জ্ঞানের মূল উৎস হ’ল মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। বিজ্ঞানীরা পৃথিবীর বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি ঠেকানোর জন্য, জলবায়ু পরিবর্তন রোধ করার জন্য, তাপমাত্রা কমানোর জন্য বিবিধ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এই সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে প্রচুর অর্থ ব্যয় হয়, সম্পদের ক্ষয় হয়, এমনকি মানুষ এবং পশু-পাখিরও মৃত্যু ঘটে। তাদের এই ব্যর্থতার অন্যতম কারণ হচ্ছে জ্ঞানের সীমারেখা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানা। কিন্তু মুসলমানদের নিকটে সেই জ্ঞানের সীমারেখা রয়েছে। তাহ’ল আল-কুরআন। অর্থাৎ আল-কুরআন যে সকল বিষয়ে মানুষের অক্ষমতা নির্ধারণ করে দিয়েছে ঐ সকল বিষয়ে মানুষ কখনোই সফল হ’তে পারবে না। একজন মুসলিম গবেষকের নিকট সহজ হ’ল সে যে বিষয়ের উপর গবেষণা করবে সে বিষয়ে আদৌ সফলতা অর্জন করা সম্ভব কি-না তা আল-কুরআন হ’তে গবেষণা করে নির্ণয় করা। তেমনই একটি বিষয় নিয়ে এ প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
পৃথিবীর একদল গবেষক দাবী করেছে, তারা চাইলেই পৃথিবীর যেকোন স্থানে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টিপাত ঘটাতে পারবে। প্রশ্ন হচ্ছে- তাদের এই দাবী আল-কুরআনের আয়াত দ্বারা গ্রহণযোগ্য কি-না এবং বিজ্ঞানী-গবেষকদের দ্বারা সমর্থিত কি-না? আলোচ্য নিবন্ধে কুরআন ও বিজ্ঞানের আলোকে এর যথার্থতা তুলে ধরার প্রয়াস পাব।-
মেঘ কি? আবহাওয়া বিজ্ঞানে, মেঘ হ’ল একটি বাতাস, যা দৃশ্যমান ভরের ক্ষুদ্র পানির ফোঁটা, হিমায়িত স্ফটিক, ধূলিকণা বা গ্রহের অন্যান্য কণার সমন্বয়ে গঠিত। পৃথিবীতে বাতাসের সম্পৃক্ততার ফলে মেঘ তৈরি হয়, যখন এটি তার শিশিরাঙ্কে (এমন তাপমাত্রা যার দ্বারা একটি স্থানে উপস্থিত জলীয়বাষ্প দ্বারা স্থানটি সম্পৃক্ত হবে এবং তাপমাত্রা এর কম হ’লে জলীয়বাষ্প পানিতে রূপান্তরিত হয়) ঠান্ডা হয় অথবা যখন পারিপার্শ্বিক পরিবেশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণ জলীয়বাষ্প আসায় স্থানটি শিশিরাঙ্ক পরিবেষ্টিত তাপমাত্রায় পৌঁছায়।
জলীয় বাষ্প হালকা হওয়ার কারণে উপরে উঠে গিয়ে বাতাসের ধূলিকণা, বালুর কণা ইত্যাদির সহায়তায় জমাটবদ্ধ হয়ে তৈরি করে মেঘ। এভাবে মেঘের আকৃতি বড় হ’তে হ’তে যখন ভারি হয়ে যায়, তখন তা নীচে পড়ে, একেই বলা হয় বৃষ্টি।
কৃত্রিম বৃষ্টি যেভাবে ঘটানোর দাবী করা হয় :
কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরি হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে আকাশের মেঘের উপর বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি প্রয়োগ করে মেঘ থেকে বৃষ্টিপাত ঘটানো। একে ক্লাউড সিডিংও (Cloud Seeding) বলা হয়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বাড়ানোর জন্য অথবা সেচের জন্য বা পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে শক্তি উৎপাদনের জন্য পানি তৈরি করা যাবে বলে তাদের দাবী। এটি কৃষি এলাকায় ভারী বৃষ্টিপাত রোধ করতে, ফসলের ধ্বংস রোধ করতে ব্যবহার করা হবে। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষজ্ঞরা ঝড়ের আশংকাযুক্ত অঞ্চলগুলিতে ঝড় পৌঁছানোর পূর্বে মেঘ তৈরি করে ঝড়ের তীব্রতা কমাতে সক্ষম হবে। ১৯৪০-এর দশকে বেশ কিছু মার্কিন বিজ্ঞানী গবেষণা করে বৃষ্টি তৈরির পদ্ধতি আবিষ্কার করেছিলেন।
মেঘের জলীয় বাষ্প যখন বরফের স্ফটিক বা পানির ফোঁটা তৈরি করে যা পৃথিবীতে পড়ার মতো ভারী হয় তখন বৃষ্টি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে, মেঘের সাথে সিডিং এজেন্ট হিসাবে পরিচিত কিছু পদার্থ যোগ করে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা বাড়ানো সম্ভব। সিডিং এজেন্ট যুক্ত করার এই পদ্ধতিটি এমন মেঘে সবচেয়ে বেশী কাজ করে যেখানে বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। সিডিং এজেন্ট হিসাবে ব্যবহৃত উপাদানসমূহ মেঘের তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে।
শূন্য ডিগ্রী সেলসিয়াসের উপরে তাপমাত্রায় ব্যবহৃত প্রধান সিডিং এজেন্ট হ’ল অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বা ইউরিয়া দ্বারা গঠিত এক প্রকার তরল। এই এজেন্টের কণা তাদের চারপাশে জলীয় বাষ্প তৈরি করে। এই সিডিং এজেন্টটি বিমানের মাধ্যমে নীচে থেকে মেঘে স্প্রে করা হয়। অন্যান্য রাসায়নিকের সাথে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট নিউক্লিয়াস বাড়ায় এবং মেঘের ঘনত্বও বাড়ায়। নিউক্লিয়াস হ’ল মেঘের মধ্যে থাকা পানির গুটিকা যা বৃষ্টি হিসাবে পড়া উচিত। এই ধরনের ফাংশন সহ, অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট কৃত্রিম বৃষ্টিতে ব্যবহৃত রাসায়নিকগুলির মধ্যে একটি।
যখন বরফের স্ফটিক তৈরি হয়, তখন তারা ছোট ছোট বরফের গুঁড়ি আকারে পৃথিবীতে পড়ে। যদি তারা শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপরে এমন একটি এলাকার মধ্য দিয়ে যায় তবে তারা গলে যায় এবং বৃষ্টি তৈরি করে।
কৃত্রিম বৃষ্টির জন্য ক্লাউড সিডিংয়ের প্রধান যেŠগ হ’ল সিলভার আয়োডাইড। সিলভার আয়োডাইড মেঘকে অধঃক্ষেপ আকারে নীচে পড়ার জন্য ট্রিগার বা হুক হিসাবে কাজ করে। রাসায়নিক পদার্থটি মেঘের সাথে মিশে যায় এবং হিমায়িত মেঘকে পানি আকারে ছেড়ে দিতে সহায়তা করে। এছাড়া কৃত্রিম বৃষ্টি তৈরীতে পটাশিয়াম আয়োডাইড ব্যবহৃত হয়।
কৃত্রিম বৃষ্টিপাত ঘটাতে কার্বনডাই অক্সাইডও ব্যবহৃত হয়। কার্বনডাই অক্সাইড মেঘের ওযন কমাতে সাহায্য করবে এবং আটকে থাকা পানিকে পৃথিবী পৃষ্ঠে নেমে আসতে সাহায্য করে। কার্বনডাই অক্সাইডকে বলা হয় শুকনো বরফ যা সাধারণ বরফের মতো নয়, তাই এটি সম্পূর্ণরূপে মেঘের অতিরিক্ত ওযন হিসাবে কাজ করে এবং এতে কোনরূপ পানি থাকে না।
