মাঝ রাত ধরে চলা ঝড়-বৃষ্টির তান্ডব ট্রেনে বসে অনুভব করতে না পারলেও রাজশাহী রেলষ্টেশনে নেমে ঘুম জড়ানো চোখে রাস্তার উপরে ক্ষতিগ্রস্ত তোরণ, বিক্ষিপ্ত পড়ে থাকা গাছের ভাঙ্গা ডাল, মাঝে মাঝে জমে থাকা পানি দেখে বুঝতে পারলাম শহরটাকে ফাল্গুন মাসের হঠাৎ আসা বর্ষণ ভালোই ভিজিয়েছে। তাবলীগী ইজতেমার এখনও দু’দিন বাকী। অটোরিক্সায় বসে মহান আল্লাহর কাছে মনে মনে প্রার্থনা করছি ইজতেমার সময়গুলোতে আবহাওয়া যেন শুষ্ক থাকে।
ফজরের ছালাত শেষে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ডঃ মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব স্যার প্রাতঃভ্রমণের পাশাপাশি তাবলীগী ইজতেমার প্যান্ডেলগুলোও পরিদর্শন করার উদ্দেশ্যে মারকায থেকে রওয়ানা দিয়েছেন প্রায় ১০জন সাথীসহ। সাথীদের মধ্যে পরিচিত আলোচক মাওলানা মোখলেছুর রহমান মাদানীও আছেন। ইজতেমায় পুরুষদের জন্য তৈরী মূল প্যান্ডেল ঘুরে ঘুরে চলমান কার্যক্রম দেখছেন কোথাও কাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন হওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন। কোথাও সমস্যার কারণে মৃদু ভৎর্সনা করছেন দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য। বিশাল মাঠের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্তপ্যান্ডেল, মঞ্চ, খাবার ও পানির ব্যবস্থাপনা পরিদর্শন শেষে মাঠের অদূরে নির্মিত টয়লেটসমূহ দেখছেন। যাতে দূর-দূরান্ত থেকে আগত ভাইদের বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ, শিশুদের টয়লেট ব্যবহারে ও যাতায়াতে সমস্যা না হয়।
প্যান্ডেলের শেষ প্রান্তে আলাদা করে নির্মিত নিরাপদ রক্তদান সংস্থা আল-আওন, হাদীছ ফাউন্ডেশন ছাড়া আরো ৩৪টি স্টল ঘুরে দেখে মহিলা প্যান্ডেলের দিকে হাঁটতে থাকলাম। পথিমধ্যে এক ভাই সম্মুখ থেকে মোবাইলের মাধ্যমে সবার ছবি তোলার চেষ্টা করছে দেখে আমীরে জামা‘আত ডেকে কাছে এনে জিজ্ঞেস করলেন, ছবি কেন তুলছেন? সহজ-সরল উত্তর আসল, স্যার! ফেসবুকে দেব। আমীরে জামা‘আত বললেন, ফেসবুকে ছবি শেয়ার করে অন্যদের নিকট ভালবাসা প্রকাশ করার চেয়ে অন্তরে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য ভালবাসা ও নীতি আদর্শকে ধারণ করুন। তাতেই কল্যাণ বেশী হবে। আর বিনাপ্রয়োজনে ছবি উঠানো থেকে অবশ্যই বিরত থাকবেন। ঐ ভাই মাথা নেড়ে সম্মতি দিয়ে আমাদের সাথী হ’লেন। এরই মাঝে মহিলা মাদ্রাসার ফটক পেরিয়ে সুবিশাল মাঠের কোণে সবাই দাঁড়িয়েছি। স্যার একে একে রান্নাঘর, প্যান্ডেল, টয়লেট, পানি সরবরাহ ও নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ইত্যাদি ঘুরে ঘুরে দেখছেন। গত বৎসর ইজতেমায় যেখানে মহিলাদের জন্য একটি প্যান্ডেল ছিল। এ বছর প্যান্ডেলের পরিধি বাড়ানোর সাথে সাথে দু’টি প্যান্ডেল করা হয়েছে।
এছাড়াও ইজতেমার মূল প্যান্ডেলের দক্ষিণে হাইওয়ে রাস্তার পার্শ্ববর্তী জায়গাতেও ও স্থানীয় মহিলাদের জন্য একটি প্যান্ডেল করা হয়েছে। মহিলা মাদ্রাসা থেকে বেরিয়ে হাঁটছি। রাস্তার দু’ধার থেকেই সাধারণ মানুষ সালাম বিনিময় ও সাথে মুছাফাহা করছেন। হাঁটার মধ্যেই সাথীদের মধ্য থেকে কেউ একজন বললেন, পেশাদার বক্তাদের অনেকেই আর্থিক আয়ের ভিত্তিতে যেলায় যেলায় বাড়ি/প্লট ক্রয় করছেন। এ কথা শুনে মাওলানা মোখলেছুর রহমানকে আমীরে জামা‘আত জিজ্ঞেস করলেন কি বক্তা ছাহেব! বাড়ি কয়টা করেছ? বক্তারা নাকি বিভিন্ন যেলায় বাড়ি-ঘর করছে? মোখলেছ ছাহেব হেসে বললেন, স্যার অনেকেরই প্লট আছে, কেউ কেউ বাড়িও করছেন। আমীরে জামা‘আত বললেন, তোমার কয়টা আছে? উত্তরে হেসে হেসে বললেন, না স্যার এখনও বাড়ি হয়নি।
