১৩ই ডিসেম্বর রবিবার। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বগুড়া যেলার গাবতলী থানাধীন মেন্দিপুর-চাকলা সালাফিইয়া হাফেযিয়া মাদরাসা ও ইয়াতীমখানার উদ্যোগে বার্ষিক জালসা। বিগত কয়েক বছর যাবত নিয়মিতভাবেই এই জালসায় যোগদান করে আসছি। কখনো সভাপতি, আবার কখনো প্রধান অতিথি হিসাবে। সেকারণ এ বছর যাওয়ার তেমন ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু জালসার ঠিক আগের দিন বগুড়া যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি ও উক্ত মাদরাসার প্রধান শিক্ষক জনাব আব্দুর রহীম ভাইয়ের ফোন ও অনুরোধ পেয়ে আমীরে জামা‘আতকে জানালাম। অনেকটা অনিচ্ছা থেকেই স্যারকে বললাম না যাওয়ার কথা। রাজশাহীতেও অনেক ব্যস্ততা। ভেবেছিলাম স্যার নিষেধ করলে তাঁর দোহাই দিয়ে হয়তবা বাঁচা যাবে। কিন্তু না, তিনি বরং যাওয়ার জন্যই উৎসাহিত করলেন। অতঃপর অনুমতি পেয়ে বেলা ২-টায় মাইক্রোযোগে রওয়ানা হ’লাম। সফরসঙ্গী ছিল রাজশাহী মহানগরী ‘যুবসংঘে’র সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মাদ নাজিদুল্লাহ ও অর্থ সম্পাদক মুকাম্মাল হোসাইন। মেন্দিপুর মাদরাসায় পৌঁছলাম মাগরিবের ছালাতের শেষ সময়ে। অতঃপর মাদরাসা মসজিদে মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও কছর করে জামা‘আতে আদায় করলাম। মুক্তাদী হিসাবে তখন ‘আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী’র প্রধান শফীকুল ইসলাম ভাই পিছনে এসে দাঁড়ালেন। ছালাত শেষে কুশল বিনিময় হ’ল। অতঃপর একসঙ্গে মাইক্রোতে চড়ে মেহমানদের বিশ্রামের স্থান গাবতলী পৌরসভার সাবেক কাউন্সিলর জনাব আব্দুল লতীফ আকন্দ ছাহেবের বাসায় গেলাম। সেখানে চা-নাশতা খেতে খেতে সাংগঠনিক বিভিন্ন দিক নিয়ে গল্প হ’ল। অতঃপর ওনাকে রেখে চলে গেলাম মঞ্চে। অনুষ্ঠান পরিচালনা করছেন যেলা ‘যুবসংঘে’র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম।
রাত প্রায় সাড়ে ৯-টা। প্যান্ডেল প্রায় কানায় কানায় পূর্ণ। সভাপতি হিসাবে আমার সংক্ষিপ্ত বক্তব্য শেষে শফীকুল ভাইয়ের নাম ঘোষণা করা হ’ল। মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সেক্রেটারী জনাব বাদশা ভাই খাবারের জন্য ডাকলে অনিচ্ছা প্রকাশ করে বললাম, পরে খাব। ভাবলাম, শফীকুল ভাইয়ের বক্তব্য শেষ হ’লে প্রধান বক্তা জনাব আব্দুর রাযযাক বিন ইউসুফ ছাহেবের বক্তব্য শুরু করে দিয়ে একেবারে উঠে যাব এবং খাওয়ার পর রাজশাহী রওয়ানা হব। সে লক্ষ্যে মনোযোগ দিয়ে বক্তব্য শুনছি। আমার বাম পাশের চেয়ারে বসে বক্তব্য দিচ্ছেন তিনি। প্রাণভরে দীর্ঘ বক্তব্য দিলেন। শ্রোতাদের মনোযোগ ও নীরবতা ছিল উল্লেখযোগ্য। আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বক্তব্যের সাথে সংশ্লিষ্ট জাগরণী শ্রোতাদের হৃদয় তন্ত্রীতে যেন ঝংকার তুলছিল। বক্তব্যের শেষ মুহূর্তে পরিচালকের স্লিপ ‘কালেকশন সহ সাড়ে ১০-টার মধ্যে বক্তব্য শেষ করার অনুরোধ’ পেয়ে সাথে সাথে বক্তব্যের মোড় ঘুরিয়ে চলে গেলেন