থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেব- বলেই তেড়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেলেন মসজিদ কমিটির জনৈক দায়িত্বশীল। রাগ-ক্ষোভকে বুকেই চাপা দিয়ে অশ্রুসজল চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলেন ইমাম ছাহেব। তার অপরাধ বিদ‘আতের বিরুদ্ধে আপোষহীন থাকা। বিচারটা মহান আল্লাহর কাছেই হয়তো দিলেন (আল্লাহু আ‘লাম)।
তিনি একাধারে ক্লিনার, খাদেম, মুওয়াযযিন, ইমাম ও খত্বীব। অর্থাৎ মসজিদের সব কাজই করেন। ষাটের কোঠায় বয়স। স্ত্রী, কলেজ-মাদ্রাসায় পড়ুয়া চার সন্তান নিয়েই তার চলমান সংসার। ইসলামী শিক্ষার সামান্য জ্ঞান নিয়েই তিনি বর্তমানে মাসিক ৭০০০ টাকা বেতনে মসজিদের পূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন। বাদ আছর কুরআন শিক্ষা দিয়ে হাদিয়া স্বরূপ টেনেটুনে মাস শেষে আরও হয়তো সর্বোচ্চ ২,০০০ টাকা যোগ করেন।
যে মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব পালন করেন সমাজটি মূলত আহলেহাদীছ (পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের অনুসারী) হিসাবেই পরিচিত। সমাজের ঊর্ধ্বতন পুরুষ বহু বছর পূর্বে সঊদী আরব থেকে হজ্জব্রত পালন শেষে মাযহাব ত্যাগ করে দেশে ফিরে আহলেহাদীছ মসজিদ আবাদ ও সমাজ সংস্কার করেন। কালের বিবর্তনে আজকে এই সমাজের মসজিদের ইমাম হ’লেন আলোচ্য দ্বীনি ভাই। নিজেদের আহলেহাদীছ হিসাবে পরিচয় দেওয়া সমাজের অধিকাংশ পরিবারই শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত। তবে সময়ের পরিক্রমায় অন্যান্য শ্রেণী-গোষ্ঠীর সাথে বিচরণ ও আত্মীয়তার কারণে এই সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে শিরক-বিদ‘আত বিদ্যমান। স্রোতের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে ইমাম ছাহেব একাই সাধ্যমতো পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে সমাজ সংস্কারে আহবান জানান এবং নিজেও দৃঢ় থাকার চেষ্টা করেন। এই দৃঢ়তার কারণেই তাকে বিভিন্নভাবে অপমান এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সহ্য করে দিনাতিপাত করতে হয়। তিন দিনা, চল্লিশা, বিবাহ ও মাযহাবের নামে বিবিধ শিরক-বিদ‘আতী অনুষ্ঠানগুলোতে তাকে যখন দাওয়াত দেয়া হয়, তিনি সেদিন ছিয়াম রাখার, রাতে শরীর অসুস্থ থাকার কথা বলে তা পরিহার করেন। ছিয়ামের কথা জেনে লোকেরা খাবার না পাঠানোতে দিন-রাতগুলোতে কোন বেলা শুধু মুড়ি খেয়ে বা না খেয়েও অতিবাহিত করেন। অথচ কাউকে এ সম্পর্কে অবহিত করার চেষ্টাও করেন না!
সমাজের কোন ভাই-বোন কোন কোন সময় কিছু আর্থিক সাহায্য পাঠান। তিনি সেই টাকাগুলো দিয়ে বিভিন্ন ইসলামী বই ক্রয় করে সমাজের মাঝে বিতরণ করেন, যাতে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলোকে তারা নিজেদের সংশোধন করে নিতে পারেন। অথচ সামান্য বেতনে তার ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবন অভাব-অনটনে তাদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। পারিবারিক চাহিদা না মেটানোর দায়ে নিজের স্ত্রী-সন্তানদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও হজম করতে হয় অধিকাংশ সময়ে। প্রতিটি জুম‘আর দিনে ছালাত আদায়ের শেষেই তাকে বিনীত স্বরে মুছল্লীদের লক্ষ্য করে বিগত মাসগুলোর বেতনের বকেয়া অংশ পরিশোধের তাকীদ দিতে হয়। মাসশেষে যেখানে বেতন দেয়াই নিয়ম। অথচ সামান্য অর্থও মাসের পর মাস অনেকেই বাকী রাখেন। মুছল্লীদের কেউ কেউ তো তাচ্ছিল্য করে বলেও ফেলেন হুজুর এত টাকা টাকা করেন কেন? এসব মুছল্লীগণ মাসের প্রথম দিকে বেতন পরিশোধ না করে মাসের পর মাস বকেয়া রাখতে লজ্জিত হন না। অথচ বেতন চাইলে তাদের আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়!