এই শুকনো বরফের তাপমাত্রা প্রায় মাইনাস ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। এই শুকনো বরফ যখন মেঘের উপর ছিটিয়ে দেওয়া হয় তখন মেঘের তাপমাত্রা কমে যায় এবং মেঘ পানিতে পরিণত হয় এবং বৃষ্টি উৎপন্ন হয়। উপরোক্ত পদ্ধতি ব্যবহার করে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঘটানো যায় বলে গবেষকগণ তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেন।
এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের অভিমত :
পরিবেশবাদী লেখক আসাদ সিরাজ আবু রাজীজা বলেছেন, ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্স বলেছে যে, এখন পর্যন্ত এই প্রযুক্তি কার্যকর কি-না তা নিশ্চিত করার জন্য কোন সুনিশ্চিত তথ্য তথা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই।
আমেরিকান মেটিওরোলজিক্যাল সোসাইটি জানিয়েছে যে, ক্লাউড সিডিং বা রেইনমেকিংয়ের পরে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ দশ শতাংশ বাড়ানো সম্ভব হ’তে পারে বলে ইঙ্গিত রয়েছে।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির বায়ুমন্ডলীয় বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডাঃ উইলিয়াম কটন বলেছেন, আমরা দেখিনি- খুব বিরল ক্ষেত্র ছাড়া- ক্লাউড সিডিং এর জন্য বৃষ্টিপাত হ’তে।
কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি একটি প্রতিবেদনে বলেছে, কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি তৈরি করে খরার অবসান ঘটানো অসম্ভব এবং এটি নিশ্চিত করেছে যে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার সাফল্য লক্ষ্য করা মেঘের ধরনের উপর নির্ভর করে এবং অধিকাংশ ধরনের মেঘ তৈরি করা যায় না।
পরিবেশবাদী লেখক আসাদ সিরাজ আরও বলেছেন, এই প্রযুক্তির পরিবেশগত প্রভাবকে সমস্ত কোণ থেকে গবেষণা এবং বোঝা দরকার। কারণ ক্লাউড সিডিং-এ ব্যবহৃত উপাদান বিষাক্ত। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির শ্রেণীবিন্যাস অনুসারে যেমন, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, স্বাস্থ্য এবং নিরাপত্তা অফিস, বার্কলে, সিলভার আয়োডাইডকে একটি বিপজ্জনক রাসায়নিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করে, যা জৈব পদার্থ নয়। এটি পানিতে দ্রবণীয় নয় এবং এটি মানুষ এবং মাছের জন্য বিষাক্ত। আমেরিকার এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি সিলভার আয়োডাইডকে বিপজ্জনক এবং বিষাক্ত পদার্থ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
