কুরআন বলছে আসমানে কোন ফাটল নেই; বিজ্ঞান কি বলে?

মহাবিশ্ব নিয়ে জল্পনাকল্পনার শেষ নেই। বিজ্ঞানীরা এর মাত্র ৫ শতাংশ সম্পর্কে তথ্য বের করতে সক্ষম হয়েছে। এখনো ৯৫ শতাংশ বিজ্ঞানীদের নিকট রহস্যে ঘেরা। আমরা স্রেফ আল-কুরআনে বর্ণিত মহাকাশ সম্পর্কিত বৈজ্ঞানিক তথ্য সম্বলিত আয়াতসমুহ পেশ করার চেষ্টা করব। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলাই কেবল জানেন তার এই বৃহৎ সৃষ্টি সম্পর্কে তার বান্দাদের কতটুকু জানা দরকার এবং তিনি যতটুকু চাইবেন মানুষ কেবল ততটুকুই জানতে পারবে।

আল্লাহ বলেন,قُلْ أَنْزَلَهُ الَّذِي يَعْلَمُ السِّرَّ فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ إِنَّهُ كَانَ غَفُورًا رَحِيمًا، ‘তুমি বল, এটি তিনিই নাযিল করেছেন, যিনি নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের গোপন রহস্য অবগত আছেন। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল ও দয়াবান’ (ফুরকান ২৫/৬)

হাবলের মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ সংক্রান্তত (পূর্ববর্তী প্রবন্ধে এই বিষয়ে আলোচনা রয়েছ) সূত্র প্রদানের বছর দু’য়েক আগে ১৯২৭ সালে বেলজিয়ান জ্যোতির্বিদ জর্জ লেমাইটার (George Lemaitre) প্রসারণশীল বিশ্ব সংক্রান্ত তত্ত্ব প্রদান করেন, যা হাবলের সূত্রের সাথে মিলে যায়। পরে ১৯৩১ সালে তিনি আরো প্রস্তাব করেন যে, প্রসারণশীল বিশ্বকে যদি সময়ের সাথে পিছিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তাহ’লে একটা বিন্দুতে আমরা উপনীত হ’তে পারবো, যেখানে মহাবিশ্বের সমস্ত ভর পুঞ্জীভূত ছিল। যাকে আদিম পরমাণু (Primeval atom) বলা যেতে পারে এবং এখান থেকেই স্থান কালের উদ্ভব। বিগ ব্যাং (Big Bang) মডেলের শুরুও এখান থেকেই। তাই জর্জ লেমাইটারকে বিগ ব্যাং মডেলের জনক বলা হয়ে থাকে।

আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الَّذِينَ كَفَرُوا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقًا فَفَتَقْنَاهُمَا وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلَا يُؤْمِنُونَ، ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল উভয়ে যুক্ত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম এবং আমরা পানি দ্বারা সকল প্রাণবান বস্ত্তকে সৃষ্টি করলাম। এরপরও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না? (আম্বিয়া ২১/৩০)

এই বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে আমাদের পূর্ববর্তী প্রবন্ধে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।

১৯৪৬ সালে জর্জ গ্যামো (George Gamow) ও তঁার সহযোগী র‌্যালফ আলফার (Ralph Alpher) এবং রবার্ট হেরম্যান (Robert Herman) বলেন, যদি বিশ্ব দিক-নিরপেক্ষ ও সমসত্ত্ব এবং সাথে সাথে সতত প্রসারণশীল হয় তাহ’লে নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের ঘনত্ব ক্রমশঃ হ্রাস পাচ্ছে। অর্থাৎ বিপরীতক্রমে বলা যায় যে, অতীতে যখন গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যকার দূরত্ব কম ছিল তখন নিশ্চয়ই মহাবিশ্বের ঘনত্ব এখনকার তুলনায় বেশী ছিল। আর এভাবে পশ্চাত দিকে যেতে থাকলে একটা সুনির্দিষ্ট সময় আগে সমগ্র মহাবিশ্বকে একটা বিন্দুসম অবস্থায় পাওয়া সম্ভব। তখন মহাবিশ্বের সমস্ত বস্ত্ত একটি বিন্দুতে পুঞ্জীভূত ছিল এবং ঘনত্ব ছিল অকল্পনীয় রকম বেশী। বিজ্ঞানী গ্যামো সম্ভাব্য এই সময়টা হিসাব করে দেখলেন যে তা প্রায় 10×10E9 বছর থেকে 20×10E9 বছর। এ সময়টাকে গ্যামোর মহাবিশ্বের বয়স বলা হয়, যা হাবল সময়ের অনুরূপ। সেই সময় ঐ অনন্য বিন্দু বা Singularity হঠাৎ করে প্রসারিত হ’তে শুরু করে, যাকে মহাবিশ্বের বিগ ব্যাং (Big Bang) বা মহাবিস্ফোরণ মডেল বলা হয়।[1] অর্থাৎ বিগ ব্যাংক তত্ত্বের যদি উপরের মত ব্যাখ্যা করা হয় তাহ’লে বলতে হবে মহাবিশ্বের ঘনত্ব ক্রমশ হ্রাসমান।

