[ঊনিশ শতকের পূর্বে মুসলমানরা কেন মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণের ব্যাপারে আগ্রহ করেনি, কেন বাংলা ভাষায় পবিত্র কুরআন অনুবাদে মুসলমানরা এত দীর্ঘ সময় নিল, কেন তৎকালে আরবী ও ফারসীর পরিবর্তে বাংলা বা অন্য কোন ভাষাকে আলেমগণ ধর্মপ্রচারের ভাষা হিসাবে গ্রহণ করেননি, কিভাবে মুদ্রণ প্রযুক্তি মুসলিম সমাজে বাংলা ভাষায় জ্ঞানচর্চার বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছিল- ইত্যাকার প্রশ্নগুলির উত্তর খোঁজা হয়েছে আলোচ্য প্রবন্ধে। লেখকের অনেক দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের দ্বিমত রয়েছে, তবে মৌলিকভাবে তিনি যে যৌক্তিক উত্তরগুলো খোঁজার চেষ্টা করেছেন, তাতে যথেষ্ট জ্ঞানের খোরাক রয়েছে। প্রবন্ধটি ঈষৎ সংক্ষেপায়িত আকারে প্রকাশ করা হ’ল।-সম্পাদক]
ভূমিকা :
জ্ঞানের প্রচার কিভাবে ছাপাখানার সাহায্যে মৌখিক রূপ হ’তে মুদ্রিত রূপ লাভ করল, এই রূপান্তর কিভাবে একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর আবির্ভাবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল বা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশে এই রূপান্তরের আদৌ কোন ভূমিকা ছিল কি-না, একজন সমাজবিজ্ঞানীর সম্মুখে এ প্রশ্নগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক এফ.সি.আর. রবিনসন ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম হিস্ট্রি ইন সাউথ এশিয়া[1] গ্রন্থে যথার্থই বলেছেন, উপরোক্ত প্রশ্নগুলো ইউরোপীয় সমাজের প্রেক্ষাপটে কমবেশী মোটামুটি আলোচিত হয়েছে। কিন্তু দক্ষিণ এশীয় মুসলিম সমাজের উপর মুদ্রণ প্রযুক্তির প্রভাব নিয়ে এখনো যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। আসলে এ জাতীয় গবেষণার ক্ষেত্রে রবিনসন হ’লেন একজন অগ্রসৈনিক। অবশ্য বঙ্গভূমি তার গবেষণায় তেমন স্থান পায়নি যদিও সেখানে বিশ্বের একটি বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী বাস করে। বঙ্গভূমি আরেকটি কারণে গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীতে বাঙালী মুসলিমই হ’ল একমাত্র মুসলিম যারা ইসলাম কবুল করার পরও তাদের ভাষা ও লিপি উভয়টির স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। এ সকল কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় ইসলাম-এর উপর বস্ত্তনিষ্ঠ গবেষণার সময় বঙ্গভূমিকে (অবিভক্ত) অন্তর্ভুক্ত করা উচিত।
ঐতিহাসিক অমলেন্দু দে তার বাংলাভাষায় কুরআন চর্চা (কোলকাতা, ১৯৯৯) পুস্তিকায় বাংলায় কুরআন অনুবাদের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। অবশ্য সেখানে মুদ্রণ প্রযুক্তির আবির্ভাব ও ব্যবহারের সঙ্গে অনুবাদ ক্রিয়ার সম্পর্ক নিয়ে কথা বলা হয়নি। ড. মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান তাঁর পরিশ্রমলব্ধ এবং তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ বাংলাভাষায় কুরআন চর্চায় (ঢাকা, ১৯৮৬) ঔপনিবেশিক আমলে কুরআনের বঙ্গানুবাদ সংশ্লিষ্ট নানা তথ্য তুলে ধরেছেন। তিনি একজন একনিষ্ঠ মুসলমানের অবস্থান হ’তে উক্ত গ্রন্থ রচনা করেছেন। ফলে তার লেখায় একজন নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকের চুলচেরা বিশ্লেষণ প্রায়ই অনুপস্থিত থেকেছে। উপরন্তু তিনি ঊনিশ শতকের বাঙালী মুসলিম সমাজে মুদ্রণ প্রযুক্তির গুরুত্বকে উপেক্ষা করেছেন। যাহোক, গবেষণার ময়দানে বিদ্যমান সেই শূন্যস্থান পূরণ করার লক্ষ্যে অত্র প্রবন্ধের অবতারণা করা হয়েছে।
আমাদের গবেষণাকাল হ’ল ঊনিশ শতকের শেষার্ধ। কারণ এ সময় একটি শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটতে শুরু করেছিল। এ সময় বাঙালী মুসলিম সমাজ কর্তৃক মুদ্রণ প্রযুক্তি বরণ করে নেওয়া ছাড়াও মূল আরবী হ’তে বাংলায় সমগ্র কুরআন অনুবাদ করার মতো ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল। অবশ্য বিশ শতক জুড়েও কুরআনের অনুবাদ অব্যাহত ছিল। তবে সে সময় মুসলিম সমাজ কর্তৃক রাজনীতিতে অংশগ্রহণের কারণে উপলক্ষটা ছিল ভিন্ন। এ কারণে আমাদের গবেষণা ঊনিশ শতকের শেষভাগে সীমাবদ্ধ থাকবে। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে ঊনিশ শতক ধর্মীয় আলোচনা-পর্যালোচনার শতক হিসাবে পরিচিত হয়ে আছে। বিষয়টি উত্তমরূপে উপস্থাপনের জন্য প্রবন্ধটি দু’টি ভাগে ভাগ করা হয়েছে। প্রথম ভাগে ইতিহাসের আলোকে মুদ্রণ প্রযুক্তির আবির্ভাব, বিকাশ ও বাঙালী মুসলিম সমাজের উপর এর প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আর শেষভাগে কুরআনের বঙ্গানুবাদ ও তার গুরুত্ব তুলে ধরা হয়েছে।
১. জ্ঞান প্রচারে পরিবর্তন : কুরআননির্ভর ধর্মানুভূতির ভিত্তি স্থাপন :
বর্তমান যুগে মুদ্রণ প্রযুক্তি জ্ঞান প্রচারকে ধ্বনি হ’তে দৃশ্যে রূপান্তর করে ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করছে। যেমন মুদ্রণ প্রযুক্তি জ্ঞানের মৌখিক বর্ণনাকে দৃশ্যমান মুদ্রিত হরফে রূপান্তর করেছে। স্মর্তব্য যে, মুসলমানরা ঊনিশ শতকের পূর্বে মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণ করেনি। ইসলাম যে জ্ঞানের মৌখিক বর্ণনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় তা কুরআনের মৌখিক বর্ণনার মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত এ কারণে মুসলমানরা ঊনিশ শতকের পূর্বে মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণের আগ্রহ অনুভব করেনি।
প্রশ্ন ওঠে কেন মুসলমানরা ঊনিশ শতকে এসে মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণ করল? উত্তর বের করা কঠিন নয়। ঔপনিবেশিক আমলে যখন দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন ঘটছে, বই-পুস্তকের মাধ্যমে ইউরোপীয় বিজ্ঞান, সাহিত্য, দর্শন ও রাজনৈতিক আদর্শ ছড়িয়ে পড়ছে, তখন আলেম সমাজ যাদের পক্ষে আর মুসলিম শাসকবৃন্দের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করা সম্ভব ছিল না, তারা কোণঠাসা হয়ে পড়লেন।[2] যেমন উত্তর ভারতে খৃষ্টান মিশনারীরা পথে-ঘাটে ও বই- পুস্তকে ইসলামকে আক্রমণ করে মুসলমানদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার করতে লাগলো। উপরন্তু বাঙালী হিন্দু ও ব্রাহ্মণ যারা তাদের তুলনামূলক পিছিয়ে পড়া মুসলিম প্রতিপক্ষের চেয়ে কয়েক দশক পূর্বে নিজেদের অস্তিত্বের সন্ধান শুরু করেছিল, তারা মুদ্রিত বই-পুস্তক হ’তে ধর্মীয় অনুপ্রেরণা লাভ করছিল। এই পরিস্থিতিতে আলেম সমাজ অনুধাবন করলেন যে, স্বয়ং মুসলমানদেরকে দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমে ইসলামকে সর্বোত্তম রূপে হেফাযত করা সম্ভব হবে এবং নবাগত মুদ্রণ প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে এ কাজ আঞ্জাম দেওয়া যাবে।[3]
বাঙালী আলেম সমাজ কর্তৃক মুদ্রণ প্রযুক্তি বরণ করে নেওয়ার বিষয়টি বাংলা ভাষায় ক্রমবর্ধমান নছীহতনামা প্রকাশ ও কুরআন-হাদীছ সহ অন্যান্য ধর্মীয় পুস্তকের ভাষান্তরে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।[4] আরবী না-জানা বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় জ্ঞান সমৃদ্ধ করতে এক সময় ছালাত সংক্রান্ত বিষয়াবলিও বাংলায় অনূদিত হয়েছিল।[5] স্মর্তব্য যে, মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণ করে আলেম সমাজ বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থাকে বদলাতে চাননি; বরং আরো সংহত করতে চেয়েছিলেন। তারা ধর্মীয় জ্ঞানের প্রচার ও ব্যাখ্যাদানের ক্ষেত্রে তাদের একক কর্তৃত্ব হারাতে চাননি। এ কারণে তৎকালীন সীরাত রচয়িতা আব্দুর রহীমকে তার রচিত সীরাত প্রকাশের পূর্বে আলেম সমাজের অনুমতি নিতে হয়েছিল।[6]
যাহোক, একবার যখন আলেম সমাজ মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণ করল, তখন জ্ঞান প্রচারের প্রথাগত পদ্ধতি বদলে গেল এবং এভাবে ইলমী ময়দানে আলেমদের একচ্ছত্র আধিপত্য হুমকির মুখে পড়ল। দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ভাষাকে কাফিরদের ভাষা মনে করা হ’ত, ফলে কোন ধর্মীয় কিতাবের বঙ্গানুবাদ করা শরী‘আত বিরোধী কাজ বলে গণ্য হ’ত।[7] এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ব্রাহ্মণ পন্ডিত গিরিশচন্দ্র সেন হ’লেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি সমগ্র কুরআন মূল আরবী হ’তে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। উপরন্তু তিনি হ’লেন প্রথম ব্যক্তি, যিনি বাংলায় মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী রচনা করেছেন (১৮৮৫)। কতিপয় মুসলিম চিন্তাবিদ এদেশীয় ভাষায় ইসলামী কিতাবাদি অনুবাদের ময়দানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার জন্য ব্রাহ্মণদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন, যদিও বহু বাঙালী মুসলিম লেখক তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল।[8] স্বদেশী ভাষায় অনুবাদ এবং মুদ্রণ প্রযুক্তির ফলে ধর্মীয় জ্ঞান বাংলার শিক্ষিত মুসলমানদের নিকট সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল এবং ফলশ্রুতিতে অত্র প্রদেশের মুসলমানদের মধ্যে উম্মাহ চেতনার বিকাশ ঘটেছিল। অতঃপর বাংলা ভাষায় সীরাতসহ অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ রচনার ফলে উক্ত চেতনা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল।
মুদ্রণ প্রযুক্তি ও অনুবাদ প্রকল্পের সহযোগে মৌখিক ধ্বনি হ’তে দৃশ্যমান হরফে জ্ঞানের রূপান্তর সম্ভব হয়েছিল। ফলশ্রুতিতে সাধারণ মুসলমানরা আলেম সমাজ, বিশেষত উর্দূভাষী আলেম সমাজের তদারকি ব্যতিরেকে ধর্মীয় গ্রন্থাদি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের সুযোগ পেল। এই পরিস্থিতিতে আমাদেরকে দু’টি বিষয় মনে রাখতে হবে। প্রথমতঃ ব্যক্তি নিজে ব্যাখ্যাদানকারী হিসাবে আবির্ভূত হওয়ায় জ্ঞান প্রচারের ক্ষেত্রে আলেম সমাজের একক কর্তৃত্ব সীমিত হয়ে পড়েছিল।[9] এ বিষয়টি বৃহত্তর ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে বিচার করা উচিত। কারণ ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে উদীয়মান মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ ঘটেছিল। সে সময় ব্যক্তি নিজের জীবনের উপর আরো বেশি নিয়ন্ত্রণ লাভ করছিল। কর্মব্যস্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা মাদ্রাসা শিক্ষায় শিক্ষিত ছিল না, ধর্মীয় পিপাসা নিবারণের জন্য আলেম সমাজ প্রদত্ত ব্যাখ্যা গ্রহণের মানসিকতাও তাদের ছিল না, সময়ও ছিল না। ঔপনিবেশিক শাসনামলে দ্রুত পরিবর্তনশীল সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিবেশে টিকে থাকার জন্য ব্যক্তি নিজের ভূমিকা তালাশ করছিল। নবী মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর জীবনী পাঠকোপযোগী শতশত সীরাত গ্রন্থে আলোচিত হয়েছিল। এটি দক্ষিণ এশিয়ায় নবীকেন্দ্রিক ধর্মচিন্তার উৎপত্তি ও বিকাশে অবদান রেখেছিল এবং ইলমী কর্তৃত্ব আলেম সমাজের হাত হ’তে সরাসরি মুদ্রিত কুরআন বা সীরাত হ’তে নির্দেশনা গ্রহণে সক্ষম শিক্ষিত শ্রেণীর হাতে অর্পণ করেছিল।
মুদ্রণ প্রযুক্তি ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের আরেকটি দিক ছূফীবাদের প্রতি বাঙালী মুসলমানদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ফুটে উঠেছিল। ঊনিশ শতকের শেষ ভাগ হ’তে ধর্মীয় বই-পুস্তক স্বদেশী ভাষায় মুদ্রিত আকারে আরো বেশী সহজলভ্য হয়ে উঠেছিল। ফলশ্রুতিতে শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সম্মুখে আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারণের জন্য পুরোপুরি ছূফীবাদের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে দ্বীনী বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অপার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল।[10] শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত কর্তৃক বাংলার ছূফীবাদের সমালোচনা আব্দুল্লাহ (১৯২০) উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।[11] স্মর্তব্য যে, গ্রামাঞ্চলে শক্ত অবস্থানে থাকা উত্তর ভারতের ব্রেলভীদের মতো[12] বাংলার বাউলরাও অশিক্ষিত গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুবিধার্থে ছূফীবাদের ওপর গুরুত্বারোপ অব্যাহত রাখল। আমাদের জানা মতে জ্ঞান বিপ্লবের সেই যুগে প্রথা ভারাক্রান্ত বাউলদের নির্মূল করার জন্য ফৎওয়া জারী করা হয়েছিল। মুদ্রণ প্রযুক্তি জ্ঞান বিপ্লবের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। কারণ বই-পুস্তক তখন বাঙালী মুসলিম সমাজ হ’তে বিভিন্ন রীতিনীতি নির্মূল করার মাধ্যমে সংস্কারকের ভূমিকা পালন করছিল।[13]
ফুরফুরার (হুগলি) পীর আবুবকর এই পরিবর্তনশীল পরিস্থিতি ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। ফলশ্রুতিতে তিনি ঊনিশ শতকের শেষ দিকে এবং বিশ শতকের প্রথম দিকে বাস্তবসম্মত উপায়ে ধর্মীয় সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন।[14] ‘ইসলাম দর্শন’-এর মতো সাময়িকীগুলো যেগুলো ইসলামী ঐক্যের আহবান জানাত, সেগুলো উক্ত পীরের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিল।[15] এই ঘটনা স্পষ্ট করে যে, কেন বিশ শতকে কতিপয় বাঙালী মুসলিম লেখক ছূফীবাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন যদিও তারা এর সুপারিশের দাবীর প্রতি আস্থাশীল ছিলেন না।
আমরা বিশদভাবে দেখিয়েছি কিভাবে মুদ্রিত আকারে ধর্মীয় কিতাবাদির সহজলভ্যতা শিক্ষিত মুসলমানদের উপর ব্যক্তিগতভাবে দ্বীনী ইলমের মর্ম অনুধাবনের গুরুদায়িত্ব অর্পণ করেছিল। ব্যক্তিগত অনুধাবনের প্রতি গুরুত্বারোপের ফলে মুসলমানরা নিষ্ক্রিয়ভাবে শুধুমাত্র ছূফীবাদের নিকট নিজেদেরকে সঁপে দেওয়ার পরিবর্তে পার্থিব জীবনে কর্মমুখী হওয়ার গুরুত্ব উপলব্ধি করল। এই কর্মচেতনা আলেম সমাজকে বিভিন্ন সংগঠনের (আনজুমান) শিক্ষিত মুসলমানদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করল। এজাতীয় সংগঠন বাঙালী মুসলিম জনতা ও সুসংঘবদ্ধ রাজনীতির মধ্যে সংযোগ হিসাবে কাজ করত। একদিকে শিক্ষিত মুসলমানদের মধ্যে ছূফীবাদের প্রভাব কমতে থাকল, অপরদিকে তারা সরাসরি মুদ্রিত কুরআন ও সীরাত হ’তে তাদের আধ্যাত্মিক ও মানসিক পিপাসা নিবারণে রত হ’ল। অতঃপর আত্মবিশ্বাসী শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী পীর-মুরশিদের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ জানাল এবং জাগতিক ও ধর্মীয় ব্যাপারে মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে দলীল হিসাবে গ্রহণ করল।[16]
