পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংগঠন সর্বত্র আনুগত্য এক অপরিহার্য বিষয়। এগুলির কোন স্তরে আনুগত্য না থাকলে সেটা ভালভাবে চলবে না, সেখানে নিয়ম-শৃংঙ্খলা থাকবে না। ফলে সেখানে কোন কাজ সুচারুরূপে পরিচালিতও হবে না। তাই সর্বস্তরে আনুগত্যের কোন বিকল্প নেই। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা করা হ’ল।-
আনুগত্য অর্থ : কোন প্রতিবাদ, বিতর্ক ও পরিবর্তন ব্যতিরেকে আদেশ-নিষেধ শ্রবণ করা বা মান্য করাই হচ্ছে আনুগত্য।
আনুগত্যের প্রকার : আনুগত্যকে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- ক. নিষিদ্ধ আনুগত্য খ. ফরয ও ওয়াজিব আনুগত্য।
ক. নিষিদ্ধ আনুগত্য : নিষিদ্ধ আনুগত্য বলতে বুঝায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ) যাদের আনুগত্য ও অনুসরণ করতে নিষেধ করেছেন। যেমন-
১. কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য : মুসলমানদের জন্য কাফের ও মুনাফিকদের আনুগত্য নিষিদ্ধ। আল্লাহ বলেন,وَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَالْمُنَافِقِيْنَ وَدَعْ أَذَاهُمْ وَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ وَكَفَى بِاللهِ وَكِيْلاً- ‘আর তুমি কাফের ও মুনাফিকদের অনুসরণ কর না। তাদের দেওয়া কষ্টসমূহ উপেক্ষা কর এবং আল্লাহর উপর ভরসা কর। বস্ত্ততঃ তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (আহযাব ৩৩/৪৮)। কাফেরদের আনুগত্য না করে বরং তাদের সাথে জিহাদ করতে আল্লাহ নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, فَلَا تُطِعِ الْكَافِرِيْنَ وَجَاهِدْهُم بِهِ جِهَادًا كَبِيْرًا ‘অতএব তুমি কাফেরদের আনুগত্য করো না এবং তুমি তাদের বিরুদ্ধে এর সাহায্যে কঠোর সংগ্রাম কর’ (ফুরক্বান ২৫/৫২)।
২. আহলে কিতাবদের আনুগত্য : আহলে কিতাব তথা ইহুদী-নাছারাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তিনি বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تُطِيْعُوْا فَرِيْقًا مِنَ الَّذِيْنَ أُوتُوْا الْكِتَابَ يَرُدُّوْكُم بَعْدَ إِيْمَانِكُمْ كَافِرِيْنَ- ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের কোন একটি দলের কথা মেনে নাও, তাহ’লে ওরা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে ফেলবে’ (আলে ইমরান ৩/১০০)।
৩. অধিকাংশ মানুষের অনুসরণ করা : পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ অনুমান ভিত্তিক কথা বলে এবং ধারণার অনুসরণ করে। এজন্য অধিকাংশ মানুষের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করে বলেন,وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوْكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُوْنَ إِلَّا الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلَّا يَخْرُصُوْنَ- ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহ’লে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করে দিবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।
৪. মিথ্যাবাদী, পাপিষ্ঠদের আনুগত্য : যারা মিথ্যা কথা বলে ও মিথ্যাচার করে তাদের আনুগত্য করতে আল্লাহ নিষেধ করে বলেন, فَلَا تُطِعِ الْمُكَذِّبِيْنَ ‘অতএব তুমি মিথ্যারোপ- কারীদের আনুগত্য করবে না’ (কলম ৬৮/৮)। অনুরূপভাবে অধিক শপথকারীর আনুগত্য করতেও আল্লাহ নিষেধ করে দেন। তিনি বলেন,وَلَا تُطِعْ كُلَّ حَلَّافٍ مَهِيْنٍ ‘আর তুমি তার আনুগত্য করবে না, যে অধিক শপথ করে, যে লাঞ্ছিত’ (কলম ৬৮/১০)। পাপীদের অনুসরণ করা থেকে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, وَلَا تُطِعْ مِنْهُمْ آثِمًا أَوْ كَفُوْرًا ‘আর তুমি ওদের মধ্যকার কোন পাপিষ্ঠ অথবা কাফেরের আনুগত্য করবে না’ (দাহর ৭৬/২৪)। সীমালংঘনকারীদের আনুগত্য করতে নিষেধ করে আল্লাহ বলেন, وَلَا تُطِيْعُوْا أَمْرَ الْمُسْرِفِيْنَ ‘আর তোমরা সীমালংঘনকারীদের আদেশ মান্য কর না’ (শু‘আরা ২৬/১৫১)। উদাসীন ও প্রবৃত্তির অনুসারীদের আনুগত্য করতে নিষেধ করে তিনি বলেন,وَلَا تُطِعْ مَنْ أَغْفَلْنَا قَلْبَهُ عَنْ ذِكْرِنَا وَاتَّبَعَ هَوَاهُ وَكَانَ أَمْرُهُ فُرُطًا- ‘আর তুমি ঐ ব্যক্তির আনুগত্য কর না যার অন্তরকে আমরা আমাদের স্মরণ থেকে গাফেল করে দিয়েছি এবং সে তার খেয়াল-খুশীর অনুসরণ করে ও তার কার্যকলাপ সীমা অতিক্রম করে গেছে’ (কাহ্ফ ১৮/২৮)।
কাফের, মুনাফিক ও অন্যদের আনুগত্যের প্রভাব :
আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য ত্যাগ করে কাফের-মুশরিক ও অন্যদের আনুগত্য করলে ইহকাল ও পরকালে ক্ষতিগ্রস্ত হ’তে হবে। যেমন-