সমাজ ও সমাজের বাইরের কোন নির্যাতিত আহলেহাদীছ ভাই যখনই সহায়তার জন্য ইমাম ছাহেবের কাছে আসেন, তিনি সেই ভাইয়ের সাহায্যার্থে নিজের বেতনের একটা অংশ তো দেনই সাথে সমাজের ও পরিচিত অন্য ভাইদের দ্বারে দ্বারে হাত পেতে অর্থ সংগ্রহ করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেন। মুছল্লীদের কেউ কেউ তাকে প্রশ্ন করেন আপনার নিজেরই কত সমস্যা তো একটু আপোষ করলে, মুনাজাত ধরলে তো ক্ষতি নেই। আর্থিক সহায়তার দ্বারও খুলে যায় সমাজের বৃহৎ অংশের নিকট বিরাগভাজন হওয়া থেকে নিরাপদে থাকতে ও ভালোভাবে পরিবার নিয়ে চলতে পারেন। উত্তরে মৃদু হেসে বলেন, সামান্য আপোষের কারণে আমার সৎআমলগুলো যে ভাই নষ্ট হয়ে যাবে! অভাব-কষ্ট তো পূর্বসূরীদের থেকে প্রাপ্ত। তারা আমার থেকেও অনেকগুণ বেশী দরিদ্রতা, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন সহ্য করেছেন, তাদের তুলনায় এটাতো ধূলাকণার সমানও নয়। শিরক-বিদ‘আত করে উপার্জিত অর্থ কার জন্য রেখে যাব? ইবাদতও কি কবুল হবে? অথচ আমার কবরে আমার একাই যেতে হবে। যে কোন কাজের নিয়তটাই মুখ্য। আমি কোন নিয়তে ইবাদত ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কাজ করছি সেটাই তো বিবেচ্য বিষয় ভাই! আমার অভাব-অভিযোগ আমি আমার প্রতিপালকের নিকটেই জানাই এবং সাহায্য তাঁর কাছেই প্রার্থনা করি। জীবন চলার পথে একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারবেন অনেকেই শারিরীক বিভিন্ন অসুস্থতা নিয়ে সময় অতিবাহিত করছেন। কারো দু’টো হাত বা পা নেই, কারো দু’টো চোখ অন্ধ, আবার কারো বিবিধ সমস্যা। আলহামদুলিল্লাহ! মহান আল্লাহ তো আমাকে, আমার পরিবারের সদস্যদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুস্থ রেখেছেন।
ফেলে আসা সময়ের একটা অংশে আমি মাযহাবী ছিলাম। তখন মীলাদ, সভা-সেমিনার, তাবীয-কবয ইত্যাদি দিয়ে ভালো পয়সা আয় করছিলাম। সাথে পেতাম সালাম ও সম্মান। মহান আল্লাহর রহমতে যেদিন থেকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আলো পেয়েছি, সেদিন থেকেই কুরআন ও ছহীহ হাদীছ অনুযায়ী আমল করার প্রয়াস পাচ্ছি। সেই সাথে নিজেকে সংশোধন করার চেষ্টা করে অপরকে দাওয়াত দেয়া শুরু করেছি। সেদিন থেকেই পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনও সাধারণ মানুষের দ্বারা বিভিন্নভাবে মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার সহ্য করছি। বিনিময়ে মহান আল্লাহর রহমতে ঈমানের যে স্বাদ আমি পেয়েছি তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। হক্বের দাওয়াত দেওয়াটা সহজ কিন্তু হকের উপরে দৃঢ় থাকাটা কঠিন। মহান আল্লাহর কাছে দৃঢ় থাকার তাওফীক কামনা করছি।
মসজিদ কমিটির ঐ দায়িত্বশীল পরের দিন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে হা-হুতাশ করতে করতে স্ত্রীকে বলছেন, আমি গতকাল রাতে ইমাম ছাহেবের সাথে দুর্ব্যবহার করেছি, মারতে উদ্ধত হয়ে সম্মুখে এগিয়ে গিয়েছি। তাতেই কি অসুস্থ হয়ে গেলাম? স্ত্রী উত্তরে বললেন, এটা আপনি কি করেছেন? হুজুরকে মারার জন্য গেলেন কেন? হয়তো ছালাতে তিনি আল্লাহর কাছে বিচার দিয়েছেন এবং তার দো‘আ কবুল হয়ে গিয়েছে। আপনি এখনি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিন। অসুস্থ শরীর নিয়েই ঐ দায়িত্বশীল ব্যক্তি ইমাম ছাহেবের কাছে এসে হাতদু’টি ধরলেন, মিনতির স্বরে ক্ষমা চাইলেন। বিস্মিত ইমাম ছাহেব ক্ষমার বাক্যগুলো আওড়াচ্ছেন আর হৃদয়ের গভীর থেকে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছেন, যিনি আমাদের প্রতিপালক! আমাদের সকল সুখ-দুঃখ ও আবেদন-নিবেদন তাঁর কাছেই। তিনিই মাযলূমের দো‘আ শ্রবণ করেন ও কবুল করেন এবং যালেমকে লাঞ্ছিত করেন। আল্লাহ আমাদের সবাইকে হকের উপরে অবিচল রাখুন-আমীন!