মানব স্বাস্থ্যের উপর সিলভার আয়োডাইডের প্রভাব সম্পর্কে অসংখ্য চিকিৎসা গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এটি হজম এবং শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে বা ত্বকের মাধ্যমে শোষণের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং এটি হজমের বিপর্যয় বা ত্বকের বিবর্ণতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন অসুস্থতার কারণ হ’তে পারে। (আরজিরিয়া, যে রোগে ত্বক নীল বা নীল-ধূসর হয়ে যায়) হালকা বিষের ক্ষেত্রে, তবে উচ্চ মাত্রায় হৃদপিন্ডের বৃদ্ধি এবং শ্বাসযন্ত্রের চরম সমস্যা হ’তে পারে।[1]
শায়খ আব্দুল মাজীদ আল-জান্দানী বলেন যে, কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের আবহাওয়াবিদ্যার অধ্যাপক ডক্টর মুহাম্মদ জামালুদ্দীন এফেন্দী উদ্ধৃত করেছেন, যে প্রাকৃতিক অবস্থার কারণে মেঘ ও বৃষ্টিপাত সৃষ্টি হয় তা মানুষ কৃত্রিমভাবে পুনরুৎপাদন করতে পারে না, এমনকি তার নিয়ন্ত্রণের কোন উপায়ও নেই। কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের বিষয়টি আসলে কৃত্রিম বৃষ্টি নয়। কারণ বৃষ্টি মানুষ গবেষণাগারে তৈরি করতে পারে না; বরং এটা এমন এক ধরনের বৃষ্টি যেটা মানুষ দ্রুত পতনের চেষ্টা করে। মেঘ পেরিয়ে বৃষ্টি তৈরি করার জন্য, শুধুমাত্র কয়েকটি পরীক্ষা ছিল যা এখনও সফল প্রমাণিত হয়নি। এমনকি যদি তারা সফল হ’তেও থাকে, তবুও কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি উৎপাদন করা সম্ভব হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক বৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় একই শর্ত প্রদান করা প্রকৃতির জন্য অপরিহার্য। অর্থাৎ প্রকৃতি যদি তার শর্ত পূর্ণ না করে তবে কৃত্রিম বৃষ্টিপাত সম্ভব নয়।[2] ইসরাঈল পরীক্ষামূলকভাবে ২০১৪ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ক্লাউন্ড সিডিং ঘটায় এবং ২০২১ সালে তারা এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। কারণ এই প্রকল্পটি অকার্যকর ও ব্যয়বহুল। কুয়েত ক্লাউড সিডিং এর উপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সফল হ’তে পারেনি। আরব আমিরাত গবেষণা করে যাচ্ছে কিভাবে এর সাহায্যে বৃষ্টিপাত বাড়ানো যায়।
এক্ষণে আমরা দেখব আল-কুরআন এবং ছহীহ হাদীছ এই ক্লাউড সিডিং সম্পর্কে কি নির্দেশনা প্রদান করে? আল-কুরআন হচ্ছে পৃথিবীর জ্ঞানের মূল উৎস এবং জ্ঞানের সীমারেখা। আল-কুরআন যে সকল বিষয়ে মানুষ সফলতা লাভ করতে অক্ষম বলে ঘোষণা করেছে ঐ সকল বিষয়ে মানুষ কখনোই সফল হ’তে পারবে না। আল্লাহ বলেন,أَأَنْتُمْ أَنْزَلْتُمُوهُ مِنَ الْمُزْنِ أَمْ نَحْنُ الْمُنْزِلُونَ، ‘তোমরা কি মেঘ থেকে ওটা বর্ষণ কর, না আমরা বর্ষণ করি?’ (ওয়াকি‘আহ ৫৬/৬৯)।
