রাজনৈতিক
ক্ষমতাসীন পক্ষ দেশকে উন্নত রাষ্ট্রের সারিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে দাবী
করলেও সামাজিক-রাজনৈতিক অর্থনৈতিকভাবে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে না পিছিয়ে পড়ছে তা
নিয়ে মানুষের মধ্যে তুমুল বিতর্ক চলছে। মূলধারার গণমাধ্যমের প্রতিদিনকার
খবরে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নানাবিধ ভাইরাল বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করলে
সেখানে মানুষের ক্ষোভ-অসন্তোষের বিষয়গুলোই বেশী ধরা পড়ছে। গণতান্ত্রিক
রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের প্রত্যাশার জায়গা অনেকটা দূরে সরে গেছে।
একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে একতরফা দশম জাতীয় নির্বাচনের পর একশ্রেণীর
সাধারণ মানুষ যখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে সন্দিহান হয়ে উঠেছিল তখন সরকারের
পক্ষ থেকে বলতে শোনা গেল, ‘উন্নয়ন না গণতন্ত্র’ কম গণতন্ত্র বেশী উন্নয়ন
ইত্যাদি কথামালা। দেশের মানুষ যদি অর্থনৈতিকভাবে মুক্তির স্বাদ পায় তাহ’লে
হয়ত কিছুদিনের জন্য হ’লেও গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপোস করতে প্রস্ত্তত আছে।
যদিও আমাদের অতীত ইতিহাস সে কথা বলে না। জেনারেল আইয়ুব খান ও জেনারেল
এরশাদের উন্নয়নের দাবী এ দেশের গণতন্ত্রের দাবীকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। যে
দেশে স্কুল-কলেজ-মাদরাসায় শিশু-কিশোরীরা নিরাপদ নয়। যে দেশে শিক্ষার নামে
অনৈতিক বাণিজ্য বিস্তার লাভ করে। যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের
নিজস্ব রাজনৈতিক মতাদর্শ চর্চার কোন সুযোগ থাকে না, শিক্ষা ও গবেষণার চেয়ে
সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি, নিয়োগ বাণিজ্য ও রক্তক্ষয়ী সংঘাতই প্রতিদিনের সাধারণ
দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেখানে ঘুষ-দুর্নীতি, জনগণের সম্পদের লুণ্ঠন,
সামাজিক-রাজনৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে পরিবর্তনের প্রত্যাশা বাস্তবে রূপায়ণের
গতানুগতিক কোন পথ খোলা থাকে না। কারণ আমাদের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতায়
যে অবক্ষয় ও পশ্চাৎগামিতা দেখা যাচ্ছে তা একদিনে ঘটেনি। এই অবক্ষয় ও
অনৈতিকতার সূচনা প্রথমে শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকেই। তথাকথিত
সার্টিফিকেটধারী উচ্চ শিক্ষিত আমলা, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মাধ্যমেই।
অতএব শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ছাড়া দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে বিদ্যমান অবক্ষয়-অধঃপতনের গহবর থেকে বের করে ইতিবাচক পরিবর্তনের শুভ সূচনা আদৌ সম্ভব নয়। সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক প্রত্যাশা, শৃঙ্খলা, সম্ভাবনা একটি দুষ্টচক্রের গ্যাঁড়াকলে আটকে গেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক বিকাশ এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা ছাড়া পরিবর্তনের আর কোন শান্তিপূর্ণ বিকল্প নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, বিচারব্যবস্থা ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মডেলে প্রতিষ্ঠিত করতে হ’লে প্রথমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ইতিবাচক ও দলনিরপেক্ষ সংস্কার প্রয়োজন। সেই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থায় বিদ্যমান দুর্নীতি, বৈষম্য, বাণিজ্য ও দলবাজির সুযোগ চিরতরে রুদ্ধ করতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেন বিশেষ দল ও গোষ্ঠির রাজনৈতিক উচ্চাভিলাস হাছিলের মতলবী হাতিয়ারে পরিণত না হয় তার আইনগত সুরক্ষা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একটি সর্বদলীয় সংলাপ ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া প্রয়োজন। বিগত দশকের শেষদিকে সরকার তড়িঘড়ি একটি শিক্ষানীতি গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও সে সময় কোন রাজনৈতিক দলই শিক্ষাব্যবস্থার ভালমন্দ সম্পর্কে তেমন কোন জোরালো প্রশ্ন তোলেনি। শিক্ষানীতি ও শিক্ষাব্যবস্থার সাথে জাতির মৌলিক আকাঙ্খা ও লক্ষ্যাভিসারি পরিকল্পনার সম্পর্ক জড়িত। এটি কোন সাময়িক রাজনৈতিক বিষয় নয়। এক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক পক্ষের নিজস্ব পর্যবেক্ষণ, মতামত ও কর্মপন্থার পর্যালোচনা জনসম্মুখে উঠে আসা প্রয়োজন।
