আল-কুরআনে বিগত জাতির বিভিন্ন ঘটনা বর্ণিত হয়েছে, যা হ’তে আমরা বিবিধ শিক্ষা গ্রহণ করি এবং যেসকল কারণে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছিল এবং তাদের আযাব দেওয়া হয়েছিল তা থেকে আমরা সতর্ক হ’তে পারি। আল্লাহ তা‘আলা এই সকল ঘটনার মধ্যে এই দুনিয়া পরিচালনার বিভিন্ন তত্ত্ব দিয়ে রেখেছেন, যার মাধ্যমে আমরা দুনিয়ার রহস্য সম্পর্কে জানতে পারি এবং তা দ্বারা নানা উপকার লাভ করতে পারি। তদ্রূপ আল্লাহ তা‘আলা সূরা কাহফে গুহাবাসীর ঘটনা বর্ণনা করেছেন, যা আছহাবে কাহফ নামে পরিচিত। এই ঘটনায় আমাদের জন্য বিশেষ করে যুবকদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশিকা রয়েছে, যা আমরা বিভিন্ন তাফসীর অধ্যয়ন করে জানতে পারি। উক্ত আয়াতগুলোতে আল্লাহ তা‘আলা কিছু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব প্রদান করেছেন যা আমাদের শরীর সুস্থ রাখার জন্য এবং পরিবেশ বিশুদ্ধ রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রবন্ধে সূরা কাহফের ঐ সকল আয়াত সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে যাতে বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব রয়েছে। আল্লাহ বলেন,إِذْ أَوَى الْفِتْيَةُ إِلَى الْكَهْفِ فَقَالُوا رَبَّنَا آتِنَا مِنْ لَدُنْكَ رَحْمَةً وَهَيِّئْ لَنَا مِنْ أَمْرِنَا رَشَدًا، ‘যখন কয়েকজন যুবক একটি গুহায় আশ্রয় নিল। অতঃপর তারা বলল, হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদেরকে নিজের পক্ষ হ’তে বিশেষ অনুগ্রহ দান কর এবং আমাদের কার্যাদি সঠিকভাবে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে দাও’ (কাহফ ১৮/১০)। তিনি আরো বলেন, فَضَرَبْنَا عَلَى آذَانِهِمْ فِي الْكَهْفِ سِنِينَ عَدَدًا، ‘অতঃপর আমরা তাদেরকে উক্ত গুহায় বহু বছর গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন রাখলাম’ (কাহফ ১৮/১১)।
উল্লেখ্য, গভীর ঘুমের সময় চোখ-কানও ঘুমিয়ে থাকে। কানের তো কথাই নেই। অনেক সময় হাযার ডাকাডাকিতেও ঘুম ভাঙে না, যাকে বলে বেঘোরে ঘুম। তাহ’লে বিজ্ঞানীরা কেন এক কান জেগে থাকার কথা বললেন? এটা এল কোথা থেকে? আসলে বিজ্ঞানীরা তাদের গবেষণায় দেখেছেন যে, নতুন বা অপরিচিত জায়গায় সহজে ঘুম আসে না। সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। পরীক্ষায় দেখা গেছে, এ সময় ডান কান জেগে থাকে। আসুন দেখি, শরীর ও মস্তিষ্কবিষয়ক বিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে কি বলেন।
১. অপরিচিত পরিবেশে মস্তিষ্কের বাম পাশের কিছু অংশ জেগে পাহারা দেয়, অন্য পাশ গভীর ঘুমে অচেতন থাকে (কারেন্ট বায়োলজি ৯ই মে ২০১৮)। এ থেকে আমরা সহজে বুঝতে পারি, কোথাও বেড়াতে গিয়ে নতুন কোন হোটেলে রাতে ঘুমে কেন কিছুটা অস্বস্তিবোধ হয়।
