প্রাথমিক কথা :
পৃথিবীতে যেকোন বস্ত্তর একটা সুনির্দিষ্ট উৎস রয়েছে। এগুলো সৃষ্টির অন্তরালে মহান স্রষ্টার সদিচ্ছা ও সদুদ্দেশ্য বিরাজমান। অতঃপর এগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনায় নিঃসন্দেহে তাঁর একচ্ছত্র সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত। তিনি সবকিছুর অধিপতি, বাদশাহ, রাজা, মহাধিরাজ, তাঁর কোন শরীক নেই, মাতা-পিতা বা সন্তান-সন্ততি নেই। তিনি এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর সৌন্দর্য, অবস্থান, জ্ঞান, ক্ষমতা ও মহানুভবতার কোন সীমারেখা নেই। এগুলো সম্পূর্ণ কল্পনাতীত ও বর্ণনাতীত ব্যাপার। তবে চিন্তা-ভাবনা, অধ্যবসায় ও গবেষণা বহির্ভূত নয়।
উপরোক্ত বক্তব্য বা সমস্যার সমাধানকল্পে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানবজাতির আবির্ভাব। মহাজ্ঞানী আল্লাহ তাঁর আকাঙ্ক্ষা দ্বারা আজকের এই জ্ঞানসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করেছেন। অবশ্য সৃষ্টির প্রাক্কালেই তিনি তাঁর অসীম ও মহা জ্ঞান ভান্ডার হ’তে মানুষকে সামান্য দান করেন। এই সামান্য জ্ঞানের প্রাচুর্য নিয়েই মানুষ তার অস্থায়ী আবাসভূমি এ নশ্বর পৃথিবীতে যে জ্ঞান-বিজ্ঞান, আশা-আকাঙ্ক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির প্রতিযোগিতা চালিয়ে যাচ্ছে তা ভাষায় প্রকাশ করাও কঠিন। কিন্তু মহাক্ষমতাধর আল্লাহর মহাজ্ঞান ও মহানিদর্শনের সামনে এগুলো কত তুচ্ছ ও নগণ্য তা বর্তমান বিজ্ঞানীরাই (পরোক্ষভাবে) নিঃসঙ্কোচে তাঁদের আবিষ্কারের মাধ্যমে বলে দিচ্ছেন। সৃষ্টির বিরাটত্বের বর্ণনায় বা গবেষণায় বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার যে নগন্য তা আজ পরিষ্কার। পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ যে সূর্যের উপগ্রহ মাত্র, সেই সূর্যের মত শত-সহস্র কোটি নক্ষত্র নিয়ে যে আলাদা একটা পরিপূর্ণ জগৎ রয়েছে যাকে বলা হয় গ্যালাক্সি বা ছায়াপথ তা আজ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় সুস্পষ্ট। এই ছায়াপথের বিরাটত্বের তুলনায় আমাদের এ পৃথিবী নয় বরং সৌরজগৎই একটা বিন্দু ছাড়া আর কিছুই নয়।
অবশ্য অধিকাংশ বিজ্ঞানীই মহান স্রষ্টা আল্লাহ বা আল্লাহর জ্ঞানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী নয়। তাদের মতে এগুলো প্রাকৃতিক (Natural) ব্যাপার বলে বিবেচিত বা পরিগণিত। তাই এগুলোর স্রষ্টা আল্লাহর অসীম জ্ঞানের আলোচনা ছাড়াই এদের বিরাটত্বের বর্ণনা দেয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর ক্ষমতা ও আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ স্বরূপই উপরোক্ত গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের অবস্থান, সন্ধান ও আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে।
বিজ্ঞানীদের আবিষ্কার ঐ ছায়াপথের অস্তিত্ব, অসীম জ্ঞানবান আল্লাহর আকাঙ্ক্ষার অবর্ণনীয় ও সৃষ্টির তুলনায় উপরোল্লিখিত সৌরজগতের মতই একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিন্দু কিনা জানি না। তবে বিজ্ঞানীরা যাই বলুক তাদের আবিষ্কার ঈমানদার বা বিশ্বাসী বান্দাদের জন্যে বিষ্ময়ের বিষয় নয়; বরং ঈমান বৃদ্ধির জন্য সহায়ক।