পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । শেষ পর্ব 

৯ম দলীল : হাদীছে এসেছে,

عَنْ عِرْبَاضِ بْنِ سَارِيَةَ، قَالَ: قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: عَلَيْكُمْ بِسُنَّتِيْ وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ الْمَهْدِيِّيْنَ مِنْ بَعْدِيْ وَعَضُّوْا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ-

ইরবায ইবনু সারিয়াহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমাদের উপর আমার সুন্নাত এবং আমার পরে হেদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতের অনুসরণ করা ওয়াজিব। তোমরা তা মাঢ়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে অাঁকড়ে ধরবে’।[1] অন্য হাদীছে এসেছে,

عَنْ حُذَيْفَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ اقْتَدُوْا بِاللَّذَيْنَ مِنْ بَعْدِىْ أَبِىْ بَكْرٍ وَعُمَرَ.

হুযাইফা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা আমার পরে যারা রয়েছে তাদের মধ্যে আবু বকর ও ওমর (রাঃ)-এর আনুগত্য কর’।[2] উল্লেখিত হাদীছদ্বয়ে যেহেতু খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরার এবং বিশেষ করে আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর আনুগত্য করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেহেতু এখানে তাক্বলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়েছে।

জবাব : ১- তাক্বলীদপন্থীরা প্রথমেই উল্লেখিত হাদীছ দু’টির বিরোধিতা করেছে। যেমন তাদের কতিপয় বিদ্বান আবু বকর (রাঃ) ও ওমর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করাকে না জায়েয বলে উল্লেখ করে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর তাক্বলীদ করা ওয়াজিব বলেছেন।[3]

২- উল্লেখিত হাদীছে নির্দেশ করা হয়েছে যে, যখন কোন বিষয়ে মতভেদ দেখা দিবে তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে অাঁকড়ে ধরবে। এতে সঠিক ফায়ছালায় উপনীত হ’তে না পারলে খুলাফায়ে রাশিদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে। এখানে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশকে উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি ও মাযহাবের অনুসরণ করার নির্দেশ নেই।

৩- উল্লেখিত হাদীছে দ্বীনের মধ্যে নতুন সৃষ্টি করা থেকে সতর্ক করা হয়েছে এবং তাকে বিদ‘আত বলে অখ্যায়িত করা হয়েছে। আর তাক্বলীদপন্থীরা দ্বীনের বিধান মানার ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করে থাকে, যা বিদ‘আত।[4]

৪- ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, আমরা জেনেছি যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সক্ষমতার বাইরে কোন নির্দেশ দেননি। এর পরেও খুলাফায়ে রাশিদীনের মধ্যে তীব্র মতভেদ লক্ষ্য করা যায়, যা তিনটি বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

(ক) মতভেদ সম্বলিত বিষয়ের সকল মতকে গ্রহণ করা ইসলামী শরী‘আতে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। আবার কোন ব্যক্তির পক্ষে পরস্পর বিরোধী দু’টি মতকে গ্রহণ করা সম্ভব নয়। যেমন আবু বকর (রাঃ) ও আয়েশা (রাঃ)-এর মতে দাদার উপস্থিতিতে ভাইয়েরা পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওয়ারিছ হবে না। ওমর (রাঃ)-এর মতে দাদা এক-তৃতীয়াংশ পাবে এবং বাকী সম্পদ ভাইয়েরা পাবে। আর আলী (রাঃ)-এর মতে দাদা এক-ষষ্টাংশ পাবে এবং বাকী সম্পদ ভাইয়েরা পাবে। অনুরূপভাবে প্রত্যেকটি মতভেদ সম্বলিত বিষয়ে কোন ব্যক্তির পক্ষে সকল মতকেই গ্রহণ করা সম্ভব নয়। অতএব এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল।