২. ঘুমের সময় কিছু জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী ও পাখির মস্তিষ্ক অর্ধেক জেগে থাকে। তিমি প্রভৃতি জলজ স্তন্যপায়ীদের অক্সিজেন গ্রহণের জন্য কিছুক্ষণ পরপর ভেসে উঠতে হয়। তাই তাদের মস্তিষ্কের এক পাশ জেগে থাকে। পুরো মস্তিষ্ক একসঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লে পানির নীচে অক্সিজেনের অভাবে মারা যাবে। গাছের ডালে বসে ঘুমানোর জন্য কোন কোন পাখির ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়। তাই ঘুমের মধ্যেও মস্তিষ্কের এক পাশ জেগে থাকে। এই কৌশলকে বলা হয় ‘ইউনিহেমিস্ফিয়ারিক সিলপ’। বিজ্ঞানীরা অবশ্য মনে করেন, ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্ক সাধারণত এ ধরনের অসামঞ্জস্য দেখায় না।
৩. বিজ্ঞানীরা সিলপ ল্যাবে পরীক্ষা করে দেখেছেন, গভীর ঘুমের সময় মানুষের মস্তিষ্কের বাম পাশের নার্ভ সেল নেটওয়ার্ক ডান পাশের নেটওয়ার্কের তুলনায় ঘুম পাড়ানোর কাজে কম ভূমিকা রাখে। এতে বোঝা যায়, ঘুমের ব্যাপারে মস্তিষ্কের বাম ও ডান অংশ একই রকম ভূমিকা রাখে না। অবশ্য দ্বিতীয়-তৃতীয় দিনে পরিবেশ চেনা-জানা হয়ে গেলে ঘুম স্বাভাবিক হয়ে আসে।
৪. নতুন জায়গায় ঘুমের প্রথম রাতে মস্তিষ্কের বাম পাশ সামান্য শব্দেই বেশী প্রতিক্রিয়া দেখায়। বাম পাশে শব্দতরঙ্গ ডান কান দিয়ে ঢোকে। ডান কানের শব্দে সহজে ঘুম ভেঙে যায়। তাই বলা যেতে পারে, নতুন জায়গায় ঘুমানোর সময় ডান কান জেগে থাকে! অবশ্য এই হালকা ঘুমের অবস্থাটা ঘুমের প্রথম প্রহরেই বেশী থাকে। পরের দিকে থাকে কি-না, তা এখনো গবেষণার বিষয়।
৫. এটা অবশ্য স্বাভাবিক। কারণ নিরাপদ পরিবেশ না থাকলে গভীর ঘুম আসবে কেন? পরিচিত পরিবেশেও কিন্তু সামান্য শব্দে ঘুম ভেঙে যেতে পারে, যদি সেই শব্দ বিপদের সংকেত হয়। যেমন বজ্রপাতের শব্দে অনেক সময় মায়ের ঘুম ভাঙে না, কিন্তু পাশে ঘুমিয়ে থাকা বাচচার সামান্য কান্নায় ঘুম ভেঙে যায়। (লেফট ব্রেইন স্ট্যান্ডস গার্ড হোয়াইল অ্যাসিলপ’, লরা স্যান্ডার্স’, সায়েন্স নিউজ, ২৮ মে ২০১৬, কিনডল এডিশন)।
আর গুহা হ’ল এমন একটি স্থান যেখানে যেকোন মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে পারে। গুহায় পশু-পাখি, সাপের আক্রমণের ভয় রয়েছে। যেহেতু স্থানটি অপরিচিত তাই সেখানে গুহাবাসীদের কান পাহারা দেওয়ার জন্য জেগে থাকবে। হয়তোবা এই কারণেই আল্লাহ তা‘আলা আছহাবে কাহফের কান বন্ধ করে দিয়েছিলেন যাতে তারা ঘুমানোর সময় তাদের নিরাপত্তার জন্য, পাহারা দেওয়ার মধ্যে কান জেগে থাকতে না পারে। আল্লাহ বলেন,