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আধ্যাত্মিক জগতে আকাঙ্ক্ষার স্থান সর্বঊর্ধ্বে। এজন্য বিজ্ঞানীরা ছাড়াও অনেক পন্ডিত, বুদ্ধিজীবি, মনীষী, দিগ্বিজয়ী রাজা, মহারাজা, ধনকুবের, শিক্ষক-ছাত্র, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সবাই আকাঙ্ক্ষার পেছনে ধাবমান। আকাঙ্ক্ষার সূচনা খুবই সহজ-সরল পদ্ধতিতে হ’লেও ক্রমশ তা জটিল হ’তে জটিলতর পর্যায়ে পরিণতি লাভ করে। কারণ এগুলোর শাখা-প্রশাখা অত্যন্ত ব্যাপক, জটিল। এটা একদিকে যেমন বাস্তব সত্য, সহজ-সরল, সুন্দর, সামাজিক, ধার্মিক, আধ্যাত্মিক, পারলৌকিক গুণভান্ডারে পরিপূর্ণ, অপরদিকে তেমনি অবাস্তব, অস্বচ্ছ, মিথ্যা, প্রতারণা, বিশ্বাসঘাতকতা, সীমালংঘন অপরাধজগতে পরিপূর্ণ। এটা মোটেও কোন নির্ভেজাল উপাদান নয়। তবে মানবজীবনের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যাণ সাধনে এবং মহামূল্যবান আমলনামা সংরক্ষণে এর কোন বিকল্প নেই। সুতরাং আকাঙ্ক্ষার সঠিকত্ব নির্ণয়ে অদৃশ্য-অস্পৃশ্য জগতে সন্তরণের ভূমিকায় মহাব্রত গ্রহণ করতে হবে।
আকাঙ্খার পরিচয় :
আকাঙ্খার আরবী প্রতিশব্দ الرجاء (আর-রাজা)। আভিধানিক অর্থ আশা, প্রত্যাশা, কামনা ইত্যাদি। পারিভাষিক অর্থে আল্লাহর প্রতি উত্তম ধারণা পোষণ করা; তাঁর আনুগত্য ও ইবাদত কবুল এবং কৃত গোনাহের জন্য ক্ষমার প্রত্যাশা করা। মহান আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّ وَعْدَ اللهِ حَقٌّ فَلاَ تَغُرَّنَّكُمُ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا وَلاَ يَغُرَّنَّكُمْ بِاللهِ الْغَرُوْرُ ‘হে মানুষ! আল্লাহর প্রতিশ্রুতি সত্য। সুতরাং পার্থিব জীবন যেন তোমাদেরকে কিছুতেই প্রতারিত না করে এবং সে (শয়তান) যেন কিছুতেই আল্লাহ সম্পর্কে তোমাদেরকে প্রবঞ্চিত না করে’ (ফাতির ৩৫/৫)।
বস্ত্ততঃ আকাঙ্ক্ষার মর্মার্থ মনের ইচ্ছা, বাসনা, কামনা, প্রত্যাশা ইত্যাদি।
আকাঙ্ক্ষার প্রকারভেদ :
আকাঙ্ক্ষা তিন প্রকার। দু’টি প্রশংসিত ও একটি ধিকৃত ধোঁকা। প্রথমটি হচ্ছে ব্যক্তির আশার সাথে সাথে আল্লাহর আনুগত্য ও ছওয়াবের প্রত্যাশা। দ্বিতীয়টি হচ্ছে ব্যক্তির কৃত পাপ থেকে তওবা করা এবং আল্লাহর ক্ষমা, অনুগ্রহ ও কৃপা কামনা করা। সুতরাং এ দু’টি হচ্ছে প্রশংসিত। তৃতীয় প্রকার হচ্ছে ব্যক্তির শিথিলতা ও পাপের উপরে থেকে আল্লাহর রহমত কামনা করা কোন সৎ আমল ব্যতিরেকে। এটাই প্রতারণা ও অলীক আশা-আকঙ্ক্ষা।
এছাড়া আশা-আকাঙ্ক্ষাকে আরো কয়েকভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা- (১) ইহকালীন (২) পরকালীন ও (৩) উভয়কালীন আকাঙ্ক্ষা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
আশা-আকাঙ্ক্ষার গুরুত্ব :
আকাঙ্ক্ষা ইবাদতের রুকন সমূহের অন্যতম রুকন। ইবাদত মুহাববত, ভীতি ও আকাঙ্ক্ষার উপরে ভিত্তিশীল। এটি অন্তরের আমলসমূহের মধ্যে একটি বড় আমল। এ ব্যাপারে অনেক শারঈ দলীল রয়েছে এবং আকাঙ্ক্ষীদের প্রশংসা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,أُولَئِكَ الَّذِيْنَ يَدْعُوْنَ يَبْتَغُوْنَ إِلَى رَبِّهِمُ الْوَسِيْلَةَ أَيُّهُمْ أَقْرَبُ وَيَرْجُوْنَ رَحْمَتَهُ وَيَخَافُوْنَ عَذَابَهُ ‘তারা যাদেরকে আহবান করে তারাই তো তাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের উপায় সন্ধান করে যে, তাদের মধ্যে কে কত নিকটবর্তী হ’তে পারে, তাঁর দয়া প্রত্যাশা করে ও তাঁর শাস্তিকে ভয় করে। তোমার প্রতিপালকের শাস্তি ভয়াবহ’ (ইসরা ১৭/৫৭)।
আল্লাহ বলেন, مَنْ كَانَ يَرْجُو لِقَاءَ اللهِ فَإِنَّ أَجَلَ اللهِ لَآتٍ ‘যে আল্লাহর সাক্ষাৎ কামনা করে (সে জেনে রাখুক যে,) আল্লাহর নির্ধারিত সময় আসবেই’ (আনকাবূত ২৯/৫)। তিনি আরো বলেন, أُولَئِكَ يَرْجُوْنَ رَحْمَتَ اللهِ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ ‘তারাই আল্লাহর অনুগ্রহের প্রত্যাশা করে এবং আল্লাহ ক্ষমাশীল দয়ালু’ (বাক্বারাহ ২/২১৮)। হাদীছে এসেছে, রাসূল (ছাঃ) বলেন, لاَ يَمُوتَنَّ أَحَدُكُمْ إِلاَّ وَهُوَ يُحْسِنُ بِاللهِ الظَّنَّ ‘তোমার কেউ যেন আল্লাহর প্রতি উত্তম ধারণা পোষণ করা ব্যতীত মৃত্যুবরণ না করে’।[1] অন্যত্র তিনি বলেন, আল্লাহ বলেন, أَنَا عِنْدَ ظَنِّ عَبْدِى بِى فَلْيَظُنَّ بِى مَا شَاءَ ‘বান্দা আমার সম্পর্কে যেমন ধারণা পোষণ করে, আমি তার নিকটে তেমন। সুতরাং সে আমার ব্যাপারে যা ইচ্ছা ধারণা করুক’।[2]
