আসমান হ’তে লোহা নাযিলের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৃষ্টির পানির উপকারিতা

মহিমান্বিত আল-কুরআন হ’ল দুনিয়ার জ্ঞানের মূল উৎস। আল-কুরআনের একটি অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে একটি আয়াতে অনেকগুলো তত্ত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আল-কুরআনের প্রতিটি আয়াতের প্রতিটি শব্দের তাৎপর্য রয়েছে। তেমনি এক আয়াত সম্পর্কে নিম্নে আলোকপাত করা হ’ল। আল্লাহ বলেন,لَقَدْ أَرْسَلْنَا رُسُلَنَا بِالْبَيِّنَاتِ وَأَنْزَلْنَا مَعَهُمُ الْكِتَابَ وَالْمِيزَانَ لِيَقُومَ النَّاسُ بِالْقِسْطِ وَأَنْزَلْنَا الْحَدِيدَ فِيهِ بَأْسٌ شَدِيدٌ وَمَنَافِعُ لِلنَّاسِ وَلِيَعْلَمَ اللهُ مَنْ يَنْصُرُهُ وَرُسُلَهُ بِالْغَيْبِ إِنَّ اللهَ قَوِيٌّ عَزِيزٌ- ‘নিশ্চয়ই আমরা আমাদের রাসূলগণকে সুস্পষ্ট প্রমাণাদিসহ প্রেরণ করেছি এবং তাদের সঙ্গে প্রেরণ করেছি কিতাব ও ন্যায়দন্ড। যাতে মানুষ ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর নাযিল করেছি লৌহ, যাতে আছে প্রচন্ড শক্তি এবং রয়েছে মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ। এটা এজন্য যে, আললাহ জেনে নিবেন কে তাঁকে ও তাঁর রাসূলগণকে না দেখে সাহায্য করে। নিশ্চয়ই আল্লাহ শক্তিমান ও মহা পরাক্রান্ত’ (হাদীদ ৫৭/২৫)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেছেন, ‘লোহা নাযিল করেছেন’। যদি আল্লাহ বলতেন লোহা সৃষ্টি করেছেন বা লোহা মওজূদ রেখেছেন বা লোহা তৈরী করেছেন, তবে উক্ত আয়াত নিয়ে তেমন আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন ছিল না। কেননা লোহাসহ অন্যান্য সকল ধাতু পৃথিবীর অভ্যন্তরেই মওজূদ রয়েছে। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা যেহেতু বলেছেন, লোহা নাযিল করেছেন, তাই অবশ্যই এর তাৎপর্য রয়েছে।

উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেন, এখানে ‘নাযিল’ ক্রিয়াকে নাযিল অর্থেই গ্রহণ করতে হবে, خلقنا বা ‘সৃষ্টি করা’ অর্থে নয়। কেননা আরবরা نزول দ্বারা অবতরণ বুঝত। এর দ্বারা বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, পাহাড়ের উপরে আল্লাহ লোহার খনি প্রস্ত্তত করেছেন। যেখান থেকে সেটি নাযিল হয় বান্দার কল্যাণে (ক্বাসেমী)। এর মধ্যে বিজ্ঞানের একটি অজানা উৎসের সন্ধান রয়েছে। কেননা সাধারণভাবে সবাই জানেন যে, লৌহ ভূগর্ভের খনিতে উৎপন্ন হয়’।[1]

এক্ষণে আমরা দেখব লোহা কোথা থেকে নাযিল হয়। প্রথমে আমরা জেনে নেই লোহার আবিষ্কার সম্পর্কে।

লোহার আবিষ্কার :

প্রত্নতাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করেন যে, প্রাচীন মিশরের হিট্টিরা (আধুনিক তুর্কি) ৫০০০ থেকে ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে লোহা আবিষ্কার করে। এই সময় তারা হাতুড়ি বা ধাতু হাতুড়ি বা ধাক্কা হাতিয়ার এবং অস্ত্র তৈরি করে। তারা উল্কাপিন্ড থেকে এটি খুঁজে বের করে এবং এর আকরিক ব্যবহার করে বর্শা, সরঞ্জাম এবং অন্যান্য ট্রিঙ্কেট তৈরি করত। ২০০০ BCE এবং ১২০০ BCE এর মধ্যে হিট্টিরা লোহা গলানোর জন্য একটি প্রক্রিয়া তৈরি করেছিল।[2]

অর্থাৎ প্রত্নতাত্ত্বিকরা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না কখন লোহা আবিষ্কৃত হয় এবং কখন থেকে এর ব্যবহার শুরু হয়।

লোহা কোথা থেকে এসেছে?

