পর্ব ১ । শেষ পর্ব ।

আমরাও বিশ্বাস করি যে, তিনি একজন আলেম ফাযেল মানুষ। তবে আমাদের উভয়ের বিশ্বাসের মাঝে পার্থক্য এই যে, আমরা ভুলে যাই না যে, আলেম ফাযেল হওয়া সত্ত্বেও তিনি ভুলের ঊর্ধ্বে নন। কিন্তু তারা এ সত্যকে ভুলে যান। ফলে তারা তাদের ইমামের কথার বিরুদ্ধে উত্থাপিত আপত্তি খন্ডনে সদাই চেষ্টা করতে থাকেন। তাদের কেউ কেউ মুসলিমদের মধ্যে মাদকের প্রসার ঘটাতে এ কথাকে পুঁজি করেন। আবার অনেকে মানহানি থেকে ইমামকে সুরক্ষা দিতে চেষ্টা করেন, তাঁর কথা খন্ডনে নয়।

সম্ভবত আপনাদের অনেকের জানা আছে যে, ‘আল-মাজাল্লা আল-আরাবী’ নামে একটি পত্রিকা অনেক দিন আগে তাদের এক লেখকের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিল। সেই প্রবন্ধকার আঙ্গুর ছাড়া অন্যান্য দ্রব্য থেকে উৎপাদিত মাদক গ্রহণ হালাল বলে মত প্রকাশ করেছিলেন এবং তা প্রতিষ্ঠার অপচেষ্টা চালিয়েছিলেন। আজকের দিনে যেসব মদ সুপরিচিত তার অধিকাংশই আঙ্গুর থেকে উৎপাদিত নয়। (কাজেই সেগুলো স্বল্প মাত্রায় পান করলে তাদের মতে কোন অন্যায় হবে না।) ‘মাজাল্লা আল-আরাবী’ পত্রিকা তার প্রবন্ধে মুসলমানদের জন্য আধুনিক মাদক দ্রব্যাদি ইচ্ছামত পান মুবাহ করে দিয়েছে। এ মুবাহকরণের পেছনে তার দলীল: ‘যা তোমাকে নেশাগ্রস্ত করে তা পান কর না’। (অতএব যা নেশাগ্রস্ত করে না তেমন নেশার দ্রব্য ইচ্ছামত পান করো।)

আর স্বল্পমাত্রাও একটা আপেক্ষিক বিষয়। কেননা বাস্তবে আমরা সবাই জানি, পয়লা ফোঁটা টেনে আনে দ্বিতীয় ফোঁটাকে; অনুরূপভাবে তৃতীয় ফোঁটা টেনে আনে চতুর্থ ফোঁটাকে। এভাবেই পানক্রিয়া চলতে থাকে পুরোমাত্রা পর্যন্ত। যে স্বল্প মাত্রায় নেশা হবে না তার কোন সীমা ও নিয়ম-নীতি নির্ধারণ সম্ভব নয়। ফলে পান করতে করতে যে মাত্রায় নেশা এসে যায় পানকারী এমন বেশী মাত্রায় পান করে বসে। (আবার দেখা যায়, একজনের অল্পতেই নেশা হয় তো অন্যের তার দ্বিগুণ মাত্রায়ও নেশা হয় না।)

কিন্তু আমি বলছি, রাসূলুল্লাহ (ছঃ) থেকে প্রমাণিত ও অকাট্য হাদীছের সাথে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও এ জাতীয় বাতিল কথা কিভাবে ফিক্বহের বইগুলোতে স্থান পেল এবং থেকে গেল? কেন আমরা একজন ধান্ধাবাজ লেখককে তার বাতিল কথা প্রসারের সুযোগ করে দিচ্ছি? তার উপর নিজের মিশন ও প্রাসাদ খাড়া করবার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি? কি করেই বা তিনি মুসলমানদের জন্য এ কথা বলে হারাম পানীয় হালাল করার  সুযোগ করে দিচ্ছেন যে,  তুমি নেশা উদ্রেককারী বস্ত্ত পান করো না এবং পান করলে অল্প পান কর, বেশী পান করো না।

যে ব্যক্তি এ কথা লিখেছে হ’তে পারে সে ধান্ধাবাজ; আবার হ’তে পারে বিশুদ্ধ নিয়তের অধিকারী। কিন্তু তার ইচ্ছা ব্যক্তিবিশেষের তরীকা বা মাযহাব অনুসরণ। তাই সে ডেকে বলে, ‘হে লোকসকল! মদ পানের ক্ষেত্রে তোমরা মুসলমানদের উপর কড়াকড়ি আরোপ করো না। কেননা এক্ষেত্রে মুসলমানদের একজন সম্মানিত ইমামের মত রয়েছে, যিনি তাদের জন্য এই পানীয় মুবাহ (বৈধ) করে গেছেন। কাজেই আমরা তা কেন হারাম করব? ঐ লেখকের নিয়ত এমনটাও হ’তে পারে।

কিন্তু আমাদের কি হ’ল যে একজন বিখ্যাত সিরীয় আলেমকে দেখি,  ঐ  লেখকের  লেখার  প্রতিবাদ  করতে গিয়ে একটি পুস্তিকা রচনা করেছেন। কিন্তু তাতে তিনি প্রতিবাদের নামে একেবারে লেজেগোবরে দশা করে ছেড়েছেন। একবার তিনি ঐ লেখক যে ইমামের কথাকে ভিত্তি করেছেন তাকে ভরপুর সমর্থন করেছেন তো আরেকবার সেসকল হাদীছের অবতারণা করেছেন যার কিছু আমরা তুলে ধরেছিু যাতে ঐ লেখক এবং লেখক যে ইমামের কথার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তার বাতিল হওয়ার কথা রয়েছে।