আশা-আকাঙ্ক্ষা করা ওয়াজিব :
মুমিনের জন্য আল্লাহর নিকটে আশা-আকাঙ্ক্ষা করা আবশ্যক। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে অনেক আয়াত ও বহু ছহীহ হাদীছ বর্ণিত হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِيْنَ أَسْرَفُوْا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لاَ تَقْنَطُوْا مِنْ رَحْمَةِ اللهِ إِنَّ اللهَ يَغْفِرُ الذُّنُوْبَ جَمِيْعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُوْرُ الرَّحِيْمُ ‘বল, হে আমার বান্দারা! তোমরা যারা নিজেদের প্রতি অবিচার করেছ, আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। আল্লাহ সমস্ত গোনাহ ক্ষমা করে দিবেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু’ (যুমার ৩৯/৫৩)। পক্ষান্তরে যারা আললাহর রহমত থেকে হতাশ ও নিরাশ হয় আল্লাহ তাদের নিন্দা করেছেন। তিনি বলেন, إِنَّهُ لاَ يَيْأَسُ مِنْ رَوْحِ اللهِ إِلاَّ الْقَوْمُ الْكَافِرُوْنَ ‘নিশ্চয়ই কাফির ব্যতীত কেউই আল্লাহর করুণা হ’তে নিরাশ হয় না’ (ইউসুফ ১২/৮৭)।
হাদীছে এসেছে, নবী করীম (ছাঃ) বলেন, لَمَّا خَلَقَ اللهُ الْخَلْقَ كَتَبَ فِى كِتَابِهِ، هُوَ يَكْتُبُ عَلَى نَفْسِهِ، وَهْوَ وَضْعٌ عِنْدَهُ عَلَى الْعَرْشِ، إِنَّ رَحْمَتِى تَغْلِبُ غَضَبِى ‘আল্লাহ যখন মাখলুক সৃষ্টি করলেন, তখন তা তাঁর কিতাবে লিখলেন। আর স্বীয় সত্তা সম্পর্কে লিখলেন, যা তাঁর কাছে আরশের উপরে রক্ষিত আছে, ‘আমার রহমত আমার গযবকে পরাভূত করেছে’।[3] তিনি আরো বলেন, جَعَلَ اللهُ الرَّحْمَةَ مِائَةَ جُزْءٍ، فَأَمْسَكَ عِنْدَهُ تِسْعَةً وَتِسْعِينَ جُزْءًا، وَأَنْزَلَ فِى الأَرْضِ جُزْءًا وَاحِدًا، فَمِنْ ذَلِكَ الْجُزْءِ يَتَرَاحَمُ الْخَلْقُ، حَتَّى تَرْفَعَ الْفَرَسُ حَافِرَهَا عَنْ وَلَدِهَا خَشْيَةَ أَنْ تُصِيبَهُ ‘আল্লাহ রহমতকে একশত ভাগে বিভক্ত করেছেন। তন্মধ্যে নিরানববই ভাগ তিনি নিজের কাছে সংরক্ষিত রেখেছেন। আর পৃথিবীতে একভাগ প্রেরণ করেছেন। এ এক ভাগ পাওয়ার কারণেই সৃষ্টজগৎ পরস্পরের প্রতি দয়া করে। এমনকি ঘোড়া তার বাচ্চার উপর থেকে পা উঠিয়ে নেয় এই আশঙ্কায় যে, সে ব্যথা পাবে’।[4]
সুতরাং হতাশ ও নিরাশ না হয়ে মুমিনকে আশা-আকাঙ্ক্ষা রাখতে হবে।
সৎ আমল ব্যতীত আশা-আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ হয় না :
বিদ্বানগণ এ ব্যাপারে ঐকমত্য যে, সৎ আমল ব্যতীত আশা-আকাঙ্ক্ষা সিদ্ধ হয় না। পক্ষান্তরে সৎ আমল ছেড়ে দিয়ে পাপের উপরে অটল থেকে আল্লাহর রহমত কামনা করা যথার্থ প্রত্যাশা নয়। এটা অজ্ঞতা, মূর্খতা ও প্রবঞ্চনা। বস্ত্ততঃ আল্লাহর রহমত সৎকর্মশীল লোকদের নিকটবর্তী; আমলে ছালেহের ক্ষেত্রে উদাসীন, পাপাচারীদের নিকটবর্তী নয়। সুতরাং সৎকর্মের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত প্রত্যাশা করতে হবে।
আশা-আকাঙ্ক্ষার সূচনা :
বিশ্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ আল-কুরআনে যাবতীয় আকাঙ্ক্ষার বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বর্তমান বিশ্বের মানুষ অগণিত আকাঙ্ক্ষার পিছনে ধাবমান। অবশ্য অতীতেও এর কোন প্রকারের কমতি ছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায় না। জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে আকাঙ্ক্ষার আধিক্যও হচ্ছে বলে মনে হয়। যা হোক আকঙ্ক্ষাই আমাদের মানব জীবনের সকল কল্যাণ ও অকল্যাণ সাধনের একমাত্র উৎস বলা যায়। তাই এর রহস্যময় অনুকূল ও প্রতিকূল দিকসমূহের গন্তব্যস্থল এবং এর পরিণতিই আলোচ্য প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত শিক্ষণীয় আহবান।
