পর্ব ১ । পর্ব ২ । পর্ব ৩ । শেষ পর্ব ।

দাওয়াতী সংগঠন সমূহকে হারাম বলে ফৎওয়া দেওয়ার প্রকৃত কারণ :

হয়তো কোন প্রশ্নকর্তা প্রশ্ন করতে পারেন যে, এমন সুস্পষ্ট ভুলের মাঝে ঐ ফৎওয়াদাতাদের পতিত হওয়ার কারণ কী?

উত্তরে বলব, বিষয়টি বুঝার জন্য খুব একটা যুক্তি-বুদ্ধি খরচের প্রয়োজন পড়ে না। বরং স্বতঃসিদ্ধভাবেই তা বুঝা যায়। কেননা কুরআন-হাদীছে এমন কোন প্রত্যক্ষ বক্তব্য নেই, যাতে সংগঠন গড়া ও পরিচালনা করা হারাম বলা হয়েছে। বরং ইসলাম পুরোটাই জামা‘আত বা দলভিত্তিক দ্বীন। এর মাথায় রয়েছেন একজন সর্বজনমান্য ইমাম বা সার্বিক শাসক (اَلْإِمَامُ الْعَامُّ)। সকল মুসলমান এই সার্বিক শাসকের নির্দেশ, পরামর্শ ও সিদ্ধান্ত মুতাবেক তাদের কাজ করবে। তাদেরকে ছালাতের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে, যার জন্য জামা‘আত, ইমামের আনুগত্য ও নিয়ম-শৃংখলা মানা ফরয। ফরয ছিয়ামও জামা‘আতবদ্ধ বা দলগতভাবে সম্পাদিত হয়। দেশের সবার জন্য রামাযান কবে শুরু হবে এবং কবে শেষ হবে তা শাসকই নির্ধারণ করেন। তদনুযায়ী আম মুসলমানকে ছিয়াম ও ঈদ পালন করতে হয়। যাকাতও নিয়ম মাফিক হিসাব-নিকাশ করে শাসকের সামনে ধারাবাহিকভাবে জমা দিতে হয়।

আবার ফরয হজ্জেও একজন ইমাম বা পরিচালক আবশ্যক। তিনি হজ্জের তারিখ ঠিক করেন। তার নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত মোতাবেক হাজীরা চলেন। জিহাদ করতেও একজন নেতা ও একজন সেনাপতি লাগে। শৃঙ্খলা ও পরিকল্পনা ছাড়া জিহাদ হয় না।

জগতের বুকে না অতীতে না বর্তমানে এমন কোন জীবনব্যবস্থার কথা জানা যায়, যে তার তিনজন অনুসারীর জন্যও সফরকালে একজন আমীর বা দলনেতা নিয়োগ ফরয করেছে। কেবল ইসলামই তা করেছে। অনুরূপ কোন জায়গায় স্রেফ তিনজন লোকও বাস করলে ইসলাম সেখানেও একটি জামা‘আত বা দল, একজন ইমাম বা নেতা, একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ নীতিমালা এবং আনুগত্যশীল অনুসারীবৃন্দ ঠিক করার বিধান দিয়েছে।

সারা পৃথিবীতে আমি এমন একটা দ্বীন-ধর্ম ও নিয়ম-নীতি পাইনি, যেখানে ইসলামের মত তার অনুসারীদের জামা‘আতবদ্ধ হওয়ার আদেশ রয়েছে। তারপরও এসব মুফতী কীভাবে এমন ধরনের ফৎওয়া দেয়?

অথচ আজ তারা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, মুসলমানরা লাঞ্ছিত, তাদের দ্বীন ধ্বংসোন্মুখ, তাদের কুরআনী বিধান ভূলুণ্ঠিত, তাদের নবীর সুন্নাত সর্বত্র উপেক্ষিত, তাদের নারী, পুরুষ ও শিশুরা অসহায়, তাদের শত্রুরা চারিদিক থেকে তাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে। এই দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে হ’লে অবশ্যই একজন ইমাম বা দলনেতার অধীনে একটি জামা‘আত বা দল গড়ে তোলা, পরস্পরে পরামর্শ করা, একে অপরকে সহযোগিতা করা, কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং জান-প্রাণ দিয়ে অবিরাম কাজ করে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন। পূর্বসূরীরা এজন্য উত্তরসূরীদের প্রস্ত্তত করবে এবং অবিরত কাজ চালিয়ে যাবে- যে পর্যন্ত না এই লাঞ্ছনাকর অবস্থা থেকে জাতি মুক্তি পায় এবং দ্বীন ও দুনিয়ার অগ্রগতি সাধিত হয়।