কেন আমরা এই আলেমকে তার মত প্রকাশে এত দ্বিধান্বিত দেখছি? তার কারণ, কথাটি একজন মুসলিম ইমামের বলে তিনি তাকে পবিত্র ভাবছেন। তার ধারণায় এই ইমাম তো প্রবৃত্তি তাড়িত হয়ে কিংবা অজ্ঞতা থেকে কথাটি বলেননি। (কাজেই তার কথার সত্যতা কোন না কোন ভাবে আছে।) আমি তার সাথে যোগ করছি, নাফসানী খাহেশ পূরণ কিংবা অজ্ঞতা থেকে কথাটি তিনি বলেননি তা ঠিক আছে, কিন্তু তিনি কি তার ঐ ইজতিহাদে ভুলের ঊর্ধ্বে বিবেচিত হবেন, যে ইজতিহাদ তিনি লেখকের দাবী মতে নাফসানী খাহেশ পূরণ কিংবা অজ্ঞতা থেকে করেননি? আমরা সবাই বলব, ‘না’। আমাদের সবাই এক্ষেত্রে স্মরণ করব রাসূল (ছঃ)-এর উক্তিإِذَا حَكَمَ الْحَاكِمُ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَصَابَ فَلَهُ أَجْرَانِ، وَإِذَا حَكَمَ فَاجْتَهَدَ ثُمَّ أَخْطَأَ فَلَهُ أَجْرٌ، ‘যখন বিচারক ইজতিহাদ বা গবেষণা করে বিচার করবেন এবং তাতে তিনি সঠিক রায় দিবেন তার দু’টি ছওয়াব মিলবে। আর যখন ইজতিহাদপূর্বক বিচার করতে গিয়ে তিনি ভুল করবেন তার একটি ছওয়াব মিলবে’।[1]

তাহ’লে কেন আমরা ভুলে যাচ্ছি যে, মুজতাহিদের কখনও কখনও একটি ছওয়াব মেলে। তবে আমরা বলছি না যে, তিনি ভুল করেছেন? কেননা কেউ যদি বলে, ‘অমুক ইমাম ভুল করেছেন’ তাহ’লে কিছু লোকের জন্য সে কথা বরদাশত করা খুব কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। প্রবাদে আছে, ‘যাঁতায় যাঁতায় মিল’। তাই আমরা বলছি, কথা বলতে এত ছলচাতুরী কেন? অথবা কেন আমরা এ কথা বলতে ভয়ে জড়সড় হয়ে পড়ছি যে ‘মুসলিমদের অমুক ইমাম একটি মাসআলায় অথবা একটি ইজতিহাদে কিংবা একটি সিদ্ধান্তে ভুল করেছেন, ফলে তিনি দু’টির বদলে একটি ছওয়াব পাবেন? প্রথমত কেন আমরা মূলেই ইমামের ভুল করার কথা বলতে পারছি না? দ্বিতীয়তঃ এক মাসআলার সঙ্গে আরেক মাসআলার সমন্বয়ের কথাও কেন বলতে পারছি না? যেই সমন্বয় আমাদের আলোচ্য ফিক্বহী মাসআলাতে যরূরী?

পাঠক! এই আলেম যে পুস্তিকা উক্ত লেখকের লেখার প্রতিবাদে লিখেছেন, তা পড়লে আপনি এমন কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারবেন না যে, উক্ত লেখক মুসলিমদের একজন ইমামের একটি মাসআলা বা রায়ের উপর নির্ভর করে ভুল করেছেন।

অথচ খোদ ইমামের কিছু কিছু অনুসারী সে আমলেই তাঁর রায়কে শারঈ দলীলের সঙ্গে যাচাই-বাছাই ও পরিশোধন করতে গিয়ে উক্ত মাসআলায় তাঁর প্রদত্ত রায় থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছেন এবং ভুলের জন্য মাসআলাটিতে ইমামকে একটা ছওয়াবের মালিক গণ্য করেছেন এবং তাঁর মাযহাব ত্যাগ করে এ মাসআলায় ছহীহ হাদীছসমূহকে আমলের জন্য আঁকড়ে ধরেছেন। যেখানে তাঁর তৎকালীন অনুসারীদের অনেকেই তাঁর মত ত্যাগ করেছেন সেখানে আমরা কেন ঐ প্রতিবাদের পুস্তিকায় এ কথা পড়তে পাই না যে, ইমাম মহোদয় ছওয়াব পাবেন বটে, কিন্তু তিনি মদ পানের উক্ত মাসআলায় ভুল রায় দিয়েছেন এবং ইমাম মহোদয়ের রায়ের উপর ভিত্তি করে ‘মাজাল্লা আল-আরাবী’ পত্রিকার লেখকের সুন্নাহর উপর আপত্তি তোলার কোন অধিকার নেই?

