পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । শেষ পর্ব ।
অনুসৃত ইমামগণ ও উক্ত আয়াতের তাফসীর :
আল্লামা আলবানী (রহঃ) এই হাদীছটির অধীনে তাফসীরে রূহুল মা‘আনী হ’তে আল্লামা আলূসীর নিম্নোক্ত উক্তিটি বর্ণনা করেছেন-
‘তার
রব বানানোর দৃষ্টান্ত এ কথা বলা যে, অমুক অমুকের ইবাদত করে। (এটা সে সময়
বলা হয়) যখন তার আনুগত্যে সীমা অতিক্রম করা হয়। এটা হ’ল ইসতি‘আরাহ (রূপক)।
যেখানে আনুগত্যকে ইবাদতের সাথে সাদৃশ্য দেওয়া হয়েছে। অথবা তার উপর ইবাদত
শব্দটির প্রয়োগ মাজাযে মুরসাল বা রূপকভাবে করা হয়েছে। আর শর্তহীন আনুগত্য
(দ্বারা) নির্দিষ্ট আনুগত্য (উদ্দেশ্য)। প্রথম কথাটি বেশী স্পষ্ট। আর এটাও
বলা হয়েছে যে, তাদেরকে রব বানানো বলতে এটা উদ্দেশ্য যে, তারা তাদেরকে (সৎ
লোকদেরকে) সিজদা করত। যা স্রেফ আল্লাহর জন্যই করা সঠিক। এভাবে (ব্যাখ্যা
করলে) এটা রূপকার্থে নয়। রাসূল (ছাঃ) হ’তে ছহীহ হাদীছ পাওয়ার পর এতে কারো
কথা বলার সুযোগ নেই। (তাদেরকে রব বানাত) এই আয়াতে গোমরাহ ফিরক্বাগুলিকে
ভৎর্সনা করা হয়েছে। যারা তাদের আলেম ও নেতাদের কথার ভিত্তিতে আল্লাহর
কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত হ’তে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। অথচ সত্যের অনুসরণ
অপরিহার্য। সুতরাং যখন হক্ব প্রকাশ পেয়ে যাবে তখন মুসলিমের উপর তার আনুগত্য
করা ওয়াজিব। যদিও স্বীয় অনুসৃত ইমামের ইজতিহাদকে ভুল আখ্যা দিতে হয়’।[1]
সামনে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে এটা দেখুন যে, আল্লামা আলূসী যিনি এই হাদীছকে ছহীহ বলে মন্তব্য করেছেন, শায়খ শু‘আইব বা তার অনুবাদক একে বিলুপ্ত করে দিয়েছেন। যেন বাহ্যিকভাবে এই ধারণা প্রকাশিত না হয়ে যায় যে, আল্লামা আলূসী (রহঃ) এই হাদীছকে ছহীহ বলে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমরা তো তার ভুল বের করছি।
শায়খ
শু‘আইব বলেছেন যে, এই হাদীছটি দ্বারা শায়খ আলবানী (রহঃ) অনুসৃত ইমামদের
সমালোচনা করতেন। অথচ আলেম ও মাশায়েখদেরকে রব বানানো এবং মুজতাহিদ ইমামদের
তাক্বলীদ-এর মধ্যে বড় পার্থক্য রয়েছে। এজন্য যে, ইহূদী-নাছারাদের আলেমগণ তো
আল্লাহর হারামকৃত বস্ত্তসমূহকে তাদের জন্য হালাল আখ্যা দিত। পক্ষান্তরে এই
ইমামগণ স্বীয় ইজতিহাদে কিতাব ও সুন্নাতের উপর নির্ভর করতেন। সুতরাং যার
ইজতিহাদ সঠিক হবে তার জন্য দ্বিগুণ পুরস্কার রয়েছে। আর যার থেকে ভুল সংঘটিত
হবে তার জন্যও একটি পুরস্কার রয়েছে। এই আলেমদেরকে ইহূদী-নাছারাদের আলেমদের
সাথে তুলনা করা দারুণ অন্যায়। এই বিষয়ে তার সাথে আমার আলোচনাও হয়েছে।[2]
কিন্তু এটাও আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর উপর অপবাদ যে, তিনি এই হাদীছটি দ্বারা অনুসৃত ইমামদের সমালোচনা করতেন। শায়খ শু‘আইব তার সাথে কি আলোচনা করেছেন এবং তার ফলাফল কি হয়েছে তা তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু যে কথা তিনি আল্লামা আলবানীর দিকে সম্পর্কিত করেছেন তার সত্যতা আল্লামা আলবানীর নিম্নোক্ত ভাষ্য দ্বারা করা যেতে পারে। যা তিনি আল্লামা শা‘রানীর ‘মীযানুল কুবরা’ এবং মাওলানা আব্দুল হাঈ লাক্ষ্ণৌবীর ‘আন-নাফে‘উল কাবীর’-এর ইবারতের পর লিখেছেন,
فَإِذَا كَانَ هَذَا عُذْرُ أَبِيْ حَنِيْفَةَ فِيْمَا وَقَعَ مِنْهُ مِنَ الْمُخَالَفَةِ لِلْأَحَادِيْثِ الصَّحِيْحَةِ دُوْنَ قَصْدٍ وَهُوَ عُذْرٌ مَقْبُوْلٌ قَطْعاً؛ لِأَنَّ اللهَ تَعَالَى لَا يُكَلِّفُ اللهُُ نَفْساً إِلَّا وُسْعَهَا؛ فَلاَ يَجُوْزُ الطَّعْنُ فِيْهِ- كَمَا قَدْ يَفْعَلُ بَعْضُ الجهلة، بَلْ يَجِبُ التَّأَدُّبَ مَعَهُ؛ لِأَنَّهُ إِمَامٌ مِنْ أَئِمَّةِ الْمُسْلِمِيْنَ الَّذِيْنَ بِهِمْ حُفِظَ هَذَا الدِّيْنَ، ووصل إلينا مَا وصل مِنْ فُرُوْعِهِ، وَأَنَّهُ مَأْجُوْرٌ عَلَى كُلِّ حَالٍ؛ أَصَابَ أَمْ أَخْطَأَ، كَمَا أَنَّهُ لَا يَجُوْزُ لِمُعَظِّمِيْهِ أن يظلوا متمسكين بأقواله المخالفة للأحاديث؛ لأنها لَيْسَتْ مِنْ مَذْهَبِهِ- كَمَا رَأَيْتَ نُصُوْصَهُ فِيْ ذَلِكَ، فَهَؤُلاَءِ فِيْ وَادٍ، وَأُولَئِكَ فِيْ وَادٍ، وَالْحَقُّ بَيْنَ هَؤُلَاءِ وَهَؤُلَاءِ، رَبَّنَا اغْفِرْ لَنَا وَلِإِخْوَانِنَا الَّذِينَ سَبَقُونَا بِالإِيمَانِ وَلَا تَجْعَلْ فِي قُلُوبِنَا غِلًا لِلَّذِينَ آمَنُوا رَبَّنَا إِنَّكَ رَؤُوفٌ رَحِيمٌ-
‘যখন ইমাম আবূ
হানীফার পক্ষ হ’তে অনিচ্ছাকৃতভাবে ছহীহ হাদীছগুলির বিরোধিতার ক্ষেত্রে এই
ওযর হয় এবং এই ওযরটি গ্রহণযোগ্য। কেননা আল্লাহ তা‘আলা কাউকে তার সাধ্যের
বাইরে অতিরিক্ত কাজে বাধ্য করেন। তখন ইমাম ছাহেবের উপর ভৎর্সনা ও কটু
মন্তব্য করা জায়েয নয়, যেমনটি কতিপয় অশিক্ষিত মানুষ করে থাকে। বরং তার