কিন্তু আফসোস! বিষয় এতটা স্পষ্ট হওয়া সত্ত্বেও জামা‘আত বা সংগঠনবিরোধী ফৎওয়া দেওয়া হচ্ছে। অথচ দ্বীন ইসলামে এমন কোন কথা নেই যাতে জামা‘আত গঠন করতে নিষেধ করা হয়েছে; বরং জামা‘আত গঠন করতেই ইসলাম উদ্বুদ্ধ করেছে। ইসলাম জামা‘আত গঠন করতেই আদেশ দেয়; জামা‘আত গঠনকেই ফরয বলে। বস্ত্ততঃ মুসলমানদের সমষ্টিগত কোন কাজই জামা‘আত ও সুশৃঙ্খলভাবে সম্পন্ন না করলে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হ’তে পারে না। জামা‘আত বা সংগঠন ও সুসংহত কর্মনীতির অভাবে দেখুন আজ মুসলমানদের অবস্থা কত নাযুক। তাদের দ্বীন সংক্রান্ত আমল-ইবাদত এক রকম পরিত্যক্ত ও ধ্বংসোন্মুখ। সকল ফরযে কেফায়াই বলতে গেলে মুখ থুবড়ে পড়েছে। তারপরও আমরা এসব বাতিল ফৎওয়া ও মতাদর্শ এমন সব ব্যক্তির মুখ দিয়ে প্রকাশ হতে দেখি যাদেরকে আমরা ভাল মানুষ বলেই জানি এবং তারা কোন বিচ্যুতি বা পক্ষপাতিত্বের শিকার বলেও মনে করতে পারি না। হ’তে পারে তাদের এহেন বাতিল ফৎওয়ার পেছনে নীচের কারণগুলো রয়েছে।

১. দ্বীন প্রচারে অতি আগ্রহ : দ্বীন প্রচারে অতীব আগ্রহ এসব ফৎওয়াদাতাকে এরূপ ফৎওয়া দিতে আগ্রহী করেছে। তারা দেখে যে, যারাই দ্বীনী দায়িত্ব পালনে জামা‘আত বা দলবদ্ধ হয় তারাই আল্লাহর শত্রু যালিম ক্ষমতাধরদের নানা অত্যাচার ও শাস্তি-সাজার মুখোমুখি হয়। ঐসব ক্ষমতাধর এতই জঘন্য, ডাকাত ও নেকড়ের মত হিংস্র যে, মুসলমানদের কোন রীতি-নীতিই তারা বরদাশত করতে রাযী নয়। এ কারণে এসব সরলমনা দাঈরা ভেবেছেন- একাকী দাওয়াত প্রদানই অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। নিয়মনীতির নিগড় থেকে দূরে থেকে দাওয়াত দিলে অপেক্ষাকৃত বেশী বিপদমুক্ত থাকা যায় এবং তাতে ঝামেলা-ঝঞ্ঝাট এবং ক্ষয়ক্ষতিও বেশী একটি পোহাতে হয় না।

আমি তাদের বলছি, বন্ধুরা, তোমরা পথ ভুল করে ফেলেছ এবং ভীরুতা ও কাপুরুষতার দরুন এমন ফৎওয়া দিয়েছ। সততা ও দৃঢ়চিত্ততার ভিত্তিতে তোমরা ‘জামা‘আতবদ্ধতা হারাম’ হওয়ার ফৎওয়া দাওনি। বস্ত্ততঃ কাপুরুষদের হাতে দ্বীন কায়েম হয় না এবং দুর্বলমনাদের দ্বারা ‘ত্বাগূত’ (আল্লাহর আইন বিরোধী শাসক)-কে পরাস্ত করা সম্ভব নয়। আর যে সকল ফরযের কথা ইতিপূর্বে আমরা উল্লেখ করেছি তা জামা‘আত বা দল ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। যালেমদের মনন্তুষ্টির নিমিত্তে এসব ফরয পালনে নিশ্চেষ্ট বসে থাকা যারপরনাই অপরাধ।

আল্লাহ বলেন,وَلَا تَرْكَنُوْا إِلَى الَّذِيْنَ ظَلَمُوْا فَتَمَسَّكُمُ النَّارُ وَمَا لَكُمْ مِنْ دُوْنِ اللهِ مِنْ أَوْلِيَاءَ ثُمَّ لَا تُنْصَرُوْنَ- ‘আর তোমরা যালেমদের প্রতি ঝুঁকে পড়ো না। তাহ’লে তোমাদেরকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করবে। আর আল্লাহ ব্যতীত তোমাদের কোন বন্ধু নেই। অতঃপর তোমরা কোনরূপ সাহায্য প্রাপ্ত হবে না’ (হূদ ১১/১১৩)

২. জামা‘আত গঠনের রীতি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না বলে ধারণা করা : ‘জামা‘আত বা দল গঠন করে দ্বীনী কাজ করা এবং যুদ্ধ-জিহাদ করার দৃষ্টান্ত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে ছিল না বলে তারা ধারণা করেন। তাই তারা জামা‘আত বা দল গঠন করে ইসলাম প্রচার কিংবা জিহাদ করা হারাম বলে ফৎওয়া দিয়েছেন। কিন্তু এটা মস্ত বড় ভুল। আমরা ইতিপূর্বে এ সম্পর্কে যেসব উপমা-উদাহরণ পেশ করেছি, সেগুলি তাদের কথা ভুল প্রমাণিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। যাদের সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি আছে তাদেরও বিষয়টি বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়।

আফসোস! আমি একটি টেপরেকর্ডে শুনেছিলাম, তাতে ঐ মুফতীদের একজনকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল যে, ‘আমাদের জন্য কি দরিদ্র-অভাবীদের সাহায্যের জন্য একটি জামা‘আত বা সংঘ গড়ে তোলা জায়েয হবে? আমরা কি অর্থ জমা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করে তা থেকে দুস্থ, অভাবী, ঋণ পরিশোধে অক্ষম ইত্যাদি লোকদের সাহায্য করতে পারব? ঐ মুফতী তার উত্তরে বলেছিলেন, ‘না তা জায়েয নেই। কেননা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে এমন জামা‘আত গঠনের রেওয়াজ ছিল না’।