আল্লাহ তা‘আলা তাঁর মহা আকাঙ্ক্ষা হ’তেই মানব সৃষ্টির পরিকল্পনা নিয়ে ফেরেশতাদের সামনে তা উপস্থাপন করেন। অতঃপর তা বাস্তবায়িত করে তাঁর ফেরেশতাদেরকে আদম (আঃ)-এর প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে সিজদা করার আদেশ দেন। ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করলেন। এ ঘটনায় আল্লাহ চরম অসন্তুষ্ট হয়ে ইবলীসকে ‘শয়তান’ নামে অভিহিত করে জান্নাত থেকে বিতাড়িত করেন। অতঃপর শয়তান মহাজ্ঞানী আল্লাহর কাছে বলে যে, আদম (আঃ) ও তাঁর সন্তানেরাও একদিন ইবলীসের মতই আল্লাহর আদেশ অমান্য করবে। আল্লাহ আদম (আঃ)-কে সাবধান করে বলে দিলেন, ইবলীস তাঁর শত্রু। সুতরাং তিনি যেন ইবলীস হ’তে দূরে থাকেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে ইবলীস তার সুচতুর কৌশল দ্বারা একদিন আদম (আঃ)-কে আল্লাহর আদেশ লংঘনে উদ্বুদ্ধ করল এবং তা করিয়েই ছাড়ল। এ ঘটনায় মহান আল্লাহ তা‘আলা আদম (আঃ)-এর প্রতি অসন্তুষ্ট হ’লেন, তবে তাঁর (আদমের) আবেদনক্রমে ক্ষমা করে তাঁকে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দিলেন আরও অসংখ্য আকাঙ্ক্ষার মোকাবিলা করার নিমিত্তে।
প্রশ্ন হ’ল, আকাঙ্ক্ষা একটি অদৃশ্য মহাব্যাপক প্ররোচনামূলক উপাদান। তাই এর গভীরতার শেষ প্রান্তে পৌঁছার পরিকল্পনা কোন প্রাণীর জন্যেই সমীচীন নয়। ইবলীস এ পথের অনুসরণ করতে গিয়েই অহংকারে ডুবে যায় এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করার পরিণতি ভুলে যায়। অতঃপর অহংকার ও প্রতিহিংসার বশে মানব জাতিকে পর্যুদস্ত করার সংকল্প করে। আল্লাহ তা‘আলা তাঁর সর্বাধিক প্রিয় মানব প্রতিনিধির উপর অগাধ ও অকৃত্রিম ভালবাসার ঘোষণা দিয়ে শয়তানের মানব শরীরে প্রবেশ ও কিয়ামত অবধি জীবন লাভের আকাঙ্ক্ষা অনুমোদন করলেন। ফলে আকাঙ্ক্ষার মধ্যে দোষণীয় উপাদান যা মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকারক, তা অনায়াসে স্থান পেয়ে গেল। ভাল ও মন্দ, আকাঙ্ক্ষা ও উচ্চাকাঙ্ক্ষা একই হৃদয়ে অবস্থান করার অসাধারণ নৈপুণ্যের জন্যই অধিকাংশ মানুষ হতবিহবল ও সিদ্ধান্তহীনতায় হাবুডুবু খায়। তবে এ থেকে আত্মরক্ষা করার মত সুন্দর উপাদান ও জ্ঞান মানব হৃদয়ের গোপন কোটরে পরিব্যাপ্ত।
কিন্তু কথা হ’ল মহান আল্লাহর অসীম আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন মানব সৃষ্টির তীব্র বিরোধিতায় ইবলীসের ক্ষুদ্র আকাঙ্ক্ষার ভূমিকার বিষয়টিও সর্বজ্ঞানী আল্লাহর অজানা ছিল না। তিনি ইচ্ছা করলে ইবলীসের এ আকাঙ্ক্ষা অংকুরেই বিনষ্ট করে দিতে পারতেন। কিন্তু তাঁর সৃষ্ট যাবতীয় ভান্ডারের মধ্যে সর্বনিম্নে অবস্থানরত নিকৃষ্টতম এক মূল্যহীন ভান্ডারের প্রতি ইবলীসের দৃষ্টি আকর্ষণ আল্লাহর অসন্তোষ সৃষ্টি করে। কারণ আল্লাহর অগণিত মহামূল্যবান নে‘মত ভান্ডার সমূহ সম্বন্ধে ইবলীস সবই জানতো এবং সেখানেই ছিল তার আবাসস্থল। অথচ মানুষ মাটি হ’তে তৈরী সেই প্রতিহিংসায় তার বিরোধিতার জন্য আল্লাহর আদেশ অমান্য করে নিকৃষ্ট ও চির অশান্তির ভান্ডারের প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। অতঃপর অনুতপ্ত না হয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিল যে, অধিকাংশ মানুষই তার দলে যোগদান করবে। ইবলীসের এই সীমালংঘন আল্লাহর মহা অসন্তোষকে চিরস্থায়ী রূপ দান করল। সর্বশক্তিমান আল্লাহ তা‘আলা ঘোষণা দিলেন, ইবলীস ও তার অনুসারীরা চির লাঞ্চিত, তারা অনন্তকাল মহা শাস্তিযোগ্য জাহান্নামে বসবাস করবে।