দেশের চলমান শিক্ষাব্যবস্থা সামাজিক-অর্থনৈতিক কোন চাহিদাই পূরণ করতে পারছে না। তৈরী পোশাক শিল্পের মত বিপুল কর্মসংস্থান নির্ভর রফতানীমুখী শিল্পের বিকাশ ঘটলেও একদিকে এসব শিল্প কারখানায় হাযার হাযার বিদেশী (প্রধানত ভারতীয়) শ্রমিক উচ্চ বেতনে চাকুরী করে দেশ থেকে বছরে শত শত কোটি ডলার বিদেশীরা নিয়ে যাচ্ছে; অন্যদিকে দেশে প্রতিবছরই শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গার্মেন্টস সেক্টরে যেসব ভারতীয় শ্রমিক কাজ করছে তাদের সমান শিক্ষিত লাখ লাখ তরুণ যুবক ১০-২০ হাযার টাকা বেতনের চাকুরীর জন্য হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত ইংরেজী ভাষা শিক্ষা বাধ্যতামূলক হ’লেও দেশের শিক্ষিত তরুণরা নাকি ইংরেজীতে কমিউনিকেশনে অদক্ষ হওয়ার কারণে গার্মেন্টস সেক্টরের বিদেশীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে হয় এমন চাকুরীতে ভারতীয়দের নিয়োগ দিচ্ছে বিনিয়োগকারীরা। এই বক্তব্যের সত্যাসত্য যাই হোক, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা ও ব্যর্থতা এখানে অনেকটাই স্পষ্ট। গার্মেন্টস সেক্টরের উচ্চ বেতনের চাকুরীতে দেশের শিক্ষিত বেকারদের নিয়োগ দিতে বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা খুব কঠিন কিছু নয়। এমনকি চাকুরীতে নিয়োগ দেয়ার পরও স্বল্প ও মধ্য মেয়াদী প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। দেশে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেলেও গত এক দশকে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে ভারতের রেমিটেন্স আয়ের অন্যতম উৎস। প্রকাশিত এক রিপোর্ট অনুসারে, ভারতীয় শ্রমিকরা বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠায় তা জাপান, যুক্তরাজ্য, কানাডা, কুয়েত, কাতার থেকে অনেক বেশী। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রেমিটেন্স আয়ের দেশ হিসাবে ভারত ২০১৭ সালে সর্বোচ্চ রেমিটেন্স আয় করে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে, ভারতের দ্বিতীয় রেমিসটেন্স আয়ের দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তৃতীয় সঊদী আরব এবং চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতীয়রা এখান থেকে শত শত কোটি ডলার নিয়ে যাচ্ছে, অথচ আমাদের শিক্ষিত বেকারদের এক বড় অংশ দেশে চাকুরী পেতে ব্যর্থ হয়ে জীবন বাজি রেখে বিপদসঙ্কুল পথে বিদেশে পাড়ি জমাতে বাধ্য হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যের গৃহযুদ্ধ কবলিত দেশগুলোতে থেকে প্রাণ বাঁচাতে হাযার হাযার নাগরিক জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোতে পাড়ি জমাতে গিয়ে প্রায়শ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে মমার্ন্তিক ঘটনার শিকার হচ্ছে অথবা উপকুলীয় সীমান্তরক্ষীদের হাতে ধরা পড়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হচ্ছে। এক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিতভাবে উঠে আসছে বাংলাদেশীদের ছবি। যেখানেই বিপদসঙ্কুল মাইগ্রেশনের ঘটনা সেখানেই বাংলাদেশীদের নাম জড়িয়ে যাচ্ছে। অথচ দেশের রফতানীমুখী গার্মেন্টস সেক্টরসহ ম্যানুফেকচারিং খাতের বিভিন্ন সেক্টরে বৈধ-অবৈধভাবে লাখ লাখ ভারতীয় শ্রমিক কাজ করে দেশ থেকে হাযার হাযার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। অনুরূপভাবে ভারতের ম্যানুফ্যাকচারিং খাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের কাজের কোন সুযোগ নেই