১. সুস্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিপতিত হওয়া : আল্লাহ ও রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করে কাফের-মুশরিকদের আনুগত্য করলে স্পষ্ট ভ্রষ্টতায় নিপতিত হ’তে হবে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِيْنًا- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে, সে স্পষ্ট ভ্রান্তিতে পতিত হবে’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
২. কুফরীর দিকে প্রত্যাবর্তন : কাফের-মুশরিকদের আনুগত্য করলে এরা মুসলমানদেরকে কুফরীর দিকে ধাবিত করে দিতে পারে। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنْ تُطِيْعُوْا فَرِيْقًا مِنَ الَّذِيْنَ أُوتُوْا الْكِتَابَ يَرُدُّوْكُم بَعْدَ إِيْمَانِكُمْ كَافِرِيْنَ- ‘হে মুমিনগণ! যদি তোমরা আহলে কিতাবদের কোন একটি দলের কথা মেনে নাও, তাহ’লে ওরা তোমাদেরকে ঈমান আনার পর পুনরায় কাফের বানিয়ে ফেলবে’ (আলে ইমরান ৩/১০০)।
তিনি আরো বলেন,وَدُّوْا لَوْ تَكْفُرُوْنَ كَمَا كَفَرُوْا فَتَكُوْنُوْنَ سَوَاءً- ‘তারা চায় তোমরা কাফের হয়ে যাও যেমন তারা কাফের হয়ে গেছে। যাতে তারা ও তোমরা সমান হয়ে যাও’ (নিসা ৪/৮৯)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَلاَ يَزَالُوْنَ يُقَاتِلُوْنَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوْكُمْ عَنْ دِيْنِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوْا- ‘বস্ত্ততঃ যদি তারা সক্ষম হয়, তবে তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।
৩. পরকালীন জীবনে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি হবে : আল্লাহর নির্দেশ উপেক্ষা করে কাফেরদের আনুগত্য করলে পরকালে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ وَيَتَعَدَّ حُدُوْدَهُ يُدْخِلْهُ نَارًا خَالِدًا فِيْهَا وَلَهُ عَذَابٌ مُهِيْنٌ- ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অবাধ্যতা করবে এবং তাঁর সীমাসমূহ লংঘন করবে, তিনি তাকে জাহান্নামে প্রবেশ করাবেন। সেখানে সে চিরদিন থাকবে। আর তার জন্য রয়েছে অপমানজনক শাস্তি’ (নিসা ৪/১৪)।
৪. আমলসমূহ বাতিল হয়ে যাবে : যারা আল্লাহর রাসূলের বিরোধিতা করে কাফেরদের অনুসরণ করে তাদের আমলসমূহ বাতিল হয়ে যাবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا وَصَدُّوْا عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَشَاقُّوْا الرَّسُوْلَ مِنْ بَعْدِ مَا تَبَيَّنَ لَهُمُ الْهُدَى لَنْ يَضُرُّوا اللهَ شَيْئًا وَسَيُحْبِطُ أَعْمَالَهُمْ- ‘নিশ্চয়ই যারা কুফরী করে ও মানুষকে আল্লাহর পথ থেকে বিরত রাখে এবং তাদের নিকট হেদায়াত স্পষ্ট হয়ে যাবার পরেও রাসূলের বিরোধিতা করে, তারা কখনোই আল্লাহর কোনরূপ ক্ষতি করতে পারবে না। আর আল্লাহ সত্বর তাদের সকল কর্ম বিনষ্ট করবেন’ (মুহাম্মাদ ৪৭/৩২)।
খ. ফরয বা ওয়াজিব আনুগত্য : মহান আল্লাহ, তদীয় রাসূল ও আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব। আল্লাহ বলেন,يَاأَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُوْلَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ- ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের’ (নিসা ৪/৫৯)।
১. আল্লাহর আনুগত্য : আল্লাহর আনুগত্য করা প্রত্যেক প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম ব্যক্তির উপরে ফরয (নিসা ৪/৫৯)। আল্লাহর আনুগত্যের ক্ষেত্রে কোন কিছু বাধা হয়ে দাঁড়ালে সেটা পরিহার করে আল্লাহর আনুগত্যের উপরে অটল থাকতে হবে। আল্লাহ বলেন,وَإِنْ جَاهَدَاكَ عَلَى أَنْ تُشْرِكَ بِي مَا لَيْسَ لَكَ بِهِ عِلْمٌ فَلَا تُطِعْهُمَا وَصَاحِبْهُمَا فِي الدُّنْيَا مَعْرُوفًا وَاتَّبِعْ سَبِيلَ مَنْ أَنَابَ إِلَيَّ ثُمَّ إِلَيَّ مَرْجِعُكُمْ فَأُنَبِّئُكُمْ بِمَا كُنْتُمْ تَعْمَلُوْنَ- ‘আর যদি পিতা-মাতা তোমাকে চাপ দেয় আমার সাথে কাউকে শরীক করার জন্য, যে বিষয়ে তোমার কোন জ্ঞান নেই, তাহ’লে তুমি তাদের কথা মানবে না। তবে পার্থিব জীবনে তাদের সাথে সদ্ভাব রেখে বসবাস করবে। আর যে ব্যক্তি আমার অভিমুখী হয়েছে, তুমি তার রাস্তা অবলম্বন কর। অতঃপর তোমাদের প্রত্যাবর্তন আমারই নিকটে। অতঃপর আমি তোমাদেরকে তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করব’ (লোক্বমান ৩১/১৫)।
২. রাসূলের আনুগত্য : রাসূলের আনুগত্য করাও ফরয। আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا أَطِيْعُوْا اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَلاَ تَوَلَّوْا عَنْهُ وَأَنتُمْ تَسْمَعُوْنَ- ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর এবং (এ বিষয়ে আল্লাহর নির্দেশ) শোনার পর তোমরা মুখ ফিরিয়ে নিয়ো না’ (আনফাল ৮/২০)। আর রাসূলের আনুগত্য করা হ’লে আল্লাহর আনুগত্য করা হয়। আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)।
৩. আমীরের আনুগত্য : আমীরের আনুগত্য করা ওয়াজিব (নিসা ৪/৫৯)।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ أَطَاعَنِى فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَانِى
فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمَنْ يُطِعِ الأَمِيْرَ فَقَدْ أَطَاعَنِى، وَمَنْ
يَعْصِ الأَمِيْرَ فَقَدْ عَصَانِى- ‘যে আমার আনুগত্য করল, সে আল্লাহর
আনুগত্য করল। আর যে আমার অবাধ্যতা করল সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। আর যে
ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য করল সে আমারই আনুগত্য করল, আর যে ব্যক্তি আমীরের
অবাধ্যতা করল সে আমারই অবাধ্যতা করল’।[1]
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্যের প্রভাব :
১. সফলতা ও কামিয়াবী হাছিল : আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর আনুগত্য করলে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলতা অর্জিত হবে। আল্লাহ বলেন,إِنَّمَا كَانَ قَوْلَ الْمُؤْمِنِيْنَ إِذَا دُعُوْا إِلَى اللهِ وَرَسُوْلِهِ لِيَحْكُمَ بَيْنَهُمْ أَنْ يَقُولُوْا سَمِعْنَا وَأَطَعْنَا وَأُولَٰئِكَ هُمُ الْمُفْلِحُوْنَ- ‘অথচ মুমিনদের কথা তো কেবল এটাই হ’তে পারে যে, যখন তাদেরকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ডাকা হয় তাদের মধ্যে ফায়ছালা করে দেওয়ার জন্য, তখন তারা বলবে, আমরা শুনলাম ও মেনে নিলাম। আর এরাই হ’ল সফলকাম’ (নূর ২৪/৫১)। তিনি আরো বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُوْلَهُ فَقَدْ فَازَ فَوْزًا عَظِيْمًا- ‘আর যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে, সে ব্যক্তি মহা সাফল্য অর্জন করে’ (আহযাব ৩৩/৭১)।
২. আল্লাহর পক্ষ থেকে হেদায়াত লাভ : আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করলে হেদায়াত লাভ হয়। আল্লাহ বলেন,قُلْ أَطِيْعُوا اللهَ وَأَطِيْعُوا الرَّسُولَ فَإِنْ تَوَلَّوْا فَإِنَّمَا عَلَيْهِ مَا حُمِّلَ وَعَلَيْكُمْ مَا حُمِّلْتُمْ وَإِنْ تُطِيْعُوْهُ تَهْتَدُوْا- ‘বল, তোমরা আল্লাহর আনুগত্য কর ও রাসূলের আনুগত্য কর। অতঃপর যদি তোমরা মুখ ফিরিয়ে নাও, তাহ’লে তার দায়িত্বের জন্য তিনি দায়ী এবং তোমাদের দায়িত্বের জন্য তোমরা দায়ী। আর যদি তোমরা তাঁর আনুগত্য কর তাহ’লে তোমরা সুপথ প্রাপ্ত হবে’ (নূর ২৪/৫৪)।
৩. জান্নাতে প্রবেশ করা : আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করলে জান্নাত লাভ হয়, যা মুমিনের চূড়ান্ত লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই মুমিন সদা সচেষ্ট থাকে। আল্লাহ বলেন, وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِيْنَ فِيْهَا وَذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে, তিনি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন, যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা’ (নিসা ৪/১৩)। তিনি আরো বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَرَسُولَهُ يُدْخِلْهُ جَنَّاتٍ تَجْرِيْ مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ وَمَنْ يَتَوَلَّ يُعَذِّبْهُ عَذَابًا أَلِيْمًا- ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে তিনি তাকে এমন জান্নাতে প্রবেশ করাবেন যার তলদেশ দিয়ে নদী সমূহ প্রবাহিত, আর যে ব্যক্তি পশ্চাদপসরণ করবে তিনি তাকে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি দিবেন’ (ফাতাহ ৪৮/১৭)।
৪. নবী-রাসূল ও শহীদদের সান্নিধ্য লাভ : যারা আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে তারা পরকালে নবী-রাসূল, শহীদ, ছিদ্দীক্ব ও সৎকর্মশীলদের সাথে থাকবে। আল্লাহ বলেন,وَمَنْ يُطِعِ اللهَ وَالرَّسُوْلَ فَأُولَئِكَ مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيْقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيْقًا- ‘বস্ত্ততঃ যে কেউ আল্লাহ ও রাসূলের আনুগত্য করে, তারা নবী, ছিদ্দীক্ব, শহীদ ও সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের সাথী হবে, যাদের প্রতি আল্লাহ অনুগ্রহ করেছেন। আর এরাই হ’লেন সর্বোত্তম সাথী’ (নিসা ৪/৬৯)।
আমীরের আনুগত্য না করার ক্ষতি :
১. জাহিলিয়াতের মৃত্যু : আমীরের
আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিলে জাহিলিয়াতের মৃত্যু হবে। রাসূল (ছাঃ) বলেন,
مَنْ خَرَجَ مِنَ الطَّاعَةِ وَفَارَقَ الْجَمَاعَةَ فَمَاتَ مَاتَ مِيتَةً
جَاهِلِيَّةً- ‘যে ব্যক্তি আমীরের আনুগত্য থেকে বের হয়ে যাবে এবং জামা‘আত
থেকে পৃথক হয়ে মারা যাবে সে ব্যক্তি জাহেলিয়াতের মৃত্যুবরণ করবে’।[2]
২. দলীল-প্রমাণ না থাকা : আমীরের
আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নিলে ক্বিয়ামতের দিন তার কোন দলীল থাকবে না।
রাসূল (ছাঃ) বলেন,مَنْ خَلَعَ يَدًا مِنْ طَاعَةٍ لَقِىَ اللهَ يَوْمَ