যখন জ্ঞান প্রচার ব্যক্তিগত দায়িত্বে রূপ নিচ্ছিল, তখন মাওলানা আকরাম খাঁ ও মুনীরুয্যামান ইসলামাবাদীর মতো একদল বাস্তববাদী আলেম ধর্মীয় প্রকাশনার জগতে পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে বাঙালী মুসলিম সমাজে প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করেছিলেন। পরিহাসের বিষয় এই যে, এ জাতীয় প্রকাশনাগুলোও একশ্রেণীর মুসলমানের উদ্ভব ঘটিয়েছিল, যারা ব্যক্তিগতভাবে ইসলাম অনুধাবনের দাবী তুলেছিল। যেমন ইতিপূর্বে তারা আলেম সমাজ প্রদত্ত ব্যাখ্যা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কতিপয় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম এমন ছিল যে, প্রাত্যহিক জীবনে তাদের শারঈ নির্দেশনা অনুসরণের কদাচিৎ সময় মিলত। তারা ছিল জন্মসূত্রে মুসলিম। গৌর কিশোর ঘোষের উপন্যাস ‘প্রেম নেই’, এ প্রধান চরিত্র শফীকুল এই নব্য শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করেছে। এই শ্রেণীর মুসলমানরা ইজমা, কিয়াস ও ফিকহকে শরী‘আতের দলীল হিসাবে গ্রহণ করতে প্রস্ত্তত ছিল না, কারণ তাদের দাবী মতে, এগুলো সরাসরি আল্লাহ এবং মুহাম্মাদ (ছাঃ)-এর কথা নয়, বরং ইমাম ও মৌলভীদের ব্যাখ্যা মাত্র।[17]
একদল শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মুসলিম আলেম সমাজের শরণাপন্ন হওয়ার পরিবর্তে কুরআন, হাদীছ ও সীরাতকে শরী‘আতের দলীল হিসাবে বেছে নিল। সন্দেহ নেই যে, এগুলো বঙ্গভূমিতে কুরআননির্ভর ধর্মচর্চার উৎপত্তি ও বিকাশে সহায়ক হয়েছিল।
এভাবে মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণের ফলে জ্ঞান প্রচারের পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছিল এবং পরবর্তীতে আলেম সমাজ ও ছূফীদের সঙ্গে শিক্ষিত মুসলমানদের সম্পর্ককে ভিন্ন অবস্থানে নিয়ে গিয়েছিল। এমনিভাবে আমরা বাঙালী মুসলিম ছাপাখানার সমৃদ্ধি ও ইসলামী ঐক্যচিন্তার মধ্যে এক নিবিড় সম্পর্ক লক্ষ্য করেছি। তবে ছাপাখানার ভূমিকাকে অতিরঞ্জিত করা উচিত নয়। কারণ এখনো দক্ষিণ এশিয়ায় সাক্ষরতার হার অতি নিম্নে।[18]
২. কুরআনের বঙ্গানুবাদ ও এর প্রভাব :
১৮৮০-এর দশকে ড. জেমস ওয়াইজ নামে ঢাকার একজন চিকিৎসক ঊনিশ শতকের সাধারণ বাঙালী মুসলিম সম্পর্কে কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ দিয়েছিলেন যে, তাদের অধিকাংশ ছিল সাধারণ কৃষক এবং ইসলামের বুনিয়াদি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদের অনেকে হিন্দুদের উৎসবে অংশগ্রহণ করত। আলেম সমাজের মধ্যে যারা ঊনিশ শতকের প্রথমার্ধে বিভিন্ন ইসলামী পুনর্জাগরণমূলক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তারা সাধারণ মুসলমানদের হিন্দুদের উৎসবে যোগদান করা হ’তে বিরত থাকার আহবান জানানোর মাধ্যমে ইসলামকে অনৈসলামিক কার্যকলাপ হ’তে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তরীকায়ে মুহাম্মাদিয়া ও ফরায়েযী আন্দোলনের সময় বাংলার সাধারণ মুসলমানদের একজন প্রকৃত মুসলমানের ন্যায় আরবীতে ছালাত আদায় করতে বলা হ’ত। কারণ তখন বাঙালী কৃষিজীবী মুসলমানরা আরবীতে ছালাত আদায় করত না। ড. ওয়াইজের বিবরণ থেকে আমরা জানতে পারি তখন আরবীতে ছালাতের ইমামতি করতে পারে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর ছিল।[19]
বাংলায় ইসলাম আগমনের পর হ’তে বেশ কয়েক শতক পেরিয়ে গেছে। বাংলা ভাষায় বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে। তাহ’লে কেন বাঙালী মুসলমানরা মাত্র ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ হাতে পেল? কেন বাংলা তাফসীরের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল? দৃশ্যত এজন্য আমরা দু’টি জিনিসকে দায়ী করতে পারি। প্রথমতঃ ঊনিশ শতকের তৃতীয় দশক পর্যন্ত শিক্ষিত বাঙালী মুসলমানরা সরকারী ও সাংস্কৃতিক কার্যাবলিতে উর্দূ ও ফারসী ভাষা ব্যবহার করত এবং উভয় ভাষাতে কুরআনের অনুবাদ সম্পন্ন হয়েছিল। তাফসীরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সেকালের সম্ভ্রান্ত বাঙালী মুসলমানরা উর্দূ ও ফারসী উভয় ভাষা জানত এবং মাঝে মাঝে তারা একে অন্যের সঙ্গে উর্দূ ভাষায় বাক্যালাপ করত।[20] মোশাররফের পিতা এই শ্রেণীর মুসলমানদের প্রতিনিধি ছিলেন। তিনি উর্দূ ও ফারসী জানলেও বাংলা লিখতে বা পড়তে পারতেন না।[21] এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষিত বাঙালী মুসলমানরা বাংলা ভাষায় ধর্মীয় বই-পুস্তক অনুবাদ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি।[22] পরবর্তীতে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন শিক্ষিত বাঙালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী আত্মপ্রকাশ করতে লাগল এবং সম্ভ্রান্ত বাঙালী মুসলমানরা প্রভাবশালী হ’তে শুরু করল, তখন বাঙালী মুসলিম সমাজে বাংলা ভাষার গুরুত্বও বেড়ে গেল।[23]
দ্বিতীয়ত, দীর্ঘদিন ধরে বাঙালী মুসলমানরা কুরআনের অনুবাদ করাকে শরী‘আত বিরোধী কাজ হিসাবে বিবেচনা করত। তাদের ধারণা ছিল অনুবাদের ফলে কুরআন তার আসমানী আবহ হারিয়ে ফেলবে এবং সাধারণ মুসলমানরা তা পড়ে গোমরাহ হয়ে যাবে। এখানে উল্লেখ্য যে, ধর্মতাত্ত্বিক শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহঃ) ১৭৩৭ সনে কুরআনের ফারসী অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এর একশ চুয়াল্লিশ বছর পর ময়মনসিংহ যেলা হ’তে ভাই গিরিশ চন্দ্র সেনের হাত ধরে বাংলা কুরআন প্রকাশিত হয়। দ্বিতীয় খন্ড বেরিয়েছিল ১৮৮২ সনে। তারপর এল তৃতীয় খন্ড। শেষ দু’টি খন্ড কোলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল।[24]
ভাই গিরিশচন্দ্র সেন অনূদিত কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ ১৮৮৬ সনে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রথম সংস্করণে এক হাযার কপি ছাপা হয়েছিল। দ্বিতীয় (১৮৯২), তৃতীয় (১৯০৮) এবং চতুর্থ (১৯৩৬) সংস্করণেও সমসংখ্যক মুদ্রিত হয়েছিল। ১৮৮১ সনে যখন প্রথম খন্ড বের হ’ল, মুসলিম সমাজের এক ব্যক্তি ভাই গিরিশচন্দ্রকে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। অবশ্য পরবর্তী খন্ডগুলো সামনে আসার পর কতিপয় মুসলিম পন্ডিত তার ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন। ১৯৩৬ সনে যখন ভাই গিরিশচন্দ্র অনূদিত কুরআনের চতুর্থ সংস্করণ বের হ’ল, তখন প্রখ্যাত ধর্মবিদ ও মুসলিম লীগ নেতা মাওলানা আকরাম খাঁ এটির ভূমিকা লিখেন এবং গিরিশচন্দ্রের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ব্যক্ত করেন। এভাবে বাঙালী মুসলমানরা তাদের ধর্মগ্রন্থের সঙ্গে পরিচিত হয়।[25]
