পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব 

৯. মানুষের লক্ষ্য হবে দ্বীনের খেদমত এবং সর্বাবস্থায় সৃষ্টির কল্যাণ সাধন করা :

عَنْ أَبِى هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ تَعِسَ عَبْدُ الدِّينَارِ وَعَبْدُ الدِّرْهَمِ وَعَبْدُ الْخَمِيصَةِ، إِنْ أُعْطِىَ رَضِىَ، وَإِنْ لَمْ يُعْطَ سَخِطَ، تَعِسَ وَانْتَكَسَ، وَإِذَا شِيكَ فَلاَ انْتَقَشَ، طُوبَى لِعَبْدٍ آخِذٍ بِعِنَانِ فَرَسِهِ فِى سَبِيلِ اللهِ، أَشْعَثَ رَأْسُهُ مُغْبَرَّةٍ قَدَمَاهُ، إِنْ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ كَانَ فِى الْحِرَاسَةِ، وَإِنْ كَانَ فِى السَّاقَةِ كَانَ فِى السَّاقَةِ، إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ، وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ-

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘দীনারের দাস ধ্বংস হোক, দিরহামের দাস ধ্বংস হোক, রেশমী বস্ত্রের দাস ধ্বংস হোক। তাকে দেওয়া হ’লে সে খুশী হয়। আর না দেওয়া হ’লে নাখোশ হয়। সে ধ্বংস হোক, ক্ষতিগ্রস্ত হোক, তার পায়ে কাঁটা ফুটলে তা বের করা না যাক। সুখময় হোক সেই মানুষের জীবন, যে তার ঘোড়ার লাগাম ধরে আল্লাহর পথে সংগ্রাম ও যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তার মাথার চুলগুলো হয়ে যায় আলু থালু, আর পা দু’টো হয়ে যায় ধূলিমাখা। যদি সে নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকে তো সেই দলেই থাকে, আবার পশ্চাৎবাহিনীতে থাকে তো পশ্চাৎবাহিনীতেই থাকে। (সে এতটাই অখ্যাত যে) সে কোন কিছুর অনুমতি চাইলে তাকে অনুমতি দেওয়া হয় না এবং কোন সুপারিশ করলে তার সুপারিশ গৃহীত হয় না’।[1]

ইবনু হাজার বলেছেন, ‘যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে প্রয়োজন বেশী দেখা দেয় তাহ’লে সে সেখানে কাজ করে। আর যদি পশ্চাৎ বাহিনীতে প্রয়োজন বেশী পড়ে তো সে সেখানে কাজে লেগে যায়’।

ইবনুল জাওযী বলেছেন, إِنْ كَانَ فِي الْحِرَاسَةِ কথাটির অর্থ সে অখ্যাত-অজ্ঞাত মানুষ। কোন সময় সে বড় বা উঁচু পদ চায় না। সুতরাং তাকে সফর করতে বলা হলে, সফর করে। অর্থাৎ যখন যে কাজের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সে সে কাজ করতে শুরু করে। অতএব যেন সে বলে, যদি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকা প্রয়োজন হয়, তো আমি নিরাপত্তারক্ষী দলে থাকব। আর যদি পশ্চাৎবাহিনীতে থাকার প্রয়োজন হয়, তো আমি সেখানেই অবস্থান করব। রাসূল (ছাঃ)-এর বাণী, إِنِ اسْتَأْذَنَ لَمْ يُؤْذَنْ لَهُ وَإِنْ شَفَعَ لَمْ يُشَفَّعْ ‘এ কথার মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতাপ্রীতি, খ্যাতি লাভের মানসিকতা পরিত্যাগ করা এবং অখ্যাতি ও বিনয়-নম্র জীবনের মাহাত্ম্য ফুটে উঠেছে’।[2]

১০. রাষ্ট্রীয় দায়িত্বের গুরুত্ব অনুধাবন করতে চেষ্টা করা :

عَنِ ابْنِ عُمَرَ أَنَّ النَّبِىَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ لاَ يَسْتَرْعِى اللهُ عَبْداً رَعِيَّةً قَلَّتْ أَوْ كَثُرَتْ إِلاَّ سَأَلَهُ اللهُ عَنْهَا يَوْمَ الْقِيَامَةِ أَقَامَ فِيهِمْ أَمْرَ اللهِ أَمْ أَضَاعَهُ حَتَّى يَسْأَلَهُ عَنْ أَهْلِ بَيْتِهِ خَاصَّةً-

