‘আহলেহাদীছ
আন্দোলন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত তাবলীগী ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় আসলেই
অতীত স্মৃতি মনে পড়ে যায়। মনের আয়নায় ভেসে উঠে ২০০৫ সালের ইজতেমার কথা। সে
বছর ইজতেমার দুইদিন আগে ২২শে ফেব্রুয়ারী অপ্রত্যাশিতভাবে সাদা পোষাকধারী
শত শত গোয়েন্দা কর্মী নিরাপত্তা দেয়ার মিথ্যা কাহিনী সাজিয়ে নওদাপাড়া
মারকায ও আশপাশে অবস্থান নেয়। অতঃপর গভীর রাতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন
শান্তিপ্রিয় দ্বীনী সংগঠন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর মুহতারাম আমীরে
জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যারকে
ঘুম থেকে ডেকে নিয়ে গ্রেফতার করে। একইভাবে ‘আন্দোলন’-এর তৎকালীন নায়েবে
আমীর আব্দুছ ছামাদ সালাফী, সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক মাওলানা নূরুল
ইসলাম, ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র সাংগঠনিক সম্পাদক এ.এস.এম
আযীযুল্লাহকেও একই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়। উল্লেখ্য, শাহমখদুম থানার
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা পরবর্তীতে সাক্ষাৎ হ’লে আমাদের জানান যে, ‘স্যারকে যে
গ্রেফতার করা হবে তা আমরা ঘটনার রাত ১১-টার পরে জানতে পারি। তখন তিনি নাকি
এও বলেছিলেন যে, ‘কেন ড. গালিব স্যারকে গ্রেফতার করব? উনি তো জঙ্গী নন?’
পরদিন ট্রাকটার্মিনালের বিশাল ময়দানে প্রস্ত্ততকৃত ইজতেমার স্টেজ,
প্যান্ডেল ভেঙ্গে চুরমার করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা শত শত
মুছল্লী চোখের পানি মুছতে মুছতে আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়।
বিষয়টি আমরা বুঝে উঠতে পারছিলাম না যে, কেন এমনটি হচ্ছে। কি অপরাধ আমাদের?
অতঃপর বিলম্বে হ’লেও আমাদের কাছে স্পষ্ট হ’ল যে, এটা ছিল স্রেফ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তবে আমাদের ধারণা ছিল, ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী চার দলীয় জোট সরকার আমাদের নেতৃবৃন্দকে এভাবে গ্রেফতার করতে পারে না। কেন করবে, তার তো যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে? অতএব দ্রুত তাঁদেরকে ছেড়ে দিবে। কিন্তু না সকল হিসাব-নিকাশ পন্ড হয়ে গেল, যখন দেখলাম রাজশাহী, নাটোর, নওগাঁ, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, গোপালগঞ্জ প্রভৃতি যেলাতে মোট ১১টি মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। নাটোরে তো রীতিমত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হ’ল। তবে পরে এটা উঠিয়ে নেয়া হয়। মামলার ধরনগুলো হ’ল ব্যাংক ডাকাতি, নাট্যমঞ্চে বোমা হামলা, বিস্ফোরক দ্রব্য ইত্যাদি।
