্দোলনকে নিয়ে প্রকাশিত উদ্ভট সব রিপোর্ট পড়ে উপলব্ধি করেছি। ১ কে ১১ বানানো সহজ। কিন্তু এ শ্রেণীর সাংবাদিকরা ০ কে ১১ বানাতে পারঙ্গম। এ প্রসঙ্গে সে সময়ে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত কিছু উদ্ভট রিপোর্টের সার সংক্ষেপ তুলে ধরলে বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যাবে।-
(১) ২৫ ফেব্রুয়ারী’০৫। গ্রেফতারের পরের শুক্রবার। দারুল ইমারত কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে খুৎবা দেওয়ার মত কেউ নেই। ফলে জুম‘আর খুৎবা দেন ইজতেমা উপলক্ষ্যে সুদূর কুমিল্লা থেকে আগত আমার বয়োবৃদ্ধ শ্বশুর, সঊদী মাবঊছ ও কোরপাই সিনিয়র ফাযিল মাদরাসার শিক্ষক হাফেয আব্দুল মতীন সালাফী। ইজতেমা বাতিল হওয়ায় পরদিন শনিবার তিনি পুনরায় কুমিল্লা চলে যান। অথচ রাজশাহীর একটি আঞ্চলিক পত্রিকায় বড় অক্ষরে লীড নিউজ হয়- ‘তাহরীক সম্পাদকের শ্বশুর গ্রেফতার ও তাহরীক সম্পাদক পলাতক’। একই নিউজ জাতীয় একটি দৈনিকেও ছাপা হয়। সেখানে আরো বৃদ্ধি করে লেখা হয় যে, সালাফী ভবনের পিছনের পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ভারী অস্ত্র’। রিপোর্ট পড়ে আমরা হতবাক। অথচ বাস্তবে কুমিল্লায় সালাফী ভবনের পিছনে কোন পুকুরই নেই। আর তার গ্রেফতারের এই রিপোর্ট যখন পাঠকদের হাতে, তখন তিনি স্বাভাবিকভাবে নিজ বাড়ীতেই অবস্থান করছেন।
(২) আমীরে জামা‘আত তখন ‘জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে’ (জেআইসি) রিমান্ডে আছেন। প্রতিদিনই আমরা পত্রিকায় চোখ রাখছি এবং অসংলগ্ন ও মিথ্যা রিপোর্টের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করছি। ২রা মার্চ বুধবার কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ‘জেআইসিতে জিজ্ঞাসাবাদে ড. গালিব’ শিরোনামে খবর বের হল যে, ড. গালিব বিগত চার বছরে ২৪ বার ভারত গমনের কথা স্বীকার করলেন। রিপোর্টটি পড়ে চোখ ছনাবড়া হয়ে গেল। পত্রিকা পড়ে যে কেউ এটি বিশ্বাস করবেন। যেহেতু তার নিজের স্বীকারোক্তি। জেআইসির জিজ্ঞাসাবাদের জবাব। কাজেই অবিশ্বাসের আর কি কারণ থাকতে পারে। যার প্রমাণ পেয়েছিলাম দৈনিক ‘আমার দেশ’ কার্যালয়ে গিয়ে তৎকালীন বার্তা সম্পাদক সৈয়দ আবদাল হোসাইনের সাথে কথা বলে। তিনিও ঐ রিপোর্টের ভিত্তিতেই বলতে লাগলেন, ভারতের সাথে ড. গালিব ছাহেবের একটা গোপন সম্পর্ক আছে। মাঝে-মধ্যেই তিনি ভারত যেতেন। জিজ্ঞাসাবাদে তো তিনি স্বীকার করেছেন চার বছরে ২৪ বার ভারত গমনের কথা। সৈয়দ আবদাল ছাহেব আরেক ধাপ বাড়িয়ে বললেন যে, তিনি ভারত হয়ে লন্ডন যাতায়াত করতেন।
অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। চার বছরে ২৪ বার তো দূরের কথা সারা জীবনে তিনি ৪ বারও ভারত যাননি। মূলত ২০০০ সালের পরে তিনি দেশের বাইরেই যাননি। সে বছর সর্বশেষ সঊদী সরকারের রাজকীয় মেহমান হিসাবে হজ্জ সফরে গিয়েছিলেন। এটিই ছিল তার সর্বশেষ দেশের বাইরে সফর। অথচ জেআইসির বরাতে কত জঘন্য মিথ্যাচারই না করল সাংবাদিক নামের কলঙ্ক এইসব লোকেরা। অতঃপর ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর পক্ষ থেকে এই মিথ্যা রিপোর্টের প্রতিবাদ জানিয়ে পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হল। যা ৪ঠা মার্চ তারিখের দৈনিক ‘ইনকিলাবে’ ‘ড. গালিবের ২৪ বার ভারতে যাওয়ার সংবাদ ভিত্তিহীন’ শিরোনামে এবং দৈনিক সংগ্রামে ‘ড. গালিব চার বছরে একবারও ভারতে যাননি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
(৩) ৬ মার্চ রবিবার দৈনিক ‘আমার দেশ’ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় আমীরে জামা‘আত রচিত ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইয়ের প্রচ্ছদের ছবি সহ একটি রিপোর্ট ছাপা হয়। শিরোনাম দেওয়া হয় ‘জিহাদের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলই ছিল ড. গালিবের লক্ষ্য’। এই রিপোর্টে আমীরে জামা‘আত রচিত ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বই সহ অন্যান্য বইয়ের ন্যাক্কারজনক অপব্যাখ্যা করা হয়। রিপোর্টের উল্লেখযোগ্য অংশগুলি নিম্নরূপ:
