পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । শেষ পর্ব ।
ভূমিকা :
‘আহল’ অর্থ অনুসারী। ‘হাদীছ’ অর্থ বাণী। এ বাণী আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী। সুতরাং ‘আহলেহাদীছ’ অর্থ কুরআন ও হাদীছের অনুসারী। কেননা আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআন মাজীদের একাধিক আয়াতে কুরআনকেও হাদীছ বলেছেন। যেমন তিনি বলেন,اللهُ نَزَّلَ أَحْسَنَ الْحَدِيْثِ ‘আল্লাহ নাযিল করেছেন উত্তম হাদীছ’ (যুমার ৩৯/২৩)। فَلْيَأْتُوا بِحَدِيثٍ مِثْلِهِ إِنْ كَانُوا صَادِقِينَ ‘তারা যদি সত্যবাদী হয় তাহ’লে এর অনুরূপ একটি হাদীছ (কুরআন) আনয়ন করুক’ (তূর ৫২/৩৪)।فَبِأَيِّ حَدِيثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُونَ ‘সুতরাং তারা এর (কুরআনের) পরিবর্তে আর কোন কথায় বিশ্বাস স্থাপন করবে?’ (মুরসালাত ৭৭/৫০)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও কখনো কুরআনকে হাদীছ বলেছেন। যেমন তিনি বলেন,فَإِنَّ خَيْرَ الْحَدِيثِ كِتَابُ اللهِ وَخَيْرُ الْهُدَى هُدَى مُحَمَّدٍ وَشَرُّ الأُمُورِ مُحْدَثَاتُهَا وَكُلُّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ- ‘অতঃপর সর্বোত্তম হাদীছ বা বাণী হ’ল আল্লাহর কিতাব। আর সর্বোত্তম হেদায়াত হ’ল মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর হেদায়াত। শরী‘আতে সবচেয়ে নিকৃষ্ট হ’ল নতুন সৃষ্টি বা বিদ‘আত। আর প্রত্যেক বিদ‘আতই হচ্ছে ভ্রষ্টতা’।[1]
সুতরাং ‘আহলেহাদীছ’ বলতে শুধুমাত্র হাদীছের অনুসারী বুঝায় না। বরং কুরআন ও হাদীছের অনুসারী বুঝায়। যিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিঃশর্ত ও নিরপেক্ষ অনুসারী, তিনিই কেবল এই নামে অভিহিত হবেন। এটি একটি বৈশিষ্ট্যগত নাম। এটি কোন ফিরক্বা নয়। মূলতঃ আমাদের প্রথম পরিচয় হচ্ছে আমরা মানুষ। দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে মুসলিম। আর আমাদের তৃতীয় ও শেষ পরিচয় হচ্ছে আমরা আহলেহাদীছ। ৩৭ হিজরীর পরে ফিৎনার যামানা শুরু হ’লে এবং মুসলমানরা বিভিন্ন বিদ‘আতী ফিরক্বায় বিভক্ত হয়ে পড়লে তাদের বিপরীতে তখন থেকেই হকপন্থীদের এই পরিচিতি চালু হয়েছে। আজও আছে, ক্বিয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশাআল্লাহ। যদিও বিভিন্ন দেশে এর ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন- সালাফী, মুহাম্মাদী, আনছারুস সুন্নাহ প্রভৃতি। নাম ভিন্ন হ’লেও আক্বীদা ও আমলে তেমন কোন বৈপরীত্য নেই।
পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ভিত্তিক জীবন গড়ার আন্দোলনকেই বলা হয় ‘আহলেহাদীছ আন্দোলন’। নিজেদের রচিত অসংখ্য মাযহাব-মতবাদ, ইযম ও তরীকার বেড়াজালে আবেষ্টিত মানব সমাজকে আল্লাহ প্রদত্ত ও রাসূল (ছাঃ) প্রদর্শিত অভ্রান্ত সত্যের পথে পরিচালনার জন্য আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রয়োজন। এই আন্দোলন তাই ছাহাবা যুগ হ’তে চলে আসা নির্ভেজাল ইসলামী আন্দোলনের নাম। এটি সরকার পরিবর্তন নয়, বরং সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন। কেননা সরকার পরিবর্তন সাময়িক, কিন্তু সমাজ পরিবর্তন স্থায়ী।
এই ‘আন্দোলন’ এলাহী বিধানের আলোকে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং এর সিঁড়ি বেয়ে রাষ্ট্র সংশোধনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এই সংগঠনের রয়েছে পাঁচ দফা মূলনীতি। যার ভিত্তিতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচীর মাধ্যমে সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা ও কর্মীগণ কাজ করে থাকেন। মূলনীতিগুলো হচ্ছে- ১. কিতাব ও সুন্নাতের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা ২. তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তিপূজার অপনোদন ৩. ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার দুয়ার উন্মুক্ত করণ ৪. সকল সমস্যায় ইসলামকেই একমাত্র সমাধান হিসাবে পরিগ্রহণ এবং ৫. মুসলিম সংহতি দৃঢ়করণ। মূলনীতিগুলো বাহ্যত সংক্ষিপ্ত মনে হ’লেও এর অর্থ ও কার্যকারিতা অত্যন্ত ব্যাপক। আহলেহাদীছ আন্দোলনের প্রত্যেক কর্মীর মূলনীতিগুলোর উপরে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। আলোচ্য নিবন্ধে আমরা অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাষায় উক্ত মূলনীতিগুলোর উপরে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ তুলে ধরার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।-
