গত তিন বছর যাবৎ ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে আমীরে জামা‘আত প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিবের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় শিক্ষা সফর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। কিন্তু কোনটিতেই আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়নি। এবারে চতুর্থবারে আমি অংশ নিয়েছিলাম।

ঐতিহাসিক এ সফরে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে আমরা ১৫ই মার্চ বৃহস্পতিবার রাতে ট্রেনযোগে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। পরদিন দুপুরে আমরা চট্টগ্রাম পৌঁছি। তারপর চট্টগ্রাম মহানগরীর উত্তর পতেঙ্গা স্টীল মিল গেটের বিপরীতে মুন বেকারীর গলিতে অবস্থিত বায়তুর রহমান আহলেহাদীছ জামে মসজিদে গিয়ে উপস্থিত হই। ইতিমধ্যে দেশের ২২টি যেলা থেকে ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর মোট ৯৭ জন কর্মী ও সুধী সেখানে একত্রিত হন। যেলাগুলি হ’ল- রাজশাহী-সদর, রাজশাহী-পশ্চিম, নাটোর, চাঁপাই নবাবগঞ্জ-উত্তর, পাবনা, দিনাজপুর-পূর্ব, কুষ্টিয়া-পূর্ব, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, খুলনা, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাযীপুর, ময়মনসিংহ-উত্তর, জামালপুর-দক্ষিণ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রংপুর, কুমিললা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও রাঙ্গামাটি। জুম‘আর ছালাতের পর মসজিদের নীচতলায় চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর ব্যবস্থাপনায় সফরে আগত মেহমানদের আতিথেয়তা প্রদান করা হয়।

পরদিন ১৭ই মার্চ শনিবার সকাল ৭-টায় আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ একটি হাইএস মাইক্রোতে এবং আমরা দু’টি বড় বাস যোগে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হই। অতঃপর সকাল ১০-টায় চট্টগ্রাম থেকে ৫৬ কি.মি. উত্তর-পূর্বে রাঙ্গামাটি যেলার কাপ্তাই উপযেলাধীন কাপ্তাই জেটি ঘাটে পৌঁছে পূর্ব ব্যবস্থাপনামতে সবাই এম.এল সুমি লঞ্চে নিজ নিজ আসন গ্রহণ করি। অতঃপর সাড়ে ১০-টায় লঞ্চটি কাপ্তাই হরদ অভিমুখে রওয়ানা হয়। লঞ্চে আমরা সবাই সকালের নাশতা ভুনাখিঁচুড়ি গ্রহণ করি।

আমীরে জামা‘আত এই সফরের ‘আমীর’ হিসাবে চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী শেখ সা‘দীর নাম ঘোষণা করেন এবং সবাইকে তার নির্দেশনা মতে চলতে বলেন।

কাপ্তাই লেক ও কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র :

ইংরেজী H বর্ণাকৃতির দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম কাপ্তাই লেক-এর আয়তন ২৫০০ বর্গকিলোমিটার। কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার কর্ণফুলী নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করলে কাপ্তাই লেক বা হরদের সৃষ্টি হয়। ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এই বাঁধের পাশে ১৬টি পানিকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্প্রিলওয়ে রয়েছে। এ স্প্রিলওয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাযার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে। কাপ্তাই হরদের কারণে ৫৪ হাযার একর কৃষি জমি ডুবে যায়, যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ। প্রায় ১৮ হাযার পরিবারের মোট ১ লাখ মানুষ বাস্ত্তচ্যুত হয়। যারা পরে রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে বসতি স্থাপন করে। বর্তমানে এ বাঁধে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে। যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। এটি স্বল্প খরচে দেশের একমাত্র পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। এটি সেনাবাহিনী কর্তৃক পরিচালিত ও কড়া নিরাপত্তার চাদরে আচ্ছাদিত। বিনা অনুমতিতে এখানে প্রবেশ নিষেধ।

প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর নৈসর্গিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি রাঙ্গামাটির অনিন্দ্যসুন্দর কাপ্তাই লেকের বুক চিরে স্বচ্ছ পানিরাশি ভেদ করে এগিয়ে চলেছে আমাদের লঞ্চটি। বামদিকে লেক ভিউ আইল্যান্ড দেখা গেল। সেখান থেকে সামান্য এগিয়ে ডাইনে নযরে পড়ল বহু আকাংখিত কাপ্তাই ড্যাম বা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আমরা তা কাছাকাছি দূর থেকে দর্শন করে তৃপ্ত হই। সরাসরি সেখানে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্র দেখার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু সফরসঙ্গীর সংখ্যা বেশী হওয়ায় সেখান থেকে অনুমতি পাওয়া যায়নি। ফলে সরেযমীনে কাপ্তাই পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্র না দেখতে না পারার অতৃপ্তি রয়ে গেল।

কুইজ ও জাগরণী :

