পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । পর্ব ৪ । পর্ব ৫ । শেষ পর্ব ।
তাক্বলীদের ক্ষতিকর দিক :
(ক) তাক্বলীদ ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার অন্তরায় : ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার সবচাইতে বড় বাধা হ’ল তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। বিগত উম্মতগুলির অধঃপতনের মূলেও এই তাক্বলীদই সর্বাপেক্ষা ক্রিয়াশীল ছিল। নবীদের মৃত্যুর পর তারা তাদের বিদ্বান ও সাধু ব্যক্তিদের এমন অন্ধ অনুসরণ করত যেন তাদেরকে ভক্তির আতিশয্যে ‘রব’ -এর আসনে বসিয়েছিল। যেমন আল্লাহ বলেন,اتَّخَذُوا أَحْبَارَهُمْ وَرُهْبَانَهُمْ أَرْبَابًا مِنْ دُونِ اللهِ وَالْمَسِيحَ ابْنَ مَرْيَمَ وَمَا أُمِرُوا إِلَّا لِيَعْبُدُوا إِلَهًا وَاحِدًا لَا إِلَهَ إِلَّا هُوَ سُبْحَانَهُ عَمَّا يُشْرِكُونَ ‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে নিজেদের আলেম-ওলামা ও পোপ-পাদ্রীদের এবং মারিয়াম পুত্র মসীহ ঈসাকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করেছে। অথচ তাদের প্রতি কেবল এই আদেশ করা হয়েছিল যে, তারা শুধুমাত্র এক উপাস্যের ইবাদত করবে। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। আর তারা যাদেরকে শরীক সাব্যস্ত করে, তিনি সে সব থেকে পবিত্র’ (তওবা ৯/৩১)।
ইমাম রাযী (৫৪৪-৬০৬ হিঃ) বলেন, অধিকাংশ মুফাসসিরের মতে উক্ত আয়াতে উল্লিখিত ‘আরবাব’ অর্থ এটা নয় যে, ইহুদী-নাছারাগণ তাদেরকে বিশ্ব চরাচরের ‘রব’ মনে করত। বরং এর অর্থ হ’ল এই যে, তারা তাদের আদেশ ও নিষেধ সমূহের আনুগত্য করত।[1]
খ্রিষ্টান নেতা ‘আদী ইবনু হাতেম যখন ইসলাম কবুল করার জন্য রাসূল (ছাঃ)-এর নিকটে আসেন, তখন তিনি তার গলায় ঝুলানো স্বর্ণের বা রৌপ্য নির্মিত ক্রুস চিহ্নটি ফেলে দিতে বললেন। অতঃপর উক্ত আয়াতটি পাঠ করলেন। তখন ‘আদী বললেন, لسنا نعبدهم ‘আমরা তো তাদের পূজা করি না’। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, أَلَيْسَ يُحَرِّمُونَ مَا أَحَلَّ اللهُ فَتُحَرِّمُونَهُ وَيُحِلُّوْنَ مَا حَرَّمَ اللهُ فَتُحِلُّوْنَهُ ‘তারা কি সেই সব বস্ত্ত হারাম করে না যা আল্লাহ হালাল করেছেন, অতঃপর তোমরাও তা হারাম কর? আর তারা কি ঐসব বস্ত্ত হালাল করে না যা আল্লাহ হারাম করেছেন। অতঃপর তোমরাও তা হালাল কর’? আদী বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, فَتِلْكَ عِبَادَتُهُمْ ‘এটাই তো ওদের ইবাদত হ’ল’।[2]
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, إنهم لم يأمروهم أن يسجُدوا لهم، ولكن أمروهم بمعصية الله، فأطاعوهم، فسمَّاهم الله بذلك أربابًا ‘তারা তাদেরকে সিজদা করার আদেশ দিত না। বরং তাদেরকে আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ দিত এবং তারা তাদের সে আদেশ পালন করত। সেকারণে আল্লাহ তাদেরকে ‘রব’ হিসাবে অভিহিত করেছেন’।[3]