লোহার মূল উৎস হ’ল গ্রহঃলোহা। যা মূলতঃ তারার উপাদানগুলির ফিউশন হ’তে তৈরি হয়। কোটি কোটি বছর পূর্বে সুপারনোভা নামক নক্ষত্রে বিশাল বিস্ফোরণের কারণে উল্কা হিসাবে লোহা পৃথিবীতে আসে।

ফিউশন হ’ল এক ধরনের নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া। কিছু নিউক্লিয়াস নিজেদের মধ্যে বিক্রিয়া করে অপেক্ষাকৃত বড় নিউক্লিয়াস গঠন করার প্রক্রিয়াকে নিউক্লিয়ার ফিউশন বলে। একটি পরমানু কেন্দ্রকে নিউক্লিয়াস বলা হয়। যার মধ্যে রয়েছে দু’টি মৌলিক কণিকা প্রোটন এবং নিউট্রন।

নক্ষত্রের কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হাইড্রোজেন নিঃশেষ হয়ে গেলে নক্ষত্রটি তার ফিউশন বিক্রিয়া শুরু করে। হাইড্রোজেন হিলিয়ামের সাথে ফিউশন বিক্রিয়া করে ভারী উপাদান তৈরি করে। এই প্রক্রিয়া চলতেই থাকে। প্রথমে কার্বন, তারপর নিয়ন, তারপর অক্সিজেন, তারপর সিলিকন, শেষ পর্যন্ত এটি শেষ পণ্য হিসাবে লোহার ছাই তৈরি করে। ফিউশন প্রক্রিয়ায় তাপশক্তি উৎপন্ন হয়। লোহা এবং নিকেলের চেয়ে ভারী উপাদানগুলি গঠিত হয় না। কারণ এদের ফিউশন সংগঠিত হওয়ার জন্য যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা পাওয়া যায় না। যে নক্ষত্রগুলি তাদের জ্বালানী শেষ করে ফেলেছে এবং যখন তারার জীবনকাল শেষ হয়ে যায় তখন তারা সুপারনোভা বিস্ফোরণে বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণের কারণে লোহার টুকরোগুলো মহাকাশের চারপাশে বিস্ফোরিত হয়। লোহার এই টুকরোগুলো উল্কা আকারে পৃথিবীতে আসে।[3]

আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَوْا أَنَّ اللهَ سَخَّرَ لَكُمْ مَا فِي السَّمَاوَاتِ وَمَا فِي الْأَرْضِ وَأَسْبَغَ عَلَيْكُمْ نِعَمَهُ ظَاهِرَةً وَبَاطِنَةً وَمِنَ النَّاسِ مَنْ يُجَادِلُ فِي اللهِ بِغَيْرِ عِلْمٍ وَلَا هُدًى وَلَا كِتَابٍ مُنِيرٍ- ‘তোমরা কি দেখ না, নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে যা কিছু আছে সবকিছুকে আল্লাহ তোমাদের বশীভূত করেছেন এবং তোমাদের প্রতি তাঁর প্রকাশ্য ও গোপন নে‘মত সমূহ পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন? অথচ লোকদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা কোনরূপ জ্ঞান, পথনির্দেশ বা উজ্জ্বল কিতাব ছাড়াই আল্লাহ সম্পর্কে বিতন্ডা করে’ (লোকমান ৩১/২০)

সূরা হাদীদের ২৫নং আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা জানিয়েছেন যে, লোহা নাযিল হয় অর্থাৎ আসমান হ’তে লোহা অবতীর্ণ হয়। সূরা লোকমানের ২০নং আয়াতে আসমান এবং যমীনে যা কিছু আছে তা মানুষের জন্য নিয়োজিত বলা হয়েছে। এক্ষণে আমরা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে জানতে পারলাম যে, মূলতঃ নক্ষত্র হ’তে এই লোহার অবতরণ হয়। অতএব আমরা আল-কুরআনের আরোও একটি আয়াতের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব সম্পর্কে জানতে পারলাম।

পৃথিবীতে কি লোহা তৈরী হওয়া সম্ভব?

