হাদিয়া অন্তর পরিবর্তন করে

যে সময়ের কথা বলছি, তখন আমি জীবনের চল্লিশটি বসন্ত অতিক্রম করেছি। ভাল-মন্দ বোঝার যথেষ্ট বয়স আমার হয়েছিল। দিনে দিনে দুর্বলতাময় পৌঢ়ত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। ভুলগুলো শুধরিয়ে জীবনটাকে নির্মল জান্নাতের উপযোগী করে শুভ্রতায় সাজিয়ে তুলছিলাম। তবুও আমার অবসাদগ্রস্ত দিনগুলো ও বেদনাক্রান্ত রাতগুলো ছিল হিমালয়ের চেয়েও ভারি। কারণ আমি মিথ্যা সমালোচনায় জর্জরিত হচ্ছিলাম সকাল-সন্ধ্যা। অসহ্য বদনামের কষাঘাত সইতে সইতে তলিয়ে যাচ্ছিলাম অবসন্নতার অতল তলে।

এই অবারিত আঘাত আমি যার কাছে পেয়েছি তিনি আমার নিকটাত্মীয়। দুয়ারের প্রতিবেশী। তিনি অবুঝ ছিলেন না। ষাট বছরের পূর্ণ পৌঢ় শরীরে বহন করছিলেন। মগজে বয়ে বেড়াচ্ছিলেন এক নাতিদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতা। আমি তার হিদায়াতের জন্য সিজদায় পড়ে অঝর নয়নে কেঁদেছি। দো‘আ কবুলের সবগুলো সময়ে তার জন্যই দো‘আ করেছি। তবুও আমি রক্ষা পাইনি তার বিদ্বেষের প্রস্তর নিক্ষেপ থেকে।

আমার মনে দাগ কেটে আছে সেই মেঘাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। যখন ভরা মজলিসে আমরা পাশাপাশি বসেছিলাম। আমি আস্তিনে লাগিয়েছিলাম কস্ত্তরীর সুঘ্রাণ। মৃদু বাতাসের শীতল প্রবাহে যা ছড়িয়ে পড়েছিল মজলিসের কোণায় কোণায়। এক বন্ধুবর প্রশংসায় বললেন, মাশাআল্লাহ! কি চমৎকার খুশবু! তার এই সত্য প্রশংসায় আমি খুশি হওয়ার সুযোগ পাইনি। কারণ দুয়ারের প্রতিবেশী বলে উঠলেন, কোথাও থেকে চুরি করে এনেছে হয়ত! সাথে সাথেই চাপা হাসির শব্দ ঘরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। যেমন ছড়িয়ে পড়েছিল কস্ত্তরীর সুবাস। আমার মনটা যেন বেদনায় মুচড়ে উঠল। তবুও আমি ওষ্ঠ-অধর পৃথক করলাম না।

পরের দিন আমি তার ভাইকে বিষয়টি জানালাম। বললাম, আমি জানি না, আপনার ভাই আমার কাছে কি চান! আমার মনে পড়ে না যে, আমি কোনদিন তার কোন অধিকার নষ্ট করেছি। রূহের জগৎ থেকে আজ পর্যন্ত তার সাথে আমার কোনই দ্বন্দ্ব ছিল না। আমি জানি না, তিনি কেন আমার সাথে এমন আচরণ করেন! শ্রোতা নিশ্চুপ রইলেন। কিছুক্ষণ পরে মাথা তুলে বললেন, আল্লাহ তাকে হিদায়াত দান করুন। এসব কারণে তিনি আমার কাছেও দারুন অপসন্দের।

আমি এই সমস্যা সমাধানের জন্য দীর্ঘ ভাবনায় ডুব দিলাম। অনেকের সাথে পরামর্শও করলাম। এভাবেই দিন যেতে থাকল। হঠাৎ একদিন আমার এক শুভাকাঙ্ক্ষীর নিকটে তার ঘটনাগুলো বর্ণনা করায় তিনি আমাকে এক কার্যকরী পরামর্শ দিলেন। বললেন, তুমি বাযারে গিয়ে কিছু মূল্যবান উপহার ক্রয় কর। সেগুলো নিয়ে ঐ আত্মীয়ের বাড়িতে যাও এবং তাকে বল, আমি আপনাকে আল্ল­াহর জন্য ভালোবাসি! আপনার জন্য এই সামান্য কিছু উপহার সেই অকৃত্রিম ভালোবাসা থেকে। খেয়াল রেখ, সেখানে বেশীক্ষণ অবস্থান করবে না। আর মাগরিব ও এশার মধ্যবর্তী সময়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে। 

