লক্ষ্যহীন জীবনের প্রতি

একদা বিমানে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রলোক আমার সহযাত্রী ছিলেন। তিনি নিজেকে সঊদী আরবের একটি বড় কোম্পানির উপদেষ্টা হিসাবে পরিচয় দিলেন। পরিচিত হওয়ার সময় আমি তার শৈশব সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলাম। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, আমি তোমাকে আমার দুই ছেলের গল্প শোনাব। এরপর তিনি যে গল্প বললেন তা সত্যিই চমৎকার।

ভদ্রলোকের দু’টি ছেলে আছে। তারা মাধ্যমিকে পড়ার সময় একদিন তিনি খেয়াল করলেন, পড়ালেখায় তাদের আগ্রহ কম। তাই তিনি তাদের উৎসাহিত করতে একটি মজার পরিকল্পনা করলেন। তিনি জানতেন গাড়ির প্রতি দু’ভাইয়ের প্রচন্ড দুর্বলতা। তারা মোবাইলে গাড়ি চালনার গেমস খেলে। রাস্তায় বের হ’লে কোন্ গাড়ি বেশী সুন্দর, কার কি গাড়ি পসন্দ তা নিয়ে কথাবার্তা বলে। তাই তিনি তাদের জিজ্ঞেস  করলেন, তারা বড় হয়ে কোন্ গাড়ি কিনতে চায়? দু’জনে একসাথে বলল, ফেরারি! তিনি তাদের বললেন, তাহ’লে চল! আমরা এখন গিয়ে গাড়ি দেখে আসি? তোমাদের কোন ফেরারি পসন্দ? বাবার কথা শুনে দুই কিশোর আনন্দে লাফিয়ে উঠল।

সেদিন তাদের বাবা আসলে তাদের একটি ফেরারি গাড়ির শো-রুমে নিয়ে গেলেন। অতি উৎসাহের সাথে দু’ভাই শো-রুমে প্রবেশ করল। সেলসম্যান তাদের অভিবাদন জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, স্যার! কিভাবে আপনাদের সাহায্য করতে পারি? বাবা উত্তর দিলেন, আমার দুই ছেলে ফেরারি গাড়ি কিনতে চায়। বাবা বলেছিলেন যে, তিনি সেদিন ভাগ্যবান ছিলেন। কারণ বিক্রেতা তার বার্তাটি বুঝতে পেরেছিল এবং তার ছেলেদের সাথে এমন আচরণ করেছিল যেন তারা সত্যিই ক্রেতা।

সেলসম্যান জিজ্ঞেস করল, তাদের কি ধরনের গাড়ি পসন্দ? এরপর ঘুরে ঘুরে তাদের গাড়ি দেখাল, যাতে তারা পসন্দ মতো গাড়িটি খুঁজে নিতে পারে। দু’ছেলে শো-রুমে থাকা গাড়িগুলোর মধ্যে একটি লাল গাড়ি পসন্দ করল। তারা গভীর আবেগ নিয়ে গাড়ির চারপাশে ঘুরে ছুঁয়ে দেখল। তারপর সেলসম্যান চাবি নিয়ে এসে গাড়িটি খুলে তাদের গাড়ির ভিতরে দেখার প্রস্তাব দিল। সীমাহীন আনন্দে তারা গাড়িতে উঠে বসল। তারা বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তারা তাদের স্বপ্নের ফেরারি গাড়িতে উঠেছে। তারা একবার পিছনে আরেকবার সামনে বসে দেখল। পালাবদল করে দু’ভাই একবার করে ড্রাইভিং সিটেও বসল। আর এমন ভাব করল যেন তারা সত্যিই গাড়ি চালাচ্ছে।

তাদের বাবা বসে শো-রুমের ম্যানেজারের সাথে কথা বলছিলেন। দেখা শেষ করে তারা বাবাকে জানাল। বাবা তখন ম্যানেজারকে

* শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

গাড়িটির দাম জিজ্ঞেস করলেন। তিনি তাকে এটাও জিজ্ঞেস করলেন যে, কিস্তিতে গাড়ি কিনতে চাইলে মাসিক কিস্তি কত হবে? বাবা তার দুই সন্তানের হাতে দু’টি কাগজের টুকরো দিয়ে এই তথ্যগুলো তাতে লিখে রাখতে বললেন। তারপর তারা বিক্রেতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বাড়িতে ফিরে আসল।