নিকটস্থ দ্বিতল বাড়ি দেখিয়ে বললেন, ঐ বাড়িতে ভাড়া থাকি। স্যার বললেন, সাবধান! ধর্মকে ব্যবসায়ে পরিণত করো না। আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই যেন হয় সকল কার্যক্রম। মাওলানা মোখলেছুর রহমান হেসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে সেখান থেকেই বিদায় নিলেন। স্যার অন্যান্য সাথীদের নিয়ে অগ্রসর হয়ে গত বৎসর ইজতেমায় উপস্থিতির আধিক্যের কারণে আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফীর পশ্চিম পার্শ্বের পুরো ময়দান জুড়ে পুরুষদের জন্য নির্মিত দ্বিতীয় প্যান্ডেলের কার্যক্রম দেখে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজ বাসভবন অভিমুখে রওয়ানা দিলেন।
পথেই দেখা হ’ল সূদূর সাতক্ষীরা (৩১৯ কি.মি.) থেকে ইজতেমার ব্যানার টাঙ্গিয়ে বাইসাইকেলে চড়ে দাওয়াত দিতে দিতে তাবলীগী ইজতেমায় আগমণকারী যয়নাল আবেদীনের (৮০) সাথে। সাতক্ষীরা সদর উপযেলার বাঁশদহা ইউনিয়নের কাওনডাঙ্গা গ্রামে তার বাড়ি। নবম শ্রেণী পাশ যয়নাল আবেদীন। এখনও বেশ নির্ভুল ও স্পষ্ট ইংরেজী বলতে পারেন। তিনি বিশ্বযুদ্ধের দামামা শুনেছেন। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৪৭-এ দেশ ভাগ দেখেছেন। পাঁচ ছেলে ও পাঁচ মেয়ের বাবা যয়নালের নাতি-নাতনীর সংখ্যা ২০ ছাড়িয়েছে। যয়নাল আবেদীন আরও জানালেন যে, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, যতদিন তিনি সুস্থ থাকবেন, ততদিন সাইকেল চালিয়ে রাজশাহীর তাবলীগী ইজতেমায় আসবেন। ২০০৪ সাল থেকে পরপর ১৩ বার এবং এবার নিয়ে ১৪ বার ইজতেমায় যোগ দিয়েছেন সাইকেলে এসে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত-এর বিদায়ী ভাষণ শেষে শনিবার বাড়ির উদ্দেশ্যে আবারও সাইকেলে রওয়ানা হবেন তিনি।
বৃহস্পতিবার যোহরের ছালাত আদায় করতে মারকাযের পূর্ব পার্শ্বের মসজিদে গিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। পুরো মসজিদ বারান্দাসহ মুছল্লীদের ভিড়ে ঠাসা। মাঠে অপেক্ষমানের সংখ্যাও কম নয়। গতরাত থেকেই বিভিন্ন যেলা থেকে কর্মী ও সুধীগণ আসছিলেন। যোহরের দিকে জনসমাগম দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে।
কয়েকটা জামা‘আত হ’ল যোহরের ছালাতের। আমীরে জামা‘আত ও মুছল্লীদের ভিড়ে প্রথম জামা‘আতে পড়তে পারেননি। যোহর ছালাত শেষে মাঠে বিভিন্ন বয়সী মানুষের ভিড়। কেউ কেউ বলছেন, এখনই ইজতেমা মাঠ প্রায় পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আগত ভাইয়েরা কোথায় স্থান নিবেন? মারকাযের পূর্ব পার্শ্বস্থ মাঠের একপাশে কয়েকটি যেলা থেকে হাদিয়া হিসাবে আসা গরু-খাসিগুলো যবেহ করে গোশত তৈরী করা হচ্ছে। বস্তায় বস্তায় চাউল, ডাল, বড় ড্রামগুলোতে তৈল, ছোট ট্রাকে করে সব্জির স্তূপ আসছে। প্যান্ডেলের ভিন্নতার কারণে পুরুষদের দু’টি প্যান্ডেলে ও মহিলাদের প্যান্ডেলগুলোতে ৩০/৪০ টাকার কুপনের মাধ্যমে খাবার ব্যবস্থাপনার প্রথম দিকের কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে।
