পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । শেষ পর্ব ।
৫ম মূলনীতি: মুসলিম সংহতি দৃঢ়করণ
: এর অর্থ- কুরআন ও সুন্নাহর আদেশ-নিষেধকে নিঃশর্তভাবে মেনে নেওয়ার
ভিত্তিতে মুসলিম ঐক্য গড়ে তোলা এবং মুসলিম উম্মাহর সার্বিক স্বার্থকে
অগ্রাধিকার দেওয়া।[1]
ঐক্য ও সংহতির অপরিহার্যতা:
ঐক্য ও সংহতি মুসলিম জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। ইসলামে ঐক্যের গুরুত্ব অপরিসীম। ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন যাপনের নির্দেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন,وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا وَاذْكُرُوا نِعْمَتَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ كُنْتُمْ أَعْدَاءً فَأَلَّفَ بَيْنَ قُلُوبِكُمْ فَأَصْبَحْتُمْ بِنِعْمَتِهِ إِخْوَانًا وَكُنْتُمْ عَلَى شَفَا حُفْرَةٍ مِنَ النَّارِ فَأَنْقَذَكُمْ مِنْهَا كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمْ آيَاتِهِ لَعَلَّكُمْ تَهْتَدُونَ- ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না। আর তোমরা তোমাদের উপর আল্লাহর সেই নে‘মতের কথা স্মরণ কর, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের অন্তর সমূহে মহববত পয়দা করে দিলেন। তোমরা তার অনুগ্রহে পরস্পরে ভাই ভাই হয়ে গেলে। আর তোমরা অগ্নি গহবরের কিনারায় অবস্থান করছিলে। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে সেখান থেকে উদ্ধার করলেন। এভাবেই আল্লাহ তোমাদের জন্য স্বীয় আয়াতসমূহ ব্যাখ্যা করেন, যাতে তোমরা সুপথপ্রাপ্ত হও’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)।
এখানে
حَبْلُ اللهِ বা ‘আল্লাহর রজ্জু’ বলতে পবিত্র কুরআনকে বুঝানো হয়েছে। যেমন-
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,أَلاَ وَإِنِّى تَارِكٌ فِيكُمْ ثَقَلَيْنِ
أَحَدُهُمَا كِتَابُ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ هُوَ حَبْلُ اللهِ مَنِ
اتَّبَعَهُ كَانَ عَلَى الْهُدَى وَمَنْ تَرَكَهُ كَانَ عَلَى ضَلاَلَةٍ
‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি ভারী (গুরুত্বপূর্ণ) জিনিস ছেড়ে যাচ্ছি। এর একটি
আল্লাহর কিতাব, যেটি ‘হাবলুল্লাহ’ বা আল্লাহর রজ্জু। যে এর অনুসরণ করবে, সে
হেদায়াতের উপর থাকবে; আর যে একে ছেড়ে দিবে, সে পথভ্রষ্টতায় পতিত হবে’।[2]
পবিত্র কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার নির্দেশ দিয়েছেন এবং বিভক্তি থেকে নিষেধ করেছেন। ইহুদী-নাছারাদের বিরোধের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আল্লাহ বলেন,وَلَا تَكُونُوا كَالَّذِينَ تَفَرَّقُوا وَاخْتَلَفُوا مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَهُمُ الْبَيِّنَاتُ وَأُولَئِكَ لَهُمْ عَذَابٌ عَظِيمٌ ‘তোমরা তাদের মতো হয়ো না, যাদের কাছে স্পষ্ট নিদর্শন সমূহ আসার পরেও তারা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে এবং নানা ধরনের মতানৈক্য সৃষ্টি করেছে। আর তাদের জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি’ (আলে ইমরান ৩/১০৫)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন,إِنَّ الَّذِينَ فَرَّقُوا دِينَهُمْ وَكَانُوا شِيَعًا لَسْتَ مِنْهُمْ فِي شَيْءٍ إِنَّمَا أَمْرُهُمْ إِلَى اللهِ ثُمَّ يُنَبِّئُهُمْ بِمَا كَانُوا يَفْعَلُونَ- ‘নিশ্চয়ই যারা নিজেদের দ্বীনকে খন্ড-বিখন্ড করেছে এবং নিজেরা বিভিন্ন দল-উপদলে বিভক্ত হয়েছে, তাদের সাথে তোমার কোন সম্পর্ক নেই। তাদের ব্যাপারটি আল্লাহর উপর ন্যস্ত। অতঃপর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে অবহিত করবেন’ (আন‘আম ৬/১৫৯)। তিনি আরো বলেন, إِنَّ هَذِهِ أُمَّتُكُمْ أُمَّةً وَاحِدَةً وَأَنَا رَبُّكُمْ فَاعْبُدُونِ وَتَقَطَّعُوا أَمْرَهُمْ بَيْنَهُمْ كُلٌّ إِلَيْنَا رَاجِعُونَ ‘এরা সবাই তোমাদের একই উম্মতভুক্ত। আর আমিই তোমাদের পালনকর্তা। অতএব তোমরা আমারই ইবাদত কর। কিন্তু মানুষ নিজেদের মধ্যকার (দ্বীনী) কাজকর্মে পরস্পরে বিভেদ সৃষ্টি করেছে। অথচ সকলেই আমাদের নিকট প্রত্যাবর্তিত হবে’ (আম্বিয়া ২১/৯২-৯৩)।
ফের্কাবন্দীর ধরন:
মানুষের মধ্যে পারস্পরিক বিরোধ ও ফের্কাবন্দী দু’ধরনের হয়ে থাকে। এক- স্বভাবগত মতভেদ, যা থেকে মুক্তি পাবার ক্ষমতা মানুষের নেই। মানুষের কল্যাণের স্বার্থেই আল্লাহ এটা করেছেন। যেমন একই বিষয়ে পাঁচ জনের পাঁচটি মত আসল। দেখা গেল তার মধ্যে একটি মত অধিকতর কল্যাণবহ। তখন সকলে সেটা গ্রহণ করল ও উপকৃত হ’ল। এভাবে জ্ঞান ও বুঝের ভিন্নতার মধ্যেই সমাজের মঙ্গল ও অগ্রগতি নিশ্চিত হয়। আল্লাহ বলেন,وَلَوْ شَاءَ رَبُّكَ لَجَعَلَ النَّاسَ أُمَّةً وَاحِدَةً وَلَا يَزَالُونَ مُخْتَلِفِينَ ‘আর যদি তোমার প্রতিপালক চাইতেন, তবে সকল মানুষকে একই দলভুক্ত করতেন। কিন্তু তারা সর্বদা মতভেদ করতেই থাকবে’ (হূদ ১১/১১৮)।
দুই- আল্লাহর বিধানের উপর মানবীয়
বিধানকে অগ্রাধিকার দেওয়া। এটাই মানব সমাজকে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত করে।
কেননা এটি হেদায়াতের আলোকবর্তিকাকে ঢেকে দেয়। মানুষের জ্ঞান সীমিত। সে জানে
না তার ভবিষ্যৎ প্রকৃত মঙ্গল কিসে আছে? তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা এই যে,
তাকে পথ চলার জন্য আল্লাহ যে সামান্য জ্ঞান দিয়েছেন, তাতেই সে নিজেকে বড়
জ্ঞানী ভাবে ও নিজের সিদ্ধান্তকেই নিজের জন্য সবচেয়ে কল্যাণকর মনে করে। অথচ
তার প্রকৃত কল্যাণ কিসে, সেকথা তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ ব্যতীত কেউ জানে
না। আর এজন্যেই মানুষকে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ করার জন্য আল্লাহ
নির্দেশ দিয়েছেন (আলে ইমরান ৩/১০৩)।[3]
মুসলিম সংহতির উপায় :
মুসলমানদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে ভ্রাতৃত্বপূর্ণ ও সহযোগিতামূলক। এক মুসলমান অপর মুসলমানের ব্যথায় ব্যথিত হবে, দুঃখে দুঃখিত হবে এবং খুশীতে হবে আনন্দিত। ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় করার লক্ষে বেশী বেশী সালাম বিনিময় করবে এবং পরস্পরের হক আদায়ে হবে তৎপর। কারো প্রতি যুলুম-নির্যাতন করবে না, কাউকে গালি দিবে না, কারো সম্মানহানি করবে না, কারো ক্ষতি করবে না। এরকম সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের ফলে মুসলমানদের পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় হবে।
মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন হবে এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,وَالْمُؤْمِنُونَ وَالْمُؤْمِنَاتُ بَعْضُهُمْ أَوْلِيَاءُ بَعْضٍ يَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَيَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَيُقِيمُونَ الصَّلَاةَ وَيُؤْتُونَ الزَّكَاةَ وَيُطِيعُونَ اللهَ وَرَسُولَهُ أُولَئِكَ سَيَرْحَمُهُمُ اللهُ إِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ- ‘আর মুমিন পুরুষ ও নারী পরস্পরের বন্ধু। তারা সৎ কাজের আদেশ করে ও অসৎ কাজে নিষেধ করে। তারা ছালাত কায়েম করে ও যাকাত আদায় করে এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করে। এসব লোকের প্রতি আল্লাহ অবশ্যই অনুগ্রহ বর্ষণ করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাবান’ (তওবা ৯/৭১)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّمَا الْمُؤْمِنُونَ إِخْوَةٌ ‘মুমিনগণ পরস্পর ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَ فِي سَبِيلِهِ صَفًّا كَأَنَّهُمْ بُنْيَانٌ مَرْصُوصٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালবাসেন তাদেরকে, যারা আল্লাহর রাস্তায় সংগ্রাম করে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায়’ (ছাফ ৬১/৪)। আবু মূসা হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন,الْمُؤْمِنُ لِلْمُؤْمِنِ كَالْبُنْيَانِ يَشُدُّ بَعْضُهُ بَعْضًا وَشَبَّكَ بَيْنَ أَصَابِعِهِ- ‘মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক একটি ইমারতের ন্যায়, যার এক অংশ অন্য অংশকে শক্তিশালী করে। অতঃপর তিনি নিজের এক হাতের আঙ্গুল অন্য হাতের আঙ্গুলে প্রবেশ করান’।[4] অর্থাৎ এক হাতের আঙ্গুল সমূহ অন্য হাতের আঙ্গুলের ফাঁকে ফাঁকে ঢুকালে যেমন মযবূত হয়, তেমনি মুমিনদের পারস্পরিক সম্পর্ক হবে মযবূত ও দৃঢ়।
আব্দুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,الْمُسْلِمُ أَخُو الْمُسْلِمِ، لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يُسْلِمُهُ، وَمَنْ كَانَ فِى حَاجَةِ أَخِيهِ كَانَ اللهُ فِى حَاجَتِهِ، وَمَنْ فَرَّجَ عَنْ مُسْلِمٍ كُرْبَةً فَرَّجَ اللهُ عَنْهُ كُرْبَةً مِنْ كُرُبَاتِ يَوْمِ الْقِيَامَةِ، وَمَنْ سَتَرَ مُسْلِمًا سَتَرَهُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- ‘একজন মুসলমান অপর মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলম করবে না এবং তাকে ধ্বংসের দিকে নিক্ষেপ করবে না। যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রয়োজন মিটাবে, আল্লাহ তার প্রয়োজন মিটিয়ে দিবেন। যে ব্যক্তি তার কোন মুসলিম ভাইয়ের কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার কষ্ট সমূহের মধ্য হ’তে একটি কষ্ট দূর করে দিবেন। আর যে ব্যক্তি কোন মুসলমানের দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবে, আল্লাহ তা‘আলা ক্বিয়ামতের দিন তার দোষ-ত্রুটি ঢেকে রাখবেন’।[5] আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত অপর হাদীছে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
الْمُسْلِمُ
أَخُو الْمُسْلِمِ لاَ يَظْلِمُهُ وَلاَ يَخْذُلُهُ وَلاَ يَحْقِرُهُ