الْقِيَامَةِ لاَ حُجَّةَ لَهُ ‘যে ব্যক্তি তার হাতকে আনুগত্য থেকে মুক্ত
করে নিল, সে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর সাথে মিলিত হবে এমন অবস্থায় যে, তার
কোন দলীল থাকবে না’।[3]
আনুগত্যের স্বরূপ :
আল্লাহ সকল সৃষ্টির উপর মানুষকে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এ কারণে যে, মানুষ আনুগত্যশীল। হযরত আদম (আঃ) আল্লাহর নিকটে শিক্ষা গ্রহণ করে তাঁর আনুগত্যের মাধ্যমে ফেরেশতা ও জিন জাতির উপর মর্যাদাবান হয়েছিলেন। কিন্তু ইবলীস তার প্রভুর হুকুম না মেনে আনুগত্যহীন হয়ে অভিশপ্ত হয়েছিল। এ বিষয়ে পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে,
ثُمَّ قُلْنَا لِلْمَلَائِكَةِ اسْجُدُوا لِآدَمَ فَسَجَدُوا إِلَّا إِبْلِيْسَ لَمْ يَكُنْ مِنَ السَّاجِدِينَ، قَالَ مَا مَنَعَكَ أَلَّا تَسْجُدَ إِذْ أَمَرْتُكَ قَالَ أَنَا خَيْرٌ مِنْهُ خَلَقْتَنِي مِنْ نَارٍ وَخَلَقْتَهُ مِنْ طِيْنٍ، قَالَ فَاهْبِطْ مِنْهَا فَمَا يَكُونُ لَكَ أَنْ تَتَكَبَّرَ فِيْهَا فَاخْرُجْ إِنَّكَ مِنَ الصَّاغِرِيْنَ-
‘অতঃপর ফেরেশতাদের বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর। তারা সকলে সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আল্লাহ বললেন, আমি যখন তোমাকে নির্দেশ দিলাম, তখন কোন বস্ত্ত তোমাকে বাধা দিল যে, তুমি সিজদা করলে না? সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে সৃষ্টি করেছেন আগুন থেকে এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি থেকে। আল্লাহ বললেন, এ স্থান থেকে তুমি নেমে যাও। এখানে তুমি অহংকার করবে, তা হবে না। অতএব তুমি বের হয়ে যাও। তুমি লাঞ্ছিতদের অন্তর্ভুক্ত’ (আ‘রাফ ৭/১১-১৩)।
উক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হ’ল যে, ১. ইবলীস স্বীয় প্রভুর হুকুম অমান্যকারী ২. সে অকৃতজ্ঞ ও অবাধ্য ৩. সে অহংকারী ৪. সে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশকারী ৫. সে অপরকে তুচ্ছজ্ঞানকারী ৬. সে কলহপ্রিয় ও নেতার সাথে বিতর্ককারী এবং ৭. সে মিথ্যা কথা বলে মানুষকে ধোঁকা দানকারী।
ইবলীসের মধ্যে উপরোক্ত ঘৃণিত দোষগুলি থাকার কারণে আল্লাহ বললেন,اخْرُجْ مِنْهَا مَذْءُوْمًا مَدْحُوْرًا لَمَنْ تَبِعَكَ مِنْهُمْ لَأَمْلَأَنَّ جَهَنَّمَ مِنْكُمْ أَجْمَعِيْنَ- ‘তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও নিন্দিত ও বিতাড়িত অবস্থায়। (জেনে রেখো) তাদের মধ্যে যারা তোমার অনুসরণ করবে, নিশ্চয়ই আমি তোমাদের সকলের দ্বারা জাহান্নামকে পূর্ণ করব’ (আ‘রাফ ৭/১৮)।
আদমের স্বভাব :
মানবীয় উত্তম গুণাবলীতে আদম (আঃ) ভূষিত ছিলেন। তিনি ভুল করে অকপটে সে ভুল স্বীকার করেন। অহংকার করেননি। ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে নত হয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। যেমন আল্লাহ বলেন,
وَيَا آدَمُ اسْكُنْ أَنْتَ وَزَوْجُكَ الْجَنَّةَ فَكُلَا مِنْ حَيْثُ شِئْتُمَا وَلَا تَقْرَبَا هَذِهِ الشَّجَرَةَ فَتَكُوْنَا مِنَ الظَّالِمِيْنَ، فَوَسْوَسَ لَهُمَا الشَّيْطَانُ لِيُبْدِيَ لَهُمَا مَا وُوْرِيَ عَنْهُمَا مِنْ سَوْآتِهِمَا وَقَالَ مَا نَهَاكُمَا رَبُّكُمَا عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ إِلَّا أَنْ تَكُونَا مَلَكَيْنِ أَوْ تَكُونَا مِنَ الْخَالِدِيْنَ، وَقَاسَمَهُمَا إِنِّي لَكُمَا لَمِنَ النَّاصِحِيْنَ، فَدَلَّاهُمَا بِغُرُورٍ فَلَمَّا ذَاقَا الشَّجَرَةَ بَدَتْ لَهُمَا سَوْآتُهُمَا وَطَفِقَا يَخْصِفَانِ عَلَيْهِمَا مِنْ وَرَقِ الْجَنَّةِ وَنَادَاهُمَا رَبُّهُمَا أَلَمْ أَنْهَكُمَا عَنْ تِلْكُمَا الشَّجَرَةِ وَأَقُلْ لَكُمَا إِنَّ الشَّيْطَانَ لَكُمَا عَدُوٌّ مُبِيْنٌ، قَالَا رَبَّنَا ظَلَمْنَا أَنْفُسَنَا وَإِنْ لَمْ تَغْفِرْ لَنَا وَتَرْحَمْنَا لَنَكُونَنَّ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ، قَالَ اهْبِطُوْا بَعْضُكُمْ لِبَعْضٍ عَدُوٌّ وَلَكُمْ فِي الْأَرْضِ مُسْتَقَرٌّ وَمَتَاعٌ إِلَى حِيْنٍ، قَالَ فِيهَا تَحْيَوْنَ وَفِيْهَا تَمُوْتُوْنَ وَمِنْهَا تُخْرَجُوْنَ، يَا بَنِي آدَمَ قَدْ أَنْزَلْنَا عَلَيْكُمْ لِبَاسًا يُوَارِي سَوْآتِكُمْ وَرِيشًا وَلِبَاسُ التَّقْوَى ذَلِكَ خَيْرٌ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللهِ لَعَلَّهُمْ يَذَّكَّرُوْنَ-
