পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।
[২০০৫ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২০০৬ সালের ৮ই জুলাই। ১ বছর ৪ মাস ১৪ দিন]
২৫
তারিখ ফজর ছালাতের পর কুরআনের দরস দেওয়ার সময় যখন জমাদার এসে আমাকে
প্রস্ত্ততি নিতে বললেন, তখন সাথীদের মধ্যে কান্নার গুঞ্জন উঠে গেল। কে
কোনটা আমাকে হাদিয়া দিবে, সেই প্রতিযোগিতা শুরু হ’ল। ডেপুটি জেলার এসে আবেগ
ভরা কণ্ঠে ক্ষমা চেয়ে আমাকে বিদায় দিলেন। গোপালগঞ্জ পুরাতন কারাগারের
স্মৃতি তাই আমার জীবনে অম্লান হয়ে রইল। মযলূম মানুষদের ভালবাসায় যা সিক্ত
এবং নিখাদ শ্রদ্ধায় যা আপ্লুত।
এদিন আসার সময় দেখলাম এসএসএফ এসকর্ট বাwহনী। যা রাষ্ট্রের ভিভিআইপিদের জন্য দেওয়া হয়ে থাকে। স্মার্ট এই তরুণ পুলিশদেরকে জিজ্ঞেস করলে টাঙ্গাইলের পুলিশটি বলল, স্যার আপনার বিষয়ে উপর থেকে বিশেষ নির্দেশনা রয়েছে। সারা পথ তারা দ্বীনের নছীহত শুনেছে ও অত্যন্ত তৃপ্ত হয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অতিক্রম করার সময় তারা বলল, স্যার এখানে আপনার সংগঠন আছে কি? আমি কিছুই বললাম না। কুষ্টিয়া মজমপুর গেইটে নেমে ওরা নাশতা করল। আমাকেও করালো। ভাবছিলাম পরিচিত কেউ এসে পড়ে কি না। তাই গাড়ীর মধ্যেই নাশতা করলাম। পয়সা ওরাই দিল। এসকর্ট অফিসার ১০০ টাকার নোট দিলেন। কিন্তু দোকানদার বাকী টাকা ফেরৎ দিল না। উল্টা পুলিশের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করল। যোগ দিল পাশের দোকানদাররাও। এতে পুলিশের মেযাজ গরম হওয়া স্বাভাবিক। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি দ্রুত ওদেরকে ফিরে আসতে বললাম। কাছে এলে অফিসারকে বললাম, ১০০ টাকা যাক। আপনি সম্মান বাঁচিয়ে চলে আসুন। তিনি কথা মানলেন। অতঃপর দ্রুত গাড়ী স্টার্ট করে আমরা চলে এলাম। এখানে পুলিশ অফিসারের আদৌ কোন দোষ ছিল না।
নাটোর আসার পরে ওরা বগুড়া হয়ে যেতে চাইল। আমি রাজশাহী হয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিলাম। ওরা মেনে নিল। অতঃপর নওদাপাড়া অতিক্রম করার সময় অফিসার বলে উঠলেন, স্যার এইতো আহলেহাদীছ-এর কেন্দ্র। আমি বললাম, হ্যাঁ। আর কিছুই না বলে বারবার তাকাচ্ছিলাম ডাইনে ও বামে। কিন্তু কাউকে পাইনি। বাসার দিকে বারবার তাকাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম ছোট বাচ্চাটি হয়ত নীচে মাঠে খেলা-ধূলা করছে। কিন্তু তাকেও পাইনি। তখন বেলা ১১-টা ২০ মিনিট। দেখলাম শিক্ষক সাঈদুর রহমান কেবল বড় মসজিদে প্রবেশ করছেন। অতঃপর অব্যক্ত বেদনা নিয়ে জুম‘আর কিছু পূর্বে নওগাঁ নতুন কারাগারের ফটকে এসে উপস্থিত হ’লাম।
* সাধারণ সম্পাদক, আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ।
দরসে কুরআন : নওগাঁ জেলখানায় প্রথম রাত্রি শেষে আমীরে জামা‘আতের ইমামতিতে আমরা ফজরের ছালাত আদায় করি। এদিন তিনি সূরা মা‘আরেজ তেলাওয়াত করেন এবং তার উপরেই দরসে কুরআন পেশ করেন। যেখানে ৫-৬ আয়াতে আল্লাহ তাঁর রাসূলকে বলছেন, ‘তুমি উত্তমভাবে ছবর কর’। ‘তারা আমার শাস্তিকে বহু দূর মনে করে’। ‘অথচ আমরা একে নিকটবর্তী মনে করি’। অতঃপর সূরার শেষ দিকে ৪০-৪২ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘আমরা উদায়াচল ও অস্তাচল সমূহের শপথ করে বলছি, নিশ্চয় আমরা সক্ষম’। ‘তাদের পরিবর্তে উত্তম মানুষ সৃষ্টি করতে। আর এটা আমাদের সাধ্যের অতীত নয়’। ‘অতএব তুমি তাদেরকে ছেড়ে দাও। তারা বাক-বিতন্ডা ও খেল-তামাশায় মত্ত থাকুক প্রতিশ্রুত (ক্বিয়ামত) দিবসের সম্মুখীন হওয়া পর্যন্ত’ (মা‘আরেজ ৭০/৪০-৪২)। সেদিনের এই দরস যালেমদের বিরুদ্ধে আমাদের সকল ক্ষোভ মিটিয়ে দেয়। আমরা আল্লাহর ফায়ছালার উপর খুশী হয়ে যাই।
ডান্ডাবেড়ী খোলা ও মুক্ত আকাশের নীচে আগমন : আমাদের সেলের পিছনে অধিকাংশ সেলেই ছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির আসামীরা। এক একজনের একাধিক মামলা থাকার কারণে সবার পায়ে ডান্ডাবেড়ী পরানো থাকত। উঠা-বসা নড়া-চড়ার সময় বালায় বালায় ঘর্ষণে ঝন ঝন শব্দ হ’ত। বহু কয়েদী ও হাজতী এসব সেলে থাকত। কারো কারো দশ বারো বছর ধরে ডান্ডাবেড়ী পরে থাকার কারণে পায়ের নির্দিষ্ট স্থানগুলি মহিষের কাঁধের মত কালো ও শক্ত হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিন একই অবস্থা একই স্থানে থাকলেও ওরা ঐ শব্দে ও বেড়ীতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। সেলের কক্ষের মধ্যেই থাকতে হ’ত। আলো-বাতাসের মুখ দেখতে পেত না।