প্রতি আদব ও সম্মান প্রর্দশন করা ওয়াজিব। কেননা তাকে ঐ ইমামদের মধ্যে গণ্য
করা হয় যাদের মাধ্যমে এই দ্বীনের হেফাযত করা হয়েছে। আর আমাদের পর্যন্ত
দ্বীনের শাখাগত মাসাআলা সমূহ তাঁদের মাধ্যমে পৌঁছেছে। যাহোক ইমাম আবূ
হানীফা পুরস্কার ও নেকীর হক্বদার। চাই তার থেকে মাসাআলা সমূহে ভুল হোক বা
না হোক। অনুরূপভাবে এটাও জায়েয নেই যে, তাকে সম্মানকারী ব্যক্তি তার সেই
উক্তিগুলিকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে যেগুলি ছহীহ হাদীছের বিরোধী। কেননা সেগুলি
ইমাম ছাহেবের মাযহাব নয়। যেমনটা তার উক্তিসমূহ আপনারা দেখছেন। উভয় পক্ষই
বাড়াবাড়িতে নিমজ্জিত। অথচ হক্ব উভয়ের মাঝামাঝিতে রয়েছে। ‘হে আমাদের
পালনকর্তা! আমাদের এবং আমাদের ভাইদের ক্ষমা কর, যারা আমাদের পূর্বে ঈমান
এনেছে। আর ঈমানদারগণের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে কোন বিদ্বেষ রেখো না। হে
আমাদের প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল, পরম দয়ালু’।[3]
অনুরূপভাবে তিনি আল্লামা ইবনু রজব হ’তে পূর্বেই এটা বর্ণনা করেছেন যে, রাসূল (ছাঃ)-এর উক্তির সাথে যদি কারো কথা সাংঘর্ষিক হয়ে যায় তাহ’লে রাসূল (ছাঃ)-এর কথাই অগ্রগণ্য হবে এবং তার আনুগত্য করতে হবে। আর যদি এ ব্যাপারে ইমামের কথা রাসূলের বিরোধী হয় তাহ’লে ইমামের কথা বাদ দিয়ে রাসূল (ছাঃ)-এর কথা মানতে হবে। আর এটা বিরোধী ইমামের বড়ত্বের প্রতিবন্ধক নয়। যদিও তিনি আল্লাহর নিকটে ক্ষমাপ্রাপ্ত হয়ে থাকুন না কেন।
এরপর আল্লামা আলবানী
(রহঃ) টীকায় বলেছেন,بَلْ هُوَ مَأْجُوْرٌ لِقَوْلِهِ صَلَّي اللهُ عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ فَأَصَابَ فَلَهُ
أَجْرَانِ وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ فَأَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ وَاحِدٌ
‘বরং তিনি পুরস্কারপ্রাপ্ত হবেন। কেননা নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘বিচারক যখন
স্বীয় ইজতিহাদের দ্বারা ফায়ছালা করে তাতে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হয় তাহ’লে
তার জন্য দু’টি পুরস্কার। আর যদি ভুল করে তবে তার জন্য একটি পুরস্কার’।[4]
সম্মানিত পাঠক! ইনছাফ করুন যে, আল্লামা আলবানী (রহঃ) মুজতাহিদ ইমামগণের সমালোচনা করেছেন এবং তাদেরকে ইহূদী-নাছারাদের আলেমদের সমতুল্য আখ্যা দেওয়ার দুঃসাহস দেখিয়েছেন? তিনি তো তাদের এমন মাসায়েল যেগুলিতে তারা ভুল করেছেন সেগুলিতেও তাদের পুরস্কার ও নেকীর হক্বদার ঘোষণা করেছেন। এই কথাটি তো শায়খ শু‘আইব বলেছিলেন যে, যার ইজতিহাদ সঠিক হয়ে থাকে তার জন্য দু’টি পুরস্কার রয়েছে। আর যার দ্বারা ভুল সংঘটিত হয়ে গিয়েছে তার জন্যও একটি পুরস্কার রয়েছে। আল্লামা আলবানী (রহঃ) একথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। সুতরাং শায়খ শু‘আইব কর্তৃক আরোপিত এই দুঃসাহসিকতা ‘একটা বড় অপবাদ’ বৈ কিছুই নয়।
মুক্বাল্লিদদের অবস্থা :
মূলত মুজতাহিদ ইমামদের প্রতি শায়খ আলবানীর কোন অভিযোগ নেই। বরং তার অন্ধ অনুসারীদের প্রতি তাঁর অভিযোগ। যারা মাযহাবী গোঁড়ামি বশত সম্মানিত ইমামদের স্পষ্ট উক্তিসমূহের বিরুদ্ধে তাদের দুর্বল অবস্থানকে অাঁকড়ে ধরে থাকার চেষ্টা করেছেন। বরং কতিপয় এমন মাসআলা-মাসায়েলকে লালন করেছেন, যা স্রেফ তাঁদের প্রতি সম্বন্ধিত করা হয়েছে। নমুনাস্বরূপ আমরা একটি প্রসিদ্ধ মাসআলা সম্মানিত পাঠকদের সামনে পেশ করছি যেন আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর অবস্থান বুঝা যায়।
তাশাহহুদে তর্জনী আঙ্গুল উঠানোর হাদীছগুলিকে আব্দুল্লাহ বিন
ওমর, ওয়ায়েল বিন হুজর, আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের (রাঃ) হ’তে ছহীহ সনদে ছিহাহ,
সুনান এবং মাসানীদ গ্রন্থসমূহে বর্ণিত আছে। কতিপয় অন্যান্য ছাহাবী থেকেও
এই হাদীছগুলি বর্ণিত আছে। এরই উপর মুহাদ্দিছ ইমামদের এমনকি ইমাম আবূ ইউসুফ
এবং ইমাম মুহাম্মাদের ফৎওয়া ও আমল রয়েছে, যেমনটা আল্লামা ইবনে হুমাম
ফাৎহুল ক্বাদীর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। ইমাম মুহাম্মাদ হযরত আব্দুল্লাহ বিন
ওমর-এর হাদীছটি উল্লেখ করে বলেছেন,وَبِصَنِيْعِ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّي
اللهِ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ نَأْخُذُ وَهُوَ قَوْلُ اَبِيْ حَنِيْفَةَ ‘রাসূল
(ছাঃ)-এর তরীকার উপর আমাদের আমল রয়েছে। আর এটাই ইমাম আবূ হানীফার উক্তি’।[5]
এই বাস্তবতার বিপরীতে দেখুন ‘খুলাছায়ে কায়দানী’ যার কভারের উপর তার নাম লেখা হয়েছে যে,
تو طريقہ نماز كے داني
گر نہ داني خلاصۂ كيداني
‘যদি তুমি খুলাছায়ে কায়দানীকে না জান তবে তুমি ছালাতের তরীকা কিভাবে জানবে’?
