যুগশ্রেষ্ঠ মুহাক্কিক আল্লামা নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) স্বীয় গবেষণাকর্মের মূল বিদ্যাপীঠ দামিশকের ‘মাকতাবাতুয যাহিরিয়া’য় সংরক্ষিত ‘ইলমে হাদীছ সংক্রান্ত গ্রন্থ ও পাণ্ডুলিপি সম্পর্কে পরবর্তীদের জ্ঞাতার্থে বহুদিনের পরিশ্রমে একটি সূচী তৈরী করেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এটি فهرس مخطوطات دار الكتب الظاهرية المنتخب من مخطوطات الحديث নামে প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য যে, সূচীপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর বিশেষ কোন দক্ষতা ছিল না। এছাড়া হাদীছ শাস্ত্রে নিরন্তর গবেষণায় লিপ্ত থাকায় এক্ষেত্রে কিছু করার মত পর্যাপ্ত সময়ও তাঁর ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কাউকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে তার জন্য কারণ সৃষ্টি করে দেন। উক্ত সূচীটি রচনার পিছনেও মোড় পরিবর্তনকারী এক অনন্য সাধারণ প্রেক্ষাপট রয়েছে। যা قصة الورقة الضائعة ‘হারানো পৃষ্ঠার কাহিনী’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কাহিনীটি নিম্নরূপ :
১৯৪৮ সালের কথা। গবেষণায় মগ্ন থাকা অবস্থায় তিনি চোখের অসুখে পড়েন। তা এতটা বৃদ্ধি পায় যে, ডাক্তার তাঁকে পড়াশুনা, লেখালেখি এবং ঘড়ি মেরামতের কাজ থেকে বিরত থেকে ছয়মাসের জন্য বিশ্রামে যাওয়ার পরামর্শ দেন। প্রথমদিকে তিনি পরামর্শ মেনে চললেও সপ্তাহ দুই পার হতেই এই বিরক্তিকর অবসরে তিনি কিছু করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেন। এসময় ‘মাকতাবা যাহিরিয়া’য় সংরক্ষিত হাফিয ইবনু আবিদ্দুনিয়া রচিত ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থটির পাণ্ডুলিপির কথা তাঁর স্মরণ হয়। যা তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তাই তিনি এর একটি অনুলিপি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য একজন লেখক ঠিক করেন। একদিকে লেখক নিয়মিতভাবে তা লিখতে থাকেন। অন্যদিকে আলবানী তা মূলকপির সাথে মিলাতে থাকেন এবং এর হাদীছসমূহ তাহকীক ও তাখরীজ করতে শুরু করেন। কিন্তু বইটির মাঝামাঝিতে পৌঁছে লেখক তাঁকে জানান যে এর মধ্যে ৪র্থ পৃষ্ঠাটি হারিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আলবানী যেকোন মূল্যে উক্ত পাতাটি খুঁজে বের করার মনস্থ করেন।
মূল রিসালাটি আরো কয়েকটি বইয়ের সাথে বাঁধাই করা ছিল। এরূপ কয়েকটি রিসালাসহ বাধাইকৃত বহু বড় বড় পাণ্ডুলিপি ‘মাজামী‘ শিরোনামে লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল। তাই তিনি হারানো পৃষ্ঠাটি অন্য কোন বাধাঁইয়ের মধ্যে ভুলবশত যুক্ত হয়ে গেছে ধারণা করে বিপুল আগ্রহে তা খুঁজতে শুরু করেন। খুঁজতে খুঁজতে আরো অনেক বিরল গ্রন্থ তাঁর নযরে পড়ে। অনেক প্রখ্যাত মুহাদ্দিছ ও হাফিযগণের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপিসমূহ পাঠ করার সুযোগ পান। এভাবে পড়তে পড়তে তিনি ১৫২টি পাণ্ডুলিপি সংকলন পড়ে ফেলেন। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় বহু বইয়ের নামও তিনি লিখে নেন। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরেও তিনি হারানো পৃষ্ঠাটি উদ্ধার করতে পারেননি।
এবার তাঁর মনে হলো যে, সম্ভবত পৃষ্ঠাটি হাদীছ সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহের সাথে ভুলবশত বাঁধাই করা হয়েছে। তাই তিনি এবার সেগুলোর মধ্যে খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু না, সেখানেও পেলেন না। তাই তিনি এবার ‘মাকতাবা যাহিরিয়া’য় সংরক্ষিত সমস্ত পাণ্ডুলিপি খুঁজে দেখার সংকল্প করেন। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত প্রায় ১০ হাযার পাণ্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও পৃষ্ঠাটি খুঁজে পেলেন না। তবে এবারও তিনি প্রয়োজনীয় বইসমূহের নাম লিখে রাখেন। এরপর তিনি লাইব্রেরীতে স্তুপ করে রাখা বিভিন্ন বইয়ের হাযারো ছিন্ন পত্রের মাঝে অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে তিনি নিরাশ হয়ে যান।