আল্লাহ বলেন,أَفَلَمْ يَنْظُرُوا إِلَى السَّمَاءِ فَوْقَهُمْ كَيْفَ بَنَيْنَاهَا وَزَيَّنَّاهَا وَمَا لَهَا مِنْ فُرُوجٍ، ‘তারা কি তাদের উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখে না কিভাবে আমরা সেটি নির্মাণ করেছি ও তাকে সুশোভিত করেছি? আর তাতে কোনরূপ ফাটল নেই?’ (ক্বা-ফ ৫০/৬)

উক্ত আয়াতে فُرُوجٍ শব্দের অর্থ হ’ল ফাটল, খালিস্থান, শূন্যতা। অর্থাৎ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা উক্ত আয়াতে জানিয়ে দিচ্ছেন যে, আসমানে কোনরূপ খালিস্থান বা শূন্যতা বা ফাটল নেই। কিন্তু উপরের আলোচনার মত ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে মেনে নিতে হবে মহাবিশ্বে শূন্যতা বা খালিস্থান রয়েছে। কিন্তু তা আল-কুরআনের সাথে সাংঘর্ষিক। অন্যদিকে আমরা হাদীছ হ’তে জানতে পারি যে,

আবূ যর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,

 إِنِّي أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ وَأَسْمَعُ مَا لاَ تَسْمَعُونَ إِنَّ السَّمَاءَ أَطَّتْ وَحُقَّ لَهَا أَنْ تَئِطَّ مَا فِيهَا مَوْضِعُ أَرْبَعِ أَصَابِعَ إِلاَّ وَمَلَكٌ وَاضِعٌ جَبْهَتَهُ سَاجِدًا لِلَّهِ.‏ وَاللهِ لَوْ تَعْلَمُونَ مَا أَعْلَمُ لَضَحِكْتُمْ قَلِيلاً وَلَبَكَيْتُمْ كَثِيرًا وَمَا تَلَذَّذْتُمْ بِالنِّسَاءِ عَلَى الْفُرُشَاتِ وَلَخَرَجْتُمْ إِلَى الصُّعُدَاتِ تَجْأَرُونَ إِلَى اللهِ‏"‏‏‏‏

‘নিশ্চয়ই আমি দেখি, যা তোমরা দেখো না এবং আমি শুনি, যা তোমরা শোন না। আসমান চড়চড় করছে এবং চড়চড় করাই তার কর্তব্য। তাতে চার আঙ্গুল পরিমাণ জায়গাও খালি নাই, যেখানে একজন না একজন ফেরেশতা আল্লাহর জন্য সিজদায় তার কপাল লুটিয়ে দেননি। আল্লাহর শপথ! আমি যা জানি, তোমরা তা জানতে পারলে খুব কমই হাসতে, বরং অধিক কঁাদতে, বিছানায় স্ত্রীদের সম্ভোগ করতে না এবং চীৎকার করে আল্লাহর কাছে দো‘আ করতে করতে পথে- প্রান্তরে বেরিয়ে পড়তে।...[2]