সুবিশাল কাপ্তাই হরদের স্বচ্ছ পানি। মাঝে-মধ্যে ভেসে ওঠা ছোট ছোট পাহাড়ী দ্বীপ। এরি মধ্যে শুরু হয় আত-তাহরীক সম্পাদক ড. মুহাম্মাদ সাখাওয়াত হোসাইনের কুইজ পাঠ। রাঙ্গামাটি ও কাপ্তাই লেকের ইতিহাস ও ‘আন্দোলন’-এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলী সমৃদ্ধ উক্ত কুইজ সবাইকে চমৎকৃত করে। এর পরে শুরু হয় মাওলানা আমানুল্লাহ বিন ইসমাঈল-এর নেতৃত্বে মাইকে সমস্বরে আল-হেরার মনোহারিণী জাগরণী- ‘আহলেহাদীছ আন্দোলনের কভু মরণ নাই। সকল কিছুর পতন হ’লেও হকের পতন নাই’। এই সঙ্গে যোগ দেন ঢাকার মাওলানা সাইফুল ইসলাম বিন হাবীব, পাবনার মাওলানা বেলালুদ্দীন, সিরাজগঞ্জের আব্দুল মতীন ও আবুবকর ভাই, আত-তাহরীকের পরপর দু’বছরের সেরা এজেন্ট বগুড়ার প্রবীণ কর্মী আনীসুর রহমান সহ আরও অনেকে। এটি ছিল জাগরণী বলার এক মনমাতানো অনুষ্ঠান। এরি মধ্যে চলে আসে প্রত্যেকের জন্য পাহাড়ী কলা ও হাফ আনারসের কাটা পিস সমূহ। এভাবে এটি ছিল পানির বুকে এক প্রাণবন্ত সফর।

জীবতলী লেকশোর পিকনিক স্পট :

কাপ্তাইয়ের জীবতলী সেনানিবাসে লেকশোর পিকনিক স্পট অবস্থিত। কাপ্তাই লেকের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার জন্য এটি প্রসিদ্ধ। পিকনিক স্পটটির পাশে রয়েছে অসংখ্য গাছপালা সমৃদ্ধ পাহাড়ের শ্রেণী। এর পাশেই রয়েছে উঁচু পাহাড়ের উপর সেনাবাহিনীর হেলিপ্যাড। পাশাপাশি পাহাড় ও লেকের নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য হৃদয় ছুঁয়ে যায়। রাঙ্গামাটি শহর থেকে সড়ক পথে এটির দূরত্ব ১৯ কিঃমিঃ।

আমরা সোয়া ১১-টার দিকে সেনাবাহিনীর ৫ আর ই ব্যাটালিয়ন কর্তৃক পরিচালিত লেকশোর পিকনিক স্পটে গিয়ে পৌঁছলাম। এখানে নির্ধারিত ৩০ মিনিটের যাত্রা বিরতি দেয়া হ’ল। সবাই ছুটে চলল স্পটের বিভিন্ন স্থান দেখার জন্য। পাহাড়ে অবস্থিত ক্যাফেতে অনেকে চা-কফি পান করলেন ও পাহাড়ী ডাবের মিষ্ট পানি পান করে রসনা তৃপ্ত করলেন।

রাঙ্গামাটি ঝুলন্ত ব্রীজ :

এরপর আমাদের গন্তব্য রাঙ্গামাটি শহরের উপকণ্ঠে ঝুলন্ত ব্রীজ। কাপ্তাই হরদের উপর ৩৩৫ ফুট  দীর্ঘ ও ৮ ফুট প্রস্থ এ ব্রীজটি ১৯৮৬ সালে নির্মিত হয়। উভয় পাশে টানা মোটা তারের মাধ্যমে ঝুলন্ত এ ব্রীজটি কাপ্তাই লেকের দু’পাশে দুই পাহাড়কে একত্রিত করেছে। ঝুলন্ত সেতুতে দাঁড়ালেই দৃশ্যমান হয় লেকের অবারিত পানিরাশি ও দূরের উঁচু-নীচু পাহাড়ের আকাশছোঁয়া বৃক্ষরাজি। লেকের মাঝামাঝিতে গেলে ব্রীজটি দুলতে থাকে। তাতে হঠাৎ সবাই ভড়কে যান। বর্ষাকালে লেকের পানি বৃদ্ধি পেলে এটি ডুবে যায়।

এখান থেকে বেরিয়ে দুপুর ২-টার দিকে আমরা পর্যটন হলিডে কমপ্লেক্স-এর অভ্যন্তরে অবস্থিত ‘রাবেতায়ে ইসলামী’ নির্মিত (১৪২১ হিঃ) মসজিদুল আস‘আদে যোহর ও আছরের ছালাত জমা ও কছর করলাম। ছালাত শেষ আমীরে জামা‘আত দাঁড়িয়ে সবাইকে নাতিদীর্ঘ উপদেশ দিলেন।

ঝুলন্ত ব্রীজ দেখার পর শুভলং যাত্রাপথে আমরা লঞ্চে কাপ্তাই হরদের প্রতিটি সাড়ে ৬ কেজি ওযনের তিনটি বিশাল বিশাল রুই মাছ দিয়ে রান্নাকৃত দুপুরের খাবার খেলাম। বর্ষাকালে এ লেকে ৯ কেজির উপরে রুই মাছ পাওয়া যায়। রাঙ্গামাটির নতুন আহলেহাদীছ ভাইয়েরা নিজেরাই রান্নাবান্না সহ সার্বিক ব্যবস্থাপনা সুন্দরভাবে সম্পন্ন করেন। আমীরে জামা‘আত তাদের কাছে ডেকে নিয়ে ধন্যবাদ জানান ও দো‘আ করেন।

বুদ্ধ মূর্তি :

শুভলং ঝর্ণার আগে শিলছড়ি এলাকায় উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় দৃষ্টিগোচর হ’ল সোনালী প্রলেপযুক্ত ৩০-৩৫ ফুট উচ্চতার বিশাল এক বুদ্ধ মূর্তি। যা ২০১২ সালে তৈরী করা হয়েছে। এর পাশে নির্বাণ নগর নামে একটি বিহার গড়ে উঠেছে। কিছুদূর গিয়ে পাহাড়ের উপর আরেকটি নির্মাণাধীন বুদ্ধমূর্তি দেখা গেল। জনশ্রুতি মতে, বৌদ্ধরা এগুলি তৈরী করে। যাতে একসময় এসব পাহাড়কে নিজেদের বলে প্রমাণ করা যায়।