পৃথিবীর বুকে যারা নিজেকে মুসলমান বলে দাবী করছে বা পরিচয় দিচ্ছে তারা অবশ্যই পবিত্র কুরআনে বিশ্বাসী। মানবজাতিকে জ্ঞানদান ও আত্মমর্যাদা দানের জন্য আল্লাহ তা‘আলা তাঁর আকাঙ্ক্ষা হ’তে মানব সৃষ্টির বিষয়টি পবিত্র কুরআনে বর্ণনা করেছেন। এতদসঙ্গে ইবলীসের দুঃসাহসিক আকাঙ্ক্ষার বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। নিম্নে সেগুলো সবিস্তার উপস্থাপন করা হ’ল। কুরআনের ধারক ও বাহক রাসূল (ছাঃ)-কে মহান আল্লাহ প্রত্যাদেশ করেন, ‘তোমার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদেরকে বললেন, আমি পৃথিবীতে একজন প্রতিনিধি বানাতে যাচ্ছি, তখন ফেরেশতাগণ বললেন, আপনি কি পৃথিবীতে এমন কাউকে সৃষ্টি করবেন, যে দাঙ্গা-হাঙ্গামার সৃষ্টি করবে এবং রক্তপাত ঘটাবে? অথচ আমরা নিয়ত আপনার গুণকীর্তন করছি এবং আপনার পবিত্র সত্তাকে স্মরণ করছি। আল্লাহ বললেন, নিঃসন্দেহে আমি জানি, যা তোমরা জান না। আর আল্লাহ তা‘আলা শিখালেন আদমকে সমস্ত বস্ত্ত-সামগ্রীর নাম। তারপর সেসব বস্ত্ত সামগ্রীকে ফেরেশতাদের সামনে উপস্থাপন করলেন। অতঃপর বললেন, আমাকে তোমরা এগুলোর নাম বলে দাও, যদি তোমরা সত্যবাদী হয়ে থাক। তাঁরা (ফেরেশতারা) বললেন, আপনি পবিত্র। আমরা কোন কিছুই জানি না, তবে আপনি আমাদেরকে যা শিখিয়েছেন (সেগুলো ব্যতীত)। নিশ্চয়ই আপনিই প্রকৃত জ্ঞানসম্পন্ন, হেকমত ওয়ালা। তিনি বললেন, হে আদম! ফেরেশতাদেরকে বলে দাও এসবের নাম। তারপর যখন তিনি বলে দিলেন সে সবের নাম, তখন আল্লাহ বললেন, আমি কি তোমাদেরকে বলিনি যে, আমি আসমান ও যমীনের যাবতীয় গোপন বিষয় সম্পর্কে খুব ভাল করেই অবগত রয়েছি? আর সেসব বিষয় জানি যা তোমরা প্রকাশ কর, আর যা তোমরা গোপন কর। অতঃপর যখন আমি আদমকে সিজদা করার জন্য ফেরেশতাগণকে নির্দেশ দিলাম, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করল। সে নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করল এবং অহংকার প্রদর্শন করল। ফলে সে কাফেরদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল এবং আমি আদমকে হুকুম করলাম যে, তুমি ও তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস করতে থাক এবং ওখানে যা চাও, পরিতৃপ্তিসহ খেতে থাক। কিন্তু এ গাছের নিকটবর্তী হয়ো না। অন্যথা তোমরা যালিমদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে। অনন্তর ইবলীস তাদের উভয়কে ওখান থেকে পদস্খলিত করেছিল। পরে তারা যে সুখ-সাচ্ছন্দ্যে ছিল তা থেকে তাদেরকে বের করে দিল এবং আমি বললাম, তোমরা নেমে যাও। তোমরা পরস্পর একে অপরের শত্রু হবে এবং তোমাদেরকে সেখানে কিছুকাল অবস্থান করতে হবে ও লাভ সংগ্রহ করতে হবে। অতঃপর আদম স্বীয় পালনকর্তার কাছ থেকে কয়েকটি কথা শিখে নিল, অতঃপর আল্লাহপাক তাঁর প্রতি করুণা ভরে লক্ষ্য করলেন। নিশ্চয়ই তিনি মহাক্ষমাশীল ও অসীম দয়ালু। আমি হুকুম করলাম, তোমরা সবাই নীচে নেমে যাও। অতঃপর যদি তোমাদের নিকট আমার পক্ষ থেকে কোন হেদায়াত পৌঁছে, তবে যে ব্যক্তি আমার সে হেদায়াত অনুসারে চলবে, তার উপর না কোন ভয় আসবে, না (কোন কারণে) তারা চিন্তাগ্রস্ত ও সন্ত্রস্ত হবে। আর যে লোক তা অস্বীকার করবে এবং আমার নিদর্শনগুলোকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করার প্রয়াস পাবে, তারাই হবে জাহান্নামবাসী, অনন্তকাল তারা সেখানে থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/৩০-৩৯)।