আল-কুরআনের আয়াত এবং হাদীছ হ’তে জানা গেল যে, আসমানে কোনরূপ শূন্যস্থান নেই। সর্বপ্রথম আমাদের জানতে হবে কোন বস্ত্ততে শূন্যস্থান আছে কি-না তা কিভাবে জানতে পারব? পদার্থবিজ্ঞানের গুরুত্বপূর্ণ একটি রাশি হ’ল ঘনত্ব। একক আয়তনের কোন বস্ত্ততে যে ভর বিদ্যমান থাকে তাকে ঐ বস্ত্তর ঘনত্ব বলে। পৃথিবীর যতবস্ত্ত রয়েছে তার একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হ’ল ঘনত্ব। অর্থাৎ প্রতিটি বস্ত্তর ঘনত্ব আল্লাহু সুবহানাহু ওয়াতা‘আলা কর্তৃক নির্ধারিত। তাই কোন বস্ত্ত বিশুদ্ধ অবস্থায় আছে কি-না তা জানার জন্য এর ঘনত্ব নির্ণয় করতে হয়। যদি ঘনত্ব নির্ধারিত মানের চেয়ে কম বা বেশী হয় তবে বুঝে নিতে হবে মাঝে অন্যকোন বস্ত্ত প্রবেশ করেছে বা এর মধ্যে শূন্যস্থান তৈরী হয়েছে। যেমন সম আয়তনের পানির তুলনায় বরফের ঘনত্ব কম। যদিও দুইটি পদার্থ একই উপাদান হাইড্রোজেন এবং অক্সিজেন দিয়ে তৈরী। তথাপি বরফের অভ্যন্তরে শূন্যস্থান তৈরী হওয়ায় এর ঘনত্ব কমে যায়। এর তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে মহাবিশ্বের মধ্যে কোন শূন্যস্থান আছে কি-না তা নির্ণয় করা যাবে।

মহাবিশ্বের ঘনত্ব এখন যেমনটি আছে অতীতেও তেমনটি ছিল, এ ধারণা থেকেই ১৯৪৮ সালে ফ্রেড হয়েল (Fred Hoyle), হারম্যান বন্ডি (Hermann Bondi) এবং থমাস গোল্ড (Thomas Gold) বিগ ব্যাং-এর বিপরীতে স্থিতিবস্থা (Steady state) মডেল উপস্থাপন করেন। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে মহাবিশ্ব যদি সতত সম্প্রসারিত হ’তে থাকে তাহ’লে এর ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকে কিভাবে। ঘনত্ব অপরিবর্তিত থাকা সম্ভব যদি এই সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্বে সর্বদা নতুন ভরের সৃষ্টি হ’তে থাকে। বলা হয় যে, মহাবিশ্বে এমন হারে বস্ত্ত সৃষ্টি হচ্ছে যে প্রসারিত হ’লেও মহাবিশ্বের ঘনত্ব প্রায় একই থাকছে। ফলে মহাবিশ্বের দিক-নিরপেক্ষতা ও সমসত্ত্বতা ব্যাহত হচ্ছে না। মহাবিশ্বের ঘনত্ব অপরিবর্তিত রাখতে প্রতি বিলিয়ন বছরে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র একটি করে হাইড্রোজেন পরমাণু সৃষ্টি হওয়া প্রয়োজন। প্রসারণের সাথে সাথে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ার কথা। গ্যামো ধারণা করলেন Singularity থেকেই যদি মহাবিশ্বের উদ্ভব হয়ে থাকে তাহ’লে মহাসম্প্রসারণের সময়কার বিকিরণের কিছু অবশিষ্ট বিকিরণের (remnant radiation) অস্তিত্ব পাওয়ার কথা। আর্নো অ্যালান পেনজিয়াস উভয় মডেলের পক্ষে বিপক্ষে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা যখন দ্বিধাবিভক্ত তখন ষাটের দশকের মাঝামাঝি ১৯৬৫ সালে আর্নো অ্যালান পেনজিয়াস (Arno Allan Penzias) ও রবার্ট উইলসন (Robert Wilson) সন্ধান পেলেন মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণের (cosmic microwave background radiation)। পেনজিয়াস ও উইলসন ব্যাপক পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্তে আসেন যে, এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ নির্দিষ্ট কোন শনাক্তকৃত (identified) উৎস থেকে নয় বরং সারা বছরব্যাপী দিবারাত্র সবসময় সকল দিক থেকে আসছে। পেনজিয়াস ও উইলসন হিসাব করে দেখান যে, মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণের তাপমাত্রা ৩ কেলভিন এবং প্রায় সবাই মেনে নিলেন যে, এই মাইক্রোওয়েভ বিকিরণ উষ্ণ বিগ ব্যাং মডেল অনুযায়ী অতি প্রত্যাশিত অবশিষ্ট বিকিরণ।