গিরিশচন্দ্র প্রাথমিক পর্যায়ে বেনামে অনুবাদ করেন। কারণ তিনি হয়ত আশংকা করেছিলেন, একজন অমুসলমানের এমন উদ্যোগ বাঙালী মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য না-ও হ’তে পারে। এ ধরনের আশংকা অবশ্য অমূলক ছিল না। কারণ ইতিপূর্বে উল্লেখিত হয়েছে যে দীর্ঘদিন ধরে বাঙালী মুসলমানরা কুরআনের বঙ্গানুবাদ করাকে শরী‘আতবিরোধী কাজ বলে বিবেচনা করেছে। একথাও ইতিমধ্যে এসে গেছে যে, বাংলা কুরআনের প্রথম খন্ড প্রকাশিত হওয়ার পর মুসলমানদের একজন অনুবাদককে হত্যার হুমকি দিয়েছিল। যাহোক, কতিপয় মুসলিম পন্ডিতের ইতিবাচক সাড়া পেয়ে বেনামি অনুবাদক পরবর্তী খন্ডগুলোতে নিজের নাম প্রকাশের যথেষ্ট সাহস পেলেন। নিজের নাম প্রকাশের পর, ভাই গিরিশচন্দ্র পরবর্তী সংস্করণে মিশ্র অনুভূতি ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছিলেন কারণ তার দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টা অবশেষে আলোর মুখ দেখেছে। একই সাথে তিনি তার গুরু কেশবচন্দ্র সেন পরলোকগমন করায় শোক প্রকাশ করেন। কেশবচন্দ্র ছিলেন বিখ্যাত ব্রাহ্মণ নেতা যিনি মূলতঃ গিরিশ চন্দ্রকে ইসলামী বই-পুস্তক বাংলায় অনুবাদ করতে উৎসাহিত করেছিলেন। পরিশ্রমী ও অধ্যাবসায়ী শিষ্য গিরিশচন্দ্র কুরআনের বঙ্গানুবাদ সম্পন্ন করেছে দেখলে কেশবচন্দ্র খুশিই হ’তেন।[26]
কুরআনের প্রত্যক্ষ অনুবাদের ময়দানে রংপুরের (বর্তমানে বাংলাদেশে) আমীরুদ্দীন বসুনিয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তার অনুবাদ ছিল অসম্পূর্ণ। কারণ এটি আমপারা অংশে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৮০৮ সালে তিনি আমপারা অংশ অনুবাদ করেন এবং দু’ভাষী বাংলায় অথবা পুঁথি আকারে তাফসীরও রচনা করেন (দু’ভাষী বাংলা হ’ল আরবী ও ফারসী শব্দবহুল বাংলা)। পরবর্তীতে ১৮৬৬ সালে এগুলো কাব্য আকারে সরল বাংলায় প্রকাশিত হয়।[27] প্রখ্যাত বিদ্বান আনিসুজ্জামান তার শ্রেষ্ঠ গবেষণাকর্ম মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, এই দু’ভাষী বা পুঁথি রীতি ১৮৬০-এর দশক পর্যন্ত মুসলিম বাঙালিদের সাহিত্যে প্রবল ছিল। এই রীতি বিশেষত অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল। পুঁথিসাহিত্য জনসাধারণের সম্মুখে পাঠ করে শোনানো হ’ত এবং তাদের মুখস্থকরণের সুবিধার্থে প্রায়ই এগুলো পদ্যে রচিত হ’ত। এই বিষয়টি নিশ্চিত করে যে, ঊনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালী মুসলমানদের একটি অংশ সাধারণ মুসলমানদেরকে ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষায় শিক্ষিত করার ব্যাপারে সচেতন হয়ে উঠেছিলেন।[28]
আমীরুদ্দীন ছাড়াও, গোলাম আকবর আলী এবং খন্দকার মীর ওয়াহিদ আলী কুরআনের অংশবিশেষ কাব্য আকারে অনুবাদ করেছিলেন। তবে ব্রাহ্মণ পন্ডিত ভাই গিরিশচন্দ্র সেন ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি সমগ্র কুরআন মূল আরবী হ’তে বাংলায় অনুবাদ করেন। গিরিশচন্দ্রের সময় হ’তে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলা ভাষায় ইসলামের উপর বহু গ্রন্থ রচিত হয়েছে, যেগুলোর মধ্যে কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীরও শামিল রয়েছে। ওসব ধর্মীয় রচনাবলি প্রকৃতপক্ষে বাঙালী মুসলমানদেরকে তাদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত সম্পর্কে সচেতন করেছে। ক্রমশঃ তারা তাদের পৃথক জাতিসত্ত্বার ব্যাপারে সচেতন হয়েছে। এসব ঘটনাবলির সুদূর প্রসারী প্রভাব ছিল।[29]
বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে কুরআনের বঙ্গানুবাদ করার বা তাফসীর রচনার প্রবল আগ্রহ থাকা স্বাভাবিক। তবে প্রশ্ন হ’ল কেন ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মতো একজন অমুসলিম ব্যক্তি এধরনের দুরূহ কাজ হাতে নিলেন? তার ও মুসলমানদের অনুবাদ উদ্যোগের মধ্যে কি কোন তফাৎ ছিল? এসব অনুবাদকর্ম কি তুলনামূলক ধর্মচর্চার পক্ষে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল? এ প্রশ্নগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক যেগুলো নিয়ে আলোচনা করা দরকার। উল্লেখ্য যে, ব্রাহ্ম নেতা কেশবচন্দ্র সেন তার পূর্বসূরী রাজা রামমোহন রায়ের মতো সারগ্রাহী মানসের অধিকারী ছিলেন। সেন তার সহযোগীদেরকে সকল ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের আহবান জানান। সেই লক্ষ্য মাথায় রেখে তিনি চারজন নিবেদিতপ্রাণ বিদ্বানকে বেছে নিয়েছিলেন।
তিনি ভাই গিরিশচন্দ্র সেনকে (১৮৩৫-১৯১০) ইসলামের উপর পড়াশোনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সংস্কৃত, ফারসী, আরবী, উর্দূ ও বাংলা ভাষায় পারদর্শী হওয়ায় গিরিশচন্দ্র কেশব সেনের সমন্বয় প্রচেষ্টাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পক্ষে পুরোপুরি উপযুক্ত ছিলেন। তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করে কেশব সেন ও তার সহযোগীবৃন্দ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বিশেষত হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে আরো ভালো সম্পর্ক সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন।[30] ভারতের মতো বহুজাতিক সমাজে যৌগিক সংস্কৃতি গ্রহণের পরিবেশ সৃষ্টি করা খুবই যরূরী ছিল। সেই ইতিবাচক পরিকল্পনা বিভিন্ন সম্প্রদায়ের পক্ষ হ’তে পূর্বেও বাধার সম্মুখীন হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। তবে সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ।
যে সকল হিন্দু ও ব্রাহ্মণ পন্ডিতের ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান ছিল তাদের এবং মুসলিম ধর্মগুরুদের দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে মিল ছিল না। বাংলার যে সকল হিন্দু ও বৌদ্ধ ইসলাম কবুল করেছিল তাদের মধ্যে অনেক অনৈসলামিক আক্বীদা ও রীতিনীতি বিদ্যমান ছিল। ঊনিশ শতকের মুসলিম সংস্কারকগণ ইসলামীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইসলামকে এ সকল অনৈসলামিক কার্যকলাপ থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। এটি অবশ্য বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের জন্যও যরূরী ছিল। কিন্তু ইসলাম ও ইসলামের ইতিহাসের উপর বাংলা ভাষায় বই-পুস্তকের অভাবে ঊনিশ শতকে উক্ত সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়নি। একমাত্র যে উপায়ে বাংলার কৃষিজীবী, অশিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মুসলমানদের নিকট ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া যেত তা হ’ল গ্রামীণ মসজিদের ইমাম। বহু ইমাম উক্ত কাজ সম্পাদনের পক্ষে উপযুক্ত ছিলেন না। এমন পরিস্থিতিতে ঊনিশ শতকের মুসলিম পন্ডিত ও লেখকগণ মুসলিম জনতার মধ্যে ইসলামী আদর্শ ও ঐতিহ্য ছড়িয়ে দেওয়ার উপর গুরুত্বারোপ করলেন। তারা সাধারণ মুসলমানদের নিকট কুরআন ও হাদীছে বর্ণিত ইসলামের মৌলিক শিক্ষাগুলো তুলে ধরার ব্যাপারে বেশী আগ্রহী ছিলেন। তারা আসলে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব অধ্যয়নের ব্যাপারে কদাচিৎ আগ্রহ দেখিয়েছিল। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, ১৮০৪ সালে যখন রামমোহন রায় ফারসী ভাষায় ‘তুহফাতুল মুওয়াহিহদীন’ (একত্ববাদীদের উপহার) পুস্তিকাটি প্রকাশ করেন, সমকালীন শিক্ষিত মুসলিম সমাজে এর উল্লেখযোগ্য কোন প্রভাব পড়েনি।[31]
