[মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শরী‘আহ ফ্যাকাল্টির উছূলে ফিক্বহ বিভাগের শিক্ষক এবং মসজিদে ক্বোবার ইমাম ও খত্বীব শায়খ সুলায়মান বিন সালীমুল্লাহ আর-রুহাইলী (৫৫) ইসলামের ভিতরে অনুপ্রবেশকারী বাতিল আক্বীদা ও ফিরক্বা সমূহের বিরুদ্ধে সোচ্চার সমসাময়িক সালাফী বিদ্বানদের অন্যতম। তিনি একাধারে বিশিষ্ট দাঈ, লেখক, গবেষক এবং সমালোচক এবং ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি বহু গ্রন্থ প্রণেতা। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হ’ল (১) শারহু উছূলিছ ছালাছাহ (২) ক্বাওয়ায়েদু তা‘আরুযিল মাছালেহ ওয়াল মাফাসেদ (৩) ইমাম রাযী লিখিত ‘আল-কিতাব ওয়াস সুন্নাহ’ বইয়ের তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ (৪) আত-তা‘রীফাতুল উছূলিইয়াহ (৫) আল-ই‘লাম বিল আইম্মাতিল আরব‘আতিল আ‘লাম। শরী‘আতের বিভিন্ন বিষয়ে তিনি মূল্যবান বক্তব্য পেশ করেছেন। তন্মধ্যে উল্লেখযোগ্য হ’ল- বিভ্রান্ত খারেজীদের ব্যাপারে পিতাকে নছীহত, আইএসরা খারেজী, তাক্বওয়াই রিযিক্বের ভিত্তি, কখন এবং কিভাবে সন্তানকে ছালাতের প্রশিক্ষণ দিতে হবে, পরিবারের প্রতি সদাচারণ, আল্লাহর পরীক্ষার অর্থ বান্দাকে ভালবাসা, প্রশংসাকারীর মুখে ধুলা নিক্ষেপ, জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব, স্বামী-স্ত্রীর সুখী জীবন, সালাফী মানহাজ ইত্যাদি।একবার তিনি যুবসমাজের অধঃপতন : কারণ ও প্রতিকার সম্পর্কে মাসজিদুল ক্বোবাতে এক গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য পেশ করেন। যা পরবর্তীতে ’ইনহিরাফুশ শাবাব : আসবাবুহূ ওয়া ওয়াসাইলু ইলাজিহী’ শিরোনামে আরবীতে প্রকাশিত হয়। সমকালীন প্রেক্ষাপটে বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় এর বঙ্গানুবাদ পাঠকের সমীপে পত্রস্থ হ’ল (সম্পাদক)]।

সম্মানিত উপস্থিতি!

আমরা সমবেত হয়েছি আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)-এর শহর মদীনাতে। এ মদীনা কতই না অনুগ্রহপুষ্ট! এতো সেই মদীনা, যাকে আল্লাহ অনেক মাহাত্ম্য ও ফযীলতে ধন্য করেছেন। এতো সেই মদীনা, যার ভালবাসা ঈমান ও সুন্নাতের পরিচায়ক। নবী করীম (ছাঃ) তাকে ভালবাসতেন। তিনি যখন সফর থেকে ফিরতেন তখন মদীনায় সত্বর প্রবেশের নিমিত্ত তাঁর বাহনকে দ্রুত তাড়া করতেন। আমরা আল্লাহরই ঘর সমূহের মধ্য থেকে একটি ঘরে জমায়েত হয়েছি। যে প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, ‘(উক্ত জ্যোতি থাকে) মসজিদ সমূহে, যেগুলিকে আল্লাহ মর্যাদামন্ডিত করার এবং সেখানে আল্লাহর নাম স্মরণ করার ও সকাল- সন্ধ্যায় তাঁর তাসবীহ তেলাওয়াতের আদেশ দিয়েছেন। (মসজিদ আবাদকারী) ঐ লোকগুলি হ’ল তারাই, যাদেরকে ব্যবসা-বাণিজ্য বা ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ থেকে এবং ছালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান থেকে বিরত রাখে না। তারা ভয় করে সেই দিনকে, যেদিন বহু হৃদয় ও চক্ষু আতংকে বিপর্যস্ত হবে। যাতে আল্লাহ তাদের কৃতকর্মের উত্তম পুরস্কার দেন এবং নিজ অনুগ্রহে আরো বেশী করে দেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ যাকে চান তাকে অপরিমিত রূযী দান করে থাকেন’ (নূর ২৪/৩৬-৩৮)।

আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ تَطَهَّرَ فِي بَيْتِهِ، ثُمَّ مَشَى إِلَى بَيْتٍ مَنْ بُيُوتِ اللهِ لِيَقْضِيَ فَرِيْضَةً مِنْ فَرَائِضِ اللهِ، كَانَتْ خَطْوَتَاهُ إِحْدَاهُمَا تَحُطُّ خَطِيئَةً، وَالْأُخْرَى تَرْفَعُ دَرَجَةً، ‘যে ব্যক্তি নিজের বাড়িতে পবিত্রতা অর্জন করার পর আল্লাহর গৃহগুলোর (মসজিদগুলোর) কোন একটির পানে আল্লাহর একটি ফরয আমল (ছালাত) সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পায়ে হেঁটে যায়, তখন তার প্রতি দু’টি পদক্ষেপের একটিতে পাপ মুছে যায় এবং অন্যটিতে মর্যাদা বৃদ্ধি পায়’।[1]