শুভলং ঝর্ণা ও শুভলং টিএ্যান্ডটি পাহাড় :

বরকল উপযেলায় অবস্থিত সৌন্দর্যের রাণী শুভলং ঝর্ণা রাঙ্গামাটি শহর থেকে নদীপথে ২৫ কিঃমিঃ। বরকল যাওয়ার পথে সরু লেক বেয়ে দু’পাশের প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু পাহাড় সমূহ থেকে বিপুল বেগে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত হয়। কিন্তু দুঃখজনক এই যে, শুকনা মৌসুমে ঝর্ণায় পানি নেই। তাই পানিবিহীন উঁচু শুভলং ঝর্ণাটিকে অনেকটা শুষ্ক ও বিবর্ণ মনে হ’ল। চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী শেখ সা‘দী এর আশেপাশে আরো কয়েকটি ঝর্ণা আমাদেরকে দেখালেন। তিনি বললেন, ‘এক সময় এসব ঝর্ণা দিয়েও পানি বেরুতো। আমি নিজে অনেক আগে এসব ঝর্ণার পানিতে গোসল করেছি’। এভাবে পাহাড়ী বিকালের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা পৌঁছে গেলাম শুভলং বাজারের ঘাটে। আমীরে জামা‘আত সহ সবাই বাজারের মসজিদ-মন্দির ঘুরে দেখলেন।

এরপর আমরা সারিবদ্ধভাবে আমীরে জামা‘আতের নেতৃত্বে এগিয়ে চললাম সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮৬০ ফুট (১৮৬ তলা সমান) উঁচু সৃষ্টির অপার বিস্ময় শুভলং টিএ্যান্ডটি পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছেই সেনাচৌকির অন্যতম সদস্য সাতক্ষীরার কালীগঞ্জের শাহজাহান নামক সৈনিক ভাইটি স্যারকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে বলে উঠলেন, উনি ড. গালিব স্যার না? আমরা তাকে স্যারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। তিনি জানালেন যে, তিনি নওদাপাড়ায় তাবলীগী ইজতেমায় গিয়েছেন। এরপর ৬০০ ফুট উপরে উঠে আমীরে জামা‘আত আমাদেরকে বললেন, তোমরা তরুণ, এবার তোমরা যাও পাহাড় জয় করে এসো। আমীরে জামা‘আতের এই উৎসাহব্যঞ্জক কথা শুনে তাঁর মেজ ও কনিষ্ঠ দুই পুত্র নাজীব ও শাকির সহ আমরা গগণচুম্বী শুভলং পাহাড় জয়ে মেতে উঠলাম। অনেকে মাঝপথ থেকে ফিরে এলেন। সিরাজগঞ্জ যেলার প্রবীণ সহ-সভাপতি জনাব শফীউল ইসলাম (৬৩) সবার আগে ওঠে গেলেন। সাথে আরেকজন প্রবীণ আন্দোলন-এর কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম (৫৮) আমাদের সাথে উঠে এলেন। বাকী আমরা ৩০/৩৫ জন যুবক অনেক কষ্টে খাড়া পাহাড়ের শীর্ষদেশে উঠে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। উপর থেকে শুভলংয়ের দৃশ্য বড়ই মনোহর, বড়ই চিত্তাকর্ষক। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পাহাড়ের উপর থেকে রাঙ্গামাটি যেলাটিকে মনে হ’ল যেন কাপ্তাই লেকের পানির মধ্যে ভেসে আছে। অথচ রাঙ্গামাটি হ’ল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যেলা।

শুভলং পাহাড়ের শীর্ষদেশে টিএ্যান্ডটি পুলিশ ক্যাম্প ও একটি টিনশেড মসজিদ রয়েছে। ২০/২৫ জনের একটি বাহিনী সেখানে অবস্থান করে। এখানে এএসআই মুহাম্মাদ ফরহাদ হোসেন (গাইবান্ধা) আমাদেরকে জানালেন, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে উক্ত মসজিদটি নির্মাণ করেছেন। মসজিদের মেঝে পাকা করার জন্য তিনি আমাদের সহযোগিতা চাইলেন। তার আবেদনের প্রেক্ষিতে  ‘আন্দোলন’-এর সেক্রেটারী জেনারেল অধ্যাপক নূরুল ইসলাম সবাইকে সহযোগিতার আহবান জানালেন। তাতে সবাই সাধ্যানুযায়ী দান করলেন। সর্বমোট ৩২৬৪ টাকা তুলে আমরা তার হাতে দিলাম। পুলিশ সদস্যগণ অত্যন্ত খুশী হয়ে দো‘আ করলেন। এ ক্যাম্পে ৫ কপি মাসিক আত-তাহরীক, ছহীহ কিতাবুদ দো‘আ, সোনামণি প্রতিভা, ‘যাবতীয় চরমপন্থা থেকে বিরত থাকুন’ শীর্ষক লিফলেট বিতরণ করা হয়। এরপর তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খুবই সতর্কতার সাথে অাঁকাবাঁকা ও সরু বিপজ্জনক পাহাড়ী পথ বেয়ে সবাই নীচে নেমে এলাম। আমীরে জামা‘আত সেনাবাহিনী কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ও স্থানটিকে পর্যটনের যথাযোগ্য স্থানরূপে গড়ে তোলার জন্য পরামর্শ দেন। অতঃপর কর্মীদের আপ্যায়নে ও বৌদ্ধ বিক্রেতাদের পরিবেশনায় তিনি ও তাঁর সাথীগণ বৃহদাকার পাহাড়ী ডাবের মিষ্ট পানি পানে তৃপ্ত হন।

রাঙ্গামাটি যাত্রা :