‘আর হে আদম! তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখানে যা খুশী তোমরা খাও। তবে এই বৃক্ষটির নিকটবর্তী হয়ো না। তাহ’লে তোমরা সীমালংঘনকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে। অতঃপর তাদের লজ্জাস্থান যা পরস্পর থেকে গোপন ছিল তা প্রকাশ করে দেবার জন্য শয়তান তাদের কুমন্ত্রণা দিল এবং বলল, তোমাদের প্রতিপালক এই বৃক্ষ থেকে তোমাদের নিষেধ করেছেন কেবল এজন্যে যে, তাহ’লে তোমরা দু’জন ফেরেশতা হয়ে যাবে অথবা এখানে চিরস্থায়ী বসবাসকারী হয়ে যাবে। আর সে উভয়ের নিকট কসম করে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত। এভাবে তাদের দু’জনকে ধোঁকার মাধ্যমে সে ধীরে ধীরে ধ্বংসে নামিয়ে দিল। অতঃপর যখন তারা উক্ত বৃক্ষের স্বাদ আস্বাদন করল, তখন তাদের লজ্জাস্থান তাদের সামনে প্রকাশ হয়ে পড়ল। ফলে তারা জান্নাতের পাতাসমূহ দিয়ে তা ঢাকতে লাগল। এ সময় তাদের প্রতিপালক তাদের ডাক দিয়ে বললেন, আমি কি এই বৃক্ষ থেকে তোমাদের নিষেধ করিনি? আর আমি কি তোমাদের একথা বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তখন তারা উভয়ে বলল, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা আমাদের নিজেদের উপর যুলুম করেছি। এক্ষণে যদি আপনি আমাদের ক্ষমা না করেন ও দয়া না করেন, তাহ’লে অবশ্যই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ব। তিনি বললেন, তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের জন্য পৃথিবীতে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত আবাসস্থল ও ভোগ্যবস্ত্ত সমূহ রয়েছে। তিনি বললেন, সেখানেই তোমরা বাঁচবে ও মরবে এবং সেখান থেকেই তোমাদের বের করে আনা হবে। হে আদম সন্তান! আমরা তোমাদের উপর পোষাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি বেশভূষার উপকরণ সমূহ। তবে আল্লাহভীতির পোষাকই সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর নিদর্শন সমূহের অন্যতম। যাতে তারা উপদেশ গ্রহণ করে’ (আ‘রাফ ৭/১৯-২৬)।
উপরোক্ত বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হ’ল যে, মানুষ সৃষ্টিগতভাবেই আনুগত্যশীল, সংঘবদ্ধ ও প্রভুভক্ত। যাদের মধ্যে উক্ত গুণ নেই তারা শয়তানের বন্ধু। প্রিয় পাঠক! আপনি নিজেকে নিয়েই ভাবুন! যখন আপনি মার্তৃগর্ভ থেকে পৃথিবীতে আসলেন, তখন আপনি ছিলেন অসহায়। তাই চিৎকার করে সাহায্য চাইলেন। আপনার সাহায্যে এগিয়ে আসল প্রথমে আপনার মা, তারপর পিতা ও আত্মীয়-স্বজন। তাদের সাহায্যে আপনি ক্রমে ক্রমে বড় হয়ে ওঠলেন। পিতা-মাতার চাইতে অর্থে-বিত্তে, শক্তি সামর্থ্যে অনেক বড় হয়েও কিন্তু অসহায় অবস্থায় সাহায্যকারী পিতা-মাতার আনুগত্য ছিন্ন করেননি। দুর্বল পিতা যখন যে হুকুম করেছেন সঙ্গে সঙ্গে তা পালনে তৎপর হয়ে নিজেকে গর্বিত করেছেন। শয়তানী স্বভাব আপনার মধ্যে প্রবেশ করতে পারেনি। ঠিক তেমনি আপনি যখন নিরক্ষর ছিলেন- কথা বলতে পারতেন না, যাদের সহযোগিতায় লেখাপড়া শিখলেন, কথা বলে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হ’লেন, তাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা, আনুগত্য করা মানবীয় স্বভাব। অকৃতজ্ঞ হওয়া ও দল ছুট হওয়া শয়তানী স্বভাব। আমাদের মধ্যে যেন শয়তানী স্বভাব প্রবেশ না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
ছাহাবায়ে কেরামের আনুগত্যের স্বরূপ :
সম্মানিত পাঠক! আজ থেকে প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর পূর্বে মক্কার আকাবা পাহাড়ের সুড়ঙ্গের ঘটনা শুনুন! নেতার প্রতি আনুগত্যের নির্দেশ দিয়ে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
تُبَايِعُونِى عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ والنَّفَقَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَعَلَى الأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ وَأَنْ تَقُولُوْا فِى اللهِ لاَ تَخَافُونَ فِى اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُوْنِى فَتَمْنَعُوْنِى إِذَا قَدِمْتُ عَلَيْكُمْ مِمَّا تَمْنَعُوْنَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَزْوَاجَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ-
‘তোমরা আমার নিকটে এই
মর্মে বায়‘আত কর যে, সন্তুষ্টি ও অলসতায় তোমরা আমার হুকুম শুনবে ও আনুগত্য
করবে। সচ্ছল ও অসচ্ছলতায় সর্বদা আল্লাহর পথে ব্যয় করবে। সৎ কাজের আদেশ
দিবে ও অসং কাজের নিষেধ করবে। সর্বদা আল্লাহর পক্ষে কথা বলবে, কোন
নিন্দুকের নিন্দাবাদ পরোয়া করবে না। আমি যখন ইয়াছরিবে (মদীনায়) আগমন করব
তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে। তোমরা যেভাবে তোমাদের নিজেদের, সন্তানদের ও
স্ত্রীদের নিরাপত্তা দাও সেভাবে আমাকেও নিরাপত্তা দিবে।[4]
উবাদা বিন ছামেত (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন,
بَايَعْنَا رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ وَالْمَنْشَطِ وَالْمَكْرَهِ وَعَلَى أَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَعَلَى أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ وَعَلَى أَنْ نَقُولَ بِالْحَقِّ أَيْنَمَا كُنَّا لاَ نَخَافُ فِى اللهِ لَوْمَةَ لاَئِمٍ.
