পর্ব ১ ।  পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ 

ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা :

আন্তরিক প্রশান্তি ও নৈতিকতা লাভে ইবাদতের ভূমিকা অপরিসীম। ইবাদতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নৈকট্য লাভ করতে পারে। এর মাধ্যমে গোনাহ থেকে মুক্তি এবং জান্নাতে প্রবেশের সুযোগ লাভ করতে পারে। আল্লাহর নে‘মত লাভ করে তাঁর শুকরিয়া আদায় করা যায় কেবল ইবাদতের মাধ্যমে। ইবাদতের মাধ্যমেই শয়তানকে পরাভূত করা যায়, নফসে আম্মারার প্ররোচনা থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। সুতরাং মানবজীবনে ইবাদতের প্রয়োজনীয়তা অত্যধিত। নিম্নের আলোচনায় যা সুস্পষ্টরূপে ফুটে ওঠে।

১. মানব ও জিন জাতি সৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য ইবাদত :

আল্লাহ মানুষ ও জিন জাতিকে সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদতের জন্য। আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা এবং তদনুযায়ী পার্থিব জীবনের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করা মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য। যা আল্লাহর ইবাদতের মধ্যে শামিল। আর এজন্যই আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন,وَمَا خَلَقْتُ الْجِنَّ وَالْإِنْسَ إِلَّا لِيَعْبُدُونِ، مَا أُرِيدُ مِنْهُمْ مِنْ رِزْقٍ وَمَا أُرِيْدُ أَنْ يُطْعِمُوْنِ، إِنَّ اللهَ هُوَ الرَّزَّاقُ ذُو الْقُوَّةِ الْمَتِيْنُ، ‘আমি জিন ও ইনসানকে সৃষ্টি করেছি কেবল এজন্য যে, তারা আমার ইবাদত করবে। আমি তাদের নিকট থেকে কোন রিযিক চাই না এবং চাই না যে তারা আমাকে আহার যোগাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ হ’লেন সবচেয়ে বড় রিযিকদাতা ও কঠিন শক্তির অধিকারী’ (যারিয়াত ৫১/৫৬-৫৮)

২. আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালন করা :

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনের বহু স্থানে মানুষকে তার ইবাদত করার জন্য আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,يَاأَيُّهَا النَّاسُ اعْبُدُوْا رَبَّكُمُ الَّذِي خَلَقَكُمْ وَالَّذِيْنَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ، ‘হে মানবজাতি! তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের দাসত্ব কর। যিনি তোমাদেরকে এবং তোমাদের পূর্ববর্তীদেরকে সৃষ্টি করেছেন। যাতে তোমরা (জাহান্নাম থেকে) বাঁচতে পারো’ (বাক্বারাহ ২/২১)। অন্যত্র আল্লাহ আরো বলেন,وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ قَبْلِكَ مِنْ رَسُولٍ إِلَّا نُوحِي إِلَيْهِ أَنَّهُ لَا إِلَهَ إِلَّا أَنَا فَاعْبُدُونِ، ‘আর আমরা তোমার পূর্বে কোন রাসূল প্রেরণ করিনি এই অহী ব্যতীত যে, আমি ছাড়া কোন উপাস্য নেই। অতএব তোমরা আমার ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/২৫)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ، ‘এরা সবাই তোমাদের একই উম্মতভুক্ত। আর আমিই তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (আম্বিয়া ২১/৯২)। অন্যত্র তিনি বলেন,يَاعِبَادِيَ الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّ أَرْضِي وَاسِعَةٌ فَإِيَّايَ فَاعْبُدُونِ، ‘হে আমার বিশ্বাসী বান্দারা! আমার যমীন প্রশস্ত। অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর’ (আনকাবূত ২৯/৫৬)। সুতরাং আল্লাহর নির্দেশ প্রতিপালনে মানুষ তাঁর ইবাদত করতে বাধ্য।

৩. নবী-রাসূলগণের আদেশ পালন করা :

পৃথিবীতে আগত সকল নবী-রাসূল স্বীয় কওমকে আল্লাহর ইবাদতের প্রতি আহবান জানিয়েছিলেন। যেমন নূহ (আঃ)-এর কথা পবিত্র কুরআনে আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেছেন,قَالَ يَاقَوْمِ إِنِّي لَكُمْ نَذِيرٌ مُبِينٌ، أَنِ اعْبُدُوا اللهَ وَاتَّقُوهُ وَأَطِيعُونِ، ‘সে বলল, হে আমার কওম! আমি তোমাদের জন্য স্পষ্ট সতর্ককারী, এ মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর ও তাঁকে ভয় কর এবং আমার আনুগত্য কর’ (নূহ ৭১/২-৩)। তিনি আরো বলেন, وَلِلَّهِ غَيْبُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَإِلَيْهِ يُرْجَعُ الْأَمْرُ كُلُّهُ فَاعْبُدْهُ وَتَوَكَّلْ عَلَيْهِ وَمَا رَبُّكَ بِغَافِلٍ عَمَّا تَعْمَلُونَ، ‘বস্ত্ততঃ নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের অদৃশ্য জ্ঞান সমূহ কেবল আল্লাহরই নিকটে। তাঁর দিকেই সবকিছু প্রত্যাবর্তিত হবে। অতএব তুমি তাঁর ইবাদত কর ও তাঁর উপরেই ভরসা কর। আর তোমরা যা কিছু কর, তোমার পালনকর্তা সে বিষয়ে উদাসীন নন’ (হূদ ১১/১২৩)। আল্লাহ আরো বলেন,لَقَدْ أَرْسَلْنَا نُوحًا إِلَى قَوْمِهِ فَقَالَ يَاقَوْمِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ، ‘আমরা নূহকে তার কওমের নিকট প্রেরণ করেছিলাম। অতঃপর সে তাদের বলল, হে আমার কওম! তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের কোন উপাস্য নেই’ (আরাফ ৭/৫৯; মুমিনূন ২৩/২৩)। অনুরূপভাবে ছালেহ, শু‘আইব, হূদ (আঃ) প্রত্যেকে স্বীয় কওমকে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান করেছিলেন।[1]