সকালেই আমাকে ডেকে বললেন, নূরুল ইসলাম! ঐ শব্দগুলো কিসের? আমি বিস্তারিত বললে তিনি ওদের দীর্ঘ দিনের ডান্ডাবেড়ীর মর্মান্তিক কষ্টের কথা শুনে অত্যন্ত ব্যথিত হন। অতঃপর সুবেদার ছাহেব এলে তিনি তাঁকে বলেন, সুবেদার ছাহেব! এরা কি মানুষ নয়? পশুকেও মানুষ শিকল দিয়ে এভাবে বেঁধে রাখে না। এক্ষুণি এদের ডান্ডাবেড়ী খুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। সুবেদার উত্তরে বললেন, স্যার আমি নিজেও এর বিরোধী। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। এটা জেল কোড-এর বিধান’। তবে আমি সুপার ছাহেবকে বলে কিছু করা যায় কি না দেখব।
পানির বোতল, আলু ভর্তা ও ডাল : ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসে উন্নত মানের খাবার দেওয়া হ’ল। পরদিন ২৭শে মার্চ কারাগারের নিয়ম অনুযায়ী নাশতার জন্য একটা করে রুটি ও গুড় এল। দুপুরে দু’টি রুটি ও গুড়। রাতে সবজি ও ডাল। আমীরে জামা‘আত বললেন, এটা চলবে না। জেলার এলেন। তিনি তাঁকে দুপুরে ভাত, আলু ভর্তা ও ডালের কথা বলে দিলেন। পাশ হয়ে গেল। এছাড়া আমাদের জন্য বাহির থেকে পিয়াজ, মরিচ, সরিষার তৈল ইত্যাদি আনার অনুমতি হ’ল। আযীযুল্লাহর ভাষায় দুপুরে ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল কারাগারের ‘রাজকীয় খানা’। যা নওগাঁ জেলখানা থেকে বের হওয়ার আগ দিন পর্যন্ত কেবল আমাদের জন্য অব্যাহত ছিল।
আমীরে জামা‘আতের কারণে আমরা ডান্ডাবেড়ী থেকে রেহাই পেয়েছিলাম। তিনি নওগাঁ থেকে অন্য কারাগারে চলে যাওয়ার পরেও আমাদের জন্য দুপুরে ভাত, আলু ভর্তা ও ডাল অব্যাহত ছিল। কর্তা ব্যক্তিরা জেল পরিদর্শনে এলে আমীরে জামা‘আতের কেইস পার্টনার হিসাবে আমাদের প্রতি বিশেষ সম্মান প্রদর্শন করতেন। যেমন একদিন একজন কর্তা ব্যক্তি জেল পরিদর্শনে এসে আমাদের কক্ষ ছাড়িয়ে চলে গেলেও পুনরায় ফিরে আসেন এবং আমাদের সাথে বিশেষভাবে কুশল বিনিময় করেন। সালাফী ছাহেব এ সময় সর্বদা নিজেকে আমীরে জামা‘আতের ‘সেকেন্ড ম্যান’ বলে পরিদর্শকদের সামনে নিজের পরিচয় দিতেন। তাঁকে একবার ঢাকা কারাগারে নেওয়া হ’লে সেখান থেকে ফিরে এসে আমাদের বললেন, ঢাকা কারাগারের আমদানী ওয়ার্ডের অব্যবস্থাপনা অবর্ণনীয়। আমি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে আছি। ভিড়ের মধ্যে আমি কোন দিশা পাচ্ছিনা। হঠাৎ একজন কয়েদী এসে আমার পরিচয় জিজ্ঞেস করলে আমি তার কাছে আমীরে জামা‘আতের নাম বলি এবং নিজেকে তাঁর কেইস পার্টনার হিসাবে পরিচয় দেই। তাতেই সে ভক্তি গদগদ হয়ে আমাকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ভালভাবে থাকার ব্যবস্থা করে দিল। পরে বুঝলাম সে একজন প্রভাবশালী ম্যাট।
এআইজি প্রিজনের আগমন : ঢাকা থেকে এআইজি প্রিজনের নওগাঁ জেলখানা পরিদর্শনের কথা। হয়তবা আমীরে জামা‘আতকে দেখতে এসেছেন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যেদিন কারাগার পরিদর্শনে আসেন, সেদিন এর চেহারা পালটে যায়। খাবারের মান সুন্দর হয়ে যায়। সকালে সুবেদার এসে স্যারকে অনুরোধের স্বরে বললেন, দয়া করে কোন বিষয়ে অভিযোগ করবেন না স্যার। অভিযোগ করলে আমরা বিপদে পড়ব। এমনকি চাকরীও চলে যেতে পারে। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, কয়েদীদের হক নষ্ট করবেন না- অভিযোগ দিব না। নইলে যা বলার তাই বলব। জেলখানায় পাগলা ঘণ্টা বেজে উঠল। সমস্ত ওয়ার্ড ও সেল বন্ধ করে দেওয়া হ’ল।
বেড়ী খোলা সমাচার : এআইজি এক এক করে সমস্ত ওয়ার্ড ঘুরে সবশেষে আমাদের সেলে এসে সালাম দিয়ে বললেন, কেমন আছেন স্যার? উত্তরে স্যার বললেন, আলহামদুলিল্লাহ ভাল আছি। তবে সিংহকে আর কত দিন লোহার খাঁচায় বন্দী রাখবেন? উনি চুপ থাকলেন। তারপর স্যার বললেন, আপনার কাছে আমার দু’টি বিষয়ে নিবেদন। (এক) কয়েদীদের ডান্ডাবেড়ী পরানোর নিয়মটি বাতিল করুন। জেলখানার ১৫ ফুট উঁচু প্রাচীর, তার মধ্যে সেলের দশ ফুট উঁচু প্রাচীর, তার মধ্যে এত কারারক্ষী পাহারাদারকে ডিঙ্গিয়ে ওরা কিভাবে পালিয়ে যাবে? এআইজি বললেন, স্যার আমাদের কিছু করার নেই। ১৯০৮ সালে বৃটিশ সরকার যে জেলকোড লিখে গেছেন, তা আজও পরিবর্তন হয়নি। আমীরে জামা‘আত বললেন, বৃটিশকে তাড়ালেন, পাকিস্তানকে তাড়ালেন, কিন্তু তাদের আইন তাড়াতে পারলেন না? স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষগুলিকে আজও জেলখানার মধ্যে ডান্ডাবেড়ীর শৃংখলে আবদ্ধ রাখছেন? আমরা ওদের পায়ের বেড়ীগুলি সর্বদা খোলা দেখতে চাই। (দুই) সারা দেশের হাযার হাযার কয়েদী ও হাজতীদের শুক্রবারের জুম‘আর ছালাত থেকে বঞ্চিত রেখেছেন। তারা যদি হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে বাদী হয় যে, কারা কর্তৃপক্ষ আমাদেরকে জুম‘আর ছালাত আদায় করতে দেয়নি, তাহ’লে সেদিন আল্লাহর কাছে আপনারা কি জবাবদিহী করবেন? স্যার বললেন, প্রত্যেক জেলখানার ভিতরে জামে মসজিদ তৈরী করতে হবে। সমস্ত মুসলিম কারাবন্দী যাতে শুক্রবারে এক সাথে ছালাত আদায় করতে পারে। সৎ ও তাক্বওয়াশীল বিজ্ঞ আলেমদের নিয়ে এসে খুৎবায় আল্লাহভীতির নছীহত করতে হবে। খারাপ পথ থেকে ভাল পথে ফিরে আসার উপদেশ দিতে হবে। আখেরাতে মুক্তির উপায় বলতে হবে। তবেই তো একজন পাপী জেলখানায় এসে পাপ মুক্ত হয়ে সৎ মানুষ হয়ে ফিরে যাবে। এআইজি বললেন, স্যার আপনার পরামর্শ বাস্তবায়নের চেষ্টা করব। আমার জন্য দো‘আ করবেন।