সেদিন নওদাপাড়া মাদ্রাসাকে শত শত পুলিশ, র্যাব, আর্মি সহ গোয়েন্দা বাহিনী দ্বারা চারিদিক থেকে সশস্ত্র পাহারায় ঘিরে ফেলা হ’ল। এ সন্দেহে যে, মাদরাসার ভিতরে শত শত জঙ্গী সশস্ত্র অবস্থায় অবস্থান করছে। তাদের ধারণা, জঙ্গীরা হয়তোবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর পাল্টা হামলা চালাতে পারে। পরদিন সকালে নিশ্চিত গ্রেফতার হব ভেবেও দুঃসাহসিকতার সাথে র্যাব, আর্মি, ব্যাটেলিয়ান-পুলিশের ব্যারিকেড ভেদ করে মাদ্রাসায় প্রবেশ করি। প্রথমে পূর্ব পার্শ্বে অতঃপর পশ্চিম পার্শ্বে ছাত্রদের মাঝে গিয়ে তাদেরকে সান্ত্বনা ও সাহস যোগাই। আতংকিত অনেক কচি-কাঁচা কান্নাকাটি করছিল প্রশাসনের এই যুদ্ধংদেহী মহড়া দেখে। সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় একটা মহল থেকে সুর উঠল ড. গালিবকে ফাঁসি দিতে হবে। তাঁর দলকে নিষিদ্ধ করতে হবে। আর সেকারণেই হয়ত স্যারকে জেলখানায় ফাঁসির সেলে রাখা হয়েছিল। আরও কত কি? ওরা সত্যকে মিথ্যার চাদরে আবৃত রেখে প্রায় অর্ধশত নির্দোষ নেতা-কর্মীকেও গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করল। ঘরছাড়া করল হাযার হাযার কর্মীকে। কিছুদিন পর পুলিশী আতঙ্কে হার্ট এ্যাটাক করে মারা গেলেন কেন্দ্রীয় অর্থ সম্পাদক জয়পুরহাটের হাফীযুর ভাই।
ইতিমধ্যে ১৭ই আগষ্ট দেশের ৬৪ যেলায় একযোগে বোমা ফাটানোর মূল নায়ক আব্দুর রহমান ও ছিদ্দীকুর রহমান ওরফে বাংলা ভাই বলে পরিচিত ২ জন সহ তাদের শীর্ষ নেতাদের ধরা হ’ল এবং বাংলা ভাইকে মেরে ফেলা হ’ল। যেন সরকারের সাথে তার সংশ্লিষ্টতা কেউ প্রমাণ করতে না পারে।
লক্ষণীয় বিষয় হ’ল ড. গালিব স্যারকে গ্রেফতার করা হ’ল ২২ ফেব্রুয়ারী’০৫। আর দেশের ৬৪ যেলায় বোমা ফাটানো হ’ল প্রায় ৬ মাস পর ১৭ই আগষ্ট ২০০৫ তারিখে। অথচ পুলিশ প্রশাসন বা গোয়েন্দা সূত্রে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা ও মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করা হ’ল যে, জেলখানা থেকে ৬৪ যেলায় বোমা হামলার নির্দেশ দাতা হচ্ছেন ডঃ গালিব। আর এক গোয়েন্দা সূত্রে রিপোর্ট প্রকাশ হ’ল, ড. গালিব হ’ল জেএমবির আধ্যাত্মিক গুরু। কি চমৎকার মিথ্যাচার? অথচ সরকার ও সরকারী দলের পৃষ্ঠপোষকতা বা ছত্রছায়ায় লালিত আব্দুর রহমান-বাংলা ভাই গংদের বাঁচানোর জন্যই যে এই নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল, দেশের বিবেকবান প্রত্যেক নাগরিক তা সহজে বুঝতে পেরেছিলেন।
