নিস্তব্ধ-নিঃসাড় গভীর রজনী। চারিদিকে ঝিঝি
পোকার ডাক, ডাহুক-ডাহুকীর অশান্ত কিচির-মিচির শব্দে যেন ঘুম আসে না। এদিকে
কাল ২৩শে ফেব্রুয়ারী (২০০৫) ১৫তম বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা। নওদাপাড়া,
রাজশাহীর এই ইজতেমার আমেজ চারিদিকে উৎসবের আনন্দে সর্বসাধারণের মনে দারুণ
উচ্ছাস; যেন নতুন সাজে সজ্জিত। এবার অনেক... অনেক লোকের ভীড় হবে। দেশের
প্রত্যন্ত এলাকা থেকে প্রতি বছরের চেয়ে এবার বিপুলসংখ্যক লোকের সমাগম হবে,
ধর্মীয় মিলন মেলায় রূপ নিবে ইজতেমা ময়দান। এজন্য সব প্রস্ত্ততি সম্পন্ন।
সন্ধ্যালগ্ন, সূর্যটি লাল আভা শেষে পশ্চিম দিকে অস্ত পথে। হঠাৎ দেখা যায় নতুন কিছু লোকের আনাগোনা। দেখতে দেখতে ডজন ডজন সাদা পোষাকধারী লোকের আগমন। জিজ্ঞেস করা হ’ল কি আপনাদের পরিচয়? তারা বললেন, আমরা পুলিশ প্রশাসনের লোকজন। অনেক বড় অফিসারও বটে তারা। কিন্তু তারা সব অপরিচিত। আমরা বললাম, আপনারা হঠাৎ এখানে এলেন? তারা বললেন, কাল আপনাদের ইজতেমা। এটা যেন সুষ্ঠু-সুন্দর হয় সেজন্য। সেই সাথে ডঃ গালিব স্যারের নিরাপত্তার জন্য আমরা এসেছি। কারণ দেশের বর্তমান অবস্থা ভাল নয়। চারিদিকে জেএমবি ও জেএমজেবির অপতৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাত প্রায় এগারোটা। আমরা বিষয়টি ঠাওর করতে পারছি না। আমীরে জামা‘আতের বাসার আশপাশে ও মাদরাসার চারিদিকে সাদা পোষাকধারীদের ব্যাপক আনাগোনা। মাদরাসা ও আন্দোলন অফিসের চারপাশ ভরে গেছে তাদের উপস্থিতিতে। আমরা সন্দেহের বশে আবার জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের আসল উদ্দেশ্য কি? আত-তাহরীক অফিসে বসা অফিসাররা বললেন, দেখুন, আপনারা যা ভাবছেন তা ঠিক নয়। আমরা উপরের নির্দেশে এসেছি, যেন আপনাদের ইজতেমা সুষ্ঠুভাবে হয় এবং স্যারের যেন কোন ক্ষতি না হয় সেজন্য এখন থেকে কয়েকদিন যাবৎ দিন-রাত তার নিরাপত্তা বিধান করাই আমাদের উদ্দেশ্য। আপনারা নিশ্চিন্তে গিয়ে যে যার মত চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ুন। আপনাদের নিরাপত্তার সব দায়-দায়িত্ব আমাদের উপর। এটা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব (?)
