আল্লাহ তা‘আলা সূরা আর-রহমানে বহু নিদর্শন সম্বলিত আয়াত নাযিল করেছেন। যাতে রয়েছে এই দুনিয়ার বহু বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা দ্বারা মানবজাতি নিজেদের বিবিধ কল্যাণ সাধন করতে পারবে। আল-কুরআনের যেকোন আয়াত নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করলে আমরা বিভিন্ন ধরনের তথ্য অনুধাবন করতে পারব। এটাই আল-কুরআনের বিস্ময়। পৃথিবীর অন্য যত বই রয়েছে তা একবার পড়ার পর দ্বিতীয়বার পড়লে খুব একটা নতুন তত্ত্ব পাওয়া যায় না বা বইটি কয়েকবার পড়লেও আর তেমন কিছু জানার থাকে না। অর্থাৎ বইটির মধ্যে যে জ্ঞান রয়েছে তা হচ্ছে সীমাবদ্ধ। বইটি একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ জ্ঞান দেওয়ার পর আর জ্ঞান দিতে পারে না। কিন্তু আল-কুরআন আল্লাহর নাযিলকৃত এমন কিতাব, যা যতবার পড়া হবে ততবার এই কিতাব নতুন নতুন তত্ত্ব প্রদান করবে। অর্থাৎ আল-কুরআন হচ্ছে একটি জীবন্ত জ্ঞানের আধার, যা ক্বিয়ামত পর্যন্ত পৃথিবীর মানুষকে জ্ঞান দিয়ে যাবে। যে ব্যক্তি আল-কুরআনকে নিত্যদিনের সংগী হিসাবে গ্রহণ করবে সে জ্ঞান অর্জনের দিক দিয়ে কখনো পিছিয়ে থাকবে না। বিজ্ঞানের নাম নিয়ে অনেক মিথ্যা জ্ঞান পৃথিবীতে ছড়িয়ে রয়েছে। আল-কুরআন হচ্ছে সেই মিথ্যা জ্ঞান যাচাই করার কিতাব। আলোচ্য প্রবন্ধে সূরা আর-রহমানে আল্লাহ তা‘আলা ভাষা শিক্ষা সম্পর্কে যে আয়াত নাযিল করেছেন সে বিষয়ে আলোকপাত করা হবে। আল্লাহ বলেন, عَلَّمَهُ الْبَيَانَ ‘তিনি তাকে ভাষা শিক্ষা দিয়েছেন’ (রহমান ৫৫/৪)

মনের ভাব যার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তাকে ভাষা বলা হয়। ভাষার বিভিন্ন ধরন রয়েছে, যেমন- শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ দিয়ে ইশারা করা এক ধরনের ভাষা, বিভিন্ন ধরনের শব্দ দ্বারা ইশারা এক ধরনের ভাষা এবং আমরা মুখে উচ্চারণ করে যা বলি সেটা ভাষা। প্রথম দুই ধরনের ভাষার কোন ব্যাকরণগত বা নিজস্ব অর্থ নেই কিন্তু আমরা যে ভাষায় কথা বলি তার নিজস্ব অর্থ রয়েছে এবং ব্যাকরণ রয়েছে।

পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে আল্লাহ তাঁর অসীম অনুগ্রহে কথা বলার সবচেয়ে উন্নত দক্ষতা প্রদান করেছেন। বাকশক্তির এই নে‘মত ব্যতীত মানব সভ্যতা সম্ভব ছিল না। সাহিত্য, সঙ্গীত, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, নতুন জিনিসের উদ্ভাবন ও তাদের অগ্রগতি সাধিত হ’ত না। এমনকি সংগঠিত মানব সমাজের অস্তিত্ব থাকত না। স্বরবর্ণ ও ব্যঞ্জনবর্ণের নানা ধরনের বিন্যাসের মাধ্যমে মানব কন্ঠস্বর ভাবের প্রকাশ ঘটাতে পারে। মানুষ তার কন্ঠস্বর উন্নয়নের দ্বারা নানান ভাষার ব্যাপক উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। সে তার চিন্তা ও কর্মের সবচেয়ে নিখুঁত বর্ণনা দিতে পারে। মানুষের দেহাভ্যন্তরস্থ স্বরতন্ত্রীসমূহ প্রধানত শব্দ সৃষ্টি করে। ফিতার ন্যায় দু’টি ক্ষুদ্র টিস্যু স্বরযন্ত্রের (স্বর উচ্চারণের স্থান বা যন্ত্র) আড়াআড়ি চলে গিয়েছে। একটি ফিতা স্বরযন্ত্রের প্রবেশের প্রত্যেক পাশে প্রসারিত অবস্থায় থাকে। গলার মাংসপেশী প্রসারিত হয়ে স্বরযন্ত্রকে শিথিল করে দেয়।