১ম মূলনীতি : কিতাব ও সুন্নাতের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা :
এর অর্থ- ‘পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছে বর্ণিত আদেশ-নিষেধকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া এবং তাকে নিঃশর্তভাবে ও বিনা দ্বিধায় কবুল করে নেওয়া ও সেই অনুযায়ী আমল করা’।[2] এখানে কিতাব বলতে পবিত্র কুরআন, আর সুন্নাত বলতে রাসূল (ছাঃ)-এর হাদীছকে বুঝানো হয়েছে। বস্ত্ততঃ এ দু’টিই হচ্ছে মুমিন জীবনে অনুসরণীয় বস্ত্ত। এ দু’টিই হচ্ছে অহী। কুরআন অহিয়ে মাতলূ, যা তিলাওয়াত করা হয়। আর হাদীছ হচ্ছে অহিয়ে গায়রে মাতলূ, যা তেলাওয়াত করা হয় না। কুরআন নাযিল হয়েছে বিশ্ব মানবতার মুক্তির সনদ হিসাবে। হাদীছও তাই। পার্থক্য হচ্ছে- কুরআনের ভাব ও ভাষা দু’টিই আল্লাহর। আর হাদীছের ভাব আল্লাহর, কিন্তু ভাষা রাসূল (ছাঃ)-এর নিজস্ব। আর এ কারণেই কুরআন ছালাতে তেলাওয়াত করা হয়। কিন্তু হাদীছ তেলাওয়াত করা হয় না। তবে আমলের ক্ষেত্রে দু’টির মধ্যে কোন পার্থক্য নেই।
মানুষের জীবন বিধান হিসাবে মহান আল্লাহর নিকট হ’তে জিব্রীল আমীনের মাধ্যমে শেষ নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর নিকটে বিভিন্ন ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে এই অহি অবতীর্ণ হয়েছে। জান্নাতপিয়াসী প্রত্যেক মুমিনের জন্য বিনা দ্বিধায় এ দু’টির যাবতীয় আদেশ-নিষেধ যথাযথভাবে মেনে নেওয়া অপরিহার্য। আর এটিই হচ্ছে কিতাব ও সুন্নাতের অধিকার বা দাবী। কেননা কুরআন এমন এক গ্রন্থ, যার শুরুতেই আল্লাহ চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন,ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ‘এটি এমন এক কিতাব, যার মধ্যে কোনই সন্দেহ নেই। আল্লাহভীরুদের জন্য এটি হেদায়াত বা পথ প্রদর্শনকারী’ (বাক্বারাহ ২/২)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَإِنَّهُ لَكِتَابٌ عَزِيزٌ لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘নিশ্চয়ই কুরআন এক মর্যাদাশীল গ্রন্থ। সম্মুখ বা পশ্চাত কোন দিক দিয়েই এতে বাতিল কিছুরই প্রবেশাধিকার নেই। এটি মহাজ্ঞানী ও চির প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হ’তে অবতীর্ণ’ (হামীম সাজদা, ৪১/৪১-৪২)।
অনুরূপভাবে হাদীছের সত্যায়ন করে মহান আল্লাহ বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى إِنْ هُوَ إِلَّا وَحْيٌ يُوْحَى ‘তিনি নিজের খেয়াল খুশীমত কিছুই বলেন না, বরং যা বলেন তা প্রত্যাদিষ্ট হয়েই বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। অন্যত্র তিনি বলেন,وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُولُ فَخُذُوهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوا ‘তোমাদের নিকট রাসূল যা নিয়ে আসেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত থাক’ (হাশর ৪৯/৭)।
আল্লাহ বলেন,وَمَا كَانَ لِمُؤْمِنٍ وَلَا مُؤْمِنَةٍ إِذَا قَضَى اللهُ وَرَسُولُهُ أَمْرًا أَنْ يَكُونَ لَهُمُ الْخِيَرَةُ مِنْ أَمْرِهِمْ وَمَنْ يَعْصِ اللهَ وَرَسُولَهُ فَقَدْ ضَلَّ ضَلَالًا مُبِينًا- ‘যখন আল্লাহ বা তাঁর রাসূল কোন বিষয়ে ফায়ছালা দেন, তখন কোন মুমিন পুরুষ বা নারীর জন্য সেখানে তাদের নিজস্ব কোন ফায়ছালা পেশ করার অধিকার নেই। যে ব্যক্তি আল্লাহ বা তাঁর রাসূলের নাফরমানী করল, সে স্পষ্ট ভ্রান্তির মধ্যে নিপতিত হ’ল’ (আহযাব ৩৩/৩৬)।
শেষ যামানায় বিলাসী একশ্রেণীর মানুষ কর্তৃক হাদীছ অস্বীকারের প্রতিবাদ জানিয়ে ও স্বীয় উম্মতকে সাবধান করে রাসূল (ছাঃ) বলেন,
أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ أَلاَ يُوشِكُ رَجُلٌ شَبْعَانُ عَلَى أَرِيكَتِهِ يَقُولُ عَلَيْكُمْ بِهَذَا الْقُرْآنِ فَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَلاَلٍ فَأَحِلُّوهُ وَمَا وَجَدْتُمْ فِيهِ مِنْ حَرَامٍ فَحَرِّمُوهُ واِنَّ مَا حَرَّمَ رَسُوْلُ اللهِ كَمَا حَرَّمَ اللهُ.