সন্ধ্যা ৫.৫৫ মিনিটে রাঙ্গামাটির উদ্দেশ্য লঞ্চ শুভলং ঘাট ছাড়ল। আসার পথে আলো-অাঁধারীর লুকোচুরির মাঝে শান্ত নীরব পাহাড়ের হাতছানি এক মায়াবী পরিবেশের সৃষ্টি করে। উদাস মন যেন পাহাড় ছেড়ে আসতেই চায় না।

আল-‘আওনের করুণ অভিজ্ঞতা :

সন্ধ্যার পর ‘আল-‘আওন’-এর রংপুর যেলা সভাপতি আবুল বাশার সবাইকে এক করুণ কাহিনী শোনালেন। তিনি বললেন, রাত ১১-টায় হঠাৎ তাঁর পরিচিত এক ইন্টার্নী ডাক্তার পঞ্চগড় থেকে আগত এক মায়ের জন্য তাকে দুই ব্যাগ রক্ত সংগ্রহের কথা জানালেন। আমি সাথে সাথে দু’জন ডোনার বন্ধুকে রক্ত দেওয়ার জন্য রংপুর মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাই। রাত ১-টার সময় তাদের শরীর থেকে রক্ত নেয়া যখন প্রায় শেষ, এমন সময় অপারেশন থিয়েটার থেকে খবর এল যে, মা ও সন্তান দু’জনেই মারা গেছেন...। আমরা দুঃখে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। একদিকে একজন মাকে রক্ত দিতে না পারার বেদনা, অন্যদিকে একসাথে দু’টি জীবনের অবসান আমাদেরকে শোকাতুর করে তোলে। বারবার মনে হচ্ছিল আর একটু আগে পৌঁছতে পারলে হয়ত তাদের বাঁচানো যেত। এ কষ্ট ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। হৃদয়বিদারক এ কাহিনী শুনে সবার চোখ অশ্রুসিক্ত হ’ল। ‘আল-‘আওন’-এর জন্য সবাই প্রাণ খুলে দো‘আ করলেন যেন এর অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকে।

রাঙ্গামাটি লঞ্চঘাট :

অতঃপর সন্ধ্যা ৭-টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম রাঙ্গামাটি লঞ্চঘাটে। ঘাট থেকে উঠে আমরা রাঙ্গামাটি শহরের বায়তুশ শরফ আদর্শ জববারিয়া মাদরাসার মসজিদে মাগরিব ও এশার ছালাত আমীরে জামা‘আতের ইমামতিতে জমা ও কছর করলাম। ছালাতের পর আমীরে জামা‘আত সবার উদ্দেশ্যে নছীহতমূলক বক্তব্য দিলেন এবং চট্টগ্রাম বায়তুর রহমান আহলেহাদীছ জামে মসজিদের জন্য প্রথমে নিজে দশ হাযার টাকা, অতঃপর সবাইকে কমপক্ষে ১০০০/= টাকা করে দান করার আহবান জানালেন। সবাই দান করার প্রতিশ্রুতি দিলেন। এখান থেকে কক্সবাজার যেলা সভাপতি এডভোকেট শফীউল ইসলাম রাতে ৮-টার কোচ ধরে কক্সবাজার এবং ময়মনসিংহ-উত্তর যেলা সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ আলী ঢাকা চলে যান।

অতঃপর রাঙ্গামাটির গ্রীনহিল আবাসিক হোটেলে আমরা রাত্রি যাপন করলাম। হোটেলে রাত ৯-টার দিকে রাঙ্গামাটির ১৭/১৮ জন দ্বীনী ভাই এসে আমীরে জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেন। এরা হলেন, আলম (ভূষণছড়া, বরকল), তার ছোট ভাই হাফেয শিহাবুদ্দীন (ঐ), হারূণ, ইমরান হোসেন, ফয়ছালুদ্দীন, নূরুল হক, ইয়াকূব ভূঁইয়া, শরীয়তুল্লাহ, আনোয়ার হোসেন, আব্দুল মান্নান, শাহাদাত, যহূরুল হক প্রমুখ। আমীরে জামা‘আতকে কাছে পেয়ে এইসব নতুন ভাইয়েরা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেল। ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) এবং ইন্টারনেটে তাঁর খুৎবা ও ভাষণ তাদের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে বলে তাদের অনেকে আবেগভরা কণ্ঠে বললেন। সেই সাথে বিরোধীদের চক্রান্ত ও নিন্দাবাদের কথাও শুনালেন। উল্লেখ্য যে, রাঙ্গামাটি  শহর থেকে ৪০ কিঃ মিঃ দূরে ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী বরকল উপযেলার ভূষণছড়া ইউনিয়নের আত-তাহরীকের গ্রাহক জনৈকা মহিলা তার শিশু পুত্রকে, যে মাত্র দু’বছরে হিফয শেষ করেছে, তাকে আমাদের নওদাপাড়া মারকাযে এবছর ভর্তি করেছেন। যদিও তার স্থানীয় শিক্ষকরা প্রচুর চাপ সৃষ্টি করেছিলেন।

ফজরের ছালাত জামা‘আতের সাথে সবাই বায়তুশ শরফ জামে মসজিদে আদায় করলাম। ছালাত শেষে ইমাম ছাহেব লম্বা মুনাজাত ধরলেন। মুনাজাতের পর তিনি তাসবীহ হাতে মুছল্লীদের দিকে ফিরে বসলেন। আমীরে জামা‘আত তাঁকে কিছু উপদেশ দিতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু ইমাম ছাহেব পুনরায় কিবলার দিকে ঘুরে গেলেন। কারণ এত বেশী আহলেহাদীছ মুছল্লী হয়ত এ মসজিদে এই প্রথম। অতঃপর আমীরে জামা‘আতের  সাথে আমরা সবাই মর্নিং ওয়াকে বের হ’লাম। দেখলাম বারান্দায় ১৭টি বাচ্চা কুরআন পড়ছে। রাস্তায় নেমে দেখলাম এক মহিলা রাস্তার ধারে প্রায় ৪ ফুট উঁচু একটা ইট ও চুনকাম করা স্তম্ভের সামনে উত্তরমুখী হয়ে সিজদার ভঙ্গীতে পড়ে আছে। স্তম্ভের মাথায় ঔঁ লেখা দেখে মনে হ’ল মহিলাটি বৌদ্ধ হবে।