যুগে যুগে ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠার মূল অন্তরায় ছিল এই তাক্বলীদ। বাপ-দাদার আচরিত ধর্মের দোহাই দিয়ে সে যুগের লোকেরা নবী-রাসূলগণের দাওয়াত থেকে যেমন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, এ যুগের লোকেরাও তেমনি তাদের আচরিত ইমাম ও মাযহাবের দোহাই দিয়ে কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহর আনুগত্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। যেমন আল্লাহ এরশাদ করেন, وَإِذَا قِيْلَ لَهُمُ اتَّبِعُوْا مَا أَنْزَلَ اللهُ قَالُوْا بَلْ نَتَّبِعُ مَا أَلْفَيْنَا عَلَيْهِ آبَاءَنَا أَوَلَوْ كَانَ آبَاؤُهُمْ لَا يَعْقِلُوْنَ شَيْئًا وَلَا يَهْتَدُوْنَ- ‘যখন তাদের বলা হয়, আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তোমরা তার অনুসরণ কর, তখন তারা বলে, বরং আমরা তারই অনুসরণ করব যার উপরে আমরা আমাদের বাপ-দাদাদের পেয়েছি। যদিও তাদের বাপ-দাদারা কিছুই জ্ঞান রাখত না এবং তারা সুপথপ্রাপ্ত ছিল না’ (বাক্বারাহ ২/১৭০)।
(খ) মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির কারণ: মুসলিম উম্মাহর বিভক্তির মূল কারণ হচ্ছে তাক্বলীদে শাখছী বা অন্ধ ব্যক্তিপূজা। ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণের কারণে মুসলমানগণ আজ দলে দলে বিভক্ত। তাক্বলীদের গন্ডী অতিক্রম করে তারা পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের নিরপেক্ষ প্লাটফরমে সমবেত হ’তে পারছে না। অথচ মহান আল্লাহর নির্দেশ হচ্ছে- وَاعْتَصِمُوا بِحَبْلِ اللَّهِ جَمِيعًا وَلَا تَفَرَّقُوا ‘তোমরা সকলে সমবেতভাবে আল্লাহর রজ্জুকে ধারণ কর এবং পরস্পরে বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (আলে ইমরান ৩/১০৩)। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللَّهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মধ্যে দু’টি বস্ত্ত ছেড়ে যাচ্ছি, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমরা এ দু’টি বস্ত্তকে অাঁকড়ে ধরে থাকবে ততক্ষণ পথভ্রষ্ট হবে না। তা হচ্ছে, আল্লাহর কিতাব তথা কুরআন ও তাঁর নবীর সুন্নাত তথা হাদীছ’।[4]
উপরোক্ত আয়াত ও হাদীছে মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ থাকার যেমন নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তেমনি ঐক্যের ভিত্তিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। আর তা হ’ল পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছ। এ দু’টির ভিত্তিতেই কেবলমাত্র মুসলিম উম্মাহ ঐক্যবদ্ধ হ’তে পারে।