ভদ্রলোকের দু’ছেলের জন্য এটি একটি অবিস্মরণীয় দিন ছিল। বাড়ি ফিরে তারা সারাক্ষণ যে গাড়িটা দেখল সেটা নিয়ে কথা বলছিল। তাদের বাবা তখন তাদের সাথে কথা বলতে বসলেন। তিনি তাদের বুঝালেন, যদি তারা বড় হয়ে গাড়িটি কিনতে চায়, তাহ’লে তাদের অবশ্যই একটি উচ্চ বেতনের মর্যাদাপূর্ণ চাকরি করতে হবে। যাতে তারা নির্ধারিত মাসিক কিস্তি পরিশোধ করতে পারে। এরপর তারা আলোচনা করে যারা ফেরারি কিনতে চায় তাদের মাসিক বেতন কমপক্ষে কত হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করল।

পরদিন বাবা তার দুই ছেলেকে নিয়ে শহরের পাবলিক লাইব্রেরিতে গেলেন। সেখানে তারা ব্রিটেনে বিভিন্ন চাকরির গড় আয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করল। তারা তালিকা থেকে ঐ সমস্ত চাকরি বাদ দিল যেগুলোর বেতন তাদের গত রাতে আলোচনায় নির্ধারিত বেতনের চেয়ে কম। শেষ পর্যন্ত তাদের তালিকায় মাত্র কয়েকটি চাকরি বাকী থাকল। বাবা তাদের বুঝিয়ে বললেন, স্বপ্নের গাড়ি কিনতে হ’লে এই চাকরিগুলোর মধ্যে একটি তাদের নিশ্চিত করতে হবে। তখন দু’জন তাদের পসন্দের চাকরি বেছে নিল।

তারপর লাইব্রেরিতে লব্ধ তথ্য ব্যবহার করে তারা নির্ধারণ করল কিভাবে তাদের কাঙ্ক্ষিত চাকরি পাওয়া যাবে। যে কেউ এই কাজ পেতে চাইলে কি কি সার্টিফিকেট প্রয়োজন এবং কোন কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করলে এটি পাওয়া সহজ হবে সব তারা বের করল। তারপর তারা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলির একটি তালিকা তৈরি করল। এরপর তারা এসব কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পরীক্ষার কাঙ্ক্ষিত ফলাফল নিয়ে গবেষণা করে আরেকটি তালিকায় সব রেকর্ড করল। তারপর সন্ধ্যা নাগাদ তারা বাড়ি ফিরল।

রাতে তাদের বাবা তাদের সাথে বসে পুরো বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করলেন। তিনি প্রথমে তাদের স্বপ্নটাকে উৎসাহিত করলেন। তারপর তিনি তাদের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথকে কয়েকটি ধাপে বিভক্ত করলেন। তিনি বললেন, প্রথম যে পদক্ষেপটি তাদের নিতে হবে তা হ’ল এখন পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী হওয়া এবং পরীক্ষায় প্রয়োজনীয় ফলাফল করা, যা তাদের কাঙ্ক্ষিত কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য সহায়তা করবে।

এই দীর্ঘ ঘটনার ফলাফল কি ছিল? তাদের বাবা আমাকে বলেছিলেন যে, তার দুই ছেলে সেদিন থেকে তাদের পড়াশোনায় বিশেষ মনোযোগী হয়ে গেল। তারা নিজেরাই তাদের পড়াশোনা ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি রুটিন তৈরি করল। সেখান থেকে সকল অপ্রয়োজনীয় কাজ যেমন, টিভি দেখা, গেমস খেলা, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া ইত্যাদি বাদ দিল। এমনকি খাওয়া-দাওয়া, পারিবারিক গল্প-গুজব ও ঘুমের সময় কমিয়ে দিল। তিনি শুধু মাঝে মাঝে তাদের বড় স্বপ্নের কথা মনে করিয়ে দিতেন ও তাদের উৎসাহিত করতেন।

কয়েক বছর পর তারা সত্যিই তাদের পড়াশোনায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হ’ল। তারা তাদের বেছে নেওয়া সেক্টরে তাদের কর্মজীবনও শুরু করল। এখন তাদের একজন বিখ্যাত চেইন রেস্টুরেন্টের ব্রিটিশ শাখার ম্যানেজার। আর অন্যজন মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় কোম্পানিতে মর্যাদাপূর্ণ চাকরি করছে।

আমার সহযাত্রী তার গল্প শেষ করার পর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তারা কি যা চেয়েছিল তা অর্জন করতে পেরেছে? মানে তারা কি ফেরারি গাড়ি কিনেছে? তিনি হাসতে হাসতে উত্তর দিলেন, বড় ছেলে একটি পোর্শে কিনেছে। সে এখন ফেরারির চেয়ে এটি বেশি পসন্দ করে। যদিও ছোট ছেলে এখনও ফেরারি পসন্দ করে এবং সে শীঘ্রই এটি কিনবে।