কালেকশনের দিকে। চলল আরো প্রায় আধা ঘণ্টা। টেবিলে নগদ টাকার স্তূপ। উপস্থিত জনতা স্রোতের মত দান করছেন। তিনিও সেই আনন্দে অধিক উচ্ছ্বাসের সাথে কুরআন-হাদীছ ও ছন্দ-কবিতার মাধ্যমে কালেকশন করছেন। রাত প্রায় পৌনে এগারটা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। শ্রোতাদের মোবাইলের আলোতে আলো-অাঁধারি পরিবেশ। তিনি বললেন, ভাই! ভাল লাগছে না, বক্তব্য শেষ করে দেই। বললাম, ঠিক আছে মাইকের কানেকশন দিলে যারা এখনো দান করতে আগ্রহী তাদেরকে মঞ্চে এসে অথবা মাদরাসা কর্তৃপক্ষের নিকটে দান পৌঁছে দেওয়ার আহবান জানিয়ে শেষ করে দিন। ইতিমধ্যে আরো প্রায় পাঁচ মিনিট অতিক্রান্ত হ’ল। দেখছি শফীকুল ভাই টেবিলে মাথা এলিয়ে চুপ করে আছেন। ভাবলাম দীর্ঘ সময় উচ্চকণ্ঠে বক্তব্য দেওয়ার কারণে হয়ত ক্লান্তিবোধ করছেন। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই পানি খাবেন? বললেন, না। তখনও ইলেকট্রিক লাইন ঠিক হয়নি। তিনি বললেন, ভাই! আমার শরীর ভাল লাগছে না, আমি চলে যাই। অনুমতি দিয়ে বললাম, ঠিক আছে, যান। এই ছিল তার সাথে আমার জীবনের শেষ কথা। কে জানে এই বিদায়ই শফীকুল ভাইয়ের শেষ বিদায়? কে জানত বক্তব্যের শেষ মুহূর্তে আলো বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে তার জীবনের আলো চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়া।
শফীকুল ভাই চলে গেলেন। আমরা অনুষ্ঠান নিয়ে ব্যস্ত। আলো নেই, মাইক নেই সবমিলিয়ে একটা বিব্রতকর পরিবেশ। সেকারণ তিনি মঞ্চ থেকে কিভাবে গেলেন সে বিষয়টি মাথায় নেই। তাছাড়া এতটা খারাপ অবস্থা, তা তো ভাবতেও পারিনি। প্রত্যক্ষদর্শী ও শেষ মুহূর্তের সাথী বগুড়া যেলা ‘যুবসংঘে’র সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম, সাহিত্য ও পাঠাগার সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মামূন ও অন্যান্য কর্মীদের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি মঞ্চ থেকে নামার মত শক্তি পাচ্ছিলেন না। মাদরাসা কমিটির সদস্য জাহাঙ্গীর আলম ও ‘যুবসংঘে’র কর্মী রাশেদুল ইসলাম (রংপুর) ধরাধরি করে তাকে মাদরাসায় নিয়ে যান। সেখানে মাথায় পানি ঢালা হ’ল। ঘামে ভিজে যাওয়া জামা-কাপড় খুলে শরীর মুছে দেওয়া ও শরীর মালিশ সবই চলল। সাথে সাথে ডাক্তার আনা হ’ল। ডাক্তারের পরামর্শে নেওয়া হ’ল পার্শ্ববর্তী গাবতলী থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। সেখান থেকে পাঠানো হ’ল বগুড়া শহরের জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আব্দুস সালাম ভাই সহ বেশ কিছু দায়িত্বশীল গেলেন সাথে। পথে আব্দুস সালামকে সম্বোধন করে বলছেন, আব্দুস সালাম! আমাকে হাসপাতালে ভর্তি করবে না, ডাক্তার দেখিয়ে আবার নিয়ে এসো, হাসপাতাল খুব ভাল জায়গা না’। কিছুটা স্বাভাবিকের মতই কথা বলছিলেন। হাসপাতালে যাওয়ার পথে যেলার শাহজাহানপুর থানাধীন বৃ-কুষ্টিয়ার অধিবাসী তার জামাই ও মেয়ের সাথেও স্বাভাবিক ফোনালাপ হ’ল। তাদেরকে বললেন, আমার তেমন কিছু হয়নি। একটু শরীর খারাপ করেছে। ডাক্তার দেখিয়ে আবার ফিরে আসব ইনশাআল্লাহ। তোমাদের আসার প্রয়োজন নেই।
