সতী-সাধ্বী নারীর
সম্ভ্রম হরণ করা যায় না। তার সম্মান নষ্ট করা যায় না। সতীত্ব ও সম্ভ্রম
রক্ষার স্বার্থে প্রয়োজনে সে জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হয় না। খাত্তাবী তার
বিখ্যাত গ্রন্থ ‘আকাশের ইনসাফ’-এ একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন, যা নিম্নরূপ-
চল্লিশ বছর পূর্বে বাগদাদে এক কশাই ছিল। ফজরের আগেই সে দোকানে চলে যেত। সে ছাগল-মেষ যবেহ করে অন্ধকার থাকতেই বাড়ী ফিরে যেত। একদা ছাগল যবেহ করে বাড়ি ফিরছিল। তখনো রাতের অাঁধার কাটেনি। সেদিন অনেক রক্ত লেগেছিল তার জামা-কাপড়ে। পথিমধ্যে সে এক গলির ভিতর থেকে একটা কাতর গোঙানি শুনতে পেল। সে গোঙানিটা লক্ষ্য করে দ্রুত এগিয়ে গেল। হঠাৎ সে একটা দেহের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে গেল। একজন আহত লোক পড়ে আছে মাটিতে। যখম গুরুতর। বাঁচাতে হ’লে দ্রুত চিকিৎসার প্রয়োজন। তখনো দরদর করে রক্ত বেরুচ্ছে। তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। ছুরিটা তখনো দেহে গেঁথে আছে। দ্রুত সে ছুরিটা ঝটকা টানে বের করে ফেলল। তারপর লোকটিকে কাঁধে তুলে নিল। কিন্তু লোকটি পথে এবং তার কাঁধেই মারা গেল।
এর মধ্যেই লোকজন জড়ো হ’ল। কশাইয়ের হাতে ছুরি। সদ্য মৃত লোকটির গায়ে তাজা রক্ত। এসব দেখে লোকজনের স্থির ধারণা হ’ল যে, সেই ঘাতক। অগত্যা তাকে হন্তারক হিসাবে অভিযুক্ত হ’তে হ’ল এবং তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হ’ল।
যখন তাকে ‘ক্বিছাছ’-এর জায়গায় আনা হ’ল এবং মৃত্যু যখন অবধারিত, তখন সে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বলে উঠল, ‘হে উপস্থিত জনতা! আমি এই লোকটিকে মোটেই হত্যা করিনি। তবে আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি অপর একটি হত্যাকান্ড সংঘটিত করেছিলাম। আজ যদি আমার মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়, তাহ’লে এই ব্যক্তির হত্যার কারণে নয়, বরং সেই হত্যাকান্ডের জন্য হ’তে পারে’।
অতঃপর সে বিশ বছর আগের হত্যার ঘটনাটি বলা শুরু করল- আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি ছিলাম এক টগবগে যুবক। নৌকা চালাতাম। লোকজনকে পারাপার করতাম। একদিন এক ধনবতী যুবতী তার মাকে নিয়ে আমার নৌকায় পার হ’ল। পরদিন আবার তাদেরকে পার করলাম। এভাবে প্রতিদিনই আমি তাদেরকে আমার নৌকায় পার করতাম।
এ পারাপারের সুবাদে যুবতীটির সাথে আমার আন্তরিকতা গড়ে উঠল। ধীরে ধীরে আমরা একে অপরকে গভীরভাবে ভালবেসে ফেললাম। এক সময় আমি তার পিতার নিকট বিবাহের প্রস্তাব নিয়ে গেলাম। কিন্তু আমার মত দরিদ্র এক মাঝির কাছে মেয়ে দিতে তিনি অস্বীকার করলেন। এরপর আমাদের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেও এদিকে আর আসত না। সম্ভবত মেয়েটির বাবা নিষেধ করে দিয়েছিল। আমি অনেক চেষ্টা করেও তাকে ভুলতে পারলাম না। এভাবে কেটে গেল ২/৩ বছর। একদিন আমি নৌকা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা করছিলাম। এমন সময় এক মহিলা ছোট একটি মেয়েকে নিয়ে ঘাটে উপস্থিত হ’ল এবং আমাকে নদী পার করে দিতে অনুরোধ করল।
আমি তাকে নিয়ে রওয়ানা হ’লাম। মাঝ নদীতে এসে তাকালাম তার চেহারার দিকে। চিনতে দেরী হ’ল না যে, এ আমার সেই প্রেয়সী। এর পিতা আমাদের মাঝে বিচ্ছেদের পর্দা টেনে না দিলে সে আজ আমার স্ত্রী থাকত।