আমরা পূর্বেই উল্লেখ করেছি যে, নিউক্লিয়ার ফিউশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তারার সুপারনোভা বিস্ফোরনের মাধ্যমে লোহার উৎপত্তি হয়। লোহা উৎপন্ন হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তাপ এবং চাপের অবস্থা পৃথিবীতে পাওয়া যাবে না। নিউক্লিয়ার ফিউশন বিক্রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় তীব্র চাপ এবং তাপ শুধুমাত্র নক্ষত্রের কোরে বা সুপারনোভার সময় পাওয়া যায়। অতএব এটা মনে করা হয় যে পৃথিবীতে এবং আমাদের সৌরজগতে লোহা পূর্ববর্তী প্রজন্মের নক্ষত্রে গঠিত হয়েছিল এবং পরে গ্রহাণু এবং ধূমকেতুর প্রভাবের মাধ্যমে আমাদের গ্রহে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

ভূ-পৃষ্ঠে লোহার উৎস :

সর্বাধিক বিস্তৃত লোহা বহনকারী খনিজগুলি হ’ল অক্সাইড, এবং লৌহ আকরিক প্রধানত হেমাটাইট দিয়ে গঠিত। যা লাল, ম্যাগনেটাইট যা কালো, লিমোনাইট যা বাদামী এবং সিডেরাইট যা ফ্যাকাশে বাদামী।

হেমাটাইট এবং ম্যাগনেটাইট হ’ল সবচেয়ে সাধারণ ধরনের আকরিক। ভূ-ত্বকে যতগুলো মৌলিক উপাদান পাওয়া যায় লোহা হ’ল তাদের মধ্যে চতুর্থ। পৃথিবীর ভূত্বকের প্রায় সমস্ত লোহা ১.৮ বিলিয়ন বছর পূর্বে জমাট বাধা শিলা হ’তে আসে। যখন থেকে মহাসাগরে বিদ্যমান জীবগুলো সালোক সংশ্লেষণের জন্য অক্সিজেন ছাড়া শুরু করে তখন থেকে পানিতে থাকা লোহা অক্সিজেনের সাথে দ্রবীভূত হয়ে হেমাটাইট এবং ম্যগনেটাইট নামক আকরিকে পরিণত হয়। 

লোহার আকরিক উৎপাদনের পাঁচটি বৃহত্তম রাষ্ট্র হ’ল চীন, ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া ও ইউক্রেন। তবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং কাজাখস্তানও উৎপাদন করে থাকে।

এক সাথে এই নয়টি দেশ বিশ্বের ৮০ শতাংশ লৌহ আকরিক উৎপাদন করে। ব্রাজিল, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ভারত সবচেয়ে বেশী রপ্তানি করে, যদিও সুইডেন, লাইবেরিয়া, ভেনিজুয়েলা, মৌরিতানিয়া এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করে। জাপান, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হ’ল লোহার প্রধান আমদানিকারক।[4]

আল্লাহ বলেন, مَنَافِعُ لِلنَّاسِ (মানুষের জন্য বহুবিধ কল্যাণ)। এই লোহা বহুকাল ধরে মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সভ্যতায় লোহা ছাড়া কোন স্থাপনা কল্পনা করা যায় না।

লোহার ব্যবহার :

প্রায়ই ৯৮ ভাগ লোহার আকরিক ইস্পাত তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। বাকী ২ ভাগ লোহার আকরিক প্রভাবকের জন্য লোহার গুড়া, ঔষধ শিল্পের জন্য তেজষ্ক্রিয় লোহা, এছাড়া রঙ, কালি, প্রসাধনী এবং প্লাস্টিকের মধ্যে লোহার নীল ব্যবহৃত হয়। 