সকল নবী-রাসূল যে স্বীয় সম্প্রদায়কে আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহবান জানিয়েছিলেন, এ মর্মে আল্লাহ বলেন,فَأَرْسَلْنَا فِيْهِمْ رَسُولًا مِنْهُمْ أَنِ اعْبُدُوا اللهَ مَا لَكُمْ مِنْ إِلَهٍ غَيْرُهُ أَفَلَا تَتَّقُوْنَ، ‘অতঃপর তাদের মধ্যকার একজনকে (হূদ) তাদের মধ্যে রাসূলরূপে প্রেরণ করেছিলাম এই বলে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর। তিনি ব্যতীত তোমাদের অন্য কোন উপাস্য নেই। তবুও কি তোমরা ভয় করবে না’? (মুমিনূন ২৩/৩২)। তিনি আরো বলেন, وَلَقَدْ بَعَثْنَا فِيْ كُلِّ أُمَّةٍ رَسُولًا أَنِ اعْبُدُوْا اللهَ وَاجْتَنِبُوْا الطَّاغُوتَ، ‘প্রত্যেক সম্প্রদায়ের নিকট আমরা রাসূল প্রেরণ করেছি এই মর্মে যে, তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং ত্বাগূত থেকে দূরে থাক’ (নাহল ১৬/৩৬)

৪. ইবাদত আল্লাহর হক :

আল্লাহ মানুষের জন্য পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। তাকে সম্মানিত করেছেন এবং তাকে সকল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ করেছেন। তাই সকল প্রকার ইবাদত পাওয়ার হকদার কেবল মহান আল্লাহ। হাদীছে এসেছে,

عَنْ مُعَاذٍ رضى الله عنه قَالَ كُنْتُ رِدْفَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم عَلَى حِمَارٍ يُقَالُ لَهُ عُفَيْرٌ، فَقَالَ يَا مُعَاذُ، هَلْ تَدْرِى حَقَّ اللهِ عَلَى عِبَادِهِ وَمَا حَقُّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ. قُلْتُ اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ. قَالَ فَإِنَّ حَقَّ اللهِ عَلَى الْعِبَادِ أَنْ يَعْبُدُوهُ وَلاَ يُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا، وَحَقَّ الْعِبَادِ عَلَى اللهِ أَنْ لاَ يُعَذِّبَ مَنْ لاَ يُشْرِكُ بِهِ شَيْئًا.

মু‘আয ইবনু জাবাল (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা আমি নবী করীম (ছাঃ)-এর পশ্চাতে উফাইর গাধার উপরে উপবিষ্ট ছিলাম। তিনি বললেন, হে মু‘আয! তুমি কি জান, বান্দার উপর আল্লাহর কী হক এবং আল্লাহর নিকটে বান্দার হক কি? আমি বললাম, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক অবগত। তিনি বললেন, বান্দার উপর আল্লাহর হক এই যে, তারা একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে, অন্য কিছুকে তাঁর সাথে শরীক করবে না। আর আল্লাহর নিকটে বান্দার হক হ’ল তিনি তাদের আযাব দিবেন না, যারা তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরীক করেনি’।[2] সুতরাং আল্লাহর জন্যই যাবতীয় ইবাদত-বন্দেগী করতে হবে।

৫. শয়তানের কবল থেকে মুক্ত হওয়া :

শয়তান সর্বদা মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।[3] কিন্তু যেসকল মানুষ আল্লাহর অনুগত থাকে এবং তাঁর ইবাদতে রত থাকে তারা শয়তানের কবল থেকে মুক্ত থাকবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ إِلَّا مَنِ اتَّبَعَكَ مِنَ الْغَاوِيْنَ، ‘নিশ্চয়ই আমার বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। তবে বিপথগামীদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে’ (হিজর ১৫/৪২)। তিনি আরো বলেন,إِنَّ عِبَادِي لَيْسَ لَكَ عَلَيْهِمْ سُلْطَانٌ وَكَفَى بِرَبِّكَ وَكِيلًا، ‘নিশ্চয়ই আমার (অনুগত) বান্দাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। আর তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে তোমার প্রতিপালকই যথেষ্ট’ (ইসরা ১৭/৬৫)। আর বান্দার কর্তব্য হ’ল রবের নির্দেশনা মেনে চলা ও তাঁর ইবাদত করা।

৬. সৎকর্মশীল বান্দাদের আল্লাহর সাহায্য-সহযোগিতা :