হোটেলের ছাদে আমীরে জামা‘আতের দরস ও স্মৃতিচারণ :

মর্নিং ওয়াক থেকে ফিরে হোটেলের ছাদে মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সূরা আলে ইমরান-এর ১০২ আয়াতের উপর মুমিন, মুত্তাক্বী ও মুসলিমের ব্যাখ্যা দিয়ে এক মনোজ্ঞ দরস প্রদান করেন এবং সাথীদের তাক্বওয়া ভিত্তিক জীবন-যাপনে উদ্বুদ্ধ করেন।

অতঃপর তিনি সবাইকে তাদের সাংগঠনিক জীবনের স্মরণীয় ঘটনা সমূহ বলার আহবান জানান। প্রথমে তিনি নিজের জীবনের ৪টি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, (১) ইউজিসি মনোনীত আমার পিএইচ.ডি থিসিসের মূল্যায়ন কমিটির সম্মানিত সদস্য, ইফাবা-এর সাবেক ডিজি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খান-কে থিসিস-এর হাতে লেখা পান্ডুলিপি দেখানোর জন্য আমি চট্টগ্রামে ১০ দিন অবস্থান করি। প্রথমদিন বিকালে তাঁর বাসায় গিয়ে দেখি আরও তিনজন পিএইচডি গবেষক শিক্ষক সেখানে আছেন। মাগরিবের ছালাতের সময় তিনি আমাকে সামনে যেতে বললেন। আমি বললাম, স্যার আপনি ইমামতি করুন। তিনি বললেন, তুমি কি ইমাম আহমাদের ফৎওয়া জানো না, যেখানে একজন আহলেহাদীছ ও একজন আহলুর রায় থাকেন, সেখানে আহলেহাদীছ ব্যক্তি ইমামতি করবেন। তখন বাধ্য হয়ে আমি ইমামতি করলাম।

(২) পরের বার সফরে গেলে তিনি আমাকে বললেন, চলেন এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি। আমি তাঁর সাথে চললাম। গাড়ী থেকে নেমে দেখি সেটা বায়তুশ শরফ-এর পীর আব্দুল জাববার ছাহেবের আস্তানা। স্যার ভিতরে গিয়ে উঁচু চেয়ারে বসা পীর ছাহেবের পায়ের কাছে ফরশের উপরে বসলেন। তারপর তিনি আমাকে ভিতরে আসার জন্য কয়েকবার ইঙ্গিত করলেন। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে রইলাম। স্যারের বার বার আহবানে আমি ভিতরে গেলাম ও দাঁড়ানো অবস্থায় চেয়ারে বসা পীর ছাহেবের সাথে কুশল বিনিময় করলাম। অতঃপর বেরিয়ে এলাম। তখন স্যার আমাকে বললেন, আপনাকে এতবার ইশারা করার পরও আপনি ভিতরে গেলেন না। তারপরেও গেলেন, কিন্তু বসলেন না ও পীর ছাহেবের দো‘আ নিলেন না। আমি বললাম, স্যার আপনি আমার শিক্ষক এবং বহু শিক্ষকের শিক্ষক। অথচ আপনি পীর ছাহেবের পায়ের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলেন! আপনার চেয়ে উনি কি বেশী মর্যাদাবান?  তাছাড়া আমি পীর-মুরীদীতে বিশ্বাসী নই।

(৩) ১৯৮১ সালের ৩০শে মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার খবর আমি সাতক্ষীরায় নিজ বাড়ীতে রেডিওতে পাই। তখন আমি মাটির ভাঙ্গা বারান্দা কাদার চাপ দিয়ে গাঁথছিলাম। খবরটি শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কাজ বন্ধ করে গোসল করতে চলে গেলাম। এসে মাকে বললাম, মা আমি একটু বাইরে যাব। ফিরতে দু’তিনদিন দেরী হ’তে পারে। বলেই আমি বাড়ী থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ি। ঐসময় আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সবেমাত্র চাকুরীতে প্রবেশ করেছি। সে সময় ৩ দিন গোটা বাংলাদেশ শাসকবিহীন অবস্থায় ছিল। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। বাতাসে নানা কথা ভেসে বেড়াচ্ছে। বাড়ী থেকে বেরুনো রীতিমত দুঃসাহসের ব্যাপার ছিল। সমগ্র দেশে কার্ফু জারী ছিল। আমি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা হয়ে দু’দিন পর চট্টগ্রামে পৌঁছলাম। চট্টগ্রাম আমার কাছে তখন একেবারে অচেনা নগরী। অতঃপর মানুষকে জিজ্ঞাসা করে বহু খোঁজাখুঁজির পর কাপ্তাই রোড ধরে রাস্তার পাশে রাঙ্গুনিয়ার পাহাড়ী জঙ্গলের মধ্যে প্রেসিডেন্ট জিয়ার প্রথম দাফনের স্থান খুঁজে বের করি। তখন বাংলাদেশের মানুষের বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে, জিয়া মানেই স্বাধীনতা। জিয়াকে হত্যা করা মানেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে হত্যা করা। ১লা জুন লাশ উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পর আমি সেখানে গিয়েছি। দুর্গন্ধযুক্ত মাটির পাশে দাঁড়িয়ে সেদিন দর্শক বইয়ে লিখেছিলাম, যদি কখনও এখানে কোন স্মৃতি কমপ্লেক্স গড়ে ওঠে, তবে যেন এই ঝুড়ি-কোদাল ও মাটির গর্ত অক্ষুণ্ণ রেখে কাঁচের আধারে আবৃত রাখা হয়। যাতে মানুষ পুরানো স্মৃতি দেখে উপদেশ হাছিল করে’।