আমরা যখন শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করি, তখন স্বরযন্ত্রকে শিথিল করি এবং এটা ইংরেজী ‘V’ অক্ষরের আকৃতি তৈরি করে। কথা বলার সময় সংলগ্ন মাংসপেশীসমূহ স্বরযন্ত্রকে টেনে ধরে বায়ুনলের প্রবেশমুখকে সংকুচিত করে। তখন ফুসফুস থেকে বায়ু স্বরযন্ত্রে প্রবেশ করে এবং স্বরযন্ত্রের পাতলা অংশ স্বরতন্ত্রীসমূহ বাতাসে ফেঁপে ওঠে। স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে বায়ুর অতিক্রমকালে যে কম্পনের সৃষ্টি হয়, তার ফলে ধ্বনির সৃষ্টি হয়। ফুসফুস থেকে বায়ু স্বরযন্ত্রের মধ্য দিয়ে যেহেতু অতিক্রম করে, তাই বায়ুনলের প্রবেশপথ খোলা-বন্ধ হওয়ার সময় স্বরতন্ত্রীসমূহ দ্রুত স্পন্দিত হয়। এভাবে তৈরি ধ্বনির উচ্চতার মাত্রা স্বরতন্ত্রীসমূহের দৈর্ঘ্য, ঘনত্ব ও কঠিন টানের উপর নির্ভর করে। স্বরতন্ত্রীর যে কঠিন টান ধ্বনির নানা প্রকার মাত্রা তৈরি করে, তা মাংসপেশীর ক্রিয়ার ফলে পরিবর্তিত হয়। একজন ব্যক্তি তার ঠোট, জিহবা ও মুখের সাহায্যে ধ্বনি পরিবর্তন করে শব্দ তৈরি করে।[1]

স্বরযন্ত্রে ধ্বনি তৈরির ফলে যেখানে স্বরের সৃষ্টি, সেখানে বাকশক্তি হচ্ছে মুখের ও নাকের অনুরণনের সর্বোত্তম অবস্থা। একটি শিশু তার মায়ের নিকট এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্যের কাছ থেকে শুনে কথা বলতে শেখে। মানুষের বাকশক্তি তাই জ্ঞান ও সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে বিভিন্ন উন্নয়নের ধারার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়েছে।[2]

মানুষের স্বরযন্ত্রে যে শব্দ উৎপন্ন হয় তা তার ঠোঁট, জিহবা এবং মুখের সাহায্যে বিভিন্ন ধ্বনি তৈরী করে। যেমন আমরা যদি বাতাস একেবারে ছেড়ে দিয়ে উচ্চারণ করি তবে তা হয় ه এবং বাতাসকে কন্ঠনালী সাহায্যে আটকিয়ে ফেলে উচ্চারণ করি তখন তা হয়ে যায় ح। এভাবে জিহবাকে বিভিন্ন অবস্থানে রাখলে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনি তৈরী হয়।