মানুষ আল্লাহর নির্দেশ পালন ও তাঁর ইবাদত সম্পাদন করার মাধ্যমে আল্লাহর সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে পারে। আর সৎকর্মশীল বান্দারা আল্লাহর সহায়তা লাভ করে থাকে। আল্লাহ বলেন,وَعَدَ اللهُ الَّذِينَ آمَنُوا مِنْكُمْ وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَيَسْتَخْلِفَنَّهُمْ فِي الْأَرْضِ كَمَا اسْتَخْلَفَ الَّذِينَ مِنْ قَبْلِهِمْ وَلَيُمَكِّنَنَّ لَهُمْ دِينَهُمُ الَّذِي ارْتَضَى لَهُمْ وَلَيُبَدِّلَنَّهُمْ مِنْ بَعْدِ خَوْفِهِمْ أَمْنًا، ‘তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, আল্লাহ তাদের ওয়াদা দিয়েছেন যে, তিনি তাদেরকে অবশ্যই পৃথিবীতে শাসন ক্ষমতা দান করবেন, যেমন তিনি দান করেছিলেন পূর্ববর্তীদেরকে। আর তিনি অবশ্যই সুদৃঢ় করবেন তাদের ধর্মকে যা তিনি তাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাদেরকে ভয়-ভীতির বদলে অবশ্যই নিরাপত্তা দান করবেন’ (নূর ২৪/৫৫)

৭. আল্লাহর নিকটে সম্মান-মর্যাদা বৃদ্ধি :

সম্মান-মর্যাদার মালিক মহান আল্লাহ। তিনি যাকে ইচ্ছা সম্মানিত করেন এবং যাকে ইচ্ছা অপমানিত-লাঞ্ছিত করেন। সুতরাং মর্যাদা লাভের জন্য আল্লাহর সন্তোষ প্রয়োজন। আর ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও রেযামন্দি হাছিল করা যায় এবং আল্লাহর নিকটে বান্দার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ বলেন,وَعِبَادُ الرَّحْمَنِ الَّذِينَ يَمْشُونَ عَلَى الْأَرْضِ هَوْنًا وَإِذَا خَاطَبَهُمُ الْجَاهِلُونَ قَالُوا سَلامًا، ‘রহমান’ (দয়াময়)-এর বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অন্ধ লোকেরা (বাজে) সম্বোধন করে, তখন তারা বলে ‘সালাম’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩)। তিনি আরো বলেন,فَبَشِّرْ عِبَادِ الَّذِيْنَ يَسْتَمِعُونَ الْقَوْلَ فَيَتَّبِعُونَ أَحْسَنَهُ أُولَئِكَ الَّذِيْنَ هَدَاهُمُ اللهُ وَأُولَئِكَ هُمْ أُولُو الْأَلْبَابِ، ‘অতএব সুসংবাদ দাও আমার বান্দাদেরকে। যারা মনোযোগ দিয়ে কথা শোনে, অতঃপর তার মধ্যে যেটা উত্তম সেটার অনুসরণ করে, তাদেরকে আল্লাহ সুপথে পরিচালিত করেন এবং তারাই হ’ল জ্ঞানী’ (যুমার ৩৯/১৭-১৮)

৮. আল্লাহর রহমত লাভ করা :

আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ তার আমলের মাধ্যমে জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।[4] আর ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَالَّذِينَ هَاجَرُوا وَجَاهَدُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أُولَئِكَ يَرْجُونَ رَحْمَتَ اللهِ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং যারা হিজরত করেছে ও আল্লাহর পথে জিহাদ করেছে, তারাই আল্লাহর রহমত আশা করে। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (বাক্বারাহ ২/২১৮)। তিনি আরো বলেন,فَأَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا بِاللهِ وَاعْتَصَمُوا بِهِ فَسَيُدْخِلُهُمْ فِي رَحْمَةٍ مِنْهُ وَفَضْلٍ وَيَهْدِيْهِمْ إِلَيْهِ صِرَاطًا مُسْتَقِيْمًا، ‘অতঃপর যারা আল্লাহর উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও তাঁর কিতাবকে দৃঢ়ভাবে ধারণ করেছে, সত্বর তিনি তাদেরকে স্বীয় অনুগ্রহ ও কল্যাণের মধ্যে প্রবেশ করাবেন এবং তাঁর প্রতি সরল পথ প্রদর্শন করবেন’ (নিসা ৪/১৭৫)। অন্যত্র তিনি বলেন,الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَهَاجَرُوْا وَجَاهَدُوْا فِي سَبِيْلِ اللهِ بِأَمْوَالِهِمْ وَأَنْفُسِهِمْ أَعْظَمُ دَرَجَةً عِنْدَ اللهِ وَأُولَئِكَ هُمُ الْفَائِزُوْنَ، يُبَشِّرُهُمْ رَبُّهُمْ بِرَحْمَةٍ مِنْهُ وَرِضْوَانٍ وَجَنَّاتٍ لَهُمْ فِيهَا نَعِيمٌ مُقِيمٌ، خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ أَجْرٌ عَظِيمٌ، ‘যারা ঈমান এনেছে ও হিজরত করেছে এবং তাদের মাল ও জান দ্বারা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করেছে, তারা আল্লাহর নিকট উচ্চ মর্যাদাবান এবং তারাই হ’ল সফলকাম। তাদের প্রতিপালক তাদেরকে সুসংবাদ দিচ্ছেন তাঁর পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহের ও সন্তুষ্টির এবং তাদের জন্য এমন জান্নাতের, যেখানে রয়েছে চিরস্থায়ী নে‘মত সমূহ। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটে রয়েছে মহা পুরস্কার’ (তওবা ৯/২০-২২)। তিনি আরো বলেন, ‘আর আমার অনুগ্রহ সবকিছুতে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছে। সত্বর আমি তা নির্ধারিত করব ঐসব লোকদের জন্য যারা আল্লাহকে ভয় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আমাদের আয়াত সমূহে বিশ্বাস পোষণ করে। যারা এই রাসূলের আনুগত্য করে যিনি নিরক্ষর নবী, যার বিষয়ে তারা তাদের কিতাব তাওরাত ও ইনজীলে লিখিত পেয়েছে। যিনি তাদেরকে ন্যায়ের আদেশ দেন ও অন্যায় থেকে নিষেধ করেন। যিনি তাদের জন্য পবিত্র বিষয় সমূহ হালাল করেন ও নাপাক বিষয় সমূহ নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের উপর থেকে বোঝা ও বন্ধন সমূহ নামিয়ে দেন, যা তাদের উপরে ছিল। অতএব যারা তার উপরে বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তাকে শত্রু থেকে প্রতিরোধ করেছে ও সাহায্য করেছে এবং সেই জ্যোতির (কুরআনের) অনুসরণ করেছে যা তার সাথে নাযিল হয়েছে, তারাই হ’ল সফলকাম’ (আরাফ ৭/১৫৬-৫৭)। আল্লাহ আরো বলেন,فَأَمَّا الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَيُدْخِلُهُمْ رَبُّهُمْ فِيْ رَحْمَتِهِ ذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْمُبِيْنُ، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদেরকে তাদের প্রতিপালক স্বীয় রহমতে প্রবেশ করাবেন। আর এটাই হ’ল সুস্পষ্ট সাফল্য’ (জাছিয়া ৪৫/৩০)। তিনি বলেন,وَأَقِيمُوا الصَّلَاةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ، ‘তোমরা ছালাত কায়েম কর, যাকাত আদায় কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর। যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হ’তে পারো’ (নূর ২৪/৫৬)

৯.আত্মিক পরিশুদ্ধতা অর্জন :

পাপাচারের কারণে মানুষের আত্মা কলুষিত হয়। আর ইবাদতের মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি অর্জন করা যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَأَقِمِ الصَّلَاةَ إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَلَذِكْرُ اللهِ أَكْبَرُ وَاللهُ يَعْلَمُ مَا تَصْنَعُونَ ‘তুমি তোমার প্রতি অহীকৃত কিতাব (কুরআন) পাঠ কর এবং ছালাত কায়েম কর। নিশ্চয়ই ছালাত যাবতীয় অশ্লীলতা ও গর্হিত কর্ম থেকে বিরত রাখে। আর (সর্বাবস্থায়) আল্লাহর স্মরণই সবচেয়ে বড় বস্ত্ত। আল্লাহ জানেন যা কিছু তোমরা করে থাক’ (আনকাবূত ২৯/৪৫)। তিনি আরো বলেন,وَأَقِمِ الصَّلَاةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلَفًا مِنَ اللَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيِّئَاتِ ذَلِكَ ذِكْرَى لِلذَّاكِرِينَ، ‘আর তুমি ছালাত কায়েম কর দিনের দুই প্রান্তে ও রাত্রির কিছু অংশে। নিশ্চয়ই সৎকর্মসমূহ মন্দ কর্মসমূহকে বিদূরিত করে। আর এটি (অর্থাৎ কুরআন) হ’ল উপদেশ গ্রহণকারীদের জন্য (সর্বোত্তম) উপদেশ’ (হূদ ১১/১১৪)

ইবাদত-বন্দেগী মানুষকে পরিচ্ছন্ন ও পরিশুদ্ধ করে। এ মর্মে হাদীছে এসেছে, عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ قَالَ جَاءَ رَجُلٌ إِلَى النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ إِنَّ فُلاَناً يُصَلِّى بِاللَّيْلِ فَإِذَا أَصْبَحَ سَرَقَ قَالَ إِنَّهُ سَيَنْهَاهُ مَا تَقُولُ. ‘আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক লোক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এলো এবং তাঁকে বলল, অমুক লোক রাত্রে ছালাত আদায় করে কিন্তু ভোরে উঠে চুরি করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, অতি শীঘ্রই তার ছালাত তাকে এ কাজ থেকে বাধা দিবে, যে কাজের কথা তুমি বলছ’।[5] অন্য হাদীছে আবূ যার (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাকে বলেছেন, اتَّقِ اللهِ حَيْثُمَا كُنْتَ، وَأَتْبِعِ السَّيِّئَةَ الحَسَنَةَ تَمْحُهَا، وَخَالِقِ النَّاسَ بِخُلُقٍ حَسَنٍ তুমি যেখানেই থাক আল্লাহকে ভয় কর, মন্দ কাজের পরপরই ভাল কাজ কর, তাতে মন্দ দূরীভূত হয়ে যাবে এবং মানুষের সাথে উত্তম আচরণ কর’।[6]

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّهُ سَمِعَ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهَرًا بِبَابِ أَحَدِكُمْ، يَغْتَسِلُ فِيهِ كُلَّ يَوْمٍ خَمْسًا، مَا تَقُولُ ذَلِكَ يُبْقِى مِنْ دَرَنِهِ. قَالُوْا لاَ يُبْقِى مِنْ دَرَنِهِ شَيْئًا. قَالَ فَذَلِكَ مِثْلُ الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ، يَمْحُو اللهُ بِهَا الْخَطَايَا.