‘নিশ্চয়ই আমি কুরআন ও তারই মত আরেকটি বস্ত্ত (সুন্নাহ) প্রাপ্ত হয়েছি। জেনে রাখো! এমন এক সময় আসবে যখন কোন উদর পূর্তি বিলাসী লোক তার আসনে বসে বলবে, তোমরা শুধু এই কুরআন মেনে চলবে। তাতে যা হালাল পাবে তাকে হালাল মনে করবে এবং তাতে যা হারাম পাবে তাকে হারাম মনে করবে। অথচ রাসূল (ছাঃ) যা হারাম
করেছেন তাও অনুরূপ যা আল্লাহ হারাম করেছেন’।[3]
অনুরূপভাবে বিদায় হজ্জের ভাষণে তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- ‘আমি তোমাদের নিকটে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা ঐ দু’টি বস্ত্তকে মযবুতভাবে ধরে থাকবে, ততদিন পথভ্রষ্ট হবে না; সে দু’টি বস্ত্ত হ’ল আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাত’।[4] সুতরাং একথা সুস্পষ্ট যে, কুরআন ও সুন্নাহ তথা হাদীছকে পৃথক করার কোন সুযোগ নেই। মুসলমানদের জন্য দু’টিই আমলযোগ্য বিধান। যদিও কেউ কেউ হাদীছের প্রামাণিকতাকে অস্বীকার করার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। কেউ আবার নিজেদেরকে ‘আহলে কুরআন’ দাবী করে গর্ববোধ করে থাকে। মূলতঃ এরা আল্লাহ প্রেরিত শাশ্বত অহিকেই অস্বীকার করছে।
সুন্নাত অর্থ :
সুন্নাত শব্দের আভিধানিক অর্থ দাগ, রীতি, প্রকৃতি, জীবন পদ্ধতি, কর্মধারা ইত্যাদি। ছুরি ধার করার উদ্দেশ্যে পাথরের উপর বারবার ঘর্ষণের ফলে সেখানে যে দাগ পড়ে যায়, সেটাই সুন্নাত। নিয়মিতভাবে কোন কাজ করলে তাকে সুনণাত বলা হয়।[5] পরিভাষায় রাসূল (ছাঃ)-এর শরী‘আত বিষয়ক কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিই হচ্ছে সুন্নাত।[6]
পবিত্র কুরআনে সুন্নাত শব্দটি রীতি প্রকৃতি বা বিধান অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,فَهَلْ يَنْظُرُونَ إِلَّا سُنَّتَ الْأَوَّلِينَ فَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللهِ تَبْدِيلًا وَلَنْ تَجِدَ لِسُنَّتِ اللهِ تَحْوِيلًا ‘তবে কি তারা পূর্ববর্তী যুগের মানুষের সুন্নাতের অপেক্ষা করছে? অতঃপর তুমি কখনই আল্লাহর বিধানের কোন পরিবর্তন পাবে না এবং আল্লাহর বিধানের কোন ব্যতিক্রমও পাবে না’ (ফাতির ৩৫/৪৩)।
হাদীছে সুন্নাত শব্দটি ভাল ও মন্দ উভয় রীতির ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়েছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,مَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً حَسَنَةً فَلَهُ أَجْرُهَا وَأَجْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا بَعْدَهُ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أُجُورِهِمْ شَىْءٌ وَمَنْ سَنَّ فِى الإِسْلاَمِ سُنَّةً سَيِّئَةً كَانَ عَلَيْهِ وِزْرُهَا وَوِزْرُ مَنْ عَمِلَ بِهَا مِنْ بَعْدِهِ مِنْ غَيْرِ أَنْ يَنْقُصَ مِنْ أَوْزَارِهِمْ شَىْءٌ. ‘যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে কোন ভাল সুন্নাত বা রীতি চালু করল, অতঃপর লোকেরা সেটা আমল করল, তাহ’লে ঐ ব্যক্তির জন্য আমলকারীদের সমপরিমাণ নেকী প্রদান করা হবে। কিন্তু তাদের নেকী থেকে সামান্য পরিমাণও হ্রাস করা হবে না। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি ইসলামের মধ্যে মন্দ রীতি চালু করল এবং লোকেরা তার এই রীতি আমল করল, ঐ ব্যক্তির আমলনামায় উক্ত রীতির অনুসারীদের সমপরিমাণ গোনাহ প্রদান করা হবে। কিন্তু তাদের গোনাহ হ’তে সামান্য পরিমাণও হ্রাস করা হবে না’।[7]
সুন্নাতের গুরুত্ব :
রাসূল (ছাঃ)-এর সকল কথা, কর্ম ও মৌন সম্মতিই হচ্ছে সুন্নাত। যা পালন করা উম্মতে মুহাম্মাদীর জন্য অপরিহার্য। সুন্নাতের অধিকার হচ্ছে, বাস্তব জীবনে যথাযথভাবে তা অনুশীলন করা। এ প্রসঙ্গে রাসূল (ছাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা-
عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ كُلُّ أُمَّتِى يَدْخُلُونَ الْجَنَّةَ، إِلاَّ مَنْ أَبَى قَالُوا يَا رَسُولَ اللهِ وَمَنْ يَأْبَى قَالَ مَنْ أَطَاعَنِى دَخَلَ الْجَنَّةَ، وَمَنْ عَصَانِى فَقَدْ أَبَى-
আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘আমার উম্মতের প্রত্যেকেই জান্নাতে প্রবেশ করবে, কেবলমাত্র ‘আবা’ বা অবাধ্য ব্যতীত। ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, আবা কে হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! তিনি বললেন, যে ব্যক্তি আমার আনুগত্য করবে সে জান্নাতে যাবে। আর যে ব্যক্তি আমার অবাধ্যতা করবে সে-ই হচ্ছে আবা’।[8]
