আল্লাহ বলেন, أَفَلَا يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِنْدِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُوا فِيْهِ اخْتِلَافًا كَثِيْرًا- ‘তবে কি তারা কুরআন অনুধাবন করে না? যদি এটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট থেকে আসত, তাহ’লে তারা এর মধ্যে বহু অসঙ্গতি দেখতে পেত’ (নিসা ৪/৮২)।
কুরআন নিয়ে গবেষণা করা আল্লাহর একটি নির্দেশ। এর ফলে আল-কুরআনের বিশুদ্ধতা এবং এর জ্ঞানের গভীরতা পৃথিবীবাসীর নিকট ফুটে উঠবে এবং মানুষ দলে দলে কুরআনের দাওয়াত মেনে নিবে। উক্ত আয়াতের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা ধারাবাহিকভাবে আল-কুরআনে বিজ্ঞানের নিদর্শনসমূহ আমাদের গবেষণার আলোকে প্রকাশ করে যাচ্ছি। তারই ধারাবাহিকতায় আলোচ্য প্রবন্ধে আল-কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে আসমানে বিদ্যমান সূর্য, চন্দ্র এবং গ্রহ অবস্থানের সাথে বিজ্ঞানী কেপলারের গ্রহ সংক্রান্ত সূত্রের বিবরণ, সময় নির্ধারক হিসাবে চন্দ্র এবং সূর্যের উপযোগিতা সম্পর্কে আলোকপাত করা হয়েছে।
আসমানের সুশৃংখল গঠন এবং বিজ্ঞানী কেপলারের সূত্র :
আল্লাহ বলেন,اَلَّذِي خَلَقَ سَبْعَ سَمَاوَاتٍ طِبَاقًا مَا تَرَى فِي خَلْقِ الرَّحْمَنِ مِنْ تَفَاوُتٍ فَارْجِعِ الْبَصَرَ هَلْ تَرَى مِنْ فُطُورٍ ‘যিনি সাত আসমান সৃষ্টি করেছেন স্তরে স্তরে। দয়াময়ের সৃষ্টিতে তুমি কোন ত্রুটি দেখতে পাবে না। পুনরায় দৃষ্টি ফিরাও! তুমি কোন ফাটল দেখতে পাও কি?’ (মুলক ৬৭/৩)। তিনি আরো বলেন,ثُمَّ ارْجِعِ الْبَصَرَ كَرَّتَيْنِ يَنْقَلِبْ إِلَيْكَ الْبَصَرُ خَاسِئًا وَهُوَ حَسِيرٌ، ‘অতঃপর তুমি বারবার দৃষ্টি ফিরাও! যা ব্যর্থ ও ক্লান্ত হয়ে তোমার দিকেই ফিরে আসবে’ (মুলক ৬৭/৪)।
অন্যত্র তিনি বলেন,وَلَقَدْ زَيَّنَّا السَّمَاءَ الدُّنْيَا بِمَصَابِيحَ وَجَعَلْنَاهَا رُجُومًا لِلشَّيَاطِينِ وَأَعْتَدْنَا لَهُمْ عَذَابَ السَّعِيرِ، ‘আমরা দুনিয়ার আকাশকে প্রদীপমালা দিয়ে সুশোভিত করেছি এবং ওগুলিকে শয়তানদের প্রতি নিক্ষেপক বানিয়েছি। আর তাদের জন্য আমরা প্রস্ত্তত করে রেখেছি প্রচন্ড আগুনের শাস্তি’ (মূলক ৬৭/৫)।
উক্ত আয়াতসমূহে আল্লাহ তা‘আলা আসমানের সুশৃংখল গঠনের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ আসমানে যা কিছু রয়েছে সেগুলো এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যে, এতে কোনরূপ খুঁত পাওয়া যাবে না। আসমানে বিদ্যমান নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু, উল্কা ইত্যাদি এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছে যেন কেউ এদের অবস্থান বা বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কোন প্রশ্ন তুলতে না পারে। এখানে আমরা আসমানে এদের সুশৃংখল অবস্থান সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের গবেষণা পেশ করব। ১৬০৯ সালে জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার গ্রহ সংক্রান্ত তিনটি সূত্র প্রদান করেন।
১ম- কক্ষপথের সূত্র : প্রতিটি গ্রহ সূর্যকে একটি উপবৃত্তাকার পথের উপকেন্দ্রে রেখে আবর্তন করছে।