আবূ হুরায়রাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছেন, ‘বলতো যদি তোমাদের কারো বাড়ির সামনে একটি নদী থাকে, আর সে তাতে প্রত্যহ পাঁচবার গোসল করে, তাহ’লে কি তার দেহে কোন ময়লা থাকবে? তারা বললেন, তার দেহে কোনরূপ ময়লা বাকী থাকবে না। রাসূল (ছাঃ) বললেন, এ হ’ল পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতের উদাহরণ। এর মাধ্যমে আল্লাহ (বান্দার) গুনাহসমূহ মিটিয়ে দেন’।[7]

অনুরূপভাবে আর্থিক ইবাদতের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র হয়। আল্লাহ বলেন, خُذْ مِنْ أَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَتُزَكِّيهِمْ بِهَا ‘তুমি তাদের মাল-সম্পদ থেকে যাকাত গ্রহণ কর। যা দ্বারা তুমি তাদের পবিত্র করবে ও পরিশুদ্ধ করবে’ (তওবা ৯/১০৩)

১০. সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হওয়া যায় :

মহান আল্লাহ সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে ভালবাসেন। আর সৎকর্মশীল বান্দা হওয়ার জন্য আল্লাহর নির্দেশনা মেনে চলতে হয় এবং তাঁর ইবাদত করতে হয়। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَنُدْخِلَنَّهُمْ فِي الصَّالِحِيْنَ، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে অবশ্যই আমরা তাদেরকে সৎকর্মশীলদের মধ্যে প্রবেশ করাবো’ (আনকাবূত ২৯/৯)। আর সৎকর্মশীল বান্দা সদা নেক আমল করতে এবং গর্হিত কাজ পরিত্যাগে সচেষ্ট হয়। এমনকি তার পূর্ণ জীবন আল্লাহর সন্তুষ্টির পথে পরিচালিত হয়। অর্থাৎ তার পথ চলা, কোন কিছু শ্রবণ করা, কোন কিছু দেখা সবকিছুই কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হয়ে থাকে। যা আল্লাহর নিকটবর্তী করে তা প্রতিপালনে এবং যা আল্লাহ থেকে দূরে সরিয়ে দেয় তা পরিহারে সে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। যেমন হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন,وَمَا تَقَرَّبَ إِلَىَّ عَبْدِى بِشَىْءٍ أَحَبَّ إِلَىَّ مِمَّا افْتَرَضْتُ عَلَيْهِ، وَمَا يَزَالُ عَبْدِى يَتَقَرَّبُ إِلَىَّ بِالنَّوَافِلِ حَتَّى أُحِبَّهُ، فَإِذَا أَحْبَبْتُهُ كُنْتُ سَمْعَهُ الَّذِى يَسْمَعُ بِهِ، وَبَصَرَهُ الَّذِى يُبْصِرُ بِهِ، وَيَدَهُ الَّتِى يَبْطُشُ بِهَا وَرِجْلَهُ الَّتِى يَمْشِى بِهَا، وَإِنْ سَأَلَنِى لأُعْطِيَنَّهُ، وَلَئِنِ اسْتَعَاذَنِى لأُعِيذَنَّهُ، ‘আমার বান্দার উপর আমি যা ফরয করেছি সে ইবাদত অপেক্ষা আমার কাছে অধিক প্রিয় কোন ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য লাভ করবে না। আমার বান্দা সর্বদা নফল ইবাদত দ্বারা আমার নৈকট্য অর্জন করতে থাকবে। এমনকি অবশেষে আমি তাকে আমার এমন প্রিয় পাত্র বানিয়ে নেই যে, আমিই তার কান হয়ে যাই, যা দিয়ে সে শুনে। আমিই তার চোখ হয়ে যাই, যা দিয়ে সে সবকিছু দেখে। আমিই তার হাত হয়ে যাই, যা দিয়ে সে ধরে। আমিই তার পা হয়ে যাই, যার দ্বারা সে চলে। সে যদি আমার কাছে কোন কিছু চায়, তবে আমি নিশ্চয়ই তাকে তা দান করি। আর যদি সে আমার কাছে আশ্রয় চায়, তবে অবশ্যই আমি তাকে আশ্রয় দেই’।[8]

১১. সৃষ্টির শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করা :

দুনিয়াতে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু মানুষ রয়েছে। এসব মানুষের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব কেবল তারা অর্জন করতে পারে যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়ন করে, তাঁর আদেশ-নিষেধ মেনে চলে এবং আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (ছাঃ)-এর প্রদর্শিত পথে ইবাদত-বন্দেগী সম্পন্ন করে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ هُمْ خَيْرُ الْبَرِيَّةِ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তারাই হ’ল সৃষ্টির সেরা’ (বাইয়েনাহ ৯৮/৭)