(গ) তাক্বলীদের কারণে ইত্তেবা বিঘ্নিত হয় : ইত্তেবা হচ্ছে দলীলের অনুসরণ আর তাক্বলীদ হচ্ছে বিনা দলীলে কোন ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণ। অন্যভাবে বলা যায় তাক্বলীদ হচ্ছে ‘রায়’-এর অনুসরণ আর ইত্তেবা হচ্ছে ‘রেওয়ায়াতে’র অনুসরণ। দু’টি পরস্পর বিরোধী ও বিপরীতমুখী। ইত্তেবা সিদ্ধ কিন্তু তাক্বলীদ নিষিদ্ধ। অনেকে ইত্তেবা ও তাক্বলীদকে একাকার করার অপচেষ্টা চালান, যা আদৌ সমীচীন নয়। মূলতঃ তাক্বলীদের কারণেই ইত্তেবা বিঘ্নিত হয়। দলীল উপস্থাপনের পরও নিজেদের অনুসরণীয় তাক্বলীদী মাযহাবের অনুকূলে ফৎওয়া না হওয়ায় তা দ্বিধাহীনচিত্তে প্রত্যাখ্যান করা হয়। দলীলের অনুসারীদেরকে তথা আহলেহাদীছদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়া, তাদেরকে সমাজচ্যুত করা, ঈদের মাঠে যেতে বাধা দেওয়া, প্রশাসন কর্তৃক হয়রানী করা, তাদের মসজিদ দখল করে নেওয়া ও মসজিদ পুড়িয়ে দেওয়া ইত্যাদি বর্তমান সমাজের রূঢ় বাস্তবতা। আর এসবের পিছনে মূল ভূমিকা পালন করে তাক্বলীদ। তাক্বলীদী পর্দা ছিন্ন করে এরা দলীলের অনুসরণ করতে চরমভাবে ব্যর্থ। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, اتَّبِعُوا مَا أُنْزِلَ إِلَيْكُمْ مِنْ رَبِّكُمْ وَلَا تَتَّبِعُوا مِنْ دُونِهِ أَوْلِيَاءَ قَلِيلًا مَا تَذَكَّرُونَ ‘তোমাদের নিকট তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হ’তে যা নাযিল করা হয়েছে তার অনুসরণ কর এবং তোমরা আল্লাহকে ছেড়ে অন্য কোন বন্ধুর অনুসরণ করো না। বাস্তবে তোমরা খুব কমই উপদেশ গ্রহণ করে থাক’ (আ‘রাফ ৭/৩) । রাসূল (ছাঃ) বলেন, مَنْ عَمِلَ عَمَلاً لَيْسَ عَلَيْهِ أَمْرُنَا فَهْوَ رَدٌّ ‘কেউ যদি এমন কোন আমল করে, যে ব্যাপারে আমার নির্দেশ নেই, তা প্রত্যাখ্যাত’।[5]
(ঘ) পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আমল ব্যাহত হয় :
তাক্বলীদের কারণে পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছের আমল ব্যাহত হয়। তাক্বলীদপন্থীরা তাদের অনুসরণীয় ইমাম বা বুযুর্গের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নিরপেক্ষভাবে কুরআন-হাদীছে মানতে পারে না। স্বীয় ইমাম বা মাযহাবের দোহাই দিয়ে তারা সঠিক আমল থেকে দূরে থাকে। ইমাম রাযী (রহঃ) বলেন, আমি মুক্বাল্লিদদের একটি জামা‘আতের সাথে সাক্ষাৎ করেছি এবং বিভিন্ন মাসআলা সম্পর্কে তাদের সামনে পবিত্র কুরআনের অনেকগুলি আয়াতকে দলীল হিসাবে পেশ করেছি। কিন্তু তাদের অনুসরণীয় মাযহাব কুরআনের আয়াতগুলির বিপরীত হওয়ায় তারা তা গ্রহণ করেনি এবং কুরআনের আয়াতের দিকে ফিরেও দেখেনি। বরং তারা অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল এবং বলল, কিভাবে আমরা এর উপর আমল করব, অথচ আমাদের অনুসরণীয় মাযহাব এর বিপরীত’?[6]
(ঙ) ইজতিহাদের পথ রুদ্ধ হয় :