ঐ মুফতী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে অর্থতহবিল না থাকা এবং তাঁর কাছে আগত অর্থ তৎক্ষণাৎ তিনি উপস্থিত লোকদের মধ্যে বণ্টন করে দিতেন বলে ফৎওয়ায় যে তথ্য প্রদান করেছেন তাতে তিনি মিথ্যার বেসাতি করেছেন। আসলে এটা দ্বীন সম্পর্কে বিরাট অজ্ঞতা, সুন্নাহ, সীরাত ও ইতিহাস সম্পর্কে পুরোটাই মূর্খতা এবং মুসলিম উম্মাহর শিকড় ধরে টানাটানির শামিল।

রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে অবশ্যই তাঁর ‘বায়তুল মাল’ বা অর্থ তহবিল ছিল। হযরত বেলাল (রাঃ) ছিলেন তার দায়িত্বশীল অফিসার। হ্যঁা, কখনো কখনো রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট আগত ধন-সম্পদ তিনি তৎক্ষণাৎ ভাগ করে দিতেন, আবার কখনো নিজের তত্ত্বাবধানে বায়তুল মালে রেখে দিতেন। আর তা দিয়ে তিনি মুসলমানদের ভবিষ্যৎ প্রয়োজন মিটাতেন। যেমন প্রতিনিধি দলের জন্য খরচ, ঋণ পরিশোধ, সেনাদলের ব্যয়ভার বহন প্রভৃতি। অবশ্য রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাঁর ব্যক্তিগত সম্পদ জমা করে রাখতেন না। কিন্তু  মুসলমানদের সম্পদ বায়তুল মালে জমা থাকত এবং তা প্রয়োজন মাফিক বণ্টন করা হ’ত। একই পথ অবলম্বন করেছিলেন খুলাফায়ে রাশেদীন এবং পরবর্তীকালের খলীফাগণ।

বায়তুল মাল বা ধনাগার না থাকলে তো জাতির কাজই চলতে পারে না। তাদের অবশ্যই একটি সমৃদ্ধ ধনাগার থাকবে যেখানে ধন-সম্পদ জমা থাকবে এবং প্রয়োজনের সময় তা থেকে বিলি-বণ্টন করা হবে। উম্মতের কল্যাণমূলক কাজেও তা থেকে ব্যয় করা হবে। আর মানুষের জামা‘আতী বা দলগত প্রচেষ্টায় দরিদ্র-অভাবীদের সাহায্য করা, ঋণগ্রস্তের ঋণ পরিশোধ করা, বিপদগ্রস্তের বিপদ দূর করা তো অতীব ভাল এবং ছওয়াবের কাজ। কুরআন ও হাদীছে এ বিষয়ে বহু কথা বলা আছে।

আমি যদি এই ফৎওয়া নিজ কানে না শুনতাম তাহ’লে অবশ্যই বলতাম, এরূপ অর্থতহবিল বানানো এবং এজন্য  জামা‘আত বা দল গঠন হারাম হওয়ার ফৎওয়া কোন বিবেকবান মানুষ দিতে পারে না। কিন্তু আমি জনৈক ব্যক্তির টেপরেকর্ড থেকে নিজ কানে এই ফৎওয়া শুনেছি। তার ধারণা তিনি একজন বড় আলেম। দলে দলে লোক তার কাছে বিদ্যা শিখতে আসে এবং বহু মানুষ তার কাছ থেকে জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ করে। (কাজেই এমন ফৎওয়া যে সমাজে হরহামেশা দেওয়া হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই)।

এখন এই মুছীবত যদি উম্মতের উপর চেপে না বসত, এরা যদি এমন আজগুবী ফৎওয়া না দিতেন তাহ’লে আমি এজন্য কাগজ-কলম ধরতাম না, এসব কথা লিখতাম না এবং নিজেকে এমন কথা প্রমাণ করার কাজে লিপ্ত করতাম না যার সম্পর্কে একদিন আমার ভাবনা ছিল প্রকাশ্য দিবালোকে দিন প্রমাণ করে দেখানোর মতই বাতুল কাজ। কিন্তু যখন মুসলিম জাতি একদল অন্ধের খপ্পরে পড়ে গেছে তখন আমরা কী করব? তারা নিজেদেরকে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে এবং জনগণকে ধারণা দিতে চেষ্টা করছে যে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে কখনো বাতিলের মুখোমুখি হ’তে হয়নি। তিনি কোন বিপদে পড়েননি। তিনি কোন জামা‘আত বা দল গঠন করেননি। তিনি সব রকম দল-সংগঠন হারাম করে গেছেন। তিনি লোকদের কোন কিছুর ব্যবস্থা না নিতে এবং কোন  কাজের পরিণাম চিন্তা না করতে আহবান জানিয়ে গেছেন। তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় না দিয়ে কেবলই অবিমৃষ্যকারী সেজে কাজ করতে বলে গেছেন। তাদের প্রত্যেকেরই ওয়াজিব- একাই একটি জাতি গড়ে তোলা। তারা কোন জামা‘আত বা সংগঠন অাঁকড়ে ধরবে না এবং অন্যের মতের আনুগত্য করবে না। তারা বরং স্বৈরাচারী দুর্নীতিবাজ শাসকদের অধীনে জীবন যাপন করবে। তাদের ইচ্ছেমত ওরা চলবে; ভাল-মন্দ সবকিছুতেই তাদের আনুগত্য করবে। কোন কিছুতেই তাদের বিরোধিতা করবে না। নতুবা তারা মন খারাপ করবে। তাদের খারাপ কাজ দেখে নিষেধ করতে যাবে না এবং তাদের দুর্নীতি ও অপরাধ নিয়ে আলোচনা করবে না। মুসলমানরা যদি খারাপ কাজ নিষেধের জন্য কিংবা শত্রুকে প্রতিহত করার জন্য কিংবা অভাবীদের সাহায্যের জন্য কিংবা যাকাতের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য কিংবা মসজিদ তৈরীর জন্য কোন জামা‘আত বা দল গঠন করে, তাহ’লেই তারা বরং পাপী, গুনাহগার ও অপরাধী হবে। তারা রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর সুন্নাত ও আদর্শ থেকে বেরিয়ে যাবে!