হায় তারা সহজ-সরল বিশ্বাসী আমাদেরকে ঠিকই সেদিন ঘুম পাড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। ভুলেও কখনও ভাবতে পারিনি যে, এত বড় ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে। হ্যাঁ, ঠিকই তো করেছি। কারণ আমরা তো সরকারের বিরুদ্ধবাদী নই। কারও শত্রুও নই। নিজেদের আত্মবিশ্বাস, অসীম সাহস ও সরলতা নিয়ে আমরা যে যার মত কেউ মাদরাসায়, কেউ অফিস সংলগ্ন শয়নকক্ষে, কেউ বাসায় গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ি।
আমি
বাসায় ফিরি অনেক রাতে। সেদিন আনন্দে যেন আমার ঘুম আসছিল না। এরই মধ্যে কখন
যে গভীর ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছে, টের পাইনি। হঠাৎ মাঝ রাতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ
শব্দে চমকে উঠি। অজানা আশঙ্কায় অন্তর কেপে ওঠে। আযান দিয়েছে কি দেয়নি।
সুখনিদ্রায় আমি শায়িত আছি। ঘুমের মধ্যে কার যেন চাপা কণ্ঠস্বর ভেসে এল
দরজার ওপাশ থেকে। হ্যাঁ অন্য কেউ নয়, কাবীরুল ভাইয়ের কণ্ঠ মনে হ’ল। কণ্ঠটি
এমন- আলম ভাই তাড়াতাড়ি উঠুন, খবর ভাল না। আমি ধড়ফড় করে উঠে পড়লাম। কে, কি,
কেন? দরজা খুললাম, কি হয়েছে? তিনি বললেন, আমীরে জামা‘আতকে ওরা ধরে নিয়ে
গেছে! সালাফী ছাহেব, নূরুল ইসলাম ও আযীযুল্লাহ ভাইকেও নিয়ে গেছে রাত
দু’টার দিকে। শুনে বললাম, ইন্না লিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজেঊন। আকাশ
ভেঙ্গে যেন মাথায় ধপাস করে পড়ল।
বুঝলাম ওরা (পুলিশরা) আমাদেরকে ধোঁকা দিয়েছে। কাবীরুল ভাই বললেন, আপনি গুছিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ুন। ওরা এদিকেও ধাওয়া করতে পারে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ-নির্বাক রইলাম। জারিনের আম্মু উঠে অত্যন্ত ভীতবিহবল কণ্ঠে বলল, কি হয়েছে? বললাম, ওরা আমীর জামা‘আতকে ধরে নিয়ে গেছে। বলল, কেন? বললাম, সম্ভবত জোট সরকার আমাদের ইজতেমা হ’তে দেবে না। সে বলল, না, ওরা হয়ত আমীর ছাহেবকে আর ছাড়বে না। সেদিন আমিও ভাবতে পারিনি যে, তার কথাই সত্যি হবে।
হ্যাঁ, সাদা জ্যোৎস্নার আলোতে সেদিন জগৎ উদ্ভাসিত থাকলেও কালো মেঘে যে আকাশ ঢাকা ছিল, তা বুঝতে পারিনি। আমি ভাবতেও পারিনি দীর্ঘ ১৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী ইজতেমা আজ হবে না। আজ না হ’লে ভবিষ্যতেও ওরা হ’তে দিবে না। ওযূ করে দু’রাক‘আত ছালাতুল হাজত আদায় করে নতুন সাজে সজ্জিত হয়ে পরিবারের নিকট থেকে দো‘আ চেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বললাম, আমি হয়ত বাসায় আর নাও ফিরতে পারি। কারণ নেতৃবৃন্দ যখন জেলে গেছেন, আমাকেও হয়ত ঐ লাল ঘরে চৌদ্দ শিকের অন্তরালে যেতে হ’তে পারে! শুরু হ’ল জীবনের নতুন অধ্যায়। এক সংগ্রাম, এক জিহাদ, বাঁচার লড়াই। সে সংগ্রাম নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। আহলেহাদীছ আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। উত্তর নওদাপাড়ার ভাঙ্গা বেড়ার মসজিদে আছেন আত-তাহরীক সম্পাদক সাখাওয়াত ছাহেব, মুযাফফর, ডাঃ সিরাজ আরও অনেকে। আমরা ফজরের ছালাত আদায় করি। পরামর্শ করে বেরিয়ে যাই মেয়র মিনুর কাছে। তার আগে বিএনপি নেতা জনাব আব্দুল মতীনের কাছে গেলাম। আমাদের সাথে যোগ হ’লেন আব্দুল লতীফ ভাই। দেখা হ’ল, তেমন কাজ হ’ল না। কারণ মেয়র তখন ঢাকায়। তবে তাঁর সাথে কথা হয়েছে। আমাদের কোন চিন্তা না করতে বলেলেন। তিনি আরো বলেলেন, সরকার কয়েকদিনের মধ্যেই তাঁদেরকে ছেড়ে দিবে।