التَّقْوَى هَا هُنَا وَيُشِيرُ إِلَى صَدْرِهِ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ بِحَسْبِ
امْرِئٍ مِنَ الشَّرِّ أَنْ يَحْقِرَ أَخَاهُ الْمُسْلِمَ كُلُّ
الْمُسْلِمِ عَلَى الْمُسْلِمِ حَرَامٌ دَمُهُ وَمَالُهُ وَعِرْضُهُ. ‘একজন
মুসলমান অন্য মুসলমানের ভাই। সে তার উপর যুলুম করবে না। তাকে উপহাস করবে
না। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করবে না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) নিজের বুকের দিকে
ইঙ্গিত করে তিনবার বললেন, তাক্বওয়া (আল্লাহ্ভীরুতা) এখানেই। কোন ব্যক্তির
মন্দ কাজ করার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট যে, সে কোন মুসলিম ভাইকে হেয় প্রতিপন্ন
করে। প্রত্যেক মুসলমানের উপর অন্য মুসলমানের রক্ত, সম্পদ ও সম্মানের
ক্ষতিসাধন করা হারাম’।[6] অন্যত্র তিনি বলেন, تَرَى الْمُؤْمِنِينَ فِى
تَرَاحُمِهِمْ وَتَوَادِّهِمْ وَتَعَاطُفِهِمْ كَمَثَلِ الْجَسَدِ إِذَا
اشْتَكَى عُضْوًا تَدَاعَى لَهُ سَائِرُ جَسَدِهِ بِالسَّهَرِ وَالْحُمَّى-
‘তুমি মুমিনদেরকে তাদের পারস্পরিক সহানুভূতি, বন্ধুত্ব ও দয়া-অনুগ্রহের
ক্ষেত্রে একটি দেহের মত দেখবে। যখন দেহের কোন অঙ্গ অসুস্থ হয় তখন সমস্ত
শরীর নিদ্রাহীনতা ও জ্বরে আক্রান্ত হয়’।[7] রাসূল (ছাঃ) আরও বলেন,
الْمُؤْمِنُونَ كَرَجُلٍ وَاحِدٍ إِنِ اشْتَكَى رَأْسُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ
وَإِنِ اشْتَكَى عَيْنُهُ اشْتَكَى كُلُّهُ- ‘সকল মুমিন এক ব্যক্তির ন্যায়,
যখন তার মাথা অসুস্থ হয় তখন তার সমস্ত দেহ অসুস্থ হয় এবং যখন তার চোখ
অসুস্থ হয় তখন সমস্ত দেহ অসুস্থ হয়’।[8]
আব্দুল্লাহ
বিন আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত জনৈক ব্যক্তি রাসূল (ছাঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন,
কোন্ ইসলাম সর্বোত্তম? জবাবে রাসূল (ছাঃ) বললেন, تُطْعِمُ الطَّعَامَ ،
وَتَقْرَأُ السَّلاَمَ عَلَى مَنْ عَرَفْتَ وَمَنْ لَمْ تَعْرِفْ ‘তুমি
ক্ষুধার্তকে খাদ্য দান করবে এবং পরিচিত ও অপরিচিত সকলকে সালাম দিবে’।[9]
এতদ্ব্যতীত হাদীছে মুসলমানদের পারস্পরিক ছয়টি হকের কথা উল্লেখ আছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,لِلْمُؤْمِنِ عَلَى الْمُؤْمِنِ سِتُّ خِصَالٍ يَعُودُهُ إِذَا مَرِضَ وَيَشْهَدُهُ إِذَا مَاتَ وَيُجِيبُهُ إِذَا دَعَاهُ وَيُسَلِّمُ عَلَيْهِ إِذَا لَقِيَهُ وَيُشَمِّتُهُ إِذَا عَطَسَ وَيَنْصَحُ لَهُ إِذَا غَابَ أَوْ شَهِدَ- ‘একজন মুমিন ব্যক্তির উপর অন্য মুমিন ভাইয়ের ছয়টি হক রয়েছে : (১) যখন সে অসুস্থ হবে তখন তার সেবা-শুশ্রূষা করবে (২) যখন সে মৃত্যুবরণ করবে, তার জানাযায় উপস্থিত হবে (৩) দাওয়াত করলে তার দাওয়াত গ্রহণ করবে (৪) সাক্ষাৎ হ’লে সালাম দিবে (৫) হাঁচি দিলে উত্তরে ‘ইয়ারহামুকাল্লা-হ’ বলবে এবং (৬) তার কল্যাণ কামনা করবে সে অনুপস্থিত থাকুক বা উপস্থিত থাকুক’।[10] অতএব মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য ও সংহতি সুদৃঢ় করার লক্ষ্যে উপরোক্ত গুণাবলী অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক।
ঐক্যের ভিত্তি