অতঃপর মুহতারাম আমীরে জামা‘আত সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, আমরা কিন্তু আপনাদের ছাড়াই আসার পথে ঐ স্থানটি দেখে এসেছি। বর্তমানে স্থানটির নাম জিয়া নগর। চট্টগ্রাম থেকে ২৭ কিঃমিঃ দূরে রাঙ্গুনিয়ার চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাপ্তাই সড়কের বাম পাশে অবস্থিত। ১৯৯৫ সালে বেগম খালেদা জিয়া এখানে একটি মসজিদ ও একটি টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট স্থাপন করেছেন। কিন্তু দাফনের স্থানটি বেশ দূরে ও অনেক উপরে। সেখানে দু’টি বড় বাগানবিলাস ফুল গাছ দেখে সন্দেহ বশে সেখানে গিয়ে স্থানটি খুঁজে পাই। দেখলাম, চারপাশে চারটি পাঁচ ইঞ্চির ইটের গাঁথুনি। মাঝখানে গর্ত। যেখানে পড়ে আছে কৃষক দলের সাধারণ সম্পাদক শামসুজ্জামান দুদুর নাম লিখিত একটি শ্রদ্ধাঞ্জলির ফেসটুন।

তিনি আরো বলেন, ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারীতে ফরিদপুরে সাংগঠনিক সফরে গিয়ে টুঙ্গীপাড়ায় শেখ মুজিবের কবর যিয়ারত করেছিলাম। এসব নেতাদের জীবনীতে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় রয়েছে।

(৪) একবার আমি ও আমার বড় ভাই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করছিলাম। হঠাৎ ভাইয়ের পকেটে খসখস শব্দ শুনে মনে খটকা লাগল। ছালাত শেষে বললাম, আপনার পকেটে কি খসখস করছে? তিনি বললেন, তুমি ওসব বুঝবে না। তখন আমি তাঁর পকেটে হাত ঢুকিয়ে পাতাটা বের করলাম। বড় ভাবীকে বললাম, ভাবী এটা কিসের পাতা? তিনি জানালেন, আমার এক বোন তোমার ভাইয়ের জন্য যশোরের নওয়াপাড়ার পীর ছাহেবের কাছ থেকে এই পাতাটা পড়ে এনেছেন। পাতাটা পকেটে থাকলে নাকি শত্রু তাকে  টের পায়না। আমি বললাম, উনার কি মনে নেই উনি কোন ঘরের সন্তান? তাওহীদের ঘরে শিরকের প্রবেশ চলবে না। একথা বলে আমি পাতাটি কুটিকুটি করে ছিঁড়ে ফেলে দেই। পরের দিনই ভাই গ্রেফতার হ’লেন। আমি ঐ সময় বাড়ীর বাইরে ছিলাম।

এরপর আমীরে জামা‘আত সাংগঠনিক জীবনে কারো কোন স্মৃতি থাকলে তা ব্যক্ত করার কথা বললেন। তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার মুহাম্মাদ মুর্তযা ও গাযীপুর যেলা ‘আন্দোলন’-এর সহ-সভাপতি ডাঃ মুহাম্মাদ ফযলুল হক স্মৃতিচারণ করলেন। মুহাম্মাদ মুর্তযা তার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ২০১৬ সালের ২রা ফেব্রুয়ারী। আমি কেরানীহাটের এক হাসপাতালে আমার এক বন্ধুর নবজাতককে দেখতে যাই। দেখার পর হোটেলে চা পান করে বের হতেই আমাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে সাতকানিয়া থানায় নিয়ে যায়। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ হ’ল, আমি জঙ্গীবাদের সাথে জড়িত। আমি তাদের বক্তব্যের প্রতিবাদ করি। এরপর বাদ মাগরিব আমাকে আমার বাসায় নিয়ে আমার ব্যক্তিগত পাঠাগারে তল্লাশী চালানো হয়। তারা বেছে বেছে মাসিক আত-তাহরীক, ছালাতুর রাসূল (ছাঃ) প্রভৃতি বই নিয়ে বলে, এগুলিই তো জঙ্গী বই। আমি তখন তাদেরকে বলি, শুধু এই বইগুলো আপনারা নিচ্ছেন কেন? চরমোনাই, ফুরফুরার পীর ছাহেবদের বইগুলোও নিন? এ প্রশ্নের জবাবে তারা নিরুত্তর হয়ে যায়। তারপর আমাকে সার্কেল অফিসারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি জঙ্গী? আমি বলি, স্যার আমি ১৩/১৪ বছর যাবৎ একটি এমপিওভুক্ত মাদরাসায় চাকুরী করি। আমাকে সুযোগ দিন, আমি চাকুরীতে ইস্তফা দেই। তারপর আপনি আমার বিরুদ্ধে তদন্ত করুন। মূলতঃ আমার বিরুদ্ধে কিছু উগ্রপন্থী জঙ্গী অভিযোগ করেছে। যারা ইতিপূর্বে আমাকে ফোনে অনেকবার হুমকি দিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে থানায় আমার জিডির কপি দেখালে তিনি আমাকে ছেড়ে দেন।