ইবনু ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, নবী করীম (ছাঃ) বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা কোন বান্দাকে কোন জাতির- চাই তাদের সংখ্যা কম হোক কিংবা বেশী হোক শাসক বানালে ক্বিয়ামতের দিন তিনি অবশ্যই তাকে তাদের সম্পর্কে একথা জিজ্ঞেস করবেন যে, সে কি তাদের মধ্যে আল্লাহর বিধান বাস্তবায়ন করেছিল, না করেনি? এমনিভাবে শেষ পর্যন্ত তিনি তাকে বিশেষভাবে তার বাড়ীর লোকদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করবেন’।[3]

আওফ ইবনু মালিক (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, একদা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) (ছাহাবীদেরকে লক্ষ্য করে) বলেন, إن شئتم أنبأتكم عن الإمارة وما هي؟ أولها ملامة وثانيها ندامة وثالثها عذاب يوم القيامة إلا من عدل ‘তোমরা চাইলে আমি তোমাদেরকে রাষ্ট্রনায়কের প্রদত্ত দায়িত্ব ও তার অবস্থা বর্ণনা করতে পারি। এ পদের প্রথমে রয়েছে তিরষ্কার। দ্বিতীয় পর্যায়ে রয়েছে অনুশোচনা এবং তৃতীয় পর্যায়ে রয়েছে ক্বিয়ামত দিবসের মহাশাস্তি। তবে যে ইনছাফ বা ন্যায়নীতি অবলম্বন করবে সে এসব থেকে রেহাই পাবে’।[4]

আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَيَتَمَنَّيَنَّ أَقْوَامٌ وُلُّوْا هَذَا الأَمْرَ أَنَّهُمْ خَرُّوْا مِنَ الثُّرَيَّا وَأَنَّهُمْ لَمْ يَلُوْا شَيْئاً ‘শাসকের দায়িত্ব পালনকারী বহু মানুষ (ক্বিয়ামত দিবসে) এই কামনা করবে যে, শাসকের কিছুমাত্র দায়িত্ব পালন না করার জন্য যদি তাদের সপ্তর্ষিমন্ডল থেকেও নীচে ফেলে দেওয়া হয়। তাহ’লে সেটাও তাদের জন্য অনেক ভাল’।[5]

১১. ব্যক্তির নিজের মর্যাদা জানা :

ক্ষমতালিপ্সু ব্যক্তি যদি নিজের মর্যাদা বা যোগ্যতা যাচাই করতে পারে, তাহ’লে সে বুঝতে পারবে যে, এই কাজের ভার বহনের ক্ষমতা তার আছে কি-না? যদি সে বুঝতে পারে যে, সে এ দায়িত্ব পালনের যোগ্য নয়, তাহ’লে সে অগ্রসর হবে না।

عَنْ أَبِى ذَرٍّ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ يَا أَبَا ذَرٍّ إِنِّى أَرَاكَ ضَعِيفًا وَإِنِّى أُحِبُّ لَكَ مَا أُحِبُّ لِنَفْسِى لاَ تَأَمَّرَنَّ عَلَى اثْنَيْنِ وَلاَ تَوَلَّيَنَّ مَالَ يَتِيْمٍ-

আবু যার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, ‘হে আবু যার! আমার দৃষ্টিতে তুমি একজন দুর্বল মানুষ। আর আমি তোমার জন্য ভালবাসি, যা নিজের জন্য ভালবাসি। সুতরাং তুমি কখনই দু’জন লোকেরও নেতা বা শাসক হয়ো না এবং কখনই ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধায়ক হয়ো না’।[6]

ইমাম কুরতুবী (রহঃ) বলেছেন, এখানে দুর্বল অর্থ আমীরের উপর জনগণের জাগতিক ও দ্বীনী কল্যাণমূলক যে যে দায়িত্ব রয়েছে তা পালন সম্পর্কিত দুর্বলতা। তাঁর এ দুর্বলতার কারণ দুনিয়ার প্রতি তাঁর অনাসক্তি এবং ইবাদত-বন্দেগীতে অধিক মনোনিবেশ। এ ধরনের লোক জনকল্যাণ ও দুনিয়ার সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণে মনোযোগী হ’তে পারে না। অথচ এই দু’টি জিনিসের রক্ষণাবেক্ষণের উপর দ্বীন ইসলামের কার্যকারিতা (বহুলাংশে) নির্ভর করে। নবী করীম (ছাঃ) যখন তাঁর এ অবস্থা জানলেন তখন তাঁকে নছীহত করলেন এবং নিষেধ করলেন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন ও ইয়াতীমের মালের তত্ত্বাবধান করতে।[7]