অন্য হাদীছে তিনি অনেকগুলো কল্যাণময় গুণের উল্লেখ করেছেন। হাদীছটির ভাষা এই যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোন মুমিনের দুনিয়ার নানা কষ্ট থেকে কোন একটি কষ্ট দূর করবে আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামত দিবসের তার কষ্টসমূহ থেকে একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। আর যে কোন সঙ্কটাপন্ন ব্যক্তির সঙ্কট লাঘব করবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার সঙ্কট লাঘব করবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ গোপন রাখবে আল্লাহ তা‘আলা দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ গোপন রাখবেন। আল্লাহ বান্দাকে ততক্ষণ পর্যন্ত সাহায্য করেন যতক্ষণ বান্দা তার ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে। আর যে ব্যক্তি বিদ্যা অন্বেষণের উদ্দেশ্যে কোন একটা রাস্তা ধরে চলবে আল্লাহ সেজন্য তার জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা সহজ করে দিবেন। আর যখন কোন একদল লোক আল্লাহর ঘরসমূহ থেকে কোন একটি ঘরে জমায়েত হয়ে আল্লাহর কিতাব তেলাওয়াত করে এবং নিজেদের মধ্যে তা পঠন-পাঠন করে তখন তাদের উপর প্রশান্তি নেমে আসে, (আল্লাহর) দয়া তাদের আচ্ছাদিত করে নেয়, ফেরেশতারা তাদের ঘিরে ধরেন এবং আল্লাহ তাঁর নিকটস্থজনদের নিকট তাদের কথা আলোচনা করেন। আর যার আমল তাকে পিছনে ঠেলে নিয়ে যায় বংশমর্যাদা তাকে অগ্রগামী করতে পারে না’।[2]

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, মু‘আবিয়া (রাঃ) মসজিদের একটি মজলিসে এসে বললেন, কি উদ্দেশ্যে তোমরা এখানে বসেছ? তারা বলল, جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ، قَالَ آللهِ مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ؟ قَالُوا: وَاللهِ مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ، قَالَ: أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَمَا كَانَ أَحَدٌ بِمَنْزِلَتِي مِنْ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَقَلَّ عَنْهُ حَدِيثًا مِنِّي، وَإِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ خَرَجَ عَلَى حَلْقَةٍ مِنْ أَصْحَابِهِ، فَقَالَ: مَا أَجْلَسَكُمْ؟ قَالُوا: جَلَسْنَا نَذْكُرُ اللهَ وَنَحْمَدُهُ عَلَى مَا هَدَانَا لِلْإِسْلَامِ، وَمَنَّ بِهِ عَلَيْنَا، قَالَ: آللهِ مَا أَجْلَسَكُمْ إِلَّا ذَاكَ؟ قَالُوا: وَاللهِ مَا أَجْلَسَنَا إِلَّا ذَاكَ، قَالَ: أَمَا إِنِّي لَمْ أَسْتَحْلِفْكُمْ تُهْمَةً لَكُمْ، وَلَكِنَّهُ أَتَانِي جِبْرِيلُ فَأَخْبَرَنِي، أَنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ يُبَاهِي بِكُمُ الْمَلَائِكَةَ ‘আমরা আল্লাহর যিকির বা আলোচনার্থে বসেছি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, তোমরা কি এতদ্ব্যতীত অন্য উদ্দেশ্যে বসনি? তারা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা এতদ্ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে বসিনি। তিনি বললেন, শোনো, তোমাদের কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলার জন্য আমি কসম কেটে এ কথা বলিনি। রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর সাথে আমার যে সাহচর্যের সম্পর্ক সেই তুলনায় আমার থেকে কম হাদীছ বর্ণনাকারী কোন ছাহাবী নেই। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একবার তাঁর ছাহাবীদের এক মজলিসে এসে উপস্থিত হন। তিনি তাদের বলেন, কি উদ্দেশ্যে তোমরা এখানে বসেছ? তারা বলল, আমরা এখানে বসে আল্লাহর যিকির করছি এবং তিনি যে আমাদের ইসলামের পথ দেখিয়েছেন এবং ইসলাম দ্বারা আমাদের অনুগৃহীত করেছেন সেজন্য তার প্রশংসা করছি। তিনি বললেন, আল্লাহর কসম, কেবল এই উদ্দেশ্যেই তোমরা বসেছ? তারা বলল, আল্লাহর কসম, আমরা কেবল এই উদ্দেশ্যেই বসেছি। তিনি বললেন, শুনো, তোমাদের কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলার জন্য আমি কসম কেটে এ কথা বলিনি। বরং জিব্রীল এসে আমাকে খবর দিলেন যে, আল্লাহ তা‘আলা তোমাদের নিয়ে ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করছেন’।[3]

মুবারকবাদ জানাই আল্লাহর সেই বান্দাদের, যাদের নিয়ে আল্লাহ ফেরেশতাদের নিকট গর্ব করেন! মসজিদে নববীর পর রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর শহর মদীনায় দ্বিতীয় যে মসজিদ নির্মিত হয় সেই ‘ক্বোবা মসজিদে’ আমাদের এই জমায়েতের ফল কি হ’তে পারে, একটু ভেবে দেখুন! এ মসজিদ তো প্রথম দিন থেকেই তাক্বওয়ার বুনিয়াদে নির্মিত হয়েছে। যেমন করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর মসজিদ প্রথম দিনেই তাক্বওয়ার বুনিয়াদে নির্মিত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) কখনো পায়ে হেঁটে এবং কখনো বাহনে চড়ে এ মসজিদ যিয়ারত করতে আসতেন।