১৯৮৯ সালে মহাজাগতিক পটভূমি এক্সপ্লোরার (Cosmic Background Explorer, COBE) বা কোবে স্যাটেলাইট প্রেরণ করে মাইক্রোওয়েভ পটভূমি বিকিরণ পরিমাপ করা হয়। সাম্প্রতিক পরিমাপ থেকে জানা যায় যে, এই বিকিরণের শক্তি ঘনত্ব প্ল্যাঙ্কের সূত্রানুযায়ী ২.৭ কেলভিন তাপমাত্রায় কৃষ্ণবস্ত্ত (এটা এমন বস্ত্ত যার উপর আরোপিত সকল দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য রশ্মি শোষণ করে) বিকিরণের শক্তি ঘনত্বের অনুরূপ। এই তাপমাত্রা ব্যবহার করে হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতি ঘনমিটার স্থান প্রায় 4x10E8 ফোটন দ্বারা পূর্ণ, যারা মহাবিশ্বকে প্রায় 2.5x10E5 বা/m3 শক্তি প্রদান করে এবং ফোটন প্রতি গড় শক্তি প্রায় 0.00063 eV। এ ফোটন সংখ্যা বিশেষ গুরুত্ব বহন করে এ কারণে যে বিগত প্রায় 13.8x10° বছর জুড়ে মহাবিশ্বে নিউক্লিয়ন ও ফোটনের অনুপাত প্রায় ধ্রুব রয়েছে। এ সকল পরীক্ষামূলক পর্যবেক্ষণ বিগ ব্যাং মডেলকে একটা শক্ত ভিত্তির উপর দঁাড় করিয়ে দিয়েছে।[3]

মহাবিশ্বের তাপমাত্রা :

সৃষ্টির শুরু হ’তে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ হ্রাসমান। গড়ে মহাবিশ্ব পরম শূন্য থেকে মাত্র 2.735 ডিগ্রি উপরে এবং বিগ ব্যাং তত্ত্ব একটি বরফ সদৃশ ভবিষ্যতের জন্য প্রস্ত্তত হওয়ার পরামর্শ দেয়। কিন্তু মহাবিশ্বের গড় তাপমাত্রার কি হবে? জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা প্রায়শই মহাজাগতিক মাইক্রোওয়েভ পটভূমির (সিএমবি) তাপমাত্রাকে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা হিসাবে বিবেচনা করেন। সিএমবি হ’ল মহাবিশ্বের প্রাচীনতম আলোর একটি স্ন্যাপশট, যা আকাশে অঙ্কিত হয়েছিল যখন মহাবিশ্বের বয়স মাত্র 380,000 বছর ছিল। এটির তাপমাত্রা পরম শূন্য থেকে মাত্র 2.735 ডিগ্রি বেশী। মহাবিস্ফোরণ তত্ত্ব ভবিষ্যদ্বাণী করে যে মহাবিশ্ব প্রসারিত হওয়ার সাথে সাথে এই তাপমাত্রা হ্রাস পাবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের বিভিন্ন দূরত্বে CMB-এর তাপমাত্রা কমিয়ে এটিই খুঁজে পেয়েছেন।[4]

মহাবিশ্বের শুরু হচ্ছে প্ল্যাঙ্ক কাল থেকে যার ব্যাপ্তি 0s থেকে 10E-43s পর্যন্ত, একে এক প্ল্যাঙ্ক সময়ও বলা হয়। এ কাল সম্পর্কে খুব কমই আমরা জানতে পেরেছি। সার্বিক আপেক্ষিক তত্ত্ব থেকে আমরা জানতে পারি যে, মহাবিশ্বের উদ্ভব একটি মহাকর্ষীয় অনন্যতা বা Gravitational singularity থেকে এবং ধারণা করা হয় যে, সে সময় সকল মৌলিক বলের তীব্রতা একই ছিল এবং সম্ভবত মহাকর্ষ বল, তাড়িত চৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল এবং সবল নিউক্লিয় বল একটি মৌলিক বল হিসাবে একীভূত অবস্থায় ছিল। এ সময়ে মহাবিশ্ব মাত্র 10E-35 মিটার বা প্ল্যাঙ্ক দৈর্ঘ্যের এলাকা জুড়ে বিরাজ করছিল এবং তাপমাত্রা ছিল প্রায় 1032 K, একে প্ল্যাঙ্ক তাপমাত্রাও বলা হয়ে থাকে।