মানব সৃষ্টির অপর এক বর্ণনায় মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি, এরপর আকার-অবয়ব তৈরী করেছি। অতঃপর আমি ফেরেশতাদেরকে বলেছি, আদমকে সিজদা কর, তখন সবাই সিজদা করেছে, কিন্তু ইবলীস সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। আল্লাহ বললেন, আমি যখন নির্দেশ দিয়েছি, তখন তোকে কিসে সিজদা করতে বারণ করল? সে বলল, আমি তার চাইতে শ্রেষ্ঠ। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। আল্লাহ বললেন, তুই এখান থেকে বের হয়ে যা! এখানে অহংকার করার কোন অধিকার তোর নেই। অতএব তুই বের হয়ে যা। তুই হীনতমদের অন্তর্ভুক্ত। সে বলল, আমাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন, তোকে সময় দেয়া হ’ল। সে বলল, আপনি আমাকে যেমন উদভ্রান্ত করেছেন, আমিও অবশ্য তাদের জন্যে আপনার সরল পথে বসে থাকব। এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বামদিক থেকে। আপনি তাদের অধিকাংশকে কৃতজ্ঞ পাবেন না। আল্লাহ বললেন, বের হয়ে যা এখান থেকে লাঞ্ছিত ও অপমানিত হয়ে। তাদের যে কেউ তার পথে চলবে, নিশ্চয়ই আমি তোদের সবার দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করে দেব। হে আদম! তুমি এবং তোমার স্ত্রী জান্নাতে বসবাস কর। অতঃপর সেখান থেকে যা ইচ্ছা খাও, তবে এ বৃক্ষের কাছে যেও না। তাহ’লে তোমরা গোনাহগার হয়ে যাবে। অতঃপর শয়তান উভয়কে প্ররোচিত করল, যাতে তাদের অঙ্গ, যা তাদের কাছে গোপন ছিল, তাদের সামনে প্রকাশ করে দেয়। সে বলল, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করেননি, তবে তা এ কারণে যে, তোমরা না আবার ফেরেশতা হয়ে যাও কিংবা হয়ে যাও চিরকাল বসবাসকারী। সে তাঁদের কাছে কসম খেয়ে বলল, আমি অবশ্যই তোমাদের হিতাকাঙ্ক্ষী। অতঃপর প্রতারণাপূর্বক তাঁদেরকে সম্মত করে ফেলল। অনন্তর যখন তাঁরা বৃক্ষ আস্বাদন করলেন, তখন তাঁদের লজ্জাস্থান তাঁদের সামনে খুলে গেল এবং তাঁরা নিজের উপর জান্নাতের পাতা জড়াতে লাগলেন। তাঁদের প্রতিপালক তাঁদেরকে ডেকে বললেন, আমি কি তোমাদেরকে এ বৃক্ষ থেকে নিষেধ করিনি এবং বলিনি যে, শয়তান তোমাদের প্রকাশ্য শত্রু? তাঁরা উভয়ে বললেন, হে আমাদের প্রতিপালক! আমরা নিজেদের প্রতি যুলুম করেছি। যদি আপনি আমাদেরকে ক্ষমা না করেন এবং আমাদের প্রতি অনুগ্রহ না করেন, তবে আমরা অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যাব। আল্লাহ বললেন, তোমরা নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। তোমাদের জন্য পৃথিবীতে বাসস্থান আছে এবং একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত ফলভোগ আছে। তোমরা সেখানেই জীবিত থাকবে, সেখানেই মৃত্যুবরণ করবে এবং সেখান থেকেই পুনরুত্থিত হবে। হে বনী আদম! আমি তোমাদের জন্যে পোশাক অবতীর্ণ করেছি, যা তোমাদের লজ্জাস্থান আবৃত করে এবং অবতীর্ণ করেছি সাজ-সজ্জার বস্ত্র এবং তাক্বওয়ার পোশাক, এটি সর্বোত্তম। এটি আল্লাহর কুদরতের অন্যতম নিদর্শন, যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে। হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে, যেমন সে তোমাদের পিতা-মাতাকে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে এমতাবস্থায় যে, তাদের পোশাক তাদের থেকে খুলিয়ে দিয়েছে, যাতে তাদেরকে লজ্জাস্থান দেখিয়ে দেয়। সে এবং তার দলবল তোমাদেরকে দেখে, সেখান থেকে তোমরা তাদেরকে দেখ না। আমি শয়তানদেরকে তাদের বন্ধু করে দিয়েছি, যারা বিশ্বাস স্থাপন করে না’ (আ‘রাফ ৭/১১-২৭)।