ইবনু ওমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, كَانَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم يَأْتِى مَسْجِدَ قُبَاءٍ كُلَّ سَبْتٍ مَاشِيًا وَرَاكِبًا، রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রতি শনিবারে (কখনো) পায়ে হেঁটে এবং (কখনো) বাহনে চড়ে ক্বোবা মসজিদে আসতেন’।[4] ক্বোবা মসজিদ যিয়ারতে তিনি লোকেদের উৎসাহও যুগিয়েছেন। এক হাদীছে তিনি বলেন, مَنْ تَطَهَّرَ فِي بَيْتِهِ ثُمَّ أَتَى مَسْجِدَ قُبَاءَ، فَصَلَّى فِيهِ صَلَاةً، كَانَ لَهُ كَأَجْرِ عُمْرَةٍ، ‘যে ব্যক্তি নিজ গৃহ থেকে পবিত্রতা অর্জন করে কেবাবা মসজিদে আসবে তারপর সেখানে ছালাত আদায় করবে তার জন্য এক ওমরা পরিমাণ ছওয়াব মিলবে’।[5]

আমরা এখানে সমবেত হয়েছি জুম‘আর রাতে, যা কিনা দিবসকুলের নেতৃস্থানীয় রাত। এ দিন আল্লাহ তা‘আলা বিশেষভাবে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতকে প্রদান করেছেন। তিনি ইহুদীদের এ দিনের দিশা দেননি। তাদের বরাদ্দ দিন শনিবার। খৃষ্টানদেরও এ দিনের হদিছ মেলেনি। তারা পেয়েছে রবিবার। আল্লাহ মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মতকে এ দিনের দিশা প্রদান করেছেন। ফলে তাদের বরাদ্দ দিবস হয়েছে জুম‘আর দিন। অনন্তর আমরা সেই মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা জানাই, যিনি আমাদের জন্য সম্মানিত স্থান ও সম্মানিত সময় যেমন মিলিয়েছেন, তেমনি যেন তিনি আমাদের সদিচ্ছা পোষণের মর্যাদা দান করেন। তিনি যেন আমাদেরকে খাঁটি মনে তার জন্য কাজ করার সামর্থ্য দান করেন এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অনুসরণের মাধ্যমে আমাদেরকে সম্মানিত করেন। তিনি যেন আমাদেরকে বানান কল্যাণের চাবি ও অকল্যাণের তালা।

সম্মানিত ভাইয়েরা!

সবরকম কল্যাণ দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে ধরাধামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে যা কিছু দিয়ে পাঠিয়েছেন তা-ই ছিরাতুল মুস্তাক্বীম তথা ইসলামের সোজা পথ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,قُلْ إِنَّنِي هَدَانِي رَبِّي إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ دِينًا قِيَمًا مِلَّةَ إِبْرَاهِيمَ حَنِيفًا وَمَا كَانَ مِنَ الْمُشْرِكِينَ، ‘বল, আমার প্রতিপালক আমাকে সরল পথ প্রদর্শন করেছেন। যা একাগ্রচিত্ত ইবরাহীমের বিশুদ্ধ ধর্ম এবং সে মুশরিকদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না’ (আন‘আম ৬/১৬১)। তিনি আরও বলেন,وَهَذَا صِرَاطُ رَبِّكَ مُسْتَقِيمًا قَدْ فَصَّلْنَا الْآيَاتِ لِقَوْمٍ يَذَّكَّرُونَ، ‘আর এটাই তোমার প্রতিপালকের সরল পথ। আমরা উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য আয়াতসমূহ বিশদভাবে বর্ণনা করে দিয়েছি’ (আন‘আম ৬/১২৬)। তিনি আরো বলেন, وَإِنَّكَ لَتَدْعُوهُمْ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘আর নিঃসন্দেহে তুমি তাদেরকে সরল পথের দিকে আহবান করে থাক’ (মুমিনূন ২৩/৭৩)। তিনি আরো বলেন, فَاسْتَمْسِكْ بِالَّذِيْ أُوحِيَ إِلَيْكَ إِنَّكَ عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘অতএব তোমার প্রতি যা অহি করা হয়, তা দৃঢ়ভাবে ধারণ কর। নিশ্চয়ই তুমি সরল পথের উপর রয়েছ’ (যুখরুফ ৪৩/৪৩)।

ভাইয়েরা আমার!

মুসলিম মাত্রেই দিনে অনেক বার আল্লাহর কাছে ছিরাতুল মুস্তাক্বীম লাভের জন্য দো‘আ করে থাকে। ছালাতের প্রতি রাক‘আতে সে সূরা ফাতিহা পড়তে আদিষ্ট। সূরা ফাতিহাতে রয়েছে ‘আপনি আমাদেরকে সোজা পথে পরিচালিত করুন’ (ফাতিহা ১/৬)। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, নবী করীম (ছাঃ) যা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন তা সবই রহমত ও হেদায়াত এবং যে তা আঁকড়ে ধরে থাকবে সে সোজা পথ প্রাপ্ত হবে। এরশাদ হয়েছে,وَكَيْفَ تَكْفُرُونَ وَأَنْتُمْ تُتْلَى عَلَيْكُمْ آيَاتُ اللهِ وَفِيكُمْ رَسُولُهُ وَمَنْ يَعْتَصِمْ بِاللهِ فَقَدْ هُدِيَ إِلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘আর কিভাবে তোমরা কাফের হ’তে পার, অথচ তোমাদের উপর আল্লাহর আয়াতসমূহ পাঠ করা হচ্ছে। আর তোমাদের মধ্যে তাঁর রাসূল অবস্থান করছেন। বস্ত্ততঃ যে ব্যক্তি আল্লাহকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে, সে ব্যক্তি অবশ্যই সরল পথে পরিচালিত হবে’ (আলে ইমরান ৩/১০১)।

