৬. তাক্বওয়া অর্জনে আদল : আদল বা সুবিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তাক্বওয়া অর্জিত হয় এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভ করা যায়। একজন তাক্বওয়াবান দায়িত্বশীল ব্যক্তি আদলের বিপরীত কোন কাজ করতে পারে না। আদল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাক্বওয়াকে সম্পৃক্ত করে কুরআন মাজীদে বলা হয়েছে, إِعْدِلُواْ هُوَ أَقْرَبُ لِلتَّقْوَى.‘তোমরা আদল কায়েম কর। এটা তাক্বওয়ার অধিক নিকটবর্তী’ (মায়েদাহ ৫/৮)।
৭. ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় আদল : সমাজ, প্রতিষ্ঠান বা রাষ্ট্রের বিভিন্ন কর্মকান্ড যদি আদল ও ইনছাফভিত্তিক সম্পাদিত হয়, তাহ’লে জাতীয় জীবনে এক অনুপম ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত হয়। আদলের অভাবে সমাজজীবনে ভ্রাতৃত্ববোধ বিনষ্ট হয় এবং হিংসা-বিদ্বেষ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
৮. সন্তানদের মাঝে আদল : সন্তানদের মাঝে সুবিচার প্রতিষ্ঠা করা বাবা-মার অন্যতম দায়িত্ব। এ দায়িত্বকে পাশ কাটিয়ে কাউকে কিছু দেয়া, আর কাউকে রিক্ত হস্ত করা গর্হিত কাজ। এজন্য ইমাম বুখারী (রহঃ) অনুচ্ছেদ রচনা করেছেন এভাবে,
بَابُ الْهِبَةِ لِلْوَلَدِ، وَإِذَا أَعْطَى بَعْضَ وَلَدِهِ شَيْئًا لَمْ يَجُزْ، حَتَّى يَعْدِلَ بَيْنَهُمْ وَيُعْطِى الْآخَرِيْنَ مِثْلَهُ- وَلاَ يُشْهَدُ عَلَيْهِ.
‘সন্তানকে দান করা সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ। যখন কোন এক সন্তানকে কিছু দান করা হবে তা বৈধ হবে না যতক্ষণ না অন্যদের মধ্যে সমতা বিধান করা হবে এবং অন্যদেরকেও তার সমপরিমাণ প্রদান করা হবে এবং এই ধরনের (যুলুমের) দানে কেউ সাক্ষী হবে না’।
নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ)-কে তার বাবা একটি দাস দান করার কথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে এসে ব্যক্ত করলে তিনি তাকে বললেন, তোমার অন্য সন্তানদেরকেও কি অনুরূপ দান করেছ? তিনি বললেন, না। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, فَاتَّقُوا اللهَ وَاعْدِلُوْا بَيْنَ أَبْنَائِكَمْ.‘আল্লাহকে ভয় কর এবং তোমার সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান কর’। এ কথা শুনে নু‘মানের বাবা তাকে দেয়া দান ফেরত নেন।১ অন্য হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِعْدِلُوْا بَيْنَ أَوْلاَدِكُمْ فِى الْعَطِيَّةِ.‘তোমরা দানের ক্ষেত্রে তোমাদের সন্তানদের মাঝে সমতা বিধান কর’।২
৯. স্ত্রীদের মাঝে আদল : যদি কারো একাধিক স্ত্রী থাকে তাহ’লে তাদের মধ্যে ন্যায় ও ইনছাফপূর্ণ আচরণ করা স্বামীর দায়িত্ব ও কর্তব্য (নিসা ৪/১২৯)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর প্রত্যেক স্ত্রীর জন্য একটি দিন ও রাত নির্ধারিত করতেন। অবশ্য সাওদা বিনতু যাম‘আ (রাঃ) ব্যতীত। কেননা তিনি (বার্ধক্যের কারণে) তাঁর পালার দিনটি আয়েশা (রাঃ)-এর জন্য দান করেছিলেন।৩ অন্য একটি হাদীছে এসেছে, আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর মৃত্যুকালীন রোগের সময় তাঁর সকল স্ত্রীকে আহবান করেন। আমরা সকলে একত্রিত হ’লে তিনি বলেন, (বর্তমানে) তোমাদের সকলের মধ্যে ঘুরে ঘুরে (পালাক্রমে) অবস্থানের ক্ষমতা আমার নেই। কাজেই তোমরা যদি অনুমতি দাও, তবে আমি (অসুস্থতার) দিনগুলো আয়েশার নিকট কাটাতে চাই। তখন সকলেই তাঁকে অনুমতি প্রদান করেন।৪ অন্য আরেকটি হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘যার দু’জন স্ত্রী আছে আর সে তার মধ্যে একজনের প্রতি অধিক ঝুঁকে পড়ে, সে ব্যক্তি ক্বিয়ামতের দিন অর্ধাঙ্গ অবশ অবস্থায় উত্থিত হবে’।৫
১০. আল্লাহর সন্তোষ অর্জনে আদল : আদল ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের এবং আল্লাহর ভালবাসা অর্জন করা যায়। আদলকারী ব্যক্তি আল্লাহর নিকট খুবই প্রিয়। যেমন- পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْمُقْسِطِيْنَ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ আদল প্রতিষ্ঠাকারীদের ভালবাসেন’ (মায়েদাহ ৫/৪২)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
إِنَّ الْمُقْسِطِيْنَ عِنْدَ اللهِ عَلَى مَنَابِرَ مِنْ نُوْرٍ : اَلَّذِيْنَ يَعْدِلُوْنَ فِىْ حُكْمِهِمْ وَأَهْلِيْهِمْ وَمَا وَلُوْا.
