পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । পর্ব ৬ । শেষ পর্ব ।
[২০০৫ সালের ২২ শে ফেব্রুয়ারী থেকে ২০০৬ সালের ৮ই জুলাই। ১ বছর ৪ মাস ১৪ দিন]
আমীরে জামা‘আতের নওগাঁ জেলখানায় আগমন :
২৫শে মার্চ’০৫ শুক্রবার ভোরের সোনালী সূর্য তার স্বকীয় রূপ নিয়ে পূর্বাকাশে প্রভা ছড়াচ্ছে। ফজরের ছালাত শেষে আমরা বসে তাসবীহ-তাহলীল করছি। সাথী আযীযুল্লাহ মন খারাপ করে মাঝে-মধ্যে সকালে শুয়ে থাকত। সালাফী ছাহেব আযীযুল্লাহকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য মাঝে-মধ্যে হাদীছের গল্প শোনাতেন। সেদিন শে‘আবে আবী তালেবে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর বন্দী জীবনের মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করছিলেন। হঠাৎ লকআপ খোলার ঘণ্টা পড়ে গেল। ম্যাট এসে লকআপ খুলে দিয়ে কি যেন বলতে চাইল। কিন্তু পিছনে কারারক্ষী বাবুকে দেখে চুপ হয়ে গেল। কেমন জানি এক অব্যক্ত আনন্দের কথা চোখে চাহনিতে প্রকাশ পাচ্ছিল। সেল থেকে বের হয়েই দেখি আজকের আয়োজন ভিন্ন। সেলের গেইটে অতিরিক্ত রক্ষী পুলিশ। জেলখানার বেষ্টনীর ষোল ফুট উঁচু প্রাচীরের ভিতরে প্রতি একশ’ ফুট অন্তর অন্তর একজন করে পাহারাদার নিয়োজিত থাকে। কিন্তু আজকে তাদের সংখ্যা অনেক বেশী। প্রাচীরের বাইরে তিন তলা বিল্ডিং-এর ছাদে রাইফেলধারী নিরাপত্তা বাহিনী নিযুক্ত। এত সব আয়োজন দেখে বুঝতে পারলাম আজকে কিছু একটা হবে। সূর্য যত ঊর্ধ্বাকাশে উঠছে, আমাদের সেলের প্রতি বিশেষ নযর ততই বাড়ছে। এক সময় ম্যাট কয়েকজন কয়েদীকে নিয়ে এসে আমাদের পাশের রুমটি ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করল। ফ্যান টাঙানো হ’ল। মেইন গেইটের সাথে আমাদের দু’টি কক্ষের বিদ্যুৎ লাইন সংযোগ দেওয়া হ’ল। জিজ্ঞেস করলাম, কেন এই তোড়-জোড়? উত্তর আসলো, জানি না। সুবেদার এসে চেক করে বললেন, পরিষ্কার হয়নি, দেওয়ালগুলি ভেজা কাপড় দিয়ে মুছে দাও। আরেক দফা অভিযান চলল। পুরাতন ছাদে লেগে থাকা কালো দাগগুলি ধুয়ে-মুছে ছাফ করে গোলাপ পানি ছিটিয়ে দেওয়া হ’ল। যেন কোনরূপ গন্ধ না থাকে। ইতিমধ্যে জেলার ছাহেব এসে পরিদর্শন করে গেলেন। সুবেদারের কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি মুচকি হেসে জানার আগ্রহে আরও উত্তাপ ছড়ালেন।
আযীযুল্লাহ আঙ্গিনায় ঘুরছিল। হঠাৎ সে উৎফুল্লচিত্তে হন্তদন্ত হয়ে আমার কাছে এসে বলল, আমীরে জামা‘আত আসছেন। সালাফী ছাহেব তখন বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁকে খুশীর খবর জানালাম। আনন্দে আপ্লুত হয়ে তিনি তিনবার আলহামদুলিল্লাহ বলে দ্রুত বাইরে আসলেন। আমরা তিনজন সেলের আঙ্গিনার গেইটে দাঁড়িয়ে আমীরে জামা‘আতের অপেক্ষা করতে লাগলাম। ইতিমধ্যে সমস্ত জেলখানায় তাঁর আগমনের খবর প্রকাশ হয়ে গেছে। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি ওয়ার্ডগুলির বারান্দায় ও গেইটে কয়েদীরা মেইন গেইটের দিকে আমীরে জামা‘আতকে এক নযর দেখার জন্য উৎসুক নেত্রে তাকিয়ে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সুবেদার দ্রুত এসে রুমটি পুনরায় চেক করে আমাদের খবর দিলেন আমীরে জামা‘আত আসছেন। আমরা নিশ্চিত খবর পেয়ে আনন্দে রাস্তার দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখলাম সুবেদার, জমাদার ও কিছু কয়েদী আমীরে জামা‘আতকে সাথে নিয়ে আমাদের সেলের দিকে আসছেন। আশে পাশে কয়েদীরা সালাম দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছে। আমাদের সেলের প্রবেশ পথে