অতঃপর রিমান্ড, হাযিরা ও সাড়ে তিন বছর অমানবিকভাবে কারারুদ্ধ থাকার পর ২০০৮ সালে হাইকোর্টের ডাইরেকশন অর্ডারের ভিত্তিতে ৬ মাস পর বগুড়া যেলার নিম্ন আদালত তাকে যামিনে মুক্তি দান করে। ডাইরেকশন অর্ডার প্রদানের পূর্বে হাইকোর্টের বিচারক বলেছিলেন, ‘ড. গালিব একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত প্রফেসর হয়ে কি করে যাত্রা মঞ্চে বোমা হামলা করতে পারেন? এটা তো অবিশ্বাস্য। দেশে লক্ষ লক্ষ আহলেহাদীছের অনুসারী সবাই তো আর সন্ত্রাসী নয়। ভাবলাম, মূল বিষয়টি অন্যখানে।
কারারুদ্ধ ড. গালিব স্যারকে নিয়ে যখন এক জেলখানা থেকে আরেক জেলখানা, এক যেলা থেকে আরেক যেলায় টানা-হেচড়া চলতে থাকে, তখন এ দৃশ্য বাংলার প্রায় তিন কোটি আহলেহাদীছ সহ দেশের সর্বস্তরের মানুষ প্রত্যক্ষ করল। তারা এই নাটকীয় গ্রেফতার ও হয়রানির প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র নেতা-কর্মীরা বেরিয়ে পড়ল মাঠে-ময়দানে। হাযার হাযার মানুষ অশ্রুজসল নেত্রে দো‘আ করল মহান করুণাময়ের বারগাহে। অতঃপর আল্লাহর অশেষ রহমতে ১৬ মাস পর তিন নেতা এবং দীর্ঘ ৩ বছর ৬ মাস ৬ দিন পর ২৮শে আগষ্ট ২০০৮ তারিখে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বগুড়া কারাগার হ’তে মুক্তি লাভ করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার। আলহামদুল্লিাহ। তিনি সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং পরিবারের মাঝে আবার ফিরে আসেন। সবার মুখে হাসি ফুটে। বহু মানুষ তাঁকে এক নযর দেখার জন্য মারকাযে আসতে থাকেন।
একদিন সকালের দিকে মাদরাসায় এক ভদ্রলোক কাকে যেন খুঁজছেন। আমি এগিয়ে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলাম। বললেন, আমি এম. রহমান (আদ্যাক্ষরে নাম) পুলিশ প্রশাসনে চাকুরী করি। পদবী জানতে চাইলে বললেন, এসবির অফিসার। বললাম, কাকে চান? বললেন, ড. গালিব স্যারের সাথে দেখা করতে চাই। বললাম, কেন? বললেন, এমনিতেই।
স্যার তখন ওপরে কাজে ব্যস্ত। তাকে নিয়ে ‘আন্দোলন’ অফিসে বসে বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে তার সাথে অনেকটা ভাব তৈরী হয়ে গেল। এক পর্যায়ে আমীরে জামা‘আতের গ্রেফতার নিয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলতে লাগলেন সেদিনের কথা। তিনি বললেন, সেদিন আমি ঢাকা এসবি হেড অফিসে দায়িরত ছিলাম। তখন আমাদেরকে ওপর থেকে নির্দেশ দেয়া হ’ল, এখনি রাজশাহী রওয়ানা দিতে হবে। কারণ রাজশাহীর নওদাপাড়া মাদ্রাসাতে ড. গালিবের নেতৃত্বে শত শত জঙ্গী সশস্ত্র অবস্থান করছে। রাতেই সেখানে পৌঁছতে হবে এবং সম্পূর্ণ যুদ্ধের প্রস্ত্ততি নিয়ে ওখানে অবস্থান নিতে হবে। নির্দেশ মোতাবেক ঢাকা থেকে এক বিরাট বহর (এসবি টিম) রাজশাহীতে আনা হ’ল এবং মাদ্রাসাকে ঘেরাও করা হ’ল। গমনাগমনের পথেও অবস্থান নেয়া হ’ল। দু’একদিন অবস্থান নেয়ার পর আমরা বললাম, কোথায় সেসব সশস্ত্র জঙ্গী? আমরা তো দেখছি মাদ্রাসার নিরীহ ছাত্ররা ঘুরে বেড়াচ্ছে। খেলাধূলা ও