হাসপাতালে নেওয়ার পর দ্রুত ভর্তি এবং প্রেসার, হার্ট, ডায়াবেটিস ইত্যাদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সবই করা হ’ল। কর্তব্যরত ডাক্তার জানালেন, ওনি হার্ট এ্যাটাক করেছেন। এই ঔষধগুলো নিয়ে আসুন। আব্দুস সালাম ভাই ছুটলেন ঔষধ আনতে। যাওয়ার সময় শফীকুল ভাই বলছেন, আব্দুস সালাম! আমি তো রাতে ভাত খাইনি, আমার খুব ক্ষুধা লেগেছে। আব্দুস সালাম বললেন, চাচা! আমি আপনার জন্য গরম দুধ, পাউরুটি ইত্যাদি নিয়ে আসব। আমিও কিছু খাইনি। দু’জন এক সঙ্গে খাব। অতঃপর আব্দুস সালাম ভাই একজনকে সাথে নিয়ে নিচে চলে গেলেন ঔষধ ও খাবার আনার জন্য। ঔষধ কিনে তিনি সাথীকে দিয়ে দ্রুত পাঠিয়ে দিলেন এবং নিজে খাবার-দাবার ক্রয় করছেন। এমন সময় হঠাৎ ওয়ার্ড থেকে ফোন আব্দুস সালাম ভাই! আপনি দ্রুত আসুন। শফীকুল ভাই কেমন যেন করছেন।
শফীকুল ভাই সাথীদের সাথে কথা বলতে বলতে বাথরুমে যেতে চাইলেন। এমনকি একাই যেতে পারবেন বলে দাঁড়িয়ে গেলেন ও হাঁটতে শুরু করলেন। ডাক্তার দেখে বললেন, সর্বনাশ! এই রোগী হাঁটতে পারবে না। দ্রুত হুইল চেয়ারে বসান। হুইল চেয়ার আনা হ’ল। বসতে শুরু করলেন হুইল চেয়ারে। কিন্তু না, আর বসতে পারলেন না। বসতে গিয়ে ঢলে পড়লেন মাটিতে। জীবনের সুইচ এখানেই চিরতরে অফ হয়ে গেল। ডাক্তার খুব চেষ্টা করলেন। কিন্তু সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে কুরআনের চিরন্তন বাণীই সত্য ‘নির্ধারিত সময় যখন এসে যাবে, তখন কিছু আগেও (জান কবয) করা হবে না বা কিছু পরেও না’ (আ‘রাফ ৭/৩৪)। শফীকুল ভাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই নির্মম সত্যই বাস্তবায়িত হ’ল।
রাত ১-টা পার হয়েছে। তখনো আব্দুল লতীফ ছাহেবের বাসায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই রওয়ানা হব। বইগুলো গাড়ীতে ওঠানোর জন্য অপেক্ষা করছি মাত্র। ফোনে আব্দুস সালাম ভাইয়ের সাথে কথা হ’ল। খোঁজ-খবর নিলাম শফীকুল ভাইয়ের। জানা গেল তিনি মোটামুটি ভাল আছেন। ওনাকে হাসপাতালে দেখে রাজশাহী রওয়ানা হব, এই ভেবে আব্দুর রহীম ভাইকে মোবাইলে বলছি, বইগুলো উঠানো হ’লে আপনিও গাড়ীতে ওঠে চলে আসেন শফীকুল ভাইকে দেখতে যাব। কি মর্মান্তিক! ফোন কানে থাকতেই অপর প্রান্তে কান্নার শব্দ। আব্দুর রহীম ভাইয়ের কথা বন্ধ হয়ে গেল। ডুকরে কেঁদে ওঠে বললেন, শফীকুল ভাই চলে গেছেন...। রাত তখন ১-২৬ মিনিট। আকস্মিক এই দুঃসংবাদ বহন করার মত শক্তি হারিয়ে ফেললাম। সকলে হতবাক হয়ে গেলাম। নীরব কান্না বেরিয়ে আসল হৃদয়ের গভীর থেকে। এ কান্না যে থামতে চায়না। হৃদয়তন্ত্রীতে শুধুই টান পড়ছে, পাশের মানুষটি না হয়ে হতে পারতাম আমিও। মৃত্যু কত নির্দয়! আর আমরা কত উদাসীন! অতঃপর আব্দুর রহীম ভাই ও যেলা ‘আন্দোলন’-এর প্রচার সম্পাদক ছহীমুদ্দীন ভাইসহ দ্রুত হাসপাতালে ছুটে গেলাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম কি করব, এত রাতে কাকে জানাব। পরিবারকে আপাতত জানাতে নিষেধ করলাম। কিন্তু অন্য মাধ্যমে তারা জেনে গেলেন। আমীরে জামা‘আতকে জানানোর জন্য তাঁর মেজ ছেলে আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীবকে ফোন দিলাম। কণ্ঠ আড়ষ্ট হয়ে আসল। কথা বলতে পারছি না। দুঃসংবাদটি জানিয়ে বললাম, স্যারকে এখন বল না। উনি আর ঘুমাতে পারবেন না। তাহাজ্জুদের ছালাতে উঠলে জানাবে। ‘আন্দোলন’-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম ভাইকে জানালাম। পর্যায়ক্রমে ফোন আসতে থাকল। চারদিকে রাতের মধ্যেই সংবাদ পৌঁছে গেল।
সফরসঙ্গী নাজিদুল্লাহ ও মুকাম্মালকে দিয়ে রাজশাহীর মাইক্রো ছেড়ে দিলাম। এ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে লাশ নিয়ে রাত প্রায় আড়াইটার দিকে রওয়ানা হ’লাম তার বাড়ী জয়পুরহাটের উদ্দেশ্যে। হাসপাতাল থেকে রওয়ানা হয়ে প্রথমে বৃ-কুষ্টিয়া গ্রাম থেকে তার মেয়ে ও জামাইকে নেওয়ার জন্য সেখানে পৌঁছলে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। অঝোর নয়নে কাঁদছেন সবাই। অতঃপর সেখান থেকে তাঁর মেয়ে, জামাই, বেয়াই এবং যেলা ‘আন্দোলন’-এর সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক হাফেয নজীবুল ইসলাম, যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি আব্দুর রাযযাক, সহ-সভাপতি আব্দুস সালাম সহ আমরা কয়েকজন চললাম লাশের সাথে। অতঃপর রাত সাড়ে চারটায় লাশবাহী এ্যাম্বুলেন্সটি জয়পুরহাটের কমরগ্রামে তার বাড়ীর সামনে পৌঁছল। এ সময় স্বজনদের বুকফাটা কান্নায় আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠল। প্রিয়জনের আকস্মিক বিদায় কোনভাবেই মেনে নিতে পারছেন না তারা। কি করে পারবেন! শুধুই দ্বীনি বন্ধন, আত্মীয় তো নয়ই, যেলারও নয়। তারপরও নিজেদের সামলাতে অপারগ অবস্থা প্রায়। আর যেখানে পরিবার অপেক্ষায় আছে বক্তব্য শেষে বাড়ি ফিরবেন। অথচ তিনি ফিরলেন লাশ হয়ে! কি করে ভুলবেন জ্বলজ্বলে স্মৃতিগুলো।
ফজরের আযান হ’ল। ওযূ করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। এমন সময় রাজশাহী হ’তে নাজীবের ফোন। অপরপ্রান্ত থেকে কান্নার শব্দ ভেসে আসল। ‘সাখাওয়াত! তুমি এ কী সংবাদ শুনালে। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বললেন, তুমি তো যেতে চাচ্ছিলে না। তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় স্মৃতি হয়ে থাকল শফীকুল’। আমীরে জামা‘আতের এই ফোন পেয়ে ভাবলাম, সত্যিই এটি আমার জীবনের এক মর্মান্তিক স্মৃতি। এভাবে একজন তরতাযা সাথী ভাইকে হারাতে হবে কখনো কল্পনায়ও আসেনি। পাশাপাশি চেয়ারে বসে থাকা দু’জনের একজন আজ শুধুই স্মৃতি। মনের আয়নায় শুধুই তার আল্পনা।