উপবৃত্তাকার পথ বলতে বুঝায় এমন পথ, যা দেখতে অনেকটা ডিমের মত। উপবৃত্তের দু’টি উপকেন্দ্র রয়েছে, যার একটিতে সুর্যের অবস্থান। এই উপবৃত্তাকার পথে সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তনের কারণে পৃথিবীতে ঋতু পরিবর্তন হয়, দিন-রাত ছোট-বড় হয়। আল্লাহ বলেন, إِنَّ رَبَّكُمُ اللهُ الَّذِي خَلَقَ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ فِي سِتَّةِ أَيَّامٍ ثُمَّ اسْتَوَى عَلَى الْعَرْشِ يُغْشِي اللَّيْلَ النَّهَارَ يَطْلُبُهُ حَثِيثًا وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومَ مُسَخَّرَاتٍ بِأَمْرِهِ أَلَا لَهُ الْخَلْقُ وَالْأَمْرُ تَبَارَكَ اللهُ رَبُّ الْعَالَمِينَ، ‘নিশ্চয়ই তোমাদের প্রভু আল্লাহ। যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল সৃষ্টি করেছেন ছয় দিনে। অতঃপর আরশে উন্নীত হয়েছেন। তিনি রাত্রি দ্বারা দিবসকে আচ্ছন্ন করেন এমনভাবে যে একে অপরকে দ্রুতগতিতে অনুসরণ করে। আর সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্ররাজি সবই তার হুকুমের অনুগত। মনে রেখ! সৃষ্টি ও আদেশের মালিক কেবল তিনিই। বিশ্বপালক আল্লাহ (শিরক হ’তে) মহাপবিত্র’ (আ‘রাফ ৭/৫৪)।
২০ই মার্চের কাছাকাছি দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সমান থাকে একে বলা হয়, Vernal Equinoxev March Equinoxev Spring Equinox. আবার সেপ্টেম্বরের ২২ অথবা ২৩ তারিখ দিন-রাতের দৈর্ঘ্য সমান থাকে।
আল্লাহ বলেন,أَلَمْ تَرَ أَنَّ اللهَ يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي إِلَى أَجَلٍ مُسَمًّى وَأَنَّ اللهَ بِمَا تَعْمَلُونَ خَبِيرٌ، ‘তুমি কি দেখ না যে, আল্লাহ রাত্রিকে দিবসের মধ্যে এবং দিবসকে রাত্রির মধ্যে প্রবেশ করান? আর তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে তোমাদের বশীভূত করেছেন। প্রতিটিই নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চলমান থাকবে। আল্লাহ তোমাদের কৃতকর্ম সম্পর্কে ভালভাবে খবর রাখেন’ (লুকমান ৩১/২৯)।
তিনি আরো বলেন,يُولِجُ اللَّيْلَ فِي النَّهَارِ وَيُولِجُ النَّهَارَ فِي اللَّيْلِ وَسَخَّرَ الشَّمْسَ وَالْقَمَرَ كُلٌّ يَجْرِي لِأَجَلٍ مُسَمًّى ذَلِكُمُ اللهُ رَبُّكُمْ لَهُ الْمُلْكُ وَالَّذِينَ تَدْعُونَ مِنْ دُونِهِ مَا يَمْلِكُونَ مِنْ قِطْمِيرٍ، ‘তিনি রাত্রিকে দিবসের মধ্যে প্রবেশ করান এবং দিবসকে প্রবেশ করান রাত্রির মধ্যে। আর তিনি সূর্য ও চন্দ্রকে অনুগত করেছেন। প্রতিটিই পরিচালিত হবে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত। তিনিই আল্লাহ। তোমাদের প্রতিপালক। তাঁরই জন্য সকল রাজত্ব। অথচ তাঁকে ছেড়ে তোমরা যাদের আহবান কর, তারা তো খেজুরের অাঁটির তুচ্ছ খোসারও মালিক নয়’ (ফাত্বির ৩৫/১৩)।
উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীর আবর্তন, পৃথিবীর নিজ অক্ষে আবর্তন এবং সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর আবর্তন ঘটানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা দিন এবং রাতের পরিমাণ হ্রাস-বৃদ্ধি করেন।