এই সোজা পথের উপর অটল-অবিচল থাকার প্রতি আল্লাহ মানব জাতিকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, إِنَّ الَّذِينَ قَالُوا رَبُّنَا اللهُ ثُمَّ اسْتَقَامُوا تَتَنَزَّلُ عَلَيْهِمُ الْمَلَائِكَةُ أَلَّا تَخَافُوا وَلَا تَحْزَنُوا وَأَبْشِرُوا بِالْجَنَّةِ الَّتِي كُنْتُمْ تُوعَدُونَ، ‘নিশ্চয়ই যারা বলে আমাদের প্রতিপালক আল্লাহ। অতঃপর তার উপর অবিচল থাকে, তাদের উপর ফেরেশতামন্ডলী নাযিল হয় এবং বলে যে, তোমরা ভয় পেয়ো না ও চিন্তান্বিত হয়ো না। আর তোমরা জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ করো, যার প্রতিশ্রুতি তোমাদের দেওয়া হয়েছিল’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩০)।

আল্লাহ তাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আর আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। যখন তারা ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর অবিচল থাকবে তখন একসময় তাদের কাছে ফেরেশতারা নেমে আসবে। তারা তাদেরকে সুসংবাদ শুনাবে যে, তোমাদের ভয় পাওয়ার ও চিন্তার কিছু নেই। তোমরা তোমাদের জন্য প্রতিশ্রুত জান্নাত লাভের সুসংবাদ গ্রহণ করো। সুতরাং যে অবিচল থাকবে দুঃখ-বেদনা তার ধারে-কাছে ঘেঁষতে পারবে না, তার অন্তরে ভয়-ভীতি জায়গা পাবে না। তার জন্য থাকবে সুসংবাদ এবং উন্নতমানের জীবিকা। আল্লাহ বলেন,وَأَلَّوِ اسْتَقَامُوا عَلَى الطَّرِيقَةِ لَأَسْقَيْنَاهُمْ مَاءً غَدَقًا، لِنَفْتِنَهُمْ فِيهِ وَمَنْ يُعْرِضْ عَنْ ذِكْرِ رَبِّهِ يَسْلُكْهُ عَذَابًا صَعَدًا- ‘যদি তারা ইসলামের উপর প্রতিষ্ঠিত থাকত, তাহ’লে আমরা তাদেরকে প্রচুর বারিবর্ষণে সিক্ত করতাম। যাতে আমরা তাদেরকে এর দ্বারা পরীক্ষা করতে পারি। কিন্তু যে ব্যক্তি তার প্রতিপালকের স্মরণ থেকে বিমুখ হবে, তিনি তাকে কঠিন শাস্তির মধ্যে প্রবেশ করাবেন’ (জিন ৭২/১৬-১৭)।

আমার ভাইয়েরা!

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যে পথে চলেছেন সে পথের বাইরে আর কোন পথ আছে কি, যার উপর অবিচল থাকার কথা বলা হয়েছে? তিনিই তো এই উম্মতের মধ্যে প্রথম ব্যক্তি, যিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দৃঢ়তার পথে প্রথম পা বাড়িয়েছেন। আল্লাহ বলেছেন, فَاسْتَقِمْ كَمَا أُمِرْتَ ‘অতএব তুমি যেভাবে আদিষ্ট হয়েছ সেভাবে দৃঢ় থাক’ (হূদ ১১/১১২)। এ আদেশ শুধু তাঁর একার সাথেই খাছ নয়, বরং অনাগত কাল পর্যন্ত যারা তাঁর দেখানো পথে চলবে তাদের জন্যও একই আদেশ। আল্লাহ বলেন, ‘এবং তোমার সাথে যারা (শিরক ও কুফরী থেকে) তওবা করেছে তারাও’ (হূদ ১১/১১২)। বস্ত্তত সত্য পথে অবিচল থাকার মহত্ত্ব ও গুরুত্ব তুলে ধরার জন্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সাথে এ আদেশে মুমিনদেরও যুক্ত করা হয়েছে।

আমাদের হাবীব, আমাদের নবী, আমাদের ইমাম এবং আমাদের নেতা মুহাম্মাদ (ছাঃ)ও আল্লাহর পথে অবিচল থাকার একই আদেশ উম্মতকে শুনিয়েছেন। সুফিয়ান বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ,قُلْ لِي فِي الْإِسْلَامِ قَوْلاً لَا أَسْأَلُ عَنْهُ أَحَدًا بَعْدَكَ، ‘ইসলাম সম্পর্কে আমাকে আপনি এমন একটা কথা বলে দিন, আপনার পরে আমাকে আর কাউকে যা জিজ্ঞেস করতে হবে না’।