মানব জাতিকে তার সৃষ্টি রহস্যের বিশদ বিরণ হৃদয়ঙ্গম করার প্রয়াসে সূরা হিজর-এর মধ্যে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘আপনার পালনকর্তা যখন ফেরেশতাদের বললেন, আমি পচা কর্দম থেকে তৈরী বিশুষ্ক ঠনঠনে মাটি দ্বারা সৃষ্ট একটি মানব জাতির পত্তন করব। অতঃপর যখন তাকে ঠিকঠাক করে নেব এবং তাতে আমার রূহ থেকে ফুঁক দেব, তখন তোমরা তার সামনে সিজদায় পড়ে যাবে। তখন ফেরেশতারা সবাই মিলে সিজদা করল। কিন্তু ইবলীস সে সিজদাকারীদের অন্তর্ভুক্ত হ’তে স্বীকৃত হ’ল না। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! তোমার কি হ’ল যে তুমি সিজদাকারীদের অন্তর্ভূক্ত হ’তে স্বীকৃত হ’লে না? সে বলল, আমি এমন নই যে, একজন মানবকে সিজদা করব, যাকে আপনি পচা কর্দম থেকে তৈরী ঠনঠনে বিশুষ্ক মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বললেন, তবে তুমি এখান থেকে বের হয়ে যাও। তুমি বিতাড়িত এবং তোমার প্রতি ন্যায়বিচারের দিন পর্যন্ত অভিসম্পাত। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন, তোমাকে অবকাশ দেয়া হল, সেই অবধারিত সময় উপস্থিত হওয়ার দিন পর্যন্ত। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা, আপনি যেমন আমাকে পথভ্রষ্ট করেছেন, আমিও তাদের সবাইকে পথভ্রষ্ট করে দেব, আপনার মনোনীত বান্দাদের ব্যতীত। আল্লাহ বললেন, এটা আমার পর্যন্ত সোজা পথ। যারা আমার বান্দা, তাদের উপর তোমার কোন ক্ষমতা নেই। কিন্তু পথভ্রান্তদের মধ্য থেকে যারা তোমার পথে চলে, তাদের সবার স্থান হচ্ছে জাহান্নাম। এর সাতটি দরজা আছে। প্রত্যেক দরজার জন্যে এক-একটি পৃথক দল আছে। নিশ্চয়ই আল্লাহভীরুরা বাগান ও নির্ঝরিণীসমূহে থাকবে’ (হিজর ১৫/২৮-৪৫)।
আলোচ্য বিষয়কে আরও সহজবোধ্য করার জন্য আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনের অন্য আয়াতে বলেন, ‘স্মরণ করুন, যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম, আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদায় পড়ে গেল। কিন্তু সে বলল, আমি কি এমন ব্যক্তিকে সিজদা করব, যাকে আপনি মাটি দ্বারা সৃষ্টি করেছেন? সে বলল, দেখুন তো, এ না সে ব্যক্তি যাকে আপনি আমার চাইতেও উচ্চ মর্যাদা দিয়ে দিয়েছেন। যদি আপনি আমাকে কিয়ামত দিবস পর্যন্ত সময় দেন, তবে আমি সামান্য সংখ্যক ছাড়া তার বংশধরকে সমূলে নষ্ট করে দেব। আল্লাহ বললেন, চলে যা, অতঃপর তাদের মধ্য থেকে যে তোর অনুগামী হবে, জাহান্নামই হবে তাদের সবার শাস্তি ভরপুর শাস্তি। তুই সত্যচুত্য করে তাদের মধ্য থেকে যাকে পারিস স্বীয় আওয়ায দ্বারা, স্বীয় অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনী নিয়ে তাদেরকে আক্রমণ কর, তাদের অর্থ-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততিতে শরীক হয়ে যা এবং তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দে। ছলনা ছাড়া শয়তান তাদেরকে কোন প্রতিশ্রুতি দেয় না। আমার বান্দাদের উপর তোর কোন ক্ষমতা নেই, আপনার পালকর্তা যথেষ্ট কার্যনির্বাহী’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৬১-৬৫)।
ইবলীসের প্রকৃত পরিচয় সম্বলিত এক আয়াতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যখন আমি ফেরেশতাদের বললাম আদমকে সিজদা কর, তখন সবাই সিজদা করল ইবলীস ব্যতীত। সে ছিল জিনদের একজন। সে তার পালনকর্তার আদেশ অমান্য করল। অতএব তোমরা কি আমার পরিবর্তে তাকে এবং তার বংশধরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করছ? অথচ তারা তোমাদের শত্রু। এটা যালেমদের জন্য খুবই নিকৃষ্ট বদলা’ (কাহফ ১৮/৫০)।