বলুন, আমরা যখন এসব মুফতীর পাল্লায় পড়ব তখন কী করব? এরা আবার লোকসমাজে আলেম, মুত্তাক্বী, নেককার ও ধার্মিক হিসাবে গণ্য?

সারকথা, এসব মুফতী যে ফৎওয়া দিয়েছেন তা দ্বীন ও দ্বীনদার সম্পর্কে তাদের অলীক ধারণা হেতু। অথবা ব্যবহারিক সুন্নাহ ও রাসূল (ছাঃ)-এর পবিত্র জীবনী সম্পর্কে তারা অজ্ঞ কিংবা জীবন সম্পর্কে তাদের কোনই ধারণা নেই। হয়তো আমার এই ছোট্ট পুস্তিকায় তাদের সহ সকলের জন্য কিছু শিক্ষণীয় উপদেশ রয়েছে।

৩. জামা‘আতে খাছছাহ ও জামা‘আতে ‘আল্লাহ-এর মধ্যে পার্থক্য করতে না পারা : জামা‘আত বা সংগঠন হারাম ঘোষণার তৃতীয় কারণ, একটি নির্দিষ্ট ফরয আদায়ের জন্য গঠিত জামা‘আত বা দল এবং সকল মুসলমান মিলে একটি ‘আম বা সার্বিক জামা‘আত গঠনের মধ্যে যে পার্থক্য আছে তা নির্ণয়ে তাদের ব্যর্থতা।

কোন নির্দিষ্ট ফরয আদায়ের জন্য গঠিত জামা‘আত বা দলকে বলা হয় জামা‘আতে খাছছাহ বা বিশেষ দল। যেমন আল্লাহর পথে জিহাদ, যাকাত সংগ্রহ ও বণ্টন, শিক্ষাদান, মাদরাসা-মসজিদ নির্মাণ, অনাহারীদের খাদ্য দান, যেসব নিষিদ্ধ কাজ জামা‘আতবদ্ধভাবে ছাড়া নির্মূল সম্ভব নয় সেসবের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হওয়া ইত্যাদি ফরযের জন্য গঠিত জামা‘আত হ’ল খাছ বা বিশেষ জামা‘আত। পক্ষান্তরে মুসলমানদের সকলে মিলে গঠিত জামা‘আত বা দলকে বলা হয় সার্বিক জামা‘আত। সার্বিক দলে কর্তৃত্বসম্পনণ একজন নেতা বা শাসক থাকবেন। তার হাতে দেশের সকল অথবা সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আনুগত্যের বায়‘আত নিবে। এরূপ দল একটা দেশে একটাই থাকবে।

সন্দেহ নেই যে, বিশেষ জামা‘আত বা দল এবং সার্বিক দলের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। যেমন- সার্বিক জামা‘আত বা দলের জন্য যিনি আমীর বা দলনেতা হবেন তিনি হবেন প্রকাশ্য আমীর। সকল মুসলমানেরই তার হাতে বায়‘আত করা এবং তার আনুগত্য করা ফরয। কিন্তু বিশেষ জামা‘আত বা দলের যিনি আমীর বা দলনেতা হবেন তার নিকট সকল মুসলমানের বায়‘আত হওয়া এবং তার আনুগত্য করা ফরয হবে না। বরং যার কাছে তার কাজকর্ম ভাল লাগবে, তার চালচলন ও প্রচার-প্রপাগান্ডার ধরণে সে রাযী খুশী হবে সে তার দলে শরীক হবে। আর যার পসন্দ হবে না এবং অন্য কোন দলকে সে তার থেকেও যোগ্য ও উত্তম দেখতে পাবে সে ঐ দলে যোগ দিবে। এমন করায় তার কোন দোষ হবে না।