লোহার সাথে কার্বন, নিকেল, ক্রোমিয়াম, ভ্যানাডিয়াম, টংস্টেন এবং ম্যাঙ্গানিজ সংযোজন করে এক ধরনের স্টীল তৈরী করা হয় যা ব্রীজ নির্মাণ, বিদ্যুতের তোরণ, সাইকেলের চেইন, কাটিং টুলস এবং রাইফেলের ব্যারেল তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। কাস্ট আয়রনে ৩-৫% কার্বন থাকে যা পাইপ, ভালভ এবং পাম্প তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। লোহা দ্বারা চুম্বক তৈরী করা যায়। স্টেইনলেস স্টীল যা লোহা, নিকেল, ক্রোমিয়াম দ্বারা গঠিত। যা ছুরি, কাটা চামচ, পাক ঘরের সিংক, রসায়ন শিল্পের বিক্রিয়ার পাত্র, অপারেশনের যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয়।

উপোরক্ত আলোচনায় আমরা আল্লাহ তা‘আলার অনন্য সৃষ্টি সম্পর্কে জানলাম। পৃথিবীতে যতবেশী গবেষণা হচ্ছে আল-কুরআনে বিদ্যমান আসমান এবং যমীন সম্পর্কিত তথ্যসমূহ তত সুস্পষ্ট হচ্ছে এবং তা অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে দলীলে পরিণত হচ্ছে। যা ক্বিয়ামতের দিন তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী হবে। আল-কুরআনের সুস্পষ্ট নিদর্শন দেখার পরও যারা ঈমান আনেনি, তারাই ক্ষতিগ্রস্ত।

বৃষ্টির পানির উপকারিতা

আল কুরআনে আসমান ও যমীনের যতগুলো বস্ত্ত সম্পর্কে নিদর্শন দেওয়া হয়েছে প্রত্যেক বস্ত্ততে দুনিয়াবাসীর জন্য বিবিধ কল্যাণ নিহিত রয়েছে। একজন মুসলিম সেই কল্যাণ স্রেফ আল্লাহ তা‘আলার নির্দেশ মান্য করার মাধ্যমে পেয়ে যায়। কিন্তু একজন আমুসলিমকে সে কল্যাণ পেতে হ’লে বহু গবেষণা করতে হয়। এমনকি তাদের গবেষণার মধ্যে অনেক সময় ভুল তথ্য বের হয়ে আসে। যা অনেকের জন্য অকল্যাণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মুসলিমদের অনেকে তাদের ভুল গবেষণার ফাদে পড়ে আল্লাহর নির্দেশের উপর সন্দেহ পোষণ করে নিজেকে বিপদগামী করে ফেলে। আল্লাহ বলেন, الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلَا تَكُونَنَّ مِنَ الْمُمْتَرِينَ ‘সত্য সেটাই যা তোমার প্রতিপালকের নিকট থেকে আসে। অতএব তুমি অবশ্যই সংশয়বাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (বাক্বারাহ ২/১৪৭)

বর্তমান সময়ে সংশয়কারীরা আল-কুরআনের বিরুদ্ধে মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরী করার জন্য যে শাস্ত্রকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছে তা হ’ল বিজ্ঞান। আমাদের রবের পক্ষ থেকে আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা ঘোষণা করেছেন যে, এই কিতাবে কোনরূপ সংশয় নেই, কোনরূপ সন্দেহ নেই। আল্লাহ বলেন, ذَلِكَ الْكِتَابُ لَا رَيْبَ فِيهِ هُدًى لِلْمُتَّقِينَ ‘এই কিতাব, যাতে কোনই সন্দেহ নেই। যা আল্লাহভীরুদের জন্য পথ প্রদর্শক’ (বাক্বারাহ ২/২)

আল-কুরআনের উপর আমাদের ঈমানকে আরো দৃঢ় করার জন্য, সংশয়মুক্ত রাখার জন্য কুরআন নিয়ে গবেষণা করতে হবে। ফলে আল-কুরআন হ’তে এমন তথ্য বের হবে, যা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের বের করতে বছরের পর বছর লেগেছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে আল-কুরআনের বৈজ্ঞানিক তথ্য মানুষের নিকট তুলে ধরা। এতে মানুষের দুনিয়াবী কল্যাণ হবে এবং মানুষ কুরআনের দাওয়াত গ্রহণ করবে।