দেখুন, কি দামী প্রশ্ন! কত দামী জিজ্ঞাসা!! কোন মুমিন যখন এ প্রশ্ন শুনবে তখন প্রশ্নের জবাব কানে প্রবেশের আগে তার অন্তরে এ কথা ঢোকা উচিত যে, কার মুখ থেকে সে জবাবটা শুনছে? সে কি তার হাবীব, তার নবী (ছাঃ)-এর মুখ থেকে এ জবাব শুধু এজন্য শুনতে চাচ্ছে যে, জবাব শুনে তার অন্তর শান্তি পাবে, আর হ্যাঁ হ্যাঁ করে সে মাথা দোলাবে? না, কখনই তা নয়। তিনি প্রশ্নটা করেছিলেন এজন্য যে, উত্তরটা তার জন্য একটি প্রতীক হবে এবং নবী করীম (ছাঃ)-এর সঙ্গে তার মহববতের স্বাক্ষর হবে। তাই তিনি বলছেন, আমি বললাম, ইয়া রাসূলাল্লাহ, ইসলাম সম্পর্কে আমাকে আপনি এমন একটা কথা বলে দিন যা আপনার পরে আমাকে আর কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না।

জবাবে তিনি বললেন, قُلْ: آمَنْتُ بِاللهِ، فَاسْتَقِمْ ‘বল’, আমি আল্লাহর উপর ঈমান আনলাম। তারপর এ কথার উপর অবিচল থাক’।[6] অন্য এক হাদীছে তিনি বলেছেন, اسْتَقِيمُوا، وَلَنْ تُحْصُوا، وَاعْلَمُوا أَنَّ خَيْرَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلَاةَ، وَلَا يُحَافِظُ عَلَى الْوُضُوءِ إِلَّا مُؤْمِنٌ، ‘তোমরা (আল্লাহর পথে) অবিচল থাক। যদিও তোমরা তা কখনই পুরোপুরি কুলিয়ে উঠতে পারবে না। আর জেনে রেখ, তোমাদের সর্বোত্তম আমল হচ্ছে ছালাত। আর যত্ন সহকারে ওযূ মুমিন ছাড়া কেউ করে না’।[7]

আল্লাহ তা‘আলা ছিরাতুল মুস্তাক্বীম বা সোজা পথ একটাই বলে উল্লেখ করেছেন। নানা পথের পথিক হওয়ার দরুন সোজা পথ থেকে বিচ্যুত হওয়া থেকে তিনি সাবধান করেছেন। তিনি বলেন,وَأَنَّ هَذَا صِرَاطِي مُسْتَقِيمًا فَاتَّبِعُوهُ وَلَا تَتَّبِعُوا السُّبُلَ فَتَفَرَّقَ بِكُمْ عَنْ سَبِيلِهِ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ، ‘আর এটিই আমার সরল পথ। অতএব তোমরা এ পথেরই অনুসরণ কর। অন্যান্য পথের অনুসরণ করো না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তাঁর পথ থেকে বিচ্যুৎ করে দেবে। এসব বিষয় তিনি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন যাতে তোমরা (ভ্রান্ত পথ সমূহ থেকে) বেঁচে থাকতে পার’ (আন‘আম ৬/১৫৩)।

আমাদের প্রভু আমাদেরকে এ কথাও বলে দিয়েছেন যে, হেদায়াত অবিচলতার মধ্যে নিহিত। আর ছিরাতুল মুস্তাক্বীম ছাড়া অন্য পথে গমনে বিপদগামী হ’তে হবে। তিনি বলেন, أَفَمَنْ يَمْشِي مُكِبًّا عَلَى وَجْهِهِ أَهْدَى أَمَّنْ يَمْشِي سَوِيًّا عَلَى صِرَاطٍ مُسْتَقِيمٍ، ‘অতঃপর যে ব্যক্তি মুখের উপর ভর দিয়ে চলে, সেই সুপথপ্রাপ্ত, নাকি যে ব্যক্তি সরল পথের উপর সোজা হয়ে চলে (সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত)?’ (মুলক ৬৭/২২)।

দয়াময় আল্লাহ আমাদেরকে এ কথাও জানিয়েছেন যে, আমরা যাতে আল্লাহর সোজা পথে চলতে না পারি এবং বিপদগামী হই সেজন্য শয়তান আল্লাহর সোজা পথের উপর নাছোড়বান্দা হয়ে বসে থাকার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। অভিশপ্ত শয়তানের কথা তুলে ধরে মহান আল্লাহ বলেন,قَالَ فَبِمَا أَغْوَيْتَنِي لَأَقْعُدَنَّ لَهُمْ صِرَاطَكَ الْمُسْتَقِيمَ، ثُمَّ لَآتِيَنَّهُمْ مِنْ بَيْنِ أَيْدِيهِمْ وَمِنْ خَلْفِهِمْ وَعَنْ أَيْمَانِهِمْ وَعَنْ شَمَائِلِهِمْ وَلَا تَجِدُ أَكْثَرَهُمْ شَاكِرِينَ، ‘সে বলল, যে আদমের কারণে আপনি আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, সেই আদম সন্তানদের পথভ্রষ্ট করার জন্য আমি অবশ্যই আপনার সরল পথের উপর বসে থাকব। অতঃপর আমি অবশ্যই তাদের কাছে আসব তাদের সামনে, পিছনে, ডাইনে, বামে, সবদিক দিয়ে। আর তখন আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না’ (আ‘রাফ ৭/১৬-১৭)।