ثُمَّ بَعَثْنَاهُمْ لِنَعْلَمَ أَيُّ الْحِزْبَيْنِ أَحْصَى لِمَا لَبِثُوا أَمَدًا، نَحْنُ نَقُصُّ عَلَيْكَ نَبَأَهُمْ بِالْحَقِّ إِنَّهُمْ فِتْيَةٌ آمَنُوا بِرَبِّهِمْ وَزِدْنَاهُمْ هُدًى، وَرَبَطْنَا عَلَى قُلُوبِهِمْ إِذْ قَامُوا فَقَالُوا رَبُّنَا رَبُّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ لَنْ نَدْعُوَ مِنْ دُونِهِ إِلَهًا لَقَدْ قُلْنَا إِذًا شَطَطًا، هَؤُلَاءِ قَوْمُنَا اتَّخَذُوا مِنْ دُونِهِ آلِهَةً لَوْلَا يَأْتُونَ عَلَيْهِمْ بِسُلْطَانٍ بَيِّنٍ فَمَنْ أَظْلَمُ مِمَّنِ افْتَرَى عَلَى اللهِ كَذِبًا، وَإِذِ اعْتَزَلْتُمُوهُمْ وَمَا يَعْبُدُونَ إِلَّا اللهَ فَأْوُوا إِلَى الْكَهْفِ يَنْشُرْ لَكُمْ رَبُّكُمْ مِنْ رَحْمَتِهِ وَيُهَيِّئْ لَكُمْ مِنْ أَمْرِكُمْ مِرْفَقًا، وَتَرَى الشَّمْسَ إِذَا طَلَعَتْ تَزَاوَرُ عَنْ كَهْفِهِمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَإِذَا غَرَبَتْ تَقْرِضُهُمْ ذَاتَ الشِّمَالِ وَهُمْ فِي فَجْوَةٍ مِنْهُ ذَلِكَ مِنْ آيَاتِ اللهِ مَنْ يَهْدِ اللهُ فَهُوَ الْمُهْتَدِ وَمَنْ يُضْلِلْ فَلَنْ تَجِدَ لَهُ وَلِيًّا مُرْشِدًا-
‘অতঃপর আমরা তাদেরকে ঘুম থেকে উঠালাম যাতে আমরা জেনে নেই যে, তাদের দু’দলের মধ্যে কোন দল সঠিকভাবে তাদের অবস্থানকালের মেয়াদ নির্ণয় করতে পারে। আমরা তোমার কাছে তাদের সঠিক খবর বর্ণনা করব। তারা ছিল কয়েকজন যুবক। যারা তাদের প্রতিপালকের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেছিল এবং আমরা তাদের হেদায়াত বৃদ্ধি করে দিয়েছিলাম। আর আমরা তাদের হৃদয় সমূহের বন্ধন সুদৃঢ় করেছিলাম, যখন তারা (কওমের পূজার অনুষ্ঠান থেকে) উঠে দাঁড়ালো। অতঃপর (একে একে একস্থানে জমা হয়ে) বলল, আমাদের প্রভু হ’লেন তিনি, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের পালনকর্তা। আমরা কখনোই তাঁকে ছেড়ে অন্যকে উপাস্য হিসাবে আহবান করব না। যদি তা করি, তবে সেটা হবে একেবারেই অনর্থক কাজ। (তারা আরও বলল,) ওরা আমাদের স্বজাতি। আল্লাহকে ছেড়ে ওরা অন্যকে উপাস্য হিসাবে গ্রহণ করেছে। তাহ’লে কেন তারা তাদের এসব উপাস্য বিষয়ে স্পষ্ট প্রমাণ উপস্থিত করে না? আর তার চেয়ে বড় যালেম আর কে আছে যে আল্লাহর উপরে মিথ্যারোপ করে? (অতঃপর আল্লাহ তাদের প্রতি ইলহাম করেন,) যখন তোমরা পৃথক হ’লে স্বজাতি থেকে এবং আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে তারা উপাসনা করে তাদের থেকে, তখন তোমরা আশ্রয় গ্রহণ কর গিরিগুহায়, যেখানে তোমাদের প্রতিপালক তোমাদের জন্য তার অনুগ্রহ প্রসারিত করবেন এবং তোমাদের জন্য কল্যাণের ব্যবস্থা করবেন। আর তুমি সূর্যকে দেখবে যখন তা উদিত হয়, তখন তাদের গুহার ডান দিকে হেলে অতিক্রম করে এবং যখন তা অস্ত যায়, তখন বাম পার্শ্ব দিয়ে অতিক্রম করে, এমতাবস্থায় তারা ভিতরের প্রশস্ত স্থানে অবস্থান করে। এটা আল্লাহর অন্যতম নিদর্শন। আল্লাহ যাকে সুপথ প্রদর্শন করেন, সেই-ই সুপথপ্রাপ্ত হয়। আর তিনি যাকে পথভ্রষ্ট করেন, তুমি তার জন্য কোন সুপথ প্রদর্শনকারী অভিভাবক পাবে না’ (কাহফ ১৮/১২-১৭)।