পরের দিন দেখা গেল সুবেদার এসে সবার ডান্ডাবেড়ী খুলে দিলেন। কেবল আদালতে নেওয়ার সময় ডান্ডাবেড়ী পরানো হ’ত। তাছাড়া সেলের মধ্যে কক্ষের বাইরে আসার অনুমতি দেওয়া হ’ল। ফলে দীর্ঘ দিনের কক্ষবন্দী এই মানুষগুলো মুক্ত আকাশের নীচে চলাফেরার সুযোগ পেয়ে ধন্য হ’ল। আমাদের পাশের কক্ষের ফাঁসির আসামীরা প্রতিদিন বিকালে বের হওয়ার সুযোগ পেল।
খাঁচায় বন্দী পাখি মুক্তি পেলে যেমন আনন্দে আকাশে উড়তে থাকে, ওরাও তেমনি বহুদিনের শিকল পরা বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে আনন্দে স্যারের প্রশংসায় উল্লাস করতে লাগল। আলহামদুলিল্লাহ। দেখা হ’লেই ওরা বলত, স্যারকেই আমরা এদেশের ‘প্রেসিডেন্ট’ পদে দেখতে চাই। স্যার আসার সাথে সাথে জেলখানার পরিবেশ উন্নত হয়েছে। খাবার মান ভাল হয়েছে। ম্যাটদের অত্যাচার কমেছে। সারা জেলখানায় যেন একটা স্বস্তি ও শান্তির বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
এই ঘটনার প্রায় ১০ বছর পর গত ২৯শে এপ্রিল’১৫ তারিখে রাজশাহী কারাগার থেকে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত রাজশাহী শহরের একটি প্রসিদ্ধ কামিল মাদরাসার প্রিন্সিপ্যাল ছাহেব সাক্ষাৎ করতে এসে মুহতারাম আমীরে জামা‘আতকে বলেন, স্যার! নওগাঁ জেলের আপনার একজন কারা সাথী আপনাকে সালাম দিয়েছেন। তিনি দীর্ঘ দিনের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদী। তিনি বলেছেন, স্যারের কারণেই আমরা আজ বেড়ী মুক্ত। দীর্ঘদিন ডান্ডাবেড়ী পরার কারণে আমাদের পাগুলি কালো কুচকুচে ও শক্ত হয়ে গেছে। কখনো কখনো সেখানে পচন ধরে। আমার মত অসংখ্য বেড়ী মুক্ত কয়েদী স্যারের জন্য সর্বদা দো‘আ করে থাকি। কত নেতা জেলে এসেছে, গিয়েছে, কত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কিন্তু কারু কাছ থেকে কারাবন্দীরা সামান্য উপকার বা সহানুভূতি পায়নি। স্যার কোন রাজনৈতিক দলের নেতা নন। কেবলই মানবিক তাকীদ থেকে তিনি আমাদের জন্য যা করেছেন, তা আমরা আমৃত্যু স্মরণ করব ও তাঁর জন্য প্রাণ ভরে দো‘আ করব।
লাল পানি সমাচার : নওগাঁ জেলের পানি ছিল লাল। আয়রণে ভরা। আমাদের জন্য বাহির থেকে পানির বোতল আনার সুযোগ দেওয়া হ’ল। আযীযুল্লাহ সেই খালি বোতলে ইটের ও কয়লার টুকরা এবং বালি ভরে তাতে লাল পানি ঢেলে নীচে স্যালাইনের খালি পাইপ ঢুকিয়ে দিয়ে পানি ফ্রেশ করার বুদ্ধি বের করল। যা দিয়ে পৃথক খালি বোতলে ফোঁটা ফোঁটা পানি জমত। যেটা পরে আমরা পান করতাম। আমাদের অতিরিক্ত খালি বোতলগুলি ক্রমে সারা কারাগারে চলে গেল ও সেখানে একই পদ্ধতিতে পানি পরিষ্কার করার ব্যবস্থা হ’ল। এমনকি জেলার ও সুপার ছাহেব নিজেরাও উক্ত পদ্ধতি নিজেদের বাসায় চালু করেন।
আমীরে জামা‘আত সুপার ছাহেবকে বলেছিলেন, আপনি কয়েদীদের নিকট থেকে দশ টাকা করে নিয়ে হ’লেও যেলা শহরের মেইন লাইন থেকে লাইন টেনে ফ্রেশ পানি আনার ব্যবস্থা করুন। আমরা টাকা দিব। তিনি বললেন, এটা জানতে পারলে সাংবাদিকরা পিছে লাগবে এবং বলবে যে, আমি আপনাদের নিকট থেকে ঘুষ খেয়েছি। অথচ সরকারের কাছে বারবার আবেদন করেও টাকা পাচ্ছি না। ফলে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে।
নওগাঁ থানায় রিম্যান্ডে : কয়েকদিন একত্রে থাকার পর ২৯.০৩.০৫ তারিখে নওগাঁর দু’টি মামলায় আমাদের হাযিরা দেওয়ার জন্য আদালতে নেওয়া হ’ল। সেদিন ছিল আদালত প্রাঙ্গণে ‘আন্দোলন’ ও যুবসংঘের নেতা-কর্মী এবং সাধারণ মানুষের ঢল। অনেকের ছিল অশ্রুভেজা চক্ষু। আদালত থেকে চারদিনের রিম্যান্ডে থানা হাজতে নেওয়া হ’ল। ওসি ছাহেব থানা হাজতের একটি ঘর পরিচ্ছন্ন করে আমাদেরকে সসম্মানে থাকার ব্যবস্থা করলেন। ঐদিন অফিস সহকারী মুফাক্ষার ভাইয়ের পাঠানো নতুন বড় চাদরটি বিছিয়ে আমীরে জামা‘আত পাশের কক্ষে একাকী শুয়েছিলেন। তিনি বারবার মুফাক্ষারের জন্য দো‘আ করছিলেন। চাদর পাওয়ার আগে আমীরে জামা‘আত পরিহিত কাপড় সহ মেঝেয় শুয়ে পড়েন। এ দৃশ্য দেখে জনৈকা মহিলা পুলিশ অফিসার জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। আমীরে জামা‘আত বিষয়টি টের পেয়ে তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তিনি কাঁপা গলায় বলেন, স্যার আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলাম। এরপর তিনি আর কোন কথা বলতে পারেন নি....। এই ঘটনার কিছু পর ওসি ছাহেব এসে জিজ্ঞেস করলেন, স্যার আপনি কি একা থাকবেন, না পাশের রুমে আপনার সাথীদের সঙ্গে থাকবেন? তিনি বললেন, আমাকে সাথীদের সঙ্গে রাখুন। তখন তাঁকে আমাদের কক্ষে স্থানান্তর করা হ’ল।