(খ) কোন একটি মতকে গ্রহণ করে বাকী মতগুলোকে প্রত্যাখ্যান করা। এটাও ইসলাম বহির্ভূত দৃষ্টিভঙ্গি। কেননা আমাদের জন্য কেবল আল্লাহ তা‘আালার বিধানকে গ্রহণ করা ওয়াজিব। নিজের ইচ্ছামত কেউ কোন হারামকে হালাল এবং কোন হালালকে হারাম করতে পারে না। কারণ দ্বীন ইসলাম পরিপূর্ণ। আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ ‘আজ হ’তে আমি তোমাদের দ্বীন ইসলামকে পরিপূর্ণ করে দিলাম’ (মায়েদাহ ৩)। তিনি অন্যত্র বলেন,تِلْكَ حُدُوْدُ اللهِ فَلَا تَعْتَدُوْهَا وَمَنْ يَتَعَدَّ حُدُوْدَ اللهِ فَأُوْلَئِكَ هُمُ الظَّالِمُوْنَ ‘এটা আল্লাহর সীমারেখা। সুতরাং তোমরা তা লঙ্ঘন কর না। আর যারা আল্লাহর সীমারেখাসমূহ লঙ্ঘন করে, বস্ত্তত তারাই যালিম’ (বাকারাহ ২২৯)। তিনি অন্যত্র বলেন, وَأَطِيْعُوا اللهَ وَرَسُوْلَهُ وَلاَ تَنَازَعُوْا ‘তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে ও নিজেদের মধ্যে বিবাদ করবে না’ (আনফাল ৪৬)। উলেলখিত আয়াতগুলো এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল হওয়ার জন্য যথেষ্ট। অতএব আল্লাহ তা‘আলা যা হারাম করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত হারাম, যা ওয়াজিব করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত ওয়াজিব এবং যা হালাল করেছেন তা ক্বিয়ামত পর্যন্ত হালাল বলে গণ্য হবে। অনুরূপভাবে যদি কোন একজন খলীফার মতকে গ্রহণ করা হয়, তাহ’লে অপর খলীফার মতকে প্রত্যাখ্যান করা হবে। এক্ষেত্রে আমরা খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্যশীল হ’তে পারব না এবং উল্লেখিত হাদীছের বিরোধিতা অথবা অস্বীকার করা হবে।

(গ) খুলাফায়ে রাশিদীন যে বিষয়ে ঐক্যমত পোষণ করেছেন, তা গ্রহণ করা। আর তা গ্রহণীয় হবে না যদি অন্যান্য ছাহাবীগণ তাঁদের সাথে ঐক্যমত পোষণ না করেন এবং তাদের মত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতের অনুকূলে না হয়।[5]

ইবনু হাযম (রহঃ) আরো বলেন, ‘খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্য করতে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নির্দেশের দু’টি অর্থ হ’তে। যথা- (১) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাতকে বাদ দিয়ে তাঁদের মন মত সুন্নাত তৈরী করা বৈধ করেছেন। আর এটা কোন মুসলিমের কথা হ’তে পারে না। যে ব্যক্তি এটা জায়েয করবে সে কাফির ও মুরতাদ হয়ে যাবে, তার জান-মাল হালাল বলে গণ্য হবে। কেননা দ্বীন ইসলামের সকল বিধান ওয়াজিব কিংবা ওয়জিব নয়, হালাল অথবা হারাম। মূলত দ্বীনের মধ্যে এর বাইরে কোন প্রকার নেই।

অতএব যে ব্যক্তি খুলাফায়ে রাশিদীনের এমন কোন সুন্নাত তৈরী করাকে বৈধ মনে করবে, যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সুন্নাত বলে গণ্য করেননি, সে এমন কিছুকে হারাম করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত হালাল ছিল। অথবা এমন কিছুকে হালাল করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হারাম করেছেন। অথবা এমন কিছুকে ওয়াজিব করবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ওয়াজিব করেননি। অথবা এমন কোন ফরযকে ছেড়ে দিবে যা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ফরয করেছেন এবং তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত ছাড়েননি। এসব কিছুকে যদি কেউ বৈধ মনে করে, তাহ’লে সে কাফির-মুশরিক হিসাবে গণ্য হবে, যা উম্মাতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। এক্ষেত্রে কোন মতভেদ নেই। অতএব এই দৃষ্টিভঙ্গি বাতিল।[6]

