খুলনার পাইকগাছা উপযেলার একটি অজপাড়া গ্রাম। বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি। অন্যান্য গ্রামের মতো আধুনিকতার ছোঁয়াও লাগেনি। সন্ধ্যা নামতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার। দিনের আলোয় গ্রামের পথ ধরে হাঁটলে সবুজের সমারোহ চোখে পড়ে। গ্রামে অনেক পুকুর। দূরে দেখা যায় খাল-বিল। উপযেলা থেকে ২০ কিলোমিটার পুবে সেই গ্রাম। এমনই গ্রামের একটি মাটির ঘরে ঢাকার চার বন্ধু মুরাদ, খোকন, ফযলে রাবিব আর মুহসিন। তিন দিন ধরে অবস্থান করছেন। রীতিমতো বন্দী জীবন তাদের। ঘর থেকে বের হ’তে মানা। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে কেবল রাতের আঁধারে বের হওয়ার অনুমতি রয়েছে। বাড়ির মালিক মুযাফ্ফর। পেশায় কৃষক। তিনি চার বন্ধুকে খাবার দিয়ে যান। একদিন দুপুরের খাবার একেবারে রাতে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু চার বন্ধুর কিছুই করার নেই। তারা অপেক্ষার প্রহর গুণছেন। তারা স্বপ্নে বিভোর। দ্রুত বড় লোক হওয়া চাই। আর বড় লোক হ’তেই স্বেচ্ছায় তাদের এই বন্দীজীবন।
‘আর ভালো লাগছে না। ধুর দোস্ত, দরকার নেই। চল চলে যাই’। কথাগুলো বলছিল মুরাদ। কথা শুনেই প্রতিবাদ করে খোকন। কী বলিস! বারো লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে! এখনো টাকা দিয়েই যাচ্ছি। গাড়ি ভাড়াও প্রতিদিন জমছে। এই সময় এসে ফিরে যাওয়ার কথা বলছিস কেন? ওরাতো বলেছে, পিলার আনবেই। তিন দিন যখন থেকেছি, আরেকটু দেখি। এসব কথা যখন নিজেরা বলাবলি করছিল, ঠিক তখনই মুযাফ্ফর এসে হাযির। হাতে পাউরুটি আর কলা। তাদের হাতে দিয়ে বলে, ‘ভাই আজ ভাত হয়নি। রাইতটা কাটাইয়া দেন রুটি আর কলা দিয়ে’। মেজায বিগড়ে যায় চার বন্ধুর। খোকন বলে, আরে মিয়াঁ, কী বলেন? খাবারের টাকা নিচ্ছেন। দুপুরে টাকা নিলেন রাতের খাবারের জন্য। ভাত হবে না কেন? আরেক বন্ধু বলে, আচ্ছা ভাত দরকার নেই। এখন কাজের কথা বলেন। মুযাফ্ফর এ সময় খাটে বসে ফিস ফিস করে কথা বলতে থাকে। বলে, সব ঠিক আছে। আজ দুপুরেই পিলার আনার কথা ছিল। কিন্তু বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব। তাই পিলারটা আবুল মিয়াঁ ঘর থেকে বের করতে পারেনি। এবার বন্ধুদের একজন বলে, ওই মিয়াঁ কাল বললেন, বেশী রোদ। আজ বলছেন, মেঘলা দিন। কী করতে চান? পারলে আনেন, না পারলে নাই। টাকা ফেরত দিবেন। ১০ লাখ ক্যাশ দিয়েছি। ফেরত দেন চলে যাই। একথা শুনে মুযাফ্ফর একটু ক্ষেপে যায়। বলে, ‘আপনাগো আমার বাড়িতে রাখছি। আমার কোন লাভ নেই। আপনাগো ইচ্ছা, কী করবেন না করবেন। লোকজন জানলে উল্টা আমারেই ধরব। আইছেন পিলার নিতে। চুপচাপ থাকেন। নিজেরা বিপদে পইড়েন না। আমারেও বিপদে ফালাইয়েন না’। এমন কথা শুনে চার বন্ধু চুপসে যায়। ফযলে