পরদিন দুপুরে হঠাৎ দেখি আমীরে জামা‘আতের মেজ ছেলে আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীবকে সঙ্গে নিয়ে ওসি ছাহেব দরজার মুখে হাযির। প্রিয়জনকে কাছে পেলে কত আনন্দ লাগে কারাজীবনে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। আমাদের জন্য সে বাসা থেকে রান্না করা খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু ওসি ছাহেব বললেন, খাবার টেস্ট করতে হবে। তখন নাজীব বাটি থেকে একটু খেল। তারপর আমাদেরকে সেটা দেওয়ার অনুমতি হ’ল। বলা বাহুল্য, জেলখানায় যাওয়ার পর গত ৩৫ দিনে এটাই ছিল প্রথম বাড়ীর খাবার। সে তৃপ্তি ভুলবার নয়।
খাবার সময় ওসি ছাহেব নিজ বাসা থেকে কাঁচের প্লেট ও গ্লাস নিয়ে আসেন। বাহির থেকে খাবার আনার অনুমতি দেন। তার আন্তরিকতায় আমরা মুগ্ধ হ’লাম। সকালে সুইপার হিন্দু ছেলেটি এসে বলল, আপনারা কোনখানের মানুষ? আমার বাবা এখানে সুইপার ছিলেন। এখন আমি সুইপার। কিন্তু কখনো কোন এসপি-কে দেখিনি যে, রাত্রি ১২-টার পর এসে হারপিক নিয়ে নিজ হাতে টয়লেট-বাথরুম তদারকি করেন’। আমরা যাওয়ার আগেই হাজত কক্ষটির দেওয়াল চুনকাম করা হয়েছে। যাতে দেওয়ালের পানের পিক ও অন্যান্য ময়লা ছাফ করা হয়েছে। বলা বাহুল্য এসপি ছিলেন অতি ভদ্র মানুষ এবং আমীরে জামা‘আতের প্রতি অতীব শ্রদ্ধাশীল।
পরদিন সকাল ১০-টায় রিম্যান্ড শুরু হয়। পোরশা থানার ব্যাংক ডাকাতি ও নওগাঁ রাণীনগর থানার খেজুর আলী হত্যা মামলার আসামী আমরা। আমাদের নাম-ঠিকানা ইত্যাদি পরিচয় লেখার পর আমীরে জামা‘আতকে উদ্দেশ্য করে মাননীয় ডিসি মহোদয় বললেন, স্যার আপনাদের বিষয়ে আমরা সবই জানি। আপনারা পরিস্থিতির শিকার। অতএব আমাদের কিছু নছীহত করুন! তখন আমীরে জামা‘আত দরদভরা কণ্ঠে প্রায় আধা ঘণ্টা নছীহত করলেন। ডিসি ছাহেব সেগুলি টেপ করে নিয়ে চলে গেলেন। পরদিন এসে পুনরায় একই দাবী করলেন এবং বললেন, আমার স্ত্রী টেপ শুনে অত্যন্ত খুশী হয়েছেন। তিনি আজকে পুনরায় আপনার নছীহত শুনতে চেয়েছেন। তখন আমীরে জামা‘আত আখেরাতে মুক্তি লাভের শর্তের উপর মর্মস্পর্শী ভাষায় উপদেশ দেন। অতঃপর বিদায়ের সময় মাননীয় ডিসি ছাহেব বলেন, স্যার আপনার থিসিস আমি পড়েছি। আমি একজন ‘আহলেহাদীছ’। এ সময় তাঁর কণ্ঠ ছিল ভারাক্রান্ত।
এভাবে চারদিনের রিম্যান্ড শেষে ১.০৪.০৫ইং তারিখে আমরা পুনরায় নওগাঁ যেলা কারাগারে ফিরে আসি।
জেলখানায় প্রথম সাক্ষাৎকার : আমীরে জামা‘আত নওগাঁ জেলখানায় এসেই আমাদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভা করলেন। তিনি বললেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশে আহলেহাদীছ আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে। আমরা ৪ জন কারাবন্দী। সরকারের মতি-গতি বোঝা যাচ্ছে না। আমাদের বের হ’তে হয়তবা দেরী হবে। ভারপ্রাপ্ত আমীর নিয়োগ করা দরকার। আপনাদের পরামর্শ চাচ্ছি।
আমাদের পরামর্শক্রমে ঐ সেশনে প্রশিক্ষণ সম্পাদক ড. লোকমান হোসাইনকে ভারপ্রাপ্ত আমীর নিয়োগ দানের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া হ’ল। পরের দিন সুবেদার ছাহেব খবর দিলেন আজ আপনাদের ‘দেখা’ এসেছে। ‘দেখা’ জেলখানার একটি প্রিয় শব্দ। কারণ এদিন বন্দীদের প্রিয় ব্যক্তিরা তাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সাধারণতঃ দশ দিন পরপর আধা ঘণ্টার জন্য এই সুযোগ দেওয়া হয়। তবে কেন্দ্রীয় কারাগার সমূহে এই নিয়মের কিছু ব্যত্যয় ঘটে থাকে।
আমীরে জামা‘আতের সাথে আমাদেরও ‘দেখা’ এসেছিল। ফলে আমরাও গেলাম। গিয়ে দেখি সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, প্রশিক্ষণ সম্পাদক ড. লোকমান হুসাইন, সমাজকল্যাণ সম্পাদক ড. মুছলেহুদ্দীন, আত-তাহরীক সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইন, কেন্দ্রীয় মুবাল্লিগ মুহাম্মাদ আব্দুল লতীফ, নওদাপাড়া মাদরাসার কয়েকজন শিক্ষক, মেহেরপুর যেলা সংগঠনের দায়িত্বশীল তরীকুযযামান সহ অনেকেই উপস্থিত আছেন। পৃথক পৃথক ছোট্ট জানালার ফাঁক দিয়ে সালাম বিনিময়ের পর বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ হ’ল। সাংগঠনিক বিষয়ে আলোচনা শুরু হ’লে আমীরে জামা‘আত আমাদের পরামর্শের কথা ঘোষণা দেওয়ার পূর্বেই অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম ভাই বললেন, স্যার আমরা পরামর্শক্রমে ড. মুছলেহুদ্দীন ভাইকে ‘ভারপ্রাপ্ত আমীর’ বানিয়েছি। আমীরে জামা‘আত একটু থেমে থাকলেন। পাশে আমি তাদের বিধি-বহির্ভূত অসাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নাকচ করে আমাদের পরামর্শের কথা জানাব বলে চিন্তা করছি। এমন সময় আমীরে জামা‘আত বাইরের পরিস্থিতি ও তাদের স্বতঃস্ফূর্ত এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিলেন এবং কিছু উপদেশ দিলেন। বেশ কিছু পরামর্শ দিলেন। যেমন- গ্রামে-গঞ্জে সাংগঠনিক মযবূতী সৃষ্টির জন্য ব্যাপক দাওয়াতী সফর করা। পেপার-পত্রিকায় ও সর্বস্তরে আমাদের অবস্থান, সাংগঠনিক লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, চিন্তা ও দর্শন তুলে ধরা এবং নেতৃবৃন্দের মুক্তির জন্য লেখালেখি করা। এ অন্যায়ের বিরূদ্ধে ব্যাপক জনমত সৃষ্টি ও মিটিং-মিছিল করা ইত্যাদি।
অধ্যাপক সিরাজ ভাই আমার কাছে রাজনৈতিক পার্টি খুলে তার মাধ্যমে সরকারকে চাপ দেওয়ার কথা বললেন এবং পার্টির নাম কি হবে এবিষয়ে আমাদের পরামর্শ চাইলেন। এ ব্যাপারে তদানীন্তন কোন একটি রাজনৈতিক মহলের পরামর্শের কথাও বললেন। আমি এত সংক্ষিপ্ত সময়ে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়া যা আমাদের আদর্শ ও মূলনীতির বিরোধী, সেটা করা বৈধ হবে কি-না তা খতিয়ে দেখার পরামর্শ দিলাম। অতঃপর আমাদের যামিনের বিষয়ে অগ্রগতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম।
ড. লোকমান আমাকে রিম্যান্ড সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। আমি বললাম, আল্লাহর রহমত যে, আমরা আমীরে জামা‘আতের সাথে এ্যারেষ্ট হয়েছি। সকলকেই আল্লাহ সম্মানের সাথে রেখেছেন। তবে রিম্যান্ডে যেসব তথ্য নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তা আমাদের ঘরের লোকেরাই সরবরাহ করেছে। এমন কিছু কথা যা তারা ছাড়া কেউ জানতোনা সে বিষয়েও আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে। কেননা একটি লিখিত কাগজ দেখে দেখে আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছিল। যা নিশ্চিতভাবেই আমাদের বহিস্কৃত ব্যক্তিটির সরবরাহ করা তথ্য। যাইহোক ইতিমধ্যে আমাদের সাক্ষাতের নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে গেল। কান্না বিজড়িত কন্ঠে সবাইকে বিদায় জানিয়ে আমরা আমাদের নির্ধারিত সেল কক্ষে ফিরে এলাম।
সিরাজগঞ্জের রিম্যান্ড : আমাদের উপর চাপানো মিথ্যা মামলা সমূহের মধ্যে অন্যতম ছিল সিরাজগঞ্জ যেলার উল্লাপাড়া থানায় ‘নেওয়ার গাছা’ গ্রামীণ ব্যাংক শাখায় বোমা হামলার একটি মামলা। ঐ মামলায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার কর্তৃক গঠিত জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে পরপর দু’বার তিন দিন করে ছ’দিন রিম্যান্ডে নেওয়া হয়। প্রথমবার ২৯ হ’তে ৩১শে মে ২০০৫ পর্যন্ত তিনদিন রিম্যান্ড হয়। সে মতে ২৮ তারিখ দুপুরের মধ্যেই আমাদেরকে সিরাজগঞ্জ যেলা কারাগারে পৌঁছানো হয়। স্যার এলেন একাকী গাইবান্ধা কারাগার থেকে এবং আমরা তিনজন গেলাম নওগাঁ কারাগার থেকে। পৌঁছলাম প্রায় একই সময়ে। কারা অফিসে ঢুকে ডেপুটি জেলার হিসাবে পেলাম আমীরে জামা‘আতের এক ছাত্রকে। অতঃপর যথারীতি কারাগারের সেলে নেওয়া হ’ল। রুমগুলি ছিল তুলনামূলকভাবে ছোট। উপরন্তু নেই কোন ফ্যানের ব্যবস্থা। আমীরে জামা‘আতকে পৃথক রুমে রাখা হ’ল। সকালে শুনলাম পানির পাইপ দিয়ে বড় এক গেছো ইঁদুর রাতভর ডিসটার্ব করেছে।
পরদিন আদালতে নেওয়া হ’ল। সেখানে এক নতুন অভিজ্ঞতা। আদালত ভবন ও প্রাঙ্গণ নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষে ঠাসা। কোর্ট হাজতে প্রবেশ করলাম। একেবারেই ফাঁকা। আমাদের চারজনের জন্য একটা ঠেস বেঞ্চ। আমাদের কেইস পার্টনার কম্পিউটার সায়েন্সের জনৈক ছাত্র নীচে বসে আছে। আমীরে জামা‘আত তাকে বারবার আমাদের সাথে বেঞ্চে বসার জন্য বললেন। কিন্তু ছেলেটি রাযী হ’ল না। পরে সে বলল, স্যার! আমি আপনাদের সাথে আসামী। আমি কয়েকবার এখানে হাযিরার জন্য এসেছি। কিন্তু আসামীদের ভিড়ে কখনো বসতেও জায়গা পাইনি। কিন্তু আজকে দৃশ্য সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে। সব আসামীকে বারান্দায় লাইন দিয়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে। হাজতখানা ও টয়লেট চুনকাম করা হয়েছে। এখন বুঝলাম এসবই আপনাদের কারণে।
হঠাৎ আযীযুল্লাহ বলল, স্যার গেইটের দিকে চলুন। বলতেই তাকিয়ে দেখি একজন পুলিশ অফিসার স্যারের উদ্দেশ্যে স্যালুট ও সালাম দিচ্ছেন। আমরা সবাই এগিয়ে গেলাম। লোহার শিকের দরজার মাঝখান দিয়ে মুছাফাহা হ’ল। তিনি অত্যন্ত ভদ্রভাবে নিজের পরিচয় দিলেন এডিশনাল এসপি ও রিম্যান্ডের প্রধান হিসাবে। অতঃপর তিনি আমাদের সাথে কুশল বিনিময় শেষে তাঁর সাথীদের নিয়ে চলে গেলেন।