এর
পঞ্চম অনুচ্ছেদ যার নাম اَلْبَابُ الْخَامِسُ فِي الْمُحَرَّمَاتِ -এর
শিরোনামে ছালাতের হারাম কার্যাবলীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে এই আঙ্গুল
ইশারা করাকে ছালাতের হারাম কাজের মধ্যে শামিল করা হয়েছে। তার কথাগুলি
নিম্নরূপ- اَلْاِشَارَةُ بِالسَّبَّابَةِ كَاَهْلِ الْحَدِيْثِ
‘আহলেহাদীছদের মত শাহাদাত আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করা হারাম’।[6]
ফাতাওয়া বাযযাযিইয়া (৪/২৬)
আলমগীরির হাশিয়াতেও একে ছালাতের হারাম কাজসমূহের মধ্যে গণ্য করা হয়েছে।
রোমের মুফতী আল্লামা আবুস সঊদকে যখন গুরুত্বপূর্ণ মাসাআলাগুলির উপর গ্রন্থ
লেখার আবেদন করা হয় তখন তিনি বললেন, ‘বায্যাযিইয়া মওজূদ থাকতে এরূপ গ্রন্থ
রচনা করতে আমার লজ্জাবোধ হয়। কেননা তার গ্রন্থটি একটি চমৎকার সারগর্ভ
সংকলন। মুশকিল মাসাআলাগুলির সমাধান করেছেন যেভাবে প্রয়োজন সেভাবেই’।[7]
এতদ্ব্যতীত
ফাতাওয়া গিয়াছিয়াহ, ফাতাওয়া লওয়ানওয়াজিয়া, উমদাতুল মুফতী, আয-যাহীরিয়া,
আল-খুলাছাহ, আল-ইতাবিয়াহ গ্রন্থগুলিতেও একে নাজায়েয লেখা হয়েছে। যেমনটা
মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষ্ণৌবী (রহঃ) আত-তা‘লীকুল মুমাজ্জাদ (পৃঃ ১০৬)
গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। বরং ‘আল-গিয়াছিয়া’ গ্রন্থে ছালাতের মাকরূহ
বিষয়াবলী সম্পর্কে উল্লেখ করতে গিয়ে প্রথম মাসআলা এটাই বর্ণনা করেছেন
যে,فِي الْفَتَاوَي لَا يَشِيْرُ بِالسَّبَّابَةِ عِنْدَ التَّشَهُّدِ هُوَ
الْمُخْتَارُ وَعَلَيْهِ الْفَتْوَي ‘আল-ফাতাওয়া গ্রন্থে আছে যে,
তাশাহহুদের সময় আঙ্গুল দ্বারা ইশারা করবে না। এটাই হ’ল অধিক গ্রহণযোগ্য মত।
আর এর উপরেই ফৎওয়া রয়েছে’।[8]
শেষ সময়ে হযরত মুজাদ্দিদে আলফে ছানী শায়খ আহমাদ সারহিন্দীও মাকতূবাত গ্রন্থে বলে দিয়েছেন যে, ইমাম মুহাম্মাদ (রহঃ)-এর উক্তি অপ্রচলিত। আর গ্রহণযোগ্য বর্ণনাসমূহে (এভাবে আঙ্গুল) ইশারা করা হারাম করা হয়েছে। আল্লাহু আকবার! এই ফৎওয়াগুলির ভিত্তিতে যে গোঁড়ামি ও কঠোরতার সৃষ্টি হয়েছে তার ধারণা এর দ্বারা করুন যার উল্লেখ মাওলানা তাক্বী ওছমানীও করেছেন, ‘এমনকি বলা হয়েছে যে,مارا قول امام بايد قول رسول كافي نيست ‘আমাদের দরকার ইমামের উক্তি। রাসূলের উক্তি যথেষ্ট নয়’।[9] ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হে রাজে‘উন।
আল্লামা
রশীদ রেযা বলেছেন, ‘আমি এই সংবাদটি পেয়েছি যে, একজন ব্যক্তি ছালাতের মধ্যে
তাশাহহুদে আঙ্গুল উঠালে তার আঙ্গুল ভেঙ্গে দেওয়া হ’ল’।[10]
মাওলানা
সাইয়েদ আবুল হাসান আলী নদবী মরহূমও আফগানী গোত্রসমূহ সম্পর্কে লিখেছেন,
‘এই গোত্রগুলি ছালাতে তাশাহহুদের সময় আঙ্গুল উঠানোকে কঠিন বিদ‘আত ও ক্ষমার
অযোগ্য গুনাহ মনে করত। এমনকি কতিপয় অতি উৎসাহী ও ক্রোধান্ধ ব্যক্তি ছালাতে
মুছল্লীর আঙ্গুল ভেঙ্গে দেওয়াকেও কোন দোষ মনে করত না। আর এই সব হ’ত এর
ভিত্তিতে যে, কতিপয় ফিক্বহ গ্রন্থে যেমন ‘খুলাছায়ে কায়দানী’-তে তাশাহহুদের
সময় আঙ্গুল উঠানোকে হারাম আখ্যা দেওয়া হয়েছে।[11]
চিন্তা করুন! অসংখ্য ফিক্বহে হানাফীর ফিক্বহ ও ফৎওয়ার গ্রন্থ সমূহে এই হানাফী মাসলাকের ভিত্তি কি? কোন হাদীছ বা ইমাম আবূ হানীফা (রহঃ) এবং তার ছাত্রদের ফৎওয়া ও ফায়ছালা? কক্ষনো নয়। ব্যস, কোন দয়ালু ব্যক্তি একে হানাফী মাসলাক বলে চালিয়ে দিয়েছেন। এরপর ফলাফল কি হয়েছে তা আপনাদের সামনে রয়েছে। এখানে একটি হালাল ও মাসনূন আমলকে হারাম বা মাকরূহ আখ্যা দেওয়া হয়েছে, না-কি হয়নি? আর এটা اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ، ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে (তওবা ৯/৩১) এই আয়াতের সত্যায়ন কি-না?।
নিঃসন্দেহে অধিকাংশ হানাফী আলেম ছালাতে এই ইশারাকে মাসনূন বলেছেন এবং হারাম বা মাকরূহ আখ্যা দানকারীদের খন্ডনও করেছেন। তা সত্ত্বেও মা ওয়ারা-আন নাহার (ট্রান্স অক্সিয়ানা), খুরাসান, ইরাক, রোম এবং হিন্দুস্তানের কতিপয় দেশে অধিকাংশ হানাফী আলেম এই সুন্নাতকে অস্বীকার করেছেন। আল্লামা আলী ক্বারী (রহঃ) এই অবস্থানটির খন্ডনে দু’টি পুস্তিকা লিখেছেন। একটি হ’ল- تَزْيِيْنُ الْاِشَارَةِ لِتَحْسِيْنِ الْاِشَارَةِ তাঁর কতিপয় সমকালীন আলেম এর উপর অভিযোগ করেছেন এবং কতিপয় ফিক্বহী গ্রন্থের বরাত দিয়ে লিখেছেন যে, ইশারা না করাই হচ্ছে মনোনীত মাযহাব। আর কেউ কেউ একে মাকরূহ বলেছেন। কতিপয় আলেমের ধারণা হ’ল, প্রতিটি মাকরূহ হ’ল হারাম। এরই ভিত্তিতে কায়দানী একে হারাম বলেছেন। কায়দানী বড় আলেম ছিলেন। ‘দ্বীনের হাফেয’ তার উপাধি ছিল। আর আবুল বারাকাত ছিল তার উপনাম। তারই জবাবে আল্লামা মোল্লা আলী ক্বারী এ বিষয়ে اَلتَّدْهِيْنُ لِلتَّزْيِيْنِ عَليَ وَجْهِ التَّبْيِيْنِ নামে আরেকটি পুস্তিকা রচনা করেন। আর দু’টি গ্রন্থেই আঙ্গুল ইশারাকে অস্বীকারকারীদের মতকে শক্তভাবে খন্ডন করেছেন। এমনকি বলেছেন যে,