দেশে দেশে আজ ঐক্যের শ্লোগান আছ, কিন্ত ঐক্যের কোন বাস্তব রূপরেখা নেই। কিসের ভিত্তিতে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হবে তা কেউ বলতে পারছে না। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দল ও মাযহাবের অধীনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবান জানাচ্ছে এবং নিজেদের আচরিত মাযহাব ও মতবাদকেই সঠিক বলে মনে করছে। ফলে ঐক্য শব্দটি আজ একটি মুখরোচক সস্তা বুলিতে পরিণত হয়েছে। অথচ মহান আল্লাহ সূরা আলে ইমরানের ১০৩ আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি তুলে ধরেছেন।
ঐক্যের ভিত্তি ২টি। এক-পবিত্র কুরআন, দুই- ছহীহ হাদীছ। দলীয় ও মাযহাবী সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এই দু’টি ভিত্তির নিরপেক্ষ ও নিঃশর্ত অনুসরণের মাধ্যমেই কেবল মুসলিম ঐক্য সম্ভব।
এক- কুরআন: কুরআন আল্লাহর কালাম। মানব জাতির জন্য প্রেরিত সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানী কিতাব। এটি নির্ভুল ও অপরিবর্তনীয় এক অনন্য গ্রন্থ। এর কোন একটি আয়াতাংশ সম্পর্কেও সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। নেই এতে কোন মিথ্যা বা বাতিলের প্রবেশাধিকার। আল্লাহ কুরআনের শুরুতেই এ বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছেন যে,ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ‘এই কিতাব যাতে কোন সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ ২/২)। কুরআনের সত্যতার চূড়ান্ত স্বীকৃতি দিয়ে আল্লাহ বলেন, وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيْزٌ- لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَ لاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيدٍ ‘নিঃসন্দেহে এটি মহা পরাক্রান্ত এক কিতাব। সামনে বা পিছনে কোন দিক থেকেই এতে কোন মিথ্যা প্রবেশ করে না। এটি মহা প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত (আল্লাহর) পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হা-মীম সাজদা ৪১/৪১-৪২)।
কুরআন সম্পর্কে বিরুদ্ধবাদীদের সন্দেহ-সংশয়কে চ্যালেঞ্জ করে আল্লাহ বলেন,قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لَا يَأْتُونَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيرًا- ‘তুমি বল, যদি মানুষ ও জিন জাতি এই কুরআনের ন্যায় আরেকটি কুরআন আনয়নের জন্য একত্রিত হয়, তবু তারা এর অনুরূপ আনতে পারবে না। যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়’ (ইসরা ১৭/৮৮)।
উল্লেখ্য যে, মক্কার নেতারা কুরআনকে মানুষের কালাম বলেছিল এবং আমরাও এরূপ কুরআন রচনা করতে পারি বলে অহংকার করেছিল। তার জবাবে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করে মক্কায় বিভিন্ন সূরায় চারটি আয়াত নাযিল হয়। এটি তার অন্যতম। বাকী তিনটি হ’ল ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ক্বাছাছ ২৮/৪৯। এতদ্ব্যতীত মদীনায় হিজরত করার পর ইহূদী-নাছারা পন্ডিতদের চ্যালেঞ্জ করে সূরা বাক্বারার ২৩নং আয়াতটি নাযিল হয়। এভাবে কুরআনে মোট পাঁচবার চ্যালেঞ্জ করে আয়াত নাযিল হয়। এ আয়াতগুলি কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়ার অন্যতম প্রধান দলীল। যাকে সে যুগেও কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারেনি, এ যুগেও পারবে না।