ইজতেমা মাঠের অবস্থা দেখা ও আছরের ছালাত আদায় করার জন্য রওয়ানা হ’লাম। আম চত্বর গিয়েই থমকে গেলাম। হাযার হাযার মানুষের পদচারণায় মুখরিত চত্বর। বিভিন্ন যেলা থেকে আগত বাস, মাইক্রোবাস, ছোট ট্রাক, সিএনজি, নসীমন, ইজিবাইক ইত্যাদি বাহনগুলো থেকে বয়োবৃদ্ধ, মধ্যবয়স্ক, যুবক, তরুণ, কিশোর, মহিলা ও শিশুরা নেমে সারিবদ্ধভাবে ইজতেমার প্যান্ডেল পানে ছুটে চলেছে। কিছু দূর এগিয়ে মহিলারা তাদের জন্য নির্ধারিত মহিলা মাদ্রাসার প্যান্ডেলের দিকের ভিন্ন রাস্তায় বাক নিচ্ছেন। ঐ রাস্তায় পুরুষদের চলাচল একেবারেই সীমিত। বিভিন্ন যেলার ভাইদের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ইজতেমা মাঠে উপস্থিত হয়েছি। প্রবেশ মুখের ফটকগুলোতে মানুষের জটলা পেরিয়ে সুবিশাল মাঠে তাকিয়ে দেখি মাঠ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে গেছে। অথচ এখনও হাযার হাযার মানুষ আসছে।
বাদ আছর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত যখন ইজতেমার উদ্বোধনী ভাষণ দিচ্ছিলেন তখন মাঠে জায়গা না পেয়ে হাযার হাযার মানুষ দাঁড়িয়ে আলোচনা শুনছেন। এভাবে সময়ের সাথে সাথে ভিন্ন ভিন্ন বিষয় নিয়ে সম্মানিত আলোচকগণ পূর্ব নির্ধারিত বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে আলোচনা করতে থাকেন। অতঃপর বাদ এশা আমীরে জামা‘আত-এর আলোচনার মাঝেই মঞ্চে উপস্থিত হন রাজশাহী মহানগরীর (বিএনপি/চারদলীয় জোট সমর্থিত) সম্মানিত মেয়র মোছাদ্দেক হোসেন বুলবুল। দীর্ঘ সময় তিনি মঞ্চে বসে আলোচনা শ্রবণ করেন। ইজতেমার ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য এবং ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর আদর্শিক কারণে তালিকাভুক্ত আলোচক ব্যতীত অন্য কারো বক্তব্য দেয়ার অবকাশ ছিল না। বাদ আছর থেকে শুরু করে রাত দু’টা পর্যন্ত আলোচকগণ আলোচনা রাখেন। হাযার হাযার জনতা মনোযোগ সহকারে আলোচনা শ্রবণ করেন।
ফজরের ছালাতে ইজতেমা প্যান্ডেলে ইমামতি করেন ও বাদ ফজর দরসে হাদীছ পেশ করেন ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ সউদী আরব শাখার সহ-সভাপতি হাফেয মুহাম্মাদ আখতার মাদানী। প্রস্তাবিত দারুল হাদীছ বিশ্ববিদ্যালয় (প্রাঃ) জামে মসজিদে দরসে কুরআন পেশ করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। বিগত রাতে দ্বিতীয় প্যান্ডেলে (মারকায ময়দান) আসার সুযোগ হয়নি। তবে ফজরের ছালাতে উপস্থিত হয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মসজিদ ও প্যান্ডেলে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। উল্লেখ্য যে, বিগত ইজতেমায় এখানে কোন প্যান্ডেল ছিল না। অনলাইনে, ফেসবুকে যেলায় যেলায় বিভিন্ন জালসায় মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ও সংগঠনের বিরুদ্ধে বছরব্যাপী মিথ্যা তথ্য দিয়ে বিভ্রান্ত করার অপপ্রয়াস সত্ত্বেও এই বৎসর বর্ধিত ও ২টা প্যান্ডেল থাকার পরও স্থান সংকুলান হচ্ছে না! মহান আল্লাহর রহমতে হক্বের প্রতি মানুষের সীমাহীন আকর্ষণ এবং জামা‘আতবদ্ধ জীবনযাপনের প্রতি অভাবনীয় সাড়া দেখে হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় আলহামদুলিল্লাহ!