وَاَمَّا الْقَائِلُ بِحُرْمَتِهَا الْمُنْفَرِد بِكَيْفِيَّتِهَا الْمُسَمَّي بِمُلاَّ لُطْفُ اللهِ النَّسَفِيْ الْمَشْهُوْر بِالفَاضِلِ الْكَيْدَانِي كَمَا صَرَّحَ بَهَ شَارِحُهُ مَوْلاَنَا شَمْسُ الدِّيْنِ مُحَمَّد الْقُهُسْتَانِي فَقَوْلُهُ مِنْ اَقْبَحِ الْقَبِيْحِ بَلْ مِنَ الْكُفْرِ الصَّرِيْحِ حَيْثُ وَقَعَ مُخَالِفًا لِلْحَدِيْثِ الصَّحِيْحِ مُنَاقِضًا لِقَوْلِ اَئِمَّةِ الْمَذْهَبِ عَليَ مَا ثَبَتَ عَنْهُمْ بِالتَّصْرِيْحِ- وَاتَّفَقَ عَلَيْهِ الْمَشَائِخ وَالْفُضَلاَءِ بَلْ اِنْعَقَدَ عَلَيْهِ اِجْمَاعُ الْعُلَمَاءِ-
‘রইল এর হারাম হওয়ার প্রবক্তার কথা। যিনি এর ধরণ সম্পর্কে একক অবস্থানে আছেন। যার নাম মোল্লা লুৎফুল্লাহ নাসাফী। যিনি ফাযেলে কায়দানী উপাধিতে প্রসিদ্ধ। যেমনটা তার ব্যাখ্যাকারক মাওলানা শামসুদ্দীন মুহাম্মাদ কুহুসতানী বলেছেন, ‘তার উক্তিটি খুবই নিকৃষ্ট। বরং স্পষ্ট কুফরী। এজন্য যে, তা ছহীহ হাদীছের বিরোধী এবং মাযহাবের ইমামদের উক্তির বিপরীত। পক্ষান্তরে স্পষ্টভাবে তাদের থেকে এটি প্রমাণিত রয়েছে। এ ব্যাপারে ওলামা-মাশায়েখ ঐক্যতমত পোষণ করেছেন। এমনকি এ ব্যাপারে আলেমদের ইজমা রয়েছে। অনুরূপভাবে ‘আত-তাযয়ীন’ গ্রন্থে তিনি আল্লামা কায়দানীর উক্তিটি বর্ণনা করে বলেছেন,
هَذَا مِنْهُ خَطَأٌ عَظِيْمٌ وَجُرْمٌ جَسِيْمٌ منشوه الْجَهْلِ عَنِ قَوَاعِدِ الْأُصُوْلِ وَمَرَاتِبِ الْفُرُوْعِ مِنَ الْمِنْقُوْلِ وَلَوْ لَا حُسْنُ الظَّنِّ بِهِ وَتَأْوِيْلُ كَلاَمِهِ بِسَبَبِهِ لَكَانَ كُفْرًا صَرِيْحًا وَاِرْتِدَادًا صَحِيْحًا- فَهَلْ يَحِلُّ لِمُوْمِنٍ اَنْ يَحْرُمَ مَا ثَبَتَ مِنْ فِعْلِهِ صَلي الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَا كَادَ نَقَلَهُ اَنْ يَكُوْنَ مُتَوَاتِرًا وَيَمْنَعُ مَا عَلَيْهِ عَامَّةُ الْعُلَمَاءِ كَانَ كَابِرًا عَنْ كَابِرٍ-
‘আল্লামা কায়দানীর পক্ষ হ’তে এটা
মস্ত বড় ভুল ও বিশাল অপরাধ। যার কারণ হ’ল উছূলী ক্বায়েদা ও শাখাগত স্তরসমূহ
সম্পর্কে অজ্ঞ থাকা। যদি তার সম্পর্কে ভাল ধারণা না থাকত এবং তার কথার
তাবীল না হ’ত তবে তার উক্তির ভিত্তিতে এটা তার স্পষ্ট কুফরী ও বাস্তবিকই
ধর্মচ্যুতি হিসাবে গণ্য হ’ত। কোন মুমিন কি একে হারাম আখ্যা দিতে পারে যা
রাসূলুলাহ (ছাঃ) হ’তে আমলগতভাবে প্রমাণিত? আর সেই আমলটি তার হ’তে প্রায়
মুতাওয়াতির বা অবিরত ধারায় বর্ণিত। অথচ তিনি সে বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা জারী
করেন, যার উপর যুগের পর যুগ সর্বতোভাবে আলেমদের আমল রয়েছে’।[12]
আমরা আরয করেছি যে, আল্লামা কায়দানী একাই হারাম হওয়ার ফৎওয়া দেননি। বরং ইমাম হাফেযুদ্দীন ইবনে শিহাব বাযযাযও (এই ফৎওয়া দিয়েছেন)। দলীল-এর মোকাবেলায় এ ধরনের ফৎওয়া ও এ বিষয়ে গোঁড়ামি করা কিসের ইঙ্গিতবাহী?
এটাই একমাত্র মাসআলা নয়। এই ধরনের ডজনখানিক রয়েছে যেগুলিতে সুস্পষ্ট দলীল-এর বিপরীতে মাসআলার নির্লিপ্ততা ও গোঁড়ামিকেই প্রকাশ করা হয়েছে। আর এ সম্পর্কেই আল্লামা আলবানী (রহঃ) সমালোচনা করেছেন। অসংখ্য আলেম একে এই গোঁড়ামিকেই اَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ-এর সত্যায়ন আখ্যা দিয়েছেন। ইমাম ফখরুদ্দীন রাযী এই আয়াতের তাফসীরে বলেছেন,
قَالَ شَيْخُنَا وَمَوْلَانَا خَاتِمَةُ الْمُحَقِّقِينَ وَالْمُجْتَهِدِينَ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: قَدْ شَاهَدْتُ جَمَاعَةً مِنْ مُقَلِّدَةِ الْفُقَهَاءِ، قَرَأْتُ عَلَيْهِمْ آيَاتٍ كَثِيرَةً مِنْ كِتَابِ اللَّهِ تَعَالَى فِي بَعْضِ الْمَسَائِلِ، وَكَانَتْ مَذَاهِبُهُمْ بِخِلَافِ تِلْكَ الْآيَاتِ، فَلَمْ يَقْبَلُوا تِلْكَ الْآيَاتِ وَلَمْ يَلْتَفِتُوا إِلَيْهَا وَبَقوا يَنْظُرُونَ إِلَيَّ كَالْمُتَعَجبِ، يَعْنِي كَيْفَ يُمْكِنُ الْعَمَلُ بِظَوَاهِرِ هَذِهِ الْآيَاتِ مَعَ أَنَّ الرِّوَايَةَ عَنْ سَلَفِنَا وَرَدَتْ عَلَى خِلَافِهَا-
‘আমাদের শায়খ, মাওলানা, খাতিমুল মুহাক্কিক্বীন ওয়াল
মুজতাহিদীন বলেছেন, নিঃসন্দেহে আমি ফক্বীহদের তাক্বলীদকারী একটি জামা‘আতকে
দেখেছি। আমি কতিপয় মাসআলা সম্পর্কে তাদেরকে কুরআনের অসংখ্য আয়াত পড়ে
শুনিয়েছি। তাদের মাযহাব এই আয়াতগুলির বিরোধী ছিল। তারা এই আয়াতগুলির (মর্ম,
বিধান) গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং সেদিকে তারা দৃকপাতও করেননি।
আমার প্রতি তারা অবাক বিস্ময়ে দেখছিলেন যে, অত্র আয়াতগুলির বাহ্যিক অর্থের
উপর কিভাবে আমল করা সম্ভব যখন আমাদের পূর্ববর্তীদের আমল অত্র আয়াতগুলির
বিরোধী’।[13]
মাওলানা মুহাম্মাদ ইসমাঈল