সূর্য যখন উদিত হয় তখন সূর্যালোক ভূমির সমান্তরালে থাকে এবং তখন সূর্যালোক গুহার অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। সূর্য যত উপরে উঠতে থাকে সূর্যালোক তত গুহা হ’তে বের হয়ে আসতে থাকে। অর্থাৎ সূর্যালোক গুহাবাসীর ডানদিকে হেলে পড়ে। আবার যখন সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে তখন তাদেরকে বামদিকে রেখে অস্ত যায়। এক্ষণে আমরা সূর্যালোকের উপকারিতা সম্পর্কে জানব।
যখন কোন স্থানে সূর্যালোক অনুপস্থিত থাকে তখন ঐ স্থানে ছত্রাক জন্মানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ খুঁজে পায়। আর গুহার ভিতরে সাধারণত আর্দ্রতা বেশী থাকে। ফলে এর অভ্যন্তরে স্যঁাতসেঁতে অবস্থা তৈরি হয়। এই ধরনের পরিবেশে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
সূর্যালোক প্রাকৃতিক বায়ু চলাচল স্বাভাবিক রাখে। ফলে অভ্যন্তরীণ বায়ুর গুণমান উন্নত করতে পারে। যখন সূর্যালোক একটি ঘরে প্রবেশ করে, তখন সেখানে আর্দ্রতা কমাতে, ছত্রাক বৃদ্ধি রোধ করতে এবং বায়ু সঞ্চালন বাড়িয়ে বাতাসকে তাজা করতে সাহায্য করে। উপরন্তু সূর্যালোকের দুর্গন্ধ এবং বায়ুবাহিত ব্যাকটেরিয়া ধ্বংস করার একটি প্রাকৃতিক ক্ষমতা রয়েছে, যা আরও সতেজ পরিবেশ তৈরিতে অবদান রাখে।
সূর্যালোক মানবদেহের বিবিধ উপকার সাধন করে। সূর্যালোকের রক্তচাপের উপর প্রভাবসহ মানবদেহে বেশ কিছু ইতিবাচক প্রভাব রয়েছে। যেমন-
ভিটামিন-ডি সংশ্লেষণ : সূর্যের আলো ভিটামিন-ডি এর একটি প্রাকৃতিক উৎস এবং সূর্যালোকের এক্সপোজার ত্বককে এই প্রয়োজনীয় ভিটামিন তৈরি করতে সাহায্য করে। কার্ডিওভাসকুলার স্বাস্থ্য সহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য ভিটামিন-ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিন-ডি এর পর্যাপ্ত মাত্রা নিম্ন রক্তচাপের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন : সূর্যালোকের এক্সপোজার ত্বকে নাইট্রিক অক্সাইড উৎপাদন শুরু করে। নাইট্রিক অক্সাইড রক্তনালীগুলিকে শিথিল করতে সাহায্য করে, যা রক্তচাপ কমাতে অবদান রাখতে পারে।
সার্কাডিয়ান রিদম রেগুলেশন : প্রাকৃতিক সূর্যালোকের এক্সপোজার শরীরের সার্কেডিয়ান রিদমকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে, যা অভ্যন্তরীণ ঘড়ি, যা ঘুম-জাগরণ চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করে। একটি ভাল-নিয়ন্ত্রিত সার্কাডিয়ান ছন্দ উন্নত রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের সাথে যুক্ত করা হয়েছে।