গল্পটিতে অভিভাবকদের জন্য সন্তানকে উৎসাহিত করার একটি শিক্ষা রয়েছে। যদিও এটি দুনিয়াকেন্দ্রিক। তবে মুমিনের লক্ষ্য হ’তে হবে আখেরাত। মুমিন আখেরাতের লক্ষ্যেই দুনিয়া অর্জন করবে। আখেরাতের জন্য দুনিয়া করলে সে দুনিয়া-আখেরাত দু’টিই পাবে। কিন্তু দুনিয়ার জন্য দুনিয়া করলে দুনিয়ার হারাবে, আখেরাতও হারাবে। তবে সামগ্রিকভাবে গল্পটি থেকে সন্তানকে স্বপ্ন দেখানো এবং সে স্বপ্ন বাস্তবায়নে কঠোর পরিশ্রমের শিক্ষা লাভ করা যায়

আমাদের উচিত সন্তানদের পসন্দ ও ভালো লাগার বিষয় সম্পর্কে জানা। প্রথমত তার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য স্থির করে দেওয়া এবং তাকে সে লক্ষ্য অর্জনের গুরুত্ব বুঝানো। তারপর সেটি অর্জনের জন্য সঠিক পথ নির্ধারণ করা ও বারবার উৎসাহিত করা। উদাহরণস্বরূপ যদি কেউ চান যে তার ছেলে ডাক্তার হোক তাহ’লে তাকে শুধু বইয়ে আমি বড় হয়ে ডাক্তার হব মুখস্থ করালে হবে না। বরং তাকে ডাক্তারদের জীবন যাপন ও সুযোগ-সুবিধা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ করে দিতে হবে।

যদি কেউ চান যে তার সন্তান দাঈ ইলাল্লাহ হোক, তাহ’লে অবশ্যই তাকে দাঈর সম্মান ও মর্যাদা উপলব্ধি করাতে হবে। তাকে বলা যেতে পারে, কোন সম্পদ তোমার কাছে সবচেয়ে পসন্দনীয়? তার উত্তর হ’তে পারে, একটি দামী গাড়ি বা একটি সুন্দর বাড়ি অথবা এক কোটি টাকা। প্রতিউত্তরে বলা যেতে পারে, আরবের লোকদের নিকট সবচেয়ে পসন্দনীয় সম্পদ ছিল অতি মূল্যবান লাল উট। কিন্তু রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যদি তোমার দ্বারা আল্লাহ একজন ব্যক্তিকেও হেদায়াত দান করেন, ‘তবে সেটি তোমার জন্য মূল্যবান লাল উটের চেয়ে উত্তম হবে’(মুসলিম হা/২৪০৬)। তুমি যদি আল্লাহর পথে মানুষকে দাওয়াত দাও, আর তোমার মাধ্যমে কাউকে আল্লাহ হেদায়াত দান করেন, তবে সেটি তোমার জন্য একটি গাড়ি বা কোটি টাকার চেয়ে বেশী উপকারী হ’তে পারে।

অথবা এভাবে বলা যেতে পারে, তুমি একটি গাড়ি কতদিন চড়তে পারবে? দশ বছর বা পনের বছর। তারপর সেটি পুরনো হয়ে নষ্ট হয়ে যাবে। তুমি এক কোটি টাকায় কি কি কিনতে পারবে? আর সেগুলো তোমার কতদিন কাজে আসবে? মৃত্যুর আগ পর্যন্ত! কিন্তু তুমি যদি সুন্দর আমল কর, আল্লাহর পথে মানুষকে আহবান কর আর সেজন্য অনেক জ্ঞান অর্জন কর, তাহ’লে তুমি জান্নাতে যেতে পারবে। সেখানে তুমি চাইলে প্রতিদিন নতুন নতুন গাড়ি চড়তে পারবে। তোমার কল্পনার চেয়ে সুন্দর ও বিশাল বাড়ি পাবে। তোমার যা ইচ্ছা সবই তুমি পাবে।

মোদ্দাকথা, আপনার সন্তানকে শুধু মুখস্থ করিয়ে বা আপনার একটি ইচ্ছা চাপিয়ে দিয়ে সে উদ্দেশ্যে ছুটতে বাধ্য করবেন না। এতে সে অনুপ্রাণিত হয় না, বরং কখনো কখনো এটিকে নিজের উপর বোঝা মনে করে। তাদেরকে নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনের গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করুন। তাদের সামনে একজন রোল মডেল উপস্থাপন করুন। তার লক্ষ্যে পৌঁছানোর পথ দেখিয়ে দিন এবং মাঝে মাঝে লক্ষ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। তাহ’লে একদিন সে তার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছাবে ইনশাআল্লাহ।

-মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম*






আরও
আরও
.