১২. শাসক নিজে আল্লাহর অধিক প্রশংসা ও গুণগান করবেন এবং অন্যদেরও তা করতে আদেশ দিবেন :

ইবনু রজব বলেছেন, রাসূলগণের খলীফাগণ এবং তাঁদের অধীনস্থ ন্যায়পরায়ণ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারকমন্ডলী কখনই নিজেদের সম্মান-ইয্যত করার দাবী করতেন না। বরং মানুষ যাতে এক আল্লাহর তা‘যীম করে; একমাত্র তাঁরই ইবাদত-বন্দেগী করে সে দাবীই জানাতেন। বরং অনেকে তো কেবলমাত্র আল্লাহর দিকে আহবান জানাতে সহযোগিতা লাভের মানসে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করতেন।

কোন কোন ন্যায়পরায়ণ লোক বিচারকের পদ গ্রহণ করতেন এবং বলতেন, আমি কেন বিচারকের পদ গ্রহণ করব না? আমি তো এ পদের দ্বারা সৎকাজের আদেশ এবং অসৎ কাজের নিষেধে সাহায্য করতে পারি।

এ কারণে রাসূলগণ ও তাঁদের অনুসারীরা আল্লাহর রাস্তায় মানুষকে আহবান জানাতে সকল প্রকার কষ্টে ধৈর্যধারণ করতেন। তাঁরা আল্লাহর বিধানাবলী বাস্তবায়ন করতে গিয়ে মানুষের দেওয়া সীমাহীন কষ্ট বরদাশত করতেন এবং তারা ধৈর্যধারণ করতেন। বরং তাতে তাঁরা খুশীই হ’তেন। প্রেমিক তো প্রেমাস্পদের সন্তোষ লাভ করতে গিয়ে যে কষ্ট পায় তাতে সে মজাই উপভোগ করে। যেমনটা ওমর ইবনু আব্দুল আযীয তাঁর খিলাফতকালে আল্লাহর অধিকার ও ইনছাফ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হন তখন তাঁর পুত্র আব্দুল মালিক তাঁকে বলেন, ‘আববু, আমার মন চাই যে, আল্লাহর ভালবাসায় আমি ও আপনি ডেগচিতে সিদ্ধ হই’। [অর্থাৎ আল্লাহর জন্য আগুনে পোড়ার মত কষ্টও সহ্য করি। আল্লাহর বিধান বাস্তবায়নে নানাবিধ বাঁধার মুকাবিলা করতে গিয়ে তিনি এমনটা বলেছিলেন]।[8]

১৩. নিজের পদ ও সুনাম-সুখ্যাতিকে মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করা :

আর সেটা মুখাপেক্ষী মানুষদের জন্য সুপারিশ এবং তাদের প্রয়োজন পূরণের চেষ্টার মাধ্যমে। ইবনু আবু ইয়া‘লা বলেন, আবু মুযাহিম মূসা ইবনু ওবায়দুল্লাহ ইবনে ইয়াহইয়া ইবনে খাক্বান বলেছেন যে, আমাকে আমার পিতা তার পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি হাসান ইবনু সাহলের নিকট উপস্থিত ছিলাম। এ সময় এক ব্যক্তি এসে তার একটি প্রয়োজন পূরণার্থে হাসানকে সুপারিশ করতে বলল। হাসান তার প্রয়োজন পূরণ করলেন। লোকটি তখন তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেল। তখন হাসান ইবনু সাহল তাকে বললেন, কি জন্য তুমি আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছ? আমরা তো মনে করি পদ-পদবীর যাকাত রয়েছে। যেমন করে অর্থ-কড়ির যাকাত রয়েছে। তারপর তিনি আবৃত্তি করলেন,

فرضت علي زكاة ما ملكت يدي * وزكاة جاهي أن أعين وأشفعا

فإذا ملكت فجد فإن لم تستطع * فاجهد بوسعك كله أن تنفعا

‘আমার সম্পদে আমার উপর যাকাত ফরয করা হয়েছে। অন্যদিকে আমার পদের যাকাত হ’ল অন্যের সহযোগিতা ও সুপারিশ করা। সুতরাং তুমি যখন রাজা-বাদশাহ হবে তখন দান করবে। তা না পারলে তোমার সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বতোভাবে অন্যের উপকার করতে চেষ্টা করবে’।[9]