সালাফী ছাহেব দাঁড়িয়েছিলেন। দীর্ঘদিনের সাথী আমীরে জামা‘আতকে কাছে পেয়ে তিনি হারানো মানিক ফিরে পাওয়ার আনন্দে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। প্রায় একমাস অনিশ্চিত এক জগতে নানা শংকার সাগরে হাবুডুবু খেয়ে পথের দিশারী পাঞ্জেরীকে কাছে পেয়ে আনন্দে আমি আর আযীযুল্লাহ বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।... সুবেদার ছাহেব সবাইকে সান্ত্বনা দিয়ে রুমে নিয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। দীর্ঘ দিন পর একসাথে চারজন বসে খেলাম। রিম্যান্ডের স্মৃতিময় দিনগুলির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করলাম। দিনটি যে আমাদের জন্য কত আনন্দের ছিল, সত্যিই তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে আমীরে জামা‘আত একটা থলের মধ্য থেকে পুরানো একটা বেডশীট বের করে আমাকে বললেন, এটা আমার গোপালগঞ্জ কারাগারের সাথীদের উপহার। এটা বিছিয়ে দাও। তারপর থলির মধ্য থেকে চিড়া, বিস্কুটের প্যাকেট ও কেক বের করে বললেন, এগুলিও আমার চার দিনের বন্ধুদের উপহার। এগুলি তোমরা খাও।
উল্লেখ্য যে, আমীরে জামা‘আত ২য় দফা ১০ দিনের জেআইসি রিম্যান্ড শেষে ১৯শে মার্চ’০৫ ঢাকা থেকে গাইবান্ধা কারাগারে এসে পরদিন ২০শে মার্চ বিকেলে গাইবান্ধা থেকে রওয়ানা হয়ে দিবাগত রাত ১২-টা ২০ মিনিটে গোপালগঞ্জ কারাগারে পৌঁছেন। অতঃপর সেখানে চারদিন থাকার পর ২৫শে মার্চ দুপুরে নওগাঁ কারাগারে আসেন।
এদিন ছিল শুক্রবার। আমীরে জামা‘আত আমাদের বললেন, জেল গেইটে নামার সাথে সাথে জেলার ছাহেবের সাথে দেখা। তিনি বললেন, স্যার এসেছেন। থাকবেন তো ১৫ দিন। ইনশাআল্লাহ কোন সমস্যা হবে না। পরক্ষণেই সুপার এলেন। কুশল বিনিময়ের পর বললেন, স্যার থাকবেন তো বেশীর বেশী ২৫ দিন। এখন আপনার নামে পত্রিকায় বড় বড় হেডিং হচ্ছে। কিন্তু যখন বের হবেন, তখন এক কোণে ছোট্ট করে একটু খবর দিবে। আপনার আসার সংবাদ ঢাকা থেকে আমাকে আগেই জানানো হয়েছিল। স্যার ভিতরে যান। রাতে আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করব। বলেই তারা উভয়ে জুম‘আ পড়তে গেলেন।
অতঃপর খাওয়া-দাওয়ার সময় আযীযুল্লাহ বলল, স্যার কালকে ‘ডায়েট’। স্যার বললেন, সেটা কি? আযীযুল্লাহ বলল, স্যার সপ্তাহে একদিন গরুর গোশত বা মাছ বা ডিম দেওয়া হয়। আর একেই বলা হয় ‘ডায়েট’। যা পাওয়ার জন্য সব কয়েদী উন্মুখ হয়ে থাকে। তাছাড়া কালকে ২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবস। তাই উন্নত মানের খাবার দেওয়া হবে।
উল্লেখ্য যে, আযীযুল্লাহ কাজলা ‘হাদীছ ফাউন্ডেশন’ বিল্ডিংয়ে অবস্থানকালে সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত সেই নিকৃষ্ট প্রফেসরের ষড়যন্ত্রে ইতিপূর্বে রাজশাহী কারাগারে ১৭দিন ছিল। ফলে আমাদের সবার চাইতে তার কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল।
বিকালে আমরা ২২শে ফেব্রুয়ারী’০৫ দিবাগত রাত থেকে ২৫শে মার্চ’০৫ দুপুর পর্যন্ত ৩১ দিনের জমানো কাহিনী বর্ণনা শুরু করলাম। তার মধ্যে স্যারের ও আমাদের জেআইসি রিম্যান্ডের কিছু কাহিনী ইতিপূর্বে বলেছি। বাকী স্যারের কিছু কথা এখন বলছি।-