রাবিব পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলে, আচ্ছা মুযাফ্ফর ভাই! আমরাতো বলছি, সব ঠিকঠাক থাকলে আপনিও কোটিপতি হয়ে যাবেন। আমরা আপনাকে আলাদা ভাবি না। মুযাফ্ফর বলে, আরে আমিতো ভাই সে কথাই বলতে আসছি। ভাত হোটেল থেকে আনতে পারতাম। কিন্তু তাড়াতাড়ি আপনাগো খবরটা দিতে হবে বলেই ছুটে আসছি। কাল সকালে আপনারা পিলার হাতে পাবেন। ভোর বেলা। আপনারা অপেক্ষায় থাকেন। একথা বলে মুযাফ্ফর বিদায় নেয়।
চার বন্ধু এখন খুব খুশি। একজন বলছে, দেখলিতো সব ঠিক আছে। শুধু তোরা চিন্তা করছিস। মুযাফ্ফর লোকটা খারাপ না। আমি যাকে পসন্দ করি, সে কি আর খারাপ হ’তে পারে! যাক। তারা পরিকল্পনা করে পিলার হাতে পেয়েই গাড়ির চালককে ফোন দিবে। দুই কিলোমিটার দূরে একটি বাড়িতে তাদের গাড়ি রাখা আছে। পিলার নিয়েই গাড়িতে তুলে সোজা ঢাকা। এটা বিক্রির সব ব্যবস্থা তারা আগেই করে রেখেছে। এক কোটি দুই কোটি নয়। বিদেশীদের সঙ্গে শত কোটি টাকার চুক্তি। তারা বিক্রি করেই নব্য কোটিপতি হ’তে যাচ্ছে। এমন কথাবার্তাতেই রাত পার হয় তাদের। ভোরে আসে মুযাফ্ফর। এসে জানায়, পিলার আসছে। আমাকে একটু দেইখেন। শুনে হাসে চার বন্ধু। দুই ঘণ্টা পার হয়। আসে না পিলার। চার বন্ধু অস্থির। মুযাফ্ফর ঘর থেকে বেরিয়ে এগিয়ে যায়। আধাঘণ্টা পর ফিরে আসে। মুখ তার ভার। ফযলে রাবিব বলে, পিলার কোথায়? মুযাফ্ফর বলে, পিলার আমি দেখে এসেছি। দু’টা বাড়ির পরেই রাখা হয়েছে, আশপাশের লোকজনের কারণে। কিন্তু সমস্যা একটা হয়েছে। কী সমস্যা-জানতে চায় চার বন্ধু। ওরা ক্যাশ টাকা আগে চায়। নইলে দিবে না বলে জানিয়েছে। চার বন্ধু এ সময় হতাশ। বলে কী? টাকাতো ১০ লাখ দেওয়া হয়েছে। বাকী ১০ লাখ টাকা ঢাকায় গিয়ে...। এমন চুক্তির কথা মনে করিয়ে দেয় মুযাফ্ফরকে। কিন্তু পিলারের মালিক বেঁকে বসেছে। হবে না। ১০ লাখ টাকা এখনই চাই। চার বন্ধু নিজেদের মধ্যে আলাপ করে নেয়। মুযাফ্ফরকে বলে, ঠিক আছে। পিলার নিয়ে আসতে বলেন, টাকা আমরা দিব। মুযাফ্ফরের চোখে-মুখে হাসির ঝলক। সে জানতে চায়, কেমনে দিবেন। সঙ্গে কী টাকা আনছেন? সঠিক করে বলেন। পরে অন্য কোন কথা বললে চলবে না। সব হারাবেন। বন্ধুরা বলেই দেয়, হ্যাঁ এনেছি। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দেখায়। উত্তেজনায় কাঁপছে চার বন্ধু। মুযাফ্ফর ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে। কিছু সময় পর তার সঙ্গে ঘরে আসে আরও পাঁচজন। হাতে তাদের একটি বড় ব্যাগ। তারা এসেই তাড়াহুড়া করছে।
আশপাশে তাকাচ্ছে। টাকা চাচ্ছে। মুযাফ্ফর তাদের বলে, ‘ভাই টাকা দেন। আশপাশে লোকজন দেখলাম। আপনাদের জিনিস লন। টাকার ব্যাগটা দিয়ে দেন’। ফযলে রাবিব টাকার ব্যাগটা তাদের হাতে দিয়ে দেওয়া মাত্র বাইরে হৈচৈ। এই কেরে ঘরে?