হ্যাঁ, পুলিশের মত আমরা আবার তাঁর কথাও বিশ্বাস করলাম। ভাবলাম হয়তবা বিশেষ কোন কারণে সরকার তাদেরকে ধরেছেন। আবার ছেড়েও দিবেন তাড়াতাড়ি। যাহোক আমরা ঐ ক’জন মিলে নওদাপাড়া বাজার মসজিদে বসে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম যে, এখন আমাদের করণীয় হচ্ছে কোর্টের শরণাপন্ন হওয়া। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ফাইল মাদরাসায়, আন্দোলন অফিসে। এই গুমোট পরিস্থিতিতে ওখানে কে যাবে? মাদরাসা থেকে ইজতেমার ময়দান ট্রাক টার্মিনাল পর্যন্ত পুলিশ, বিডিআর, রিজার্ভ ফোর্স ও র্যাব-এর কয়েক হাযার সদস্য ঘিরে রেখেছে। কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বললাম, আমি যাব। আল্লাহর নাম নিয়ে রিক্সাযোগে গিয়ে মাদরাসায় প্রবেশ করলাম গ্রেফতারের ঝুঁকি নিয়ে। নিরাপত্তা বাহিনীর নিশ্ছিদ্র বেষ্টনী ভেদ করে সেদিন মাদরাসায় ও আন্দোলন অফিসে প্রবেশ করা ছিল অত্যন্তদুঃসাধ্য বিষয়। মোবাইলে ডাকার বেশ কিছুক্ষণ পর আনোয়ার ভাই আসল। এর মধ্যে আত-তাহরীক অফিস খুললাম। পিওনকে আন্দোলন অফিস খুলে রাখতে বললাম। মাদরাসার রুমে রুমে ঘুরে ছাত্রদের ধৈর্য ও সাহসের সাথে স্বাভাবিক থাকতে বললাম। ফাইল নিয়ে বেরিয়ে গেলাম কোর্টের উদ্দেশ্যে। থানার কক্ষে ও কোর্টে নেতৃবৃন্দকে দেখে মনটা যেমন ব্যথিত হয়ে উঠল, তেমনি ক্ষোভে ফেটে পড়লাম ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী ৪ জোটের শাসকদের নারকীয় কার্যক্রম দেখে। তখন একটাই প্রশ্ন আমাদের ইজতেমা তাহ’লে হবে না? এর মধ্যে শত শত মানুষ দূরদূরান্ত থেকে এসে ভীড় জমিয়েছে ইজতেমা মাঠে। কিন্তু মানুষ আসলে কি হবে? ততক্ষণে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। পুলিশ প্যান্ডেল ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। হায়রে আহলেহাদীছদের প্রাণের ইজতেমা এক নিমিষে ভন্ডুল হয়ে গেল। ভাবলাম, ইজতেমা বন্ধ করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু না, তাদের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্ন রকম। কয়েকদিনের মধ্যে যখন নেতৃবৃন্দের উপর একটার পর একটা কেস চাপানো হ’ল, তখন টের পেয়ে গেলাম তাদের আসল উদ্দেশ্য। নওগাঁ, বগুড়া, গাইবান্ধা, গোপালগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ নাটোরে পূর্বের ১০/১২টি কেস তাঁদের উপর চাপানো হ’ল। রাষ্ট্রদ্রোহী মামলাও করা হ’ল। এ কোর্ট থেকে ও কোর্ট। এক যেলা থেকে আরেক যেলায় অমানবিকভাবে টানা-হেঁচড়ার দৃশ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বের লোক অবাক বিস্ময়ে অবলোকন করল। প্রকৃত অপরাধীদের সাথে একাকার করে সর্বত্র নানা কল্পকাহিনী রচনা করে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করছে মিডিয়া। গোটা মানব সমাজ অপলক দৃষ্টিতে কেবল দেখছে নীরব দর্শকের মত। তাদের যেন করার কিছুই নেই।