‘রাজশাহী ভার্সিটির গ্রেফতারকৃত শিক্ষক ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের জিহাদের মাধ্যমে সমাজে বিপ্লব করে রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার প্রত্যাশা ছিল। এজন্য তিনি তার কর্মী বাহিনীকে জান-মালের চরম ত্যাগ স্বীকার করে চিরন্তন জিহাদে এগিয়ে আসার আহবান জানান। আহলে হাদিস আন্দোলন বাংলাদেশের আমির ড. গালিব তার লেখা ১৬টি বইয়ের সর্বত্রই তার কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, ‘জিহাদ ব্যতীত তাওহিদ প্রতিষ্ঠা ও জাহান্নাম থেকে মুক্তির আর কোন পথ মুমিনের জন্য খোলা নেই। অন্য এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ইসলামী অর্থনীতির পরিপন্থী। তাই এসব মত পরিহার করে নির্ভেজাল ইসলামী রাজনীতি কায়েম করতে হবে’। তার লেখা ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ ‘ইসলামী খেলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন কি ও কেন’ এবং ‘উদাত্ত আহবান’ বইয়ের বিভিন্ন স্থানে তিনি এসব সার কথা তুলে ধরেন। ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইতে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘সৈয়দ আহমাদ ব্রেলভী ও আল্লামা ইসমাঈল শহীদের ‘জিহাদ আন্দোলন’, মাওলানা সৈয়দ নিছার আলী তিতুমীরের ‘মোহাম্মাদী আন্দোলন’ ও হাজী শরীয়তুল্লাহর ‘ফারায়েজী আন্দোলনে’র স্টাইলে আমরা বিপ্লব চাই।’... ড. গালিব তার ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইতে আরো লিখেছেন, ‘জাহান্নামের কঠিন আজাব হতে বাঁচার দ্বিতীয় শর্ত হলো জিহাদ’। আবার লিখেছেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে ও মহল্লায় আল্লাহর সেনাবাহিনী হিসেবে বয়স্ক ও তরুণদের একটি জামায়াতে সংগঠিত হতে হবে, যারা আমিরের নির্দেশনা মোতাবেক পবিত্র কুরআন ও ছহিহ হাদিস অনুযায়ী নিজেদের জীবন, পরিবার ও সমাজ গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হবেন’। একই বইয়ে উল্লেখ করেছেন, ‘আল্লাহকে রাজি-খুশি করার জন্য ন্যায়ের আদেশ ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করাই জিহাদ। আর এর মাধ্যমেই আসে কাঙ্খিত সমাজ বিপ্লব’। এই বইয়ের শেষ দিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘জানি না বিগত কয়েক বছরের চেষ্টায় আমরা কতজন বিপ্লবী কর্মী সৃষ্টি করতে পেরেছি। তবে আমাদের আন্দোলন যে ইতোমধ্যে বাতিলের হৃদয়ে দুরু দুরু কম্পনের সৃষ্টি করেছে তা স্পষ্ট হয়ে গেছে। এতদিন বাইরের হুমকি মোকাবিলা করেছিলাম, এখন অভ্যন্তরীণ হিংসার মোকাবিলা করতে হচ্ছে।’... ইসলামী খিলাফত ও নেতৃত্ব নির্বাচন’ বইয়ে তিনি লিখেছেন ‘ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ধর্মীয় স্বৈরাচার এবং গণতন্ত্রের নামে দলীয় স্বৈরাচার ও নেতৃত্বের লড়াই এখন ঘরে ঘরে ও অফিসের চার দেয়ালের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ন্যায়নীতি ও ন্যায়বিচার এখন সন্ত্রাসীদের লালনকারী নেতা-নেত্রী ও শক্তিমানদের একচ্ছত্র অধিকারে’।... তিনি লিখেছেন, ‘আজো যদি কুফরী শক্তি অস্ত্র নিয়ে ইসলামী দেশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তবে প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর উপরে সশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ ‘ফরজে আইন’ হবে’।...‘বর্তমানে মুসলিম সমাজের ব্যাপক অধপতনের মূল কারণ জিহাদ বিমুখতা’র কথা তুলে ধরা হয়েছে তাঁর ‘সমাজ বিপ্লবের ধারা’ বইয়ে। এ বইয়ে তিনি মুক্তির পথ জিহাদের জন্য তিনটি বিষয়ে খেয়াল রাখতে বলেছেন। বিষয় তিনটি হলো : ১. নিজেকে সব সময় জাহেলিয়াতের ময়দানে যুদ্ধরত সৈনিক মনে করা, ২. শাহদত পিয়াসী সৈনিকের বাঁচার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুতে সন্তুষ্ট থাকা এবং যাবতীয় প্রলোভন বিলাসিতা থেকে দূরে থাকা ও ৩. আমাদের প্রতিটি কর্ম ও আচরণ কেবলমাত্র আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে হওয়া’।...