২৩শে ফেব্রুয়ারী’০৫ বুধবার বিকালে রাজশাহী কারাগারে প্রবেশ করার পর ২৬শে ফেব্রুয়ারী বিকালে পৃথক পুলিশ ভ্যানে স্যারকে বগুড়া যেলা কারাগারে নেওয়া হয়। তাঁর সঙ্গে যে পুলিশ এসকর্ট ছিল তাদের মধ্যে একজন ছিলেন গাইবান্ধা সাঘাটার জনৈক আহলেহাদীছ পুলিশ। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেন, স্যার আপনাদের বিরুদ্ধে সবকিছু ষড়যন্ত্রের মূলে হ’ল আমাদের এলাকার কুলাঙ্গার এক প্রফেসর (প্রভাষক)। আপনি আমাদের এলাকায় যেসব উন্নয়নমূলক ও জনহিতকর কাজ করেছেন তার তুলনা নেই। দেশ স্বাধীনের পর থেকে কোন এমপি, মন্ত্রী আপনার কাজের ধারে-কাছেও যেতে পারবে না। কিন্তু ঈর্ষাকাতর ঐ ব্যক্তি, যে আগে ‘জামায়াত’ করত। পরে সেখান থেকে বেরিয়ে আপনার সংগঠনে প্রবেশ করে। তারপর আপনার বিশ্বস্ত হয়ে বড় পদের অধিকারী হয়। আপনি বিশ্বাস করে তাকে দিয়ে আমাদের যেলায় বহু জনসেবামূলক কাজ করিয়েছেন। অথচ সে নিজেই সবকিছুর ক্রেডিট দাবী করে। সে কলেজের সামান্য বেতনের প্রভাষক হয়েও ইয়াতীমের টাকা মেরে বগুড়া শহরে জমি কিনে চার কামরা বিশিষ্ট পাকা বাড়ী করেছে। তার মাধ্যমে আপনি বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, টাঙ্গাইল, নীলফামারী, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট সহ উত্তরবঙ্গের অনেকগুলি যেলায় বহু মসজিদ, মাদরাসা, ইয়াতীমখানা ও ওযূখানা ইত্যাদি জনসেবামূলক কাজ করেছেন। আমাদের শিমুলবাড়ী মাদরাসার দোতলা বিশাল বিল্ডিং করে দিয়েছেন। এছাড়া মাদরাসার জন্য ২৮ বিঘা জমি কিনে দিয়েছেন। এলাকার গরীব রোগীদের ফ্রি চিকিৎসার জন্য নূরা জাহিম হাসপাতাল করে দিয়েছেন। বন্যার সময় হাযার হাযার টাকা ও ত্রাণ সামগ্রী গরীবদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। অনেকের ঘর-বাড়ী করে দিয়েছেন। অথচ সে বলে সবকিছু সে নিজেই করেছে। আমরা তাকে ভালভাবেই চিনি। অবশেষে তার দুর্নীতি আপনার নযরে আসে এবং আপনি তাকে সংগঠন থেকে বের করে দেন। এতে আমরা খুবই খুশী হয়েছি এবং আপনার সততার ব্যাপারে এলাকাবাসী নিশ্চিত হয়ে গেছে। ঐ প্রফেসর (?) এখন সরকারের সঙ্গে লাইন করে আপনাদের জেল খাটাচ্ছে’।
সন্ধ্যা ৭-টার পর স্যার বগুড়া কারাগারে প্রবেশ করেন এবং তাঁকে ১২১ বছরের পুরানা ১০×৬ ফুট জানালা ও ফ্যান বিহীন ফাঁসির সেলের ৫নং কক্ষে একাকী রাখা হয়। যার ফাটা সিমেন্টের মধ্যে পিঁপড়ার সারি। সে সময় শীতের মধ্যে তাঁকে স্রেফ একটি কম্বলের উপরে শুয়ে থাকতে দেখে কারারক্ষী এক পর্যায়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে। আমীরে জামা‘আত কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, স্যার আমার বাড়ী চাঁপাই নবাবগঞ্জের বারোরশিয়ায়। আমাদের গ্রামে আপনি দোতলা মসজিদ করে দিয়েছেন। গত বন্যার সময় ঐ মসজিদের দো’তলায় গ্রামের নারী-শিশুরা আশ্রয় নিয়ে বেঁচে যায়। অথচ আজ আপনার আশ্রয় কারাগারে। এই শীতের মধ্যে আপনার একটি বালিশ-কাঁথাও নেই। মশার কামড়ে আপনি ঘুমাতে পারছেন না। অথচ আমার কিছুই করার নেই’। স্যার তাকে সান্ত্বনা দেন। তিন ঘণ্টা ডিউটি শেষে যাওয়ার সময় রক্ষীটি বলে যান, আমার ভাই প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পি.এস। আমি তাকে বলব, যেন তিনি দ্রুত আপনাকে মুক্ত করে দেন’। এরপর আর কোনদিন তার সাথে দেখা হয়নি। তবে তার কান্নার শব্দ যেন এখনও শুনতে পাচ্ছি।
পরদিন ২৭/০২/০৫ সকালে স্যারকে গাবতলীতে বোমা বিস্ফোরণ ও লক্ষ্মীকোলায় হত্যা মামলায় ১০ দিনের জেআইসি রিম্যান্ডে ঢাকায় নেওয়া হয়। এটাই ছিল স্যারের ১ম রিম্যান্ড। সেখানে আমাদের সঙ্গে অদৃশ্য সাক্ষাতের বিবরণ গত সংখ্যায় বিবৃত হয়েছে। অতঃপর জেআইসি রিম্যান্ড শেষে স্যারকে ঢাকা থেকে পুনরায় বগুড়া কারাগারে আনা হয়।