রাসূল (ছাঃ) বলেন,مِنْ خَيْرِ مَعَاشِ النَّاسِ لَهُمْ، رَجُلٌ مُمْسِكٌ عِنَانَ فَرَسِهِ فِي سَبِيلِ اللهِ، يَطِيرُ عَلَى مَتْنِهِ، كُلَّمَا سَمِعَ هَيْعَةً، أَوْ فَزْعَةً طَارَ عَلَيْهِ، يَبْتَغِي الْقَتْلَ وَالْمَوْتَ مَظَانَّهُ، أَوْ رَجُلٌ فِي غُنَيْمَةٍ فِي رَأْسِ شَعَفَةٍ مِنْ هَذِهِ الشَّعَفِ، أَوْ بَطْنِ وَادٍ مِنْ هَذِهِ الْأَوْدِيَةِ، يُقِيمُ الصَّلَاةَ، وَيُؤْتِي الزَّكَاةَ، وَيَعْبُدُ رَبَّهُ حَتَّى يَأْتِيَهُ الْيَقِينُ، لَيْسَ مِنَ النَّاسِ إِلَّا فِي خَيْرٍ، ‘সর্বোত্তম জীবন হ’ল সে ব্যক্তির জীবন যে আল্লাহর পথে জিহাদের জন্যে ঘোড়ার লাগাম ধরে থাকে। শত্রুর উপস্থিতি ও শত্রুর দিকে ধাবমান হওয়ার শব্দ শোনামাত্র ঘোড়ার পিঠে সওয়ার হয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ে যথাস্থানে সে শত্রুকে হত্যা এবং নিজ শাহাদতের সন্ধান করে। অথবা ঐ লোকের জীবনই উত্তম যে ছাগপাল নিয়ে কোন পাহাড় চূড়ায় বা (নির্জন) উপত্যকায় বসবাস করে আর যথারীতি ছালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং আমৃত্যু তার প্রভুর ইবাদতে নিমগ্ন থাকে। মানুষের মধ্যে এ ব্যক্তি মঙ্গলের মধ্যে রয়েছে’।[9]

অন্য একটি হাদীছে এসেছে,

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ قَالَ إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم جَاءَ أَوْ خَرَجَ عَلَيْهِمْ وَهُمْ جُلُوسٌ فَقَالَ أَلاَ أُحَدِّثُكُمْ بِخَيْرِ النَّاسِ مَنْزِلاً. قَالَ قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ رَجُلٌ مُمْسِكٌ بِرَأْسِ فَرَسِهِ فِى سَبِيلِ اللهِ حَتَّى يَمُوتَ أَوْ يُقْتَلَ. ثُمَّ قَالَ أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِالَّذِى يَلِيهِ. قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللَّهِ. قَالَ امْرُؤٌ مُعْتَزِلٌ فِى شِعْبٍ يُقِيمُ الصَّلاَةَ وَيُؤْتِى الزَّكَاةَ وَيَعْتَزِلُ شُرُورَ النَّاسِ. ثُمَّ قَالَ أَلاَ أُخْبِرُكُمْ بِشَرِّ النَّاسِ مَنْزِلاً. قَالَ قُلْنَا بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ. قَالَ الَّذِى يُسْأَلُ بِاللهِ وَلاَ يُعْطِى بِهِ-

ইবনু আববাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তারা বসে ছিলেন এমতাবস্থায় নবী করীম (ছাঃ) তাদের নিকট বেরিয়ে এলেন। তখন তিনি বললেন, আমি কি তোমাদেরকে সর্বোচ্চ মর্যাদাশীল ব্যক্তি সম্পর্কে অবগত করাব না? আমরা বললাম, কেন নয়? (নিশ্চয়ই) হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, সে ঐ ব্যক্তি, যে মহান আল্লাহর রাস্তায় তাঁর ঘোড়ার মাথা ধরে প্রস্তুত থাকে। এমতাবস্থায় সে মৃত্যুবরণ করে বা শহীদ হয়ে যায়। তিনি বললেন, তার পরবর্তী পর্যায়ের লোকের সংবাদ তোমাদেরকে দেব কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, সে হ’ল ঐ ব্যক্তি যে নির্জনে কোন গুহায় থাকে, সেখানে সে ছালাত আদায় করে, যাকাত প্রদান করে এবং লোকদের অনিষ্ট থেকে দূরে থাকে। অতঃপর তিনি বলেন, তোমাদেরকে কি নিকৃষ্ট লোক সম্পর্কে অবহিত করব? আমরা বললাম, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! (অবহিত করুন)। তিনি বললেন, সে হ’ল ঐ ব্যক্তি যার কাছে কেউ আল্লাহ তা‘আলার নামে (সাহায্য) চায় কিন্তু সে তাকে দান করে না’।[10]

১২. দুনিয়াতে পবিত্র জীবন লাভ :