২য়- ক্ষেত্রফলের সূত্র : সূর্য ও গ্রহের সংযোগ রেখা সমান সময়ে সমান ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে। অর্থাৎ গ্রহ ও সূর্যের সংযোগ রেখা নির্দিষ্ট সময়ে এক অবস্থান হ’তে অন্য অবস্থানে গেলে যে ক্ষেত্রফল উৎপন্ন হয় তা পরবর্তী একই সময়ে একই ক্ষেত্রফল অতিক্রম করে।
৩য়- আবর্তনকালের সূত্র : সূর্যের চারিদিকে গ্রহের আবর্তনকালের বর্গ সূর্য হ’তে গ্রহের গড় দূরত্বের ঘনের সমানুপাতিক।[1] এ বিষয়ে নিম্নে কিছু তথ্য দেওয়া হ’ল :
(১) পৃথিবীর সূর্যের চারিদিকে একবার আবর্তন করতে ৩৬৫ দিন ৬ ঘণ্টা ৯ মিনিট সময় লাগে। (২) মঙ্গল গ্রহের নিজ অক্ষে আবর্তন করতে ২৪ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট সময় লাগে, অর্থাৎ আহ্নিক গতি। আর সূর্যের চারিদিকে মঙ্গলের একবার আবর্তন করতে ৬৮৭ দিন (পৃথিবীর হিসাবে) সময় লাগে অর্থাৎ বার্ষিক গতি। (৩) সূর্য হ’তে পৃথিবীর গড় দূরত্ব ১৫০ মিলিয়ন কিলোমিটার। (৪) সূর্য হ’তে পৃথিবীতে আলো আসতে ৫০০ সেকেন্ড বা ৮ মিনিট ২০ সেকেন্ড সময় লাগে। (৫) পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে উপবৃত্তাকার (মুরগীর ডিমের মত) পথে সেকেন্ডে ৩০০০০ মিটার বেগে ঘুরছে। (৬) একটি উপবৃত্তের দু’টি উপকেন্দ্র থাকে। দু’টি উপকেন্দ্রের যেকোন একটিতে সূর্যকে রেখে পৃথিবী এর চারিদিকে ঘুরছে। প্রতিটি গ্রহ, উপগ্রহ নির্দিষ্ট কক্ষপথে, নির্দিষ্ট আবর্তনকালে সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে।
অর্থাৎ প্রতিটি গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র, উল্কাপিন্ড, ধুমকেতু, ছায়াপথ আল্লাহ তা‘আলা এমনভাবে স্থাপন করেছেন যে, এদের মধ্যে কোনরূপ খুঁত পাওয়া যাবে না। কারো পক্ষে এমন দাবী করা সম্ভব হবে না যে, আসমানের এই বিন্যাসের চেয়ে আরো উত্তম বিন্যাস করা সম্ভব।
আল্লাহ বলেন,وَسَخَّرَ لَكُمُ اللَّيْلَ وَالنَّهَارَ وَالشَّمْسَ وَالْقَمَرَ وَالنُّجُومُ مُسَخَّرَاتٌ بِأَمْرِهِ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآيَاتٍ لِقَوْمٍ يَعْقِلُونَ، ‘তিনি তোমাদের জন্য অনুগত করেছেন রাত্রি, দিন, সূর্য ও চন্দ্রকে। আর নক্ষত্ররাজিও অনুগত তাঁরই হুকুমে। নিশ্চয়ই এর মধ্যে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য নিদর্শন সমূহ রয়েছে’ (নাহল ১৬/১২)।
বোধশক্তি সম্পন্ন জাতি হ’ল তারাই যারা আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করে এবং এই জাতির মধ্যে তারাই আল্লাহ তা‘আলার নিকট সর্বোত্তম যারা আল্লাহর সৃষ্টিতে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং প্রদত্ত বিধান আল-কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের নিদর্শন দেখতে পেয়ে আল্লাহর প্রশংসা করে এবং আল্লাহর বিধানের নিকট মাথা নত করে।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর সৃষ্টির রহস্য অনুধাবন করে তাঁর বিধানের কাছে পরিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের তাওফীক দান করুন- আমীন!
[1]. উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান, ১ম পত্র, ৬ষ্ঠ অধ্যায়।