সেখান থেকে পরদিন ০৯/০৩/০৫ তারিখে বগুড়া যেলা আদালতে হাযিরা দিয়ে বিকালে গাইবান্ধা (পুরাতন) কারাগারে নেওয়া হয়। বিকেল ৫-টায় লকআপ-এর পর রাত সাড়ে ৭-টায় পৌঁছানোর কারণে স্যারকে সাধারণ একটি কারাকক্ষে রাখা হয়। যেখানে ধারণ ক্ষমতার প্রায় দ্বিগুণ কয়েদী ছিল। ফলে স্যারকে সারা রাত দাঁড়িয়ে কাটাতে হয়। অন্য কয়েদীরা কেউ চিৎ হয়ে, কেউ কাত হয়ে ঠাসাঠাসি করে কোন মতে শুয়ে ছিল। জেলখানার ভাষায় কাত হয়ে শুলে তাকে ‘রুই ফাইল’ চিৎ হয়ে শুলে তাকে ‘কাতলা ফাইল’ বলা হয়। ম্যাটদের চাহিদা মত টাকা দিতে না পারলে সেই হতভাগাদের সারারাত চার ঘণ্টা করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচন্ড মশার কামড়। কয়েদীদের কেউ কেউ নিজেরা দাঁড়িয়ে স্যারকে শোওয়ার কথা বললেও স্যার তাদের কষ্ট দিতে চাননি। তিনি ইশারায় রুকু-সিজদার মাধ্যমে সারা রাত ছালাতে ও তাসবীহ তেলাওয়াতে অতিবাহিত করেন। ফজরের আযানের পর কয়েদীরা উঠলে তিনি তাদেরকে সংক্ষিপ্ত দরসের মাধ্যমে ছবর ও ছালাতের উপদেশ দেন।
এ সময় তিনি তাদের কারু কারু জীবনের করুণ কাহিনী শুনে অভিভূত হন। যেমন একজন যুবক তার চারদিনের সন্তান ফেলে গ্রাম্য কোন্দলে মিথ্যা মামলায় জেলে ঢুকেছে। গত পাঁচ বছরেও কোন বিচার হয়নি। স্ত্রীর বাপেরা সন্তান সহ তাদের মেয়েকে ফিরিয়ে নিতে চায়। এখন যুবকটি দিন-রাত কেঁদে বুক ভাসায়। হতদরিদ্র এই যুবকটির দেখার কেউ নেই। এমনিতর মিথ্যা মামলার ঘটনা প্রায় সবারই।
পরদিন সকালে স্যারকে টিনশেড কারা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে তিনি একজন কয়েদীকে পান। সাড়ে চার বছর অপেক্ষা করেও মামলার কোন অগ্রগতি না হওয়ায় তিন সন্তান ফেলে যার স্ত্রী সংসার ছেড়ে চলে গেছে। আরেকজন দল নিরপেক্ষ বি.এ পাশ ছেলে সরকারী দল করতে রাযী না হওয়ায় দলীয় ক্যাডারদের ইঙ্গিতে গভীর রাতে পুলিশ গিয়ে তাকে থানায় ধরে আনে। অতঃপর পিটিয়ে হাড়-হাড্ডি ভেঙ্গে জাল টাকার মিথ্যা মামলা দিয়ে কারাগারে পাঠায়। অথচ তার মা লোকদের কাছে চেয়ে-চিন্তে খায়। তদবীর না হওয়ায় গোবিন্দগঞ্জের এই শিক্ষিত ছেলেটি আড়াই বছরের অধিক কারাগারে পড়ে আছে ডান্ডাবেড়ী পরা অবস্থায়।
এই সময় জমাদার ছাহেব এসে লম্বা সালাম দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন, স্যার! আপনি জেলে আসায় আমরা ব্যথিত হ’লেও এখন খুব আনন্দিত। কেননা দেশী-বিদেশী সকল টিভি চ্যানেলে আপনাকে দেখানো হচ্ছে। সেই সাথে ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’ নামটা প্রচার হচ্ছে। এতে আমাদের সাহস বেড়েছে। আমি এখন মসজিদে গিয়ে প্রকাশ্যে বুকে হাত বেঁধে, রাফউল ইয়াদায়েন করে ও জোরে আমীন বলে ছালাত আদায় করি। কিন্তু এ যাবত সাহস হয়নি। বগুড়াবাসী এই জমাদারের মন্তব্য শুনে আমি হেসে ফেললাম।
পরদিন ১০/০৩/০৫ তারিখ সকালে স্যারকে পলাশবাড়ী থানার তোকিয়ার বাজার গানের প্যান্ডেলে বোমা হামলা এবং মহিমাগঞ্জ ব্র্যাক অফিসে ডাকাতির মামলায় গাইবান্ধা যেলা আদালতে হাযির করা হয়। আদালত প্রাঙ্গণে হাযার হাযার মানুষের সমাগম হয়। এদিন স্যারের হাতে বার হাত লম্বা দড়ি বাঁধা অবস্থায় খালি মাথায় হাঁটতে থাকা দৃশ্য টেলিভিশনে দেখে বহু মানুষ কেঁদে বুক ভাসায় বলে পরবর্তীতে জানা যায়। কড়া নিরাপত্তায় ঠাসা আদালত কক্ষের মধ্যে স্যারের ২য় পুত্র ছোট্ট নাজীব সবাইকে ঠেলে কাঠগড়ায় দাঁড়ানো স্যারের কাছে গিয়ে জোরালো কণ্ঠে বলে ওঠে, আববা আপনার মাথায় টুপী নেই কেন?’ বিচারক ও উকিল সহ সকলের দৃষ্টি তখন বাপ-বেটার দিকে। স্যার ঝাঁঝালো কণ্ঠে জবাব দিলেন, যে দেশে টুপির মর্যাদা নেই সে দেশে টুপী মাথায় দিয়ে কি লাভ!