আমরা আমাদের ধারাবাহিক বিবরণে আল-কুরআনে বিদ্যমান বিজ্ঞানের বিভিন্ন তথ্যাদি বৈজ্ঞানিক গবেষণাসহ প্রকাশ করার চেষ্টা করছি। এ পর্যায়ে আমরা বৃষ্টির পানির উপকারিতা জানার চেষ্টা করব।

আমরা বিভিন্ন উৎস থেকে পানি পেয়ে থাকি যথা- নদী, পুকুর, খাল-বিল, সমুদ্র এবং আসমান হ’তে বৃষ্টির পানি। আল্লাহ বলেন,وَنَزَّلْنَا مِنَ السَّمَاءِ مَاءً مُبَارَكًا فَأَنْبَتْنَا بِهِ جَنَّاتٍ وَحَبَّ الْحَصِيدِ، ‘আর আমরা আকাশ থেকে বরকতময় বৃষ্টি বর্ষণ করি। অতঃপর তার মাধ্যমে বাগান ও শস্য বীজ উদ্গত করি’ (ক্বা-ফ ৫০/৯)

আল্লাহু সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা উক্ত আয়াতে বৃষ্টির পানিকে বরকতময় বলেছেন এবং আরো জানিয়েছেন তা দ্বারা গাছপালার বর্ধন এবং শস্যদানা উৎপাদন করা যায়। এখন প্রশ্ন হ’ল- পানির বিভিন্ন উৎস থাকার পরও বৃষ্টির পানিকে কেন বরকতময় বলা হয়েছে? কেন এই পানি গাছপালা এবং শস্যদানা উৎপাদনের জন্য উপকারী?

বৃষ্টির পানি হ’ল স্থলভাগের বিভিন্ন অংশের পানি যেমন- সমুদ্র, নদী, পুকুর ইত্যাদির পানি বাষ্পীভূত হয়ে আসমানে মেঘ হিসাবে জমা হয় এবং পরবর্তীতে বৃষ্টি আকারে ঝরে পড়ে। এখন প্রশ্ন হ’ল এই বৃষ্টির পানি কি বিশুদ্ধ? গবেষণায় জানা গেছে যে, যত ধরনের উৎস হ’তে পানি পাওয়া যায় তার মধ্যে বৃষ্টির পানি হচ্ছে সবচেয়ে বেশী বিশুদ্ধ। কিন্তু যখন বৃষ্টির পানি পৃথিবীতে নেমে আসে তখন বায়ুমন্ডলে বিদ্যমান কার্বনডাই অক্সাইডের সাথে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিডে পরিণত হয় এবং যখন বৃষ্টির ফোটা তৈরী হয় তখন বায়ুতে বিদ্যমান ধুলিকণা এবং বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া এর সাথে যুক্ত হয়। এই কারণে বৃষ্টির পানি সরাসরি পান করা উচিত নয়।

বৃষ্টির পানির উপাদান সমূহ : বৃষ্টির পানি হ’ল একটি মিশ্র তড়িত বিশেষ্য (অর্থাৎ যার মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধান বিদ্যমান) যা বিভিন্ন ধরনের আয়রণ সরবরাহ করে থাকে। যথা- সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, ক্লোরাইড, বাইকার্বোনেট, সালফেট আয়রণ হ’ল প্রধান উপাদান যা অ্যামোনিয়া, নাইট্রেট, নাইট্রাইট, নাইট্রোজেন এবং অন্যান্য নাইট্রোজেন গঠিত যৌগ হিসাবে থাকে।[5]

বৃষ্টির পানি কিভাবে বাগ-বাগিচা এবং শস্যদানা উৎপাদনে কার্যকরী?