১৪. আল্লাহ বান্দার অন্তরে পদের প্রতি যে ভালবাসা সৃষ্টি করেছেন তা সঠিক ক্ষেত্রে ব্যয় করা :

আল্লামা ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) বলেছেন, পদের ক্ষমতা কাজে লাগানোর যথার্থ স্থান রয়েছে। তা হচ্ছে আল্লাহর বিধি-বিধান ব্যস্তবায়নে কাজ করা, দ্বীন প্রতিষ্ঠা করা, অত্যাচারিত ব্যক্তির সহযোগিতা, দুর্বলদের সাহায্য করা, আল্লাহর শত্রুদের উৎখাত করা ইত্যাদি। এরূপ হ’লে রাষ্ট্রক্ষমতা ও পদ প্রীতি ইবাদত বলে গণ্য হবে।[10]

১৫. পূর্বসূরি নেককারদের জীবনী অধ্যয়ন ও শিক্ষা গ্রহণ :

আমের ইবনু সা‘দ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, সা‘দ ইবনু আবী ওয়াক্কাছ (রাঃ) তাঁর উটের পাল চরাচ্ছিলেন। এমন সময় তাঁর ছেলে ওমর তাঁর কাছে আসল। তাকে দেখে সা‘দ বলে উঠলেন, এই আরোহীর অনিষ্টতা থেকে আমি আল্লাহর আশ্রয় চাচ্ছি। সে বাহন থেকে নেমে বলল, আপনি ছাগল, উট নিয়ে পড়ে আছেন। আর জনগণকে ছেড়ে দিয়েছেন, যারা রাষ্ট্র নিয়ে ঝগড়া করছে? সা‘দ (রাঃ) তার বুকে তখন করাঘাত করে বললেন, চুপ কর। আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলতে শুনেছি,إِنَّ اللهَ يُحِبُّ الْعَبْدَ التَّقِىَّ الْغَنِىَّ الْخَفِىَّ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা সেই বান্দাকে ভালবাসেন, যে পরহেযগার, ধনী এবং নির্ঝন্ঝাট জীবন যাপন করে’।[11]

ইমাম নববী (এ হাদীছের ব্যাখ্যায়) বলেছেন, এখানে ঐশ্বর্য বলতে মনের ঐশ্বর্যকে বুঝানো হয়েছে। এই ঐশ্বর্যই কাম্য। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, وَلَكِنَّ الْغِنَى غِنَى النَّفْسِ অর্থাৎ ‘মনের প্রাচুর্যই আসল প্রাচুর্য’।[12] আর الخفي শব্দের অর্থ অপরিচিত, অজ্ঞাত মানুষ যে সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল আল্লাহর ইবাদতে এবং নিজের ব্যক্তিগত কাজকর্মে মশগূল থাকে।[13]

কখনও কেউ বড় কোন কল্যাণার্থে নিজে পদত্যাগ করেন এবং অন্যকে পদ লাভের সুযোগ করে দেন। যেমন হাসান ইবনু আলী (রাঃ) খিলাফতের দাবী মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর অনুকূলে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এক ভবিষ্যদ্বাণীতে নবী করীম (ছাঃ) এজন্য তার প্রশংসা করে গিয়েছেন।

عَنْ أَبِيْ بَكْرَةَ قَال رَأَيْتُ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم عَلَى الْمِنْبَرِ وَالْحَسَنُ بْنُ عَلِىٍّ إِلَى جَنْبِهِ، وَهْوَ يُقْبِلُ عَلَى النَّاسِ مَرَّةً وَعَلَيْهِ أُخْرَى وَيَقُولُ إِنَّ ابْنِى هَذَا سَيِّدٌ، وَلَعَلَّ اللهَ أَنْ يُصْلِحَ بِهِ بَيْنَ فِئَتَيْنِ عَظِيمَتَيْنِ مِنَ الْمُسْلِمِينَ-

আবু বাকরা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মিম্বরের উপর দেখেছি। এমতাবস্থায় হাসান ইবনু আলী তার পাশে ছিলেন। একবার তিনি জনতার দিকে তাকাচ্ছিলেন, আরেকবার তার দিকে। এমতাবস্থায় তিনি বলেছিলেন, নিশ্চয়ই আমার এই পুত্র একজন নেতা। সম্ভবতঃ আল্লাহ তার মাধ্যমে মুসলমানদের দু’টি বড় দলের মধ্যে সমঝোতা করে দিবেন’।[14]