(২) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অনুযায়ী খুলাফায়ে রাশিদীনের আনুগত্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে উল্লেখিত হাদীছ দ্বারা এই নির্দেশ ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশ দেওয়া হয়নি।

ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন,

 وإذ لم يبق إلا هذا فقد سقط شغبهم وليس في العالم شيء إلا وفيه سنة منصوصة

‘যদি এই নির্দেশ ব্যতীত অন্য কোন নির্দেশ না দেওয়া হয়, তাহ’লে তাদের দ্বন্দ্বের অবসান হ’ল। আর পৃথিবীতে এমন কিছু নেই, যা নির্দিষ্ট সুন্নাত দ্বারা প্রমাণিত নয়’।[7]

৫- আবু বকর ও ওমর (রাঃ) সহ বাকী খলীফাদের আনুগত্য করা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। আর শারঈ দলীল ছাড়া এই আনুগত্য অন্য কারো দিকে নিয়ে যাওয়া বৈধ নয়।[8]

১০ম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ বলেছেন, ما استبان لك فاعمل به وما اشتبه عليك فكله إلى عالمه ‘তোমার নিকটে (দলীল) স্পষ্ট হ’লে তুমি তা আমল কর। আর (দলীল) অস্পষ্ট হ’লে আলেমের নিকটে অর্পণ কর’।[9]

জবাব : উল্লেখিত আছারটিই তাক্বলীদপন্থীদের দাবীকে খন্ডন করার এক শক্তিশালী দলীল। কেননা উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) ও অন্যান্য ছাহাবীগণ বলেছেন, ما استبان لك فاعمل به ‘তোমার নিকটে (দলীল) স্পষ্ট হ’লে তুমি তা আমল কর’। অথচ তাক্বলীদপন্থীদের নিকটে রাসূল (ছাঃ)-এর সুন্নাত স্পষ্ট হওয়ার পরেও তারা অনুসরণীয় ব্যক্তি বা মাযহাবের কোন রায় বা মতকে ছেড়ে রাসূলের সুন্নাতের দিকে ফিরে আসে না। বরং রাসূলের সুন্নাতকে উপেক্ষা করে তার উপরই আমল করতে থাকে এবং তা দ্বারাই ফৎওয়া প্রদান করে। পরের অংশে বলা হয়েছে, وما اشتبه عليك فكله إلى عالمه ‘আর (দলীল) অস্পষ্ট হ’লে আলেমের নিকটে অর্পণ কর’। অথচ তাক্বলীদপন্থীরা কোন মাসআলাকে তার যোগ্য আলেম তথা রাসূল (ছাঃ)-এর ছাহাবীদের নিকটে অর্পণ করে না, যারা দ্বীনের ব্যাপারে অধিক জ্ঞাত। বরং তারা তাঁদের কথাকে উপেক্ষা করে অনুসরণীয় মাযহাবের মতের উপরেই অটল থাকে।[10]

১১তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই ফৎওয়া প্রদান করতেন। আর যেহেতু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় ছাহাবীদের কোন কথা দলীল হ’তে পারে না, সেহেতু এটা অকাট্য তাক্বলীদ।

জবাব : ছাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় তাঁর প্রদত্ত ফৎওয়া প্রচার করতেন মাত্র। তাদের মন মত ফৎওয়া প্রদান করতেন না। তাঁরা বলতেন, রাসূল (ছাঃ) নির্দেশ দিয়েছেন, তিনি এ কাজ করেছেন, তিনি নিষেধ করেছেন ইত্যাদি। তাঁরা কোন ব্যক্তি বা মাযহাবের তাক্বলীদ করতেন না, যেমন তাক্বলীদপন্থীরা করে, যদিও তা সুন্নাতবিরোধী হয়।[11] 

