জনৈক
ব্যক্তি একদিন দূর সফরে বেরিয়েছেন। সাথে আছে তার স্ত্রী ও সন্তানেরা।
পথিমধ্যে তিনি রাস্তার পাশে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। গাড়ি থামিয়ে তাকে
জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কে? দন্ডায়মান ব্যক্তি বলল, আমি ধন-সম্পদ। আমি চাই
তুমি আমাকে তোমাদের সফরসাথী করে নিবে। মুসাফির ব্যক্তি তার স্ত্রী ও
সন্তানদের প্রশ্ন করল, তাকে (ধন সম্পদ) কি আমাদের সফরসঙ্গী করতে পারি? তারা
সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ! অবশ্যই। সম্পদই তো আমাদের চলার পথের প্রধান
অনুষঙ্গ। পর্যাপ্ত পরিমাণ সম্পদ হাতে থাকলে আমরা যা খুশী তাই ক্রয় করতে
পারব, যা ইচ্ছা তার মালিক হ’তে পারব। অতঃপর তিনি সম্পদকে সাথে নিয়ে সামনে
অগ্রসর হ’লেন।
পথিমধ্যে আরেক ব্যক্তির সাথে তাদের সাক্ষাৎ হ’ল। তাকে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে সে বলল, আমি ক্ষমতা ও পদমর্যাদা। তিনি আবার স্ত্রী-সন্তানদের জিজ্ঞেস করলেন, তাকে (ক্ষমতা ও পদমর্যাদা) কি আমাদের সাথে সফরের জন্য আহবান করব? তারা একবাক্যে উত্তর দিল, কেন নয়? ক্ষমতা, পদমর্যাদার মত কাঙ্ক্ষিত সঙ্গী হাত ছাড়া করা কি নিতান্ত বোকামী নয়? অতঃপর তাকে সাথী করে নিয়ে গাড়ী এগিয়ে যেতে থাকল।
পথের বিভিন্ন বাকে বাকে তাদের সাথে আরো অনেকের সাক্ষাৎ হ’ল। যেমন প্রবৃত্তি, লোভ, নানা কামনা-বাসনা, আকাঙ্ক্ষা ইত্যাদি। তারা সবাইকে তাদের সাথী করে নিল।
সফরের এক পর্যায়ে তাদের সাথে সাক্ষাৎ হ’ল আরেকজনের। জিজ্ঞেস করতেই সে বলল, আমি হ’লাম আল্লাহ প্রেরিত একমাত্র দ্বীন তথা ইসলাম। এবার পিতা স্ত্রী-সন্তানদের এ ব্যাপারে কোন প্রশ্ন করলেন না। বরং সবাই সমস্বরে বলে উঠলেন, না না। আমরা এক সুন্দর সফরে বেরিয়েছি। এখানে ধর্মের কোন স্থান নেই। এটা কেবলি ভোগ-বিলাস ও আনন্দ-উল্লাসের সময়। এখানে দ্বীনের আগমন ঘটলে আমাদের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে। দ্বীনের নানাবিধ বিধি-বিধান তথা ছালাত-ছিয়াম, হালাল-হারাম ইত্যাদি দিয়ে আমাদেরকে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত করে তুলবে। এ মনোহরী সফরে যা সাথী করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। দুনিয়াবী সফর শেষে, দুনিয়াবী ভোগ-বিলাসের যাবতীয় উপকরণ ভোগ করার পর আমরা চেষ্টা করব দ্বীনকে সাথী করার।
অতঃপর তারা দ্বীনকে ছেড়ে তাদের সফর পূর্ণ করার পথে যাত্রা করল। কিছু দূর যাওয়ার পর এবার তারা একটি আওয়ায শুনতে পেল। গাড়ী থামিয়ে পিতা আওয়াজের উৎস অনুসন্ধানে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলেন। অতঃপর দেখলেন এক ব্যক্তি তাকে গাড়ী থেকে নামার জন্য ইশারা করছে। তিনি নেমে তার সাথে মিলিত হ’লে আগন্তুক ব্যক্তিটি বললেন, স্ত্রী-সন্তানদের সাথে তোমার সফর এখানেই সমাপ্ত। এখন তোমাকে যেতে হবে আমার সাথে; দূর সফরে। যে সফরের কোন শেষ নেই। নির্বাক, হতবুদ্ধি পিতা কিছুই