মানুষ যে ভাষা শিখতে পারে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হ’ল শিশু। একজন শিশু শৈশবকালে যে ভাষা শুনে সে ভাষাতেই কথা বলতে পারে। আমরা দেখতে পাই অনেক গৃহপালিত পশু-পাখি জন্মের পর থেকে মানুষের সংস্পর্শে বছরের পর বছর থেকেও মানুষের ভাষা শিখতে পারে না বরং তার জন্য আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত শব্দই সে উচ্চারণ করে। এর কারণ হ’ল আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে ভাষা শিক্ষা দেননি। আমরা যদি আদম (আঃ)-কে সৃষ্টির পর যে সকল বিষয় কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে তার দিকে লক্ষ্য করি তবে এর উত্তর পেয়ে যাব। আল্লাহ বলেন,وَعَلَّمَ آدَمَ الْأَسْمَاءَ كُلَّهَا ثُمَّ عَرَضَهُمْ عَلَى الْمَلَائِكَةِ فَقَالَ أَنْبِئُونِي بِأَسْمَاءِ هَؤُلَاءِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِينَ، قَالُوا سُبْحَانَكَ لَا عِلْمَ لَنَا إِلَّا مَا عَلَّمْتَنَا إِنَّكَ أَنْتَ الْعَلِيمُ الْحَكِيمُ، قَالَ يَاآدَمُ أَنْبِئْهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ فَلَمَّا أَنْبَأَهُمْ بِأَسْمَائِهِمْ قَالَ أَلَمْ أَقُلْ لَكُمْ إِنِّي أَعْلَمُ غَيْبَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَأَعْلَمُ مَا تُبْدُونَ وَمَا كُنْتُمْ تَكْتُمُونَ، ‘অতঃপর আল্লাহ আদমকে সকল বস্ত্তর নাম শিক্ষা দিলেন। অতঃপর সেগুলিকে ফেরেশতাদের সম্মুখে পেশ করলেন এবং বললেন, তোমরা আমাকে এগুলির নাম বল, যদি তোমরা (তোমাদের কথায়) সত্যবাদী হও’। তারা বলল, সকল পবিত্রতা আপনার জন্য। আমাদের কোন জ্ঞান নেই, যতটুকু আপনি আমাদের শিখিয়েছেন ততটুকু ব্যতীত। নিশ্চয়ই আপনি মহা বিজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ বললেন, হে আদম! তুমি এদেরকে ঐসবের নামগুলি বলে দাও। অতঃপর যখন আদম তাদেরকে ঐসবের নামগুলি বলে দিল, তখন আল্লাহ ফেরেশতাদের বললেন, আমি কি তোমাদের বলিনি যে, আসমান ও যমীনের অদৃশ্য বিষয় সমূহ আমি সর্বাধিক অবগত এবং তোমরা যেসব বিষয় প্রকাশ কর ও যেসব বিষয় গোপন কর, সকল বিষয়ে আমি সম্যক অবহিত?’ (বাক্বারাহ ২/৩১-৩৩)

উক্ত আয়াতগুলো হ’তে জানা যায় যে, আদম (আঃ)-কে সকল কিছুর নাম শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। অর্থাৎ ভাষা ও শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল। সে কারণেই আদম (আঃ) ফেরেশতাদেরকে তার সামনে পেশকৃত বস্ত্তসমুহের নাম জানাতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু পৃথিবীর গবেষকরা এখন পর্যন্ত নির্ণয় করতে পারেনি যে, কিভাবে মানুষের মধ্যে ভাষা তৈরী হ’ল বা এই ভাষার উৎপত্তি কোথা থেকে হ’ল। তারা কেউ কেউ বলেছে, ভাষার উৎপত্তি মানুষের বিবর্তনের সাথে সম্পর্কিত এবং এর পরিণতিগুলো বহু শতাব্দী ধরে অধ্যয়নের বিষয় হয়ে আসছে। অনেকে যুক্তি দেখান যে, ভাষার উৎপত্তি সম্ভবত আধুনিক মানুষের আচরণের উৎপত্তির সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। কিন্তু এই সংযোগের তথ্য এবং প্রভাব সম্পর্কে সামান্যই একমত। অর্থাৎ তারা কোন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না যে, কিভাবে ভাষার উৎপত্তি হয়েছে তা খুঁজে বের করার পদ্ধতি কি হবে।