عن أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ رضى الله عنه يَقُولُ جَاءَ ثَلاَثَةُ رَهْطٍ إِلَى بُيُوتِ أَزْوَاجِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم يَسْأَلُونَ عَنْ عِبَادَةِ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم فَلَمَّا أُخْبِرُوا كَأَنَّهُمْ تَقَالُّوهَا فَقَالُوا وَأَيْنَ نَحْنُ مِنَ النَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم قَدْ غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ وَمَا تَأَخَّرَ قَالَ أَحَدُهُمْ أَمَّا أَنَا فَإِنِّى أُصَلِّى اللَّيْلَ أَبَدًا وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَصُومُ الدَّهْرَ وَلاَ أُفْطِرُ وَقَالَ آخَرُ أَنَا أَعْتَزِلُ النِّسَاءَ فَلاَ أَتَزَوَّجُ أَبَدًا فَجَاءَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ أَنْتُمُ الَّذِينَ قُلْتُمْ كَذَا وَكَذَا أَمَا وَاللهِ إِنِّى لأَخْشَاكُمْ لِلَّهِ وَأَتْقَاكُمْ لَهُ، لَكِنِّى أَصُومُ وَأُفْطِرُ، وَأُصَلِّى وَأَرْقُدُ وَأَتَزَوَّجُ النِّسَاءَ، فَمَنْ رَغِبَ عَنْ سُنَّتِى فَلَيْسَ مِنِّى-
আনাস বিন মালেক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, ‘একদা তিন সদস্যের একটি দল রাসূল (ছাঃ)-এর স্ত্রীদের বাড়ীতে এসে নবী করীম (ছাঃ)-এর ইবাদত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। যখন তাদেরকে সে সম্পর্কে খবর দেয়া হ’ল, তখন তারা এটাকে খুব কম মনে করল এবং বলল, রাসূল (ছাঃ)-এর তুলনায় আমরা কোথায়। তাঁর পূর্বের ও পরের সকল পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে। অতঃপর তিনজনের একজন বলল, এখন হ’তে আমি সারা রাত ছালাত আদায় করব। আরেকজন বলল, আমি সারা বছর ছিয়াম পালন করব, ছিয়াম ত্যাগ করব না। অপর ব্যক্তি বলল, আমি নারীদের সংশ্রব থেকে দূরে থাকব, কখনো বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হব না। অতঃপর রাসূল (ছাঃ) তাদের নিকটে আসলেন এবং বললেন, তোমরাই কি তারা যারা এরূপ এরূপ মন্তব্য করেছ? সাবধান! নিশ্চয়ই আমি তোমাদের মধ্যে আল্লাহকে সবচেয়ে বেশী ভয় করি এবং আমি সবচেয়ে বেশী পরহেযগার। কিন্তু আমি ছিয়াম পালন করি এবং ছিয়াম ত্যাগ করি। আমি ছালাত আদায় করি এবং ঘুমাই। আর আমি বিবাহ করেছি। অতএব যে ব্যক্তি আমার সন্নাত হ’তে দূরে সরে যাবে, সে আমার উম্মতের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[9]
ইখতেলাফের সময় করণীয় শীর্ষক হাদীছটি এক্ষেত্রে আরও সুস্পষ্ট।- ইরবায বিন সারিয়া (রাঃ) বলেন,
صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الصُّبْحَ ذَاتَ يَوْمٍ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَيْنَا فَوَعَظَنَا مَوْعِظَةً بَلِيغَةً ذَرَفَتْ مِنْهَا الْعُيُوْنُ وَوَجِلَتْ مِنْهَا الْقُلُوْبُ فَقَالَ قَائِلٌ يَا رَسُولَ اللهِ كَأَنَّ هَذِهِ مَوْعِظَةُ مُوَدِّعٍ فَمَاذَا تَعْهَدُ إِلَيْنَا فَقَالَ أُوصِيكُمْ بِتَقْوَى اللَّهِ وَالسَّمْعِ وَالطَّاعَةِ وَإِنْ كَانَ عَبْداً حَبَشِيًّا فَإِنَّهُ مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِى فَسَيَرَى اخْتِلاَفاً كَثِيراً فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِى وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ-
‘একদা রাসূল (ছাঃ) আমাদের সাথে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। অতঃপর আমাদের দিকে মুখ করে আমাদের উদ্দেশ্যে এমন এক মর্মস্পর্শী নছীহত করলেন, যাতে আমাদের চক্ষু সমূহ অশ্রু প্রবাহিত করল এবং অন্তর সমূহ ভীত-বিহবল হয়ে গেল। অতঃপর এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! মনে হচ্ছে এটি বিদায়ী ভাষণ। অতএব আমাদেরকে আরো কিছু উপদেশ দিন। তখন নবী করীম (ছাঃ) বললেন, ‘আমি তোমাদেরকে নছীহত করছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, নেতার কথা শুনবে ও মেনে চলবে নেতা বা ইমাম যদিও হাবশী গোলাম হন। আমার পরে তোমাদের মধ্যে যারা জীবিত থাকবে, তারা অচিরেই অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং হেদায়াত প্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরবে, অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে ধারণ করবে এবং তাকে মাঢ়ির দাঁত দিয়ে শক্তভাবে ধরে থাকবে। সাবধান তোমরা (দ্বীনের ব্যাপারে কিতাব ও সুন্নাহর বাইরে) নতুন সৃষ্ট কাজ হ’তে বেঁচে থাকবে। কেননা প্রত্যেক নতুন কাজই