তার পরামর্শ আমার মনঃপূত হ’ল। পরের দিন আমি বাযার থেকে প্রায় বার হাযার টাকার উপহার সামগ্রী ক্রয় করলাম। উপহার নিয়ে সেই আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে দরজায় কড়া নাড়লাম। দরজা খুললেন আমার দুয়ারের প্রতিবেশী। আমাকে দেখার পরে তার চেহারায় কিছুটা প্রশ্ন মিশ্রিত বিস্ময়ের প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠল। বললেন, তুমি! কি চাও? আমি বললাম, আমাকে ভেতরে ডাকবেন না? তিনি কিছুটা খসখসে স্বরে বললেন, এসো! আমি ভেতরে ঢুকেই বললাম, আমি অনেক সাহস সঞ্চয় করে আপনার বাড়িতে এসেছি কেবল আপনাকে সালাম জানাতে ও আপনার খোঁজ-খবর নিতে। তারপরও আপনি আমাকে ভেতরে ঢুকতে অনুমতি দিলেন। এ আমার পরম সৌভাগ্য।

তিনি আমাকে বসতে বললেন। কিছুক্ষণ আলাপচারিতা চলল। এশার ছালাত নিকটবর্তী হ’লে সময় সংকীর্ণতার অযুহাত দেখিয়ে আমি চলে আসতে চাইলাম। বললাম, দয়া করে আমার সাথে একটু গাড়ি পর্যন্ত আসুন। তিনি বললেন, গাড়ি এনেছ কেন? বললাম, এমনিতেই। তিনি আমার অনুরোধ রাখলেন। আমি গাড়ির দরজা খুলে উপহার সামগ্রী তার হাতে তুলে দিলাম। বললাম, আমি আপনাকে আল্ল­াহর জন্য ভালোবাসি। এগুলো আমার পক্ষ থেকে আপনার জন্য সামান্য নাযরানা। আমি আর বাক্য না বাড়িয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম।

গাড়ির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে খেয়াল করলাম, তিনি সেটা ধরে রেখেছেন। রাতের আবছা অন্ধকারে তার চোখের কোণে চিকচিক করা মুক্তাদানার মত অশ্রুবিন্দু আমার নযর এড়াল না। তিনি বললেন, আজ কতদিন পরে আমার বাড়িতে এসেছ? আমি বললাম, বেশ অনেকদিন! তিনি বললেন, তো না খেয়ে চলে যাচ্ছ যে! এসো, আজ এশার ছালাত একসাথেই আদায় করি! একসাথে রাতের খাবার খাই! তোমার সাথে তো আমার ঢের গল্প বাকী!

শিক্ষা : জীবনে চলার পথে আমরা অনেকের প্রতিবেশী হই। কারো ঊর্ধ্বতন হই। কারো অধীন হই। আমাদের মাধ্যমে যদি কেউ কষ্ট পায় তবে তার দিন-রাত তেমনই কাটে যেমন এই গল্পে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং কাউকে কষ্ট দেয়া যাবে না। আর কেউ যদি অহেতুক কষ্ট দেয় তবে প্রথমত আল্লাহর নিকট প্রতিদানের আশায় ধৈর্যধারণ করতে হবে। দ্বিতীয়ত তার হেদায়াতের জন্য দো‘আ করতে হবে। তৃতীয়ত তার সাথে সদাচরণ করতে হবে। চতুর্থত তাকে সাধ্যমত কিছু হাদিয়া দিতে হবে। কেননা হাদিয়া ভালোবাসা বৃদ্ধি করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা পরস্পর উপহার আদান-প্রদান কর, তাহ’লে তোমাদের মাঝে ভালোবাসা বৃদ্ধি হবে’ (আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৯৪)

নাজমুন নাঈম

শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আরও
আরও
.