এই পরিস্থিতিতে প্রফেসর ডঃ গালিব ছাহেবের দলের কর্মীরা নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। তারা কখনও ময়দান ছাড়েনি। কর্মীদের প্রতিবাদ, দাবী-দাওয়া, আন্দোলন-সংগ্রাম, তাওহীদপন্থী জনগণের ঐকান্তিক দো‘আ এবং আল্লাহর অশেষ করুণার ফলে ড. গালিব ও তাঁর দলের বিজয় হয়েছে। কত ত্যাগ-তিতীক্ষা, কত ধৈর্য, কত কর্মীর উপর জেল-যুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন! তা যেন ফেরাঊনের শাসনকেও হার মানিয়েছিল। আসলে ওরা চেয়েছিল আহলেহাদীছ আন্দোলনকে বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। যুগে যুগে এ রকম ষড়যন্ত্র ও নীলনক্সা চলেছে। বহুপূর্ব থেকেই এসব চালু ছিল, আজও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কিন্তু দ্বীনে হক্ব কেউ মুছে দিতে পারবে না।
ঘরের শত্রুরাও ষড়যন্ত্রের জাল বহু দূর পর্যন্ত বিস্তৃত করেছিল। দেশী-বিদেশী এজেন্টরাও এতে অংশ নিয়েছিল যেন আমীরে জামা‘আত বের হ’তে না পারেন। কখনও যেন নওদাপাড়ার মাটিতে তাবলীগী ইজতেমা না করতে পারেন। সারা দেশের পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী তাওহীদপন্থীরা যেন কখনও এক না হ’তে পারে। বরং তারা যেন বাতিলপন্থী দলের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। কিন্তু তাদের সে ষড়যন্ত্র সফল হয়নি। উপরন্তু আলাহভীরু ও হকপন্থী লোকের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। সংগঠনের অধীনে প্রকাশিত ও প্রচারিত বই-পুস্তক, পত্র-পত্রিকা, সংগঠনের উদ্যোগে আয়োজিত সভা-সমাবেশ, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম প্রভৃতির মাধ্যমে প্রচার-প্রসারে এ আন্দোলনের দাওয়াত শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সবার নযর এখন নওদাপাড়া, রাজশাহীর দিকে। কুরআন ও ছহীহ হাদীছ প্রচারের বাতিঘরে পরিণত হয়েছে এটি।
অবশেষে ২৮শে আগষ্ট ২০০৮ তারিখে দীর্ঘ ৩ বছর ৬ মাস ৬দিন কারাভোগের পর সকল বাধা ও ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। মুক্ত হয়ে ফিরে আসেন নওদাপাড়ার মাটিতে। সকল শূন্যতায় আজ বিশুদ্ধ বাতাস বয়ে যায়, আকাশ আজ রাহুমুক্ত। ঘন নীলিমা হয়ে ওঠে স্বচ্ছ-নিরেট, স্ফটিক সদৃশ। সকলের কাছে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যায়। রাতারাতি নওদাপাড়া আবার পূর্ণ হয় জনারণ্যে।
বছর ঘুরে ফিরে আজ ২২তম বার্ষিক তাবলীগী ইজতেমা। রাজশাহীবাসীর মধ্যে আবার ধর্মীয় উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে, আবেগের জোয়ার শুরু হয়েছে। ২৩ ও ২৪ ফেব্রুয়ারী ’১২-এর তাবলীগী ইজতেমা আবার প্রমাণ করবে হককে মুখের ফুৎকারে নিভিয়ে দেওয়া যায় না।। এ দ্বীনের প্রচারকে পৃথিবীর কোন শক্তি প্রতিহত করতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না ইনশাআল্লাহ।
আসিছে প্রভাত
আলোকে রঙীন
দূরীবে অাঁধার যত
দৃপ্ত পদে সরাবো মোরা
পথের জঞ্জাল শত শত।
যত বাধা, জেল-যুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন, ষড়যন্ত্র আসুক না কেন, তা ছিন্ন করাতে আল্লাহর শক্তিই যথেষ্ট, যদি সত্যিকার অর্থে আমরা দ্বীনে হকের উপর টিকে থাকতে পারি; ঐক্যবদ্ধ জীবন-যাপন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন- আমীন!
শামসুল আলম
শিক্ষক, নওদাপাড়া মাদরাসা, রাজশাহী।