‘ন্যায়বিচারকগণ আল্লাহর কাছে নূরের মিম্বরে আসন গ্রহণ করবেন। যারা তাদের বিচারক্ষেত্রে, পরিবার-পরিজনের ব্যাপারে এবং অর্পিত দায়িত্বের ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার করে’।৬
ন্যায়পরায়ণ শাসকের দৃষ্টান্ত :
(১) ছিফফীনের যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর বর্ম হারিয়ে গেলে তিনি এক খৃষ্টানের কাছে তা পান। তাকে সাথে নিয়ে কাযী শুরাইহ্-এর নিকট বিচারের জন্য এসে বলেন, এটি আমার বর্ম। আমি এটি বিক্রিও করিনি এবং কাউকে দানও করিনি। শুরাইহ ঐ খৃষ্টান লোকটিকে বললেন, আমীরুল মুমিনীনের বক্তব্য সম্পর্কে তোমার মতামত কী? লোকটি বলল, বর্মটি আমার। তবে আমীরুল মুমিনীন মিথ্যা বলেননি। একথা শুনে বিচারক আলী (রাঃ)-এর দিকে তাকিয়ে বললেন, হে আমীরুল মুমিনীন! আপনার কাছে প্রমাণ আছে কী? আলী (রাঃ) হেসে বললেন, না, কোন প্রমাণ নেই। ফলে শুরাইহ ঐ বর্মটি খৃষ্টান লোকটিকে দিয়ে দিলেন। সে তা নিয়ে এক ধাপ অগ্রসর হয়ে ফিরে এসে বলল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এটিই নবীদের বিচার। আমীরুল মুমিনীন আমাকে তাঁর অধীনস্ত বিচারকের নিকট নিয়ে গেলেন, আর তিনি (বিচারক) তাঁর বিরুদ্ধে ফায়ছালা দিলেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ ছাড়া কোন (হক) মা‘বূদ নেই এবং আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ (ছাঃ) তাঁর বান্দা ও রাসূল। হে আমীরুল মুমিনীন! আল্লাহর কসম! বর্মটি আপনার। ছিফফীনের দিকে যাত্রার সময় এটি আপনার উটের উপর থেকে পড়ে গিয়েছিল। আলী (রাঃ) বললেন, তুমি যেহেতু ইসলাম গ্রহণ করলে, সেহেতু এটি তোমার জন্য। এরপর খলীফা তাকে স্বীয় ঘোড়ায় আরোহণ করিয়ে নিয়ে গেলেন।৭
(২) আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে বায়তুল মালে মতির একটি হার জমা করা হয়। আলী (রাঃ)-এর মেয়ে যায়নাব (রাঃ) এ সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে ঈদের একদিন পূর্বে বায়তুল মালের দায়িত্বে নিয়োজিত ইবনু আবী রাফে‘ (রাঃ)-কে বললেন, আগামীকাল ঈদ। মেয়েরা নতুন নতুন পোষাক ও অলংকার পরিধান করবে। আমার কোন গহনা নেই। বায়তুল মালে যে মতির হারটি জমা আছে সেটি আমাকে ধার দিন। ঈদের পর আপনাকে ফেরত দেব। ইবনু আবী রাফে‘ বললেন, আমি মাত্র তিন দিনের জন্য এ হার ধার দিতে পারি। এ প্রস্তাবে যায়নাব সম্মত হ’লেন এবং তিন দিনের জন্য ধার নিলেন। ঈদের দিন হার পরিধান করলে আলী (রাঃ) মেয়েকে বললেন, এটি তুমি কোথায় পেয়েছ? যায়নাব ঘটনা খুলে বললেন। তৎক্ষণাৎ আলী (রাঃ) ইবনু আবী রাফে‘ (রাঃ)-কে ডেকে পাঠালেন। তিনি উপস্থিত হ’লে খলীফা তাকে বললেন, তুমি আমার অনুমতি ছাড়া বায়তুল মালের মতির হার আমার মেয়েকে কেন দিয়েছ? তিনি বললেন, আপনার মেয়ে মাত্র তিন দিনের জন্য ধার নিয়েছে, তাই দিয়েছি। নচেৎ কখনো তাকে দিতাম না। খলীফা বললেন, তুমি ভুল করেছ। দ্রুত হারটি বায়তুল মালে জমা করো। আমি আমার মেয়ের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। যদি সে তিন দিনের জন্য ধার না নিত, তাহ’লে চুরির অপরাধে তাকে গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তি দিতাম। ইবনু আবী রাফে‘ যায়নাবের কাছে হার ফেরত চাইল। মেয়ে খলীফার কাছে এসে শুধু ঈদের দিনের জন্য ব্যবহারের অনুমতি চাইল। খলীফা বললেন, বেটি! তুমি কি নিজের জন্য ন্যায়নীতিকে গলাটিপে হত্যা করতে চাও। এরপর যায়নাব হারটি ইবনু আবী রাফে‘কে ফিরিয়ে দিলেন।৮