আমরা যদি প্রাণীর সাথে মানুষের শব্দের তুলনা করি তবে দেখব যে, পশু-পাখি যে শব্দগুলো করে সেগুলোর নিজস্ব কোন অর্থ নেই, কিন্তু উদ্দেশ্য আছে। পশু-পাখি নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করার জন্য শব্দ করে থাকে। যেমন- বিপদ সম্পর্কে অন্যদের সতর্ক করা, একজন সঙ্গীকে আকৃষ্ট করা, অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা, সামাজিক বন্ধন বজায় রাখা, গোষ্ঠীর ক্রিয়াকলাপগুলিকে সমন্বয় করা বা সঙ্কটের সংকেত দেওয়া, আত্মরক্ষার জন্য, সঙ্গম মৌসুমে প্রাণীরা প্রায়ই সম্ভাব্য সঙ্গীদের আকর্ষণ করার জন্য নির্দিষ্ট শব্দ উৎপন্ন করে। এই শব্দগুলি মিলনের জন্য প্রস্ত্ততি এবং প্রজনন ফিটনেস প্রতিষ্ঠার জন্য একটি উপায় হিসাবে কাজ করে। প্রাণীরা সন্তানদের সাথে যোগাযোগ করার জন্য শব্দ উৎপন্ন করে। কিছু প্রাণী তাদের গোষ্ঠী বা প্রজাতির অন্যান্য সদস্যদের সনাক্ত করতে শব্দ ব্যবহার করে। উদাহরণস্বরূপ, ডলফিনরা পানির নীচে নেভিগেট করতে এবং একে অপরের সাথে যোগাযোগ করতে ইকোলোকেশন ব্যবহার করে। সুতরাং এ কথা প্রনিধানযোগ্য। যেই পশু-পাখিকে আল্লাহ তা‘আলা শব্দ উৎপন্ন করার শক্তি দিয়েছেন কিন্তু মানুষের মত ভাষার শক্তি দেননি। আল্লাহ বলেন,وَوَرِثَ سُلَيْمَانُ دَاوُودَ وَقَالَ يَاأَيُّهَا النَّاسُ عُلِّمْنَا مَنْطِقَ الطَّيْرِ وَأُوتِينَا مِنْ كُلِّ شَيْءٍ إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْفَضْلُ الْمُبِينُ، ‘আর সুলায়মান দাঊদের উত্তরাধিকারী হয়েছিল। সে বলেছিল, হে লোকসকল! আমাদেরকে পাখির ভাষা শিক্ষা দেওয়া হয়েছে এবং আমাদেরকে (প্রয়োজনীয়) সবকিছু দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই এটি (আমাদের প্রতি) সুস্পষ্ট অনুগ্রহ’ (নামল ২৭/১৬)

উক্ত আয়াতে আল্লাহ তা‘আ'লা পাখির জন্য لِـسَان বা لُغَة বা كَلَام -এর পরিবর্তে مَنْطِق শব্দ ব্যবহার করেছেন। لِـسَان বা لُغَة বা كَلَام অর্থ হ’ল ভাষা। অর্থাৎ এমন কথা যার নিজস্ব ব্যাকরণগত অর্থ রয়েছে। অপরদিকেمَنْطِق এর অর্থ হ’ল যুক্তি বা শব্দযুক্ত কথা। অর্থাৎ উক্ত আয়াতেمَنْطِقُ الطيرِ বলতে পাখির মুখনিঃসৃত শব্দকে বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ যে শব্দের নিজস্ব কোন অর্থ নেই। কিন্তু এর দ্বারা কোন বার্তার প্রতি ইঙ্গিত করে। আমরা আরেকটু বিশদভাবে বুঝার জন্য নীচের দু’টি হাদীছের দিকে লক্ষ্য করি।

عَنْ أَبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ صَلَّى رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صَلَاةَ الصُّبْحِ ثُمَّ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَالَ بَيْنَا رَجُلٌ يَسُوقُ بَقَرَةً إِذْ رَكِبَهَا فَضَرَبَهَا فَقَالَتْ إِنَّا لَمْ نُخْلَقْ لِهَذَا إِنَّمَا خُلِقْنَا لِلْحَرْثِ فَقَالَ النَّاسُ سُبْحَانَ اللهِ بَقَرَةٌ تَكَلَّمُ فَقَالَ فَإِنِّيْ أُومِنُ بِهَذَا أَنَا وَأَبُوْ بَكْرٍ وَعُمَرُ،

আবূ হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা নবী করীম (ছাঃ) ফজরের ছালাত শেষে লোকজনের দিকে ঘুরে বসলেন এবং বললেন, একদা এক লোক একটি গরু হাঁকিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ সে এটির পিঠে চড়ে বসলো এবং ওকে প্রহার করতে লাগল। তখন গরুটি বলল, আমাদেরকে এজন্য সৃষ্টি করা হয়নি। আমাদেরকে চাষাবাদের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে। এতদশ্রবণে লোকজন বলে উঠল, সুবহানাল্লাহ! গরুও কথা বলে? নবী করীম (ছাঃ) বললেন, আমি, আবুবকর ও ওমর তা বিশ্বাস করি।[3]