এ প্রশ্নের উত্তর এই যে, আমরা হয়ে গেছি কট্টর। আমাদের উপর আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশিত ফরযের তুলনায় ইমামদের পবিত্রতা ও সম্মান আমাদের অন্তরে অনেক বেশী জেঁকে বসে আছে। ফলে আল্লাহর হুকুম লংঘন হয় হোক, কিন্তু ইমামদের হুকুমের নড়চড় করতে আমরা মোটেও আগ্রহী নই।

এদিকে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদের উদ্দেশ্যে নিম্নের যে বাণীটি বলেছেন তাতে কিন্তু আমরা সবাই আস্থাশীল। তিনি বলেছেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ لَمْ يُجِلَّ كَبِيرَنَا وَيَرْحَمْ صَغِيرَنَا وَيَعْرِفْ لِعَالِمِنَا حَقَّهُ ‘যে আমাদের বড়দের সম্মান করে না, আমাদের ছোটদের উপর দয়া করে না এবং আমাদের আলেম বা বিদ্বানদের অধিকার সম্বন্ধে জানে না সে আমাদের অন্তর্ভুক্ত নয়’।[2] এ বাণীতে রাসূল (ছাঃ) মুসলমানদের খাছভাবে আলেমদের অধিকার জানতে বলেছেন। কিন্তু একজন আলেমের অধিকার ও মর্যাদা কি এত উঁচুতে যে আমরা তাঁকে নবুঅত ও রিসালাতের আসনে আসীন করব? আমরা কি তাকে আমাদের হাবভাবের ভাষায় নিষ্পাপত্বের মর্যাদা প্রদান করব? হাবভাবের ভাষা তো দেখছি এখানে মুখের ভাষা থেকে অধিক জোরালো!!

আসলে আমরা একজন আলেমকে সম্মান করব, তাকে যথাযথ মূল্যায়ন করব এবং আমাদের সামনে দলীল প্রকাশিত হ’লে আমরা তার তাক্বলীদও করব। কিন্তু তাই বলে ঐ আলেমের কথা উপরে রেখে রাসূল (ছাঃ)-এর কথা নীচে নামিয়ে দেওয়ার কোন অধিকার আমাদের নেই। আমাদের এমন অধিকারও নেই যে, তার কথাকে রাসূল (ছাঃ)-এর কথার উপর অগ্রাধিকার দিব। এ বিষয়ে কুরআন ও সুন্নাহর বিদ্যায় পারদর্শী আলেমদের কারও কোন অস্বীকৃতি কিংবা আপত্তি নেই।

আমার প্রকাশিত আরেকটি পুস্তিকায় আমি মদ পান সংক্রান্ত এ দৃষ্টান্তটি আলোচনা করেছি। ঐ পুস্তিকা থেকে পাঠক একটা সিদ্ধান্তে অবশ্যই উপনীত হ’তে পারবেন। সেও এই একই কথা। যেমনটা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَا أَسْكَرَ كَثِيرُهُ فَقَلِيلُهُ حَرَامٌ، ‘যার বেশী মাত্রায় পানে নেশা জন্মে তার স্বল্প মাত্রাও হারাম’।[3]

বস্ত্তত ‘মাজাল্লা আল-আরাবী’ পত্রিকার লেখক ভুল করেছেন। তিনি যে ইমামের উপর নির্ভর করে কথাটি বলেছেন তিনিও ভুল করেছেন। আর কেউ যখন ভুল করে তখন আমাদের মনে তার জন্য কোন পক্ষপাতিত্ব জাগার কথা নয়। ভুল ভুলই, কুফর কুফরই, চাই তা ছোট করুক কিংবা বড়; নারী করুক কিংবা পুরুষ- তা সবই ভুল। কার থেকে তা প্রকাশ পেল তা নিয়ে ভুলের তারতম্য করা যাবে না।

বিবাহকে ঘিরেও এমন একটি আইনের দৃষ্টান্ত আছে। ফিক্বহের বই-পুস্তকে সে আইন অতীতে যেমন ছিল এখনও তেমনি আছে। এমনকি ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’ (Muslim personal law) নামে যে আইন আজ মুসলিম দেশগুলোতে চালু আছে তাতেও বিবাহ কেন্দ্রিক ঐ আইন বলবৎ আছে।

আফসোসের সাথে বলতে হচ্ছে যে, ‘মুসলিম ব্যক্তিগত আইন’-এর নামে আমাদেরকে যে সমস্ত আইন মানতে বাধ্য করা হচ্ছে সর্বসম্মত মতানুসারেই তাতে শরী‘আত পরপন্থী অনেক বিধান রয়েছে। তা সত্ত্বেও শরী‘আত পরপন্থী সেসব বিধান ‘মর্যাদাবান ইসলামী আইন’(?) হিসাবে আমাদের মাঝে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ বিধান অনুসারেই কোন প্রাপ্তবয়ষ্কা মুসলিম নারী তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া নিজের ইচ্ছামত যে কোন পুরুষকে বিবাহ করতে পারে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খোলাখুলি বলেছেন,أَيُّمَا امْرَأَةٍ نُكِحَتْ بِغَيْرِ إِذْنِ وَلِيِّهَا فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ فَنِكَاحُهَا بَاطِلٌ ‘যে নারীই তার অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া নিজে নিজে বিবাহ করবে তার বিবাহ বাতিল; তার বিবাহ বাতিল; তার বিবাহ বাতিল’।[4] এখন এ হাদীছ অকার্যকর, কিন্তু উক্ত বিধান কার্যকর এবং তদনুসারে বিচার কাজ সম্পন্ন হয়ে থাকে।

কেউ কেউ হয়ত বলতে পারেন, ‘হাদীছটি কি আপনি ছাড়া আর কেউ বোঝেনি’? উত্তরে বলব, এই হাদীছ আরবী ভাষা ও তার রীতি-নীতি সম্বন্ধে নিজ যামানায় যিনি সবচেয়ে বেশী বুঝতেন সেই ইমাম শাফেঈ (রহঃ) গ্রহণ করেছেন। এটা এমন কোন লোকের রায় নয়, যিনি মূলে আলবানী, আলবেনীয় হিসাবে পরিচিত। বরং এই আলবানী একটি হাদীছ পেয়েছে, আর পেয়েছে একজন ইমামের এতদসংক্রান্ত উপলব্ধি যিনি কিনা কুরাইশ বংশীয় বনু মুত্তালিব গোত্রের সন্তান।