পড়ালেখা নিয়ে তারা ব্যস্ত। তিনি বললেন, আমার আর বুঝতে বাকী রইল না যে, এ অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা। তবে কেন আমাদেরকে এভাবে পাঠানো হ’ল? তিনি তার বসকে বললেন, স্যার! আমাদেরকে কেন এই কাল্পনিক কাজে আনা হ’ল? মূলতঃ পুরো ঘটনাই ছিল ভুঁয়া এবং আইওয়াশ। তিনি বললেন, দেখেন হুযুর! একটি দেশের সরকার এবং তাঁর গোয়েন্দা বিভাগের যদি এত অদূরদর্শিতা থাকে তাহ’লে সে দেশটি কিভাবে চলতে পারে? আর বিশ্ব দরবারেই বা আমাদের ভাবমূর্তি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? সেদিন থেকে আমার এই চাকুরীর প্রতি বিতৃষ্ণার সৃষ্টি হয়। তবে শুধু পেটের দায়ে এই গোলামী করতে হচ্ছে। আপনারা কোন চিন্তা করবেন না। আপনাদের সম্পর্কে সরকারের ধারণা এখন অনেকটা পরিস্কার। একটা স্বার্থবাদী গ্রুপ কর্তৃক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ড. গালিব স্যার সহ আপনাদের ওপর এই নির্যাতন করা হয়েছে। ড. গালিব স্যার যে হকের ওপর টিকে আছেন, তা আমাদের বুঝতে বাকী নেই। আর এজন্য শুনেছি পুলিশ প্রশাসনেরও বহু লোক আহলেহাদীছ হয়ে গেছে। আমিও একজন আহলেহাদীছ। আমি বহু দূর থেকে স্যারকে এক নযর দেখতে এসেছি। পত্র-পত্রিকা, টিভিতে উনার নাম, ছবি বহু দেখেছি আজ স্বচক্ষে দেখতে চাই এবং স্যারের কাছ থেকে দো‘আ নিতে চাই।
ইতিমধ্যে স্যার নিচে নেমে আসলেন। স্যারের সাথে সাক্ষাত হ’ল। দীর্ঘ সময় ধরে কথা হ’ল। বিদায়কালে আবেগঘন কণ্ঠে তিনি বললেন, স্যার! সেদিন আপনার এখানে এসেছিলাম আপনাকে গ্রেফতার করতে, আর আজ আসলাম আপনার কাছ থেকে ক্ষমা ও দো‘আ নিতে। স্যার আমাদের বড়ই দুর্ভাগ্য যে, প্রকৃত সন্ত্রাসীদের না ধরে আমরা আপনাদের মত দেশপ্রেমিক এবং উঁচু দরের আলেমগণের উপর নির্যাতন করে যাচ্ছি। জানি না হয়তবা অচিরেই আমাদেরকে এর খেসারত দিতে হবে।
এরপরই ক্ষমতায় পালাবদল হ’ল। গোয়েন্দা প্রধান সহ অনেকে বন্দী হ’লেন। আদালতের রায়ে ফাঁসির আসামী হ’লেন। অনেকে রাজনৈতিক কারণে মৃত্যুবরণ করলেন। অনেকে বিদেশে পালিয়ে গেলেন। অনেকে কৃত অপরাধের দায় স্বীকার করে স্যারের কাছে ক্ষমা চাইলেন। কিন্তু ততক্ষণে জাতির যে অপূরণীয় ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেল।
পরিশেষে সরকার ও প্রশাসনের দায়িত্বশীল ভাইদেরকে বলব, দেশের অভ্যন্তরে এরকম জঘন্য মিথ্যাচারের পুনরাবৃত্তি যেন আর না ঘটে। মনে রাখবেন, আপনার কলমের একটি খোঁচায় দেশ ও জাতির যেমন কল্যাণ হ’তে পারে, তেমনি মুহূর্তে ধ্বংসও ডেকে আনতে পারে। সর্বোপরি আল্লাহর নিকটে জবাবদিহিতার ভয় করুন! মিথ্যাবাদীদের ভয়াবহ পরিণতি স্মরণ করুন! আল্লাহ আমাদের এই স্বাধীন-সুন্দর মুসলিম দেশটিকে রক্ষা করুন এবং সকল মযলূম, সম্মানী মানুষ ও আলেম-ওলামাকে হেফাযত করুন- আমীন!!