শয়তান তাই বনু আদমকে পথহারা করার জন্য অনেক পথ খাড়া করেছে। অন্য সব পথে চলাই হচ্ছে অধঃপতন ও বিচ্যুতি। এটাই আল্লাহর পথ ছেড়ে শয়তানের পথে যাত্রা। ইবনু মাস‘উদ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের সামনে একটা রেখা টানলেন, তারপর বললেন, এটা আল্লাহর রাস্তা। তারপর তার ডানে বামে অনেকগুলো রেখা টেনে বললেন, এগুলো অনেক রাস্তা। এর প্রত্যেকটা রাস্তায় একটা করে শয়তান মোতায়েন রয়েছে। সে তার দিকে আসার জন্য ডাকছে। তারপর তিনি (সূরা আন‘আমের ১৫৩ নং আয়াত) তেলাওয়াত করলেন, ‘আর এটিই আমার সোজা পথ। সুতরাং তোমরা এ পথেই চল এবং অন্য সব পথে চল না। তাহ’লে তা তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্যুত করে দেবে। এ নির্দেশ তিনি তোমাদেরকে দিয়েছেন। আশা আছে যে তোমরা আল্লাহকে ভয় করে চলবে’।[8]

ভাইয়েরা দেখুন, আল্লাহর পথ একটাই। তা হচ্ছে ছিরাতুল মুস্তাক্বীম তথা সোজা পথ। আর অধঃপতন হচ্ছে এ পথ থেকে অন্য দিকে ঝুঁকে পড়া, অন্য রাস্তা ধরে চলা। অধঃপতন কখনো বাড়াবাড়ির ফলে হয়, আবার কখনো ছাড়াছাড়ির ফলে হয়। কখনো সন্দেহের ফলে দেখা দেয়, কখনো কুপ্রবৃত্তির তাড়নাতে হয়। কখনো ফরয দায়িত্বে অবহেলার দরুন হয়, কখনো নিষিদ্ধ হারামে লিপ্ত হওয়ার ফলে হয়। কখনো বা বিদ‘আতের ছড়াছড়ির ফলে হয়।

যুবসমাজই তো সমাজের মূল শক্তি। তারাই সমাজের খুঁটি। যে কোন সমাজ ও জাতির সুস্থতা নির্ভর করে তার যুবসমাজের সুস্থতার উপর। অপরদিকে যুবসমাজ যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তবে সে সমাজ ও জাতির ভাগ্যাকাশে ঘোর অমানিশা নেমে আসে।

ভাইয়েরা আমার!

এজন্যই দেহের ক্ষেত্রে হৃৎপিন্ডের যে ভূমিকা জাতির ক্ষেত্রে যুবসমাজেরও সেই ভূমিকা। হৃৎপিন্ড সুস্থ থাকলে যেমন সারা দেহ সুস্থ থাকে; আর তা খারাপ হয়ে পড়লে সারা দেহ সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তদ্রূপ যুবসমাজ ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর চললে পুরো সমাজ ও জাতি ইসলামের ছিরাতুল মুস্তাক্বীমের উপর সহজেই চলবে। কিন্তু তারা ছিরাতুল মুস্তাক্বীম থেকে বিচ্যুত হ’লে, তাদের মধ্যে দ্বীনদারীর অভাব ঘটলে পুরো সমাজে দ্বীনহীনতার কুপ্রভাব ছড়িয়ে পড়বে। যুবকদের মধ্যে বেশীর ভাগ সময় শিশুসুলভ আচরণ লক্ষ্য করা যায়। তারা আল্লাহর ইবাদতে যত্নবান হ’তে চায় না। কিন্তু এ সময়ের ইবাদতের মূল্য অত্যধিক। তাই তো হাদীছে এসেছে, আবু হুরায়রা (রাঃ) কর্তৃক নবী করীম (ছাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ تَعَالَى فِى ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إِلاَّ ظِلُّهُ إِمَامٌ عَدْلٌ، وَشَابٌّ نَشَأَ فِى عِبَادَةِ اللهِ، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ فِى الْمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابَّا فِى اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيْهِ وَتَفَرَّقَا عَلَيْهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأَةٌ ذَاتُ مَنْصِبٍ وَجَمَالٍ فَقَالَ إِنِّى أَخَافُ اللهَ، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ فَأَخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ اللهَ خَالِيًا فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ- ‘যেদিন আল্লাহর বিশেষ ছায়া ব্যতীত অন্য কোন ছায়া থাকবে না, সেদিন আল্লাহ তা‘আলা সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে তাঁর ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন। (১) ন্যায়পরায়ণ শাসক (২) এমন যুবক যে আল্লাহর ইবাদতে জীবন অতিবাহিত করেছে (৩) এমন ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে (৪) এমন দু’জন ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে পরস্পরকে ভালবেসে একত্রিত হয় এবং পৃথক হয় (৫) এমন ব্যক্তি যাকে কোন সুন্দরী ও অভিজাত নারী (ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার জন্য) আহবান করে, তখন সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি (৬) এমন ব্যক্তি যে গোপনে ছাদাক্বা করে কিন্তু তার বাম হাত জানতে পারে না যে তার ডান হাত কি ব্যয় করে (৭) এমন ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে অশ্রুধারা প্রবাহিত করে’।[9]

উক্ববা বিন আমের (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ عَزَّ وَجَلَّ لَيَعْجَبُ مِنَ الشَّابِّ لَيْسَتْ لَهُ صَبْوَةٌ، ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ বিস্ময়বোধ করেন সেই যুবকের প্রতি, যার মধ্যে ছেলেমি বা শিশুসুলভ আচরণ নেই’।[10]