দেহলবী এই ভুল নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘আফসোস! যদি আমি জানতাম
যে, একজন নির্দিষ্ট ইমামের তাক্বলীদ কিভাবে জায়েয হ’তে পারে যখন রাসূল
(ছাঃ) হ’তে বর্ণিত বর্ণনাসমূহের দিকে প্রত্যাবর্তন করা সম্ভব। আর তা
অনুসরণীয় ইমামের উক্তির স্পষ্ট বিরোধী হয়। যদি (এই অবস্থায়) স্বীয় ইমামের
উক্তি বর্জন করা না হয় তবে এতে শিরকের আশঙ্কা রয়েছে। যার পক্ষে তিরমিযীর
হাদীছটি নির্দেশ করছে। যা আদী ইবনে হাতেম বর্ণনা করেছেন যে, আমি রাসূল
(ছাঃ)-কে আল্লাহ তা‘আলার এই বক্তব্যের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম যে, ‘তারা
তাদের স্বীয় আলেম ও পীরদেরকে এবং ঈসা বিন মারয়ামকে আল্লাহ ব্যতীত রব
বানিয়ে নিয়েছে’। আমি বললাম, জনাব! আমরা তো তাদেরকে রব বানাইনি। নবী করীম
(ছাঃ) বললেন, ‘যে বস্ত্ত তারা তোমাদের জন্য হালাল করেছেন সেগুলিকে তোমরা
হালাল মনে কর আর যেসকল বস্ত্তকে তারা হারাম মনে করত সেগুলিকে তোমরা হারাম
মনে কর (এটাই হচ্ছে তাদেরকে রব বানানো)। এর দ্বারা ইমামদের উক্তির
মোকাবেলায় দলীলকে প্রত্যাখ্যান করা এবং সেগুলিকে অস্বীকার করা উদ্দেশ্য নয়।
বরং শরী‘আতের দলীলসমূহকে ইমামদের উক্তির দিকে ফেরানো উদ্দেশ্য। এর দ্বারা
প্রতীয়মান হ’ল যে, কোন নির্দিষ্ট ব্যক্তির কথার অনুসরণ করা যদিও কিতাব ও
সুন্নাতের দলীলসমূহ তার বিরোধী হয়। আর কুরআন ও সুন্নাত ইমামের বক্তব্যের
দিকে তাবীল করা নাছারাদের সাদৃশ্য গ্রহণ ও শরীকানার অংশ’।[14]
স্বীয় ইমামের কথা মোতাবেক হাদীছের তাবীল করা বরং মর্মগত বিকৃতি করার পরিধি অত্যন্ত ব্যাপক। যার আলোচনা করার সুযোগ এখানে নেই। আল্লামা ইযয বিন আব্দুস সালাম, ইমাম রাযী, শাহ ওয়ালীউল্লাহ, আল্লামা মুহাম্মাদ হায়াৎ সিন্ধী, আল্লামা সুয়ূত্বী, আল্লামা ছালেহ ফুল্লানী, আল্লামা শা‘রানী, শাহ আব্দুল আযীয মুহাদ্দিছ দেহলবী (রহঃ) ইত্যাদি বিষয়ে যা কিছু লিখেছেন তার বিস্তারিত আলোচনার স্থান এটা নয়। আমরা এখানে স্রেফ এই নিবেদন করতে চাই যে, সুস্পষ্ট দলীলের মোকাবেলায় স্রেফ ফিক্বহী বর্ণনার উপর গোঁড়ামি করা এবং দলীলের তাবীলের পন্থা اَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ الله -এর সত্যায়ন।
মাওলানা
আশরাফ আলী থানবী (রহঃ) দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছেন, ‘কতিপয় মুক্বাল্লিদ
স্বীয় ইমামকে ভুল-ত্রুটি মুক্ত এবং ওয়াজিব ও ফরযরূপে তার আনুগত্য করার
ধারণা পোষণ করে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েছেন যে, যেভাবে ছহীহ হাদীছ ইমামের উক্তির
বিরোধী হয় এবং নির্ভরযোগ্য ইমামের ক্বিয়াস হয়ে থাকে। আবার অসংখ্য
ত্রুটি-বিচ্যুতি হাদীছের মধ্যে সৃষ্টি করে বা এর দূরবর্তী তাবীল করে
হাদীছকে প্রত্যাখ্যান করবেন। আর ইমামের উক্তিকে বর্জন করবেন না। এমন
তাক্বলীদ হারাম এবং اَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ الله ‘আল্লাহর এই আয়াতটির
সত্যায়ন আর মরহূম ইমামদের অছিয়তের বিরোধী’।[15]
এজন্য
ঐ সকল গোঁড়াপন্থী মুক্বাল্লিদদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিশ্চিতরূপে সম্মানিত
ইমামদের উপর নয়। যেমনটা শায়খ শু‘আইব মনে করেছেন। আল্লামা ছালেহ ফুল্লানী
স্পষ্টভাবে লিখেছেন, وَالْاَئِمَّةُ كُلُّهُمْ بَرِيْئُوْنَ مِنْهُ فَهُوَ
مَعَ الْاَئِمَّةِ بِمَنْزِلَةِ أَحْبَارِ أَهْلِ الْكِتَابِ- ‘এমন
মুক্বাল্লিদ হ’তে সকল ইমাম মুক্ত। তার সাথে নিজের ইমামদের সম্পর্ক আহলে
কিতাবদের আলেমদের অনুরূপ’।[16]
এজন্য সম্মানিত ইমামগণ এমন গোঁড়াপন্থী মুক্বাল্লিদদের কর্মপন্থা হ’তে মুক্ত। বরং যদি ইজতিহাদ গতভাবে তাদের ভুলও হয় তবুও তারা পুরস্কারপ্রাপ্ত। অবশ্য গোঁড়াপন্থী মুক্বাল্লিদরা পাপী। আর তাদের কর্মপন্থা اَرْبَابًا مِنْ دُوْنِ اللهِ এবং আদী বিন হাতেম (রাঃ)-এর হাদীছটির অনুরূপ।
আবার তাল-বাহানা করার যে দরজা খোলা হয়েছে, সেটা কি শরী‘আত বানানো এবং এই আয়াতটির সত্যায়ন নয়? পূর্বের যুগের কথা বাদ দিন। সাম্প্রতিক কালে এর ভয়ানক অবস্থা মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মরহূম ‘তাযকিরাহ’ গ্রন্থে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করে দিয়েছেন। শায়খ শু‘আইব এবং তার সাথীরা যদি বাস্তবতা থেকে চোখ বন্ধ করে রাখেন তবে এর দ্বারা সত্য পরিবর্তিত হ’তে পারে না।
গবেষণার অস্পষ্ট মানহাজ :
এ শিরোনামে শায়খ শু‘আইব যা কিছু লিখেছেন তার দ্বারা তার উদ্দেশ্য সম্ভবত এটাই যে, সিলসিলা ছহীহাহ এবং যঈফায় কোন সজ্জায়ন নেই। যে হাদীছটি আল্লামা আলবানী (রহঃ) পেতেন স্বীয় তাহক্বীক্ব মোতাবেক তাকে ছহীহাহ বা যঈফাহ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে দিতেন।
এই অভিযোগটি সস্থানে ঠিক। যদি তিনি ফিক্বহী বা
আরবী বর্ণমালার বিন্যাস করতেন তবে অধিকতর উপকার হ’ত। কিন্তু তিনি এই কথাটি