স্ট্রেস হ্রাস : সূর্যালোকের এক্সপোজার সেরোটোনিন নামক এনজাইম উৎপাদন বাড়িয়ে মেজায-বুস্টিং প্রভাব দেখায়, সুস্থতার অনুভূতির সাথে যুক্ত একটি নিউরোট্রান্সমিটার। নিম্নচাপের মাত্রা পরোক্ষভাবে রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অবদান রাখতে পারে। এছাড়া এটি লক্ষ্য করা গুরুত্বপূর্ণ যে সূর্যালোকের অত্যধিক এক্সপোজার, বিশেষত যথাযথ সুরক্ষা ছাড়াই, ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলতে পারে যেমন রোদে পোড়া এবং ত্বকের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। সূর্যালোকের সুবিধা উপভোগ করার সময় ভারসাম্য বজায় রাখা এবং সূর্য সুরক্ষা অনুশীলন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অর্থাৎ গুহার মধ্যে যদি সূর্যালোক প্রবেশ না করতো তবে গুহাবাসীদের নিকট গুহার বায়ূ দূষিত হয়ে যেত, স্যঁাতসেঁতে পরিবেশ তৈরী হ’ত। ফলে ছত্রাক জন্মাতো যা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক হ’ত। এছাড়া গুহার মধ্যে সূর্যালোককে এমনভাবে প্রবেশ করানো হয়েছে যাতে প্রখর রৌদ্রতাপ গুহাবাসীর শরীরের কোন ক্ষতি করতে না পারে। এখানে আমাদের নিকট শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আমাদের ঘরগুলোতে আলো-বাতাস প্রবেশের ব্যবস্থা রাখতে হবে নয়তো বদ্ধ ঘরে দুর্গন্ধ তৈরী হবে, স্যঁাতসেঁতে পরিবেশ তৈরী হবে এবং ছত্রাক জন্মাবে যা আমাদের স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
আল্লাহ বলেন,وَتَحْسَبُهُمْ أَيْقَاظًا وَهُمْ رُقُودٌ وَنُقَلِّبُهُمْ ذَاتَ الْيَمِينِ وَذَاتَ الشِّمَالِ وَكَلْبُهُمْ بَاسِطٌ ذِرَاعَيْهِ بِالْوَصِيدِ لَوِ اطَّلَعْتَ عَلَيْهِمْ لَوَلَّيْتَ مِنْهُمْ فِرَارًا وَلَمُلِئْتَ مِنْهُمْ رُعْبًا، ‘তুমি তাদের মনে করবে জাগ্রত। অথচ তারা নিদ্রিত। আর আমরা তাদেরকে ডাইনে ও বামে পার্শ্ব পরিবর্তন করে দিতাম। এমতাবস্থায় তাদের কুকুরটি সম্মুখের দু’পা প্রসারিত করে (মাথা উঁচু করে) গুহা মুখে উপবিষ্ট থাকত। যদি তুমি উঁকি মেরে তাদেরকে দেখতে, তাহ’লে তুমি পিছন ফিরে পালাতে ও তাদের ভয়ে আতংকিত হয়ে পড়তে’ (কাহফ ১৮/১৮)।
ঘুমের মধ্যে ডান এবং বাম কাঁধের মধ্যে পর্যায়ক্রমে অবস্থান পরিবর্তন করা বিভিন্ন কারণে উপকারী হ’তে পারে:
প্রেসার ডিস্ট্রিবিউশন : পার্শ্ব বদলানো চাপ বিতরণে সাহায্য করে এবং এক কাঁধ বা জয়েন্টে দীর্ঘস্থায়ী চাপ প্রতিরোধ করে। এটি শরীরের নির্দিষ্ট অংশে অস্বস্তি বা ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। অনেক সময় আমরা দেখতে পাই ঘুম থেকে উঠার পর আমাদের শরীরের একটা অংশে ব্যথা করছে। এর কারণ হ’ল সারারাত এক অবস্থানে ঘুমানোর কারণে সম্পূর্ণ শরীরের চাপ ঐ অংশের উপর গিয়ে পড়েছে। তাই এরূপ ব্যথা অনুভূত হচ্ছে।
রক্ত সঞ্চালন : অবস্থান পরিবর্তন স্বাস্থ্যকর রক্ত সঞ্চালন বজায় রাখে। এটি রক্তকে আরও অবাধে প্রবাহিত করার সুযোগ তৈরি করে শরীরের নির্দিষ্ট অংশে কঠোরতা এবং অসারতা প্রতিরোধ করে। পার্শ্ব পরিবর্তনের ফলে শরীরে স্বাভাবিক রক্ত চলাচল বজায় থাকে এবং রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকে।
শ্বাসযন্ত্রের স্বাস্থ্য : নাক ডাকার প্রবণতা বা সিলপ অ্যাপনিয়ায় (এটি এক ধরনের রোগ যার লক্ষণ হ’ল: জোরে নাক ডাকা, হঠাৎ জেগে ওঠার সাথে দম বন্ধ হওয়া বা হাঁপাতে থাকা এবং দিনের বেলা অতিরিক্ত ঘুম হওয়া) ভুগছেন এমন ব্যক্তিদের জন্য অবস্থান পরিবর্তন করা শ্বাসনালীর উন্মুক্ততাকে প্রভাবিত করে। পার্শ্ব পরিবর্তন করে ঘুমানো, নাক ডাকা কমাতে এবং শ্বাস-প্রশ্বাস উন্নত করতে সাহায্য করে।
মেরুদন্ডের প্রান্তিককরণ : মেরুদন্ডের অবস্থান যথাযথ রাখতে ঘুমানোর সময় পার্শ্ব পরিবর্তন যরূরী।
হজমের প্রশান্তি : অবস্থান পরিবর্তন হজমের প্রশান্তিতে সাহায্য করে, বিশেষত যারা অ্যাসিড রিফ্লাক্সের সাথে কাজ করে তাদের জন্য। কিছু লোক তাদের বাম দিকে ঘুমিয়ে স্বস্তি খুঁজে পায়, যা পেটের অ্যাসিডকে খাদ্যনালীতে প্রবাহিত হ’তে বাধা দিতে সাহায্য করতে পারে।
আল্লাহ তা‘আলা ঘুমের মধ্যে গুহাবাসীর পার্শ্ব পরিবর্তন বর্ণনা করার মাধ্যমে আমাদের জানিয়ে দিলেন এর মধ্যে আমাদের বিভিন্ন ধরনের উপকারিতা রয়েছে, যা আমাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সাহায্য করবে।
আল্লাহ বলেন,وَكَذَلِكَ بَعَثْنَاهُمْ لِيَتَسَاءَلُوا بَيْنَهُمْ قَالَ قَائِلٌ مِنْهُمْ كَمْ لَبِثْتُمْ قَالُوا لَبِثْنَا يَوْمًا أَوْ بَعْضَ يَوْمٍ قَالُوا رَبُّكُمْ أَعْلَمُ بِمَا لَبِثْتُمْ فَابْعَثُوا أَحَدَكُمْ بِوَرِقِكُمْ هَذِهِ إِلَى الْمَدِينَةِ فَلْيَنْظُرْ أَيُّهَا أَزْكَى طَعَامًا فَلْيَأْتِكُمْ بِرِزْقٍ مِنْهُ وَلْيَتَلَطَّفْ وَلَا يُشْعِرَنَّ بِكُمْ أَحَدًا، ‘আর আমরা তাদেরকে এমনভাবে (সুস্থহালে) জাগ্রত করালাম (যেভাবে তাদেরকে ঘুমিয়ে দিয়েছিলাম), যাতে তারা পরস্পরে জিজ্ঞাসাবাদ করে। (যেমন) তাদের একজন বলল, কতদিন এভাবে ছিলে? তারা বলল, একদিন বা তার কিছু অংশ। আরেকজন বলল, তোমাদের প্রতিপালকই ভাল জানেন কতকাল তোমরা এভাবে ছিলে। এখন তোমাদের একজনকে তোমাদের এই মুদ্রাসহ নগরে প্রেরণ কর যেন সে দেখে কোন খাদ্য উত্তম। অতঃপর তা থেকে যেন তোমাদের জন্য কিছু খাদ্য কিনে নিয়ে আসে। আর সে যেন নম্রতার সাথে কাজ করে এবং তোমাদের সম্পর্কে কাউকে কিছু বুঝতে না দেয়’ (কাহফ ১৮/১৯)।