এভাবে তাঁর বিভিন্ন বইয়ের জিহাদ সম্পর্কিত অংশগুলো উপস্থাপন করে রিপোর্টার জঙ্গীবাদের সাথে আমীরে জামা‘আতের সম্পৃক্ততা খোঁজার অপচেষ্টায় ঘর্মাক্ত হয়েছেন। আসলে জিহাদ ও জঙ্গীবাদের পার্থক্যই বিদেশী খুদ-কুঁড়ো খাওয়া এ ধরনের সাংবাদিকরা বুঝে না। জিহাদ ও জঙ্গীবাদকে এরা একাকার করে দেখছে। ফলে কুরআন-হাদীছের যেখানেই ‘জিহাদ’ শব্দ দেখে, সেখানেই এরা জঙ্গীবাদের গন্ধ খুঁজে বেড়ায়। কি পরিমাণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলে এভাবে অপব্যাখ্যা করে রিপোর্ট লেখা যায় তা বলাই বাহুল্য।
৭ই মার্চ’০৫ তারিখে জাতীয় সংসদে প্রশ্নোত্তরকালে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম. মোরশেদ খান বলেছিলেন, ‘আজকাল কিছু কিছু সংবাদপত্র পড়লে মনে হয় যেন তারা দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে’। আমাদেরও তখন মনে হয়েছে যে, কতিপয় সংবাদপত্র মনে হয় আমীরে জামা‘আত ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ভাবখানা এই যে, যে করেই হোক তাঁকে জঙ্গী নেতা প্রমাণ করতেই হবে। ক্ষুন্ন করতে হবে দেশ-বিদেশে তাঁর ভাবমূর্তি। স্বাধীন এই মুসলিম দেশটিকে আন্তর্জাতিক বাজারে পরিচিত করতে হবে একটি জঙ্গী ও সন্ত্রাসী রাষ্ট্র হিসাবে। তাই শিরোনাম দেখেই লুফে নেওয়া হয়েছে ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইটিকে।
যদি প্রশ্ন করা হয় যে, ড. গালিব তাঁর ‘দাওয়াত ও জিহাদ’ বইয়ের কোথাও কি বলেছেন যে, সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে দেশের প্রতিষ্ঠিত সরকারকে অপসারিত করে ক্ষমতা দখল করতে হবে? তখন তাদের আর কোন উত্তর থাকে না। মূলতঃ উক্ত বইয়ে জিহাদ সম্পর্কিত যে সকল বক্তব্য উপস্থাপিত হয়েছে তাদের মগজ তা সঠিক ব্যাখ্যা সহ ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে এরা গোলক-ধাঁধায় পড়েছে এবং মুহূর্তেই জঙ্গী কানেকশনের মিথ্যা ও চাঞ্চল্যকর তথ্য আবিষ্কারের অপপ্রয়াস চালিয়েছে। অথবা এর আরেকটি কারণ এই হ’তে পারে যে, এরা বইটি হাতেই নিয়েছে আমীরে জামা‘আতকে জঙ্গী বানানোর মানসিকতা নিয়ে। ফলে এর মধ্যে ভাল কিছু থাকলেও তাদের নজরে পড়েনি। এছাড়া তাঁর লেখা ‘ইক্বামতে দ্বীনঃ পথ ও পদ্ধতি’ বইয়ে প্রচলিত জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে বিস্তর লেখনী থাকলেও এগুলো এ শ্রেণীর সাংবাদিকদের নজরে পড়েনি।
[ক্রমশঃ]