স্যারের ঐদিন জ্বর ও লুজ মোশন ছিল। তাই সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে বললেন, আমি অসুস্থ। আমার একদিন বিশ্রাম প্রয়োজন। ম্যাজিস্ট্রেট সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে আদেশ লিখলেন। পরে আদালত কক্ষ থেকে বেরিয়ে কারাগারে গেলেন। অতঃপর আধা ঘণ্টার মধ্যেই জেলার খবর দিলেন, প্রস্ত্তত হওয়ার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই জমাদার ও কারারক্ষীরা তাঁকে নিয়ে গেইটে এলেন। তখনও তিনি জানতেন না কোথায় তাঁকে নেওয়া হবে।
কারা ফটকে এসে নাজীবকে দেখে তিনি বিস্মিত হ’লেন। নাজীব স্যারকে এক সেট জামা-পায়জামা ও লুঙ্গি-গামছা দিল। ওখানে দাঁড়িয়েই স্যার পরনের লুঙ্গি ও জামা খুলে পাল্টে নিলেন। ২২শে ফেব্রুয়ারী থেকে গত ১৭দিন যাবৎ যা তিনি একটানা পরিহিত ছিলেন। জীবনে কখনই যা তাঁর অভ্যাস নয়। হঠাৎ নাজীবের চোখ স্যারের পায়ের দিকে পড়ে। ওদিকে জেলারের তাড়া। নাজীব মাথা ঝুঁকিয়ে লোহার শিকের দরজার ফাঁক গলিয়ে পায়ে হাত দিয়ে বলে, আববা শীঘ্র স্যান্ডেল খুলুন। বলেই সে নিজের পায়ের ৮০ টাকা দামের বার্মিজ স্যান্ডেল খুলে দিল এবং স্যারের পা থেকে অনুরূপ মূল্যের ছেঁড়া বার্মিজ স্যান্ডেলটি খুলে নিল। এরপর পুলিশ ভ্যান স্যারকে নিয়ে চলে গেল।
দুপুরে গোবিন্দগঞ্জ থানায় এসে স্যার টয়লেটে গেলেন। কিন্তু সেখানেও তাঁর হাতের দড়ি বাহির থেকে পুলিশে ধরে রইল। অতঃপর বেরিয়ে এসে তিনি যোহর-আছরের ছালাত আদায় করেন ও থানায় খাওয়া-দাওয়া করেন। থানার ওসির কথায় স্যার সেদিন মনে কষ্ট পান। তবে বিদায়ের সময় তিনি ভালো ব্যবহার করেন। রাস্তায় এসে আরেকবার টয়লেটে যেতে হয়। কিন্তু ঔষধ খাওয়ার কোন ব্যবস্থা হয়নি। এই অবস্থায় রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানায় পৌঁছানো হয়। এসকর্ট পুলিশ অফিসারটি রাস্তায় বললেন যে, তিনি আগে থেকেই স্যারকে চিনেন। যখন স্যারের বিরুদ্ধে ২০০২ সালে বহিষ্কৃত প্রফেসরটি বগুড়ায় তাঁর বিরুদ্ধে ঘর পোড়ানোর মিথ্যা মামলা দায়ের করে। তিনি ছিলেন ঐ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। তিনি ঐ ব্যক্তিকে একজন শঠ, ধূর্ত ও মতলববাজ বলে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন। উক্ত মামলায় স্যার বেকসুর খালাস পান।
ক্যান্টনমেন্ট থানার হাজত কক্ষে ময়লা-আবর্জনা পূর্ণ মেঝের উপর অসুস্থ অবস্থায় স্যার শুয়ে পড়েন। হাতের পোটলা থেকে গামছাটা বের করে নিয়ে তার উপর শুতে চাইলেও পুলিশ দেয়নি। তাদের নাকি আইনে নিষেধ আছে। কেননা অনেকে নাকি গামছা গলায় পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। হাজত কক্ষের এক কোণায় পড়ে থাকা একটি ছেঁড়া খাকি কাপড়ের টুকরা পাওয়া যায়। সেটা কুড়িয়ে এনে তিনি মুষ্টি করে মাথার বালিশ বানান। এভাবেই তাঁকে রাত কাটাতে হয় দুর্গন্ধ ও মশার কামড়ের মধ্যে। কক্ষের মধ্যেই খোলা টয়লেট। পরদিন সকাল ৯-টায় তাঁকে বের করে গুলশানে একটি নির্ধারিত ভবনে রিম্যান্ডের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। বস্ত্ততঃ এটা ছিল স্যারের ২য় জেআইসি রিম্যান্ড।
সেখানে সারাদিন রেখে সন্ধ্যায় হাজতে নেওয়া হয়। দ্বিতীয় দিন অবশ্য একটি ছেঁড়া কাঁথা ও কভারবিহীন ময়লা বালিশ তাঁকে এনে দেওয়া হয়। পরদিন রিম্যান্ড থেকে এসে দেখেন ঐ ছেঁড়া কাঁথার উপরেই বিড়ালের নরম পায়খানা ভরা। একজন পুলিশ ভদ্রতা দেখিয়ে সেটি ফেলে দেয় ও কাঁথাটি ধুয়ে দেয়। আরেকজন পুলিশ দয়াপরবশে রাতে একটা কয়েল ধরিয়ে দিয়ে যায়। ঐ ছেঁড়া কাঁথা ও ছেঁড়া বালিশে শুয়ে স্যারের মনের মধ্যে আপনা থেকেই উদয় হয়, যদি কখনো দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রীর এই অবস্থা হয়, তখন তিনি বুঝবেন হাজতীদের বেদনা। হ্যাঁ। সেদিনের প্রধানমন্ত্রী পরে নিজেকে ও নিজের দুই ছেলেকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করেছেন।