বিদ‘আত এবং প্রত্যেক বিদ‘আতই ভ্রষ্টতা’।[10]
জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, একদিন একদল ফেরেশতা নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকটে আসলেন। তিনি তখন ঘুমিয়ে ছিলেন। ফেরেশতাদের কেউ বললেন, তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন। কেউ বললেন, তাঁর চক্ষু ঘুমিয়ে আছে বটে, কিন্তু অন্তর জেগে আছে। তখন তারা বললেন, তোমাদের এ সাথীর একটি উদাহরণ আছে। তাঁর উদাহরণটি তোমরা বর্ণনা কর। তখন তাদের কেউ বললেন, তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন, আবার কেউ বললেন, তাঁর চক্ষু ঘুমন্ত কিন্তু অন্তর জাগ্রত। তখন তারা বললেন, তাঁর উদাহরণ হ’ল ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে একটি গৃহ তৈরি করল। অতঃপর সেখানে খানাপিনার ব্যবস্থা করল এবং একজন আহবানকারীকে (লোকদের ডাকতে) পাঠাল। যারা আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিল, তারা ঘরে প্রবেশ করে খানা খাওয়ার সুযোগ পেল। আর যারা আহবানকারীর ডাকে সাড়া দিল না, তারা ঘরেও প্রবেশ করতে পারল না এবং খানাও খেতে পারল না। তখন তারা বললেন, উদাহরণটির ব্যাখ্যা বলে দিন, যাতে তিনি বুঝতে পারেন। তখন কেউ বললেন, তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন, আর কেউ বললেন, তার চক্ষু ঘুমন্ত, তবে অন্তর জাগ্রত। তখন তারা বললেন, ঘরটি হ’ল জান্নাত, আহবানকারী হ’লেন মুহাম্মাদ (ছাঃ)। অতএব যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর আনুগত্য করল, তারা আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যারা মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর অবাধ্যতা করল, তারা আল্লাহরই অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ (ছাঃ) হ’লেন মানুষের মাঝে সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী।[11]
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لا يُؤْمِنُ أَحَدُكُمْ حَتَّى يَكُونَ هَوَاهُ تَبَعًا لِمَا جِئْتُ بِهِ- ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত মুমিন হ’তে পারবে না যতক্ষণ না তার প্রবৃত্তি আমার আনীত দীন ও শরী‘আতের অধীন হবে’।[12] হযরত আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন,
صَنَعَ النَّبِىُّ صلى الله عليه وسلم شَيْئًا فَرَخَّصَ فِيهِ فَتَنَزَّهَ عَنْهُ قَوْمٌ فَبَلَغَ ذَلِكَ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم فَخَطَبَ فَحَمِدَ اللهَ ثُمَّ قَالَ مَا بَالُ أَقْوَامٍ يَتَنَزَّهُونَ عَنِ الشَّىْءِ أَصْنَعُهُ، فَوَاللهِ إِنِّى لأَعْلَمُهُمْ بِاللهِ وَأَشَدُّهُمْ لَهُ خَشْيَةً-
‘একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) একটি কাজ করলেন এবং তা করার জন্য অন্যদেরও অনুমতি দিলেন। এতদসত্ত্বেও কতক লোক তা হ’তে বিরত থাকল। এ সংবাদ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর কানে পৌঁছলে তিনি খুৎবা দিলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করলেন অতঃপর বললেন, ঐ সকল লোকদের কি হ’ল, যারা আমি যে কাজ করি তা হ’তে বিরত থাকে। আল্লাহর কসম! তাদের অপেক্ষা আমি আল্লাহকে অধিক জানি এবং তাদের অপেক্ষা অধিক ভয় করি’।[13]
খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে সুন্নাতের গুরুত্ব কত বেশী ছিল তা নিম্নের হাদীছ থেকে প্রতীয়মান হয়।-
عَنْ عُمَرَ رضى الله عنه أَنَّهُ جَاءَ إِلَى الْحَجَرِ الأَسْوَدِ فَقَبَّلَهُ، فَقَالَ إِنِّى أَعْلَمُ أَنَّكَ حَجَرٌ لاَ تَضُرُّ وَلاَ تَنْفَعُ، وَلَوْلاَ أَنِّى رَأَيْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يُقَبِّلُكَ مَا قَبَّلْتُكَ-
ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত যে, তিনি হাজরে আসওয়াদের নিকট গমন করলেন এবং একে চুমু দিলেন। অতঃপর (পাথরকে সম্বোধন করে) বললেন, আমি নিশ্চিতভাবে জানি যে, তুমি একটি পাথর। তুমি কারও ক্ষতি বা উপকার করতে পার না। যদি আমি নবী করীম (ছাঃ)-কে তোমায় চুমু দিতে না দেখতাম, তবে আমি তোমাকে কখনই চুমু দিতাম না’।[14]
অনুরূপভাবে মোজার উপরে মাসাহ সম্পর্কিত হযরত আলী (রাঃ)-এর বিখ্যাত উক্তিটিও এখানে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন,
لَوْ كَانَ الدِّينُ بِالرَّأْىِ لَكَانَ أَسْفَلُ الْخُفِّ أَوْلَى بِالْمَسْحِ مِنْ أَعْلاَهُ وَقَدْ رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَمْسَحُ عَلَى ظَاهِرِ خُفَّيْهِ.