ইসলামের ইতিহাসে এবং আমাদের সমসাময়িক কালে অনেক যুবকের আল্লাহর ইবাদতে কাটানোর বহু চিত্তাকর্ষক উদাহরণ রয়েছে। তারপরও বহু যুবক আজ অধঃপাতে নিপতিত। তবে তাদের অধঃপতনের মাত্রা ও ধরনের মাঝে ভিন্নতা রয়েছে। তাদের কেউ কেউ অধঃপাতে যাওয়ার পরক্ষণে তার বিপদ অাঁচ করতে পারে, কি করুণ পরিণতি দাঁড়াবে তা বুঝতে পারে এবং তার প্রভু ও তার শাস্তিকে ভয় করে। ফলে তারা যা করে ফেলেছে সেজন্য লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয় এবং সেই পাপ-পঙ্কিলতা ও বিচ্যুতি থেকে দ্রুতই সরে আসে। পরবর্তীতে তারা এ ধরনের কাজে আর জড়িত হবে না বলে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে। দেখা যায়, তারা মূল্যবোধের অবক্ষয় জাতীয় কাজ এবং তার প্রভাব থেকে নিরাপদ থাকে। অনুতাপেরই নাম তওবা। আর পাপ থেকে তওবাকারী নিষ্পাপ ব্যক্তির মতই।

তাদের কেউ কেউ এরূপ অধঃপতনে যাওয়ার যে কি বিপদ ও যন্ত্রণা তা বুঝতে পারে। এসব কাজের ক্ষতি, কাজকর্ম এলোমেলো হয়ে যাওয়া এবং মন সংকীর্ণ হয়ে পড়ার কথা তাদের মনে জাগরুক থাকে। এজন্য তারা ইসলামের পথে অবিচল থাকার ইচ্ছা মনে মনে কামনা করে, মনের প্রশান্তি ও নিরাপত্তার কথাও ভাবে; কিন্তু কুপ্রবৃত্তি এবং জিন শয়তান ও মানুষ শয়তান তাদের মনকে পরাস্ত করে ফেলে। ফলে তারা তাদের রবের দিকে ফেরার চিন্তা থেকে সরে আসে এবং নিজেদের বিচ্যুতির উপর অনুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে।

এ ধরনের অধঃপতিতদের বেলায় সুপথে ফেরার আশা করা যায়, আবার অধঃপতনের অতলে তলিয়ে যাওয়ার ভয়ও থেকে যায়। এ বিষয়ে একটি হাদীছ প্রণিধানযোগ্য। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِنَّ الْمُؤْمِنَ إِذَا أَذْنَبَ كَانَتْ نُكْتَةٌ سَوْدَاءُ فِي قَلْبِهِ، فَإِنْ تَابَ وَنَزَعَ وَاسْتَغْفَرَ، صُقِلَ قَلْبُهُ، فَإِنْ زَادَ، زَادَتْ، فَذَلِكَ الرَّانُ الَّذِي ذَكَرَهُ اللَّهُ فِي كِتَابِهِ: (كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ) ‘যখন কোন মুমিন পাপ কাজ করে তখন তার অন্তরে একটি কালো দাগ পড়ে। যদি সে তওবা করে পাপ পরিত্যাগ করে এবং আল্লাহর কাছে ক্ষমা চায় তাহ’লে তার অন্তর ঝকঝকে নির্মল হয়ে যায়। আর যদি সে পাপের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তাহ’লে কালো দাগও বাড়তে থাকে। এটাই সেই মরিচা যার কথা আল্লাহ তা‘আলা কুরআনে উল্লেখ করেছেন, كَلَّا بَلْ رَانَ عَلَى قُلُوبِهِمْ مَا كَانُوا يَكْسِبُونَ ‘কখনই না। বরং তাদের অপকর্মসমূহ তাদের অন্তরে মরিচা ধরিয়েছে’।[11]

তাদের কেউ কেউ নিজের অবস্থার কোন খবরই রাখে না। প্রতিদিন অধিকাংশ সময় তারা অবৈধ, বেআইনী ও কদর্য কাজের মধ্যে ডুবে থাকে। ভয় হয়, ঐ অবস্থাতেই তাদের মৃত্যু এসে পড়ে কি-না। অপরদিকে আল্লাহ বলেন,وَلَيْسَتِ التَّوْبَةُ لِلَّذِينَ يَعْمَلُونَ السَّيِّئَاتِ حَتَّى إِذَا حَضَرَ أَحَدَهُمُ الْمَوْتُ قَالَ إِنِّي تُبْتُ الْآنَ وَلَا الَّذِينَ يَمُوتُونَ وَهُمْ كُفَّارٌ أُولَئِكَ أَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابًا أَلِيمًا ‘আর ঐসব লোকদের তওবা কবুল হবে না, যারা মন্দকর্ম করতেই থাকে, যতক্ষণ না তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় এবং বলে, আমি এখন তওবা করছি। আর তওবা কবুল হবে না ঐসব লোকের, যারা মৃত্যুবরণ করে কাফের অবস্থায়। আমরা তাদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্ত্তত করে রেখেছি’ (নিসা ৪/১৮)।

কিছু অধঃপতিত এমন আছে, যারা বাতিকগ্রস্ত, সন্দেহপ্রবণ ও খুঁতখুঁতে স্বভাবের। তারা নিজেদেরকে জান্নাতের প্রথম কাতারের লোক মনে করে। তাদের চারপাশে সমাজের যেসব লোক রয়েছে তাদেরকে তারা নীচু নযরে দেখে। এ বৃত্তও ছোট হ’তে হ’তে একসময় তারা নিজেদের ভাইদেরও তুচ্ছ দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। এমনকি উম্মতের আলেম সমাজ ও মাতা-পিতাকেও তারা নিজেদের থেকে অনেক নীচে ভাবতে থাকে। তারা মনে করে, ইসলাম শুধুই তাদের মতো কতিপয় যুবকের মধ্যে আছে।

প্রিয় দ্বীনী ভাইয়েরা!