বেশ কিছু পরে আমাদেরকে আদালতের উদ্দেশ্যে বের করা হ’ল। কাউকে কাছে ভিড়তে দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু মানুষ মানছে না। অশ্রু ছলছল নেত্রে সবাই সালাম করছে। ভীড়ের মধ্যে আমার বড় ভাই আমাকে একজোড়া স্যান্ডেল দিল। অতঃপর আদালত কক্ষে প্রবেশ করলাম। কিন্তু সেখানে দাঁড়ানোর জায়গা নেই। এমনকি আমাদের কাঠগড়াতেও উঠানো হ’ল না। আমাদের উকিল ও জজ-এর মধ্যে অল্পক্ষণ কথার পরেই আমাদেরকে পুলিশ বের করে আনল।
এবার পুলিশ ভ্যানে উঠার পালা। প্রচন্ড ভীড় ঠেলে চলেছি। ভ্যানে উঠছি। এমন সময় জনৈক ব্যক্তি এক ছড়া লিচু আমীরে জামা‘আতের হাতে দিতে গেল। এটাই তার অপরাধ হ’ল। তখনই তাকে এ্যারেস্ট করা হ’ল। পরে তার নাম জেনেছি। তিনি সিরাজগঞ্জ বাজারে একটি ঔষধের দোকানের মালিক। তার এই অন্যায় গ্রেফতারের বিরুদ্ধে ব্যবসায়ী সমিতি ফুঁসে ওঠে। ফলে দু’সপ্তাহ কারাগারে থেকে তিনি মুক্তি পান।
এবার আমাদেরকে সরাসরি সদর থানায় নেওয়া হ’ল। কর্মীরা কেউ জানতে পারেনি আমাদের কোথায় নেওয়া হচ্ছে। ফলে আমীরে জামা‘আতের জ্যেষ্ঠ পুত্র ছাকিব ও তার সাথীরা জামতৈল থানা অতঃপর উল্লাপাড়া থানায় চলে যায়। কিন্তু না পেয়ে গভীর দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে আসে। পরদিন আব্দুল লতীফ সদর থানায় গিয়ে আমাদের সন্ধান পায়। তার পরদিন ছাকিব ও সালাফী ছাহেবের ছেলে আব্দুল হামীদ সদর থানায় গিয়ে সাক্ষাৎ করে।
এখানে আমাদেরকে পরিচ্ছন্ন মহিলা হাজত খানায় রাখা হয়। যেখানে কোন মহিলা হাজতী ছিল না। এডিশনাল এসপি ছাহেব নিজ হাতে বালতি ভরে বাথরুমে পানি এনে রাখলেন। যিনি ছিলেন রিম্যান্ড কমিটির প্রধান। আমীরে জামা‘আত বিনয় প্রকাশ করে তাকে বললেন, আপনি এটা কি করছেন? এটুকু আমরাই তো পারি। জবাবে তিনি বললেন, আমাকে একটু খিদমতের সুযোগ দিন। তাঁর এই ভদ্রতায় আমরা মুগ্ধ ও বিস্মিত হলাম।
যোহরের ছালাত শেষে আমরা বসে আছি। এমন সময় দেখি বারবার পুলিশ আসছে। আর আমাদেরকে সালাম দিয়ে দো‘আ চেয়ে চলে যাচ্ছে। একজন পুলিশ জানালার ধারে অপেক্ষা করছে কিছু জানার জন্য। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই কিছু বলবেন কি? তিনি বললেন, স্যার! আজকে মসজিদে এক কান্ড ঘটে গেছে। এএসপি ছাহেব ছালাত শেষে দাঁড়িয়ে আমাদের বললেন, থানা হাজতে ড. গালিব ও তাঁর তিনজন সাথী এসেছেন। তোমরা যদি দো‘আ নিতে চাও, তবে এখুনি গিয়ে সালাম দিয়ে দো‘আ চেয়ে এসো। এমন মানুষ তোমরা হয়ত আর কাছে পাবে না’। স্যার এজন্য আমরা আপনার নিকট দো‘আ নেওয়ার জন্য এবং এক নযর দেখার জন্য এখানে এসেছি। আপনারা আমাদের জন্য দো‘আ করবেন যেন ভাল হয়ে চলতে পারি।
নওগাঁর ন্যায় এখানেও রিম্যান্ডে ডিসি ও এসপি মহোদয় অত্যন্ত ভদ্র ব্যবহার করেন। আমীরে জামা‘আত বানান ভুল সহ্য করতে পারেন না। তিনি বললেন, টেপরেকর্ডার নিয়ে আসুন এবং আমার বক্তব্য রেকর্ড করুন। তাতে কর্তৃপক্ষ খুবই খুশী হ’লেন এবং সেটাই করা হ’ল। একপর্যায়ে যেলা ডিবি পুলিশের প্রধান বললেন, আপনার সহকর্মী প্রফেসর, যিনি একটি আহলেহাদীছ সংগঠনের প্রধান, তার নিকটে তথ্য নিতে গেলে তিনি বলেন, ‘আমরা হ’লাম উদার এবং উনি হ’লেন কট্টর’। ঐ সময় এই ধরনের মন্তব্য যে কত কঠিন ছিল, ভুক্তভোগী মাত্রই তা বুঝতে পারেন। আমীরে জামা‘আত কথাটি সহজভাবে নিয়ে বললেন, বেশ। আপনি একজন মুসলমান। কিন্তু ইসলামের বিধান সমূহ তেমন মেনে চলেন না। আপনি সব ব্যাপারে শিথিলতা দেখান। কিন্তু আরেকজন ভাই ইসলামের বিধান সমূহ সঠিকভাবে মেনে চলেন এবং অন্যকে মেনে চলার দাওয়াত দেন। এখন আপনিই বিচার করুন কাকে আপনি ‘উদার’ বলবেন ও কাকে আপনি ‘কট্টর’ বলবেন’। উপস্থিত কর্মকর্তাগণ সকলে খুশী হ’লেন।
ঐদিন ডিবি কর্মকর্তার মুখে ঐ প্রফেসরের উপরোক্ত মন্তব্য শুনে আমরা গভীরভাবে দুঃখিত ও বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ সে সময় চরমপন্থী জেএমবিদেরকে বাঁচিয়ে আমাদেরকে জঙ্গী প্রমাণের জন্য সরকারীভাবে সাধ্যমত চেষ্টা করা হচ্ছিল। অথচ একটি আহলেহাদীছ সংগঠনের নেতা হয়েও তার কাছ থেকে সামান্যতম সহানুভূতিও আমরা পাইনি।