দ্বিতীয় একটি পার্থক্য এই যে, সার্বিক দলের বিরোধিতা করা জায়েয নয়। সুতরাং যখন একজন আমীর বা নেতার বায়‘আত হয়ে যাবে তখন অন্য আরেকজন আমীরকে দাঁড় করানো এবং তার পক্ষ নিয়ে প্রথম আমীরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়া যাবে না। যেমন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إِذَا بُويِعَ لِخَلِيفَتَيْنِ، فَاقْتُلُوا الْآخَرَ مِنْهُمَا ‘যখন দু’জন খলীফার জন্য বায়‘আত করা হবে তখন শেষের জনকে তোমরা হত্যা করবে’।[1] তিনি আরও বলেছেন,مَنْ أَتَاكُمْ وَأَمْرُكُمْ جَمِيعٌ عَلَى رَجُلٍ وَاحِدٍ، يُرِيدُ أَنْ يَشُقَّ عَصَاكُمْ، أَوْ يُفَرِّقَ جَمَاعَتَكُمْ، فَاقْتُلُوه ‘যখন তোমরা একজন নেতার ছায়াতলে ঐক্যবদ্ধ হবে তখন যে এসে তোমাদের ঐক্যে ফাটল ধরাবে এবং তোমাদের জামা‘আতের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাইবে, তখন তোমরা তাকে তরবারির আঘাতে দ্বিখন্ডিত করবে’।[2]

তৃতীয় পার্থক্য হ’ল, সার্বিক দল একটাই থাকবে। কিন্তু বিশেষ দল একাধিক হওয়া জায়েয। বরং ওয়াজিব দায়িত্বের সংখ্যা যত হবে দলের সংখ্যাও তত হ’তে পারে। সীমান্ত ঘাঁটি পাহারা ও অন্যান্য ফরযে কিফায়াহ পালনে যত জামা‘আত বা দল প্রয়োজন তত জামা‘আত বা দল করা যাবে। সুতরাং কোথায় সার্বিক জামা‘আত বা দল আর কোথায় বিশেষ জামা‘আত বা দল! উভয়ের মধ্যে কত বড় ফারাক!

যাদের সামনে এসব ফারাক অস্পষ্ট থেকে গেছে এবং যারা এক থেকে অন্য দলের পার্থক্য নিরূপণ করতে পারে না তারা ধারণা করে যে, যে সকল ফরয অকার্যকর বা নিষ্ক্রিয় অবস্থায় পড়ে রয়েছে সেগুলো আবার কার্যকর বা সক্রিয় করার জন্য যারা জামা‘আত বা দল গঠন করছে, জামা‘আত বা দলের একজন আমীর বা নেতা নিয়োগ করছে এবং জামা‘আত বা দল পরিচালনার জন্য একটি গঠনতন্ত্র বানাচ্ছে তারা সবাই বর্তমান শাসকের বিরুদ্ধাচারী এবং মুসলিমদের দলে বিভক্তি সৃষ্টিকারী। সুতরাং যারাই নিজেদের মাঝে জামা‘আত বা দল গঠন করে মসজিদ-মাদরাসা নির্মাণ করছে, অজ্ঞদের শিক্ষাদান, শিক্ষার প্রসার ঘটানো ইত্যাদি কাজ করছে তাদের মতে তারা সবাই  উক্ত দোষে দোষী।

এটা মূলত বুঝার ভুল এবং বিশেষ জামা‘আত ও সার্বিক জামা‘আতের মধ্যে পার্থক্য করতে না পারার ফলে হয়েছে।

৪. কিছু দলের নেতিবাচক কর্মকান্ড : এসব জামা‘আত বা দলের কোন কোনটি কখনো কুরআন-সুন্নাহ বিরোধী নেতিবাচক কিছু কর্মকান্ড করে থাকে। ফলে এসব মুফতী সেজন্যও জামা‘আত গঠনকে হারাম বলে থাকেন। যেমন তারা অনেকে বিদ‘আতে ডুবে থাকে, অনেকে সুন্নাহ থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে, আবার অনেকে দলীয়-উপদলীয় কোন্দলে জড়িয়ে  পড়ে ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব নেতিবাচক কর্মকান্ডের কারণে তারা কেউ কেউ ফৎওয়া দেন যে, এসব দল-উপদল সার্বিক দলের মধ্যে বিভেদ ও দলাদলি ডেকে আনছে, এদের কারণে বিদ‘আত ছড়িয়ে পড়ছে এবং অনেক সুন্নাহ পরিত্যক্ত হচ্ছে। এদের লাগাম টেনে না ধরলে অবস্থা আরও নীচে নেমে যাবে। কাজেই জামা‘আত বা দল গঠন করা হারাম।