উক্ত হাদীছে গরুর কথা বলার ক্ষেত্রে كَلَام শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে এ কারণে যে, গরু মানুষের মত করে কথা বলেছিল এবং উক্ত হাদীছে سُبْحَانَ اللهِ বলার মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, এটি একটি আশ্চর্যজনক ঘটনা। অর্থাৎ গরু কখনো মানুষের মত করে কথা বলতে পারে না। মূলত: এটি ছিল একটি মু‘জেযা।

عَنْ أَبِي سَعِيدٍ الْخُدْرِيِّ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم وَالَّذِي نَفْسِي بِيَدِهِ لاَ تَقُومُ السَّاعَةُ حَتَّى تُكَلِّمَ السِّبَاعُ الإِنْسَ وَحَتَّى تُكَلِّمَ الرَّجُلَ عَذَبَةُ سَوْطِهِ وَشِرَاكُ نَعْلِهِ وَتُخْبِرَهُ فَخِذُهُ بِمَا أَحْدَثَ أَهْلُهُ مِنْ بَعْدِهِ

‘আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, সেই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ! ক্বিয়ামত সংঘটিত হবে না যে পর্যন্ত না হিংস্র প্রাণী মানুষের সাথে কথা বলবে, যে পর্যন্ত না কারো চাবুকের মাথা এবং জুতার ফিতা তার সাথে কথা বলবে এবং তার উরুদেশ বলে দিবে তার অনুপস্থিতিতে তার পরিবার কি করেছে’।[4]

উক্ত হাদীছে ক্বিয়ামতের একটি নিদর্শন বর্ণনা করা হয়েছে। এখানেও বলা হচ্ছে, হিংস্র প্রাণী মানুষের সাথে কথা বলবে। ক্বিয়ামতের সকল নিদর্শন স্বাভাবিক অবস্থা হ’তে ভিন্নতর হবে। যেমন সূর্য পশ্চিম দিক হ’তে উদিত হওয়া, দাজ্জালের ফিৎনার সময় একদিন এক বছরের সমান হওয়া ইত্যাদি। অর্থাৎ উপরোক্ত আয়াত এবং হাদীছ হ’তে এটা বলা যায় যে, পশু-পাখিকে মানুষের মত কথা বলার সামর্থ্য দেওয়া হয়নি। আল্লাহ বলেন,وَمِنْ آيَاتِهِ خَلْقُ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ وَاخْتِلَافُ أَلْسِنَتِكُمْ وَأَلْوَانِكُمْ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِلْعَالِمِينَ، ‘তাঁর নিদর্শনাবলীর অন্যতম হ’ল, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের বৈচিত্র্য সৃষ্টি। নিশ্চয়ই এর মধ্যে নিদর্শন সমূহ রয়েছে জ্ঞানীদের জন্য’ (রূম ৩০/২২)

আল্লাহ তা‘আলা মানুষের জন্য لِـسَان শব্দ ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ মানুষকে এমন কথার সামর্থ্য দেওয়া হয়েছে যার নিজস্ব অর্থ রয়েছে। মানুষের শারীরিক গঠন মানুষের ভাষা শিক্ষা গ্রহণ করার পরিচয় বহন করে। মানুষ যেকোন লিখিত বাক্য চোখ দিয়ে পড়তে পারে। পশু-পাখির চোখ রয়েছে এবং তাদের এই চোখ অনেক ক্ষেত্রে মানুষের চেয়েও উন্নততর। যেমন- ঈগল দূর থেকে শিকারের উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিতে পারে, বিড়ালের দৃষ্টিশক্তি রাতের বেলা খুব প্রখর থাকে। কিন্তু কোন লিখিত বাক্য পড়ার জন্য এই ধরনের বৈশিষ্ট্য থাকাই শুধু যথেষ্ট নয়। অক্ষর ও চিহ্নের মতো সূক্ষ্ম বিবরণ বুঝার জন্য মস্তিষ্কের কার্যকারিতা যরূরী। এর জন্য প্রয়োজন উন্নত জ্ঞানীয় ফাংশন এবং ভাষা প্রক্রিয়াকরণে সক্ষম মস্তিষ্কের গঠন।