বাদ ফজর দরসের পর সাড়ে ১০-টা পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চলতে থাকে। বিশেষভাবে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ বাহরাইন শাখার আহবায়ক মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম ভাইয়ের বিশুদ্ধভাবে রাসূল (ছাঃ)-এর ছালাতের পদ্ধতির উপর দলীল ভিত্তিক বাস্তব প্রশিক্ষণ এবং ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম ও মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম ভাইয়ের বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশ্নোত্তর ছিল আকর্ষণীয়।
ইজতেমার ২য় দিন শুক্রবার সকাল সাড়ে ৮-টা হ’তে আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী কমপ্লেক্স-এর মহিলা শাখা ‘মহিলা সালাফিইয়াহ মাদরাসা’ ময়দানে মহিলাদের প্যান্ডেলে মহিলা সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে পর্দার অন্তরালে সমবেত মা-বোনদের উদ্দেশ্যে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। তিনি মুমিন নারী-পুরুষ উভয়কেই বিশুদ্ধ ইসলামের আলোকে পরিবার ও সমাজ সুন্দরভাবে গড়ে তোলার আহবান জানান।
জুম‘আর পূর্বে মারকাযের পূর্ব পার্শ্বে ‘বাংলাদেশ আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র উদ্যোগে গ্রন্থপাঠ প্রতিযোগিতা এবং পশ্চিমপার্শ্বে যুবসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। তিনি সংগঠনকে মযবূত করার এবং আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার আহবান জানিয়ে সারগর্ভ বক্তব্য পেশ করেন। যুবসমাবেশে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে এসে যোগদান করেন বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান জনাব সালমান এফ রহমান। পূর্ব থেকেই মঞ্চে বসে ছিলেন পাকিস্তানী মেহমান ডঃ ইদরীস যুবায়ের। অতঃপর তারা উভয়ই যুবকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য পেশ করেন। এ সময়ে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর কেন্দ্রীয় ও যেলা নেতৃবৃন্দও বক্তব্য রাখেন।
যুবসমাবেশ শেষে জুম‘আর ছালাতের জন্য ইজতেমার মূল প্যান্ডেলের দিকে যাওয়ার পথে লক্ষ্য করলাম মহানগরীর ছোট-বড় রাস্তাগুলো ধরে জায়নামায, পাটি হাতে কেউ একা, কেউবা সাথীসহ, কেউ নিজের শিশু সন্তানকে সাথে নিয়ে জুম‘আর ছালাতে অংশগ্রহণের জন্য ছুটছেন। খুৎবা শুরু হয়েছে। মুহতারাম আমীরে জামা‘আত খুৎবা দিচ্ছেন। পুরো মাঠ ও আশপাশ জুড়ে পিনপতন নীরবতা। মনোযোগ দিয়ে সবাই খুৎবা শুনছেন। প্যান্ডেলে এমনিতেই তিলধারণের ঠাই নেই। তথাপি নতুন মুছল্লীদের আগমন। যারা যেখানে কিঞ্চিৎ জায়গা পাচ্ছেন, সেখানে বসে যাচ্ছেন। দুপুরের দাবদাহকে তোয়াক্কা না করে খোলা আকাশের নীচে বসে খুৎবা শুনছেন অনেকে। খুৎবা চলাকালীন সময়ে ইজতেমা মঞ্চে উপস্থিন হন রাজশাহী মহানগরীর সাবেক মেয়র জনাব খায়রুয্যামান লিটন, খুৎবা শুরুর পূর্বক্ষণ থেকেই মঞ্চে আছেলন জনাব সালমান এফ. রহমান। জুম‘আর ছালাত শেষে প্রচন্ড দাবদাহ ও ধূলোকে সঙ্গী করে নিয়ে ইজতেমা প্যান্ডেলের পাশ দিয়ে হেঁটে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত, সালমান এফ. রহমান, খায়রুয্যামান লিটন, ড. ইদ্রীস যুবায়ের সহ সাথীবৃন্দ আপামর জনসাধারণের সাথে মিলে বুকস্টলগুলোতে হাযির হন। বুকস্টলের পাশাপাশি ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর স্বেচ্ছাসেবী রক্তদান সংস্থা ‘আল-আওন’-এর সার্বিক কার্যক্রম পরিদর্শন করেন।