বলেছেন যে, ‘যঈফ ও মাওযূ হাদীছগুলি নতুনভাবে লোকদের মধ্যে বিস্তার করার কোন
দরকার ছিল না। বর্তমান যুগের কেউ সেগুলি সম্পর্কে অবগত ছিল না। যেমন
عَلَيْكُمْ بِالْعَدَسِ র্শীষক হাদীছটি অর্থাৎ ডালকে আবশ্যিকভাবে অাঁকড়ে
ধর এজন্য যে, এটা সত্তরজন নবী (আঃ)-এর পবিত্র মুখের খাদ্য ছিল। উত্তম হ’ত,
যদি এই বানোয়াট হাদীছটি বিস্মৃতির পর্দার অন্তরালে অন্তরীণ থাকত’।[17]
কিন্তু
এটা শায়খ শু‘আইবের মানহাজ হ’তে পারে, মুহাদ্দিছীনে কেরামের নয়।
মুহাদ্দিছগণ যেখানে ছহীহ এবং আমলযোগ্য বর্ণনাসমূহ সংকলন করেছেন সেখানে তারা
বাজে, যঈফ এবং বানোয়াট বর্ণনাসমূহেরও পিছু নিয়েছেন। বাকী থাকল সেই
বর্ণনাটি যার উদ্ধৃতি শায়খ শু‘আইব প্রদান করেছেন। এ সম্পর্কে তার স্বয়ং
চিন্তা করা উচিৎ ছিল যে, আল্লামা ইবনে জাওযী (রহঃ)-একে বানোয়াট বলেছেন।
পক্ষান্তরে আল্লামা সুয়ূত্বী (রহঃ) একে স্রেফ যঈফ বলেছেন।[18]
এখন
যদি কেউ আল্লামা সুয়ূত্বীর এই ফায়ছালার উপর ভিত্তি করে একে ‘ডাল শরীফ’-এর
ফযীলত আখ্যা দেন এবং ‘ফাযায়েলে যঈফ হাদীছসমূহ গ্রহণীয় হয়’-কথাটির সাহায্য
নেন তখন শায়খ শু‘আইব কি বলবেন? বিশেষত যখন ইবনুল জাওযীর এই হুকুম সম্পর্কে
আল্লামা সুয়ূত্বী ‘আল-লাআলী আল-মাছনূ‘আহ’ গ্রন্থে সমালোচনা করেছেন এবং
ইবনু আর্রাক্বও তাঁর সাথে সহমত পোষণ করেছেন।[19]
পক্ষান্তরে এটা এমন কোন বর্ণনা নয় যেটা পর্দার অন্তরালে গুম হয়ে আছে। বরং আল্লামা আলবানী (রহঃ)ও উল্লেখ করেছেন যে, এটা প্রসিদ্ধ হাদীছগুলির মধ্যে গণ্য হয়। আর আল্লামা যারকাশী (রহঃ) ‘আল-লাআলী আল-মানছূরাহ ফিল আহাদীছিল মুশতাহারাহ’ গ্রন্থে একে উল্লেখ করেছেন (ক্রমিক ১৪৩)।
আরো নিবেদন রইল যে, আল্লামা ইবনে তূলূন (রহঃ)ও ‘আশ-শাযারাতু ফিল আহাদীছি মুশতাহিরাহ’ গ্রন্থে (২/১৪, ক্রমিক ৬৫৩), আল্লামা যারকাশী ‘আত-তাযকিরাহ ফিল আহাদীছ আল-মুশতাহিরাহ’ গ্রন্থে (পৃঃ ১৫৪), সুয়ূত্বী আদ-দুরারুল মুনতাছারাহ ফিল আহাদীছিল মুশতাহারাহ গ্রন্থে (পৃঃ ১৫৪), আল্লামা সাখাবী (রহঃ) ‘আল-মাক্বাছিদুল হাসানাহ ফী বায়ানি কাছীরিম মিনাল আহাদীছ আল-মুশতাহারাহ আলাল আলসিনাহ’ গ্রন্থে (ক্রমিক ৭৬৩, পৃঃ ৩০৩), আল্লামা আজলূনী কাশফুল খাফা গ্রন্থে (২/১২০)
একে প্রসিদ্ধ হাদীছসমূহে গণ্য করেছেন। আর শায়খ শু‘আইব নিজেই বলেছেন,
‘অবশ্য লোকদের মাঝে সুপরিচিত ও প্রসিদ্ধ হাদীছগুলির অবস্থা বর্ণনা করা ও
সেগুলির সমালোচনা করায় কোন দোষ নেই’।[20]
এজন্য আল্লামা আলবানী মুখে মুখে প্রসিদ্ধ এই বর্ণনাটিকে যঈফা গ্রন্থে উল্লেখ করে এবং আল-জামেউছ ছগীর গ্রন্থে আল্লামা সুয়ূত্বীর দুর্বল অবস্থানকে বর্ণনা করে এর মাওযূ বা জাল হওয়ার বিষয়টি খোলাছা করে কোন অপরাধ করেননি। পেরেশানী তো খোদ শায়খ শু‘আইবের ন্যায় বুযুর্গের উপর যিনি ‘ডাল শরীফ’-এর এই বর্ণনাটিকে পূর্ববর্তীদের বিপরীতে ‘বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে গেছে’ মনে করছেন; আবার উল্টো আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর উপর অপবাদ আরোপ করছেন। বড়ই আফসোস!
হাদীছের শ্রেণীবিন্যাস ও সনদসমূহের বিলুপ্তিকরণ :
এই
শিরোনামে শায়খ শু‘আইবের উদ্ধৃতিতে বলা হয়েছে যে, ‘আল্লামা আলবানী
(রহঃ)-এর অন্যতম সমালোচিত একটি বিষয় এই যে, তিনি সুনানে আরবা‘আর ছহীহ ও যঈফ
হাদীছগুলিকে আলাদা আলাদা করে প্রকাশ করেছেন এবং সেগুলির সনদসমূহ বিলুপ্ত
করে দিয়েছেন। অথচ সনদগুলিকে বিলুপ্ত না করাই ছিল ইলমী সততার দাবী’।[21]
আরয রইল যে, এটাও শায়খ শু‘আইবের বেখবর থাকার দলীল। সুনানে আরবা‘আর ছহীহ এবং যঈফ হাদীছগুলির বিভাজনে সনদসমূহের বিলুপ্তি আল্লামা আলবানী (রহঃ) করেননি। বরং গ্রন্থের প্রকাশক এমনটা করেছেন। প্রকৃত বাস্তবতাকে শায়খ আলবানী (রহঃ) নিজেই স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘গ্রন্থ প্রকাশকরা লিখেছেন,صَحِيْحُ ابْنِ مَاجَهْ بِاِخْتِصَارِ السَّنَدِ (ছহীহ ইবনু মাজাহ : সংক্ষিপ্ত সনদে)। আর তারা (প্রকাশকগণ) অন্যান্য সুনান গ্রন্থসমূহেও এমনটা করেছেন এবং লিখেছেন, ‘রচনায় : মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী’। অথচ এটা আলবানীর নামে সুস্পষ্টভাবে মিথ্যারোপ।فَإِنَّ الْاِخِتْصَارَ مِنْهُ وَلَيْسَ مِنِّي، وَفِيْهِ أَوْهَامٌ وَتَخْلِيْطَاتٌ وَجُهَالَاتٌ كَثِيْرَةٌ جِداً لَا يُمْكِنُ إِحْصَاؤُهَا- এই সংক্ষিপ্তকরণ আমার পক্ষ হ’তে হয়নি। বরং আমার নামে অসংখ্য গোঁজামিল ও ভ্রান্তিও এতে অর্ন্তভুক্ত করা হয়েছে’।
এই সকল পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা বরং দুঃখ ভরা কাহিনী তিনি ‘সিলসিলা ছহীহাহ’ গ্রন্থের সপ্তম খন্ডে বর্ণনা করেছেন। আগ্রহী পাঠকগণ (হা/৩০১৬, ৭/৪১)-এর মধ্যে এটা দেখতে পারেন। এই রকম ঘটনার প্রতি তিনি অন্যত্রও (হা/৩২০৩, পৃঃ ৬১৭) ইঙ্গিত করেছেন।