মাথার উপরে ১০০ পাওয়ারের বাল্ব। এরই মধ্যে রাত ৩-টার দিকে স্যার উঠেছেন তাহাজ্জুদ পড়ার জন্য। তাহাজ্জুদ শেষ হওয়ার পর হাজতরক্ষী পুলিশ লোহার শিকের খোলা দরজার মুখে এসে দাঁড়িয়ে কাঁদ কাঁদ স্বরে বলল, স্যার রাত ১০-টার দিকে আমার মাকে মোবাইলে আপনার কথা জানাই। তিনি এখন বাড়ীতে তাহাজ্জুদ পড়ছেন। কিছু আগে আমাকে ফোন করে বললেন, আমি যার ‘ছালাতুর রাসূল’ পড়ে তাহাজ্জুদ শিখেছি, তুমি আজ তাঁর রক্ষী। এই ‘ছালাতুর রাসূল’ বুকে নিয়েই তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি আমার আমীরে জামা‘আতের যেন কোন কষ্ট না হয়’। বলেই যুবক পুলিশটি হু হু করে কাঁদতে লাগল...। বগুড়ার ঐ তরুণ পুলিশ সদস্যটির অশ্রুভেজা চোখের স্মৃতি আজও ভুলতে পারি না।
তার দু’দিন পরে জনৈক নতুন রক্ষী গভীর রাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাতর কণ্ঠে বলল, স্যার বাসায় খবর দিব কি? ফোন নম্বরটা বলবেন কি? স্যার বললেন, তুমি কে? তিনি পরিচয় দিয়ে বললেন, আমার নাম এই। আপনার শ্বশুর বাড়ীর গ্রামে আমার বাড়ী। স্যার তাকে ধন্যবাদ দিলেন।
পরের দিন রিম্যান্ডে এসে স্যার দায়িত্বশীল এসকর্ট অফিসারের মাধ্যমে দরখাস্ত করে ক্ষৌরকর্মের জন্য আয়না-ব্লেড ও বাড়ীতে ফোন করার জন্য অনুমতি চাইলেন। কিন্তু অনুমতি মেলেনি। এভাবে ১০দিন কাটিয়ে স্যারকে পুনরায় গাইবান্ধা কারাগারে ১৯/০৩/০৫ তারিখে ফিরিয়ে আনা হয়।
গোপালগঞ্জ কারাগারে :
পরদিন ২০/০৩/০৫ তারিখে গাইবান্ধা আদালতে হাযির করে গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়ায় ব্যাংক ডাকাতি মামলায় হাযিরা দেওয়ার জন্য বিকাল ৩-টা ২০ মিনিটে গাইবান্ধা থেকে রওয়ানা করা হয়। আত-তাহরীকের সার্কুলেশন ম্যানেজার গাইবান্ধার আবুল কালাম এ সময় দ্রুত একটা পলিথিনের প্যাকেট দিল। যাতে পাউরুটি, বিস্কুট ও একটি ছোট তোয়ালে ছিল। যা পরে খুবই উপকারী প্রমাণিত হ’ল। গত ২০/১০/১১ ইং তারিখে আবুল কালাম আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছে। আল্লাহ তাকে জান্নাত নছীব করুন-আমীন!
রাস্তায় সন্ধ্যার পরে ঘন অন্ধকারের মধ্যে ঝিনাইদহ-মাগুরার মধ্যবর্তী ফাঁকা ময়দানে পুলিশের গাড়ী হঠাৎ থেমে যায়। স্যার বললেন, আমার মনে তখন ভয় উপস্থিত হয়। হয়তোবা এখন ক্রসফায়ারে হত্যা করবে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলেন যে, ওরা পেশাব করার জন্য থেমেছে। তখন স্যার গাড়ী থেকে নেমে মাটি দিয়ে তায়াম্মুম করে ঘাসের উপর মাগরিব ও এশার ছালাত জমা ও ক্বছর করে নেন। অতঃপর রাস্তা ভুল করে ফরিদপুর হয়ে রাত ১২-টা ২০ মিনিটে স্যারকে নিয়ে পুলিশের গাড়ী গোপালগঞ্জ কারাগারে পৌঁছে। ডেপুটি জেলার অত্যন্ত ভদ্র যুবক। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানিয়ে বললেন, এত রাতে আপনার জন্য কি খাওয়ার ব্যবস্থা করব, তাই ভাবছি। তখন স্যার বললেন, গাইবান্ধা থেকে পুলিশ ভ্যানে উঠার সময় আমাদের এক কর্মী পাউরুটি ও কলা দিয়েছিল। ওটাতেই চলবে’। ইতিমধ্যে লকআপের সময় হয়ে গেল। সুবেদার গোলাম হোসেন এসে আমীরে জামা‘আতের জন্য পরিষ্কার করা পাশের কক্ষটি দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু আমীরে জামা‘আত বললেন, আমি আমার সাথীদের সাথেই থাকতে চাই। ফলে সুবেদার চলে গেলেন। আমরা একসাথেই রাত্রি যাপন করলাম। তারপর স্যারের নিকট আমরা গোপালগঞ্জ কারাগারে তাঁর অভিজ্ঞতা শুনতে চাইলাম। যদিও স্যারের ১১দিন পূর্বেই ১৪/০৩/০৫ তারিখে আমরা ঐ কারাগার থেকে নওগাঁ কারাগারে এসেছি।