অন্যত্র আল্লাহ বলেন, إِنَّ اللهَ عِنْدَهُ عِلْمُ السَّاعَةِ وَيُنَزِّلُ الْغَيْثَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْأَرْحَامِ وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ مَاذَا تَكْسِبُ غَدًا وَمَا تَدْرِي نَفْسٌ بِأَيِّ أَرْضٍ تَمُوتُ إِنَّ اللَّهَ عَلِيمٌ خَبِيرٌ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর নিকটেই রয়েছে ক্বিয়ামতের জ্ঞান। আর তিনিই বৃষ্টি বর্ষণ করেন এবং তিনিই জানেন মায়ের গর্ভাশয়ে কি আছে। কেউ জানে না আগামীকাল সে কি উপার্জন করবে এবং কেউ জানে না কোন মাটিতে তার মৃত্যু হবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও সকল বিষয়ে খবর রাখেন’ (লোকমান ৩১/৩৪)।
আল্লাহ তা‘আলা আরোও বলেন,أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يُزْجِي سَحَابًا ثُمَّ يُؤَلِّفُ بَيْنَهُ ثُمَّ يَجْعَلُهُ رُكَامًا فَتَرَى الْوَدْقَ يَخْرُجُ مِنْ خِلَالِهِ وَيُنَزِّلُ مِنَ السَّمَاءِ مِنْ جِبَالٍ فِيهَا مِنْ بَرَدٍ فَيُصِيبُ بِهِ مَنْ يَشَاءُ وَيَصْرِفُهُ عَنْ مَنْ يَشَاءُ يَكَادُ سَنَا بَرْقِهِ يَذْهَبُ بِالْأَبْصَارِ ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ মেঘমালাকে সঞ্চালিত করেন? অতঃপর তাকে একত্রিত করেন। অতঃপর তাকে পুঞ্জীভূত করেন। অতঃপর তুমি দেখতে পাও যে, ওর মধ্য থেকে নির্গত হয় বৃষ্টিধারা। আর তিনি আকাশের শিলা পর্বত সমূহ থেকে শিলা বর্ষণ করেন। অতঃপর তা দিয়ে তিনি যাকে চান আঘাত করেন ও যাকে চান তার থেকে অন্যদিকে ফিরিয়ে দেন। মেঘের বিদ্যুতের চমক যেন চক্ষুসমূহ অন্ধ করে দেয়’ (নুর ২৪/৪৩)।
উপরের আয়াতগুলো হ’তে সুস্পষ্ট যে, বৃষ্টি কখন ও কোথায় হবে এটা সম্পুর্ণ আল্লাহ তা‘আলার ইচ্ছাধীন। বান্দা চাইলেই যদি বৃষ্টি ঘটাতে পারে তবে এই আয়াতসমূহের সাথে সাংঘর্ষিক হবে। আর আল-কুরআন ও ছহীহ হাদীছ ক্বিয়ামত পর্যন্ত মিথ্যা হবে না। এখন পর্যন্ত ক্লাউড সিডিং-এর দাবীদাররা কোনরূপ সফলতা অর্জন করতে পারেনি। আধুনিক প্রযুক্তিতে শক্তিধর ইসরাঈলও এই প্রযুক্তি হ’তে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে। এছাড়া ছহীহ হাদীছে এসেছে,
عَنْ زَيْدِ بْنِ خَالِدٍ الْجُهَنِىِّ أَنَّهُ قَالَ صَلَّى لَنَا رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الصُّبْحِ بِالْحُدَيْبِيَةِ عَلَى إِثْرِ سَمَاءٍ كَانَتْ مِنَ اللَّيْلَةِ، فَلَمَّا انْصَرَفَ أَقْبَلَ عَلَى النَّاسِ فَقَالَ «هَلْ تَدْرُونَ مَاذَا قَالَ رَبُّكُمْ». قَالُوا اللهُ وَرَسُولُهُ أَعْلَمُ . قَالَ «أَصْبَحَ مِنْ عِبَادِى مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ، فَأَمَّا مَنْ قَالَ مُطِرْنَا بِفَضْلِ اللهِ وَرَحْمَتِهِ فَذَلِكَ مُؤْمِنٌ بِى وَكَافِرٌ بِالْكَوْكَبِ، وَأَمَّا مَنْ قَالَ بِنَوْءِ كَذَا وَكَذَا فَذَلِكَ كَافِرٌ بِى وَمُؤْمِنٌ بِالْكَوْكَبِ-