বলতে পারলেন না। ঐ ব্যক্তি বললেন, তোমার সাথে কি দ্বীন আছে? কারণ আমার সাথে তোমার সফর নির্বিঘ্ন করা দ্বীন ব্যতীত সম্ভব নয়। পিতা বলল, না, তাকে তো এই অল্প দূরের ব্যবধানে ছেড়ে আসলাম। আমাকে একটু সুযোগ দাও! যাতে আমি দ্রুততার সাথে পিছনে ফিরে গিয়ে তা সাথে নিয়ে আসতে পারি। ঐ ব্যক্তি বললেন, না তা সম্ভব নয়। সফরের এই পর্যায়ে এসে পিছনে ফিরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। পিতা বললেন, ধর্ম না থাকলে তাতে কি? গাড়ীতে আমার সাথে নানা প্রকার গুরুত্বপূর্ণ জিনিস যথা অর্থ, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা, স্ত্রী-সন্তান আছে। আরও আছে...। তাকে থামিয়ে দিয়ে আগন্তুক ব্যক্তিটি বললেন, থাম! এই নতুন পথে এসবের কোন কিছুই তোমাকে সহযোগিতা করবে না, শুধুমাত্র দ্বীন ব্যতীত। যা তুমি রাস্তায় ফেলে এসেছ।
হতবুদ্ধি পিতা এবার লোকটিকে বললেন, আপনি কে? তিনি বললেন, আমি ‘মালাকুল মঊত’। এসেছি তোমার জান কবয করতে। তোমার মৃত্যু আসন্ন, যা থেকে তুমি উদাসীন ছিলে। আর সর্বদা আগামীতে সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা এবং প্রস্ত্ততি গ্রহণ করবে বলে রেখে দিয়েছিলে। এদিকে পিতা দেখতে পেলেন, পিছনে তার গাড়ী চলতে শুরু করেছে। স্ত্রী নিজেই গাড়ী চালাচ্ছে, সন্তানেরা পিছনে বসে আছে। তার ব্যাপারে তাদের কোনই ভ্রূক্ষেপ নেই। এভাবেই স্ত্রী-সন্তান ও সহায়-সম্পদ সবই চলে গেল। কিছুই তার সাথী হ’ল না। কপর্দকশূন্য অবস্থায় তাকে চলে যেতে হ’ল চিরস্থায়ী ঠিকানা পরপারের উদ্দেশ্যে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে নবী! তুমি বলে দাও, তোমাদের নিকট যদি তোমাদের পিতা, পুত্র, ভাই, স্ত্রী, স্বগোত্র ও ধন-সম্পদ যা তোমরা অর্জন কর, ব্যবসা যা তোমরা বন্ধ হবার আশংকা কর এবং বাড়ী-ঘর যা তোমরা পসন্দ কর- আল্লাহ, তাঁর রাসূল ও তাঁর রাস্তায় জিহাদ করা হ’তে অধিক প্রিয় হয়, তাহ’লে তোমরা অপেক্ষা কর আল্লাহর নির্দেশ (আযাব) আসা পর্যন্ত। বস্ত্ততঃ আল্লাহ পাপাচারী সম্প্রদায়কে সুপথ প্রদর্শন করেন না’ (তওবা ৯/২৪)।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রত্যেক প্রাণীই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে এবং ক্বিয়ামতের দিন তোমরা পূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। অতঃপর যাকে জাহান্নাম থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, সে ব্যক্তি সফলকাম হবে। বস্ত্ততঃ পার্থিব জীবন প্রতারণার বস্ত্ত ছাড়া কিছুই নয়’ (আলে ইমরান ৩/১৮৫)।
এ পৃথিবীতে অর্জিত সকল সম্পদ, স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, ভাই-বোন সব ছেড়ে যেতে হবে। সাথী হবে কেবল দ্বীন ও সৎ আমল। সেগুলো অর্জনের জন্য সময় থাকতে চেষ্টা করতে হবে। বেলা ফুরিয়ে গেলে আর কোন চেষ্টা-প্রচেষ্টা কাজে আসবে না। তাই সময় থাকতে নেক আমলের জন্য সচেষ্ট হ’তে হবে। আল্লাহ আমাদের তাওফীক দান করুন-আমীন!