অতঃপর অতিথিবৃন্দ মুহতারাম আমীরে জামা‘আতের অফিসে দুপুরের আতিথ্য গ্রহণ করেন। অতীতের স্মৃতি রোমন্থনের পাশাপাশি আমীরে জামা‘আত অতিথিবৃন্দকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গঠন এবং সেই সাথে তা ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে প্রচার-প্রসারে দৃঢ় ভূমিকা রাখার আহবান জানান। সেই সাথে সকল কার্যক্রম মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যেই করার জন্য নছীহত করেন।
অতঃপর বাদ আছর পুনরায় তাবলীগী ইজতেমার কার্যক্রম শুরু হয়। লক্ষাধিক মুছল্লী প্যান্ডেল ও প্যান্ডেলের বাইরে অবস্থান করে আলোচকবৃন্দের বক্তব্য শ্রবণ করতে থাকেন। বাদ মাগরিব আমীরে জামা‘আতের জ্যেষ্ঠ পুত্র আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব ও অন্যান্য আলোচকবৃন্দ বক্তব্য পেশ করেন।
ইজতেমার ২য় দিন বিকাল সাড়ে ৪-টায় আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, নওদাপাড়া, রাজশাহীর পশ্চিম পার্শ্বস্থ ময়দানে মাসিক আত-তাহরীক-এর এজেন্ট সম্মেলন’১৮ অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ প্রদান করেন আত-তাহরীক-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক মন্ডলীর মাননীয় সভাপতি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। তিনি সমবেত এজেন্টদেরকে আখেরাত লাভের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আত-তাহরীক-এর প্রচার-প্রসারে আত্মনিয়োগ করার আহবান জানান। আত-তাহরীক সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে বিভিন্ন যেলা থেকে আগত লেখক ও এজেন্টগণ বক্তব্য পেশ করেন। অতঃপর প্রধান অতিথি এজেন্টগণকে পুরস্কার প্রদান করেন।
ইজতেমা ময়দানে মারকায মাদ্রাসার হেফয বিভাগের হাফেয ছাত্রদের মাঝে সম্মাননা পুরস্কার প্রদান করেন মুহতারাম আমীরে জামা‘আত। ১৩ মাসে পবিত্র কুরআন হিফয সম্পন্ন করায় কাযী নাফীস ও তার পিতা কাযী হারূনুর রশীদ ছাহেবকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করা হয়। সাথে অন্যান্য হাফেয ছাত্র ও হিফয শাখার প্রধান শিক্ষক হাফেয লুৎফর রহমান ছাহেবকেও সম্মাননা দেয়া হয়। একই সাথে গ্রন্থ পাঠ প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের মাঝেও পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
পুরস্কার বিতরণ শেষে পুনরায় ধারাবাহিকভাবে আলোচনা চলতে থাকে। সারা রাতব্যাপী আলোচনা শেষে ফজরের ছালাতে ইমামতি ও ছালাতের পর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত আবেগঘন বিদায়ী ভাষণ শেষে বৈঠক ভঙ্গের দো‘আ পড়ে তাবলীগী ইজতেমা ২০১৮-এর সমাপ্ত ঘোষণা করেন।