তাক্বলীদের কারণে ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার পথ রুদ্ধ হয়। তাক্বলীদপন্থীদের বদ্ধমূল ধারণা এই যে, তাদের অনুসরণীয় ইমামের পরে আর কেউ ইজতিহাদ করার যোগ্যতা রাখেন না। তিনি যে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছেন চোখ বন্ধ করে তা মেনে নিতে হবে। ইজতিহাদের দরজা চিরতরে বন্ধ হয়ে গেছে। এই ভ্রান্ত ধারণা অনুসারীদের মধ্যে বিরাজ করার কারণে যুগ যুগ ধরে তারা ভুল ফৎওয়ার উপরে আমল করে চলেছেন। অথচ কোন ইমামই অন্ধভাবে তাদের অনুসরণ করার কথা বলে যাননি। বরং নিষেধ করে গেছেন।
তৃতীয় মূলনীতি: ইজতিহাদ বা শরী‘আত গবেষণার দুয়ার উন্মুক্তকরণ :
যুগ-জিজ্ঞাসার জওয়াব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহ হ’তে বের করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর নাম ‘ইজতিহাদ’। এই অধিকার ক্বিয়ামত পর্যন্ত সকল যুগের সকল মুত্তাক্বী ও যোগ্য আলেমের জন্য খোলা থাকবে। এটি আহলেহাদীছ আন্দোলনের তৃতীয় দফা মূলনীতি।
তাক্বলীদপন্থীদের ধারণা ইমাম চতুষ্টয়ের পরে আর কোন ইজতিহাদ নেই। ইজতেহাদের দ্বার চিরতরে রুদ্ধ হয়ে গেছে। কারো পক্ষে এই যুগে ইজতিহাদ করা সম্ভব নয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এটি একটি ভ্রান্ত ধারণা। বর্তমান যুগেও যদি কেউ ইজতিহাদের জন্য আবশ্যক যাবতীয় যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকারী হন, তাহ’লে তাঁর পক্ষে ইজতিহাদ করা মোটেই অবৈধ বা অসম্ভব নয়। বরং আল্লাহ প্রদত্ত পূর্ণাঙ্গ দীনকে সচল ও স্থায়ী রাখার জন্য ইজতিহাদের পথ সদা উন্মুক্ত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। নিম্নে এ বিষয়ে আলোচনা পেশ করা হ’ল।-
ইজতিহাদ অর্থ :
‘ইজতিহাদ’ (اجتهاد) শব্দটি আরবী ‘জুহদুন’ (جهد) শব্দ হ’তে উদ্গত। এর আভিধানিক অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় কুরআন, সুন্নাহ ও ইজমায়ে ছাহাবার মধ্যে স্পষ্ট পাওয়া যায় না এমন বিষয়ে শারঈ হুকুম নির্ধারণের জন্য সার্বিক অনুসন্ধান প্রচেষ্টা নিয়োজিত করাকে ‘ইজতিহাদ’ বলা হয়।[7]
ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা :
ইজতিহাদের গুরুত্ব অপরিসীম। সমাজে উদ্ভূত নতুন কোন সমস্যার সমাধান কুরআন ও হাদীছে সরাসরি না পাওয়া গেলে সেক্ষেত্রে এ সম্পর্কিত মূলনীতির আলোকে নব-উদ্ভূত সমস্যার সমাধানের জন্য ইজতিহাদ প্রয়োজন। ইজতিহাদ ইসলামী আইন ও বিধানকে সচল, সক্রিয় ও সঞ্জীবিত রাখে। ইজতিহাদের পথ রুদ্ধ হয়ে গেলে ইসলামের সার্বজনীনতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। পবিত্র কুরআন মাজীদের বহু আয়াতে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা ও চেষ্টা-সাধনার নির্দেশ রয়েছে, যা ইজতিহাদের প্রয়োজনীয়তা ও বৈধতার ইঙ্গিত বহন করে। যেমন : মহান আল্লাহ বলেন,