এই শ্রেণীর অধঃপতিতরা সবচেয়ে বেশী বিপজ্জনক। কেননা এরূপ অধঃপতনের শিকার মানুষগুলো জানতেই পারে না যে তারা গুমরাহ ও পথহারা। বরং তারা ভাবে যে, তারা নেক কাজের সাগর থেকে সদাই আঁজলা ভরে পান করছে। সুতরাং তওবার কথা তাদের মনে কখনই জাগে না। তাদের দু’কান ও অন্তর তালাবদ্ধ। ফলে তারা কোন সত্য ও অপ্রিয় কথা শুনতে চায় না। কখনো কখনো তারা আল্লাহর ঘরের উপরও বাড়াবাড়ি করে বসে। মসজিদসমূহে লেকচারদানের যেসব প্রচারপত্র লাগানো থাকে তাদের মনে না ধরলে তারা সেগুলো টেনে ছিঁড়ে ফেলে। অথচ এ কাজ তাদের অধিকারভুক্ত নয়। তারা হক কথা শোনে না, হকের ডাকে সাড়া দেয় না এবং হকের কাছে আসে না। নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন,إِنَّ اللهَ حَجَبَ التَّوْبَةَ عَنْ صَاحِبِ كُلِّ بِدْعَةٍ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ প্রত্যেক বিদ‘আতীর জন্যে তওবার রাস্তা পর্দাবৃত করে রাখেন, যে পর্যন্ত না সে তার বিদ‘আত পরিত্যাগ করে’।[12]

অবস্থা যখন এমন বিপজ্জনক তখন ওদের প্রতি অনুকম্পা এবং নিজেদের ও আমাদের ভাইদের অবস্থা যাচাইয়ের মানসে আমি আমার ভাইদের সামনে আলোচ্য বিষয়ে সংক্ষেপে যুবসমাজের অধঃপতনের কিছু কারণ ও তার প্রতিকার তুলে ধরা ভালো মনে করেছি। মহান আল্লাহর অনুগ্রহে আমরা সবাই মিলে যাতে আল্লাহর পথে অবিচল থাকতে পারি এবং অধঃপতন ও অনুশোচনার পথ হ’তে দূরে থাকতে পারি সেই আকাঙ্ক্ষা থেকে কথাগুলো আপনাদের সামনে নিবেদন করছি।

(ক্রমশঃ)

মূল (আরবী) : ড. সুলায়মান আর-রুহাইলী

অনুবাদ : মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

ঝিনাইদহ। 


[1]. মুসলিম হা/৬৬৬

[2]. মুসলিম হা/২৬৯৯, মিশকাত হা/২০৪

[3]. মুসলিম হা/২৭০১, মিশকাত হা/২২৭৮

[4]. বুখারী হা/১১৯৩।

[5]. ইবনু মাজাহ হা/১৪১২; ছহীহ তারগীব হা/১১৮১

[6]. মুসলিম হা/৩৮

[7]. ইবনু মাজাহ হা/২৭৭

[8]. ছহীহ ইবনু হিববান হা/৬; ইবনু মাজাহ হা/১১; মিশকাত হা/১৬৬

[9]. বুখারী হা/১৪২৩; মুসলিম হা/১০৩১।

[10]. আহমাদ হা/১৭৪০৯; ছহীহাহ হা/২৮৪৩।

[11]. মুত্বাফফেফীন ৮৩/১৪; ইবনু মাজাহ হা/৪২৪৪; মিশকাত হা/২৩৪২।

[12]. ত্বাবারাণী আওসাত্ব হা/৪২০২; ছহীহ তারগীব হা/৫৪






বিষয়সমূহ: যুবসমাজ
হজ্জ পরবর্তী করণীয় - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
তওবা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার : ইসলামী দৃষ্টিকোণ - মুহাম্মাদ শাহাদত হোসাইন, বসুন্ধরা গ্রুপ, ঢাকা
১৬ মাসের মর্মান্তিক কারা স্মৃতি (৫ম কিস্তি) - মাওলানা মুহাম্মাদ নূরুল ইসলাম
অল্পে তুষ্টি - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
ছালাতের আদব সমূহ - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা - মীযানুর রহমান মাদানী
আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (২য় কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
পবিত্র রামাযান : আল্লাহর সান্নিধ্যে ফিরে আসার মাস - ড. মুহাম্মাদ নযরুল ইসলাম খান, আমেরিকা
পলাশীর ষড়যন্ত্রকারীদের পরিণাম - আত-তাহরীক ডেস্ক
পবিত্র কুরআনের ১৩৭০ বছর আগের কয়েকটি পৃষ্ঠা উদ্ধার
আরও
আরও
.