উক্ত পুস্তিকায় রামমোহন কুরআন ও হাদীছের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের মত প্রকাশ করেন। যেহেতু তিনি আরবী ও ফারসী ভাষায় দক্ষ ছিলেন, তিনি ইসলামী ধর্মতত্ত্বের গভীরে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন। একজন যুক্তিবাদী চিন্তাশীল হিসাবে তিনি তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে গ্রহণ করতে পারেননি যারা নিজেদের ধর্মকে নির্ভুল দাবী করে এবং কোন বিষয়ে ভিন্নমত পোষণকারীদের ধর্মের সমালোচনা করে। তিনি বললেন, অন্যান্য মানুষের মতো তাদের পূর্বসুরীরাও ভুল করেছে। তিনি দাবী করলেন, কোন ধর্মই নির্ভুল নয়। তিনি লক্ষ্য করলেন যুক্তির অভাবে গোঁড়ামি আর ঘৃণা-বিদ্বেষ জন্ম নেয় এবং যারা ধর্মের নামে নর হত্যা বা সহিংসতা চালায় তাদের তিনি তীব্র সমালোচনা করলেন। রায়ের ধর্মদর্শন, বিশেষত ইসলাম ধর্মের উপর তার পর্যালোচনা পরিষ্কারভাবে ইঙ্গিত দেয় তিনি ধর্মকে উদার, মানবিক ও যুক্তিবাদীর অবস্থান থেকে বিচার করেছেন।[32]
১৮৮৪ সালে মৌলভী ওবায়দুল্লাহ রামমোহনের ‘তুহফাতুল মুওয়াহিহদীন’ মূল ফারসী হ’তে ইংরেজীতে অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ দাশ উক্ত পুস্তিকাটি ইংরেজী হ’তে বাংলায় অনুবাদ করেন।[33] দৃশ্যতঃ ঊনিশ শতকের বাঙালী মুসলমানদের তরফ হ’তে এটিকে সাধারণ মুসলমানদের হাতে তুলে দিতে কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এভাবে ঐতিহাসিক অমলেন্দু দের দাবী প্রমাণিত হয় যে, ঊনিশ শতকের শিক্ষিত বাঙালী মুসলমানগণ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে আগ্রহী ছিলেন না। তারা রায়ের যুক্তিবাদী, মানবিক এবং সারগ্রাহী চিন্তাধারার মূল্যায়ন করতে পারেননি।[34]
ভাই গিরিশচন্দ্রের পূর্বে আমীরুদ্দীন বসুনিয়ার অনুবাদ উদ্যোগ ইতিপূর্বে বিধৃত হয়েছে। বিশ শতকের প্রথমদিকে দু’ভাষী বাংলায় আমীরুদ্দীনের আংশিক অনুবাদ বাঙালী মুসলিম লেখকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল। তারা আমীরুদ্দীনের এ প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানিয়েছিল। ঊনিশ শতকের দ্বীনী মজলিসগুলোতে কাব্যিক দু’ভাষী বাংলায় সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম সংক্রান্ত জ্ঞান প্রচার করা হ’ত।
সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, উক্ত রীতিতে আমীরুদ্দীনের আমপারা অংশের অনুবাদ বাঙালী মুসলিম সমাজে ঢেউ তুলেছিল এবং দীর্ঘদিন যাবৎ তার আংশিক অনুবাদ ও তাফসীর বাঙালী মুসলমানদের সাহিত্য ধারাকে সমুন্নত রেখেছিল। ১৮৬০-এর দশকে গোলাম আকবর আলী এবং মীর ওয়াহিদ আলী কর্তৃক দু’ভাষী বাংলায় কুরআনের আংশিক অনুবাদ উক্ত ধারাকে আরো সমৃদ্ধ করেছিল। গোলাম আকবর আলী তার কাব্যিক অনুবাদে প্রচুর আরবী ও ফারসী শব্দের ব্যবহার করেছিলেন।[35]
মজার ব্যাপার হ’ল বাঙালী মুসলমানরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুসলমানদের চেয়ে ব্যতিক্রম, কারণ তারা ইসলাম কবুল করা সত্ত্বেও তাদের ভাষা ও লিপি দু’টিরই স্বকীয়তা বজায় রেখেছে। এমনিভাবে প্রচুর পরিমাণে আরবী ও ফারসী শব্দের ব্যবহার বাঙালী মুসলমানদের আত্মপরিচয়ের সন্ধানে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এমনকি অদ্যাবধি মুসলিমপ্রধান বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় আরবী ও ফারসী শব্দের পরিমাণ হিন্দুপ্রধান পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক বেশী। মীর ওয়াহিদ আলীর পদ্যে রচিত কুরআনের আংশিক অনুবাদ সমকালীন মুসলমানদের মানস, বিশ্বাস ও রীতিনীতি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করেছে। সেখান থেকে আমরা জানতে পারি ঊনিশ শতকের বাঙ্গালি মুসলিম সমাজ নানা কুসংস্কার আর আচার-প্রথায় ছেয়ে গিয়েছিল। বহু নামধারী আলেম এমন কিছু আক্বীদা আর আমলের প্রচার করত যার সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক ছিল না।[36]
১৮৭২ সালে নাছিরুদ্দীন আহমাদের ‘নিয়ামায়ে খোদা’ (আল্লাহর উপহার) প্রকাশিত হয়েছিল। পুস্তিকাটিতে বিশেষ কয়েকটি সূরার উপর আলোকপাত করা হয়েছিল। ছয় বছর পর ক্বারী নাছিরুদ্দীন ও ছাদিক আলীর যৌথ প্রচেষ্টায় যশোর (বর্তমানে বাংলাদেশের একটি যেলা) হ’তে ‘যীনাতুল ক্বারী’ পুস্তিকাটি বের হয়। এতে মূলতঃ কুরআন তেলওয়াতের বেশ কিছু নিয়ম তুলে ধরা হয়েছিল। ১৮৭৯ সালে বাংলা ভাষায় ‘কুরআন-শরীফ’-এর প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয়। রাজেন্দ্রনাথ মিত্র এই আংশিক অনুবাদ করেন।[37]
এই হ’ল ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের পূর্বে বাংলা ভাষায় কুরআনকেন্দ্রিক সাহিত্যচর্চার ইতিহাস। গিরিশচন্দ্রের বাংলা কুরআন ব্যতীত উপরোল্লেখিত অন্য সকল অনুবাদ পরিষ্কার ইঙ্গিত দেয় সমগ্র কুরআন মূল আরবী হ’তে বাংলায় রূপান্তরে বিভিন্নরকম সীমাবদ্ধতা ছিল। একই কথা হাদীছ সাহিত্যের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। ফলশ্রুতিতে আদি ইসলাম বা ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে উপযুক্ত জ্ঞান বাঙালী মুসলিম সমাজে বিরাজ করতে পারেনি। কোন কোন লেখক দুনিয়াবী স্বার্থ হাছিল করার জন্য সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে নানারকম কুসংস্কার আর গোঁড়ামি ছড়িয়ে দিত। ড. মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান এ বিষয়ে তার সাম্প্রতিক গবেষণাকর্মে উল্লেখ করেছেন ‘অর্থোপার্জনের জন্য কতিপয় কাঠমোল্লা নিজেদের বইয়ে উদ্ভট ও কাল্পনিক গালগল্প ঢুকিয়ে দিত যেগুলোর সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই’।[38]
বাঙালী মুসলমানরা গিরিশচন্দ্রের মাধ্যমে সমগ্র কুরআনের বাংলা অনুবাদের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিল এবং পরপর তিনটি সংস্করণে অনুবাদটির জনপ্রিয়তা নিশ্চিত হয়েছিল। গিরিশচন্দ্রের অনুবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর গদ্য ও পদ্য আকারে কুরআন অনুবাদের জোরালো উদ্যোগ দেখা গেল। খৃষ্টান মিশনারীরাও কুরআনের বাংলা অনুবাদ করার উদ্যোগ নিয়েছিল। তবে এক্ষেত্রে তাদের উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম ধর্মের তুলনায় খ্রিস্ট ধর্মকে শ্রেষ্ঠতর হিসাবে সাব্যস্ত করা। ফলে খৃষ্টান মিশনারীদের বাংলা কুরআন বাঙালী মুসলমানদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি।[39] একদল মুসলিম গিরিশচন্দ্র অনূদিত কুরআনের উপর সন্দেহ করতে লাগল। যেহেতু বহু মুসলিম তার বঙ্গানুবাদ ক্রয় করেছিল, তাই তার পক্ষে মুদ্রণ ও বিজ্ঞাপনের খরচ পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব ছিল। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল তিনি তার বঙ্গানুবাদের কপিরাইট ও বিক্রয়লব্ধ অর্থ ‘নববিধান ব্রাহ্মণ সমাজ’-কে (ব্রাহ্মণ ও হিন্দু একত্ববাদীদের সংগঠন) প্রদান করেছেন। কতিপয় মুসলিম দাবী করল তিনি মুসলমানদের মধ্যে বঙ্গানুবাদ বিক্রয় করে যে অর্থ লাভ করেছিলেন তা মূলতঃ ব্রাহ্ম ধর্মের প্রচারে ব্যয়িত হয়েছে। পরিণতিতে কতিপয় মুসলিম ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। কিছু মুসলিম গিরিশচন্দ্রের অনুবাদে ভুল-ত্রুটি খুঁজে বের করায় লিপ্ত হয়েছে। অবশ্য ইতিপূর্বে বলা হয়েছে, অনেকে তাকে কুরআনের বঙ্গানুবাদের ময়দানে অগ্রদূত হিসাবে অভিনন্দন জানিয়েছে। তবে ঊনিশ শতকের শেষ নাগাদ কতিপয় বাঙালী মুসলিম অমুসলমানদের কৃত কুরআনের বঙ্গানুবাদের প্রতি সন্দেহপ্রবণ হয়ে পড়ে।