‘আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাতে আনুগত্যের বায়‘আত
নিয়েছিলাম এই মর্মে যে, আমরা নেতার কথা শ্রবণ করব এবং মান্য করব সচ্ছল
অবস্থায় হৌক অথবা অসচ্ছল অবস্থায় হৌক। আনন্দে হৌক অথবা অপসন্দে হৌক।
সন্তুষ্ট অবস্থায় হৌক অথবা অসন্তষ্ট অবস্থায় হৌক। আমাদের উপরে অন্যকে
প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রে হৌক। আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কখনোও ঝগড়া করব না।
যেখানেই থাকি সদা হক কথা বলব, আল্লাহর জন্য নিন্দুকের নিন্দাবাদকে পরোয়া
করব না’।[5]
৯ম হিজরীর একটি আনুগত্যের ঘটনা :
৯ম
হিজরীর রবীঊল আখের মাস। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জানতে পারলেন যে, হাবশার কিছু
নৌদস্যু জেদ্দা তীরবর্তী এলাকায় সমবেত হয়ে মক্কা আক্রমণের চক্রান্ত করছে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) শক্রদের চক্রান্তের কথা ঘোষণা দেওয়ার সাথে সাথেই
আলক্বামা তিনশত সৈন্যের এক বাহিনী নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। দ্বীপে
পৌঁছে দেখলেন দস্যুরা তাদের খবর পেয়ে পালিয়ে গেছে। আলক্বামা পলাতকদের
বিরুদ্ধে আব্দুল্লাহ বিন হুযায়ফাকে সৈন্যসহ প্রেরণ করেন। হুযায়ফা রাস্তায়
এক স্থানে অবতরণ করেন। সেখানে তিনি একটি অগ্নিকুন্ড তৈরী করেন এবং তাঁতে
সৈন্যদের ঝাঁপ দিতে বলেন। সৈন্যরা ঝাঁপ দিতে উদ্যত হ’লে তিনি
বললেন,أَمْسِكُوْا عَلَى أَنْفُسِكُمْ فَإِنَّمَا كُنْتُ أَمْزَحُ
مَعَكُمْ، ‘থাম! হে সৈন্যগণ! আমি তোমাদের সাথে ঠাট্টা করছিলাম’। মদীনায় এসে
একথা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জানালে তিনি বললেন,لَوْ دَخَلُوْهَا مَا
خَرَجُوا مِنْهَا إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ ‘যদি তারা আগুনে প্রবেশ করত
তাহ’লে তারা ক্বিয়ামত পর্যন্ত সেখানেই থাকত’। এরপর তিনি বলেন, لاطاعة في
معصية الله إنما الطاعة في المعروْف ‘আল্লাহর অবাধ্যতায় কোন আনুগত্য নেই।
আনুগত্য কেবল ন্যায় কর্মে’।[6]
‘আহলেহাদীছ
আন্দোলন’ চায় এমন কিছু নেতা-কর্মী যারা ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের প্রতি সর্বদা
আনুগত্যশীল থাকবে। হুকুম মানার জন্য সর্বদা প্রস্ত্তত থাকবে। দুনিয়াবী
লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে অবস্থান করবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,تَعِسَ عَبْدُ
الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيْصَةِ، إِنْ أُعْطِىَ
رَضِىَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ ‘ধ্বংস হৌক দীনার ও দিরহামের গোলামেরা,
যাদেরকে কিছু দিলে খুশি হয়। না দিলে অখুশি হয়। আর জান্নাতের সুসংবাদ ঐ
বান্দাদের জন্য, যে তার ঘোড়া নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় সদা প্রস্ত্তত থাকে। যদি
তাকে পাহারা দিতে বলা হয় সে পাহারা দেয়। যদি তাকে পিছনে থাকতে বলা হয় সে
পিছনে থাকে। সে ছুটি চাইলে ছুটি দেওয়া হয় না। সে কারোর জন্য সুপারিশ করলে
তাও কবুল করা হয় না। তবুও সে নেতার আদেশে আল্লাহর রাস্তায় সদা প্রস্ত্তত
থাকে’।[7]
আনুগত্যের অনুপম দৃষ্টান্ত :
দামেশক, জর্ডান, মিশর, মুসলমানদের অধীনে চলে আসলে রোম সম্রাট রডারিক রাগান্বিত হয়ে তার ভাই থিওডোরাসের নেতৃত্বে আর্মেনীয়, সিরীয়, মিশরীয়, রোমান ও আরব গোত্রীয় খৃষ্টানদের সমন্বয়ে দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার সৈন্য নিয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইয়ারমুক ময়দানে উপস্থিত হয়। এদিকে হযরত আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) খালেদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে ৩৫ হাযার সৈন্য তাদের প্রতিরোধের জন্য প্রেরণ করেন। সৈন্য প্রেরণের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) মৃতবরণ করেন। ওমর ফারূক (রাঃ) খলীফা হন। তিনি শুনতে পেলেন- মদীনার মুসলমানগণ বলাবলি করছে, যেহেতু খালেদ সাইফুল্লাহ সেনাপতি, তাই জয় সুনিশ্চিত। ওমর ফারূক (রাঃ) মুসলমানদের গোপন শিরক থেকে রক্ষা করার জন্য এবং বিজয় একমাত্র আল্লাহর হাতে তা প্রমাণ করার জন্য এক ফরমান জারী করলেন।
৬৩৬ খৃঃ ২০শে আগষ্ট ইয়ারমুক ময়দানে তুমুল যুদ্ধ চলছে। খৃষ্টানদের ৭০ হাযার নিহত সৈন্যের রক্ত ও মুসলিম বাহিনীর তিন হাযার শহীদের রক্তে ইয়ারমুক ময়দান লালে লাল। ভীষণ যুদ্ধ, তরবারির আঘাতে যেন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। এমন সময় মুসলিম আমীরের ফরমান খালিদ বিন ওয়ালিদের হাতে। ‘আপনাকে সেনাপতির পদ থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হ’ল। তদস্থলে আবু ওবায়দা বিন জাররাহকে সেনাপতি নিয়োগ করা হ’ল’। ফরমান পাঠ মাত্রই সেনাপতির মুকুট খুলে আবু ওবায়দার মাথায় পরিয়ে দিয়ে পূর্বের চেয়ে বিপুল উদ্যমে যুদ্ধের ময়দানে ঝাঁপিয়ে পড়লেন খালিদ বিন ওয়ালিদ। দুই লক্ষ চল্লিশ হাযার খৃষ্টান সৈন্যকে পরাজিত করে মুসলমানদের বিজয় ছিনিয়ে এনে খালিদ বিন ওয়ালিদ আমীরের আনুগত্যের যে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ক্বিয়ামত পর্যন্ত মানুষের মনের মণিকোঠায় তা অমর হয়ে থাকবে।