না পাওয়ার বেদনার মধ্য দিয়েও আলবানী অনুধাবন করতে পারেন যে, আল্লাহ তা‘আলা এই নিরন্তর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তাঁর জন্য জ্ঞানার্জনের এক বৃহৎ দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি খুঁজে পেয়েছেন এমন সব গ্রন্থরাজির অস্তিত্ব, যা মানুষের অজানা ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘মাকতাবা যাহিরিয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন উপকারী ‘ইলম সমৃদ্ধ গ্রন্থ ও পুস্তিকাসমূহের ভাণ্ডার। যার মধ্যে রয়েছে এমন অনেক অপ্রকাশিত ও বিরল পাণ্ডুলিপি, যা বিশ্বের অন্য কোন লাইব্রেরীতে নেই’।[১]
তাই এবার তিনি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। দ্বিতীয়বারের মত লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত সমস্ত পাণ্ডুলিপি অধ্যয়ন শুরু করেন। আগেরবার কিছু নির্বাচিত বইয়ের নাম লিখলেও এবার তিনি ‘ইলমে হাদীছের সাথে সংশ্লিষ্ট যত গ্রন্থ তাঁর উপকারে আসতে পারে, এরূপ প্রচলিত-অপ্রচলিত সকল বইয়ের নাম লিখে নেন। এমনকি কোন বইয়ের একটি পাতা বা অপরিচিত অংশবিশেষ পেলে তাও নোট করেন। এভাবে তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত করতে না করতেই নতুন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এবার হাদীছ সংশ্লিষ্ট সমস্ত গ্রন্থ গভীরভাবে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় তাঁর গবেষণার তৃতীয় ও শেষ পর্যায়। প্রতিটি পাতা মনোযোগ সহকারে অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। স্বীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আলবানী বলেন, ‘এসময় আমার এমনও দিন আসতো, যেদিন আমি লাইব্রেরীর উপরের শেলফে সাজিয়ে রাখা বইসমূহ পাঠ করার জন্য মই নিয়ে এসে তাঁর উপর চড়তে বাধ্য হতাম এবং সেখানে দাড়িয়েই দ্রুততার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা পাঠ করে যেতাম। অতঃপর সেখানে কোন অংশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হ’লে, লাইব্রেরীতে নিযুক্ত কর্মচারীকে তা নামিয়ে টেবিলে রাখার জন্য বলতাম’।
এভাবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তিনি প্রভূত ‘ইলমী ফায়েদা হাছিল করেন। এসময় তিনি যত হাদীছের সন্ধান পান, সবগুলো ধারাবাহিকভাবে পৃথক পৃথক খাতায় লিপিবদ্ধ করেন। এভাবে প্রত্যেক খণ্ডে চারশ’ পাতা করে মোট ৪০ খণ্ডে তাঁর এই কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। যার প্রত্যেক পাতায় একটি করে হাদীছ উল্লেখ করে সকল হাদীছ আরবী অক্ষরের ধারাবাহিকতায় সংকলন করেন। তার সাথে যে সমস্ত গ্রন্থে হাদীছটি পেয়েছেন তার নাম সনদ ও তুরুকসমূহের বিবরণসহ পেশ করেন। আলবানীর বলেন, ‘হাদীছ সংকলনের এই খণ্ডগুলো থেকেই আমি আমার সকল লেখনী ও ‘ইলমী প্রকল্পের রসদ যুগিয়েছিলাম’। এভাবে একটি হারানো পৃষ্ঠা খোঁজার অসীলায় আল্লাহ তা‘আলা ‘ইলমে হাদীছের প্রভুত জ্ঞানের দুয়ার তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে দেন।[২]
তবে উক্ত সংকলনের হাদীছসমূহ জমা করার ক্ষেত্রে তিনি কেবল ‘মাকতাবা যাহিরিয়া’র উপরেই নির্ভর করেননি। বরং বিভিন্ন দেশের মাকতাবাসমূহ থেকেও তা সংগ্রহ করেছেন। যেমন হলবের ‘মাকতাবাতুল আওক্বাফ আল-ইসলামিয়াহ’, মসজিদুন নববীর ‘মাকতাবাতুল মাহমূদিয়াহ’, মদীনায় অবস্থিত ‘মাকতাবা ‘আরিফ হিকমাত’ প্রভৃতি। আলবানীর ভাষায়, ‘এসব মাকতাবায় হাদীছ, ইতিহাস, জীবনী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট এমন সব মূল্যবান গ্রন্থরাজি সংরক্ষিত আছে, যার কোন কিছুই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।[৩]
[১]. আল-আলবানী, ফিহরিসু মাখতূতাতিদ দারিল কুতুবিয যাহিরিইয়াহ (রিয়াদ : মাকতাবুল মা‘আরিফ, ১ম প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.), পৃ. ৮-১২।
[২]. ‘আলী হাসান হালাবী বলেন, জনৈক গবেষক উক্ত হারানো পাতাটি তুরস্কের একটি লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করেন। অতঃপর তা স‘ঊদী ‘আরবের ‘মদীনা মুনাওয়ারা’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উক্ত পৃষ্ঠাটি আলবানী পড়ে শোনানো হলে তিনি খুবই খুশী হন। কারণ এর মাধ্যমে একদিকে তিনি নিশ্চিত হন যে, উক্ত পাতাটি আসলেই ‘মাকতাবা যাহিরিয়া’য় ছিল না। অন্যদিকে পাতাটির মধ্যস্থিত ‘ইলমী ফায়েদা হাসিল করতে সক্ষম হন। দ্র. ছাফহাতুন বায়যাউ মিন হায়াতিল ইমাম মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী, পৃ. ৩৩।
[৩]. আল-আলবানী, য‘ঈফুল জামি‘ আছ-ছাগীর, ১ম খণ্ড (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ৮।