১২তম দলীল : ইবনু যুবাইর (রাঃ) হ’তে ছহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি দাদা এবং ভাইয়ের অংশ সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হ’লেন। জবাবে তিনি বললেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيْلاً، لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً ‘যদি আমি কাউকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম, তাহ’লে আবু বকরকেই বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম’।[12] আর আবু বকর (রাঃ) দাদাকে বাবার স্থলাভিষিক্ত বলেছেন। অতএব এখানে ইবনু যুবাইর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর তাক্বলীদ করেছেন।

জবাব : এখানে এমন কিছু নেই, যা দ্বারা তাকবলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়। কেননা ইবনু যুবাইর (রাঃ) আবু বকর (রাঃ)-এর কথাকে অধিক ছহীহ হওয়ার কারণে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। অতএব ইবনু যুবাইর (রাঃ) স্পষ্ট শারঈ দলীলের উপর আবু বকর (রাঃ)-এর কথাকে প্রাধান্য দেননি যেমন তাক্বলীদপন্থীরা প্রাধান্য দিয়ে থাকে।[13]

১৩তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, যেমন সাত প্রকার ক্বিরাআতের মধ্যে যেকোন এক প্রকারের ক্বিরাআতে কুরআন তেলাওয়াত জায়েয, তেমনি চার মাযহাবের যেকোন এক মাযহাবের তাক্বলীদ করা জায়েয। এ দু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।

জবাব : এই যুক্তি স্পষ্ট ভুল। কেননা সাত প্রকার ক্বিরাআত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) হ’তে মুতাওয়াতির সূত্রে প্রমাণিত। আরবদের বিভিন্ন গোত্রের মানুষের কুরআন তেলাওয়াত সহজ করার জন্য তিনি সাত প্রকার ক্বিরাআতের অনুমোদন দিয়েছেন। আর এই কারণে প্রত্যেক মুসলিমের উপর যেকোন এক প্রকারের ক্বিরাআত জায়েয। কিন্তু প্রচলিত চার মাযহাব শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত নয় এবং প্রত্যেকটি মাযহাবের মধ্যে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে।[14]

১৪তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, যেমন অন্ধ ব্যক্তির ছালাতের সময় ও ক্বিবলা নির্ধারণের জন্য অন্যের তাক্বলীদ করা ও নৌকা আরোহীর ছালাতের সময় ও ক্বিবলা নির্ধারণের জন্য নদীর তীরে অবস্থানরত কৃষকের তাক্বলীদ করা উম্মাতের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। অতএব এটা খাঁটি তাক্বলীদ।

জবাব : ইবনু হাযম (রহঃ) বলেন, এটা তাক্বলীদের কোন দলীল নয়। কেননা তারা এর দ্বারা অন্যের সংবাদ গ্রহণ করা হয়েছে। দ্বীনের ব্যাপারে দলীল বিহীন কোন ফৎওয়া গ্রহণ করা হয়নি। আর এটা এমন কোন বিষয় নয়, যা দ্বারা কোন হালালকে হারাম করা হয়েছে, অথবা ফরয নয় এমন কোন বিষয়কে ফরয করা হয়েছে, অথবা কোন ফরযকে ত্যাগ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে দলীল হিসাবে যা উল্লেখ করা হয়েছে তা তাক্বলীদ নয়; বরং সংবাদ মাত্র। আর অনেক ক্ষেত্রে খবরে ওয়াহেদ গ্রহণযোগ্য যা ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। যেমন কোন ঋতুবর্তী মহিলার হায়েয থেকে পবিত্র হওয়ার সংবাদ শুনে স্ত্রী মিলন বৈধ হয়ে থাকে।[15]

১৫তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, رأي الصحابة لنا خير من رأينا لأنفسنا ‘আমাদের নিজেদের রায় বা মতের চেয়ে ছাহাবীদের রায় বা মত উত্তম।[16] অতএব আমরা বলব, আমাদের নিজেদের রায় বা মতের চেয়ে ইমাম শাফেঈ (রহঃ) ও অন্যান্য ইমামদের রায় বা মত উত্তম।

