একজন পিতা যিনি তার জীবন-যৌবনে অশ্লীলতা পরিহার করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সেই কষ্টকর জীবনে কিভাবে তিনি প্রকৃত সুখ পেয়েছিলেন? আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক বিষয়ে প্রিয় সন্তানের প্রতি পিতার মূল্যবান নছীহত।

প্রিয় সন্তান,

আমি সারাটি জীবন সুখ সুখ করে কেঁদেছি। যৌবনে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার জন্যে বার বার সুখের সন্ধান করেছি। কিন্তু কিছুতেই সুখের নাগাল পাইনি। এই নাগাল না পাওয়াটাই ছিল আমার জন্য সুখকর। কিন্তু কেন জান?

চোখে দেখা সুখের উপাদানগুলো ছিল চাকচিক্যে ভরা। কিন্তু তার গভীরে ছিল ভয়াবহ অাঁধার। সেই চাকচিক্যের ধাঁধায় ছুটতে দেখেছি পাশের অনেককে। ছুটিনি তবু আমি- তুমি এটা জেনে খুশি হবে।

তুমিও দেখবে রঙিন সব সুখ উড়ছে। হয়তো আমার একালে যা দেখিনি, তার চেয়েও চাকচিক্য তুমি দেখতে পাচ্ছ। কিন্তু ওসব মোটেই সুখের উপাদান নয়। মনের ভুলেও হাত দিও না, চোখ তুলে তাকিও না ওদিকে। সাবধান! আমি যেখানেই থাকি না কেন, তুমি সাবধান থাকলে আমি বড্ড বেশী খুশি হব তোমার উপর।

বাবা জানো- মহান আল্লাহ তা‘আলা আমাকে খাওয়া-পরার কষ্ট দেননি, তবে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে নিজের জীবন-যৌবনকে রক্ষার জন্য। এত কষ্ট! মনে হ’ত এর চেয়ে না খেয়ে থাকাই ভালো ছিল। তবুও দিন শেষে আমি শান্তিতে ঘুমাতে পারতাম। কেন জান? আমি রঙিন বেলুনে গা ভসিয়ে দেইনি। আমি জানতাম, এটা রঙিন ফানুস, শেষ হ’তে বেশী সময় নেবে না।

আমি এক অধঃপতিত সমাজে দিন কাটিয়েছিলাম, চারিদিকে ছিল অশ্লীলতার অাঁধার। অনেককে দেখেছি অশ্লীলতা দিয়ে পেট ভরছে। অখাদ্য দিয়ে উদর পূর্ণ করেই তারা সুখ পেত। কিন্তু আবার চোখের সামনে তাদের পতন হ’তে দেখেছি। এও দেখেছি, রঙিন বেলুন ফেটে তারা আছড়ে পড়েছে। ধ্বংসের গ্লানি তাদের দেহ-মনকে অতিষ্ট করে তুলেছে। তবে তুমি যে সমাজে বাস করছ তা আমার সমাজ থেকেও চরম অধঃপতনের সীমায় আটকে যাওয়া এক সমাজ। তাই তোমাকে আরো বেশী সতর্ক হ’তে হবে। তোমাকে সতর্ক করছি হে প্রিয় সন্তান!

লোকে যে সুখ অশ্লীলতার ভিতর খুঁজে, তুমি সেই একই সুখ শালীনতার মধ্যে পাবে। এই একটি কথাই তোমার পিতাকে প্রকৃত সুখ খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিল। পিতার সন্তান হিসাবে তুমিও সে পথটি বেছে নিও। আর তুমি এ পথটি পাবে একমাত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নাহতে।

শোন প্রিয় সন্তান,                                                

আমি চলে যাব। শুধু একটি আকুতি জানাতে চাই, সেটা হচ্ছে- আমার ছবি তুমি দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখ না, তোমার মনের দেয়ালে ঝুলিয়ে রেখ আমার রেখে যাওয়া কথাগুলো। আমি যা লিখেছি তার অনুসরণের মধ্যে তুমি সুখ খুঁজে পাবেই। কথা দিলাম। তুমি ছিলে আমার আদরের ধন। তোমাকে প্রকৃত সুখের পথটি দেখিয়ে যাই। তুমি সুখী হ’লে আর তো কিছু আমার চাওয়া-পাওয়ার নেই।

তুমি যদি প্রকৃত সুখী হ’তে চাও তবে জীবনের সকল ক্ষেত্রে দু’টো জিনিস আঁকড়ে ধরো। এক হ’ল- তোমার-আমার সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর প্রেরিত মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। আর দুই হ’ল- মহান আল্লাহর প্রেরিত বিশ্বনবী (ছাঃ)-এর আদর্শ, যা তুমি পাবে একমাত্র ছহীহ হাদীছে। মহান রবের ইবাদতের ক্ষেত্রে নবী করীম (ছাঃ)-এর শেখানো পদ্ধতির বাইরে চুল পরিমাণও নড়বে না। এর অন্যথা হ’লে তোমার সেই ইবাদত নিশ্চিতভাবে ইহকালে প্রত্যাখ্যাত ও পরকালে শাস্তিযোগ্য হয়ে যাবে।