বললেই চলে। যেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সঊদী আরবের মত সস্তায় বিদেশী শ্রমিক নির্ভর ধনী দেশগুলোও বিদেশীদের চাকুরীর সুযোগ সংকোচিত করে স্থানীয় শ্রমিক নিয়োগের জন্য নানা রকম আইনগত বাধ্যবধকতা সৃষ্টি করে চলেছে, সেখানে লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ যুবককে বেকার রেখে বিদেশী শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ অবারিত করা হয়েছে। এ এক বিষ্ময়কর বাস্তবতা, এ বিষয়ে সরকারকে অবশ্যই কার্যকর সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
দেশে শিক্ষিত বেকারের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা এবং বিভিন্ন সেক্টরে বিদেশী শ্রমিক নির্ভরতা থেকেই আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতা ও অনুপযোগিতার বিষয়টি বুঝা যায়। দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেছনে জনগণের রাজস্ব থেকে বছরে হাযার হাযার কোটি টাকা ব্যয় করা হ’লেও এসব প্রতিষ্ঠান দেশকে কি দিচ্ছে তার কোন হিসাব-নিকাশ, জবাবদিহিতা বা পর্যালোচনা আছে বলে মনে হয় না। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন ভাতার পেছনে ক্রমবর্ধমান হারে হাযার হাযার কোটি টাকা ব্যয় করা হ’লেও শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতার বিকাশ, ভাষা শিক্ষায় দক্ষতা নিশ্চিতকরণ, কারিগরী ও গবেষণা খাতের উন্নয়নে তেমন কোন অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এসব খাতের বাজেট বরাদ্দও কমতে কমতে অনুল্লেখযোগ্য আকার লাভ করেছে। এসব কারণে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক কোন র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ কোন বিশ্ববিদ্যালয়েরই স্থান হচ্ছে না। এটি জাতি হিসাবে আমাদের পিছিয়ে পড়া ও বিপর্যয়ের নিদর্শন। যুক্তরাজ্যের টাইমস হায়ার এডুকেশন সাময়িকী প্রতি বছর বিশ্বের উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নির্ধারণে পর্যায়ক্রমিক তালিকা প্রকাশ করে থাকে। সম্প্রতি টাইমস হায়ার এডুকেশনের জরিপে এশিয়ার ৪১৭টি বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশিত হ’লেও সে তালিকায় বাংলাদেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম স্থান পায়নি। তবে ইতিপূর্বে প্রকাশিত টাইমস হায়ার এডুকেশন জরিপে ৫ শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ছিল। চীনের শত শত বিশ্ববিদ্যালয় এ তালিকায় স্থান পাওয়ার তুলনা বাদ দিলেও, তালিকায় ভারতের অর্ধশত, পাকিস্তানের ৯টিসহ দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভূক্ত দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কার কলম্বো এবং নেপালের ত্রিভুবন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান হ’লেও এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বাংলাদেশের সরকারী-বেসরকারী দেড়শতাধিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশেষায়িত উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটিও আঞ্চলিক তালিকায় স্থান না পাওয়ার বাস্তবতা উদ্বেগজনক। এর মানে হচ্ছে, আমাদের সরকারী-বেসরকারী কোন বিশ্ববিদ্যালয়ই ন্যুনতম মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠার শর্ত পূরণ করতে পারছে না। এখন থেকে অর্ধশত বছর আগেও আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে স্বীকৃত ছিল। অনেকে একে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড বলে আখ্যায়িত করেছেন।
পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়তন, পরিধি, অবকাঠামো, পরিবেশ ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সংখ্যায় যে কোন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের সমকক্ষ। তাহ’লে ঘাটতিটা কোথায় তা আমাদের বুঝতে হবে। মূলতঃ শিক্ষকের মানই একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানের প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনায় আইনগত স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা, শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি ও শর্তাবলী শিক্ষকের মান নিশ্চিত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানেই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমাহীন ব্যর্থতা ধরা পড়ছে। দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছাহেব যখন ছাত্র-শিক্ষকদের বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক গবেষণা, সৃজনশীলতা ও মননশীলতার চর্চার কথা বেমা‘লূম ভুলে গিয়ে ১০ টাকায় চা-সিঙ্গারা-চপ-সমুচা খাওয়ার সুবিধাকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। এ কারণে তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়কে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম তোলার উপযুক্ত বলে দাবী করেন, তখন এশিয়ার চারশতাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকার র্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকার কারণ সহজেই অনুমেয়।
ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্ব, শিক্ষক ও ছাত্র রাজনীতিতে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে এ্যাকাডেমিক যোগ্যতা না দেখে দলীয় আনুগত্যকে মানদন্ড হিসাবে বিবেচনা করার সাম্প্রতিক রেওয়াজ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সবদিক থেকে ডুবিয়েছে। ছাত্র-শিক্ষকদের লাগামহীন অপরাজনীতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এক সময় সন্ত্রস্ত-রক্তাক্ত করে তোলে। দেশের প্রায় সবগুলো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দলবাজ শিক্ষক ও ছাত্ররা সে পথ ধরে প্রতিটি পবিত্র ক্যাম্পাসকে সন্ত্রাস-রক্তপাতসহ নানা অনৈতিক কর্মকান্ডে কলঙ্কিত করে তুলেছে। এভাবে আমাদের উচ্চশিক্ষার সৃষ্টিশীল উদ্ভাবনী শক্তি সন্ত্রাসী, ধর্ষক-দখলবাজদের হাতে যিম্মী হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রত্যাশিত মান বজায় রাখতে না পারা এবং শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত পরিবেশ নস্যাৎ হওয়ার পেছনে দেশের সামগ্রিক সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দায়ী করা যায়। মূলতঃ এটি একটি ভিসাশ সার্কেল, শিক্ষাঙ্গণের বিশৃঙ্খলা, দলবাজি ও অনৈতিক দখলবাজির কারণেই সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে পুরো সমাজব্যবস্থার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষার নিম্নস্তর থেকে শুরু হওয়া দলবাজি, দখলবাজি ও অনৈতিকতার চর্চা ক্রমে উচ্চশিক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি মাদরাসা শিক্ষাকে পর্যন্ত গ্রাস করে ফেলেছে। সোনাগাজীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাতের উপর নির্যাতন, হত্যার আগে ও পরের ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের দখলবাজি ও অনৈতিক চর্চার একটি চিত্র পাওয়া যায়। সরকারীদলের স্থানীয় নেতা থেকে শুরু করে পুলিশের স্থানীয় দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এসব অপকর্মের সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আগুনে পুড়িয়ে ছাত্রী হত্যার মত নৃসংশতা না ঘটলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান এবং ম্যানেজিং কমিটি ও সরকারীদলের স্থানীয় নেতাদের কুপ্রভাবের যোগসাজশ কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। সম্প্রতি এক শিক্ষক সমাবেশে শিক্ষাউপমন্ত্রী মহিবুল হাসান নওফেল বলেছেন, ম্যানেজিং কমিটির অশিক্ষিত সদস্যরাই শিক্ষকদের উপর বেশী কর্তৃত্ব ফলান। শিক্ষা উপমন্ত্রী বয়েসে তরুন, তিনি ভণিতা বা কপটতা না করে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।