বাদ ফজর শফীকুল ভাইয়ের বাড়ী সংলগ্ন ওয়াক্তিয়া মসজিদে মৃত্যু ও দুনিয়ার জীবন সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত দরস শেষে যেলা ‘যুবসংঘে’র সভাপতি আবুল কালাম আযাদের বাসায় গিয়ে পরামর্শে বসলাম। যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি মুহাম্মাদ মাহফূযুর রহমান সহ আরো অনেকে আসলেন। ফজরের পূর্বেই আমীরে জামা‘আতের সাথে আলোচনায় বাদ আছর জানাযার সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কেননা তার বড় ছেলে সাতক্ষীরা থেকে পৌঁছতে যোহর পার হয়ে যাবে। সুদূর পঞ্চগড়, লালমণিরহাট, নীলফামারী থেকেও কর্মী ও দায়িত্বশীলগণ রওয়ানা হয়েছেন জানাযার উদ্দেশ্যে। পার্শ্ববর্তী বগুড়া থেকে ৪টি বাস ও অন্যান্য মাধ্যম, রাজশাহী হ’তে ২টি বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার যোগে, এভাবে উত্তরাঞ্চলের প্রায় সকল যেলা থেকে বাস, মাইক্রো, প্রাইভেটকার, ট্রেন যোগে বিপুল সংখ্যক কর্মী ও সুধী জানাযার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছেন। যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘে’র নেতৃবৃন্দ আগত কর্মী ও সুধীবৃন্দের জন্য দুপুরে আপ্যায়নের সিদ্ধান্ত নিলেন।
অতঃপর বাদ আছর বিকাল ৪-টায় আমীরে জামা‘আতের ইমামতিতে জানাযার ছালাত অনুষ্ঠিত হয়। হাযার হযার মানুষের উপস্থিতিতে জানাযাস্থল জনসমুদ্রে পরিণত হয়। কোন জানাযায় এত মানুষের উপস্থিতি আমি ইতিপূর্বে কখনো দেখিনি। আমার মতো হয়ত অনেকেই দেখেননি। শফীকুল ভাই সত্যিই ভাগ্যবান। এত মানুষের আন্তরিক দো‘আ নিয়ে কবরে শায়িত হ’লেন। আরও সৌভাগ্য যে, জীবনের শেষ মুহূর্তেও দ্বীনে হক-এর প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারলেন। রাসূল (ছাঃ)-এর অমর বাণী- ‘নিশ্চয়ই আমলের ভাল-মন্দ নির্ভর করে তার শেষ অবস্থার উপরে’ (বুখারী) তাঁর জীবনে কার্যকর হ’ল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
দেশের অপ্রতিদ্বন্দ্বী জাগরণী শিল্পী ও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ জয়পুরহাট যেলার অর্থ সম্পাদক শফীকুল ইসলাম ভাই এভাবেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে চলে গেলেন। কাঁদিয়ে গেলেন গোটা জাতিকে। রেখে গেলেন অনেক স্মৃতি। মৃত হৃদয়কে জাগিয়ে তোলার মত অসংখ্য তেজস্বী জাগরণী। প্রথম রাতে যিনি অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে হাযার হাযার শ্রোতাকে মাতিয়ে রাখলেন, মধ্যরাতে তিনিই লাশ হয়ে ফিরছেন এই নির্মম সত্য মেনে নেওয়া যে কতটা কঠিন, কতটা মর্মান্তিক, কতটা বেদনাবিধুর তা বলে বা লিখে প্রকাশ করা যাবে না। আর তাবলীগী ইজতেমা ময়দান, যেলা সম্মেলন, দেশের আনাচে-কানাচের সভা-সমাবেশ শফীকুল ইসলামের সুললিত কণ্ঠের জাগরণী দ্বারা ঝংকৃত হবে না। হয়ত অনেকেই গাইবেন। কিন্তু শফীকুল ভাইয়ের সেই কণ্ঠ আর সরাসরি শুনা যাবে না। সদা হাস্যোজ্জল প্রিয় শিল্পীর চিরবিদায়ে আমরা গভীরভাবে মর্মাহত ও বেদনাহত। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন-এটিই আমাদের হৃদয় নিংড়ানো প্রার্থনা। আল্লাহ তুমি কবুল কর-আমীন!!
[আল-হেরা শিল্পী গোষ্ঠী প্রধান শফীকুল ইসলামের স্মৃতিতে প্রেরিত লেখনী সমূহ লেখকের নামে এই কলামে প্রকাশিত হবে। -সম্পাদক]