তুমি যৌবনের শুরু থেকেই ছালাতকে সঙ্গী করে নিও, তাহ’লে দুনিয়ার সব উত্তম জিনিস তোমার সঙ্গী হবে। ছালাতের সময় হ’লে সর্বপ্রথম ছালাত আদায় করে নিবে, পরে অন্য কাজ। ছালাত ছেড়ে দিয়ে কোন সুখকে কখনোই গ্রহণ করবে না। এটা যেন মনে থাকে যে, ছালাত ছেড়ে দিলে দেহ-মন থেকে সুখ চিরপ্রস্থান করে। ছালাতহীন জীবনে কোন ধন-দৌলত, কোন আরাম-আয়েশের উপাদান সুখ বয়ে আনতে পারে না।

পরিত্যাগ কর তিনটি জিনিসকে। যা পরিত্যাগের নির্দেশ কুরআন-হাদীছ থেকেই আমি পেয়েছি- ১. শিরক অর্থাৎ আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো কাছে মাথা নত করা ও সকল প্রকার শিরকী কাজ ও আক্বীদা। ২. সকল প্রকার অশ্লীলতা। ৩. যাচাই ছাড়া কারো কথা ও কোন খবরে বিশ্বাস করা। এ তিনটি বিষয় বর্জন করা খুবই যরূরী। কেননা পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষ এ তিনটিকে বর্জন করতে পারছে না। বর্তমানে মানুষ শুধু এ তিনটির পিছনে ছুটছে। আমি চাই তুমি তা করবে না। তুমি যে শিক্ষা অর্জন করবে তাতে ঐ পাঁচটি গ্রহণ-বর্জন যেন থাকে।

আর সবসময় মধ্যপন্থা অবলম্বন করবে। বিপরীতে সকল প্রকার উগ্রতা অবশ্যই পরিত্যাজ্য। কোন দল ও ব্যক্তির একমাত্র পূজারী না হয়ে যে-ই উত্তম কথা বলবে তার উত্তম কথাটুকুই শুধু গ্রহণ করবে। মসজিদের ইমাম ছাহেবকেও অন্ধ অনুকরণ করবে না, আর তো অন্য কেউ! কারণ তারা কেউ-ই ভুলের ঊর্ধ্বে নয়।

কারো চাকচিক্য দেখে তাকে যোগ্য ভেবে তার ভুলটাকেও সঠিক ভেবো না। চারদিকে তাই-ই সবাই করছে। কিন্তু তুমি অন্য সবার মতো ভুল পথটি বেছে নেবে না। একমাত্র পবিত্র কুরআন ও ছহীহ হাদীছকে সকল কথা ও কাজের দলীল হিসাবে গ্রহণ করবে। বাবা, আমার এ কথাগুলো ভুলে যেও না কিছুতেই।

আরেকটি কথা-                                                       

আমার জীবন-যৌবন চলে গিয়েছে, এখন আল্লাহ সুখ দিয়েছেন। কিন্তু আমি তো আর এ সুখ ভোগ করব না। যত সুখ সব তোমার জন্যে। আমার জন্যে নয়। তুমি ভোগ কর, সুখী হও। তবে মনে রেখ- সুখ নিজেকেই অর্জন করতে হয়। সুখ উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যায় না। অন্যের অর্জিত সুখ তোমার কাজে আসবে না। তারপরেও যদি কিছু পাও তবে তা বোনাস হিসাবে নিও। যদি মনে কর আমি তোমার জন্যে সুখের উপকরণ কিছু রেখে যেতে পেরেছি, তবে তার সদ্ব্যবহার কর।

আর যদি দেখ কিছুই তোমায় দিতে পারিনি তাহ’লে কষ্ট নিও না। আমি চেষ্টা করেছিলাম তোমার জন্য অঢেল ধন-দৌলত ও সুনাম রেখে যাবার, কিন্তু আমার তা ছিল না। তা কিছু রেখে যেতে না পারলেও একটা জিনিস রেখে গেছি। সেটা হ’ল- আমি যে কুরআনটি পড়তাম। তুমি জেনে খুশি হবে যে তোমার পিতা নিয়মিত কুরআন পড়তেন। আর আমার হাতের ছোঁয়ার সেই কুরআনটি তোমার জন্যে রেখে গেলাম। আমাকে অঢেল সম্পদ যিনি দেননি, তিনিই তোমার-আমার রব। রবের এই কুরআনটি তুমি পড়বে। আমার দো‘আ- আমাদের মহান রব আল্লাহ যেন তোমাকে সুখের সব উপকরণ দেন, দেন সুনাম ও সুখ্যাতি।