‘যদি দ্বীন ব্যক্তি বিশেষের রায় অনুযায়ী হ’ত, তাহ’লে মোজার নীচের অংশ মাসাহ করা অবশ্যই উত্তম ছিল উপরের অংশের চেয়ে। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মোজার উপরাংশ মাসাহ করতে দেখেছি’।[15]
উপরোক্ত হাদীছগুলো পর্যালোচনা করলে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, মানুষের সামগ্রিক জীবনকে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিকটে সমর্পণ করতে হবে। যা উক্ত মানদন্ডের সাথে মিলে যাবে তা গ্রহণযোগ্য হবে। আর যা মিলবে না তা প্রত্যাখ্যাত হবে।
আখেরী যামানায় সুন্নাত পালন খুবই কঠিন :
সুন্নাতের গুরুত্ব যেমন অপরিসীম, তেমনি সুন্নাত পালনে প্রতিবন্ধকতাও ব্যাপক। সে যুগে যেমন ইসলাম কবুল করার কারণে মর্মান্তিকভাবে নির্যাতিত হ’তে হয়েছিল, এ যুগেও তেমনি সুন্নাত পালনের কারণে নানাবিধ নির্যাতন ভোগ করতে হচ্ছে। শুধুমাত্র রাসূল (ছাঃ)-এর পদ্ধতিতে ছালাত আদায়ের কারণে কতজনকে যে গৃহহারা, বাড়ী ছাড়া ও সমাজচ্যুত করা হচ্ছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। ধর্ম নেতারাই আজকাল ধর্ম পালনের বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে ছালাতে রাফঊল ইয়াদায়েন ও সরবে আমীন বলার কারণে কোন মুসলিম ভাইকে মসজিদ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দেওয়া কিভাবে সম্ভব হ’তে পারে। কিভাবে সম্ভব শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা। অথচ এ রকম অসংখ্য ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। মাযহাব ও তরীকার পর্দা ছিন্ন করে এরা নিরপেক্ষভাবে সুন্নাত পালন করতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় বাধা তো আছেই। সব মিলিয়ে শেষ যামানায় সুন্নাত পালন করা হবে খুবই কঠিন। তবে আশার কথা হ’ল এরূপ নানাবিধ প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে সুন্নাত পালনকারীদের জন্যই রয়েছে মহা পুরস্কার। একটি সুন্নাত দৃঢ়ভাবে ধারণের মর্যাদা হবে ৫০ জন শহীদের সমান। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূল (ছাঃ) এরশাদ করেন,إِنَّ مِنْ وَرَائِكُمْ زَمَانَ صَبْرٍ لِلْمُتَمَسِّكِ فِيْهِ أَجْرُ خَمْسِيْنَ شَهِيْدًا مِّنْكُمْ ‘তোমাদের পরে এমন একটা কঠিন সময় আসছে, যখন সুন্নাতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারী ব্যক্তি তোমাদের মধ্যকার পঞ্চাশ জন শহীদের সমান নেকী পাবে’।[16] অন্য বর্ণনায় আছে যে, এ সময় ছাহাবীগণ জিজ্ঞেস করলেন, এরা কি তাদের মধ্যেকার শহীদ? তিনি বললেন, না বরং তোমাদের মধ্যেকার শহীদ’।[17]
কিতাব ও সুন্নাহর কাছে আত্মসমর্পণের কতিপয় দৃষ্টান্ত :
১. আবুবকর (রাঃ) রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর স্ত্রী ও সন্তানদেরকে তাঁর পরিত্যক্ত সম্পতির অংশ দেননি। কন্যা ফাতিমা ও চাচা আববাস (রাঃ) খলীফা আবুবকর (রাঃ)-এর নিকটে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর ফাদাক-এর খেজুর বাগান ও খায়বারের সম্পতির অংশ দাবী করলেন। তখন খলীফা তাঁদেরকে নিম্নোক্ত হাদীছ শুনিয়ে নিবৃত্ত করেনسَمِعْتُ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ لاَ نُورَثُ، مَا تَرَكْنَا صَدَقَةٌ ‘আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনছি যে, আমাদের (সম্পতির) কেউ উত্তরাধিকারী হয় না। আমরা যা রেখে যাই সবই ‘ছাদাক্বাহ’। অর্থাৎ তা সর্বসাধারণের। তাই আবুবকর (রাঃ) বলেন ‘নিশ্চয়ই মুহাম্মাদ পরিবার এই মাল খেতে পারে না।[18]