কিন্তু এ কথার মধ্যে বড় রকমের গলদ রয়ে গেছে। আমাদের শুধু নেতিবাচক ও ক্ষতিকর দিক দেখলেই হবে না, বরং ইতিবাচক ও কল্যাণকর দিকও দেখতে হবে। এদিকটায় অন্ধ থাকলে চলবে না। একজন সক্রিয় প্রচারক- যিনি আল্লাহর দিকে ডাকেন- তার কিছু কাজে ভুল-ভ্রান্তি হতেই পারে, এমনকি কিছু বিদ‘আতও ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু তাই বলে আমরা তার সকল প্রচেষ্টা ও কর্মকান্ডকে বাতিল আখ্যা দিতে পারি না। মানব সমাজে এমন কেউ আছে কি যার কোন ভুল হয় না? হুযায়ফা (রাঃ) কর্তৃক বর্ণিত এক হাদীছে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)ও তো এমন লোকদের ভাল-র সার্টিফিকেট দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,قَوْمٌ يَسْتَنُّونَ بِغَيْرِ سُنَّتِي، وَيَهْدُونَ بِغَيْرِ هَدْيِي، تَعْرِفُ مِنْهُمْ وَتُنْكِرُ ‘তারা এমন লোক হবে যারা আমার পথের বাইরে চলবে এবং আমার সুন্নাহ বা তরীকা ছাড়া ভিন্ন সুন্নাহ বা তরীকা অবলম্বন করবে’। তাদের কাজে ভাল-মন্দ সবই থাকবে।[3] খুঁত থাকা সত্ত্বেও এ দলটি যখন ভাল গণ্য হচ্ছে তখন দল বিশেষের প্রচেষ্টা ও কর্মকান্ডে খুঁত থাকলেই তা বাতিল গণ্য করা আমাদের জন্য বৈধ হবে না।

আর প্রচারভিত্তিক জামা‘আত বা দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা তো মূলনীতি অনুসারেই জায়েয। ভাল কাজে একে অন্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা, মাহাত্মপূর্ণ কাজের প্রসার ঘটাতে পাল্লা দেওয়া এবং জয় করায়ত্ত করা শরী‘আতসম্মত কাজ। এটি বরং মুস্তাহাব। নিষিদ্ধ প্রতিযোগিতা তাই যা অন্যায়ের জন্য করা হবে এবং ভাল কাজে যে জয়যুক্ত হবে তার প্রতি হিংসা তৈরী করবে। এ ক্ষেত্রে বরং প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে থাকা ব্যক্তি এগিয়ে থাকা ব্যক্তির জন্য দো‘আ করবে এবং তার মত কিংবা তার থেকেও বেশী পরিমাণে ভাল কাজ করতে আগ্রহী হয়ে উঠবে। যেমন আওস ও খাযরাজ গোত্র প্রত্যেক ভাল কাজে প্রতিযোগিতা করত। যেমন তাবুক যুদ্ধে ওমর (রাঃ) আবুবকর (রাঃ)-এর উপর শ্রেষ্ঠত্ব লাভের জন্য তাঁর অর্ধেক সম্পদ এনে হাযির করেছিলেন। কিন্তু আবুবকর (রাঃ) হাযির করেছিলেন তাঁর সমস্ত সম্পদ। ফলে ওমর (রাঃ) বলেছিলেন, لَا أُسَابِقُكَ إِلَى شَيْءٍ أَبَدًا ‘আমি কোনদিন কোন বিষয়ে আপনার আগে যেতে পারব না’।[4]

আর হিংসা-বিদ্বেষ ও পারস্পরিক শত্রুতা তো দলে দলে যেমন হারাম, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতেও তেমনি হারাম। এটি শুধু দলের মধ্যে জন্ম নেয় তা নয়, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতেও জন্ম নেয়। এটাও সুবিদিত যে, লোকসমাজে শিক্ষিতরাই একে অপরের প্রতি বেশী হিংসাপরায়ণ। যেমন আল্লাহ বলেছেন,وَمَا اخْتَلَفَ فِيْهِ إِلَّا الَّذِيْنَ أُوتُوْهُ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَتْهُمُ الْبَيِّنَاتُ بَغْيًا بَيْنَهُمْ ‘অথচ যারা কিতাবপ্রাপ্ত হয়েছিল, তাদের নিকটে স্পষ্ট নিদর্শনাবলী এসে যাওয়ার পরেও তারা পারস্পরিক হঠকারিতাবশে উক্ত কিতাবে মতভেদ করল’ (বাক্বারাহ ২/২১৩)

যদিও এ আয়াত পূর্ববর্তী উম্মতদের জন্য নাযিল হয়েছিল তবুও আমাদের উম্মতও অনুরূপ মতবিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি এ বিষয়ে তারা তাদের থেকেও একধাপ এগিয়ে।

এজন্যই হাদীছ শাস্ত্রবিদগণএকটি বড় মূলনীতি (أَصْلاً عَظِيْمًا) বানিয়েছেন যে, ‘সমকালীন আলেমদের পারস্পরিক দোষারোপ (جَرْحٌ) গ্রহণযোগ্য নয়’। কেননা এ দোষারোপের অনেকটাই হিংসার বশবর্তী হয়ে করা হয়ে থাকে। ইমাম বুখারী (রহঃ) তো তাঁর দেশের শাসকের হিংসার শিকার হয়ে দেশ থেকে বিতাড়িত হন এবং অন্যত্র ইন্তিকাল করেন। তাহলে আলেমরা পরস্পরে হিংসা করে বলে কি আমরা ইলম অর্জন হারাম করব এবং আলেমদের অস্তিত্ব বাতিল করে দেব। ধরুন কাতার বা মদীনায় একজন আলেম একাকী দাঁড়িয়ে গেলেন। এখন তার খাতিরে আমাদের উপর অন্য একজন আলেমের দাঁড়ানো হারাম বা অবৈধ ঘোষণা করা ওয়াজিব হবে কী? যেন তারা দু’জনে প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্বে লিপ্ত হ’তে না পারে?

আমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব নয় এবং তা জায়েযও নয়। একাধিক জামা‘আত বা দলের অবস্থাও তদ্রুপ। একদল অন্য দলকে হিংসা-বিদ্বেষ করল বলে দ্বিতীয় দলকে হারাম ঘোষণা বৈধ হবে না। বরং প্রচার ও জিহাদ কেন্দ্রিক দল একাধিক হ’লে তাদের অকল্যানের চাইতে কল্যাণই বেশী। কেননা তখন একদল আরেক দলের কাজের মূল্যায়ন করবে এবং নিজেদের কাজের গতি ও মান বাড়াতে সচেষ্ট হবে। তাদের পারস্পরিক প্রতিযোগিতার ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল কাজ বেশী বেশী করার মানসিকতা সৃষ্টি হবে এবং কাজের মান বাড়বে।

পক্ষান্তরে বিভেদ সৃষ্টি হবে বলে সংগঠন হারাম হওয়ার কথা বলা অজ্ঞতাপ্রসূত একটি দুর্বল চিন্তা। যে কোন বিভাজনই যদি বিভেদের কারণ হয় এবং সেজন্য বিভাজন মাত্রেই বাতিল গণ্য হয় তাহলে আনছার-মুহাজির, আওস-খাযরাজ নামাঙ্কিতদেরও বাতিল গণ্য করতে হয়। আপনি কি জানেন না যে, মুহাজিরদের আলাদা পতাকা, পরিচিতি, প্রতীক ও বৈশিষ্ট্য ছিল? তদ্রুপ আনছারদেরও ছিল? জিহাদের ময়দানে উভয় দলের আলাদা পতাকা ও আলাদা সেনাপতি থাকত? এরূপ বিভাজন থাকার ফলে সময় সময় উভয় দলের মধ্যে হিংসা, শত্রুতা ও গোত্রপ্রীতিও মাথাচাড়া দিয়ে উঠত?  যেমন মুরাইসী বা বনু মুছত্বালিকের যুদ্ধে ঘটেছিল। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাদেরকে গোত্রপ্রীতি দেখাতে নিষেধ করেছিলেন। তবে গোত্রের নামে নামাঙ্কিত হ’তে নিষেধ করেননি; বরং পবিত্র কুরআনে ঐ দু’টি নামেই তাদের প্রশংসা করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন,وَالسَّابِقُونَ الْأَوَّلُونَ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَالْأَنْصَارِ وَالَّذِينَ اتَّبَعُوهُمْ بِإِحْسَانٍ رَضِيَ اللهُ عَنْهُمْ وَرَضُوا عَنْهُ وَأَعَدَّ لَهُمْ جَنَّاتٍ تَجْرِي تَحْتَهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا أَبَدًا ذَلِكَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ- ‘মুহাজির ও আনছারগণের মধ্যে যারা অগ্রবর্তী ও প্রথম দিককার এবং যারা তাদের অনুসরণ করেছে নিষ্ঠার সাথে, আল্লাহ তাদের প্রতি সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তারাও তাঁর প্রতি সন্তষ্ট। তিনি তাদের জন্য প্রস্ত্তত রেখেছেন জান্নাত, যার তলদেশ দিয়ে নদীসমূহ প্রবাহিত হয়। সেখানে তারা চিরকাল থাকবে। আর এটাই হ’ল মহা সফলতা।’ (তওবা ৯/১০০)। তাই মুহাজিরগণ ‘মুহাজির’ নামে এবং আনছারগণ ‘আনছার’ নামেই থেকে গেছেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) প্রত্যেককে স্ব স্ব দলের প্রতি অবৈধভাবে দলপ্রীতি দেখাতে নিষেধ করেছেন। তিনি দলীয় ব্যবস্থায় কোন হস্তক্ষেপ করেননি। তারা প্রত্যেকেই স্ব স্ব গোত্রের নামের সৈনিক হ’লেও একই যুদ্ধের ময়দানে একই সেনাদলের হয়ে একক সেনাপতির অধীনে একই লক্ষ্য পূরণের নিমিত্তে যুদ্ধ করেছেন।

দলের সংখ্যাধিক্য মাশায়েখ বা জ্ঞানতাপস শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাধিক্য থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ঐ জ্ঞান তাপস শিক্ষকদের প্রত্যেকের জন্য কি নির্দিষ্ট কিছু শিক্ষার্থী থাকা হারাম? যারা প্রত্যেকের থেকে আলাদা আলাদাভাবে ইলম শিখবে, তার তত্ত্বাবধানে ফিক্বহ শিখবে তারপর তার শেখানো ইলম ও ফিক্বহ প্রচার করবে? যদি তা নাজায়েয হয় তাহলে আমাদের উপর অবশ্যই উক্ত জ্ঞানতাপস শিক্ষকদের শিক্ষা মজলিসকে, মাযহাবের ধারক শিক্ষার্থীদেরকে এবং একজন নির্দিষ্ট ইমাম থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ফিক্বহ শিক্ষাকে বাতিল গণ্য করা ফরয হবে। যার সামান্য জ্ঞান আছে সেও তা হারাম বলবে না। তাহলে এসব মুফতী বিভেদ ও দ্বন্দ্বের কথা তুলে কী করে দলের সংখ্যাধিক্যকে হারাম বলে ফৎওয়া দিতে পারেন?