দুই- হাদীছ: মুসলিম
ঐক্যের দ্বিতীয় ভিত্তি হচ্ছে হাদীছ, যা কুরআনের ব্যাখ্যা। দু’টিই আল্লাহর
অহী। কুরআন ‘অহীয়ে মাতলূ’ যা তেলাওয়াত করা হয়। আর হাদীছ ‘অহীয়ে গায়র মাতলূ’
যা তেলাওয়াত করা হয় না। পার্থক্য এটুকুই। তবে হাদীছ অবশ্যই ছহীহ বা
বিশুদ্ধ হ’তে হবে। মুহাদ্দিছীনে কেরামের মতে জাল ও যঈফ হাদীছ আমলযোগ্য নয়।
হাদীছের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) বলেন,أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ
الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْقُرْآنَ وَمِثْلَهُ
مَعَهُ ‘সাবধান! নিশ্চয়ই আমাকে কিতাব ও অনুরূপ একটি বস্ত্ত দেওয়া হয়েছে।
সাবধান! নিশ্চয়ই আমাকে কুরআন ও এর অনুরূপ একটি বস্ত্ত দান করা হয়েছে অর্থাৎ
হাদীছ’।[11] আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا
نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা প্রদান করেন তা
গ্রহণ কর এবং যে বিষয়ে নিষেধ করেন তা বর্জন কর’ (হাশর ৫৯/৭)।
কেননা রাসূল (ছাঃ) অহীর আলোকেই কথা বলতেন। তিনি নিজে থেকে কোন কথা বলতেন না
বা নিজের মস্তিষ্কপ্রসূত কোন সিদ্ধান্ত জনগণের উপর চাপিয়ে দিতেন না। এ
প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا
وَحْيٌ يُوحَى ‘তিনি মনগড়া কোন কথা বলেন না। এটা তো অহী, যা তার প্রতি
প্রত্যাদেশ হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। রাসূল (ছাঃ) বলেন,تَرَكْتُ فِيكُمْ
أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ
وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের নিকট দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি, যতক্ষণ
পর্যন্ত তোমরা এই দু’টিকে অাঁকড়ে থাকবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। একটি
আল্লাহর কিতাব ও অপরটি তাঁর নবীর সুন্নাত’।[12] তিনি বলেন,فَعَلَيْكُمْ
بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ
وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ
فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَإِنَّ كُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-
‘অতএব তোমাদের উপর আবশ্যক যে, তোমরা আমার সুন্নাত ও আমার হেদায়াতপ্রাপ্ত
খলীফাদের সুন্নাত অনুসরণ করবে এবং তা মাড়ির দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরবে। আর নতুন
সৃষ্টি হ’তে বেঁচে থাকবে, কেননা প্রত্যেক নতুন সৃষ্টিই বিদ‘আত এবং প্রত্যেক
বিদ‘আতের পরিণাম ভ্রষ্টতা’।[13]
অতএব শতধা বিভক্ত মুসলিম জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হ’তে হ’লে মহান আল্লাহর ঘোষণা অনুযায়ী ‘হাবলুল্লাহ’ তথা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরতে হবে। এই দুই এলাহী উৎসের যাবতীয় আদেশ-নিষেধকে নিজেদের সার্বিক জীবনে বাস্তবায়ন করতে হবে। স্ব স্ব দলীয় অহমিকা ও ব্যক্তিগত মতামতকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ‘হাবলুল্লাহ’র দিকেই প্রত্যাবর্তন করতে হবে। আর যে বিষয়ে স্পষ্ট দলীল নেই সে বিষয়ে অধিকাংশ সুন্নাতপন্থী পরহেযগার বিদ্বানদের রায় মেনে নিয়ে ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখতে হবে। যেমন আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا أَطِيعُوا اللهَ وَأَطِيعُوا الرَّسُولَ وَأُولِي الْأَمْرِ مِنْكُمْ فَإِنْ تَنَازَعْتُمْ فِي شَيْءٍ فَرُدُّوهُ إِلَى اللهِ وَالرَّسُولِ إِنْ كُنْتُمْ تُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَالْيَوْمِ الْآخِرِ ذَلِكَ خَيْرٌ وَأَحْسَنُ تَأْوِيلًا ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমরা আনুগত্য কর আল্লাহর এবং আনুগত্য কর রাসূলের ও তোমাদের নেতৃবৃন্দের। অতঃপর যদি কোন বিষয়ে তোমরা বিতন্ডা কর, তাহ’লে বিষয়টি আল্লাহ ও রাসূলের দিকে ফিরিয়ে দাও। যদি তোমরা আল্লাহ ও আখেরাতের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে থাক। এটাই কল্যাণকর ও পরিণতির দিক দিয়ে সর্বোত্তম’ (নিসা ৪/৫৯)।
উপসংহার :
‘আহলেহাদীছ’
সদ্য গজিয়ে ওঠা কোন নাম নয়। ছাহাবায়ে কেরামের যুগ থেকেই এ নামের প্রচলন
রয়েছে। ফিৎনার যামানা শুরু হ’লে বিদ‘আতীদের বিপরীতে হক্বপন্থীরা নিজেদেরকে
‘আহলেহাদীছ’ বলে পরিচয় দিতেন। তাই ‘আহেলেহাদীছ আন্দোলন’ নতুন নয়, বরং
ছাহাবা যুগ হ’তে চলে আসা এক নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের নাম। এ আন্দোলনে
বাতিলের কোন প্রবেশাধিকার নেই। নেই পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের
সিদ্ধান্তের বাইরে ব্যক্তিগত মতামতের কোন অগ্রাধিকার। এ আন্দোলনের রয়েছে
সুনির্দিষ্ট লক্ষ-উদ্দেশ্যে, কর্মসূচী ও মূলনীতি সমূহ। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা
‘আহলেহাদীছ আন্দোলনে’র ৫ দফা মূলনীতির ধারাবাহিক বিশ্লেষণ তুলে ধরলাম।
মতবাদ বিক্ষুব্ধ এ সমাজে উক্ত মূলনীতিসমূহ বাস্তবায়নের মাধ্যমে কাংখিত
লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হবে এবং এর বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে বৃহত্তর মুসলিম
ঐক্যের পথ সুগম হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদেরকে এই হক্ব আন্দোলনের সাথে
থেকে দাওয়াতী ময়দানে হাযারো প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা মোকাবেলায় দৃঢ়
হিমাদ্রির ন্যায় অবিচল থাকার তাওফীক্ব দিন-আমীন!!
[1]. আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশ, পরিচিতি লিফলেট, পৃ:৩।
[2]. মুসলিম হা/২৪০৮; মিশকাত হা/৬১৩১।
[3]. আহলেহাদীছ আন্দোলন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃ: ১৯১-১৯২; জীবন দর্শন, পৃ: ৪৫।
[4]. বুখারী হা/৪৮১, ২৪৪৬, ৬০২৬; মুসলিম হা/২৫৮৫; মিশকাত হা/৪৯৫৫।
[5]. বুখারী হা/২৪৪২; মুসলিম হা/২৫৮০; মিশকাত হা/৪৯৫৮; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৪৭৪১।
[6]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৪৭৪২।
[7]. বুখারী হা/৬০১১; মিশকাত হা/৪৯৫৩।
[8]. মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৫৪; ঐ, বঙ্গানুবাদ হা/৪৭৩৭।
[9]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/৪৬২৯।
[10]. নাসাঈ, মিশকাত হা/৪৬৩০।
[11]. মুসনাদে আহমাদ, তাহক্বীক্ব: শু‘আইব আরনাউত্ব হা/১৭২১৩ সনদ ছহীহ।
[12]. মুওয়াত্ত্বা মালেক, মিশকাত হা/১৮৬, সনদ হাসান।
[13]. আহমাদ, আবূদাঊদ, তিরমিযী, মিশকাত হা/১৬৫।