প্রিয় পাঠক! এবার আর্থিক আনুগত্যের দৃষ্টান্ত দেখুন! ৯ম হিজরীর রজব মাসে গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে মদীনা থেকে ৭৭৮ কিলোমিটার দূরে তাবূক প্রান্তরে অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি রোম সম্রাটের গোপন ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবনের শেষ অভিযান। রোমকদের ৪০,০০০ (হাযার) সৈন্যের বিরুদ্ধে মুসলিম সৈন্য ৩০,০০০ হাযার। যাতায়াতের জন্য ৩০ দিন ও ২০ দিন অবস্থানের জন্য বিপুল খরচের এই অভিযানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিহাদ ফান্ডে দানের ঘোষণা দিলেন। ঘোষণা শোনামাত্র আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ) তাঁর সমস্ত সম্পদ জিহাদ ফান্ডে জমা দিলেন। বলা হ’ল তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ? দৃঢ়তার সাথে উত্তর দিলেন আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-কে। ওমর ফারূক (রাঃ) তাঁর অর্ধেক সম্পদ নিয়ে এলেন। ওছমান গণী (রাঃ) ৯০০ উট, গদি ও হাওদা সহ ১০০ ঘোড়া, সাড়ে পাঁচ কেজি স্বর্ণমুদ্রা, ২৯ কেজি রৌপ্য মুদ্রা দান করলেন। এই বিপুল স্বর্ণমুদ্রা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উল্টে পাল্টে দেখছেন আর বলছেন, مَا ضَرَّ ابْنَ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ، يُرَدِّدُهَا مِرَاراً ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ইবনু আফফানের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারবে না’ (মুসনাদে আহমাদ হা/২০৬৪৯)। তিনি তাকে যোগানদাতা খেতাব দেন (مُجْهِزُ جَيْشِ الْعُسْرَةِ)। তাবূক যুদ্ধের রসদ সংগ্রহকালে আছেম বিন আদী ১৩,৫০০ কেজি খেজুর জমা দেন। এ সময় উমায়রাহ দুই ছা‘, আবু খায়ছামা ১ ছা‘, আবু আকিল অর্ধ থলি খেজুর নিয়ে হাযির হন। আবু আকিল বলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমি সারা রাত দুই ছা‘ খেজুরের বিনিময়ে অন্যের জমিতে পানি সেচ করেছি। ১ ছা‘ বাড়ীর জন্য ও এক ছা‘ এখানে এনেছি। আল্লাহর রাসূল বললেন, খেজুরগুলি সমস্ত স্তূপের উপর ছড়িয়ে দাও। তারপর দো‘আ করলেন,بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি এনেছ এবং যা তুমি পরিবারের জন্য রেখেছ’। সবশেষে আব্দুর রহমান বিন আওফ এসে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! ছাদাক্বাকারী কি কেউ বাকী আছে? আল্লাহর রাসূল বললেন, না। তখন তিনি মোট ৮০০০ দিরহামের অর্ধেক ৪০০০ দিরহাম এনে রাখলেন। আর বললেন, আমি আমার পরিবারের জন্য রাখলাম ৪০০০ দিরহাম এবং আমার প্রতিপালককে ঋণ দিলাম ৪০০০ দিরহাম। আল্লাহর রাসূল খুশি হয়ে দো‘আ করলেন,بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘তুমি যা দিয়েছ এবং যা রেখেছ আল্লাহ তাতে বরকত দিন’। এভাবে কমবেশী দানের স্রোত চলতে থাকল। মহিলারা তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, নাকের ফুল, পায়ের অলংকার, কানের রিং-আংটি ইত্যাদি যার যা ছিল, তাই খুলে দিয়ে আর্থিক আনুগত্যের চরম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন।
অসুস্থতা, দরিদ্রতা, বাহন সংকট প্রভৃতি
কারণে যারা জিহাদে যেতে পারেননি, তারা জান্নাত লাভের এই মহা সুযোগ হারানোর
বেদনায় কাঁদতে থাকেন। উলবাহ বিন যায়েদ সারা রাত ছালাত আদায় করেন আর কাঁদেন,
হে আল্লাহ! তুমি জিহাদের নির্দেশ দিয়েছ এবং তাতে উৎসাহিত করেছ। কিন্তু
আমার তো কিছু নেই, যা দিয়ে আমি তোমার রাসূলের সাথে যাব। হে আল্লাহ! ইসলাম
গ্রহণের কারণে আমার উপরে যে যুলুম হয়েছে তার প্রতিটি যুলুমের বিনিময়ে
প্রত্যেক মুসলমানের উপর আমার ছাদাক্বা কবুল কর। ফজরের ছালাতের পর
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আজ রাতে ছাদাক্বাকারী কোথায়? কেউ
দাঁড়াল না। তিন বার বলার পর ঐ ব্যক্তি দাঁড়িয়ে সব ঘটনা বললে রাসূল (ছাঃ)
বললেন,أَبْشِرْ فَوَاَلَّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ لَقَدْ كُتِبَتْ فِي
الزَّكَاةِ الْمُتَقَبَّلَةِ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর যার হাতে মুহাম্মাদের
জীবন, তার কসম করে বলছি, তোমার ছাদাক্বা আল্লাহ কবুল করেছেন। অন্য বর্ণনা
আছে তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে (قَدْ غُفِرَ لَهُ)।[8]
জীবন ও সম্পদ সবকিছুর চেয়ে ঈমানের হেফাযতের জন্য নেতার আদেশ পালনে নিবেদিতপ্রাণ হওয়া যে সর্বাধিক যরূরী, তার সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত দেখা গেছে তাবূক যুদ্ধের গমনকারী শাহাদত পাগল মুজাহিদগণের মধ্যে। ইসলামী বিজয়ের জন্য সর্বযুগে এরূপ নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী একান্তই দরকার।
আনুগত্য ও তওবার এক অনন্য দৃষ্টান্ত :