আব্দুর রহমান মুবারকপুরী (রহঃ) বলেছেন, এটি নবী করীম (ছাঃ)-এর একটি বড় মু‘জিযা। তিনি যেমনটা বলে গিয়েছিলেন, তেমনই ঘটেছিল।[15]

পূর্বসুরি নেককারদের কেউ কেউ তার থেকে উপযুক্ত কাউকে দেখলে নিজেকে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া থেকে বহু বহু দূরে রাখতেন। যেমন আবুবকর (রাঃ)-এর খলীফা হওয়া এবং ছাহাবীদের তাঁর হাতে বায়‘আত হওয়ার ঘটনার মধ্যে এর বড় প্রমাণ রয়েছে।

ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আবুবকর (রাঃ) ভাষণ দিলেন। তখন তিনি বললেন, আমি তোমাদের জন্য খলীফা হিসাবে এই দু’জনকে পসন্দ করছি। তোমরা তাদের যাকে পসন্দ কর তার হাতে বায়‘আত কর। তিনি আমার ও আবু ওবায়দা ইবনুল জাররাহ-এর হাত ধরলেন। এর আগে তিনি আমাদের (দু’জনের) মাঝে বসা ছিলেন। তিনি যদি এ কথা বাদে অন্য কিছু বলতেন তাহ’লে হয়ত আমার তা অপসন্দ হ’ত না। আল্লাহর কসম! যে জাতির মধ্যে আবুবকর রয়েছেন সেই জাতির আমীর বা রাষ্ট্রপ্রধান আমাকে নির্বাচন করার তুলনায় যদি আমার গর্দানও কাটা যায় আর তাতে আমার কোন পাপ না হয়, তবে সেটাই আমার নিকট সবচেয়ে ভাল লাগত।[16]

এমনই আরেকটি ঘটনা- ওমর ইবনু আব্দুল আযীয (রহঃ) যখন খলীফার আসনে আসীন হ’লেন, তখন পুলিশ প্রধান ভূতপূর্ব খলীফাদের যেভাবে বর্শা হাতে কর্ডন করে মসজিদে নিয়ে যেতেন নিয়মমাফিক তাকেও সেভাবে নিতে এলেন। ওমর (রহঃ) তাকে দেখে বললেন, আমাকে তোমার কী প্রয়োজন? তুমি আমার নিকট থেকে সরে যাও। আমি তো একজন সাধারণ মুসলিম বৈ কিছুই নই। তারপর তিনি যাত্রা শুরু করলেন। তারাও তাঁর সাথে সাথে চলল। অবশেষে মসজিদে ঢুকে তিনি মিম্বরে দাঁড়ালেন। লোকেরা তাঁর পাশে জমা হ’লে তিনি বললেন, হে লোক সকল! খিলাফতের এ গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে চেপে বসেছে। অথচ এ ব্যাপারে আমার কোন মতামত নেয়া হয়নি। আমার পক্ষ থেকে কোন দাবীও তোলা হয়নি। আবার মুসলমানদের সাথেও কোন পরামর্শ করা হয়নি। আমি আমার প্রতি তোমাদের বায়‘আতের যে বাধ্যবাধকতা আছে তা প্রত্যাহার করে নিচ্ছি। সুতরাং তোমাদের ইচ্ছামত একজনকে তোমরা তোমাদের নিজেদের ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করে নাও। সমবেত মুসলমানরা তখন চিৎকার করে এক বাক্যে বলল, আমরা আপনাকেই আমাদের জন্য ও দেশ পরিচালনার জন্য নির্ধারণ করলাম। আমরা সবাই আপনার প্রতি রাযী-খুশী। তখন তিনি উঠে দাঁড়ালেন এবং তাদের সামনে ভাষণ দিলেন।[17]