يَسْأَلُوْنَكَ عَنِ الْخَمْرِ وَالْمَيْسِرِ قُلْ فِيْهِمَا إِثْمٌ كَبِيْرٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَإِثْمُهُمَا أَكْبَرُ مِنْ نَفْعِهِمَا وَيَسْأَلُونَكَ مَاذَا يُنْفِقُوْنَ قُلِ الْعَفْوَ كَذَلِكَ يُبَيِّنُ اللهُ لَكُمُ الْآيَاتِ لَعَلَّكُمْ تَتَفَكَّرُوْنَ-
‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে মদ ও জুয়া সম্পর্কে। তুমি বল যে, এ দু’য়ের মধ্যে বড় পাপ রয়েছে এবং মানুষের জন্য কিছু উপকার রয়েছে। তবে এ দু’টির পাপ তার উপকার অপেক্ষা গুরুতর। আর তারা তোমাকে জিজ্ঞেস করছে কি পরিমাণ ব্যয় করবে? তুমি বল, উদ্বৃত্ত থেকে ব্যয় কর। এভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য আয়াত সমূহ ব্যাখ্যা করেন, যাতে তোমরা চিন্তা-গবেষণা করতে পার’ (বাক্বারাহ ২/২১৯)।
وَأَنْزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ-
‘আর তোমার নিকটে প্রেরণ করেছি কুরআন, যাতে তুমি মানুষকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দাও যা তাদের প্রতি নাযিল করা হয়েছে, যেন তারা চিন্তা-গবেষণা করে’ (নাহল ১৬/৪৪)।
أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللَّهَ أَنْزَلَ مِنَ السَّمَاءِ مَاءً فَسَلَكَهُ يَنَابِيعَ فِي الْأَرْضِ ثُمَّ يُخْرِجُ بِهِ زَرْعًا مُخْتَلِفًا أَلْوَانُهُ ثُمَّ يَهِيجُ فَتَرَاهُ مُصْفَرًّا ثُمَّ يَجْعَلُهُ حُطَامًا إِنَّ فِي ذَلِكَ لَذِكْرَى لِأُولِي الْأَلْبَابِ-
‘তুমি কি দেখনা যে, আল্লাহ আকাশ থেকে বারি বর্ষণ করেন। অতঃপর সে পানি পৃথিবীর ঝর্ণাসমূহে প্রবাহিত করেন। অতঃপর তা দিয়ে রং-বেরংয়ের শস্যাদি উৎপন্ন করেন। অতঃপর তা শুকিয়ে যায়। যাকে তুমি হলুদ দেখ। অতঃপর আল্লাহ তাকে খড়কুটায় পরিণত করেন, নিশ্চয়ই এর মধ্যে উপদেশ রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য’ (যুমার ৩৯/২১)।
وَلَقَدْ يَسَّرْنَا الْقُرْآنَ لِلذِّكْرِ فَهَلْ مِنْ مُدَّكِرٍ-
‘আমি কুরআন সহজ করে দিয়েছি উপদেশ গ্রহণের জন্য। অতএব উপদেশ গ্রহণকারী কেউ আছ কি?’ (ক্বামার ৫৪/১৭)।
ইজতিহাদের প্রকার :
ইজতিহাদ দু’প্রকার। ১. বর্তমানের কোন সমস্যাকে পূর্বকালের কোন সমস্যার সদৃশ বিধানের মাধ্যমে সমাধানের প্রচেষ্টা চালানো। ২. শরী‘আতের সার্বিক বিধান সমূহ অনুধাবন করা ও তার আলোকে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা। প্রথম প্রকারের ইজতিহাদকে ‘বিশুদ্ধ কিয়াস’ (القياس الصحيح) বলা যায়। এই প্রকারের ইজতিহাদ সকল যুগের সকল বিদ্বানের জন্য উন্মুক্ত এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকার ব্যাপারে ঐক্যমত রয়েছে।[8]
