[খতীবে
আযম মাওলানা ছিদ্দীক আহমাদ দেশের একজন উদারমনা প্রখ্যাত হানাফী আলেম
ছিলেন। তিনি ১৯০৩ সালে কক্সবাজার যেলাধীন চকরিয়া উপযেলার বরইতলী গ্রামে
জন্মগ্রহণ করেন। তীক্ষ্ণ ধীশক্তিসম্পন্ন ও উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী দীর্ঘ
৪৩ বছরের এই মহান শিক্ষাবিদ ও রাজনীতিক শেষ জীবনে ৩ বছর পক্ষাঘাতগ্রস্ত
থাকার পর ১৯৮৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন ও নিজ গ্রামে নিজের প্রতিষ্ঠিত জামে‘আ
ইসলামিয়া ফয়যুল উলূম মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে কবরস্থ হন। তিনি চট্টগ্রামের
হাটহাজারী দারুল উলূম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসায় দাওরায়ে হাদীছ ডিগ্রী লাভ করার
পর ১৯২৬ সালে ভারতের সাহারানপুর ও ১৯২৯ সালে দেউবন্দ মাদ্রাসায় লেখাপড়া
করেন। দেশে ফিরে ১৯৩০ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ১৫ বছর হাটহাজারী মাদ্রাসায়
‘মুহাদ্দিছ’ হিসাবে এবং ১৯৬৬ হ’তে ১৯৮৩ পর্যন্ত ১৭ বছর চট্টগ্রামের জামে‘আ
ইসলামিয়া পটিয়া মাদ্রাসায় ‘শায়খুল হাদীছ’ হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি শিরক ও
বিদ‘আতের বিরুদ্ধে বিশেষ করে পীরপূজা, কবরপূজা, কবর পাকা করা, ওরস, হিল্লা
প্রথা, কাদিয়ানী মতবাদ ইত্যাদির বিরুদ্ধে তেজোদ্দীপ্ত ভাষায় বক্তব্য
রাখতেন। ১৯৬৫ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারী ফেনী আলিয়া মাদ্রাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত
ইসলামী সম্মেলনে তাঁকে ‘খতীবে আযম’ উপাধি দেওয়া হয় এবং পরবর্তীতে এই লকবেই
তিনি পরিচিত হন। ভারতে শিক্ষা গ্রহণকালে তিনি মাওলানা আশরাফ আলী থানভী
(১৮৬৩-১৯৪৩ খৃ.)-এর নিকট বায়‘আত গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে তিনি চট্টগ্রামের
হাটহাজারী মাদ্রাসার মুহতামিম মুফতী ফয়জুল্লাহ (১৮৯২-১৯৭৬) ও সাতকানিয়ার
চুড়ামণির পীর মাওলানা শাহ আহমাদুর রহমান (১৮৮৪-১৯৬৪)-এর নিকট হ’তে ‘খেলাফত’
লাভ করেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে
গেছেন। তিনি পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান নেযামে ইসলাম পার্টির সভাপতি
এবং বাংলাদেশ আমলে উক্ত পার্টির আমৃত্যু সভাপতি ছিলেন। তিনি ১৯৫৪ সালের
নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের অঙ্গদল হিসাবে নেযামে ইসলাম পার্টি থেকে
মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক এসেম্বলীর সদস্য
(এম.পি.এ) নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৬ সালের ২৪শে আগষ্ট
৬টি রাজনৈতিক দল নিয়ে গঠিত ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ-আইডিএল-এর তিনি
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮২ সালের ডিসেম্বরে ‘ইত্তেহাদুল উম্মাহ’-র
১ম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে তিনি এই সংগঠনের মজলিসে ছাদারাতের ১ নং সদস্য
নির্বাচিত হন। তাঁর দুই স্ত্রীর গর্ভজাত ৭ পুত্র ও ৬ কন্যার মধ্যে তৃতীয়
জামাতা জামে‘আ ইসলামিয়া পটিয়া-র সুপ্রাচীন মুখপত্র মাসিক আত-তাওহীদ-এর
সম্পাদক ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন গত ১২ ও ১৭ই নভেম্বর পর পর দু’বার রাজশাহী
মারকাযে আসেন এবং তাঁর শ্বশুরের স্মৃতিতে প্রকাশিতব্য স্মারক গ্রন্থের জন্য
মুহতারাম আমীরে জামা‘আত-এর নিকটে তাঁর সম্পর্কে অভিমত ও মন্তব্য লিখিতভাবে
জানাতে অনুরোধ করেন। যা ই-মেইল যোগে তার নিকট পাঠানো হয়।] যেটি নিম্নরূপ-
খতীবে আযম মাওলানা ছিদ্দীক আহমাদ (১৯৮৩-১৯৮৭ খৃ.)-এর সাথে আমাদের পরিচয় স্বল্পকালের জন্য। তাতেই তিনি আমাদের স্মৃতিতে ভাস্বর হয়ে আছেন।