প্রশ্ন জাগে, এই ছহীহ হাদীছের সাথে যুক্ত ছহীহ রায়কে কেন অন্য একজন মুসলিম ইমামের রায়ের খাতিরে পরিত্যাগ করা হ’ল? হ্যাঁ, ইমামের ইজতিহাদকে আমরা ধারণ করি। কিন্তু সেই ইজতিহাদ তখনই মূল্য পাবে যখন তা কুরআন-সুন্নাহর নিষ্কলুষ নছের (text) সাথে সাংঘর্ষিক হবে না।

আমরা সবাই উছূলে ফিক্বহর বই-পুস্তকে ফক্বীহ ও উছূলবিদদের কথা পড়ি :إذا ورد الأثر بطل النظر،  ‘যখন হাদীছ পাওয়া যাবে তখন যুক্তি বাতিল  (অকার্যকর) হয়ে যাবে’;نهر الله بطل نهر معقل. إذا ورد ‘যখন আল্লাহর কথার দরিয়া আসবে তখন বুদ্ধি-বিবেচনার দরিয়া বাতিল (অকার্যকর) হয়ে যাবে,ولا اجتهاد في مورد النص ‘নছ যেখানে মজুদ সেখানে ইজতিহাদ খাটানোর সুযোগ নেই’। এই সূত্রগুলোর প্রত্যেকটিই তত্ত্ব হিসাবে সুবিদিত। তাহ’লে কেন আমরা এই সূত্রগুলোকে গুরুত্ব দিয়ে সমন্বয়ের কাজে লাগাব না? এবং কেনইবা আমরা সুন্নাহ বিরোধী নানা মাসআলা সদাই আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকব?

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) উম্মতের যিল্লতির রোগ নির্ণয়ের পর দ্বীনের পথে ফিরে আসাকে ওষুধ হিসাবে নির্বাচন করেছেন। তিনি বলেন, حَتَّى تَرْجِعُوْا إِلَى دِيْنِكُمْ ‘তোমরা যতক্ষণ না তোমাদের দ্বীনের মাঝে ফিরে আসবে’।[5] (ততক্ষণ তিনি তোমাদের থেকে ঐ লাঞ্ছনা দূর করবেন না।) এখন ‘দ্বীনের পথে ফিরে আসা’ কি শুধুই মুখের কথায় হবে? নাকি আক্বীদায় ও আমলেও ফিরতে হবে?

নিশ্চয়ই অনেক মুসলমান সাক্ষ্য দেয় যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল। কিন্তু তারা এই দুই সাক্ষ্য বাণীর সঙ্গে আবশ্যিকভাবে জড়িত দাবীসমূহ পূরণে মোটেও তৎপর নয়। সে অনেক লম্বা কথা। ফলতঃ আজকের যুগে অনেক মুসলমান এমনকি যারা মুরশিদ হিসাবে খ্যাত তারা পর্যন্ত কালিমা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’-এর বিশদ হক আদায় করেন না। এ সম্পর্কে অনেক মুসলিম যুবক ও লেখক তাদের আলোচনা ও লেখনীতে জনগণকে সচেতন করে থাকেন। তারা বলেন যে, কালিমা শাহাদতের হক হ’ল: হুকুম চলবে কেবল আল্লাহর। হ্যাঁ, আমিও এ কথা খোলাখুলি বলতে চাই। তবে আমি মুসলিম যুবক ও লেখকগণকে এই সত্যের প্রতিও সচেতন করতে চাই যে, ইসলামের নামে জাগতিক যেসব আইন-কানূনের বাস্তবায়ন এবং আজকের চলমান সমস্যাদির সমাধান যেসব আইনে করতে চাওয়া হচ্ছে তার অনেকটাই ‘হুকুম কেবল এক আল্লাহর জন্য’ হওয়ার পরিপন্থী।[6] আমি লক্ষ্য করছি যে, এই সব লেখকের অনেকেই যে বিষয়ে অন্যদের সচেতন করছেন তার সঙ্গে কিন্তু নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারছেন না।  তাদের সচেতনতা তো ‘হুকুম চলবে কেবল আল্লাহর’ এ কথাকে ঘিরে। কিন্তু আল্লাহর হুকুমের অর্থ তো কুরআন ও সুন্নাহর হুকুম। (সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কেবল কুরআনের হুকুম নয়। কিন্তু তারা যেন সুন্নাহকে বাদ দিয়ে কেবল কুরআনের হুকুমকে আল্লাহর হুকুম মনে করছেন।)

ভেবে দেখুন, যখন অমুক কাফের থেকে আল্লাহর হুকুমের বিপরীত একটি হুকুম প্রকাশ পায় তখন আমরা তাকে আল্লাহ বিরোধী হুকুম বলেই গণ্য করি। কিন্তু যদি ঐ হুকুমই কোন ভুলকারী মুজতাহিদের ইজতিহাদ থেকে প্রকাশ পায় তখন কি তা আল্লাহ বিরোধী হুকুম বলে গণ্য হবে না?