পক্ষান্তরে দ্বিতীয় প্রকার ইজতিহাদের জন্য প্রত্যেক যুগেই উপযুক্ত মুজতাহিদ থাকবেন। রাসূল (ছাঃ) বলেন,لاَ تَزَالُ طَائِفَةٌ مِنْ أُمَّتِى ظَاهِرِينَ عَلَى الْحَقِّ لاَ يَضُرُّهُمْ مَنْ خَذَلَهُمْ حَتَّى يَأْتِىَ أَمْرُ اللَّهِ وَهُمْ كَذَلِكَ- ‘আমার উম্মতের মধ্যে চিরকাল একটি দল হক-এর উপরে বিজয়ী থাকবে, বিরোধিতাকারী বা পরিত্যাগকারীরা তাদের কোনই ক্ষতি করতে পারবে না, এইভাবে কিয়ামত এসে যাবে’।[9] অন্যত্র রাসূল (ছাঃ) বলেন, بَدَأَ الإِسْلاَمُ غَرِيبًا وَسَيَعُودُ كَمَا بَدَأَ غَرِيبًا فَطُوبَى لِلْغُرَبَاءِ- ‘ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল গুটি কয়েক লোকের মাধ্যমে আবার ফিরেও যাবে সে অবস্থায়। অতএব সুসংবাদ সেই অল্পসংখ্যক লোকদের জন্যই’।[10] অর্থাৎ অল্পসংখ্যক হ’লেও কিয়ামত পর্যন্ত চিরকাল হক্বপন্থী দলের অস্তিত্ব থাকার অর্থই হ’ল হকপন্থী আলেমগণের অস্তিত্ব বজায় থাকা। উপরোক্ত হাদীছ চিরকাল ইজতিহাদের বিদ্যমানতা, ইসলামের চিরঞ্জীবতা ও সর্বযুগীয় সমাধান হওয়ার প্রমাণ বহন করে।[11] তবে জমহুর বিদ্বানের মতে কোন কোন যুগ খালি থাকাও সিদ্ধ আছে। যেমন :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرِو بْنِ الْعَاصِ قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ: إِنَّ اللهَ لاَ يَقْبِضُ الْعِلْمَ انْتِزَاعًا، يَنْتَزِعُهُ مِنَ الْعِبَادِ، وَلَكِنْ يَقْبِضُ الْعِلْمَ بِقَبْضِ الْعُلَمَاءِ، حَتَّى إِذَا لَمْ يُبْقِ عَالِمًا، اتَّخَذَ النَّاسُ رُءُوسًا جُهَّالاً فَسُئِلُوا، فَأَفْتَوْا بِغَيْرِ عِلْمٍ، فَضَلُّوا وَأَضَلُّوا-
আব্দুল্লাহ বিন আমর বিন ‘আছ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূল (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তার বান্দার নিকট হ’তে ইলম উঠিয়ে নেন না। বরং তিনি আলেমদের উঠিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে ইলমকে উঠিয়ে নেন। এমনকি যখন কোন আলেম বাকী থাকবে না তখন লোকেরা মূর্খ ব্যক্তিদেরকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করবে। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসিত হবে এবং ইলম ছাড়াই ফৎওয়া দিবে। ফলে তারা অন্যদের পথভ্রষ্ট করবে এবং নিজেরা পথভ্রষ্ট হবে’।[12]
মুজতাহিদের যোগ্যতা ও গুণাবলী :
যে কেউ চাইলেই ইজতিহাদ করতে পারেন না। ইজতিহাদ করার যোগ্যতা অর্জন মহান আল্লাহর এক বিশেষ দান। মুজতাহিদকে অবশ্যই কুরআন-হাদীছে পূর্ণ পারদর্শী এবং সেখান থেকে উদ্ভূত সমস্যার সমাধান বের করার যোগ্যতা হাছিল করতে হবে। হ’তে হবে পূর্ণ তাক্বওয়াশীল ও বাস্তব জীবনে সুন্নাতের পাবন্দ। মহান আল্লাহ কম সংখ্যক মানুষের মধ্যেই এই যোগ্যতা দান করেন। এমনকি শতাব্দী অন্তর একজন মুজাদ্দিদ প্রেরণ করেন। আবুহুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,إِنَّ اللهَ يَبْعَثُ لِهَذِهِ الأُمَّةِ عَلَى رَأْسِ كُلِّ مِائَةِ سَنَةٍ مَنْ يُجَدِّدُ لَهَا دِينَهَا- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা প্রতি শতাব্দীর মাথায় এই উম্মতের জন্য একজন করে মুজাদ্দিদের উত্থান ঘটাবেন, যিনি দ্বীনের সংস্কার সাধন করবেন’।[13]