ইজতেমা সমাপ্তির পর আমচত্বর ও এর চারপাশের রাস্তাগুলো হাযার হাযার মানুষের গন্তব্যে ফেরার পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। চারপাশের প্রতিটি রাস্তায় ইজতেমা ফেরত বাস/মিনিবাস, টেম্পু, সিএনজি-অটো রিক্সা, নছীমন-ভটভটি বাহন সমূহের ভিড়ে যানজটে পতিত হয়। দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষার পর আম চত্বর ধীরে ধীরে তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায়।
ফেরার পথের ট্রেনের টিকেটটা কাটা ছিল না। মহান আল্লাহর রহমতে ঢাকা যেলা ‘যুবসংঘে’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফের সহায়তায় ফিরতি টিকেটের ব্যবস্থা হ’ল। মারকায থেকে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হওয়ার পথেই দেখি মুহতারাম আমীরে জামা‘আত ফটকের সামনে চেয়ারে বসে আছেন। অনেকেই দো‘আ চেয়ে বিদায় নিচ্ছেন। তিনি ছলছল চোখে সকলের চলে যাওয়ার শেষ দৃশ্য অবলোকন করছেন। বিদায় নিতে গিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। মুছাফাহা করলাম মুখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করলাম না। খুব দ্রুতই বেরিয়ে আসলাম একবারও পিছনের দিকে তাকাইনি বুকের কোথাও শূন্যতা অনভূত হচ্ছিল অশ্রুসজল চোখকে সামলে নিয়ে রেলস্টেশন অভিমুখে ছুটে চললাম।
রেলস্টেশনে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। অধিকাংশ পুরুষ-মহিলাই ইজতেমা ফেরত। অধিকাংশের গন্তব্যই ঢাকা, গাযীপুর। কিছুটা আশ্চর্য হয়েছি, এজন্যই কি আজ শনিবার অথচ মঙ্গলবার পর্যন্ত কোন টিকেট নেই! কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে ভিড় সরিয়ে নির্ধারিত আসনে বসলাম।
পরিচিত হয়েছি কয়েক ভাইয়ের সাথে। ঢাকা যেলার বিভিন্ন স্থান থেকে তারা ইজতেমায় এসেছিলেন। অধিকাংশই বয়সে তরুণ ও যুবক। এবার ইজতেমায় তরুণ-যুবকদের আধিক্য দেখেছি। হাতে থাকা মার্চ’১৮ সংখ্যা মাসিক আত-তাহরীকটা এক ভাই চেয়ে নিয়ে পাশের পাগড়ি পরা অন্য ভাইকে পড়তে দিলেন। দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে দেখে এক ভাই নিজের সিট ছেড়ে দিয়ে আমার সাথে গল্প করতে লাগলেন। পরণের পোষাকে সম্ভ্রান্ত মনে হ’ল না। তবে পরিচ্ছন্ন। চেহারাতে চাকচিক্যের ছাপও নেই। বললাম, উঠলেন যে, সারারাত তো ঘুমাননি আলোচনা শুনেছেন সমস্যা হবে না? হেসে বললেন, ভাই আপনার সাথে গল্প করতে করতে সময় চলে যাবে ইনশাআল্লাহ। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলেন। নিজেদের ভাগের রুটি-কলার একটা অংশও আমাকে দিলেন। বললাম, আপনারা কয়জন এসেছেন? উত্তরে বললেন, ৭ জন। আমাদের এলাকা মাযহাবী, তাই দাওয়াত চলমান। গুটিকয়েক ভাই মিলে সাধ্যমত দাওয়াত পৌঁছিয়ে দেই। আমিতো ভাই তেমন উচ্চ শিক্ষিত নই, সেকারণ দাওয়াত দিতে গিয়ে যেভাবে মন থেকে চাই সেভাবে হয়ে উঠে না। তাই এক ভাইয়ের মাধ্যমে কম্পিউটারে টাইপ করে এটা বিলি করি, বলেই পকেট থেকে ছোট্ট চিরকুট বের করে দিলেন।