১৯৭৮ সালের ১২ই মে থেকে ২৪শে মে পর্যন্ত প্রতিবেশী দেশ বার্মা থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা মুসলিম ভাই-বোনদের ত্রাণ সহায়তা দানের উদ্দেশ্যে সদ্য গঠিত ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘ’-এর একটি দল নিয়ে আমরা উখিয়া ও নাইক্ষংছড়ির সীমান্তবর্তী এলাকায় গমন করি। আমাদের সাথে ‘লালবাগ জামে‘আ কুরআনিয়া’-র একজন শিক্ষক ও কয়েকজন ছাত্র ছিলেন। সে সময় গঠিত ‘জাতীয় ত্রাণ কমিটি’র তিনজন নেতা উক্ত উদ্দেশ্যে একই সময়ে চট্টগ্রাম যান। তারা হ’লেন পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, নেযামে ইসলাম পার্টির সভাপতি মাওলানা ছিদ্দীক আহমাদ ও সহ-সভাপতি হাজী আক্বীল (বংশাল, ঢাকা)। চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার অফিসে ১২ই মে একটি সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। নেতাদের আবেদনে আমিও সেখানে বক্তব্য রাখি। যাতে খতীব ছাহেব খুবই খুশী হন। আমাদের ত্রাণবাহী ট্রাকগুলি কক্সবাজার রওয়ানা হয়ে যাবে, আমিও সেই সাথে যাব। কিন্তু খতীব ছাহেব ইতিমধ্যে আমার জন্য বিমানের টিকেট কেটেছেন। ফলে আমাকে রেখেই ‘যুবসংঘে’র ট্রাকগুলি কর্মীদের নিয়ে কক্সবাজার চলে যায়। পরে আমি তিন নেতার সাথে চট্টগ্রাম থেকে বিমানে কক্সবাজার যাই। এটাই ছিল আমার জীবনে প্রথম বিমান ভ্রমণ। খতীবে আযমের বদান্যতায় আমরা মুগ্ধ হ’লাম।
কক্সবাজার নেমে হোটেলে বসে ওনারা সংক্ষিপ্ত বৈঠকের পর ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। সেই সাথে আমার উপর দায়িত্ব দিলেন আমাদের ত্রাণের সাথে ওনাদের ত্রাণগুলি একত্রে বিতরণের জন্য। কারণ তাঁদের সাথে কোন কর্মী ছিল না। ওনারা আমাদের জন্য দো‘আ করে ফিরে গেলেন। অতঃপর আমরা গন্তব্যস্থলে গিয়ে প্রচুর বৃষ্টি ও কাদা-পানির মধ্যে দিন-রাত ত্রাণ বিতরণ, ঘর তৈরী, চিকিৎসা সহায়তা প্রভৃতি কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে ২৪শে মে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই।
রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ বিতরণের সফরে প্রাথমিক পরিচয়ের সূত্র ধরে কিছুদিন পর মাওলানা ছিদ্দীক আহমাদ অঘোষিতভাবে একদিন ৭৮ উত্তর যাত্রাবাড়ী মাদ্রাসা মুহাম্মাদিয়া আরাবিয়াতে আসেন। তখন আমি সেখানে ‘মুহতামিম’ ছিলাম। আমরা তাঁকে সসম্মানে অভ্যর্থনা জানালাম। অতঃপর তিনি শিক্ষক ও ছাত্রদের সামনে চেয়ারে বসে নাতিদীর্ঘ ভাষণ দিলেন। ভাষণে তখনকার সময়ের প্রেক্ষিতে কুরআনের সূরা আন‘আম ৭৬-৭৮ আয়াতের তাফসীর পেশ করে বলেন, ‘তাফসীরের নামে যেন আমরা যে কোন তাফসীর পড়ে বিভ্রান্ত না হই’। তিনি পীরপূজা, কবরপূজা, ওরস প্রভৃতি শিরকী ও বিদ‘আতী রসম-রেওয়াজের বিরুদ্ধেও বক্তব্য রাখেন। সেদিন তাঁর সাবলীল ও যুক্তিপূর্ণ ভাষণে আমরা চমৎকৃত হই। তাঁর ইলমের গভীরতায় ও নিরহংকার ব্যবহারে আমরা মুগ্ধ হই। এরপর থেকে আর কোনদিন তাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়নি। তাঁর মত উদারমনা আলেমের সংখ্যা বেশী থাকলে হানাফী সমাজ থেকে তাক্বলীদী গোঁড়ামী অনেকটা হালকা হয়ে যেত এবং আহলেহাদীছদের সঙ্গে তাদের দূরত্ব আল্লাহর রহমতে অনেক কমে যেত। আমরা তাঁকে সর্বদা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতুল ফেরদৌসে স্থান দান করুন- আমীন!
দীর্ঘ চল্লিশ বছর পরে তাঁর জামাতা সুযোগ্য আলেম ও বক্তা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেন-এর সৌজন্যে মুহতারামের স্মৃতিতে কিছু লিখতে পেরে নিজেকে ধন্য ও ভারমুক্ত মনে করছি। তাই আল্লাহ পাকের অশেষ শুকরিয়া আদায়ের সাথে সাথে জামাতাকেও অসংখ্য ধন্যবাদ রইল।