পৃথিবীতে পবিত্র জীবন লাভ করলে তার আমলও পরিচ্ছন্ন হবে, তার চাল-চলন পরিশীলিত হবে। ফলে পরকালে সে নাজাত পাবে এবং জান্নাত লাভ করতে পারবে ইনশাআল্লাহ। আর ইবাদতের মাধ্যমেই পবিত্র জীবন লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন,مَنْ عَمِلَ صَالِحًا مِنْ ذَكَرٍ أَوْ أُنْثَى وَهُوَ مُؤْمِنٌ فَلَنُحْيِيَنَّهُ حَيَاةً طَيِّبَةً وَلَنَجْزِيَنَّهُمْ أَجْرَهُمْ بِأَحْسَنِ مَا كَانُوْا يَعْمَلُونَ، ‘পুরুষ হৌক নারী হৌক মুমিন অবস্থায় যে সৎকর্ম সম্পাদন করে, আমরা তাকে পবিত্র জীবন দান করব এবং অবশ্যই তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম অপেক্ষা উত্তম পুরস্কারে ভূষিত করব’ (নাহল ১৬/৯৭)

১৩. উত্তম রিযক লাভ :

পৃথিবীর সকল প্রাণী আল্লাহর রিযকের মাধ্যমে জীবন ধারণ করে (হূদ ১১/৬)। সুতরাং আল্লাহর রিযক খেয়ে মানুষকে তাঁরই ইবাদত করতে হবে। এটা যেমন মানুষের দায়িত্ব তেমনি এই ইবাদতের মাধ্যমে দুনিয়াতে মানুষ উত্তম রিযক লাভ করবে। আল্লাহ বলেন, لِيَجْزِيَ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَرِزْقٌ كَرِيْمٌ، ‘যাতে তিনি ঈমানদার ও সৎকর্মশীলদের যথাযথ পুরস্কার দিতে পারেন। তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক’ (সাবা ৩৪/৪)

১৪. আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ :

পরকালীন জীবনে নাজাত লাভ ও জান্নাতে প্রবেশের জন্য আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা অপরিহার্য। আর ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوْا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا، ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য দয়াময় (সৎকর্মশীল বান্দাদের অন্তরে) মহববত সৃষ্টি করে দিবেন’ (মারিয়াম ১৯/৯৬)

এ আয়াতের ব্যাখ্যায় রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

إِذَا أَحَبَّ اللهُ عَبْدًا نَادَى جِبْرِيلَ: إِنِّي قَدْ أَحْبَبْتُ فُلَانًا فَأَحِبَّهُ، قَالَ: فَيُنَادِي فِي السَّمَاءِ، ثُمَّ تَنْزِلُ لَهُ المَحَبَّةُ فِي أَهْلِ الأَرْضِ، فَذَلِكَ قَوْلُ اللهِ: {إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا}

‘আল্লাহ যখন কোন বান্দাকে ভালবাসেন, তখন জিব্রীলকে ডেকে বলেন, আমি অমুক ব্যক্তিকে ভালবেসেছি। অতএব তুমিও তাকে ভালবাস। তখন জিব্রীল সেটা আসমানে ঘোষণা করে দেন। অতঃপর যমীনবাসীর মধ্যে তার জন্য মহববত নাযিল হয়। আর এটাই হ’ল আল্লাহর বাণীإِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَيَجْعَلُ لَهُمُ الرَّحْمَنُ وُدًّا، (এর মর্মার্থ)।[11]

১৫. আল্লাহর ক্ষমা লাভ :

মানুষ শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে নানা পাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। এ পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তওবা করতে হয়, আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হয়। সেই সাথে ইবাদত-বন্দেগীও করতে হয়। যার মাধ্যমে ক্ষমা পাওয়া যায়। আল্লাহ বলেন,وَالَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ مَغْفِرَةٌ وَأَجْرٌ كَبِيرٌ، ‘আর যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্মাদি সম্পাদন করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও মহা পুরস্কার’ (ফাতির ৩৫/৭)। তিনি আরো বলেন,وَعَدَ اللهُ الَّذِيْنَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ مِنْهُمْ مَغْفِرَةً وَأَجْرًا عَظِيمً، ‘তাদের মধ্যে যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা ও মহা পুরস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন’ (ফাতহ ৪৮/২৯)

১৬. পরকালে অশেষ প্রতিদান লাভ :

ইবাদত-বন্দেগী করা মহান আল্লাহর নির্দেশ। এ নির্দেশ পালন করা মানুষের উপরে ফরয। এ ফরয পালনের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর পক্ষ থেকে অশেষ ছওয়াব বা প্রতিদান লাভ করবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ وَأَقَامُوا الصَّلَاةَ وَآتَوُا الزَّكَاةَ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ، ‘নিশ্চয়ই যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে, তাদের জন্য পুরস্কার রয়েছে তাদের প্রতিপালকের নিকটে। তাদের কোন ভয় নেই এবং তারা চিন্তান্বিত হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৭৭)। তিনি আরো বলেন, ‘পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস স্থাপন করেছে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করেছে, তাদের প্রাপ্য পূর্ণভাবে দেওয়া হবে’ (আলে ইমরান ৩/৫৭)। অন্যত্র তিনি বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ لَهُمْ أَجْرٌ غَيْرُ مَمْنُونٍ، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য রয়েছে অবিচ্ছিন্ন পুরষ্কার’ (ফুচ্ছিলাত ৪১/৮)