তাবূক যুদ্ধে ৫০ দিন অতিবাহিত করে বিজয়ী বেশে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) মদীনায় ফিরে প্রথমে মসজিদে নববীতে দু’রাক‘আত নফল ছালাত আদায় করে সাধারণ জনগণের সাথে দেখা করার জন্য বসেন। এ সময় ৮০ জন লোক যুদ্ধে গমন না করার জন্য ওযর পেশ করে ক্ষমা নিয়ে চলে যায়। আনছারদের তিন জন শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব স্রেফ সাময়িক বিচ্যুতির কারণে যুদ্ধে গমন থেকে পিছিয়ে ছিলেন। (১) কা‘ব বিন মালেক (২) মুরারাহ বিন রবী‘ (৩) হেলাল বিন উমাইয়া। তারা তিন জন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কাছে গিয়ে সত্য কথা বলে ক্ষমা চান। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদের ক্ষমার বিষয়টি আল্লাহর উপর ছেড়ে দিয়ে তাদেরকে বয়কট করেন। আপনজন, বন্ধু-বান্ধব, কেউ তাদের দিকে ফিরে তাকায় না। কথাও বলে না, সালাম দিলে জবাব দেয় না। মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। এই দুর্বিসহ জীবনে দুঃখ-বেদনায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হওয়ার উপক্রম। ৪০ দিনের মাথায় তাদের স্ত্রীগণও তাদের থেকে পৃথক হয়ে পিতার বাড়ী চলে যায়। জীবনের এই সংকটাপন্ন অবস্থায় তারা সর্বদা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে কেঁদে কেঁদে বুক ভাষায়। এমন সময় গাসসান অধিপতি কা‘ব বিন মালেকের নিকটে সহানুভূতি দেখিয়ে পত্র লিখে যে, হে কা‘ব ইবনে মালেক! আমরা জানতে পেরেছি, তোমাদের আমীর তোমাকে উপেক্ষা করেছে, তোমাকে বয়কট করে কষ্ট দিচ্ছে। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছনা ও অবমাননার জন্য রাখেননি, তুমি আমাদের কাছে চলে এসো। আমরা তোমাকে খেয়াল রাখব এবং যথোপযুক্ত সম্মান দিব’। পত্র পড়েই কা‘ব বলেন, এটাও আমার জন্য একটি পরীক্ষা। তিনি পত্রটা জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষেপ করে দুনিয়ার সমস্ত সম্মান আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে ওয়াসওয়াসা দানকারী শয়তানকে পরাজিত করে আমীরের আনুগত্য ও তওবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। অতঃপর আল্লাহ তার আনুগত্য ও ধৈর্য দেখে খুশি হয়ে আয়াত নাযিল করেন,
وَعَلَى الثَّلَاثَةِ الَّذِيْنَ خُلِّفُوا حَتَّى إِذَا ضَاقَتْ عَلَيْهِمُ الْأَرْضُ بِمَا رَحُبَتْ وَضَاقَتْ عَلَيْهِمْ أَنْفُسُهُمْ وَظَنُّوا أَنْ لَا مَلْجَأَ مِنَ اللهِ إِلَّا إِلَيْهِ ثُمَّ تَابَ عَلَيْهِمْ لِيَتُوبُوا إِنَّ اللهَ هُوَ التَّوَّابُ الرَّحِيْمُ-
‘আর ঐ তিন ব্যক্তির প্রতি, যারা (জিহাদ থেকে) পিছনে ছিল। অবশেষে প্রশস্ত পৃথিবী তাদের জন্য সংকুচিত হয়ে গেল এবং তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে উঠল। আর তারা বুঝতে পারল যে, আল্লাহ ব্যতীত তাদের আর কোন আশ্রয়স্থল নেই। অতঃপর তিনি তাদের প্রতি সদয় হ’লেন যাতে তারা ফিরে আসে। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও অসীম দয়ালু’ (তওবা ৯/১১৮)। আল্লাহর ক্ষমাপ্রাপ্ত এই তিনজন বিখ্যাত আনছার ছাহাবী হলেন, কা‘ব বিন মালেক, মুরারাহ বিন রবী‘ ও হেলাল বিন উমাইয়া। দীর্ঘ ৫০ দিন পরে তাদের তওবা কবুল হয়। এই দিনগুলিতে রাসূল (ছাঃ) সহ সকল ছাহাবী তাদেরকে বয়কট করেন এবং কথাবার্তা ও যাবতীয় লেনদেন বন্ধ রাখেন।
আয়াত
নাযিলের সাথে সাথে মুসলমানদের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। সকলেই
দান-ছাদাক্বায় লিপ্ত হ’লেন। কা‘ব বিন মালেক বলেন, ‘আমি নিঃসঙ্গভাবে
দুঃখ-বেদনায় ঘরের ছাদে বসে বুক ফাঁটিয়ে কাঁদছি। এমন সময় দূর থেকে ভেসে আসল
يَا كَعْبَ بْنَ مَالِكٍ أَبْشِر ‘হে কাব বিন মালেক! সুসংবাদ গ্রহণ কর’।
কা‘ব বলেন, এ সংবাদ শুনে আমি সিজদায় পড়ে যাই। চারিদিক থেকে বন্ধু-বান্ধব
ছুটে আসে অভিনন্দন জানাতে থাকে। আমি দৌড়ে রাসূলের দরবারে গিয়ে জিজ্ঞেস
করলাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এ ক্ষমা কি আপনার পক্ষ থেকে না আল্লাহর
পক্ষ থেকে? তিনি বললেন, আল্লাহর পক্ষ থেকে। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল
(ছাঃ)! এর শুকরিয়া স্বরূপ আমার সমস্ত সম্পদ আল্লাহর রাস্তায় ছাদাক্বা করে
দিলাম’।[9]
আলোচ্য হাদীছে নেতার প্রতি আনুগত্যের চূড়ান্ত দৃষ্টান্ত পরিস্ফূট হয়ে ওঠেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ও ছাহাবীদের বয়কট সত্ত্বেও তারা বিদ্রোহ তো দূরে থাক সামান্যতম বিরোধিতা বা সমালোচনারও দুঃসাহস দেখাননি। এমনকি এ সময়ে গাসসান অধিপতির লিখিত লোভনীয় প্রস্তাবকেও আগুণে নিক্ষেপ করে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর আনুগত্যের উপর দৃঢ় থেকেছেন। আর মহান আল্লাহর কাছে কেঁদেকেটে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ইসলামী আন্দোলনের কর্মীদের বৈশিষ্ট্য এ রকমই হওয়া উচিত।
পরিশেষে বলব, অনুকূল-প্রতিকূল যেকোন অবস্থাই হোক না কেন নেতার প্রতি আনুগত্য বজায় রেখে দাওয়াতী কাজ করে যেতে হবে। এতে পার্থিব ও পরকালীন জীবন কল্যাণময় হবে। আল্লাহ আমাদের সকলকে নেতৃত্বের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা ও আনুগত্য বজায় রাখার তাওফীক্ব দান করুন-আমীন!
[1]. বুখারী হা/২৯৫৭, ৭১৩৭; মুসলিম হা/১৮৩৫; মিশকাত হা/৩৬৬১।
[2]. মুসলিম হা/১৮৪৮; মিশকাত হা/৩৬৬৯।
[3]. মুসলিম হা/১৮৫১; মিশকাত হা/৩৬৭৪।
[4]. মুসনাদে আহমাদ হা/১৪৪৯৬, ছহীহাহ হা/৬৩।
[5]. মুসলিম হা/৪০৭৪; মিশকাত ৩৬৬৬।
[6]. বুখারী হা/৭২৫৭; মুসলিম হা/১৮৪০; যাদুল মা‘আদ পৃঃ ৪৫০।
[7]. মিশকাত হা/৫১৬৯।
[8]. যাদুন মা‘আদ ৩/৪৬২ সনদ ছহীহ।
[9]. বুখারী হা/৪৪১৮; মুসলিম হা/২৭৬৯।