শায়খ শু‘আইব সাধারণত আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর এই দ্ব্যর্থহীন বক্তব্য ও সঠিক অবস্থা সম্পর্কে বেখবর রয়েছেন। এজন্য তার এই অপবাদ ‘অন্ধকারে ঢিল ছোঁড়ার ন্যায়’ হয়েছে অথবা সমকালীন হওয়ার ফলাফল।
অন্যান্য ইমামদের বক্তব্যের প্রতি ভ্রূক্ষেপ না করা :
শায়খ
শু‘আইব এই অপবাদও আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর উপর আরোপ করেছেন যে, ‘তিনি
হাদীছের উপর হুকুম আরোপের ক্ষেত্রে অন্যান্য ইমামদের উক্তিসমূহ এড়িয়ে
যেতেন। তিনি যখন কোন হাদীছকে ছহীহ আখ্যা দেন যেটাকে অন্যান্য (হাদীছের)
হাফেযগণ যঈফ বলেছেন; তখন অন্যান্য (হাফেয, ইমামদের) উক্তিসমূহ তিনি উল্লেখ
করতেন না। এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, তিনি লোকদেরকে স্বীয় উক্তিসমূহের
আনুগত্য করানোর জন্য দাঁড় করাতে চান’।[22]
কিন্তু প্রথম দাবীর ন্যায় এই দাবীটিও ভিত্তিহীন। আফসোস! শায়খ শু‘আইব আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর ছহীহ আখ্যাদানকৃত হাযারো হাদীছের মধ্য হ’তে একটির উদাহরণও যদি পেশ করতেন! কোন হাদীছের তাছহীহ হোক বা তাযঈফ হোক-তিনি উভয় ক্ষেত্রেই পূর্বোক্ত ইমামদের উক্তিসমূহ উল্লেখ করেন এবং যেটাকে ইলমী মূলনীতির আলোকে সঠিক মনে করেন সেটার (অনুকূলে) ফায়ছালা দেন। ‘তিনি লোকদেরকে স্বীয় উক্তিসমূহের আনুগত্য করানোর জন্য দাঁড় করাতে চান’-কথাটিও শায়খ শু‘আইবের মনগড়া আবিষ্কার। যদি এমনটা হ’ত তাহ’লে তার হুকুমের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম তার ছাত্ররা ‘দাঁড়িয়ে’ যেতেন। পক্ষান্তরে আমরা দেখি যে, তারা শায়খের সাথে এখতেলাফ করেছেন। এমনকি আমর আব্দুল আযীম হুয়ায়নী তার ছাত্র আবূ ইসহাক্ব হুয়ায়নীর ইখতিলাফের উপর الترياق باحاديث قواها الالباني وضعها ابو اسحاق নামে একটি স্বতন্ত্র গ্রন্থ রচনা করেছেন। এটা আলাদা বিষয় যে, তাছহীহ ও তাযঈফের জন্য পূর্বোক্ত ইমামদের সকল উক্তি অবগত থাকার দাবী কেউই করেননি। وَفَوْقَ كُلِّ ذِيْ عِلْمٍ عَلِيْم ‘প্রত্যেক জ্ঞানীর উপর জ্ঞানী রয়েছে’-এরই বাস্তব ইঙ্গিত। যা অস্বীকার করার সুযোগ কারো নেই।
শায়খ আলবানী (রহঃ)-এর কাজের পুনঃনিরীক্ষণ করার প্রয়োজনীয়তা :
এই শিরোনামের অধীনে শায়খ শু‘আইব বলেছেন যে, ‘আলামা আলবানীর ইলমী কাজের উপর পুনঃনিরীক্ষণ করা প্রয়োজন’। এই কথাকে কে অস্বীকার করতে পারে? তাঁর ছাত্ররাও এটা অস্বীকার করেন না। এটাই কারণ যে তারা তার (আলবানীর) সাথে মতানৈক্যও করেন। আল্লামা আলবানী হোন বা অন্য কেউ হোন-কারো হুকুমকে শেষ বক্তব্য বলা যেতে পারে না। তবে আল্লাহ যা চান তা ব্যতীত। শায়খ শু‘আইবের এ জাতীয় কাজের কি পুনঃনিরীক্ষণ করার সুযোগ নেই? মুসনাদে আহমাদ যা তার তাহক্বীক্ব ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে; আর এই আলোচনায় তিনি নিজের কতিপয় তাহক্বীক্বের বরাত দিয়েছেন। এতে (হা/১৭১৬৫, ২৮/৩৯৮) আবূ আমের আশ‘আরী সম্পর্কে তিনি বলেছেন, اِسْنَادُهُ ضَعِيْفٌ لِاِنْقِطَاعِهِ ‘ইনক্বিতার কারণে এর সনদ যঈফ’। কেননা আলী বিন মুদরিক হযরত আবূ আমের (রাঃ)-এর থেকে শ্রবণ করেননি। এই বর্ণনাটির পুনরাবৃত্তি হয়েছে এবং এটা ১৭৭৯৮ হাদীছের অধীনেও বর্ণিত আছে। কিন্তু সেখানে শায়খ শু‘আইব বলেছেন, اِسْنَادُهُ صَحِيْحٌ رِجَالُهُ ثِقَاتٌ ‘এর সনদ ছহীহ। এর রাবীগণ ছিক্বাহ’। যদি স্রেফ رِجَالُهُ ثِقَاتٌ বলতেন তাহ’লে তাতে পুনঃনিরীক্ষণ করার দরকার হ’ত না। কিন্তু যখন اِسْنَادُهُ صَحِيْحٌ ‘এর সনদ ছহীহ’ বলা হয়েছে তখন এটা পূর্বের হুকুমের বিরোধী হয়েছে। আর মজার বিষয় এই যে, উভয় স্থানে যথারীতি হাদীছ নং সহ তা পুনরুল্লেখিত হওয়ার কথাও বলা হয়েছে। বলুন! এখন এই স্ব বিরোধী হুকুম সম্পর্কে কি বলা যাবে?
শায়খ শু‘আইব-ই নন বরং আল্লামা আলবানী (রহঃ)ও প্রথমে এই বর্ণনাকে ছহীহাহ গ্রন্থে (হা/২৫৬০) উল্লেখ করেছেন এবং ইনক্বিতার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কিন্তু এরপর যঈফা গ্রন্থেও (হা/৪১৩২) এটা নিয়ে এসেছেন এবং ইনক্বিতা অস্বীকারকারীদের খন্ডন করেছেন।
এভাবে শায়খ শু‘আইব একটি বর্ণনার উপর আলোচনায় বলেছেন, আবূ আযিবের জীবনী না আল্লামা হুসাইনী আল-ইকমাল গ্রন্থে করেছেন আর না হাফেয ইবনু হাজার আত-তা‘জীল গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। অথচ সেটা তার শর্ত অনুসারে।
অথচ আবূ আযিব আল-ইকমাল এবং তা‘জলীলু মানফা‘আহ গ্রন্থের শর্ত অনুযায়ীই নেই। কেননা ইনি ইবনু মাজাহর রাবী। আর আত-তাহযীব গ্রন্থে (১২/১৪২) হাফেয ইবনু হাজার তাকে উল্লেখ করেছেন। আবূ আযিবের নাম মুসলিম বিন আমর। শায়খ শু‘আইব তাকে রাবীদের নামের মধ্যে তালাশ করতে থেকেছেন। অন্যদিকে হাফেয ইবনু হাজার (রহঃ) তাকে উপনামে উল্লেখ করেছেন। এতদ্ব্যতীত আব্দুর রহমান বিন হাযরামী সম্পর্কে শায়খ শু‘আইব বলেছেন যে, ‘আমরা তার জীবনী পাইনি’।[23] অথচ ইমাম বুখারী (রহঃ) তার জীবনী ‘আত-তারীখুল কাবীর’ গ্রন্থে এবং ইমাম ইবনু হিববান ‘আছ-ছিক্বাত’ (৫/১০০) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন।