হাদীছে কুদসীতে এসেছে, আল্লাহ বলেন,يَا عِبَادِي إِنَّمَا هِيَ أَعْمَالُكُمْ أُحْصِيهَا لَكُمْ، ثُمَّ أُوَفِّيكُمْ إِيَّاهَا، فَمَنْ وَجَدَ خَيْرًا، فَلْيَحْمَدِ اللهَ وَمَنْ وَجَدَ غَيْرَ ذَلِكَ، فَلَا يَلُومَنَّ إِلَّا نَفْسَهُ، ‘হে আমার বান্দাগণ! এ তো তোমাদের আমল, যা আমি তোমাদের জন্য সংরক্ষণ করি, অতঃপর তোমাদের তা পূর্ণ করে দেব। অতএব যে ভাল কিছু পেল সে যেন আল্লাহর প্রশংসা করে। আর যে অন্য কিছু পেল সে যেন নিজেকে ভিন্ন কাউকে দোষারোপ না করে’।[12]

১৭. জান্নাতে প্রবেশ :

মুমিনের ইহকালের যাবতীয় আমলের মাধ্যমে পরকালীন জীবনে জাহান্নাম থেকে মুক্তি এবং জান্নাত লাভই হ’ল লক্ষ্য। আর ইবাদত-বন্দেগীর মাধ্যমে সেই লক্ষ্যে পৌঁছা যায়, জান্নাত লাভ করা যায়। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ كَانَتْ لَهُمْ جَنَّاتُ الْفِرْدَوْسِ نُزُلًا، ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম সমূহ সম্পাদন করে, তাদের আপ্যায়নের জন্য জান্নাতুল ফেরদৌস প্রস্ত্তত করা আছে’ (কাহফ ১৮/১০৭)

তিনি আরো বলেন,وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ أُولَئِكَ أَصْحَابُ الْجَنَّةِ هُمْ فِيهَا خَالِدُوْنَ، ‘পক্ষান্তরে যারা ঈমান এনেছে এবং সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করেছে, তারা হ’ল জান্নাতের অধিবাসী। সেখানেই তারা চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৮২)

অন্যত্র তিনি বলেন,وَالَّذِيْنَ آمَنُوْا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ سَنُدْخِلُهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا أَبَدًا لَهُمْ فِيْهَا أَزْوَاجٌ مُطَهَّرَةٌ وَنُدْخِلُهُمْ ظِلًّا ظَلِيْلًا، ‘পক্ষান্তরে যারা বিশ্বাস স্থাপন করে ও সৎকর্ম সম্পাদন করে, সত্বর আমরা তাদেরকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো, যার তলদেশে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। তারা সেখানে চিরকাল থাকবে। সেখানে তাদের জন্য থাকবে পবিত্রা স্ত্রীগণ আর আমরা তাদেরকে প্রবেশ করাবো ছায়াঘন বাগিচায়’ (নিসা ৪/৫৭)[ক্রমশঃ]


[1]. আ‘রাফ ৭/৬৫, ৭৩, ৮৫; হূদ ১১/৫০, ৬১, ৮৪; আনকাবূত ২৯/১৬

[2]. বুখারী হা/২৮৫৬; মিশিকাত হা/২৪।

[3]. আ‘রাফ ৭/১৫-১৬; হিজর ১৫/৩৯; ছোয়াদ ৩৮/৮২।

[4]. মুসলিম হা/২৮১৮।

[5]. আহমাদ হা/৯৭৭৮; ইবনু হিববান হা/২৫৬০; শু‘আবুল ঈমান হা/২৯৯১; মিশকাত হা/১২৩৭; সিলসিলাহ ছহীহাহ হা/৩৪৮২।

[6]. তিরমিযী হা/১৯৮৭; মিশকাত হা/৫০৮৩; ছহীহুত তারগীব হা/৩১৬০।

[7]. বুখারী হা/৫২৮; মুসলিম হা/৬৬৭; মিশকাত হা/৫৬৫।

[8]. বুখারী হা/৬৫০২; মিশকাত হা/২২৬৬; ছহীহাহ হা/১৬৪০।

[9]. মুসলিম হা/১৮৮৯।

[10]. দারেমী, আহমাদ হা/২৯২৯; ছহীহুত তারগীব হা/১২৯৮, সনদ সহীহ।

[11]. বুখারী হা/৬০৪০; মুসলিম হা/২৬৭; তিরমিযী হা/৩১৬১।

[12]. মুসলিম হা/২৫৭৭; ছহীহুত তারগীব হা/১৬২৫; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩৪৫।






আলেমগণের মধ্যে মতভেদের কারণ (২য় কিস্তি) - আব্দুল আলীম বিন কাওছার
পুনরুত্থান - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
খতমে নবুঅত আন্দোলন ও আহলেহাদীছ ওলামায়ে কেরাম - ড. নূরুল ইসলাম
বাংলা বানান রীতি ও আমাদের প্রস্তাবনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
বিদ‘আতে হাসানার উদাহরণ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
তাক্বলীদের বিরুদ্ধে ৮১টি দলীল (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (৬ষ্ঠ কিস্তি) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
ক্বিয়ামতের আলামত সমূহ (১ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের আবশ্যকতা (৪র্থ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হাদীছ অনুসরণে চার ইমামের গৃহীত নীতি ও কিছু সীমাবদ্ধতা পর্যালোচনা - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আলেমে দ্বীনের মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য শিখন ফলাফলের গুরুত্ব (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - প্রফেসর ড. শহীদ নকীব ভূঁইয়া
আরও
আরও
.