২. মারামারি করার সময় আংগুল কেটে ফেলার এক আসামীকে ওমরের দরবারে হাযির করা হ’লে তিনি আংগুলের গুরুত্ব হিসাবে রক্তমূল্য নির্ধারণের পক্ষপাতি ছিলেন। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি ইয়ামনবাসী আমর বিন হযম পরিবারের নিকট হ’তে রাসূলের লিখিত ফরমান অবগত হ’লেন এই মর্মে যে, রক্তমূল্যের ক্ষেত্রে সকল আংগুলের গুরুত্ব সমান। হাত বা পায়ের প্রত্যেকটি আংগুলের বিনিময়ে রক্তমূল্য হ’ল দশ দশটি উট।’ সাঈদ ইবনুল মুসাইয়িব (মৃঃ ৯৪ হিঃ) বলেন, এই হাদীছ শোনার পর ওমর (রাঃ) স্বীয় সিদ্ধান্ত হ’তে প্রত্যাবর্তন করেন। কাযী শুরাইহ-এর নিকটে একদা একজন এসে বলল ‘বুড়ো আংগুল ও কড়ে আংগুলের মূল্য কি সমান হ’তে পারে? কাযী শুরাইহ তখন কঠোর ভাষায় বললেন, ‘তোমার ধ্বংস হৌক! হাদীছ যাবতীয় কিয়াসকে প্রতিরোধ করে। তুমি কেবল অনুসরণ করে যাও, বিদ‘আতী হয়ো না’। ওমর ফারূক (রাঃ)-এর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা এখানে স্মরণযোগ্য। তিনি বলেন, ‘যার হাতে ওমরের জীবন তাঁর কসম খেয়ে বলছি, নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর নবীর রূহ কবয করেননি বা অহী উঠিয়ে নেননি, যতক্ষণ না তার উম্মত সকল প্রকার ‘রায়’ হ’তে মুক্ত হ’তে পেরেছে।[19]
৩. ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন যে, আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর জীবদ্দশায় এক ছা‘ করে খাদ্যবস্ত্ত, খেজুর, যব, কিসমিস বা পনির ‘যাকাতুল ফিৎর’ হিসাবে আদায় করতাম। এই অবস্থা চালু ছিল। এমন সময় খলীফা হিসাবে মু‘আবিয়া (৪১-৬০) হজ্জ বা ওমরাহ উপলক্ষ্যে মদীনায় আসলেন। তাঁর সঙ্গে সিরিয়ার গমও আনা হ’ল। তিনি মসজিদের মিম্বারে দাঁড়িয়ে জনগণকে উদ্দেশ্য করে বললেন ‘আমি মনে করি সিরিয়ার দুই মুদ (অর্ধ ছা‘) গম (মূল্যের দিকে দিয়ে) মদীনার এক ছা‘ খেজুরের সমতুল্য’। ছহীহ মুসলিম-এর বর্ণনায় এসেছে যে, ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) মু‘আবিয়ার উক্ত প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, ‘আমি যতদিন দুনিয়ায় বেঁচে থাকব ততদিন অর্ধ ছা‘ গমের ফিৎরা কখনোই আদায় করব না। বরং রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যামানায় আমি যা দিতাম তাই-ই দিয়ে যাব’। বুখারীর ভাষ্যকার ইবনু হাজার আসক্বালানী (৭৭৩-৮৫২ হিঃ) বলেন, উক্ত আমল ঠিক নয়। কারণ এটি একজন ছাহাবীর আমল, যার বিরোধিতা করেছেনে ছাহাবী আবু সাঈদ খুদরী ও আবদুল্লাহ বিন ওমর সহ বহু নেতৃস্থানীয় ছাহাবা, যাঁরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর দীর্ঘ সাহচর্যে কাটিয়েছেন এবং যাঁরা তাঁর হাল অবস্থা সম্পর্কে অধিক ওয়াকিফহাল ছিলেন। তাছাড়া মু‘আবিয়া (রাঃ) স্পষ্টভাবেই বলে দিয়েছেন যে, এটি তাঁর নিজস্ব রায় মাত্র, রাসূলের উক্তি নয়। রাসূল (ছাঃ)-এর উক্তি ও আমল হ’ল এক ছা‘ খাদ্যবস্ত্তর পক্ষে। অতএব দলীল মওজুদ থাকতে ‘ইজতিহাদ’ বাতিল হবে।[20]
৪. ওমর (রাঃ)-এর পুত্র আব্দুল্লাহ একজন জলীলুর কদর ছাহাবী ছিলেন। তিনি ওমরাহ ও হজ্জের মধ্যবর্তী সময়ে ইহরাম ভঙ্গ করে হালাল হওয়া অর্থাৎ তামাত্তু হজ্জ জায়েয বলতেন। কিন্তু ওমর (রাঃ) এটা পসন্দ করতেন না। একদা কিছু লোক ইবনু ওমর (রাঃ)-কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কিভাবে আপনার পিতার বিরোধিতা করেন?’ তখন আবদুল্লাহ বিন ওমর (রাঃ) জওয়াবে বললেন ‘তোমাদের ধ্বংস হৌক তোমরা কি আল্লাহ্কে ভয় পাওনা? যদি ওমর (রাঃ) এটাকে নিষেধ করে থাকেন, তবে সেটা ভাল উদ্দেশ্যেই করেছেন। তিনি এর দ্বারা ওমরাহ পূর্ণ করতে চেয়েছেন। কিন্তু তার জন্য তোমরা তামাত্তু-কে হারাম করছ কেন? অথচ আল্লাহ সেটা হালাল করেছেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সেটার উপরে আমল করেছেন, তাহ’লে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত অধিক অনুসরণযোগ্য না ওমরের সুন্নাত?