10E-43s থেকে 10E-38s সময়কালকে ধরা হয় মহা একীভবনের কাল। এ সময়ে মহাকর্ষ বল একীভূত অবস্থায় থাকা অন্য মৌলিক বলসমূহ থেকে পৃথক হয়ে যায় এবং আদিমতম মৌলিক কণা ও প্রতি-কণাসমূহ তৈরি হ’তে শুরু করে। 10E-36s থেকে 10E-32s সময়কালকে স্ফীতিকাল (time of inflation) হিসাবে ধরা হয়। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা 1032 K থেকে 1027 K-এ নেমে আসে এবং এ সময়েই সবল নিউক্লিয় বল অন্য দু’টি একীভূত মৌলিক বল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সময়ে মহাবিশ্ব সূচকীয় স্ফীতির (exponential inflation) মধ্য দিয়ে অতি দ্রুত প্রসারিত হয় যা মহাজাগতিক স্ফীতি (cosmic inflation) নামে পরিচিত। বলা হয়ে থাকে যে, মহাবিশ্বের দিক-নিরপেক্ষতা এবং সমসত্ত্বতা বজায় রাখার জন্যই এই মহাজাগতিক স্ফীতির ঘটনা ঘটে। এই অতি ক্ষুদ্র স্ফীতিকালে ধারণা করা হয় মহাবিশ্বের রৈখিক মাত্রা 10 cm থেকে প্রায় 1026 গুণ বৃদ্ধি পায়। মহা একীভবন যুগ শেষে রয়ে যাওয়া মৌলিক কণাসমূহ একটা অতি ঘন কোয়ার্ক-গ্লুয়ন প্লাজমা বা কোয়ার্ক-গ্লুয়ন সুপ বা কোয়াগমা (Quagma) রূপে পুরো মহাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। 10E-36s থেকে 10E-12s সময়কালকে তড়িৎ দুর্বল বলের কাল হিসাবে ধরা হয়। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা 1012K-এ নেমে আসে এবং অন্য দু’টি মৌলিক বল থেকে সবল নিউক্লিয় বল বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে কণাসমূহের মিথস্ক্রিয়ায় W ও Z বোসন ও হিগস বোসনসহ বিপুল সংখ্যক বিচিত্র ধরনের কণার জন্ম হয়। বিগ ব্যাং-এর 10E-12s থেকে 10E-6s সময়কালকে কোয়ার্ক কাল হিসাবে মনে করা হয়। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা কয়েক বিলিয়ন কেলভিন নীচে নেমে আসে এবং এ সময়েই চারটি মৌলিক বল তাদের বর্তমান রূপ ধারণ করে। কোয়ার্ক এবং প্রতি কোয়ার্ক পরস্পরের সংস্পর্শে এসে বিনাশিত হয় এবং বেরিয়নসূচন (Baryogenesis) নামক পদ্ধতিতে অতি সামান্য প্রায় প্রতি বিলিয়নে একটি করে কোয়ার্ক রক্ষা পায় যারা অবশেষে সংযুক্ত হয়ে পদার্থ গঠন করে।

বিগ ব্যাং-এর পরে 10E-6s থেকে 1s সময়কালকে হ্যাডরনের কাল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। এ সময়ে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা প্রায় 101K-এ নেমে আসে। ফলে কোয়ার্কগুলো পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়ে হ্যাডরন গঠন করে। হ্যাডরন পর্বের চূড়ান্ত অবস্থায় ইলেকট্রনসমূহ প্রোটনের সাথে সংঘর্ষের ফলে একীভূত হয়ে নিউট্রন উৎপন্ন করে এবং নিউট্রিনো নামে আর একটি কণা নির্গত হয়। পূর্বে ধারণা করা হ’ত নিউট্রিনোর কোন ভর নেই। কিন্তু সম্প্রতি নিউট্রিনোর ভর নির্ণয়ে সফলতা লাভ করায় জাপানি পদার্থবিদ তাকাকি কাজিতা ও কানাডীয় পদার্থবিদ আর্থার বি ম্যাকডোনাল্ড যুগ্মভাবে ২০১৫ সালে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন।[5] উপরোক্ত তথ্য হ’তে এটা প্রতীয়মান হয় যে, এই মহাবিশ্বের তাপমাত্রা ক্রমশ হ্রাসমান এবং সম্প্রসারিত হচ্ছে তাই প্রতিনিয়ত নতুন কণা সৃষ্টি হচ্ছে। তাই আসমানে কোনরূপ খালীস্থান নেই।