স্যার কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতিতে মিশতেন না। যদিও তিনি সমিতির সদস্য চাঁদা নিয়মিত পরিশোধ করতেন। তিনি সহকর্মীদের সাথে বলতেন, দলাদলির রাজনীতি পরস্পরের মধ্যে হিংসা ও রেষারেষি সৃষ্টি করে। তার চাইতে এটাই কি ভাল নয় যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠতম তিনজন প্রফেসরের মধ্য থেকে মহামান্য চ্যান্সেলর একজনকে ভাইস চ্যান্সেলর মনোনীত করবেন। একইভাবে অনুষদ ও বিভাগীয় ছাত্র সংসদে শ্রেণী ও মেধা তালিকায় সর্বোচ্চদেরকে নিয়ে ‘ছাত্র সংসদ’ গঠন করা উত্তম নয় কি? এর ফলে শিক্ষক ও ছাত্রদের দলাদলির প্রচলিত নোংরা রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে। সবাই মেধাকে সম্মান করবে এবং পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু এ কথা সমর্থন করলেও মেনে নেওয়ার মত কাউকে পাওয়া যায়নি। সম্ভবতঃ সে কারণেই ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি’ স্যারের পক্ষে কোন বিবৃতি দেয়নি। আর এইসব দলীয় লেজুড় প্রফেসররা স্যারের মুক্তির দাবীতে রাবি শাখা ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র ছেলেদের নিয়ে যাওয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষর পর্যন্ত করেননি। তাদেরকে ক্যাম্পাসে মিছিলও করতে দেননি। অথচ তখন ভিসি, রেজিস্ট্রার, শিক্ষক সমিতির সভাপতি, কলা অনুষদের ডীন এবং আরবী বিভাগের চেয়ারম্যান সবাই ছিলেন ‘আহলেহাদীছ’। ১৯৮০ সাল থেকে যাদের সঙ্গে স্যার একই বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকুরী করে আসছেন। বস্ত্ততঃ দুনিয়াবী স্বার্থ ও দলীয় সংকীর্ণতা এদের জ্ঞানের চক্ষুকে অন্ধ করে দিয়েছে। সত্যকে স্পষ্টভাবে সত্য বলার সাহসহীন এই ধরনের উচ্চ শিক্ষিত মানুষ থেকে আল্লাহ সমাজকে রক্ষা করুন!
বস্ত্ততঃ দলবাজি রাজনীতির কারণেই সমাজে যেমন পচন ধরেছে, বিশ্ববিদ্যালয় সহ দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি এখন মেধার লালন ক্ষেত্র না হয়ে দলীয় কর্মীদের পুনর্বাসন ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। ফলে মেধাবীরা ক্রমেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
উল্লেখ্য যে, ‘আহলেহাদীছ যুবসংঘে’র রাবি শাখার অন্তর্ভুক্ত ভূ-তত্ত্ব ও খনি বিদ্যা বিভাগের কর্মীদের প্রস্তাবক্রমে তৎকালীন সভাপতি প্রফেসর তাহের ছাহেব (পরে নিহত), তাঁর বিভাগে মেধা তালিকার ভিত্তিতে একবার ছাত্র সংসদ নির্বাচন করেন। যা সাধারণ ছাত্রদের নিকটে প্রশংসার সাথে গৃহীত হ’লেও পরবর্তীতে দলবাজ শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের কারণে উক্ত নীতি আর টিকেনি বলে ছাত্রদের মাধ্যমে জেনেছি।
এ সময় আমীরে জামা‘আতের বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ মামলা দেওয়ার জন্য বামপন্থী পত্রিকাগুলিতে খুব লেখালেখি চলছিল। সেমতে নাটোর যেলার সাধুপাড়া মসজিদ থেকে গ্রেফতারকৃত বারো জন জেএমবি সদস্যের বক্তব্যের সূত্র ধরে মামলা দায়ের করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় চাপ সৃষ্টি করা হয়। তখন নাটোর সদর থানা থেকে দায়িত্বপ্রাপ্ত জনৈক তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা সিরাজগঞ্জ সদর থানায় আসেন। তিনি আমাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে স্যারের বক্তব্য সমূহ লিপিবদ্ধ করেন। শেষে বলেন, স্যার! আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আপনার সুনাম-সুখ্যাতি সম্পর্কে আমার জানা আছে। পত্র-পত্রিকায় যা কিছুই লেখা হৌক না কেন জেনে-শুনে আপনার বিরুদ্ধে আমি কোন মিথ্যা রিপোর্ট করব না’। আলহামদুলিল্লাহ নাটোরে স্যারের বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়নি।
এভাবে তিনদিন রিম্যান্ড শেষে আমাদের পুনরায় কারাগারে নেওয়া হয়। সকালে বেরিয়ে জেল গেইট পার হওয়ার সময় গেইট প্রহরী পুলিশটি আমাদের সালাম দিয়ে কেঁদে ফেলল। অল্প দূরে দাঁড়ানো মাইক্রোর পাশে এসে তাকিয়ে দেখি প্রবীণ পুলিশটির লম্বা দাড়ি ভিজে চোখের পানি পড়ছে। সালাফী ছাহেব বললেন, উনার বাড়ী চাপাই নবাবগঞ্জ। উনার ছেলে আমাদের মারকাযের ছাত্র। এদিন আমাদের প্রিয়জনদেরকে দূর থেকে দেখেছি। কিন্তু ওরা কাছে আসতে পারেনি। এডিশনাল এসপি ছাহেব নিজেই এসেছেন আমাদের বিদায় দেওয়ার জন্য। তাঁর এই সৌজন্য আমরা কখনই ভুলতে পারব না।
সিরাজগঞ্জ থানায় পুনরায় তিন দিনের রিম্যান্ডে নেওয়া হয় ১০.০৬.০৫ থেকে। এবারে আদালতে উঠালে জজ ছাহেব জিআরও-কে ধমক দিয়ে বললেন, আবার উনাদের এনেছেন কেন? তারপরেই আমরা ফিরে এলাম কারাগারে। এবার পৃথক নতুন সেলে।
জৈষ্ঠ্যের দুপুরের কনকনে কংক্রিটের গরম ছাদের নীচে রুমগুলো যেন আগুন হয়ে আছে। ফ্যান বিহীন রুমের ভিতর ঢুকলে মুহূর্তে জামা-কাপড় ঘামে ভিজে যায়। রাতের বেলা মাথার উপরে শত পাওয়ারের লাইট। সেই সাথে মশার উপদ্রব। সবকিছু সহ্য করেই থাকতে হ’ল। আমীরে জামা‘আতকে পৃথক রুমে রাখা হ’ল। সকালে আমীরে জামা‘আত বললেন, মশার হাত থেকে বাঁচার জন্য বিছানার চাদরটা উঠিয়ে গায়ে দিয়েছি। তাতে গরমের উপরে গরম ভোগ করেছি। তবুও সান্ত্বনা। আল্লাহর পথেই কষ্ট করছি। তোমরাও ধৈর্য ধারণ কর।