আমি তাকে দেখে খুশি হ’লাম। বিভিন্ন মধুময় স্মৃতির ডালি একে একে তার সামনে মেলে ধরতে লাগলাম। সে প্রতি উত্তর করছিল খুব সতর্কতার সাথে এবং বিনয়ের সাথে। পরক্ষণেই সে জানাল যে, সে বিবাহিতা এবং সঙ্গের শিশুটি তারই সন্তান। আমার মন বড় অস্থির হয়ে গেল। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলাম না। একটা অশুভ ইচ্ছা আমাকে তাড়া করল। এক পর্যায়ে যৌন পিপাসা নিবৃত্ত করার জন্য আমি তার উপর চাপাচাপি শুরু করলাম। সে আমাকে মিনতি করে বলল, আল্লাহকে ভয় কর! আমার সর্বনাশ কর, না’।
আমি মানলাম না। আমি ফিরলাম না। তখন অসহায় নারীটি শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আমাকে প্রতিরোধের চেষ্টা করতে লাগল। তার শিশু কন্যাটি চিৎকার করতে লাগল। আমি তখন তার শিশু কন্যাটিকে শক্ত হাতে ধরে বললাম, তুমি আমার আহবানে সাড়া না দিলে তোমার সন্তানকে আমি পানিতে ডুবিয়ে মারব। তখন সে কেঁদে উঠল। হাত জোড় করে মিনতি জানাতে লাগল। কিন্তু আমি এমনই অমানুষে পরিণত হ’লাম যে, নারীর অশ্রু ও কান্না কিছুই আমার প্রবৃত্তিকে চরিতার্থ করার চেয়ে মূল্যবান মনে হ’ল না। আমি নিষ্ঠুরভাবে শিশু কন্যাটির মাথা পানিতে চেপে ধরলাম। মরার উপক্রম হ’তেই আবার বের করে আনলাম। বললাম, জলদি রাযী হও, নইলে একটু পরই এর লাশ দেখবে। কিন্তু যুগপৎ সন্তানের মায়ায় এবং সতীত্বের ভালবাসায় বিলাপ করে কাঁদতে লাগল, যা আমার কাছে ছিল অর্থহীন, মূল্যহীন।
আমি আবার মেয়েটিকে পানিতে চেপে ধরলাম। শিশুটি হাত-পা নাড়ছিল। জীবনের বেলাভূমিতে আরো অনেক দিন হাঁটার স্বপ্নে দ্রুত হাত-পা ছুঁড়ছিল। কিন্তু ওর জানা ছিল না কেমন হিংস্রের হাতে পড়েছে সে। এবার আমি তার মাথাটা তুলে আনলাম না। ফল যা হবার তাই হ’ল। কিছুক্ষণের মধ্যেই শিশুটি নিথর নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
আমি এবার তাকালাম তার দিকে। কিন্তু মেয়ের করুণ মৃত্যুও তাকে নরম করতে পারল না। সে তার সিদ্ধান্তে অনড়, অবিচল। তার দৃষ্টি যেন বলছিল ‘সন্তান গেছে, প্রয়োজনে আমিও যাব। জান দেব। তবু মান দেব না’। কিন্তু আমার মানুষ সত্তা হারিয়ে গিয়েছিল। বিবেক-সত্তা ঘুমিয়েছিল গভীর সুপ্তির কোলে। আমার মাঝে রাজত্ব করছিল শুধু আমার পশু-সত্তা। আমি নেকড়ের মতো তার দিকে এগিয়ে গেলাম। চুলকে মুষ্টি বদ্ধ করলাম। তারপর তাকেও পানিতে চেপে ধরলাম। বললাম, ভেবে দেখ জলদি; জীবনের মায়া যদি কর তবে আবার ভাব’। সে ঘৃণাভরে না বলে দিল। আমিও তাকে চেপে ধরে রাখলাম। এক সময় আমার হাত ক্লান্ত হয়ে এল। সাথে সাথে তার দেহটাও নিথর হয়ে গেল। আমি ওকে পানিতে ফেলে দিয়ে ফিরে এলাম। খবর আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানল না। মহান সেই সত্তা, যিনি বান্দাকে সুযোগ দেন। কিন্তু ছুড়ে ফেলে দেন না। এই করুণ কাহিনী শুনে উপস্থিত সবার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এল। এরপর তার শিরোশ্ছেদ করা হ’ল।
এ ঘটনা উজ্জ্বল প্রমাণ যে, সতীত্ব ও সম্ভ্রম রক্ষায় সতী-সাধ্বী নারীরা কত আপোষহীন? নিজের মেয়েটা নিজের চোখের সামনে জীবন দিল তবুও সে আপোষ করল না। নিজের জীবন দিল। তবুও নিজের মান সে বিলিয়ে দিল না। তার সতীত্ব ও সম্ভ্রমের গায়ে একটা কাঁটাও ফুটতে দিল না।
হোসনে আরা আফরোয
শেরপুর, বগুড়া।