চার্লসের সূত্র হ’তে জানা যায় যে, স্থির চাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ গ্যাসের আয়তন এর পরম তাপমাত্রা সমানুপাতিক। অর্থাৎ তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে আয়তন বৃদ্ধি পাবে। আবার তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে ঘনত্ব হ্রাস পায় কারণ আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু আমরা বিজ্ঞানীদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে প্রদত্ত তত্ত্ব হ’তে জানি যে, মহাবিশ্ব সৃষ্টির শুরুতে উত্তপ্ত ছিল। এরপর মহাবিশ্ব যত সম্প্রসারিত হচ্ছে এর তাপমাত্রা ধীরে ধীরে কমছে। অর্থাৎ মহাবিশ্বের আয়তন বাড়ছে কিন্তু তাপমাত্রা কমছে। কিন্তু চার্লসের সূত্রানুসারে জানি যে, তাপমাত্রা কমলে আয়তন কমবে যা মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের উলটো। এর সমন্বয় কি হবে? যদি কোন পদার্থের তাপমাত্রা হ্রাস পায় এবং আয়তন বৃদ্ধি পায় তবে এর ভরও বৃদ্ধি পেতে হবে। অর্থাৎ আয়তন বৃদ্ধির সাথে সাথে কোন শূন্যস্থান তৈরী হ’তে পারবে না এবং পদার্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পেতে হবে। এরূপ যদি ঘটে তবে ঐ বস্ত্তর ঘনত্ব স্থির থাকবে।

উপরোক্ত আলোচনা হ’তে বুঝা যাচ্ছে যে, মহাবিশ্বের আয়তন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং তাপমাত্রা হ্রাস পাচ্ছে তাই এরূপ অবস্থা বজায় রাখার জন্য যতটুকু শূন্যস্থান তৈরী হবে ততটুকু পদার্থ তৈরী হবে ফলে ঘনত্ব স্থির থাকবে। তাই মহাবিশ্বের কোথাও শূন্যস্থান বা ফাটল নেই। অর্থাৎ বিজ্ঞানীদের গবেষণা আল-কুরআনের নিকট আত্মসমর্পণ করল। অতএব একজন মানুষ যদি জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল-কুরআন এবং ছহীহ হাদীছের নিকট আত্মসমর্পণ করে তবেই তারা ইহকালীন এবং পরকালীন কল্যাণ লাভ করবে।


[1]. জ্যোতির্বিজ্ঞান, তপন-হাসান-চৌধুরী, উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র।

[2]. ইবনু মাজাহ হা/৪১৯০, সনদ হাসান। তবে হাদীছের শেষে উল্লিখিত ‘আল্লাহর শপথ! আমি যদি একটি গাছ হতাম এবং তা কেটে ফেলা হ’ত অংশটুকু যঈফ।

[3]. জ্যোতির্বিজ্ঞান, তপন-হাসান-চৌধুরী, উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র।

[4]. BBC Science Focus Magazine, Dr. Alastair Gunn.

[5]. জ্যোতির্বিজ্ঞান, তপন হাসান চৌধুরী, উচ্চ মাধ্যমিক পদার্থ বিজ্ঞান ২য় পত্র।






চন্দ্র দিয়ে মাস এবং সূর্য দিয়ে দিন গণনা : মহান আল্লাহর এক অনন্য বিধান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আছহাবে কাহফের ঘটনায় বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
পৃথিবীতে মানুষের আগমন নিয়ে আল-কুরআনের পথে বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
মানুষ কি কৃত্রিম বৃষ্টি (ক্লাউড সিডিং) ঘটাতে সক্ষম? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
রক্ত ও মৃত জন্তুর গোশত ভক্ষণ হারাম হওয়ার বৈজ্ঞানিক কারণ - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আল-কুরআনে কার্বন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস এবং পানি ও সূর্যের তরঙ্গচক্র - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আসমান ও যমীনের মাঝে বিদ্যমান পরিমাপ সমূহ - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
কুরআন বলছে আসমানে কোন ফাটল নেই; বিজ্ঞান কি বলে? - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ভাষা জ্ঞান মানবজাতির জন্য আল্লাহর অনন্য নিদর্শন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
ঘুমের কতিপয় সুন্নাতী পদ্ধতি ও আধুনিক বিজ্ঞান - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আসমান হ’তে লোহা নাযিলের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও বৃষ্টির পানির উপকারিতা - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
সূর্যের চারিদিকে গ্রহের সুশৃংখল গঠন - ইঞ্জিনিয়ার আসিফুল ইসলাম চৌধুরী
আরও
আরও
.