বৃষ্টির পানির দ্বারা বাগ-বাগিচা এবং শস্যদানার দ্রুত বর্ধন হয়। বৃষ্টির পানির মধ্যে থাকা উপরে বর্ণিত নাইট্রোজেন গঠিত যৌগসমূহ হ’ল এর প্রধান কারণ। বৃষ্টির পানিতে অন্যান্য পানির তুলনায় বেশী পরিমাণে অক্সিজেন থাকে এবং এটি গাছগুলিকে পরিপূর্ণ এবং উজ্জ্বল হ’তে সাহায্য করে। বৃষ্টি হ’লে বায়ুমন্ডলে থাকা কার্বনডাই অক্সাইড ভূমিতে নেমে আসে, যা সালোক সংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় উদ্ভিদের খাদ্য তৈরীতে ব্যবহৃত হয়। একবার কার্বনডাই অক্সাইড মাটিতে পৌঁছালে, এটি গাছের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টি তৈরি করতে সাহায্য করতে পারে। বৃষ্টির পানি সাধারণত বাগানের সকল স্থানে সমভাবে পতিত হয় তাই মাটির সকল অংশে রাসায়নিক উপাদানসমূহ সমভাবে গৃহীত হয়। এছাড়া বৃষ্টির পানি বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকারক উপাদান, ধূলিকণা এবং বিভিন্ন ধরনের দূষক ধুয়ে ফেলে যা গাছের পাতা দ্বারা ঢাকা থাকে।[6]

মাটিতে শস্য উৎপাদন করার জন্য মাটির pH 5.5 হ’তে ৬.৫ হ’তে হয়। কিন্তু আমরা যে পাইপের পানি ব্যবহার করি তার pH 8.5 হ’তে 10.5 হয়, যা শস্যের জন্য ক্ষতিকারক। অপরদিকে বৃষ্টির পানি সামান্য এসিডিয় হওয়ায় এর pH 7-এর নীচে থাকে, যা শস্য উৎপাদনের জন্য উপকারী। জেনে রাখা ভালো যে, কোন কিছুর pH 7-এর কম হ’লে তা এসিডিয় এবং 7-এর বেশী হ’লে তা ক্ষারীয়। বৃষ্টির পানিতে প্রয়োজনীয় পরিমাণে কার্বন থাকে, যা গাছের চারপাশের মাটিতে উপস্থিত মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টকে উন্মুক্ত করতে সাহায্য করে। এই মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্ট হ’তে পারে জিঙ্ক, ম্যাঙ্গানিজ, কপার এবং ম্যাগনেসিয়াম। এই প্রয়োজনীয় মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টগুলি গাছের দ্রুত বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বৃষ্টির পানিতে নাইট্রোজেন গঠিত যৌগ থাকার কারণে গাছের বৃদ্ধি বেশী হয় এবং অত্যধিক সবুজ হয়। এই কারণে আমরা বর্ষাকালে গাছের পাতা অত্যধিক সবুজ দেখতে পাই।[7]

বৃষ্টির পানি মানুষের শরীরের জন্য কেন উপকারী?

বৃষ্টির পানি যেভাবে গাছপাল এবং শস্যদানা উৎপাদনের জন্য বরকতময়, তদ্রূপ বৃষ্টির পানি মানুষের শরীরে লাগলে বিবিধ উপকার সাধিত হয়। আনাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,أَصَابَنَا وَنَحْنُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صلّى الله عليه وسلم مَطَرٌ فَخَرَجَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَحَسَرَ ثَوْبَهُ عَنْهُ حَتَّى أَصَابَهُ، فَقُلْنَا: يَا رَسُولَ اللهِ، لِمَ صَنَعْتَ هَذَا؟ قَالَ: لِأَنَّهُ حَدِيثُ عَهْدٍ بِرَبِّهِ، ‘একদা আমরা রাসূলুললাহ (ছাঃ)-এর সঙ্গে থাকাবস্থায় বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়। তিনি বাইরে বেরিয়ে যান এবং শরীর থেকে কাপড় খুলে ফেলেন, যাতে বৃষ্টির পানি তাঁর শরীরে পড়ে। তখন আমরা তাঁকে জিজ্ঞেস করি, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি এরূপ কেন করলেন। তখন তিনি বলেন, এ বৃষ্টি এখনই তার রবের পক্ষ থেকে বর্ষিত হচ্ছে’।[8]