জবাব : ১- তাক্বলীদপন্থীরাই সবার পূর্বে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর কথাকে উপেক্ষা করে। কেননা তারা তাদের অনুসরণীয় ইমামদের রায় বা মতের চেয়ে ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর রায় বা মতকে উত্তম মনে করে না।

২- উল্লেখিত দলীল মূলতঃ তাকবলীদের বৈধতা প্রমাণ করে না। তাছাড়া ছাহাবীগণ ব্যতীত অন্য কারো অনুসরণ করা ওয়াজিব নয়। তাঁরা সরাসরি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হ’তে ইলম অর্জন করেছেন, কোন মাধ্যম ছাড়াই আল্লাহর রাসূলের নিকটে অহি-র অবতরণ অবলোকন করেছেন, তাদের ভাষাতেই (আরবী) অহী নাযিল হয়েছে। কোন সমস্যায় সরাসরি আল্লাহর রাসূলের নিকট হ’তে সমাধান গ্রহণ করেছেন। তাদের পরে এমন কেউ এই মর্যাদায় পেঁŠছতে পরেনি, যার তাক্বলীদ করা যেতে পারে।

৩- ছাহাবীদের কথা দলীল যা ইজমা দ্বারা প্রমাণিত।[17] পক্ষান্তরে অনুসরণীয় ইমামদের কথা দলীল নয়।

১৬তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, ছালাতের মধ্যে মুক্তাদী যেমন ইমামের তাক্বলীদ করে, ইসলামের বিধান মানার ক্ষেত্রে আমরা তেমন প্রসিদ্ধ চার ইমামের যে কোন একজনের তাক্বলীদ করি।

জবাব : ছালাতের মধ্যে ইমামের অনুসরণ করা তাক্বলীদ নয়। বরং তা হ’ল ইত্তেবা। কেননা তা শারঈ দলীল দ্বারা সাব্যস্ত। অথচ অনুসরণীয় ইমামের তাক্বলীদ করার এমন কোন দলীল নেই। যেখানে বলা হয়েছে যে, তোমরা ইমাম আবু হানীফা অথবা ইমাম শাফেঈর তাক্বলীদ কর।[18]

১৭তম দলীল : তাক্বলীদপন্থীরা বলে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায়ই অন্যান্য মানুষ ফৎওয়া প্রদান করতেন। যেমন হাদীছে বর্ণিত হয়েছে,

 عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ وَزَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِيِّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمَا قَالاَ جَاءَ أَعْرَابِيٌّ فَقَالَ يَا رَسُوْلَ اللهِ اقْضِ بَيْنَنَا بِكِتَابِ اللهِ فَقَامَ خَصْمُهُ فَقَالَ صَدَقَ اقْضِ بَيْنَنَا بِكِتَابِ اللهِ فَقَالَ الأَعْرَابِيُّ إِنَّ ابْنِيْ كَانَ عَسِيْفًا عَلَى هَذَا فَزَنَى بِامْرَأَتِهِ فَقَالُوْا لِيْ عَلَى ابْنِكَ الرَّجْمُ فَفَدَيْتُ ابْنِيْ مِنْهُ بِمِئَةٍ مِنَ الْغَنَمِ وَوَلِيْدَةٍ ثُمَّ سَأَلْتُ أَهْلَ الْعِلْمِ فَقَالُوْا إِنَّمَا عَلَى ابْنِكَ جَلْدُ مِئَةٍ وَتَغْرِيْبُ عَامٍ فَقَالَ النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم لأَقْضِيَنَّ بَيْنَكُمَا بِكِتَابِ اللهِ أَمَّا الْوَلِيْدَةُ وَالْغَنَمُ فَرَدٌّ عَلَيْكَ، وَعَلَى ابْنِكَ جَلْدُ مِئَةٍ وَتَغْرِيْبُ عَامٍ وَأَمَّا أَنْتَ يَا أُنَيْسُ، لِرَجُلٍ فَاغْدُ عَلَى امْرَأَةِ هَذَا فَارْجُمْهَا فَغَدَا عَلَيْهَا أُنَيْسٌ فَرَجَمَهَا.