একবার খলীফা ওমর ইবনু আব্দুল আযীযের স্ত্রী ফাতিমা তাঁর সাথে দেখা করেন। তিনি তখন তাঁর ছালাতের পাটিতে গালে হাত দিয়ে বসা ছিলেন। তাঁর দু’গাল বেয়ে চোখের পানি ঝরে পড়ছিল। তাঁর স্ত্রী তাঁকে বললেন, আমীরুল মুমিনীন, কোন কারণ বশত কি এরূপ করছেন? তিনি বললেন, হে ফাতিমা! মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর উম্মাতের শাসনের গুরুদায়িত্ব আমার কাঁধে নিয়েছি। আমি ভাবছি দেশের আনাচে-কানাচে সর্বত্র কত ক্ষুধার্ত, অভাবী, মুমূর্ষু রোগী, কষ্ট-ক্লেশভোগী বস্ত্রহীন, লাঞ্ছিত, অত্যাচারিত, পরদেশী বন্দী, বৃদ্ধ, পোষ্যভারাক্রান্ত ইত্যাদি কত অসহায় মানুষ যে আছে! আমি জানি যে, আমার প্রভু অচিরেই আমাকে তাদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন। আর তাদের পক্ষে আমার বিরুদ্ধে বাদী হবেন স্বয়ং নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)। আমার ভয় হচ্ছে- তাঁর এই মামলার সময় আমার পক্ষ থেকে জবাব দেওয়ার মত কোনই দলীল-প্রমাণ আমার থাকবে না। তাই আমার নিজের উপর করুণা করে আমি কাঁদছি।[18]

১৬. দো‘আ :

عَنْ مَعْقَلِ بْنِ يَسَارٍ قال: انْطَلَقْتُ مَعَ أَبِيْ بَكْرٍ الصِّدِّيقِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ إِلَى النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ. فَقَالَ: يَا أَبَا بَكْرٍ! لَلشِّرْكُ فِيكُمْ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ. فَقَالَ أَبُو بَكْرٍ: وَهَلِ الشِّرْكُ إِلَّا مَنْ جَعَلَ مَعَ اللهِ إِلَهًا آخَرَ؟ فَقَالَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ، لَلشِّرْكُ أَخْفَى مِنْ دَبِيبِ النَّمْلِ، أَلَا أَدُلُّكَ عَلَى شَيْءٍ إِذَا قُلْتَهُ ذَهَبَ عَنْكَ قَلِيلُهُ وَكَثِيرُهُ؟  

হযরত মা‘কাল ইবনু ইয়াসার (রাঃ) হ’তে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর সাথে নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট গেলাম। তিনি বললেন, হে আবুবকর! পিঁপড়ার গতির ক্ষীণ শব্দ থেকেও অতি সংগোপনে শিরক তোমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে। আবুবকর (রাঃ) বললেন, শিরক তো কেবল তারাই করে যারা আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে মা‘বূদ বা প্রভু গণ্য করে। নবী করীম (ছাঃ) তখন বললেন, যার হাতে আমার জীবন তার শপথ! পিঁপড়ার ক্ষীণ শব্দ থেকেও অতি সংগোপনে শিরক তোমাদের মাঝে লুকিয়ে থাকতে পারে। আমি কি তোমাকে এমন কিছু বাতলে দেব, যাতে তোমার কাছ থেকে তার কম-বেশী সবই দূর হয়ে যাবে? তারপর তিনি বললেন, তুমি বলবে اللَّهُمَّ إِنِّيْ أَعُوْذُ بِكَ أَنْ أُشْرِكَ بِكَ وَأَنَا أَعْلَمُ، وَأَسْتَغْفِرُكَ لِمَا لَا أَعْلَمُ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি আমার জ্ঞাতসারে তোমার সঙ্গে শিরক করা থেকে এবং তোমার নিকট ক্ষমা চাচ্ছি আমার অজ্ঞাতসারে শিরক করা থেকে’।[19]

কথা এ পর্যন্তই। আর আল্লাহর নিকট আমাদের প্রার্থনা, তিনি যেন আমাদেরকে আমাদের জন্য যে কাজটা যথাযথ তা করতে ক্ষমতা দেন। আমাদেরকে যেন তিনি তাদের দলভুক্ত করেন, যারা তাকে মান্য করে এবং তার সন্তোষ লাভের আশায় কাজ করে। সকল প্রশংসা তো আল্লাহরই, যিনি তামাম সৃষ্টির প্রতিপালক।

শেষ কথা :

বড়ই আফসোস! আমরা দেখতে পাচ্ছি, বর্তমানে বহু লোক রাষ্ট্রক্ষমতা, উঁচু পদ ও মর্যাদা লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-লড়াইয়ে লিপ্ত। তাদের এখন একটাই চিন্তা দাঁড়িয়েছে কী করে তারা প্রেসিডেন্ট, রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ইত্যাদি শীর্ষপদ অধিকার করবে। এসব লাভ করতে তারা এমন সব হীন কৌশল অবলম্বন করছে যাতে মুসলমানদের মাঝে বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা ও অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে।