আমি বিশ্বাস করি, এক্ষেত্রে কোন পার্থক্য নেই। কেননা হুকুমের উৎস (হুকুমদাতা) যেই হোক না কেন, সে হুকুম যতক্ষণ পর্যন্ত কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী বলে গণ্য হবে ততক্ষণ পর্যন্ত তা থেকে দূরে থাকা একজন মুসলিমের জন্য ফরয। তবে এখানে এই পার্থক্য অবশ্যই রয়েছে যে, আল্লাহকে অস্বীকার করে আল্লাহ বিরোধী হুকুমের কথা যে বলেছে, সে চিরজাহান্নামী কাফের। আর যে মুসলিম, কিন্তু ভুল করে তা বলেছে, সে তার ভুলের উপরও ছওয়াব পাবে। যেমন ইতিপূর্বে ছহীহ হাদীছের বরাতে এ সম্পর্কে জানানো হয়েছে।

তাহ’লে বুঝা গেল, এখন দ্বীন বুঝার রাস্তায় চেষ্টা-সাধনা করা এবং তদনুযায়ী চলার মাধ্যমে দ্বীনের দিকে ফেরা ওয়াজিব হবে। আর এই চেষ্টা-সাধনা ও চলা তখনই সম্ভব হবে যখন আজকের দিনে ‘আল-ফিক্বহুল মুকারিন’ বা ‘আল-ফিক্বহুল মুকারান’ নামে আখ্যায়িত ফিক্বহশাস্ত্রের মধ্যে সমন্বয় করা হবে।[7] সকলকে  আবশ্যিকভাবে এই ফিক্বহর পঠন-পাঠন করতে হবে। বিশেষত ফিক্বহ ও হাদীছের আইনানুগ সার্টিফিকেটধারী বিশেষজ্ঞগণ তা ভালোমত অধ্যয়ন করবেন।

আবার আমরা যখন কোন মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ডাক দেব তখন অবশ্যই সে রাষ্ট্রের একটা সুস্পষ্ট সংবিধান ও ততোধিক সুস্পষ্ট কানূন লাগবে। তাহ’লে কোন মাযহাবের উপর ভিত্তি করে আমরা সে সংবিধান রচনা করব? কোন মাযহাবের ভিত্তিতে সেই সাংবিধানিক আইনের ব্যাখ্যা দেওয়া হবে?

বর্তমান যুগে কিছু মুসলিম লেখককে দেখা যায়, তারা কিছু কিছু কানূন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন এবং তাদের কাম্য মুসলিম রাষ্ট্রে এই কানূনগুলো আবশ্যিকভাবে কার্যকর করতে হবে বলে দাবী করেন। কিন্তু আমরা এই কানূনগুলোকে আমাদের বর্ণিত ‘তুলনামূলক ফিক্বহ শাস্ত্র’ এবং আমাদের কানূনের মূল উৎস ‘কুরআন ও সুন্নাহ’-এর ভিত্তিতে লেখা হয়েছে বলে দেখতে পাই না। এসব লেখক কেবলই মাযহাব অধ্যয়ন করেছেন। ফলে কানূন নির্ধারণ করতে গিয়ে তারা নিজ মাযহাবের মাসআলাগুলো নকল করেছেন এবং সামনের দিনে শীঘ্রই যে ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম হ’তে যাচ্ছে বলে তারা আশা করছেন, তাদের লিখিত এই কানূনই তার কানূন হবে বলে তারা তাদের রচিত গ্রন্থে তা স্থান দিয়েছেন। সুতরাং বাস্তবে এ কোন নতুন তত্ত্ব নয়; যেমন ‘নেশা উদ্রেককারী পানীয়’ (المشروبات المسكرة) পুস্তিকার লেখক নেশা সম্পর্কে নতুন কোন তত্ত্ব হাযির করেননি। নতুন যে তত্ত্ব আমরা আশা করছি তা এই যে, আমরা মাদকের অবৈধতা সম্পর্কে মুসলিম জাতিকে সচেতন করে তুলব। তবে কমপক্ষে এতটুকু বলা যায় যে, নেশার ক্ষেত্রে অন্য আরেকজন ইমাম সঠিক কথা বলেছেন। কেননা তাঁর কথা সুন্নাহ সমর্থিত। এ মত ইমাম শাফেঈ (রহঃ)-এর। তাঁর মতে, যে নেশার দ্রব্য বেশী পরিমাণ পানে নেশা হয় তার অল্প পরিমাণ পানও হারাম। চাই তা আঙ্গুর থেকে তৈরি হোক কিংবা অন্য কিছু থেকে। কেননা হাদীছে এসেছে, ‘যার বেশী পরিমাণ নেশার উদ্রেক করে তার অল্প পরিমাণও হারাম’।

এই যে লেখকের লেখার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে, তার লেখার একটি দফায় এসেছে: ‘কোন মুসলিম কোন যিম্মী অমুসলিমকে হত্যা করলে বিনিময়ে তাকে হত্যা করা হবে। ইসলামী ফিক্বহশাস্ত্রে এ কথা সুবিদিত। তবে এক্ষেত্রে আরেকটি মত রয়েছে, যা এর বিপরীত। অর্থাৎ কোন মুসলিম কোন যিম্মী অমুসলিমকে হত্যা করলে বিনিময়ে তাকে হত্যা করা হবে না। ছহীহ বুখারীতে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لاَ يُقْتَلَ مُسْلِمٌ بِكَافِرٍ ‘কোন কাফিরের মোকাবেলায় কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না’।[8] তাহ’লে কোন প্রেক্ষিতে এই খ্যাতিমান আলেম ও সমকালীন লেখক রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছের বিপরীতে গিয়ে কাফের হত্যার বিনিময়ে মুসলিম হত্যার বিধান ইসলামী আইনের অন্তর্ভুক্ত করলেন? আমি বিশ্বাস করি, এর কারণ, ঐ ব্যক্তি যেই ফিক্বহর উপর প্রতিপালিত হয়েছেন সেই ফিক্বহই কেবল অধ্যয়ন করেছেন এবং তাকেই জীবনের ব্রত বানিয়ে নিয়েছেন। তাহ’লে এই ব্রত অবলম্বনই কি দ্বীনের পানে ফেরা বলে গণ্য হবে? দ্বীন বলছে, ‘কাফিরের মোকাবেলায় কোন মুসলিমকে হত্যা করা যাবে না’; কিন্তু মাযহাব বলছে, ‘তার বদলে তাকে হত্যা করা হবে’।