মুযাফ্ফরসহ তার সহযোগীরা বলতে থাকে, খাইছেরে, পুলিশ আসছে মনে হয়। একথা বলেই টাকার ব্যাগ নিয়ে চলে যায়। আর তাদের ব্যাগটি ফেলে রেখে যায়। মুযাফ্ফর তাদের নিয়ে বাড়ির পেছন দিয়ে বেরিয়ে পড়ে। ব্যাগ খোলা যাবে না। গাড়িতে নিয়ে ব্যাগ তারা খুলবে সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু তার আগেই গাড়ি চলে আসে। সেই গাড়িতে ব্যাগসহ তুলে দেয় চার বন্ধুকে। মুযাফ্ফর বিদায় নেয়। গাড়ি চলতে থাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে। চার বন্ধু মহা খুশি। তারা ব্যাগ খুলতে চায়। কিছুদূর পথ গিয়ে ব্যাগ খুলে। সেখানে দেখতে পায় সিমেন্টের তৈরী শিলপাটার একটি শিল। তখন বুঝতে পারে চরম প্রতারণার শিকার হয়েছে তারা। ফিরে যাওয়ার পথও নেই। ইতিমধ্যে ফোনে জানতে পেরেছে, যেখানে তারা ছিল পুলিশ সেখানে অভিযান চালিয়েছে। তাদের খুঁজছে পুলিশ।
উল্লেখ্য যে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার সীমানা নির্ধারণী পিলারকে ম্যাগনেটিক পিলার বলে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে এভাবেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে একটি প্রতারক চক্র। বলা হয়ে থাকে, এই পিলারে মহামূল্যবান ইউরেনিয়াম পাওয়া যায়। যার মূল্য কয়েকশ’ কোটি টাকা। হঠাৎ কোটিপতি হওয়ার স্বপ্নে বিভোর মানুষগুলো এ সিন্ডিকেটের প্রতারণার শিকার হয়ে পথে বসছেন। এ নিয়ে খুন-খারাবির মত ঘটনাও ঘটছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, পিলারে কোন ম্যাগনেটিক বা চৌম্বিক শক্তি নেই। জনসাধারণের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার এটি একটি কৌশলমাত্র।
সম্প্রতি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয় খুলনার তেরখাদার দম্পতি খসরু মোল্লা ও তার স্ত্রী নিতু বেগমের মরদেহ। তারা দু’জনই এলাকায় ম্যাগনেট পিলারের প্রতারক চক্রের সদস্য হিসাবে পরিচিত ছিল। ধারণা করা হয়, পিলারের কারণেই এদের হত্যা করা হয়েছে। কুমিল্লায় পিলার আনতে গিয়ে ঢাকার এক ব্যবসায়ীকে হত্যা করা হয়। টাঙ্গাইলের নাগরপুরের সুদামপাড়া গ্রামে সীমানা পিলার আনতে গিয়ে গণপিটুনিতে মারা যান মজনু মিয়া নামে এক ব্যক্তি। খুলনার বটিয়াঘাটায় ৩টি সীমানা চিহ্নিতকরণ পিলারসহ প্রতারক চক্রের ২ সদস্যকে আটক করে র্যাব। বাগেরহাটের ফকিরহাট থেকে একই ধরনের পিলারসহ ৬ জনকে আটক করে র্যাব। এছাড়া আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পিলার প্রতারণা চক্রের অসংখ্য সদস্যকে আটক করেছে।