(৩) ভারতের সম্রাট মুহাম্মাদ বিন তুগলক জানতে পারলেন যে, জনৈক ব্যক্তির উপরে আদালতে অবিচার করা হয়েছে। তিনি যুবকটিকে দরবারে ডাকালেন। দরবার ভর্তি সভাসদগণের সম্মুখে যুবকটিকে ডেকে সব ঘটনা শুনলেন। এবারে তিনি রাষ্ট্রের পক্ষ হ’তে যুবকটির সম্মুখে নত হয়ে করজোড়ে ক্ষমা চাইলেন। তারপর নিজের পোষাক খুলে পিঠ নগ্ন করে দিলেন ও নিজের বেতের লাঠিখানা হিন্দু যুবকটির হাতে দিয়ে বললেন, তুমি সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে মার, যেভাবে আদালতের হুকুমে তোমাকে বেত্রাঘাত করা হয়েছিল। যুবকটি আবেগে আপ্লুত হয়ে কেঁদে ফেলল। কিন্তু সম্রাট কোন কথাই শুনতে চান না। অবশেষে তাকে মারতেই হ’ল। জোরে আরো জোরে। পিঠ রক্তাক্ত হয়ে গেল। এবার যুবককে বুকে জড়িয়ে ধরে সম্রাট বললেন, হে যুবক! আমার রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, ‘মযলূমের দো‘আ ও আল্লাহর মধ্যে কোন পর্দা নেই’।৯ তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ, প্রতিশোধ নিয়েছ। ইনশাআল্লাহ এর মাধ্যমে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি জাহান্নাম থেকে বেঁচে যাব। হে যুবক! তুমি প্রতিশোধ নিয়ে আজ আমার সবচেয়ে বড় উপকার করেছ। তোমাকে ধন্যবাদ।১০
উপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, ব্যক্তিগত, সামাজিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারসাম্য এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় আদলের গুরুত্ব অপরিসীম। সামাজিক স্থিতিশীলতা, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে আদলের কোন বিকল্প নেই। আদলের দৃষ্টিকোণ থেকে বিত্তবান, বিত্তহীন, ধনী-দরিদ্র, আপন-পর, সবল-দুর্বল, ধর্ম, বর্ণ, সাদা-কালো, জ্ঞানী-মূর্খ সবাই সমান। সমাজের সকল অঙ্গনে সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ সমুন্নত রাখার মাধ্যমে আদল প্রতিষ্ঠিত হ’লেই সমাজ থেকে অস্থিরতা ও অশান্তি বিদূরিত হয়ে শান্তি-সমৃদ্ধির ফল্গুধারা প্রবাহিত হবে। এ মহৎ চারিত্রিক গুণ অর্জন করতে পারলে মানুষ মানবতা ও মানবিক মর্যাদাবোধ এবং পারস্পরিক দায়িত্ববোধে উদ্বুদ্ধ হ’তে পারবে। সুতরাং আমাদের সকলেরই এ মহৎ চারিত্রিক গুণটি অর্জন করা উচিত। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দিন- আমীন!
১. বুখারী হা/২৫৮৬, ‘হেবা ও তার ফযীলত’ অধ্যায়।
২. ঐ।
৩. আবুদাঊদ, হা/২১৩৮, হাদীছ ছহীহ।
৪. ঐ, হা/২১৩৭, হাদীছ ছহীহ।
৫. ঐ, হা/২১৩৩, হাদীছ ছহীহ।
৬. মুসলিম হা/১৮২৭, নাসাঈ হা/৫৩৭৯; মিশকাত হা/৩৬৯০; রিয়াযুছ ছালেহীন হা/৬৬০।
৭. আল-বিদায়াহ ওয়ান-নিহায়াহ (কায়রো : দারুর রাইয়ান লিত-তুরাছ, ১৯৮৮), ৮ম খন্ড, পৃঃ ৫।
৮. আইয়ামে খিলাফতে রাশেদা পৃঃ ৮৯-৯০।
৯. মুত্তাফাক্ব আলাইহ; মিশকাত হা/১৭৭২ ‘যাকাত’ অধ্যায়।
১০. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, দরসে কুরআন : ইনছাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা, আত-তাহরীক, ডিসেম্বর ’০৬,পৃঃ ৭।