মানুষের মস্তিষ্কে বিশেষ এলাকা রয়েছে, যেমন বাম গোলার্ধের অঞ্চল (যেমন, ব্রোকার এলাকা, ওয়ার্নিকের এলাকা), যা ভাষা এবং পড়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অধিকাংশ প্রাণীর এই বিশেষ মস্তিষ্কের কাঠামো এবং জ্ঞানীয় ক্ষমতা নেই। তাদের মস্তিষ্ক বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় অন্যান্য দক্ষতার জন্য অভিযোজিত হয়। অর্থাৎ মানুষের মস্তিষ্কে এমন গঠন দান করা হয়েছে, যার সাহায্যে তারা ভাষা শিখতে পারবে, এর প্রয়োগ করতে পারবে, লিখতে পারবে এবং পড়তে পারবে। ভাষা হচ্ছে মানবজাতির জন্য আল্লাহ তা‘আলার এক বিশেষ অনুগ্রহ (নে‘মত), যার যথাযথ ব্যবহারের মাধ্যমে মানুষ নিজেকে পরিপূর্ণ মানুষে পরিণত করে তুলতে সক্ষম হয়। এই ভাষা এমন যে, একজন ব্যক্তি যদি চট্টগ্রামের মীরসরাই হ’তে কক্সবাজার পর্যন্ত ভ্রমণ করে এবং চলতি পথের প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষের সাথে কথা বলে তবে সে দেখবে কেবল চট্টগ্রামের এক এক অঞ্চলে এক এক ভাষার স্বাদ পাওয়া যাচ্ছে। এই ভাষা শেখানো আল্লাহ তা‘আলা কর্তৃক তার বান্দার জন্য বিশেষ নে‘মত। তাইতো আল্লাহ তা‘আলা সূরা আর-রহমানে অনেকবার বলেছে, فَبِأَيِّ آلَاءِ رَبِّكُمَا تُكَذِّبَانِ ‘সুতরাং তোমরা উভয়ে তোমাদের পালনকর্তার কোন কোন নে‘মতকে অস্বীকার করবে?’ (আর-রহমান ৫৫/১৩)

অতএব আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে ভাষা শেখানোর মাধ্যমে সৃষ্টিকুলের মধ্যে এক অনন্য অবস্থান দান করেছেন এবং এই ভাষা দিয়ে অন্যান্য সৃষ্টিকূলের সাথে আমাদের কি মৌলিক পার্থক্য রয়েছে তা জানার সুযোগ করে দিয়েছেন। আমরা যেন এই ভাষার যথাযথ ব্যবহার করে আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি এবং এই ভাষার সাহায্যে যে জ্ঞান অর্জন করার নির্দেশ তিনি দিয়েছেন তা অর্জন করে নিজেদের দুনিয়া এবং আখেরাতের কল্যাণ সাধন করতে পারি। আল্লাহ আমাদের তাওফীক্ব দান করুন- আমীন!

ইঞ্জিনিয়ার আসীফুল ইসলাম চৌধুরী



[1]. The World Book Encyclopaedia, Field Enterprises Educational Corporation, London, Vol. 12. p. 522, 1966.

[2]. Encyclopaedia Britannica, Vol. 17. p. 477, 1978.

[3]. ছহীহ বুখারী হা/৩৪৭১

[4]. সুনান তিরমিযী হা/২১৮১






বিষয়সমূহ: শিক্ষা-সংস্কৃতি
সূর্যের চারিদিকে গ্রহের সুশৃংখল গঠন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ঘুমের কতিপয় সুন্নাতী পদ্ধতি ও আধুনিক বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
চন্দ্র দিয়ে মাস এবং সূর্য দিয়ে দিন গণনা : মহান আল্লাহর এক অনন্য বিধান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
কুরআন বলছে আসমানে কোন ফাটল নেই; বিজ্ঞান কি বলে? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ভাষা জ্ঞান মানবজাতির জন্য আল্লাহর অনন্য নিদর্শন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
পৃথিবীতে মানুষের আগমন নিয়ে আল-কুরআনের পথে বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষ কি কৃত্রিম বৃষ্টি (ক্লাউড সিডিং) ঘটাতে সক্ষম? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আসমান হ’তে লোহা নাযিলের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৃষ্টির পানির উপকারিতা - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আল-কুরআনে কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পানি ও সূর্যের তরঙ্গচক্র - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
রক্ত ও মৃত জন্তুর গোশত ভক্ষণ হারাম হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আছহাবে কাহফের ঘটনায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আরও
আরও
.