তাদের আশঙ্কা ছিল অনুবাদের সময় কুরআনের আসমানী আবহকে বিকৃত করা এমন উদ্যোগের মূল অভিসন্ধি হ’তে পারে।[40] ঊনিশ শতকে হিন্দু পুনর্জাগরণবাদ এবং কুরআন অনুবাদের সঙ্গে যুক্ত খৃষ্টান মিশনারীদের তুলনামূলক ধর্মচর্চার জন্য মুসলমানদের সন্দেহপ্রবণতা দায়ী ছিল। এমন পরিস্থিতিতে বাঙালী মুসলিম সমাজে ব্রাহ্ম, আর্য ও খৃষ্টান মিশনারীদের প্রভাব হ’তে সাধারণ মুসলমানদের মুক্ত করার উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। এমন অবস্থায় বাঙালী মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের কৃত কুরআনের বঙ্গানুবাদের উপর আরো বেশী নির্ভরশীল হওয়া খুব সঙ্গত ছিল।[41]
মুসলমানদের কৃত কুরআনের বঙ্গানুবাদের ময়দানে মাওলানা মুহাম্মাদ নাঈমুদ্দীন (১৮৩৮-১৯০৮) অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। করোটিয়ার জমিদার মাহমূদ আলী খান পন্নী এবং ধনবাড়ির জমিদার সৈয়দ নবাব আলী চৌধুরী বাঙালী মুসলিম সমাজে কুরআনকেন্দ্রিক ধর্মচিন্তা, ইসলামী সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। করোটিয়ার জমিদারের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে মুহাম্মাদ নাঈমুদ্দীন কুরআনের বঙ্গানুবাদ শুরু করেন। ১৮৮৭, ১৮৮৯ ও ১৮৯১ সালে তার বঙ্গানুবাদের তিনটি খন্ড প্রকাশিত হয়েছিল। পরবর্তীতে নাঈমুদ্দীনের এ উদ্যোগ অনেক মুসলিম লেখককে বাংলা ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও তাফসীর রচনায় অনুপ্রাণিত করেছিল। মসজিদের ইমাম ও মাদরাসার আলেমগণ একযোগে বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে কুরআন ও হাদীছের আলোকে ইসলামের বুনিয়াদী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে সচেষ্ট হ’লেন।[42] বাঙালী মুসলিম সমাজের প্রেক্ষিতে বলা যায়, যশোরের মুন্সী মেহেরুল্লাহ, নদীয়ার শেখ যমীরুদ্দীন ও মাওলানা আনিসুদ্দীন আহমাদের মতো একনিষ্ঠ প্রচারকগণ খৃষ্টান মিশনারীদের ধর্মান্তরিতকরণ প্রচেষ্টাকে রুখে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। সুধাকর শীর্ষক রক্ষণশীল বাঙালী মুসলিম লেখকদের একটি সঙ্ঘ গড়ে উঠেছিল। দলটির নাম এরূপ হওয়ার কারণ হলো সুধাকর শিরোনামে একটি বাংলা সাপ্তাহিক এটির মুখপত্র ছিল।[43] বাঙালী মুসলিম জনগোষ্ঠীকে খৃষ্টান মিশনারী, ব্রাহ্ম ও আর্য সমাজের প্রচারণা থেকে হেফাযত করতে সুধাকর গোষ্ঠীর লেখকগণ বিভিন্ন পুস্তিকা প্রকাশ করত ও প্রবন্ধ রচনা করত। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও মুসলমানরা একইভাবে খৃষ্টান মিশনারী ও আর্যদের ক্রিয়াকলাপের জবাব দিয়েছে। বঙ্গদেশে খৃষ্টান মিশনারীরা ইসলামবিরোধী বই-পুস্তক ও বাংলা কুরআন বিলি করার মাধ্যমে ইসলামের প্রতি শত্রুতা দেখিয়েছিল।[44]
সন্দেহ নেই যে, মুদ্রণ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করে খৃষ্টান মিশনারীদের পক্ষে ঊনিশ শতকে বাংলায় ইসলামবিরোধী প্রচারণা চালানো সম্ভব হয়েছিল।[45] ইসলামের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণের জবাবে মাওলানা আবু মুহাম্মাদ আব্দুল হক হক্কানী (১৮৫০-১৯১৫) উর্দূ ভাষায় তাফসীর রচনা করেন। সে যুগে অন্য কোন গ্রন্থ এতটা বলিষ্ঠভাবে ইসলামবিরোধী প্রচারণার মোকাবেলা করতে পারেনি। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, সুধাকর গ্রুপ হক্কানীর তাফসীরের ভূমিকা অংশ বাংলায় অনুবাদ করেছিল। এটি ১৮৮৮ সালে এছলাম তত্ত্ব বা মুসলমান ধর্মের সারসংগ্রহ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল। বাংলার কতিপয় শিক্ষিত মুসলমানের সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে পুস্তকটি বের করা সম্ভব হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে মুহাম্মাদ রিয়াযুদ্দীন আহমাদ এটির সম্পাদনার দায়িতব নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে মাওলানা ওহীদুদ্দীন ও শেখ আব্দুর রহীম (১৮৫৯-১৯৩১) সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এটির বঙ্গানুবাদে পন্ডিত রিয়াযুদ্দীন আহমাদ মাশহাদীও (১৮৫৯-১৯১৮) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। এছলাম তত্ত্ব পুস্তকটি বাঙালী মুসলমানদের মধ্যে ইসলাম প্রচারে এবং সাম্প্রদায়িক সংহতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল। এখানে স্মর্তব্য যে, অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলাম ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায়ও উদ্যোগ দেখা গিয়েছিল। ধর্মের প্রাধান্য পরম্পরায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ছূফী মধু মিঞা সম্পাদিত মাসিক প্রচারক-এ ধারাবাহিকভাবে হক্কানীর তাফসীরের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল। অবশেষে ১৯০১ সালে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত বঙ্গানুবাদ গ্রন্থ আকারে মুদ্রিত হয়। হক্কানীর তাফসীর অনুবাদ করতে ছূফী মধু মিঞা মাওলানা মনীরুয্যামান ইসলামাবাদীর (১৮৭৪-১৯৫০) প্রত্যক্ষ সহযোগিতা পেয়েছিলেন।
ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে এবং বিশ শতকের প্রথম ভাগে খৃষ্টান মিশনারীদের ইসলাম বিরোধী প্রপাগান্ডা মোকাবেলায় হক্কানীর তাফসীরটি আলেম সমাজের জন্য একটি সহজলভ্য হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। উক্ত অনুবাদ ঔপনিবেশিক আমলে বঙ্গদেশে শরী‘আত কেন্দ্রিক ধর্মচর্চার এক উর্বর ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করেছিল।[46] ১৮৯৩ সালে ছূফী মিঞাজান কামালী একটি উর্দূ কিতাব অনুবাদ করে কুরআন ও হাদীছের ব্যাখ্যা শিরোনামে প্রকাশ করেন। উক্ত কাজ সম্পাদনে তিনি করোটিয়ার জমিদারের সহযোগিতা পেয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের শেষ ভাগে বাঙালী মুসলমানরা কুরআনের ব্যাপারে এত সচেতন হয়ে উঠেছিল যে পবিত্র কালামের ভাষান্তরে আপত্তিকর কিছু পাওয়া গেলে তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালী মুসলিম সমাজের তরফ হ’তে তীব্র প্রতিবাদ জানানো হ’ত। যেমন ১৮৯১ সালে ফিলিপ বিশ্বাস অনূদিত বাংলা কুরআন প্রকাশিত হ’লে মুসলমানরা এটির তীব্র সমালোচনা করেছিল। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার এটি বাজেয়াপ্ত করতে বাধ্য হয়েছিল। ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে বাঙালী মুসলিমগণ তাদের ধর্ম সম্পর্কে কতটুকু সচেতন হয়ে উঠেছিল, তা তৎকালীন বাংলা সাময়িকীগুলোতে প্রকাশিত প্রবন্ধ ও কুরআনের অনুবাদ ও অনুধাবন প্রচেষ্টার মধ্যে ফুটে উঠেছে।[47]