ইজতিহাদের নেকী :
মুজতাহিদের ইজতিহাদ ভুল-শুদ্ধ দু’টিই হ’তে পারে। মুজতাহিদ নিজেও জানেন যে, তার এই সিদ্ধান্ত সঠিক হ’তে পারে আবার বেঠিকও হ’তে পারে। তবে যেহেতেু তিনি নিরপেক্ষভাবে কুরআন-হাদীছ পর্যালোচনা করে অধিকতর সঠিক বিবেচনায় সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন, সেকারণ আল্লাহর পক্ষ হ’তে তার জন্য নেকী রয়েছে। ইজতেহাদ ভুল হ’লেও রয়েছে একগুণ নেকী। আর সঠিক হ’লে তো দ্বিগুণ নেকী। আমর বিন আছ (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূল (ছাঃ) বলেন,
إِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ-
‘বিচারক যখন বিচারকার্য সম্পাদন করেন অতঃপর ইজতিহাদ করেন, আর তা যদি সঠিক হয় তবে তার জন্য দ্বিগুণ নেকী রয়েছে। আর বিচারকের ইজতিহাদ যদি ভুল হয়, তবুও তার জন্য একগুণ নেকী রয়েছে’।[14]
দলীল পাওয়া গেলে ইজতেহাদ বাতিল হবে:
যে বিষয়ের উপর ইজতিহাদ করা হবে সে বিষয়ে পরবর্তীতে দলীল পাওয়া গেলে ইজতিহাদ বাতিল হবে এবং দলীলের অনুসরণ করা ওয়াজিব হবে। যেমন বলা হয়إذا ورد الأثر بطل النظر ‘যখন হাদীছ পাওয়া যাবে তখন ক্বিয়াস বাতিল হবে’।[15] জগদ্বিখ্যাত ইমাম চতুষ্টয়ের সকলেই এ কথার উপর জোরালো তাকীদ দিয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই নিজেদের ইজতিহাদকে দলীলের নিকটে সোপর্দ করেছেন এবং স্ব স্ব অনুসারীদেরকে তাদের ইজতিহাদের বিপরীতে দলীল পাওয়া গেলে দলীলের অনুসরণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
[চলবে]
[1]. ইমাম রাযী, তাফসীরুল কাবীর ১৬/২৭ পৃঃ; গৃহীত : আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ, পৃঃ ১৫১।
[2]. তাহক্বীক্ব তিরমিযী হা/৩০৯৫ সনদ হাসান; সিলসিলা ছহীহাহ হা/৩২৯৩।
[3]. তাফসীরে তাবারী, সূরা তওবা ৯/৩১ আয়াতের ব্যাখ্যা দ্রষ্টব্য।
[4]. মুওয়াত্ত্বা মালেক হা/৩৩৮; মিশকাত হা/১৮৬, ‘কিতাব ও সুন্নাতকে অাঁকড়ে ধরা’ অনুচ্ছেদ, সনদ হাসান।
[5]. মুসলিম হা/১৭১৮।
[6]. কুরআন সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ, পৃঃ ৭২, গৃহীত : ইমাম রাযী, তাফসীরে কাবীর ৪/১৩১ পৃঃ।
[7]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৮৩।
[8]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৮৩।
[9]. মুসলিম হা/১৯২০।
[10]. মুসলিম হা/১৪৫; মিশকাত হা/১৫৯।
[11]. আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, পৃঃ ১৮৩।
[12]. বুখারী হা/১০০; মুসলিম হা/২৬৭৩; মিশকাত হা/২০৬।
[13]. আবূদাঊদ হা/৪২৯১; সিলসিলা ছহীহা হা/৫৯৯।
[14]. ছহীহ বুখারী হা/৭৩৫২; মুসলিম হা/১৭১৬; মিশকাত হা/৩৭৩২।
[15]. সিলসিলা ছহীহা হা/৩২১ এর আলোচনা দ্রষ্টব্য।