অনুরূপভাবে ঐ একই লেখক তার উক্ত একই লেখার মধ্যে বলেছেন, কোন মুসলিম কোন যিম্মী অমুসলিমকে ভুলক্রমে হত্যা করলে তার দিয়াত বা রক্তপণ কি হবে? তারপর লিখেছেন, মুসলিমের দিয়াত আর তার দিয়াত এক সমান। কানূন বা বিধিবদ্ধ আইনও যেই মাযহাবের উপর নির্ভরশীল তার অনুসরণে এই একই কথা বলেছে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, دِيَةُ عَقْلِ الْكَافِرِ نِصْفُ دِيَةِ عَقْلِ الْمُؤْمِنِ ‘কাফিরের দিয়াত মুসলিমের দিয়াতের অর্ধেক’।[9]

এক্ষেত্রে কি তবে আমরা মাযহাবের কথাকেই কানূন বানিয়ে নেব, নাকি তার বিপরীতে হাদীছের কথাকে?

বস্ত্তত দ্বীনে ফেরা অর্থ কুরআন ও সুন্নাহর দিকে ফেরা। কেননা সকল ইমামের ঐক্যমতে কুরআন ও সুন্নাহই দ্বীন। এই দ্বীনই পরিবর্তন-পরিবর্ধন ও ভুল পথে আটকে পড়া থেকে মুক্ত। এজন্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,تَرَكْتُ فِيكُمْ شَيْئَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا بَعْدَهُمَا: كِتَابَ اللهِ وَسُنَّتِي، وَلَنْ يَتَفَرَّقَا حَتَّى يَرِدَا عَلَيَّ الْحَوْضَ، ‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি জিনিস রেখে যাচ্ছি। এই দু’টির উপরে থাকলে পরবর্তীতে তোমরা কখনই পথ হারাবে না। তা হ’ল: আল্লাহর কিতাব এবং আমার সুন্নাহ। আর এরা দু’টো কখনই বিচ্ছিন্ন হবে না, যে পর্যন্ত না এরা হাওযের ধারে আমার সাথে মিলিত হবে’।[10]

আমরা এ পুস্তিকায় এমন কিছু উদাহরণ পেশ করেছি যাতে প্রমাণিত হয় যে, বর্তমানকালের আলেম বা বিদ্বানদের উপর কেবল দ্বীনের উল্লিখিত দু’টি মূল উৎস তথা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে দ্বীন বুঝা ফরয। এর ফলে আল্লাহ যা হারাম করেছেন তাকে আল্লাহ কর্তৃক মুবাহ করার দাবী তুলে মুসলমানরা হারামকে হালাল করার দোষে দুষ্ট হবে না।

এবার দ্বীনে ফেরা নিয়ে আমার শেষ কথা :

যখন আমরা মহান আল্লাহ তা‘আলার কাছ থেকে ইযযত লাভের আকাঙ্ক্ষা করব, আমাদের উপর চেপে বসা লাঞ্ছনা ও দুর্গতি থেকে রেহাই পেতে চাইব এবং শত্রুর বিরুদ্ধে আল্লাহর সাহায্য প্রাপ্তির প্রত্যাশা করব তখন শুধু চিন্তা-চেতনা ও বোধ-বুদ্ধির পরিশোধন এবং দ্বীনী বিদ্যায় পারদর্শী আলেম-ওলামা ও বিশেষ ফিক্বহশাস্ত্রের (তুলনামূলক ফিক্বহ শাস্ত্রের) বিশেষজ্ঞগণ কর্তৃক ইমামদের সঠিক মতামতসমূহ শারঈ দলীলাদির আলোকে জনগণের সামনে তুলে ধরাই যথেষ্ট হবে না, বরং এখানে চিন্তা-চেতনা ও বোধ-বুদ্ধির পরিশোধনের সাথে আরও একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লাগবে। তা হ’ল আমল। কেননা ইলম বা বিদ্যা হ’ল আমলের মাধ্যম। সুতরাং কোন মানুষ বিদ্যা অর্জন করলেও এবং তার বিদ্যা খাঁটি ও নির্ভেজাল হ’লেও যদি সে তদনুযায়ী আমল না করে তাহ’লে স্বতঃসিদ্ধভাবেই বলা যায় যে, এই বিদ্যা কোন ফল বয়ে আনবে না। সুতরাং বিদ্যার সাথে আমলকে অবশ্যই যোগ করতে হবে।

এভাবে যে নতুন মুসলিম প্রজন্ম গড়ে উঠবে তাদেরকে কুরআন ও সুন্নাহ থেকে সাব্যস্ত বিধি-বিধানের আলোকে তারবিয়াত বা প্রশিক্ষণের দায়িত্ব অবশ্যই দ্বীনী আলেমদের নিতে হবে। জনগণ বংশ পরম্পরায় যে বিবেচনা-বোধ ও ভুলের উপর রয়েছে তার উপর তাদের থাকতে দেওয়া আমাদের জন্য জায়েয হবে না। তাদের সে সকল বিবেচনা-বোধ ও ভুলের কিছু তো সকল ইমামের ঐক্যমতে নিশ্চিতই বাতিল, আবার কিছু আছে মতভেদপূর্ণ এবং তাতে যুক্তি, ইজতিহাদ ও রায়ের দখল রয়েছে। আর এই রায় ও ইজতিহাদের কিছু আবার সুন্নাহর পরিপন্থী।