যেসকল বাঙালী মুসলমানের মধ্যে নেতৃত্বগুণ ছিল, তারা বাংলার পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে এগিয়ে নিতে ঊনিশ শতকে বিভিন্ন সংগঠন গড়ে তোলেন। মুসলিম ধর্মগুরু, লেখক এবং প্রভাবশালী সরকারী ব্যক্তিবর্গ কামনা করতেন তাদের সম্প্রদায় যেন জাগতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে ‘নয়া শিক্ষা’ (পশ্চিমা শিক্ষা) গ্রহণ করে। একই সাথে তারা তাদের সাম্প্রদায়িক সংহতি প্রতিষ্ঠায়ও সচেষ্ট ছিলেন। তাদের সম্মুখে ‘ইয়ং বেঙ্গল মুভমেন্টের’ দৃষ্টান্ত ছিল।[48] পশ্চিমা শিক্ষার সঙ্গে পরিচিত হয়ে একদল হিন্দু তরুণ অতি প্রগতিশীল হয়ে যায় এবং চিরায়ত হিন্দুধর্মের বিরোধিতা করে। ঊনিশ শতকের বাঙ্গালি মুসলিম নেতৃবৃন্দ মোটেই চাননি যে, মুসলিম তরুণরা ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপের অনুকরণ করুক। তারা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন পশ্চিমা শিক্ষা ও ধর্মীয় দর্শন মুসলিম সমাজে সহাবস্থান করবে এবং সেমতে কাজ করবে। মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশের মধ্যে এই উপলব্ধি জন্মেছিল যে, কুরআন ও হাদীছের অনুসরণ ছাড়াও ইজমা ও ক্বিয়াসের ক্ষেত্র প্রস্ত্তত করতে হবে।[49] অবশ্য ঔপনিবেশিক বাংলার মুসলিম সমাজে ‘ইজতিহাদ’ প্রসঙ্গটি তেমন মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেনি।[50] পশ্চিমের রাজনৈতিক উত্থান সত্ত্বেও মধ্যযুগের ভারতবর্ষে ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি নিরাপদ ছিল। এমন পরিস্থিতিতে মুসলিম বুদ্ধিজীবীদের একটি দল ইজতিহাদ বা গবেষণার উপর নির্ভর করা নিরাপদ মনে করেছিলেন। ব্যাপক ও নিবিড় ধর্মীয় গবেষণার পরিবেশে ইসলামকেন্দ্রিক উদারতাবাদ, মানবতাবাদ ও যুক্তিবাদের বিকাশ ঘটেছিল যেগুলো আন্তঃসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষায় সহায়ক হয়েছিল।[51] মধ্যযুগের ভারতীয় ইতিহাস থেকে প্রমাণ মেলে একজন ব্যক্তি নিজ ধর্মের প্রতি অনুগত থেকেও অন্য ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতে পারে। মধ্যযুগের ভারতবর্ষের কতিপয় চিন্তাবিদ তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের উপর জোর দেওয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগণের অজ্ঞতা দূর করতে চেয়েছিলেন। ঊনিশ শতকের বাঙালী মুসলিমগণ সেই উন্নত চিন্তাধারাকে পুনরুজ্জীবিত করার পরিবর্তে অন্য ধর্মের তুলনায় ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণে ব্যস্ত ছিলেন। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল অন্য ধর্মের প্রভাব হ’তে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করা।[52]
বিশ শতকের প্রথমভাগেও ভারতীয় মুসলমানদের একটি বড় অংশ নিজেদেরকে একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসাবে পরিচয় দিতে থাকল। বিশ শতকেও কুরআনের বঙ্গানুবাদ অব্যাহত ছিল। তবে ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ এবং ১৯২০ ও ১৯৩০-এর দশকে বাঙালী মুসলিম কর্তৃক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ, যেমনটি গৌর কিশোর ঘোষের ‘প্রেম নেই’ উপন্যাসে দেখানো হয়েছে, উক্ত অনুবাদ প্রক্রিয়ায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছিল; এবিষয়ে আরেকটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধ রচনা করা যেতে পারে।[53]
উপসংহার :
অত্র প্রবন্ধে কুরআনের বঙ্গানুবাদ ও বাঙালী মুসলিম সমাজের উপর মুদ্রণ প্রযুক্তির প্রভাব বিশদভাবে আলোচিত হয়েছে। প্রভাবশালী মুসলিম ব্যক্তিবর্গ ধর্মীয় সাহিত্য চর্চায় বিশেষত কুরআনের ভাষান্তরে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন এবং বিষয়টি বাংলার ইসলামী ঐক্যের প্রেক্ষাপটে বিধৃত হয়েছে। কর্মব্যস্ত ও উদীয়মান শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী যারা ক্রমবর্ধমানভাবে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের মোহে আবিষ্ট হচ্ছিল, তারা আলেমসমাজ বা ছূফীদের নিকট গমন করার পরিবর্তে সরাসরি বাংলা কুরআন, তাফসীর ও সীরাত পাঠের মাধ্যমে ধর্মীয় জ্ঞান অর্জন করা পসন্দ করতেন। ধর্মের প্রতি বা মুদ্রিত আকারে ধর্মীয় সাহিত্যের প্রতি প্রত্যক্ষ আগ্রহের ফলে বঙ্গভূমিতে কুরআন ও নবীকেন্দ্রিক ধর্মচিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ সাধিত হয়েছিল এবং ইতিমধ্যে বিষয়টি ইসলাম প্রচারের বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে আলোচিত হয়েছে।
ধর্মীয় জ্ঞান মৌখিকভাবে প্রচারের উপর ইসলামের চিরায়ত গুরুত্বারোপের ফলে মুসলিম সমাজ কর্তৃক মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণে বিলম্ব হয়েছিল। অবশেষে ঊনিশ শতকে যখন খৃষ্টান মিশনারী, ব্রাহ্মসমাজ ও নব্য হিন্দুত্ববাদীরা মুদ্রণ প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেদের আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছিল, ভারতবর্ষের অন্যান্য জায়গার সহ-ধর্মপ্রচারকদের ন্যায় বাংলার মুসলিমরাও ধর্মীয় প্রতিযোগিতার সে যুগে টিকে থাকতে মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণ করেছিল। মুদ্রণ প্রযুক্তি গ্রহণের ফলে জ্ঞানের প্রচার মৌখিক হ’তে মুদ্রিত রূপ লাভ করেছিল।
বাংলার সম্ভ্রান্ত মুসলিমগণ সাধারণত একে অপরের সঙ্গে উর্দূ ও ফারসী ভাষায় বাক্যালাপ করতেন এবং স্বভাবতই মূল আরবী হ’তে বাংলায় কুরআনের ভাষান্তরকে শরী‘আত বিরোধী কাজ হিসাবে গণ্য করতেন। সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মূল আরবী হ’তে বাংলায় সমগ্র কুরআনের অনুবাদ পেতে বাঙালী মুসলিমদেরকে ঊনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল যদিও ভাই গিরিশচন্দ্র সেনের মতো একজন অমুসলিম সেই কাজ আঞ্জাম দিয়েছিলেন।
মুদ্রণ প্রযুক্তি ও কুরআনের বঙ্গানুবাদ নিয়ে আমাদের এই গবেষণায় ঊনিশ শতকের ভারতীয় মুসলিমদের, বিশেষত বঙ্গীয় মুসলমানদের মানসিক বিবর্তন ফুটে উঠেছে। পশ্চিমের রাজনৈতিক উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে অন্যান্য জায়গার সহ-ধর্মপ্রচারকদের মতো বাঙালী মুসলিমরাও শুধুমাত্র জাগতিক সমৃদ্ধির লক্ষ্যে পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণ করেছিল। নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে ইসলামী ঐক্য রক্ষা করতে স্বদেশী ভাষায় কুরআনের অনুবাদ ও মুদ্রণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তা মুসলিম জনগোষ্ঠীর নিকট পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল।
মূল : অমিত দে
অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ভারত। লেখকের উক্ত প্রবন্ধটি "BENGALI TRANSLATION OF THE QURAN AND THE IMPACT OF PRINT CULTURE ON MUSLIM SOCIETY IN THE NINETEENTH CENTURY"শিরোনামে ২০১২ সালে Societal Studies (vol. 4, no. 4) নামক একটি ষাণ্মাসিক গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অনুবাদ : আসাদুল্লাহ আল-গালিব
শিক্ষার্থী, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