রাষ্ট্রক্ষমতা প্রীতির এহেন ব্যাধি ছড়িয়ে পড়ায় নিঃসন্দেহে জাতির শক্তি ক্ষয় হচ্ছে। বিরোধের সীমা বেড়ে চলেছে। ব্যক্তিগত কল্যাণ ও সুযোগ-সুবিধার চেষ্টা করা হচ্ছে। দ্বীন প্রতিষ্ঠার কাজ গৌণ হয়ে পড়ছে। যার ফলে আজ ব্যক্তি, সমাজ ও মুসলিম উম্মাহ বড়ই দুর্ভোগ ও মহাক্ষতির শিকার হয়ে পড়েছে।

এহেন পতনদশা থেকে মুক্তি পেতে চাইলে আমাদেরকে সত্যিকার অর্থে আল্লাহ তা‘আলার গ্রন্থ আল-কুরআন, তাঁর নবীর সুন্নাত এবং প্রথম যুগের নেককার মানুষদের জীবনধারায় ফিরে যেতে হবে।

আল্লাহ তা‘আলার নিকট আমরা সত্যপথ ও সঠিক কর্মপন্থার জন্য প্রার্থনা জানাই। আল্লাহ যেন রহমত ও শান্তি বর্ষণ করেন আমাদের নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ), তাঁর পরিবারবর্গ ও তাঁর ছাহাবীদের সকলের উপর।


[1]. বুখারী হা/২৮৮৭।

[2]. ফাৎহুল বারী  ৬/৮২-৮৩, হা/২৮৮৬-এর আলোচনা।

[3]. আহমাদ হা/৪৬২৩। শু‘আইব আরনাঊত হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।

[4]. ত্বাবারাণী হা/৬৭৪৭। আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন। দ্রঃ ছহীহুল জামে‘ হা/১৪২০; ছহীহাহ হা/১৫৬২।

[5]. আহমাদ হা/১০৩৫৯। আলবানী হাদীছটিকে হাসান বলেছেন। দ্রঃ ছহীহ তারগীব হা/২১৮০; ছহীহাহ হা/২৬২০।

[6]. মুসলিম হা/১৮২৬।

[7]. সুনানুন নাসাঈ (সুয়ূত্বীর টীকা সহ) ৬/২৫৫।

[8]. শারহু হাদীছে মা যি’বানে জায়ে‘আনে, পৃঃ ৪৫-৪৬।

[9]. ওফায়াতুল আ‘য়ান ২/১২০।

[10]. আত-তিবইয়ান ফী আকসামিল কুরআন, পৃঃ ২৫৯।

[11]. মুসলিম হা/২৯৬৫।

[12]. বুখারী হা/৬৪৪৬; মুসলিম হা/১০৫১; মিশকাত হা/৫১৭০।

[13]. নববী, শরহে মুসলিম হা/২৯৬৫-এর ব্যাখ্যা, ১৮/১০০।

[14]. বুখারী হা/২৭০৪।

[15]. তুহফাতুল আহওয়াযী ১০/১৮৯।

[16]. বুখারী হা/৬৮৩০।

[17]. আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৩৮।

[18]. যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৫/১৩১।

[19]. ইমাম বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৭১৬। আলবানী হাদীছটিকে ছহীহ বলেছেন।






আশূরায়ে মুহাররম - আত-তাহরীক ডেস্ক
শরী‘আতের আলোকে জামা‘আতবদ্ধ প্রচেষ্টা (শেষ কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ : একটি পর্যালোচনা - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
আল্লাহর হক - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
ভুল সংশোধনে নববী পদ্ধতি (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, শিশুর পাঠদান পদ্ধতি ও শিখনফল নির্ণয় - মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক
ঈদে মীলাদুন্নবী - আত-তাহরীক ডেস্ক
বাংলা বানান রীতি ও আমাদের প্রস্তাবনা - প্রফেসর ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব
পিতা-মাতার উপর সন্তানের অধিকার - মুহাম্মাদ শফীকুল ইসলাম
ছিয়ামের ফাযায়েল ও মাসায়েল - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল-কুরআনের আলোকে ক্বিয়ামত (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তান (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
আরও
আরও
.