মনে রেখো-                                                            

অনেক সাধনার পরে জীবনের অর্জিত যে সুখ তা একটু কষ্ট করে ধরে রাখার চেষ্টা কর। সুখ কিন্তু সব সময় স্বর্গে চলে যেতে চায়। দুনিয়ায় এ সুখ ধরে রাখা খুবই কঠিন। যদি একটু ভুল করে ফেল তবে এ সুখ চলে যাবে। একবার চলে গেলে আবার ফিরিয়ে আনা অতিশয় কঠিন হ’তে পারে। বাবা, মনে রেখো আমার এ কথা।

সুখ যদি ধরে রাখতে চাও তবে একটা কাজ কর। সেটা হচ্ছে, তোমার এ সুখ থেকে তুমি অন্যদের ভাগ দিও। তোমার পিতামাতা, তোমার স্ত্রী, সন্তানরা তোমার সুখের ভাগিদার। তারপর তোমার অসহায় ভাই-বোনেরা। অসহায় ভাই-বোনেদের দিকে সাহায্যের হাত না বাড়ালে তোমার-আমার রব মহান আল্লাহ খুবই অসন্তুষ্ট হন।

তবে আমি কিছু চাই না বাবা, জানি তোমার মা-ও চায় না। কিন্তু তোমার দায়িত্ব তুমি পালন না করলে তোমার সন্তানও যে তোমাকে ঠকাবে! আমি তো আর তা চাইতে পারি না। তবে আপনজনের সহায় হ’তে তোমায় যেন কেউ বাধা না দেয়। নিজের চোখে অনেক দেখেছি- বাধা দিলে বাধাদান কারীও কোন একদিন ঠিক ততটুকুই পায়। এ কারণেই আমি চাই তোমরা ঐ দায়িত্ব পালনে কোন ভুল করবে না।

শুনে রেখো,

আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করবে না। কেউ তোমার ঘরে খেতে বসলে কৃপণতা না করে তার প্লেটে জোর করে খাবার উঠিয়ে দিবে। খাবার দিয়ে তাকে এমন কোন কথা বলা যাবে না যাতে সে কষ্ট ও লজ্জা পায়। খেতে দিয়ে দূরে চলে যাবে না কখনোই। গেলেই প্রমাণ হবে যে তুমি চাও সে একাকী লজ্জা পেয়ে নিজে উঠিয়ে না নিতে পেরে অল্প খাক। মেহমানের প্লেটে উঠিয়ে না দিলে তারা নিজ হাতে নিয়ে খেতে বিব্রতবোধ করেন। কাছে বসে হাসিমুখে তাকে পেটপুরে খাওয়াবে। নিজের জন্য না থাকলেও সে চিন্তা করবে না। আবার কাছে বসে এমন কোন কথা ও কাজও করবে না যাতে তিনি খেতে না পারেন। প্রথমে ভাববে, মেহমান যেন কষ্ট না পায়।

বর্তমানে অধিকাংশ পরিবার আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষার ব্যাপারে উদাসীন। মেহমানকে মন থেকে আপ্যায়ন না করালে মুখের কৃত্রিম হাসি দিয়েও সে আচরণ ঢাকা যায় না। তখন তাদের মনে ভীষণ আঘাত নেমে আসে। তোমাকে এ ধরনের আচরণ মনেপ্রাণে পরিহার করতে হবে। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী জাহান্নামী ও মেহমানকে অপমানিত করার ফলে মহান আল্লাহ তা‘আলা বরকত উঠিয়ে নেন।

পারলে পাশের গরীব-দুঃখীদের সুখের অংশীদার কর। তাদের জন্য তুমি যাকাতের হিসাব করতে ভুলে যেও না। যদি একা ভোগ করতে চাও আর কাউকে না দিতে চাও, তবে এ সুখ ধরে রাখতে পারবে না। যদি পারো সব সুখ তুমি অকাতরে বিলিয়ে দিও, তাতেও তুমি অসুখী হবে না কখনোই। বরং আরো সুখ তোমার কাছে আসবে। আমার এ কথাগুলো তুমি মনে রেখো হে প্রিয় সন্তান!

আর একটা কথা মনে রাখবে- তোমার রবকে অসন্তুষ্ট করে যোর করে সুখী হ’তে চেষ্টা করবে না। এটা অসম্ভব। আমি এ অপচেষ্টার ভয়াবহ পরিণতি বহু দেখেছি। তুমি সাবধান থেকো!

ইতি,

তোমার পিতা।

আল-আমীন খান

লেখক, কবি ও শিক্ষক।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও
আরও
.