অর্থ ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় প্রাথমিক, মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অশিক্ষিত ব্যক্তিরা ম্যানেজিং কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে থাকে। এরা শিক্ষকদের উপর অনৈতিকভাবে কর্তৃত্ব ফলানোর চেষ্টা করলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক চলমানতা ব্যাহত হ’তে বাধ্য। অনেক অশিক্ষিত ব্যক্তিও জমি-জিরাত সম্পদ দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন এমন উদাহরণ সারাদেশে অসংখ্য। যেসব দানশীল ব্যক্তিরা নিঃস্বার্থভাবে শিক্ষা উন্নয়নে অবদান রাখেন তারা শিক্ষকদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছেন, এমন অভিযোগ বিরল। তবে সাম্প্রতিক বাস্তবতা হচ্ছে, এক শ্রেণীর ব্যক্তি স্থানীয় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনৈতিক প্রভাব সৃষ্টি করে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ ও শৃঙ্খলা নষ্ট করে দিচ্ছে। দেশের হাযার হাযার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোন ম্যানেজিং কমিটিই নেই। স্থানীয় প্রভাবশালীরা মোটা টাকার বিনিময়ে অযোগ্য শিক্ষক ও প্রধানশিক্ষক নিয়োগের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইনগত জটিলতা ও মামলাবাজির জন্ম দিয়ে ম্যানেজিং কমিটি গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার ঘটনাও অনেক।
নারায়ণগঞ্জের কানাইনগর ছোবহানিয়া উচ্চবিদ্যালয় থেকে আশির দশকে এসএসসি পাস করেছিলাম। আমার পিতা মরহুম মেছবাহুল বারী আমার দাদার নামে ১৯৬০ সালে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে নববই দশক পর্যন্ত বিদ্যালয়টি নারায়ণগঞ্জের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসাবে পরিগণিত ছিল। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল, শিক্ষকদের মান, শিক্ষার পরিবেশ এবং সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা পালনের মধ্য দিয়ে বিদ্যালয়টি সামাজিক বন্ধন ও ঐক্য প্রতিষ্ঠায় মূল দায়িত্ব পালন করেছে। এক-এগারো সরকারের সময় রাজনৈতিক কারণে ম্যানেজিং কমিটি বাতিল হওয়া এবং অস্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর স্থানীয় এমপিকে প্রভাবিত করে একজন অযোগ্য-অদক্ষ ব্যক্তিকে এই ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রিন্সিপ্যাল হিসাবে নিয়োগ দেয়ার পর থেকে প্রতিষ্ঠানটির ধ্বংসযাত্রা শুরু হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি করে বছরের পর বছর ধরে কোন কমিটি ছাড়াই চলছে বিদ্যালয়টি। পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলে ক্রমাবনতি এবং নানাবিধ দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা মানব বন্ধন করে, দুর্নীতি দমন বিভাগে অভিযোগ করলেও স্থানীয় প্রভাবশালীদের গোপণ ছত্রছায়ায় দুর্নীতিবাজ প্রধানশিক্ষক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা স্কুলটিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। বিশাল সবুজ মাঠ, গাছপালা শোভিত বিদ্যালয়টি এখন উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণীতে উন্নীত হ’লেও প্রিন্সিপালের অযোগ্যতা, দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ক্রমাবনতি ও শিক্ষার পরিবেশ না থাকার কারণে গত এক দশকে শিক্ষার্থীর সংখ্যা দেড় হাযার থেকে বর্তমানে এক হাযারে নেমে এসেছে। সারাদেশের মাধ্যমিক স্তরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশীরভাগই এমন পরিস্থিতির শিকার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোই হচ্ছে ভবিষ্যতের নাগরিক ও উচ্চশিক্ষার বুনিয়াদ। এসব প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ, নিয়োগবাণিজ্য, দখলবাজি ও অনৈতিক প্রভাবের সুযোগ অব্যাহত রেখে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার কোন মৌলিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষাকে সত্যিকারের জ্ঞানচর্চা ও জাতি গঠনের হাতিয়ারে পরিণত করতে হ’লে প্রথমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক দলবাজি, অনৈতিকতার চর্চা বন্ধ করে যথাযথ নযরদারী ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
\ সংকলিত \