বৃষ্টির পানিতে রাসায়নিক দ্রব্য এবং খনিজ উপাদান কম থাকায় এই পানি শরীরের জন্য উপকারী। গবেষণায় দেখা গেছে, বৃষ্টির পানিতে পাওয়া অণুজীবগুলি মানবদেহে ভিটামিন বি-১২ উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করতে পারে, যার ফলে এটি স্বাস্থ্যকর কোষের বৃদ্ধি, ত্বকের হাইড্রেশন উন্নত করতে এবং ত্বকের জ্বালাপোড়ার ঝুঁকি কমাতে একটি দুর্দান্ত উপায় হিসাবে কাজ করে।

বৃষ্টির পানি শুধু শারীরিক উপকার করে না, মানসিক উপকারও সাধন করে। গবেষণায় জানা গেছে যে, বৃষ্টির পানি যখন মুখে পড়ে তখন বৃষ্টির পানির শিথিলতার প্রভাব মানুষের অন্তরের উপর পড়ে। এর ফলে এন্ডোরফিন এবং সেরোটোনিন নামক হরমোন নিঃসরনের অবস্থা তৈরী হয়।

এগুলি আনন্দ হরমোন হিসাবে পরিচিত, যা সুখ এবং আনন্দের জন্য দায়ী। মেজাযের এই স্বাভাবিক বৃদ্ধি মানুষকে বিবিধ উদ্বেগ থেকে বিরত থাকতে সহায়তা করতে পারে।[9]

আমরা উপরোক্ত আলোচনা হ’তে জানতে পারলাম বৃষ্টির পানির বিভিন্ন উপকার সম্পর্কে। আল্লাহ তা‘আলা বৃষ্টির পানিকে বরকতময় করেছেন এবং এর দ্বারা বাগ-বাগিচা এবং শস্যদানা উৎপাদন করেন। আমরা জানতে পারলাম এই বৃষ্টির পানি মানব জীবনের জন্য কতটা কল্যাণকর। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বৃষ্টির পানি শরীরে লাগাতেন। অবশ্যই রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) অনর্থক কোন কাজ করেননি। এই বৃষ্টির পানি আমাদের শরীরের বিবিধ উপকার সাধন করে। অতএব আমরা যদি কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের যাথাযথ অনুসরণ করি, তবে বিনিময়ে পরকালে লাভ করব আল্লাহর সন্তুষ্টি এবং ইহকালে লাভ করব শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ একটি জীবন। আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন- আমীন!!


[1]. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, তাফসীরুল কুরআন, ২৬-২৮ পারা, পৃ-৩৭৩

[2]. History of Iron Castiong part-1 by C.A.Lawton.

[3]. Characteristics of Terrestrial Planets" by John Chambers

[4]. Ores, Britannica.

[5]. Rainwater as a Chemical Agent of Geologic Processes A ReviewBy DOROTHY CARROLL, page-3.

[6]. spectrumnews 04,dec, 2023.

[7]. Bonasila, 25, sept, 2021.

[8]. আবুদাউদ হা/৫০১২

[9]. healthians, 20 july, 2023.






বিষয়সমূহ: বিধি-বিধান
আল-কুরআনে কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পানি ও সূর্যের তরঙ্গচক্র - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ঘুমের কতিপয় সুন্নাতী পদ্ধতি ও আধুনিক বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
কুরআন বলছে আসমানে কোন ফাটল নেই; বিজ্ঞান কি বলে? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষ কি কৃত্রিম বৃষ্টি (ক্লাউড সিডিং) ঘটাতে সক্ষম? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আসমান ও যমীনের মাঝে বিদ্যমান পরিমাপ সমূহ - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আসমান হ’তে লোহা নাযিলের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৃষ্টির পানির উপকারিতা - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
সূর্যের চারিদিকে গ্রহের সুশৃংখল গঠন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ভাষা জ্ঞান মানবজাতির জন্য আল্লাহর অনন্য নিদর্শন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
রক্ত ও মৃত জন্তুর গোশত ভক্ষণ হারাম হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
পৃথিবীতে মানুষের আগমন নিয়ে আল-কুরআনের পথে বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
চন্দ্র দিয়ে মাস এবং সূর্য দিয়ে দিন গণনা : মহান আল্লাহর এক অনন্য বিধান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আছহাবে কাহফের ঘটনায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আরও
আরও
.