চিরকুটে লেখা আছে, আসুন! পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে জীবন গড়ি। ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’ কর্তৃক আয়োজিত সম্মেলন, মুহতারাম আমীরে জামা‘আত প্রদত্ত জুম‘আর খুৎবা এবং সাপ্তাহিক তা‘লীমী বৈঠকে প্রদত্ত বক্তব্যসহ সংগঠনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পর্কে নিয়মিত আপডেট পেতে ব্রাউজ করুন আমাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট http://multimedia.ahlehadeethbd.org, Youtube চ্যানেল ahlehadeeth andolon Bangladesh. ফেসবুক পেজ www.facebook.com/ Monthly.At-tahreek. ফৎওয়া হটলাইন-০১৭৩৮৯৭৭৭৯৭ (বাদ আছর থেকে মাগরিব)।
চিরকুট দেখে মানিকগঞ্জ থেকে আগত আল-আমীন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, কতগুলো করেছেন? তিনি বললেন, এক ভাই দুইশত করে দিয়েছে। দুইশ’ ব্যক্তির কাছে পৌঁছানোর পর আবার তৈরী করে নতুন ভাইদের কাছে বিলি করব ইনশাআল্লাহ। আমাদের কথোপকথন আশপাশের যাত্রীদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ কেউ মনোযোগী হয়ে শুনছেন, এরই মধ্যে আশিক নামে সুদর্শন এক যুবক ভাই তার আসন ছেড়ে দিয়ে অসুস্থ বৃদ্ধ যাত্রীকে বসিয়ে উঠে এসেছেন।
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছি তাদের কার্যক্রম। যেখানে আসনের আশায় রীতিমত যুদ্ধ, সেখানে সারারাত নির্ঘুম কাটানো দ্বীনি ভাইয়েরা নিজেদের আসনগুলো নির্দ্বিধায় ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যাচ্ছেন! অনেকে দু’টো আসনে মিলিতভাবে তিনজন বসেছেন। কথার মাঝে আশিক বললেন, ভাই, আলহামদুলিল্লাহ! আলোচনা খুব ভালো হয়েছে, প্রচুর লোকসমাগম হয়েছে। তবে আমার কাছে সবচেয়ে ভালো লেগেছে স্বেচ্ছাসেবক তরুণ-যুবক ভাইদের অক্লান্ত পরিশ্রম। দিন-রাত জেগে আগত জনতাকে সুশৃংখলভাবে পরিচালনা করা ও অন্যান্য কার্যক্রম সত্যিই কঠিন বিষয়। আমি একবেলা খাবারের প্যান্ডেলে খেয়েছি। ভিড়ের কারণে অন্য সময়গুলোতে খেতে পারিনি। বাইরের হোটেলগুলোর তুলনায় প্যান্ডেলের খাবারের স্বাদ ভাল, দামও কম। খাবারের প্যান্ডেলের স্বেচ্ছাসেবকদের দেখেছি বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন ধরনের কথাকে গায়ে না মেখে হাসিমুখে ধৈর্য ধরে সাধ্যমত সমাধানের চেষ্টা করছে। পার্থিব কোন লাভের আশা না করে তাদের কষ্ট ও হাসিমুখে ধৈর্যধারণ স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন হ’ত। মহান আল্লাহ তাদের উত্তম প্রতিদান দান করুন!
পাশের সিটের যে ভাই মাসিক আত-তাহরীক নিয়েছিলেন তিনি বললেন, পত্রিকাটা আমি কি রেখে দিতে পারি? বললাম, অবশ্যই। পাগড়ি পরা ঐ ভাই তখনও মাসিক আত-তাহরীক পড়ছেন। এখন তার বিষয় ‘ইমাম মাহদী’। বললাম, তিনি পাগড়ী পরা কেন? উত্তরে বললেন, টঙ্গীর ইজতেমায় যেতেন। এখন আহলেহাদীছদের ইজতেমায় এসেছেন বক্তব্য শ্রবণ করতে। এখন এটা পড়ছেন কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছেন না। মৃদু হেসে বললাম, মাসিক আত-তাহরীকের পাতায় দেয়া অফিসের নম্বরে যোগাযোগ করে গ্রাহক হয়ে যাবেন। প্রতিমাসে আপনার দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে মাসিক আত-তাহরীক। নিজে পড়বেন এবং অন্যদের মাঝে বিতরণ করে ছাদাক্বায়ে জারিয়ায় অংশগ্রহণ করবেন ইনশাআল্লাহ। এভাবে দ্বীনী ভাইদের সাথে স্মরণীয় কিছু স্মৃতি নিয়ে গন্তব্যে নেমে পড়লাম। আশা রাখলাম, আবার দেখা হবে জীবনের কোন এক ক্ষণে একক বা সম্মিলিতভাবে ইনশাআল্লাহ\