স্যার বললেন, রাতেই আমাকে একটা টিনশেড সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়া হ’ল। যেখানে আমাকে দিয়ে ৫০জন হ’ল। ওয়ার্ডের সাথীরা ডেপুটি জেলার ও জমাদারের কাছে পরিচয় পেয়ে যথেষ্ট সমাদর করল। তারা বলল, স্যার আপনার সাথীরা এখানে এসেছিলেন। সবাই ভালো মানুষ। তবে কেইস পার্টনার তরুণ ছেলেটি খুবই কান্নাকাটি করত। বললাম, তরুণ ছেলে হিসাবে এটাতো হ’তেই পারে। বড় টিনশেড ওয়ার্ডের মধ্যে মাত্র দু’টি ফ্যান। ঘরের এক কোণায় আমাকে জায়গা করে দিল। হাজতীদের দেওয়া চাদরে ও বালিশে শোয়ার ব্যবস্থা হ’ল। মশার অত্যাচার থেকে বাঁচার জন্য ওদের একজন তার এ্যারোসলটি আমাকে দিল। অন্যদিকে ডেপুটি জেলারও একটি পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু মশা এসবের তোয়াক্কা করে না।
সকালে উঠে ফজরের জামা‘আত করলাম। মুছল্লী পেলাম পাঁচ জনের মত। সালাম ফিরে বসে সবাইকে উঠিয়ে কুরআনের দরস দিলাম। এরপর থেকে দু’জন হিন্দু বাদে সবাই প্রতি ওয়াক্তে আমার সাথে জামা‘আতে ছালাত আদায় করেছে। সন্ধ্যায় দেখি টিনের চালের উপরে ধমধম করে শব্দ হচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানলাম, এখন নাকি সবাইকে ‘ধ্যান’ করতে হবে। জমাদারকে ডেকে বললাম, এটা কেন করছেন? তিনি বললেন, বৃটিশ আমল থেকেই এ নিয়ম চলে আসছে। বললাম, এ নিয়ম বাতিল করতে হবে। এখন থেকে এখানে পাঁচ ওয়াক্ত ছালাতে আযান হবে। অতঃপর যার যার ওয়ার্ডে ছালাতের জামা‘আত হবে। উনি খুশী হ’লেন এবং সেটাই কার্যকর হ’ল।
পরদিন সকালে আমাকে আদালতে নেওয়া হবে। কিন্তু দুপুর গড়িয়ে গেলেও নেওয়া হ’ল না। বিকালে জেলার ও জমাদার এসে বললেন, স্যার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই আপনাকে আদালতে নেওয়া হয়নি। গোয়েন্দা পুলিশের রিপোর্ট হ’ল এই যে, আপনাকে দেখার জন্য গোপালগঞ্জ শহরে এত লোক সমাগম হয়েছে যে, কোন হোটেলেই সীট খালি নেই। এছাড়াও রাস্তা-ঘাটে প্রচুর মানুষ। সবার মুখে একই কথা গালিব স্যার কখন আসবেন। যেলার একটি প্রসিদ্ধ মাদরাসার ছাত্র ও শিক্ষকরা বাস রিজার্ভ করে এসেছে। তারা বলাবলি করছে, আজকে আমাদের যেলায় আল্লাহর একজন বিখ্যাত অলী আসবেন। তাই মাদরাসা ছুটি দেওয়া হয়েছে’। সব দিক বিবেচনা করে প্রশাসন আপনাকে বের করেনি।
স্যার ভেবেছিলেন গোপালগঞ্জ শহরের মিঞাপাড়ায় আহলেহাদীছদের জন্য তিনি যে জামে মসজিদটি করে দিয়েছেন, যেখানে তিনি নিজে সফর করেছেন, সেই মসজিদের কমিটিতে দু’জন সিনিয়র এ্যাডভোকেট আছেন। তারা অন্তত এই মামলায় স্বেচ্ছায় তাঁর উকিল হবেন এবং জেলখানায় দেখতে আসবেন। কিন্তু চারদিনের মধ্যে কেউ আসেননি। একইভাবে গাইবান্ধা জেলখানার পাশেই গাইবান্ধা যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতির বাড়ী। তার ভাতিজার দোকান গাইবান্ধা জেলখানার গেইটের সামনেই। কিন্তু তাদের কেউ কখনও আমীরে জামা‘আতকে জেলখানায় দেখতে আসেননি। অথচ পলাশবাড়ী থেকে ২২ কি. মি. পায়ে হেঁটে এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা সমূহ থেকে শত শত নারী-পুরুষ গাইবান্ধা আদালতে গিয়েছিল আমীরে জামা‘আতকে এক নযর দেখার জন্য। এটাই হ’ল মানুষের চরিত্র।
গোপালগঞ্জ কারাগারে চারদিনের দাওয়াতে ছয় জন প্রকাশ্যভাবে ‘আহলেহাদীছ’ হন। বাকী প্রায় সবাই ছিলেন ভক্ত। কারাগারের চৌকাটি ছিল শেখ মুজিবের বৈঠকখানা। তাঁর বাপ নাকি বলতেন, ছেলে যখন সব সময় জেলেই থাকে, তখন ওর বৈঠকখানাটা জেলখানাকেই দান করে দাও’। পরে নাকি সেটাই করা হয়। কারাগারের ভাষায় ‘চৌকা’ অর্থ রান্নাঘর।
আমি যখন ঢাকা কারাগারে, তখন আমাকে দেখার জন্য ঢাকা ও নরসিংদী যেলা সংগঠনের কয়েকজন আসেন। কিন্তু নিয়ম জানা না থাকায় তারা বেশ সমস্যায় পড়েন। তখন জনৈক কারারক্ষী পুলিশ তাদেরকে জিজ্ঞেস করলে তারা আমার কথা বলেন। তখন তিনি ভক্তির সাথে সব ব্যবস্থা করে দেন। সে সময় তিনি গোপালগঞ্জ কারাগারে আমার ব্যাপারে তার স্মৃতি চারণ করে ভূয়সী প্রশংসা করেন। গোপালগঞ্জের মামলা শেষ হ’লে তার ফাইনাল রিপোর্টের কপি আনতে কর্মীরা ব্যর্থ হ’লে গোপালগঞ্জ কারাগারের ডেপুটি স্বেচ্ছায় ও নিজ চেষ্টায় আদালত থেকে কপি এনে বগুড়া কারাগারে পাঠিয়ে দেন। এসবই আমাদের প্রতি তাদের ভালবাসা ও ভক্তির বহিঃপ্রকাশ মাত্র।