গাযীপুর যেলা ‘আন্দোলন’-এর সহ-সভাপতি ডাঃ মুহাম্মাদ ফযলুল হক তাঁর জীবনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, আমার বাড়ী লালমণিরহাট যেলার হাতিবান্ধা থানার পূর্ব বিছনদই গ্রামে। আদিতমারীতে একটি ভাড়া বাসাতে আমি থাকতাম। বাজারে আমার একটি হোমিও ঔষধের দোকান ছিল। একদিন আমি সেখানকার একটি মসজিদে ছালাত আদায় করতে গিয়ে দেখি, মুছল্লীরা পায়ে পা লাগিয়ে রাফ‘উল ইয়াদায়েন করে আহলেহাদীছদের মতো ছালাত আদায় করছে। আমি তাদেরকে বললাম, আপনারা কি শাফেঈ? তারা বললেন, না, আমরা আহলেহাদীছ। পরে যেলা ‘আন্দোলন’-এর তৎকালীন সভাপতি মাওলানা সাঈদুর রহমান ছাহেবের সাথে আমার পরিচয় হ’ল। তিনি আমাকে আত-তাহরীক পড়তে দিলেন। আমি সঠিক পথের দিশা পেয়ে আহলেহাদীছ হয়ে গেলাম। তারপর শুরু হল আমার উপর বিভিন্নমুখী নির্যাতন। গ্রামে গেলে মসজিদের ইমাম ও আমার আপন চাচাও আমাকে গাল-মন্দ করলেন। পরে আমি গাযীপুরে চলে যাই। সেখানে গিয়ে হোমিও ডাক্তারীর পাশাপাশি দ্বীনের দাওয়াত শুরু করি। শুরু হয় আমার উপর যুলুম। বিদ‘আতীরা আমার চেম্বারে হামলা করে আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। আমরা গাযীপুরে ভাড়া বাড়ীতে ‘মুহাম্মাদী ইসলামী পাঠাগার’ নামে একটি লাইব্রেরী করেছিলাম। একদিন বিদ‘আতীরা সেখানে হামলা করে আমাদের লাইব্রেরীটি তছনছ করে দেয় এবং বাড়ীওয়ালা রাজুকে মারধর করে। এভাবে বিদ‘আতীদের বিভিন্ন যুলুম-নির্যাতনের মধ্য দিয়েও ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’-এর কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আল-হামদুলিল্লাহ

৩১৪ বছরের চাপালিশ বৃক্ষ :

সফরের ২য় দিন ১৮ই মার্চ রবিবার সকালে নাশতার পর আমরা রাঙ্গামাটি ডিসি বাংলো পার্ক পরিদর্শন করি। লেকের পাশে নির্জন জায়গায় দারুণ এক কাব্যিক পরিবেশ এখানে। আমরা কিছুক্ষণ পার্কে বসে হরদ ও পাহাড়ের দৃশ্য অবলোকন করি। ডিসি বাংলো পার্কের প্রবেশমুখের বাম পাশে রয়েছে ৩১৪ বছরের পুরানো ঐতিহ্যবাহী চাপালিশ গাছ। এর দৈর্ঘ্য  ১০৩ ফুট এবং প্রস্থ ২৫ ফুট। তিন শতাধিক বছরের স্মৃতি বুকে ধারণ করে অবাক বিস্ময়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটি। চাপালিশ গাছের পাশে রয়েছে একটি মসজিদ। অথচ সাইন বোর্ড লেখা হয়েছে ‘এবাদতখানা’ বলে।

আরণ্যক হলিডে রিসোর্ট :

ডিসি বাংলো পার্ক ও চাপালিশ গাছ দেখার পর সকাল ১০-টায় আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। পথিমধ্যে কাপ্তাই লেক ঘেরা ছিমছাম পরিবেশে সেনাবাহিনীর সাজানো-গুছানো আরণ্যক হলিডে রিসোর্ট পরিদর্শন করলাম। এখানে বাঘার এক ভাইয়ের সাথে আমাদের পরিচয় হ’ল। আমরা তাকে জঙ্গীবাদ বিরোধী লিফলেট দিলাম। এখানে অল্প কিছুক্ষণ অবস্থান করে অাঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ বেয়ে আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশ্যে পুনরায় চলতে শুরু করলাম।

খাগড়াছড়ির পথে : গাড়ী গেল থমকে

পীচ ঢালা উঁচু-নীচু পাহাড়ী পথ বেয়ে পাহাড়গাত্রের আনারস বাগান, সেগুন গাছ, ভুট্টাক্ষেত, তেজপাতা গাছ, কচুক্ষেত প্রভৃতি দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম খাগড়াছড়ির দিকে। হঠাৎ রাঙ্গামাটির নানিয়ারচর নামক স্থানে আমাদের গাড়ী থমকে দাঁড়াল। আমাদেরকে চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’-এর সভাপতি ডাঃ শামীম আহসান ও সেক্রেটারী শেখ সা‘দী জানালেন, পাহাড়ীদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। সামনে-পিছনে কোন দিকে যাওয়া যাবে না। সবাইকে গাড়ীর ভিতরে বসার জন্য তারা অনুরোধ করলেন।  সবার চোখে-মুখে ভীতির ছাপ স্পষ্ট। মাত্র কয়েক গজ দূরে দেখছি কয়েকজন সন্ত্রাসী দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলা। এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ। ১১.৪৫ থেকে ১.৪৮ পর্যন্ত প্রায় দুই ঘণ্টা আটকে থাকার পর পুলিশ ও আর্মী এসে গাছের গুঁড়ি সরালে আমরা নানিয়ারচর থেকে আবার যাত্রা শুরু করলাম। পথিমধ্যে আরো ৩/৪ জায়গায় গাছের গুড়ি ফেলা ছিল। সেসব বাধা পেরিয়ে বিকেল ৩.৪০ মিনিটে আমরা খাগড়াছড়িতে পৌছলাম। উক্ত অভিজ্ঞতার আলোকে ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২০ বছর পর’ শিরোনামে এপ্রিল’১৮ সংখ্যা আত-তাহরীকে আমীরে জামা‘আত একটি অমূল্য সম্পাদকীয় লেখেন।