সুতরাং এই বিষয়গুলো পরিশোধন এবং সেই পরিশোধিত পথে চলা যে ফরয, তা পরিষ্কারভাবে ফুটিয়ে তোলার পর নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই এই ছহীহ ইলম বা বিদ্যার ভিত্তিতে তারবিয়াত করতে হবে। এই তারবিয়াতই হবে তাই যা আমাদের জন্য একটি পরিচ্ছন্ন বা নির্ভেজাল ইসলামী সমাজ উপহার দিবে। তার পরেই না আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠিত হবে ইসলামী হুকুমত বা রাষ্ট্র।

আমার বিশ্বাস মতে এই দু’টি আবশ্যিক বিষয় তথা ‘ছহীহ ইলম’ এবং ‘ছহীহ ইলমের ভিত্তিতে ছহীহ তারবিয়াত’ না হ’লে ‘ইসলামী সমাজের নকশা’ বা ‘ইসলামী প্রশাসন’ বা ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ যাই বলি না কেন তা কায়েম হওয়া সম্ভব নয়।

ছহীহ ইলমের ভিত্তিতে ছহীহ তারবিয়াত যে কতখানি আবশ্যক আমি তার একটা উদাহরণ টানছি: আমাদের সিরিয়াতে একটা ইসলামী দল আছে যারা চায় ইসলামের জন্য কাজ করতে, ইসলামী জাগরণ ঘটাতে এবং নিজেদেরকে ও নতুন প্রজন্মকে ইসলাম মুতাবেক প্রতিপালন করতে। কিন্তু আমাদের অনুভবে ধরা পড়ে, এই সংস্কারকামীদের বেশীর ভাগেরই ইতিপূর্বে আমাদের উল্লেখিত নিরাপদ ও ছহীহ ধারায় ইসলামের ব্যাপক অধ্যয়ন নেই। তাদের জন্য এ অধ্যয়ন অত্যন্ত যরূরী। এই দলের অনেক মুসলিম যুবককে দেখি, তারা জুম‘আর রাতে রাত জাগার জন্য জমায়েত হওয়ার জন্য একে অপরকে আহবান জানায়। আল্লাহর আনুগত্য ও ইবাদতের জন্য পারস্পরিক এ আহবান নিঃসন্দেহে খুবই সুন্দর। কিন্তু যেহেতু তারা সুন্নাত অধ্যয়ন করেনি, সুন্নাত বোঝেনি এবং বুদ্ধি-বিবেচনা হওয়ার পর থেকে তারা এমন কোন বংশধারা পায়নি যারা তাদেরকে বাল্যকাল থেকে সুন্নাহ ভিত্তিক প্রতিপালন করতে পারে, সেহেতু একাজ করতে গিয়ে তারা সুন্নাতের বিরুদ্ধাচরণ করে বসেছে। এ বিষয়ে আমরা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর একটি হাদীছের প্রতি ইঙ্গিত করছি। তিনি বলেছেন,لاَ تَخْتَصُّوا لَيْلَةَ الْجُمُعَةِ بِقِيَامٍ مِنْ بَيْنِ اللَّيَالِى وَلاَ تَخُصُّوا يَوْمَ الْجُمُعَةِ بِصِيَامٍ مِنْ بَيْنِ الأَيَّامِ، ‘রাত্রিকালে ছালাত আদায়ের জন্য তোমরা রাতগুলো থেকে জুম‘আর রাতকে নির্দিষ্ট কর না এবং (দিবাভাগে) ছিয়াম পালনের জন্য দিনগুলো থেকে জুম‘আর দিনকে নির্দিষ্ট কর না’।[11] বুঝে দেখুন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যেখানে আমাদেরকে জুম‘আর রাত ইবাদতে জেগে কাটাতে নিষেধ করলেন সেখানে কিভাবে আমরা তার অন্যথা করছি? এর কারণ, আমাদের বিষয়টি মোটেও জানা নেই। কিন্তু আলেমদের তো বলা দরকার ছিল যে, এ রাতে ইবাদতের জন্য জাগরণ জায়েয নেই। একটু আগে উল্লেখিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর হাদীছ তার প্রমাণ।

প্রিয় পাঠক! আপনি এই ভালমনা যুবকদের অন্য এক গ্রুপকে পাবেন, তারা গান-বাজনা শোনা ও বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারকে হালাল গণ্য করে। অথচ রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার নিষেধ করেছেন। গীত-বাদ্য শুনতে সাবধান করেছেন এবং যারা অসার ক্রীড়া-কৌতুকে মেতে থাকে ও গীতবাদ্য শোনে তাদের বানর-শূকরে রূপান্তরিত হওয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে এই নতুন মুসলিম প্রজন্মকে কোন সার্বিক নির্দেশনা প্রদান করা হয়নি।[12]

এই নতুন প্রজন্মকে কোনটা জায়েয, আর কোনটা নাজায়েয তা শেখানো হয়নি এবং সেভাবে গড়ে তোলা হয়নি। তারা অনেক ধরনের মতামত পায় এবং সুবিধামত একটা মানে। উদাহরণস্বরূপ গান মুবাহ হওয়া সম্পর্কে ইমাম ইবনু হাযম (রহঃ)-এর একটি পুস্তিকা আছে। দ্রুতই এ পুস্তিকা ছাপা হচ্ছে এবং জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে পুস্তিকাটি তাদের খেয়াল-খুশীর সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কিছু সংস্কারক ও সংশোধনকামী তো এ কথাও বলে থাকেন যে, ইনি তো যুগ যুগ ধরে ইমাম পদে বরিত এবং তাঁর এ ধরনের একটি মত রয়েছে। কাজেই আমরা গীত-বাদ্য শুনতে তাঁর তাক্বলীদ ও অনুসরণ করব। বিশেষত যখন এ মুছীবত ব্যাপক রূপ লাভ করেছে। বুঝুন! অবস্থা এমন হ’লে সুন্নাতের স্থান দাঁড়ালো কোথায়? সুন্নাতের তো তাহ’লে একেবারেই দফারফা হয়ে গেল!

যখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের উপর ঘাঁটি গেড়ে বসা লাঞ্ছনার চিকিৎসা ‘দ্বীনে ফেরা’ নির্ধারণ করেছেন, তখন আমাদের উপর ফরয হয়ে দাঁড়িয়েছে আলেমদের মাধ্যমে কুরআন ও সুন্নাহ মাফিক ছহীহ-শুদ্ধভাবে দ্বীন বুঝা এবং আমাদে নেককার ও পবিত্র নতুন বংশধরদের ছহীহ-শুদ্ধ দ্বীনের উপর লালন-পালন করা। প্রত্যেক মুসলমান যে সমস্যা নিয়ে নিরন্তর অনুযোগ করে তা থেকে মুক্তির এটাই পথ।

আমার খুব পসন্দের একটি বাক্য, বস্ত্তত যেন তা আমার বলা সকল কথার সার কথা, যা কিনা বর্তমান যুগের জনৈক সংস্কারকের উক্তি, আমার মনে বলে এ যেন আসমানী অহী, তা হ’ল,أَقِيموا دَولةَ الإسلامِ في قُلوبِكُم، تُقَمْ لَكُم في أرضِكُم- ‘তোমরা তোমাদের হৃদয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠা কর, তোমাদের জনপদে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হবে’ ।

আমাদের অবশ্যই দ্বীন ইসলামের ভিত্তিতে যেমন করে আমরা উল্লেখ করেছি তেমন করে আমাদের মনের সংশোধন করতে হবে। নিশ্চয়ই তা অজ্ঞতার ভিত্তিতে হবে না, বরং হবে ইলমের ভিত্তিতে। এমনি করে এক সময় আমাদের এই দেশে ইসলামী হুকুমত কায়েম হবে।

উপসংহারে বলব, এই মহতী উদ্যোগ বাস্তবায়নে যারাই শরীক হবেন তারা এবং ইসলামী বিশেষজ্ঞগণ যেন ইসলামের বর্ণনা কুরআন ও সুন্নাহতে যেভাবে এসেছে ঠিক সেভাবে বর্ণনা করেন এবং নতুন বংশধরদের তদনুযায়ী প্রতিপালন করতে এগিয়ে আসেন। সেই সঙ্গে যেন বাড়িয়ে দেন সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত। এ হ’ল উপদেশ। আর উপদেশ মুমিনদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনে।


[1]. বুখারী হা/৭৩৫২; মুসলিম হা/১৭১৬

[2]. ছহীহুল জামে‘ হা/৫৪৪৩।

[3]. আবূদাঊদ হা/৩৬৮১; ইবনু মাজাহ হা/৩৩৯৩; ইরওয়া, হা/২৩৭৫।

[4]. আবূদাঊদ হা/২০৮৩; তিরমিযী হা/১১০২; ইরওয়া হা/১৮৪০

[5]. আবূদাঊদ হা/৩৪৬২; ছহীহাহ হা/১১।

[6]. এখানে মাযহাবের ইমামের হুকুমের ভূমিকা থাকছে কি?

[7]. তুলনামূলক ফিক্বহশাস্ত্রকে আরবীতে ‘আল-ফিকহুল মুকারিন’ বা ‘আল-ফিকহুল মুকারান’ বলা হয়। এই ফিক্বহশাস্ত্রে বিভিন্ন মাসআলায় ইমামদের মতামত ও দলীলাদি তুলে ধরে তুলনামূলক বিশ্লেষণের মাধ্যমে সঠিক-বেঠিক তুলে ধরা হয়ে থাকে। আল্লাহই সর্বজ্ঞ।

[8]. বুখারী হা/৩০৪৭; মিশকাত হা/৩৪৬১; ইরওয়া হা/২২০৯

[9]. তিরমিযী হা/১৪১৩; ছহীহুল জামে‘ হা/৩৩৯৭।

[10]. হাকেম হা/৩১৯; ছহীহুল জামে‘ হা/২৯৩৭।

[11]. মুসলিম হা/১১৪৪; মিশকাত হা/২০৫২; ছহীহুল জামে‘ হা/৭২৫৪।

[12]. ছহীহাহ হা/৯১।





ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
নেতৃত্বের মোহ - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
তাহাজ্জুদের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ কতিপয় আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
যাকাত ও ছাদাক্বা - আত-তাহরীক ডেস্ক
জুম‘আর কতিপয় বিধান - মুহাম্মাদ আকমাল হুসাইন
আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আত পরিচিতি (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
হাদীছ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পরিক্রমা (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
ইসলামে ভ্রাতৃত্ব (৪র্থ কিস্তি) - ড. এ এস এম আযীযুল্লাহ
যেসব ক্ষেত্রে গীবত করা জায়েয - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
মহামনীষীদের পিছনে মায়েদের ভূমিকা - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
আল্লাহর হক - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আরও
আরও
.