আবু হুরায়রাহ ও যায়েদ ইবনু খালিদ জুহানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তাঁরা উভয়ে বলেন যে, এক বেদুঈন এসে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কিতাব মুতাবেক আমাদের মাঝে ফায়ছালা করে দিন। তখন তার প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে বলল, সে ঠিকই বলেছে, হ্যঁা, আপনি আমাদের মাঝে কিতাবুল্লাহ মুতাবেক ফায়ছালা করুন। পরে বেদুঈন বলল, আমার ছেলে এ লোকের বাড়িতে মজুর ছিল। অতঃপর তার স্ত্রীর সঙ্গে সে যিনা করে। লোকেরা আমাকে বলল, তোমার ছেলের উপরে রজম (পাথরের আঘাতে হত্যা) ওয়াজিব হয়েছে। তখন আমার ছেলেকে একশ’ বকরী ও একটি বাঁদীর বিনিময়ে এর নিকট হ’তে মুক্ত করে এনেছি। পরে আমি আলিমদের নিকট জিজ্ঞেস করলে তাঁরা বললেন, তোমার ছেলের উপর একশ’ বেত্রাঘাত এবং এক বছরের নির্বাসন ওয়াজিব হয়েছে। সব শুনে নবী (ছাঃ) বললেন, আমি তোমাদের মাঝে কিতাবুল্লাহ মুতাবেকই ফায়ছালা করব। বাঁদী এবং বকরীর পাল তোমাকে ফেরত দেওয়া হবে, আর তোমার ছেলেকে একশ’ বেত্রাঘাত সহ এক বছরের নির্বাসন দেওয়া হবে। আর অপরজনের ব্যাপারে বললেন, হে উনাইস! তুমি আগামীকাল সকালে এ লোকের স্ত্রীর নিকট যাবে এবং তাকে রজম করবে। উনাইস তার নিকট গেলেন এবং তাকে রজম করলেন।[19] অতএব এ হাদীছ দ্বারা তাক্বলীদ জায়েয প্রমাণিত হয়।

জবাব : রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় উল্লেখিত মাসআলার সমাধান দিতে গিয়ে ওলামায়ে কেরামের মধ্যে মতভেদ পরিলক্ষিত হয়। যেমন কতিপয় ছাহাবী অবিবাহিত যেনাকারকে রজম করার ফৎওয়া প্রদান করেছেন। আবার কতিপয় ছাহাবী তাকে একশ’ বেত্রাঘাত সহ এক বছরের নির্বাসন ওয়াজিব ফৎওয়া প্রদান করেছেন। আর কোন বিষয়ে এরূপ মতভেদ দেখা দিলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে যাওয়া ওয়াজিব। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِيْ شَيْءٍ فَرُدُّوْهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُوْلِ ‘অতঃপর কোন বিষয়ে যদি তোমরা মতবিরোধ কর, তাহ’লে তা আল্লাহ ও রাসূলের দিকে প্রত্যার্পণ কর’ (নিসা ৫৯)। অতএব উল্লেখিত মাসআলায় মতভেদ দেখা দিলে তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট তা প্রত্যার্পন করেছিলেন। আর রাসূল (ছাঃ) সঠিক ফায়ছালা প্রদান করেছিলেন। বর্তমানেও যদি কোন মাসআলায় আমাদের মধ্যে মতভেদ দেখা দেয়, তাহ’লে ফিরে যেতে হবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে। আর যখন আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে যাওয়া হবে, তখন তাক্বলীদ দূরীভূত হবে। আমরা ওলামায়ে কেরামের ফৎওয়া প্রদানকে অস্বীকার করি না। কিন্তু অস্বীকার করি দলীল বিহীন ফৎওয়া প্রদানকে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে ফিরে না গিয়ে অনুসরণীয় মাযহাবের ইমামদের দিকে ফিরে যাওয়াকে।২০