[1]. ফ্রান্সিস রবিনসন, ইসলাম অ্যান্ড মুসলিম হিস্ট্রি ইন সাউথ এশিয়া. নিউ দিল্লি: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০০।
[2]. ফ্রান্সিস রবিনসন, ‘ইসলাম অ্যান্ড দা ইমপ্যাক্ট অব প্রিন্ট ইন সাউথ এশিয়া’ গৃহীত: এন. ক্রুক সম্পাদিত দা ট্রান্সমিশন অব নলেজ ইন সাউথ এশিয়া: এসেজ অন এডুকেশন, রিলিজিওন, হিস্ট্রি অ্যান্ড পলিটিক্স, (দিল্লি : ১৯৯৬), পৃ. ৭০-৭১, ১নং টীকা দ্রষ্টব্য।
[3]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৭১।
[4]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন এবং মুসলিম ধর্মচিন্তার সেকাল-একাল, গৃহীত: শারদীয় বারোমাস, (কোলকাতা, ১৯৯৬), পৃ. ৪১-৫৭; অমিত দে, বাংলা ভাষী কুরআন চর্চা, (কোলকাতা, ১৯৯৯)।
[5]. এম. এম. এম. খান, ইসলাম কৌমুদী. খুলনা, ১৯১৪, পৃ. ১২৪।
[6]. অমিত দে, দ্যা ইমেজ অব দ্যা প্রফেট ইন বেঙ্গলি মুসলিম পয়েট্রি. (কোলকাতা, ২০০৫)।
[7]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৪২।
[8]. এম. এম. এম. খান, ৫ নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৯৯।
[9]. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪৮-১৪৯।
[10]. ফ্রান্সিস রবিনসন, ২নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭৩-৮৯।
[11]. আব্দুল কাদির সম্পাদিত. কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী, খন্ড ১, ঢাকা, ১৯৬৮, পৃ. ৩-১২।
[12]. দালি মেটকাফ, বি. ইসলামিক রিভাইভাল ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া: দেওবন্দ ১৮৬০-১৯০০ (প্রিন্সটন, ১৯৮২), পৃ. ২৬৭-২৯৬।
[13]. ফ্রান্সিস রবিনসন, ২নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭৮।
[14]. আনিসুজ্জামান, মুসলিম-মানস ও বাংলা সাহিত্য, (কোলকাতা, ১৯৭১), পৃ. ৩৮৩।
[15]. ইসলাম দর্শন (কোলকাতা থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা, ১৯২১), প্রথম সংখ্যা, প্রচ্ছদ দ্রষ্টব্য।
[16]. প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার, দা বেঙ্গলি মুসলিমস: আ স্টাডি ইন দেয়ার পলিটিসাইজেশন, ১৯২১-১৯২৯ (কোলকাতা, ১৯৯১), পৃ. ১৬৪।
[17]. গৌর কিশোর ঘোষ, প্রেম নেই, (কোলকাতা, তৃতীয় সংস্করণ, ১৯৮৩), পৃ. ২২৬-২২৮।
[18]. ফ্রান্সিস রবিনসন, ২নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৯০-৯১।
[19]. জেমস ওয়াইজ, নোটস অন দা রেসেজ, (লন্ডন : কাস্টস অ্যান্ড ট্রেডস অব ইস্টার্ন বেঙ্গল, ১৮৮৩), পৃ. ৩৬; অমিত দে, কুরআন চর্চা, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১।
[20]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ২; অমিত দে, সমাজ ও সংস্কৃতি (কোলকাতা, ১৯৮১), পৃ. ১৩।
[21]. অমিত দে, ‘বাংলায় কুরআন’, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ২।
[22]. আ. কা. মান্নান, (সম্পাদিত) মোশাররফ রচনা সম্ভার, ৫ম খন্ড (ঢাকা : ১৮৮৫), পৃ. ৯২-৯৫।
[23]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ২।
[24]. প্রাগুক্ত; অমিত দে, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২।
[25]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৩।
[26]. অমিত দে, ২০নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১৯-২০।
[27]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৩।
[28]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৪।
[29]. অমিত দে, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২ ও ৩।
[30]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৪।
[31]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৪।
[32]. প্রাগুক্ত।
[33]. প্রাগুক্ত।
[34]. প্রাগুক্ত।
[35]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬।
[36]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৬।
[37]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭; মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, বাংলা ভাষী কুরআন চর্চা. ঢাকা, ১৯৮৬, পৃ. ৪৯৪-৪৯৫।
[38]. মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, ৩৯নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৪৯২; অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭।
[39]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭; মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, ৩৯নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ৪।
[40]. অমিত দে, ‘বাংলায় কুরআন’, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৭ু৮; মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, ৩৯নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৪৯৫।
[41]. অমিত দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮; মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, প্রাগুক্ত, পৃ. ৪৯৩-৪৯৪।
[42] .মাওলানা আববাস আলী (১৮৫৯-১৯৩২) পবিত্র কুরআনের টীকাসহ পূর্ণাঙ্গ তরজমা সমাপ্ত করেন। বাংলাভাষায় মুসলমানদের মধ্যে তিনিই ছিলেন কুরআনের প্রথম পূর্ণাঙ্গ অনুবাদক (১৩১৬/১৯০৯)। দ্র. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন: উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ; দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিত সহ, পৃ. ৪৬৬।- সম্পাদক।
[43]. অমিত দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮; ঐ, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২ ও ৩।
[44]. অমিত দে, প্রাগুক্ত, পৃ. ৮, ৯।
[45]. ঐ, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২ ও ৩।
[46]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৯।
[47]. প্রাগুক্ত, পৃ. ৯, ১০; মুহাম্মাদ মুজিবুর রহমান, ৩৯নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ৯৮, ১০১ু১০২।
[48]. অমিত দে, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২ ও ৩।
[49]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১১। ইজমা ‘সরাসরি কুরআনে উল্লিখিত হয়নি এমন কোন বিষয়ে ধর্মীয় পন্ডিতদের ঐকমত্য’। ক্বিয়াস ‘কুরআন ও হাদীছের মূলনীতির আলোকে যুক্তিগ্রাহ্য সিদ্ধান্ত’। রুকাইয়া ওয়ারিছ মাকছূদ, আ বেসিক ডিকশনারি অব ইসলাম (নিউ দিল্লি : ১৯৯৮, পুনঃমুদ্রণ : ২০০০), পৃ. ১০৩, ১৭৬।
[50]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১২। ইজতিহাদ- ‘সরাসরি কুরআনে বর্ণিত হয়নি এমন কোন বিষয়ে সঠিক সমাধান খুঁজে পেতে যুক্তির প্রয়োগ করা’। মাকছূদ, রুকাইয়া. ওয়ারিছ, প্রাগুক্ত, পৃ. ১০৩।
[51]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১২। ঔপনিবেশিক ভারতে ইজতিহাদের গুরুত্ব কীভাবে ক্রমশ লুপ্ত হয়েছে তা মুযাফফর হোসেনের দা ল্যাঙগুয়েজ অব পলিটিকাল ইসলাম ইন ইন্ডিয়া (নিউ দিল্লি : ২০০৪) গ্রন্থে আলোচিত হয়েছে।
[52]. অমিত দে, বাংলায় কুরআন, ৪নং টীকা দ্রষ্টব্য, পৃ. ১২।
[53]. প্রাগুক্ত; অমিত দে, ৬নং টীকা দ্রষ্টব্য, অধ্যায় ২ ও ৩।