গোপালগঞ্জ কারাগারে থাকা অবস্থায় একদিন জমাদার এসে বললেন, স্যার মাতালদের কান্ড দেখুন। ওরা একটা আস্ত টিকটিকি ধরে খেয়ে ফেলেছে। বললাম, কেন? উনি বললেন, টিকটিকির লেজে মাদকতা আছে। ওটা পুড়িয়ে খেলে মাদকতা আরও বাড়ে। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে খাওয়ার উপায় নেই। তাই ধরে আস্ত খেয়ে ফেলেছে। এটি অন্য ওয়ার্ডের ঘটনা। এতে আমি শিক্ষা পেলাম এই যে, হাদীছে এক আঘাতে টিকটিকি মারলে ১০০ নেকী ও দুই আঘাতে মারলে ৫০ নেকীর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কেন বলা হয়েছে তা এখন বুঝলাম। অতএব হাদীছ মানার মধ্যেই বরকত রয়েছে। যুক্তি তালাশ করার মধ্যে নয়।
দ্বিতীয় দিন ২২/০৩/০৫ বিকালে ডিসি-এসপি ও বিএনপি নেতা সহ কয়েকজন আমাকে দেখতে এলেন। কারাগারের নিয়ম হ’ল এ সময় সবাইকে বিছানা গুটিয়ে মামলার টিকেটটা হাতে নিয়ে লাইন দিয়ে উপুড়হাঁটুতে বসে থাকতে হয়। এটা আমার মেযাজের খেলাফ। আমি আমার বিছানায় বসে থাকলাম। ডিসি ছাহেব সরাসরি এসে আমাকে সালাম দিলেন। তখন আমি দাঁড়িয়ে মুছাফাহা করে তাঁকে কিছু কথা বললাম। যার মধ্যে ছিল, (১) অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পূর্বে কোন ব্যক্তিকে অপরাধী হিসাবে গণ্য করা ও কারা নির্যাতন ভোগ করানো কি যুলুম নয়? (২) কারা কক্ষের মধ্যে ডান্ডাবেড়ী পরিয়ে স্বাধীন মানুষের প্রতি ক্রীতদাস সূলভ আচরণ করা কি অন্যায় নয়? (৩) নিরপরাধ মানুষকে স্রেফ সন্দেহ বশে থানায় নিয়ে মারপিট করা ও ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি আদায় করা কি মানুষের মৌলিক মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? (৪) মযলূমের দো‘আয় আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে। আমি আপনার মাধ্যমে মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, তিনি যেন আমাদের মত হাজতের নামে কারা নির্যাতন ভোগকারী অগণিত নিরপরাধ মানুষকে সত্বর মুক্তি দানের ব্যবস্থা করেন এবং মেয়াদবিহীন হাজতী প্রথা বাতিলের মাধ্যমে আল্লাহর রহমতের ভাগীদার হন। জবাবে তাঁরা কোন কথা বলেননি। কিন্তু তাদের যাওয়ার পর উপস্থিত সাথীদের মধ্যে আনন্দের যে উচ্ছ্বাস সেদিন দেখেছিলাম, তা কখনই ভুলবার নয়। তারা বলল, আমাদের দীর্ঘ কারাজীবনে আজই প্রথম প্রশাসনের সামনে এরূপ হক কথা বলতে শুনলাম’। আমি মনে করি, সেদিন আসবেই, যেদিন মযলূম বিজয়ী হবে। যালেম পরাজিত হবে। কারা কর্তৃপক্ষ কৃতজ্ঞচিত্তে সেদিন আমাকে যে প্রাণভরা অভিনন্দন জানিয়ে ছিলেন, তা সর্বদা মনে থাকবে। বলা চলে যে, যালেমের বিরুদ্ধে তাদের অধীনস্তদেরও আক্রোশ ধূমায়িত থাকে। যা সুযোগ মত বেরিয়ে আসে। রাতের বেলায় জেলার ও ডেপুটি জেলার এসে বললেন, স্যার যাওয়ার বেলায় ডিসি ছাহেব মন্তব্য করলেন, এইসব পন্ডিত মানুষকে সরকার কেন যে জেলখানায় আনল বুঝতে পারি না। বললেন, আপনারা উনাকে সাধ্যমত যত্ন করবেন’।
উল্লেখ্য যে, আমাদের ওয়ার্ডে ঐ সময় রাজশাহীর একটা হালকা-পাতলা ছেলে ছিল। যার দু’পায়ে ডান্ডাবেড়ী পরানো ছিল। যা তার পায়ে দিন-রাত সর্বদা থাকত। আমার জীবনে এই প্রথম ডান্ডাবেড়ী দেখলাম। অথচ সেই-ই ছিল ওয়ার্ডের মধ্যে সবচেয়ে নিরীহ ও পরহেযগার ছেলে। আরেকটি যুবক ছিল যাকে থানায় মেরে হাত-পা ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছিল। অনেক দিন হাসপাতালে থেকে কয়েকদিন আগে কারাগারে আনা হয়েছে। পাশের ওয়ার্ডে মোল্লাহাটের একটা আহলেহাদীছ তরুণ ছিল। যাকে রাতের বেলা ক্রসফায়ার দিতে নিয়ে গিয়েছিল। পরে চাহিদা মত টাকার আশ্বাস পেয়ে থানায় ফিরিয়ে আনা হয়।
(ক্রমশঃ)