মানব জাতিকে তার আশা-আকাঙ্ক্ষা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা নিরূপণে মিথ্যাবাদী ও অহংকারী শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ না করে মহান স্রষ্টার উদাত্ত ও প্রেমময় আহবানের প্রতি আত্মসমর্পণের নির্ভুল পদক্ষেপ গ্রহণের সম্মানীয় প্রত্যাদেশ করা হয়। এখানে মহান আল্লাহ বলেন, ‘আমি ইতিপূর্বে আদমকে নির্দেশ দিয়েছিলাম, অতঃপর সে ভুলে গিয়েছিল এবং আমি তার মধ্যে দৃঢ়তা পাইনি। যখন আমি ফেরেশতাদেরকে বললাম, তোমরা আদমকে সিজদা কর, তখন ইবলীস ব্যতীত সবাই সিজদা করল, সে অমান্য করল। অতঃপর আমি বললাম, হে আদম! এ তোমার ও তোমার স্ত্রীর শত্রু। সুতরাং সে যেন বের করে না দেয় তোমাদের জান্নাত থেকে। তাহ’লে তোমরা কষ্টে পতিত হবে। তোমাকে এই দেয়া হ’ল যে, তুমি এতে ক্ষুধার্ত হবে না এবং রেŠদ্রেও কষ্ট পাবে না। অতঃপর শয়তান তাকে কুমন্ত্রণা দিল, বলল, হে আদম! আমি কি তোমাকে বলে দেব অনন্তকাল জীবিত থাকার বৃক্ষের কথা এবং অবিনশ্বর রাজত্বের কথা? অতঃপর তারা উভয়েই এর ফল ভক্ষণ করল, তখন তাদের সামনে তাদের লজ্জাস্থান খুলে গেল এবং তারা জান্নাতের বৃক্ষপত্র দ্বারা নিজদেরকে আবৃত করতে শুরু করে দিল। আদম তার পালনকর্তার অবাধ্যতা করল। ফলে সে পথভ্রান্ত হয়ে গেল। এরপর তার পালনকর্তা তাকে মনোনীত করলেন, তার প্রতি ক্ষমাপরায়ণ হ’লেন এবং তাকে সুপথে আনয়ন করলেন। তিনি বললেন, তোমরা উভয়েই এখান থেকে এক সঙ্গে নেমে যাও। তোমরা একে অপরের শত্রু। এরপর যদি আমার পক্ষ থেকে তোমাদের কাছে হেদায়াত আসে, তখন যে আমার বর্ণিত পথ অনুসরণ করবে, সে পথভ্রষ্ট হবে না এবং কষ্টে পতিত হবে না। আর যে আমার স্মরণ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, তার জীবিকা সংকীর্ণ হবে এবং আমি তাকে কিয়ামতের দিন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করব। সে বলবে, হে আমার পালনকর্তা! আমাকে কেন অন্ধ অবস্থায় উত্থিত করলেন, আমি তো চক্ষুষ্মান ছিলাম। আল্লাহ বলবেন, এমনিভাবে তোমার কাছে আমার আয়াত সমূহ এসেছিল, অতঃপর তুমি সেগুলো ভুলে গিয়েছিলে। তেমনিভাবে আজ তুমিও বিস্মৃত হ’লে’ (ত্বোয়া-হা ২০/১১৫-১২৫)।
মানব জাতিকে সঠিক পথে প্রতিষ্ঠিত থাকার জন্যে আল্লাহ তা‘আলা বার বার তাঁর সৃষ্টির অভিন্ন কাহিনী বর্ণনা করেছেন তাঁর অমূল্য মহাবাণীর বিশাল কলেবরে। এই বিস্ময়কর বর্ণনা অন্যত্র আল্লাহ এভাবে উল্লেখ করেন, ‘যখন আপনার পালনকর্তা ফেরেশতাগণকে বললেন, আমি মাটির মানুষ সৃষ্টি করব। যখন আমি তাকে সুষম করব এবং তাতে আমার রূহ ফুঁকে দেব, তখন তোমরা তার সম্মুখে সিজদায় নত হয়ে যেয়ো। অতঃপর সমস্ত ফেরেশতাই একযোগে সিজদায় নত হ’ল। কিন্তু ইবলীস, সে অহংকার করল এবং অস্বীকারকারীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। আল্লাহ বললেন, হে ইবলীস! আমি স্বহস্তে যাকে সৃষ্টি করেছি, তার সম্মুখে সিজদা করতে তোমাকে কিসে বাধা দিল? তুমি অহংকার করলে, না তুমি তার চেয়ে উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন? সে বলল, আমি তার চেয়ে উত্তম। আপনি আমাকে আগুন দ্বারা সৃষ্টি করেছেন, আর তাকে সৃষ্টি করেছেন মাটি দ্বারা। আল্লাহ বললেন, বের হয়ে যা এখান থেকে। কারণ তুই অভিশপ্ত। তোর প্রতি আমার এ অভিশাপ বিচারদিবস পর্যন্ত স্থায়ী হবে। সে বলল, হে আমার পালনকর্তা! আপনি আমাকে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত অবকাশ দিন। আল্লাহ বললেন, তোকে অবকাশ দেয়া হ’ল, সেদিন পর্যন্ত যা জানা। সে বলল, আপনার ইয্যতের কসম! আমি অবশ্যই তাদের সবাইকে বিপথগামী করে দেব। তবে তাদের মধ্যে যারা আপনার খাঁটি বান্দা, তাদেরকে ছাড়া। আল্লাহ বললেন, তাই ঠিক, আর আমি সত্য বলছি, তোর দ্বারা আর তাদের মধ্যে যারা তোর অনুসরণ করবে তাদের দ্বারা জাহান্নাম পূর্ণ করব। বল, আমি তোমাদের কাছে কোন প্রতিদান চাই না, আর আমি লৌকিকতাকারীও নই। এটা তো বিশ্বাসীর জন্যে এক উপদেশ মাত্র। তোমরা কিছুকাল পর এর সংবাদ অবশ্যই জানতে পারবে’ (ছোয়াদ ৩৮/৭১-৮৮)।
[চলবে]
রফীক আহমাদ
শিক্ষক (অবঃ), বিরামপুর, দিনাজপুর।
[1]. মুসলিম হা/২৮৭৭; মিশকাত হা/১৬০৫।
[2]. দারেমী হা/২৭৮৭; ছহীহুল জামে‘ হা/৪৩১৬।
[3]. বুখারী হা/৭৪০৪।
[4]. বুখারী হা/৬০০০।