(চলবে)

 শরীফুল ইসলাম

লিসান্স, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব।


[1]. ছহীহ ইবনু মাজাহ, তাহক্বীক্ব আলবানী, হা/৯৭।

[2]. তিরমিযী, হা/৪০২৩।

[3]. আবু আব্দুর রহমান সাঈদ মা‘শাশাহ, আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবা‘আহ, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, পৃঃ ১০৩।

[4]. ইবনুল কাইয়েম, ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন, ২/১৭৩।

[5]. ইবনু হাযম, আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ ৮০৫।

[6]. ঐ, পৃঃ ৮০৬।

[7]. ঐ।

[8]. ঐ।

[9]. আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবা‘আহ, পৃঃ ১০৭।

[10]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১১৭।

[11]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১৭৮, ইমাম শাওকানী, আল-ক্বাওলুল মুফীদ পৃঃ ৩৬-৩৭।

[12]. বুখারী, মুসলিম, মিশকাত, বাংলা অনুবাদ, হা/৫৭৬৫।

[13]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১৭৯।

[14]. মুহাম্মাদ ঈদ আববাসী, বিদ‘আতুত তা‘য়াছ্ছুবিল মাযহাবী ১/৯৫।

[15]. আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ ৮০১।

[16]. আল-মুক্বাল্লিদূন ওয়াল আইম্মাতুল আরবাআতি, আল-মাকতাবাতুল ইসলামী, পৃঃ ১১৮।

[17]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১৮৫-১৮৬।

[18]. ই‘লামুল মুয়াক্কিঈন ২/১৮২।

[19]. বুখারী, ‘অন্যায়ের উপর চুক্তিবদ্ধ হ’লে তা বাতিল’ অধ্যায়, হা/২৬৯৫-২৬৯৬, বাংলা অনুবাদ, ৩/৬৬।

২০. আল-ইহকাম ফী উছুলিল আহকাম, পৃঃ ৮২৪-৮২৫।






বিষয়সমূহ: বিবিধ
ফৎওয়া : গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও বিকাশ (৩য় কিস্তি) - ড. শিহাবুদ্দীন আহমাদ, শিক্ষক, আল-মারকাযুল ইসলামী আস-সালাফী, রাজশাহী
আল্লাহর প্রতি ঈমানের স্বরূপ (তৃতীয় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
অন্তর কঠিন হওয়ার কারণ ও প্রতিকার - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আক্বীদা ও আহকামে হাদীছের প্রামাণ্যতা (৯ম কিস্তি) - মীযানুর রহমান মাদানী
মানব জাতির সাফল্য লাভের উপায় (ফেব্রুয়ারী’১৩ সংখ্যার পর) - হাফেয আব্দুল মতীন - পিএইচ.ডি গবেষক, আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, মালয়েশিয়া
নেতৃত্বের মোহ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আহলেহাদীছ জামা‘আতের বিরুদ্ধে কতিপয় মিথ্যা অপবাদ পর্যালোচনা (৫ম কিস্তি) - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
হিন্দু শব্দের শাব্দিক, পারিভাষিক ও ঐতিহাসিক স্বরূপ বিশ্লেষণ - আবু হিশাম মুহাম্মাদ ফুয়াদ, বগুড়া।
আল্লাহর সতর্কবাণী - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
এক হাতে মুছাফাহা : একটি তাত্ত্বিক পর্যালোচনা - তানযীলুর রহমান - শিক্ষক, বাউটিয়া দাখিল মাদ্রাসা, রাজশাহী
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আহলেহাদীছ একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম (৭ম কিস্তি) - আহমাদুল্লাহ - সৈয়দপুর, নীলফামারী
আরও
আরও
.