অনুরূপভাবে মুসনাদ আহমাদে ‘আবূ মনছূর যায়দ বিন ওয়াহাব হ’তে’ সনদ রয়েছে। যেটিকে শায়খ শু‘আইব আবূ মনছূরের পরিবর্তে ‘মনছূর’ বানিয়ে দিয়েছেন এবং বলেছেন, ইনি হ’লেন মনছূর বিন মু‘তামির। আমরা মনছূর সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করতে পারিনি যে, ইনি কে। তিনি এটাও বলেছেন, ‘উছূলে খাত্ত্বিইয়া’ এবং জামিউল মাসানীদেও আবূ মনছূর-ই রয়েছে। অথচ আবূ মনছূর নামটিই ছহীহ। তার নাম মায়মূন আল-জুহানী। আর তার জীবনী আত-তারীখুল কাবীর (৭/১৩৪২), আল-জারহু ওয়াত-তা‘দীল (৭/২৩৫), ইবনু হিববানের আছ-ছিক্বাত (৭/৪৭৩) ইত্যাদি গ্রন্থে মওজুদ আছে। আর তিনি নির্ভরযোগ্য রাবী।
এছাড়া শায়খ শু‘আইব এটাও বলেছেন যে, এই হাদীছটি ‘মনছূর’ থেকে কেউই বর্ণনা করেননি। অথচ এই বর্ণনাটি আবূ মনছূর মায়মূন হ’তে ত্বাবারানী আল-আওসাত্ব (হা/৩১৮৩) গ্রন্থে এবং ইমাম দারাকুৎনী আল-ইফরাদ ওয়াল-গারাইব (৪/১১৮) গ্রন্থে বর্ণনা করেছেন। যেমনটি আত্বরাফুল গারাইব ওয়াল ইফরাদ (হা/৪৬৩৭, ৫/৪৯) গ্রন্থে আছে। ইমাম ত্বাবারানী (রহঃ) বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ (বিন ফুযাইল) ব্যতীত এই হাদীছটি আবূ মনছূর হ’তে আর কেউই বর্ণনা করেননি’। অবশ্য আত্বরাফ গ্রন্থে ভুলক্রমে মনছূর বিন মায়মূন আল-জুহানী লিখিত হয়েছে। সঠিক হ’ল আবূ মনছূর মায়মূন আল-জুহানী।
শায়খ শু‘আইব আরো বলেছেন, ‘মুহাম্মাদ বিন যিয়াদ মাহীছাহ হতে’-কে তা আমরা জানি না। সম্ভবত এটি মুহাম্মাদ বিন আইয়ূব হ’তে বিকৃত হয়ে এসেছে।
আরয রইল যে, কোন তাহরীফ হয়নি। ইনি হ’লেন মুহাম্মাদ বিন যিয়াদ আল-কুরাশী আল-জুমাহী। যিনি ছিহাহ তথা কুতুবে সিত্তার রাবী। তাহযীব গ্রন্থে (৯/১৬৯) তার জীবনী মওজূদ আছে।
এই ধরনের আরো দৃষ্টান্ত মওজূদ আছে। সেজন্য কার কাজের ক্ষেত্রে পুনঃ তদন্তের অবকাশ নেই? আম্বিয়ায়ে কেরাম (আঃ) ব্যতীত প্রত্যেক ব্যক্তির বক্তব্য ও কাজের উপর পুনঃনিরীক্ষণের সম্ভাবনা থাকতে পারে। (শুধু) আল্লামা আলবানী (রহঃ) সম্পর্কেই এমন বক্তব্য প্রদান স্রেফ কথায় রং চড়ানোর বৃথা চেষ্টা।
শায়খ আলবানীর ফিক্বহী মর্যাদা :
শায়খ
শু‘আইব আল্লামা আলবানীর হাদীছের খেদমত স্বীকার করেন। কিন্তু এই সম্পর্কে
তার যে সাবধানতা রয়েছে তার পর্যালোচনা আমরা সম্মানিত পাঠকদের সামনে পেশ করে
এসেছি। রইল আল্লামা আলবানীর ফিক্বহী মর্যাদার বিষয়টি, তো এ সম্পর্কে
শায়খ শু‘আইব বলেছেন, ‘ফিক্বহ তার বিষয়-ই নয়’।[24]
অথচ শায়খ আলবানীর বই ‘আছ-ছামারুল মুসতাত্বাব ফী ফিক্বহিস সুন্নাতি ওয়াল কিতাব’ তার হাদীছভিত্তিক ফিক্বহে দক্ষতার একটি প্রমাণ। অনুরূপভাবে ‘আত-তালীক্বাতুল মারযিয়া আলার রওযাতিন নাদিয়া’, আহকামুল জানায়েয, ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), তামামুল মিন্নাহ, আত-তা‘লীক্বাতু আলা সুবুলিস সালাম, আদাবুয যিফাফ ইত্যাদি গ্রন্থগুলিও তার ফিক্বহ ও ইজতেহাদের পক্ষে প্রমাণ বহন করছে। ছহীহাহ গ্রন্থে মাঝে মাঝে ফিক্বহী মাসআলা উল্লেখ করেছেন। তার ফিক্বহ ‘ফিক্বহুল হাদীছ’ ছিল, আহলে রায়ের ফিক্বহ নয়। আল্লামা আলবানী (রহঃ)-এর ফিক্বহী দক্ষতার বিষয়টি অস্বীকার করা নতুন কোন বিষয় নয়। ফিক্বহুল হাদীছের সাথে সম্পৃক্ত আলেমদের ফিক্বহী দক্ষতাকে অস্বীকার করার উপাখ্যান দীর্ঘ। এমনকি কিছু মানুষের দৃষ্টিতে ইমাম আহমাদ, ইমাম বুখারী তো দূরের কথা, হযরত আবূ হুরায়রা (রাঃ)ও ফক্বীহ হিসাবে গণ্য হন না।
[চলবে]
[1]. ছহীহাহ ৭/৮৬৫, ৮৬৬।
[2]. মাসিক বাইয়েনাত, পৃঃ ৩৫।
[3]. হাশিয়া ছিফাতু ছালাতিন নাবী (ছাঃ), পৃঃ ২৫, ১১তম সংস্করণ, ১৪৩০ হিঃ।
[4]. ঐ, পৃঃ ৩৩।
[5]. মুওয়াত্ত্বা পৃঃ ১০৬।
[6]. লুৎফুল্লাহ আন-নাসাফী আল-কায়দানী (মৃত্যু ৯০০ হিঃ/১৪৯৪ খ্রিঃ), খুলাছায়ে কায়দানী (মুম্বাই, ভারত : মাতবা‘আহ ফাতহুল কারীম, ১৮৮৬ খ্রিঃ/১৩০৪ হিঃ), পৃঃ ১৫, ১৬।
[7]. কাশফুয যুনূন ১/২৪২।
[8]. আল-গিয়াছিয়া পৃঃ ২৯।
[9]. দরসে তিরমিযী ২/৬২।
[10]. মুক্বাদ্দামা মুগনী পৃঃ ১৩।
[11]. যাব ঈমান কী বাহার আ-ঈ টীকা পৃঃ ২১৩, ২১৪।
[12]. আত-তাযঈন পৃঃ ৬৬, ৬৭।
[13]. আত-তাফসীরুল কাবীর ১৮/৩৭।
[14]. তানবীরুল আইনাইন পৃঃ ২৭, প্রকাশনায় : লাহোর।
[15]. ইমদাদুল ফাতাওয়া ৫/২৯৭, দারুল উলূম, করাচী।
[16]. ঈক্বাযু হিমাম উলিল আবছার পৃঃ ৯১।
[17]. মাসিক বাইয়েনাত পৃঃ ৩৫।
[18]. আল-জামেউছ ছগীর ২/৬৩।
[19]. তানযীহুশ শরী‘আহ ২/২৪৩।
[20]. মাসিক বাইয়েনাত পৃঃ ৩৫।
[21]. মাসিক বাইয়েনাত পৃঃ ৩৫।
[22]. মাসিক বাইয়েনাত পৃঃ ৩৪।
[23]. তা‘লীকুল মুসনাদ ক্রমিক ১৬৫৯২, ২৭/১৩।
[24]. মাসিক বাইয়েনাত পৃঃ ৩৭।