যায়েদ বিন খালেদ জুহানী (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) রাতে বৃষ্টি হবার পর হুদায়বিয়াতে আমাদের নিয়ে ফজরের ছালাত আদায় করলেন। ছালাত শেষ করে তিনি লোকদের দিকে ফিরে বললেন, তোমরা কি জান, তোমাদের পরাক্রমশালী ও মহিমাময় প্রতিপালক কি বলেছেন? তাঁরা বললেন, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই অধিক জানেন। রাসূল (ছাঃ) বললেন, আল্লাহ বলেন, আমার বান্দাদের মধ্য কেউ আমার প্রতি মুমিন হয়ে গেল এবং কেউ কাফির। যে বলেছে, আল্লাহর করুণা ও রহমতে আমরা বৃষ্টি লাভ করেছি, সে হ’ল আমার প্রতি বিশ্বাসী এবং নক্ষত্রের প্রতি অবিশ্বাসী। আর যে বলেছে, অমুক অমুক নক্ষত্রের প্রভাবে আমাদের উপর বৃষ্টিপাত হয়েছে, সে আমার প্রতি অবিশ্বাসী হয়েছে এবং নক্ষত্রের প্রতি বিশ্বাসী হয়েছে’।[3]
উক্ত হাদীছ হ’তে এটা আরো সুস্পষ্ট যে, বৃষ্টি ঘটানোর একমাত্র অধিকারী হ’লেন আল্লাহ তা‘আলা। আর কোন বস্ত্ত বা ব্যক্তির পক্ষে নিজের ইচ্ছামত বৃষ্টি ঘটানো কখনোই সম্ভব নয়। আমরা মুসলমানরা বৃষ্টির জন্য ইস্তিস্ক্বার ছালাত আদায় করি। অর্থাৎ এই ছালাতের মাধ্যমে আমরা আল্লাহর নিকট বৃষ্টির জন্য দো‘আ করি। এখন যদি মানুষের পক্ষে কৃত্রিমভাবে বৃষ্টি ঘটনো সম্ভব হয় তবে এই ছালাতের প্রয়োজনীয়তা শেষ হয়ে যাবে। অর্থাৎ মানুষের পক্ষে কখনোই নিজের ইচ্ছেমত বৃষ্টিপাত ঘটানো সম্ভব নয়।
সঊদী আরববের স্থায়ী কমিটি ফাতাওয়ায় লাজনা দায়েমার মুফতীগণ বলেছেন, ‘আমরা যতদূর জানি, তথাকথিত কৃত্রিম বৃষ্টিপাতের দাবী প্রমাণিত নয়। বরং বিষয়টি নিয়ে কিছু অতিরঞ্জন আছে। আলহামদুলিল্লাহ! তবে এটি দিয়ে কোন বিভ্রান্তির সৃষ্টি করা উচিত নয়, কারণ আল্লাহ তাদের শিখিয়েছেন যে বৃষ্টি তার হুকুম অনুসারে ঘটে যখন বিভিন্ন কারণ একত্রিত হয় এবং মিথস্ক্রিয়া করে। তারপরে তারা এই কারণগুলি নিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল এবং তারা কিছু ফলাফল অর্জন করতে পারে বা নাও করতে পারে। যদি তা ঘটে, তবে তা খুব ছোট পরিসরে, বৃষ্টির মতো নয়, যা আললাহ তা‘আলা মেঘ থেকে বর্ষণ করেন।[4]
পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, ১৯৪৬ সালে তথাকথিত কৃত্রিম বৃষ্টিপাত প্রথম উদ্ভাবিত হয়েছিল। তারা যা দাবী করে তা করতে সফল হ’লে সমগ্র পৃথিবী সবুজ হয়ে যেত এবং কোন দেশে খরা হ’ত না। কিন্তু তা পরীক্ষা-নিরীক্ষার এই পর্যায় অতিক্রম করেনি। মূলতঃ বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ব্যবসা করার জন্য বিভিন্ন চমকপ্রদ বিজ্ঞাপন দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। একজন মুসলিমের সর্বদা আল-কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন করা উচিত। অহী-র বিধান যেসকল বিষয়ে মানুষের অক্ষমতা প্রকাশ করেছে সেসকল বিষয়ে মানুষের সক্ষমতা অর্জন করা কখনোই সম্ভব নয়। আল্লাহ আমাদেরকে পবিত্র কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের উপর অটল থাকার তাওফীক্ব দান করুক। আমীন!
[1]. আল-ওয়াতান, সঊদী আরব, ২৮ মে ২০০৮, ৮ম বর্ষ ২৭৯৮ সংখ্যা।
[2]. শায়খ আব্দুল মাজীদ আল-জান্দানী, তাওহীদ আল-খালিক, পৃ. ২২৩।
[3]. বুখারী হা/৮৪৬।
[4]. ফাতাওয়া লাজনা দায়েমাহ ১/২৪১।