গুহাবাসীদের একজন ভেজালমুক্ত খাবার নিয়ে আসার জন্য অন্যজনকে পরামর্শ দিল। যেহেতু গুহাবাসীরা অনেক বছর অভুক্ত ছিল তাই তাদের দেহের কিডনি, লিভার, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃদান্ত্র ইত্যাদি তাদের নিজস্ব কর্ম করতে পারেনি। খালি পেটে ভেজাল খাদ্য খাওয়া বিভিন্ন কারণে আদর্শ নয়। প্রথমত, ভেজাল খাদ্যে প্রায়শই উচ্চ পরিমাণে পরিশোধিত কার্বোহাইড্রেটের কারণে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করে। এর ফলে একটি স্বল্পস্থায়ী শক্তি বৃদ্ধি হ’তে পারে এবং তারপরে ক্র্যাশ হ’তে পারে, যার ফলে একজন মানুষ ক্লান্তি বোধ করতে পারে। তাছাড়া ভেজাল খাদ্যে সাধারণত প্রয়োজনীয় পুষ্টির পরিমাণ কম থাকে এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বি ও শর্করা বেশী থাকে। খালি পেটে এই জাতীয় খাবার খাওয়া পুষ্টির ঘাটতিতে অবদান রাখতে পারে এবং সময়ের সাথে সাথে ওযন বৃদ্ধি পেতে পারে।
অন্যদিকে খালি পেটে তাজা খাবার খেলে কিছু উপকার পাওয়া যেতে পারে। তাজা খাবার, যেমন ফল এবং সবজি, ভিটামিন, খনিজ এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টিতে সমৃদ্ধ। খালি পেটে এগুলি খাওয়া আপনার শরীরকে এই পুষ্টিগুলি আরও দক্ষতার সাথে শোষণ করতে দেয়। প্রক্রিয়াজাত বা ভারী খাবারের তুলনায় তাজা খাবারগুলিও প্রায়শই হজম করা সহজ হয়। খালি পেটে এগুলি খাওয়া ভাল হজমকে উন্নীত করতে পারে এবং ফোলাভাব বা অস্বস্তির অনুভূতি প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
উপরন্তু, তাজা স্বাস্থ্যকর খাবার দিয়ে একজন মানুষ দিন শুরু করলে তা শক্তির একটি স্বাস্থ্যকর উৎস প্রদান করে এবং সামগ্রিক খাদ্যের জন্য একটি ইতিবাচক টোন সেট করে। এটি ভাল হাইড্রেশনে অবদান রাখে এবং সর্বোত্তমভাবে কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি দিয়ে আপনার শরীরকে সমর্থন করে। গুহাবাসীরা অনেকদিন খালি পেটে থাকার কারণে তাদের জন্য তাজা ভেজালমুক্ত খাবার প্রয়োজন ছিল, যা তাদের দুর্বল দেহে ত্বরিত শক্তির সঞ্চার করবে। এখানে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় হ’ল সর্বদা তাজা খাবার খাওয়ার চেষ্টা করা এবং ভেজালযুক্ত খাবার পরিহার করা। বিশেষ করে সকালে ঘুম থেকে উঠার পর স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করা।
অতএব আমরা সূরা কাহফে বিদ্যমান বৈজ্ঞানিক যেসব তথ্যাদি জানতে পারলাম তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে মেনে চলতে পারলে আমরা স্বাস্থ্যকর পরিবেশে স্বাস্থ্যকর জীবন যাপন করতে পারব ইনশাআল্লাহ \