আজকের দিনের ইসলাম প্রচারক দলগুলোর মধ্যকার বিভেদ বিগত দিনের জ্ঞানতাপস শিক্ষকদের শিক্ষার্থীদের মধ্যকার বিভেদের মতই। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানে যে, এসব জ্ঞানতাপস মাশায়েখের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মাযহাবের অনুসারী হওয়ার দরুন পরস্পরের মধ্যে আলোচনা করতে গিয়ে কী ধরনের হিংসা, খুনখারাবী, দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ক্ষয়ক্ষতি ডেকে এনেছে। এসব কিছুই কিন্তু ঘটেছিল মাযহাবপ্রীতি ও পারস্পরিক বিদ্বেষের ফলে। তাই বলে কি আমরা ঐসব জ্ঞানতাপস শিক্ষক, তাদের শিক্ষার্থী এবং তাদের মাযহাবকে হারাম বলব? এগুলোও তো বিভেদ ও দ্বন্দ্ব উষ্কে দেয়!

ইসলাম প্রচারক দলগুলোর অবস্থাও প্রকৃতপক্ষে পুরোটাই জ্ঞানতাপস শিক্ষকবৃন্দ ও তাদের শিক্ষার্থীদের অনুরূপ, যা ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষাক্রম এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রচার সংঘের ফলে ভিন্ন ভিন্ন রূপ লাভ করেছে। এসব জামা‘আত বা সংগঠনের মধ্যে মানগত তারতম্য, কর্মপদ্ধতির ভিন্নতা, অঙ্গীভূতকরণ ক্ষমতা, বিশেষায়ণ ইত্যাদি নানা আঙ্গিকের পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু এসব পার্থক্য গ্রহণযোগ্য। হ্যাঁ, জামা‘আত বা দলগুলোতে কখনো বিচ্যুতি, কখনো বিদ‘আত, কখনো ঘাটতি থাকতে পারে। কিন্তু এর কোনটাই আল্লাহর পথে দাওয়াতদাতা দলগুলোকে হারাম বলার উপযুক্ত কোন কারণ নয়। এই দলগুলোই তো ইসলামী হুকূমতের চৌহদ্দী পাহারা দিচ্ছে এবং বিভিন্ন ফরযে কিফায়াহ সম্পাদন করে চলেছে, যা কি-না ছিল সকল উম্মতের উপর ফরয।

এখন আমি আশা করতে পারি যে, চক্ষুষ্মানের সামনে অাঁধার কেটে ভোর পরিষ্কার হয়েছে এবং সঠিক রাস্তা স্পষ্ট রূপে প্রতিভাত হয়েছে। আর এটাও স্পষ্ট বুঝা গেছে যে, ইসলাম প্রচারকারী দলগুলোকে হারাম আখ্যাদানকারী বক্তা মাত্রাজ্ঞান ছেড়ে বক্তৃতা দিয়েছেন এবং কোন দলীল-প্রমাণ ছাড়াই ফৎওয়া দিয়েছেন। তারা তাদের ফৎওয়ার মাধ্যমে এমন সব কাজ হারাম গণ্য করেছেন, যা আল্লাহ তা‘আলা তার বান্দাদের উপর ফরয করেছেন। সত্যের পথে চলতে একে অপরকে জোরালোভাবে ডাকা, পরস্পরকে ধৈর্যের উপদেশ দেয়া, সৎকাজ ও তাক্বওয়ার ক্ষেত্রে পরস্পরে সহযোগিতা করা, আল্লাহর রজ্জু কুরআন ও আল্লাহর দ্বীনকে মযবুতভাবে ধারণ করা, সৎকাজের আদেশদাতা ও অসৎ কাজের নিষেধকারী হওয়া এবং সর্বোপরি আল্লাহর পথে দাওয়াত দানকারী একটি উম্মাহ বা জাতি হওয়াটা আসলেই ফরয।


[1]মুসলিম হা/১৮৫৩।

[2]মুসলিম হা/১৮৫২।

[3]বুখারী হা/৩৬০৬; মুসলিম হা/১৮৪৭।

[4]দারেমী হা/১৭০১; আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; বায়হাকী হা/৭৭৭৪; হাকেম ও আবু নু‘আইম এটিকে ছহীহ বলেছেন।





রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে ভালবাসা - ইহসান ইলাহী যহীর
আমানত (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ মীযানুর রহমান
বৈঠকের আদব বা শিষ্টাচার - ড. মুহাম্মাদ কাবীরুল ইসলাম
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৮ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
বিদ‘আত ও তার পরিণতি (৭ম কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে তাক্বলীদ (২য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ শরীফুল ইসলাম মাদানী
মুসলিম সমাজে মসজিদের গুরুত্ব (৩য় কিস্তি) - মুহাম্মাদ আব্দুল ওয়াদূদ
পুনরুত্থান - রফীক আহমাদ - বিরামপুর, দিনাজপুর
কুরবানীর মাসায়েল
কিভাবে নিজেকে আলোকিত করবেন? - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
হজ্জ সফর (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ ছাকিব
তাহাজ্জুদের ন্যায় ফযীলতপূর্ণ কতিপয় আমল - আব্দুল্লাহ আল-মা‘রূফ
আরও
আরও
.