পরিশেষে বলব, আহলেহাদীছগণ সর্বাবস্থায় কিতাব ও সুন্নাহর নিঃশর্ত ও সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে বিশ্বাস পোষণ করেন এবং মুসলিম উম্মাহ্কে সকল দিক হ’তে মুখ ফিরিয়ে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর দিকে ফিরে যাওয়ার উদাত্ত আহবান জানান। আহলেহাদীছ বা সালাফীদের এই বৈশিষ্ট্য ও মূলনীতি ব্যাখ্যাকরতে গিয়েই মিসরীর পন্ডিত আবু যুহ্রা বলেন, ‘সালাফীগণ যুক্তির উপরে নির্ভর করেন না। কেননা যুক্তি অনেক সময় ভ্রান্ত হয়। বরং তাঁরা সর্বদা নির্ভর করেন নছ তথা দলীলের উপরে অথবা ঐসবের উপরে যে দিকে দলীল ইংগিত প্রদানর করে। কারণ দ্বীন হ’ল অহি, যা আল্লাহর নবী প্রাপ্ত হয়েছিলেন’।[21] অতএব কিতাব ও সুন্নাহ দ্বারা যা প্রমাণিত হবে তা প্রত্যেক মুসলমানকে নির্দ্বিধায় মেনে নিতে হবে। এর কোন একটি বিধানও প্রত্যাখ্যান করা যাবে না। আর এটিই হচ্ছে কিতাব ও সুন্নাতের সার্বভৌম অধিকার।
[ক্রমশঃ]
[1]. মুসলিম হা/২০৪২; মিশকাত হা/১৪১ ঐ অনুচ্ছেদ, ছহীহ নাসাঈ হা/১৪৮৭, ‘দুই ঈদের ছালাত’ অধ্যায় ‘খুৎবা কেমন হবে’ অনুচ্ছেদ।
[2]. আহলেহাদীছ আন্দোলন পরিচিতি লিফলেট, পৃঃ ৩।
[3]. আবূদাঊদ হা/৪৬০৬; মিশকাত হা/১৬৩ ‘কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ, সনদ ছহীহ।
[4]. মুওয়াত্ত্বা হা/১৬২৮; মিশকাত হা/১৮৬ ‘সনদ হাসান’।
[5]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (রাজশাহী : হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৬ খ্রী./১৪১৬হি.), পৃঃ ২৯।
[6]. ঐ, পৃঃ ২৯।
[7]. মুসলিম হা/৪৮৩০ (২৩৯৮)।
[8]. ছহীহ বুখারী হা/৭২৮০; মিশকাত হা/১৪৩ ‘কিতাব ও সুন্নাহকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ ।
[9]. বুখারী হা/৫০৬৩; মিশকাত হা/১৪৫, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে আকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[10]. আহমাদ, হা/১৭৯০৯; আবুদাউদ হা/৪৬০৯; মিশকাত হা/১৫৮, ‘কিতাব ও সন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ।
[11]. বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪: ছহীহাহ হা/৩৫৯৫।
[12]. শারহুস্ সুন্নাহ; মিশকাত হা/১৬৭।
[13]. মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মিশকাত হা/১৪৬।
[14]. বুখারী হা/১৫৯৭, ১৬১০; মিশকাত হা/২৫৮৯ ‘মক্কায় প্রবেশ ও তাওয়াফ’ অনুচ্ছেদ; বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/২৪৭৩।
[15]. আবূদাঊদ হা/১৬২; মিশকাত হা/৫২৫ সনদ ছহীহ।
[16]. ত্বাবারাণী কাবীর হা/১০২৪০; ছহীহুল জামে‘ হা/২২৩৪।
[17]. সিলসিলা ছহীহাহ হা/৪৯৪।
[18]. বুখারী, ‘ফারায়েয’ অধ্যায় হা/৪০৩৬, ৬৭২৬; মিশকাত হা/৫৯৬৭।
[19]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৩৮; গৃহীত : আব্দুল ওয়াহ্হাব শা‘রানী, কিতাবুল মীযান (দিল্লী : আকমালুল মাতাবে, ১২৮৬ হিঃ) ১ম খন্ড পৃঃ ৬২।
[20]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৪০।
[21]. আহলেহাদীছ আন্দোলন উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৪৪।