সে সময় আমীরে জামা‘আত সহ কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে বহনকারী মাইক্রোটি পথ ভুল করার কারণে বেলা ১২-টার দিকে মানিকছড়ি উপযেলার বুড়ীর ঘাট বাজার জামে মসজিদের সামনে থেমে ছিল।  পরে বিকাল সাড়ে ৪-টার দিকে  তাঁরা খাগড়াছড়ি এসে পৌঁছেন।

আলুটিলা গুহা :

দুপুরের খাবার ও ছালাত শেষে আমরা গেলাম আলুটিলা গুহা পরিদর্শনে। খাগড়াছড়ি যেলার মাটিরাঙা উপযেলা শহর হ’তে ৭ কিলোমিটার পশ্চিমে সমুদ্র সমতল হতে ৩০০০ ফুট উঁচুতে আরবারী পাহাড়ে আলুটিলা গুহা অবস্থিত। এটি খাগড়াছড়ির অন্যতম আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র। স্থানীয়দের ভাষায় এর নাম ‘মাতাই হাকড়’ বা ‘দেবতার গুহা’। গুহামুখের ব্যাস প্রায় ১৮ ফুট। গুহাটির ভেতরে ১০০ মিটার দীর্ঘ, ১ দশমিক ৮ মিটার উঁচু এবং শূন্য দশমিক ৯ মিটার প্রশস্ত। গুহাটি খুবই অন্ধকার ও শীতল। তলদেশ পিচ্ছিল ও পাথুরে। তলদেশে একটি ঝর্ণা প্রবাহমান। ভূগর্ভস্থ ট্যানেল সদৃশ গুহাটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫০ ফুট। গুহাটির একপাশ থেকে আরেকপাশে যেতে সময় লাগে ১০/১৫ মিনিট।

আল্লাহর সৃষ্টির এক অপূর্ব নিদর্শন এই আলুটিলা গুহা। জনপ্রতি ১০ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে আমরা ২৬৬টি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নেমে গেলাম রহস্যঘেরা আলুটিলা গুহায়। চতুর্দিকে সবুজের সমারোহের মাঝে গুহাটি দেখে আমরা অভিভূত হলাম। আমাদের পরে আমীরে জামা‘আত তাঁর অন্য সাথীদের নিয়ে এখানে আসেন এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে নিয়ে গুহাটি অতিক্রম করেন।

তারেং সেনাক্যাম্প :

অতঃপর পার্শ্ববর্তী তারেং সেনাক্যাম্পে গেলাম। সূর্য তখন অস্ত গেছে। সেখানে রাজশাহীর দু’জন তরুণ সৈনিকের সাথে পরিচয় হল। তাদের কল্যাণে তারেং সেনাক্যাম্প ও হেলিপ্যাড পরিদর্শন করে আমরা খাগড়াছড়ি শহরে ফিরে এলাম।

১৪১ বছরের পুরনো খাগড়াছড়ি কেন্দ্রীয় শাহী জামে মসজিদ:

খাগড়াছড়ি ফিরে এসে আমরা খাগড়াছড়ি শহরটা ঘুরে দেখলাম। এখানে রয়েছে ১৮৭৭ সালে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী খাগড়াছড়ি কেন্দ্রীয় শাহী জামে মসজিদ। তিন তলাবিশিষ্ট এই মসজিদটির প্রত্যেক তলায় ২২টি করে কাতার রয়েছে। ভিতরে ১৮টি ও বাইরে ৪টি। প্রত্যেক কাতারে ৬০ জন করে মুছল্লী ধরে।  এখানে  আমরা  মাগরিব ও এশা জমা ও কছর করি। ছালাতের পর খাগড়াছড়ি বাজার থেকে সুস্বাদু পাহাড়ী আনারস ও অন্যান্য জিনিসপত্র ক্রয় করি।

বিদায় পর্বে খাদ্যবিভাগসহ সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা চট্টগ্রাম যেলা ‘আন্দোলন’ ও ‘যুবসংঘ’-এর বিভিন্ন স্তরের দায়িত্বশীল ভাইদের প্রতি আমরা প্রাণখোলা অভিনন্দন ও গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলাম। অতঃপর সবশেষে আমীরে জামা‘আতের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসে ও ট্রেনে প্রত্যেকে স্ব স্ব গন্তব্যে রওয়ানা হলেন। মনের গহীনে গেঁথে রইল দু’দিনের অভিজ্ঞতালব্ধ সফরের দারুণ সব টাটকা স্মৃতি। এ স্মৃতি অমলিন। এমন সফরের হাতছানি কে পারে উপেক্ষা করতে?

 







কোয়েটার ঈদস্মৃতি - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৌত লাহোরে (আগস্ট’১৮ সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
বালাকোটের রণাঙ্গণে (আগষ্ট সংখ্যার পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়ায় পাঁচদিন (৩য় কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মাসজিদুল হারামে ওমরাহ ও ই‘তিকাফ (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
তাওহীদের এক চারণগাহ তাওহীদাবাদে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
মধ্যপ্রাচ্যের শহরে-নগরে (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
দক্ষিণের দ্বীপাঞ্চলে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ঝিলাম-নীলামের দেশে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইতিহাস-ঐতিহ্য বিধৌত লাহোরে - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
আরও
আরও
.