এবারে রিম্যান্ড চলা অবস্থায় একদিন এএসপি ছাহেব টিভি অন করে দিয়ে আমাদেরকে লাইভ নিউজ দেখালেন। এক একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল একই খবর বিভিন্নভাবে প্রচার করেছে। ঐদিনের খবর হ’ল সিরাজগঞ্জ শহরে ৭জন সন্ত্রাসী পুলিশের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। আরেকটি চ্যানেল বলছে ৩জন। আরেকটি বলছে ১জন। আরেকটি বলছে ৫জন বন্দী হয়ে হাজতে রয়েছে। অথচ ১জন সশস্ত্র ক্যাডার ধরা পড়েছে। যে আপনাদের পাশের হাজত কক্ষে রয়েছে।
রিম্যান্ডের শেষ দিন এডিশনাল এসপি ছাহেব দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে বললেন, স্যার! যে ধরা পড়েছে, সে সরকার দলীয় ক্যাডার। অতএব আমার স্ট্যান্ড রিলিজের অর্ডার হয়েছে। আমাকে কালই চলে যেতে হবে। দো‘আ করবেন।
সিরাজগঞ্জ কারাগারে এসে স্যার জেলার ছাহেবের অনুমতি নিয়ে দিনের বেলায় সেলের বাইরে কাঁঠাল গাছের ছায়ার নীচে কংক্রিটের রাস্তার উপরে কম্বল বিছিয়ে আমাদের বসার ব্যবস্থা করলেন। এই সময় স্যার কারা লাইব্রেরী থেকে সংগ্রহ করে সিরাজগঞ্জের বৃটিশ বিরোধী বিখ্যাত স্বাধীনতা সংগ্রামী কীর্তিমান ইসলামী ব্যক্তিত্ব সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজীর (১৮৮০-১৯৩১ খ্রিঃ) প্রায় পৌনে পাঁচশ’ পৃষ্ঠার বিরাট জীবনী গ্রন্থটি পড়ে শেষ করেন। মাঝে-মধ্যে সেখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয়গুলি আমাদের শুনাতেন। যেমন একদিন তিনি বললেন, বৃটিশের বিরুদ্ধে সিরাজী ছাহেবের লিখিত ‘অনল প্রবাহ’ কাব্য বাযেয়াফ্ত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে বৃটিশ সরকার রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দেয় এবং হুলিয়া জারী করে। তিনি কলকাতার এক বস্তিতে দিনের বেলা মশারী টাঙিয়ে রোগী সেজে দিন-রাত পরিশ্রম করে চলেছেন সম্ভবতঃ তাঁর স্পেন বিজয় মহাকাব্য রচনা শেষ করার জন্য। এক ইংরেজ ব্যারিষ্টার তাঁর প্রতি আকৃষ্ট ছিলেন। তিনি বললেন, আমার কোন ফিস লাগবেনা। কেবল আদালতের বিভিন্ন খরচ মিটাতে দু’শ টাকা লাগবে। কিন্তু মাত্র এই দু’শ টাকা এই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে দেওয়ার মত লোক সেদিন পাওয়া যায়নি। ফলে তাঁকে দু’বছর জেল খাটতে হয়।
তিনি প্রথম দিকে কংগ্রেস করতেন। পরে মুসলিম লীগে যোগ দেন। এই রাজনৈতিক মতবিরোধের জের ধরে খোদ সিরাজগঞ্জের লোকেরাই তাঁকে সিরাজগঞ্জ আলিয়া মাদরাসার নিকটে সর্বসমক্ষে রাস্তায় ফেলে পিটিয়ে আহত করে। তাঁর উদ্যোগে সে সময় সিরাজগঞ্জে সর্বভারতীয় মুসলিম নেতাদের নিয়ে বড় বড় রাজনৈতিক সমাবেশ হ’ত। নিজের কোন আয় ছিল না। অথচ কবি নজরুল অসুস্থ হ’লে তিনি মানুষের কাছ থেকে নিয়ে মানি অর্ডার যোগে কলিকাতায় নজরুলের ঠিকানায় টাকা পাঠাতেন। অবশেষে তিনি কঠিন অসুখে পড়লেন। পিঠে বিষাক্ত ফোঁড়ার অসহ্য যন্ত্রণা। চিকিৎসার পয়সা নেই। স্ত্রীকে বললেন, বাসায় কি কিছু আছে? দেখা গেল এক টাকা তিন আনা আছে। বললেন, ওটা ছাদাক্বা করে দাও। স্ত্রী বললেন, চলবে কিভাবে? উনি বললেন, সে দায়িত্ব আল্লাহর। বিকালেই ডাক পিয়ন এসে হাক-ডাক শুরু করে। দেখা গেল ৬১ টাকার মানি অর্ডার এসেছে।
তাঁর কঠিন অসুখের কথা শুনতে পেয়ে কলিকাতা থেকে মুখ্যমন্ত্রী ডা. বিধান চন্দ্র রায় (১৮৮২-১৯৬২) সহ বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা এসেছেন। সবাই তাঁর জীবন সম্পর্কে নিরাশ হয়ে ফিরে গেলেন। রাতের বেলায় নববিবাহিত ছেলে আসাদুল্লাহ সিরাজীকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন এবং বললেন, শিশু অবস্থায় তুমি যেমন আমার বুকের মধ্যে থাকতে, তেমনিভাবে আমার কাছে থাক। আর তুমি আমাকে জোরে জোরে সূরা রহমান শুনাবে। যাতে আমি জান্নাতের সুসংবাদ শুনতে শুনতে দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে যেতে পারি’। অতঃপর মাত্র ৫১ বছর বয়সে তিনি নিজ বাড়ীতে ইন্তেকাল করেন। উল্লেখ্য যে, ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় আসাদুল্লাহ সিরাজীকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করে। থানা থেকে কারাগারে যাওয়ার সময় আমরা সিরাজী ছাহেবের কবরের পাশ দিয়ে যেতাম। আর তাঁর জন্য দো‘আ করতাম। বলা বাহুল্য, সিরাজগঞ্জ কারাগারে গিয়ে সিরাজী ছাহেবের জীবনীর সাথে পরিচিত হওয়াটাই ছিল আমীরে জামা‘আতের ভাষায় একটা বড় অর্জন। আল্লাহ তাঁর গোনাহ-খাতা মাফ করুন ও জান্নাতুল ফেরদাঊস নছীব করুন- আমীন!
[ক্রমশঃ]