২০১৪ সাল। আমি তখন মেহেরপুরের বিচারক ছিলাম। আমার এক দশকের অধিক সময়ের বিচারক জীবনে মেহেরপুরের দিনগুলি আজো আমার কাছে স্বর্ণসময় মনে হয়।

একদিনের ঘটনা। আধা কেজি গাঁজা দখলে রাখার দায়ে  আসামীর বিচার চলছে। আসামী মধ্যবয়সী। সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে আসামী পরীক্ষা (সাক্ষীদের বক্তব্য আসামীকে পড়ে শুনিয়ে আসামীর বক্তব্য জানতে চাওয়ার পর্যায়)  গ্রহণকালে  আসামীর সাথে আমি কথা বলি। আসামী একজন মাদকসেবী তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। আধা কেজি নয়, সেবনকালে অসতর্কতাবশত ধৃত হয়েছে মর্মে দাবী করে সে।

ফাঁকে অনেকটা আগ্রহী হয়ে তার গাঁজা সেবনে অভ্যস্ত হওয়ার গল্প শুনি। আমাকে মনযোগী শ্রোতা পেয়ে সে জীবনের আদ্যোপান্ত বলতে থাকে। গল্পের সারমর্ম এই যে, সে এক মেয়েকে পসন্দ করত ভীষণ। পরিবার হ’তে তাঁকে বিয়ে দেয়া হয় না সেখানে। মেয়েটার বিয়ে হয় অন্যত্র। মানসিক হতাশায় কয়েকজন বন্ধুর সাথে প্রথমে বিড়ি, পরে সিগারেট, তামাক পাতা, শেষে গাঁজা সেবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে সে।

মাদকের মামলায় একজন মাত্র সাক্ষীর উপর ভিত্তি করে আসামীকে সাজা দেয়ার নযীর থাকলেও এই মামলায় সাক্ষীদের পরস্পরের বক্তব্য এতটাই অসঙ্গতিপূর্ণ যে, আসামীকে নূন্যতম সাজা দেয়ার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তা পারিনি। মাদকসেবী আসামীকে সাজা দিতে না পেরে এজাহারকারী ও তদন্তকারীদের উপর মনে মনে রাগও হয় আমার। শেষে ওপেন এজলাসে আসামীকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করি।

রায়ের পর তার সাথে মাদকের ক্ষতিকর দিক নিয়ে খোলামেলা কথা বলি। ক্ষণস্থায়ী জীবনের পরে চিরস্থায়ী জীবনের কথা সে একসময়  বিশ্বাস করে। নেশাদার দ্রব্য গ্রহণকারীরা সেই চিরস্থায়ী জীবনে জান্নাত পাবে না। আর যাবতীয় নেশাদ্রব্য হারাম, কথাগুলি তাকে বোঝাই। আসামীর সাথে উন্মুক্ত আদালতে প্রায় কুড়ি মিনিট কথা বলি। আসামী আবেগাপ­ুত হয়ে পড়ে। ভবিষ্যতে সে আর নেশা করবে না মর্মে প্রতিজ্ঞা করে।

একমাস পরের ঘটনা। অভ্যাসবশত আদালত শেষে আমি হাঁটতে বের হয়েছি সেদিন। কোর্ট হ’তে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে জেলখানা পার হয়ে মেঠো পথ ধরে হাতের ডানের আবাদি মাঠের ভিতর একাকী চলছি। জ্যৈষ্ঠ মাস। হাঁটু সমান পাট খেতের আইল ধরে নীচে নামতে থাকা আকাশ পানে আনমনে তাকিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ ফসলের মাঠ হ’তে কাজ ফেলে এগিয়ে আসে এক মধ্যবয়সী লোক। আমার পায়ে সালাম করতে উদ্যত হয়। অকস্মাৎ আগন্তুকের উপস্থিতি দেখে হতচকিত হয়ে জোরে চিৎকার করি, কে আপনি? খরবদার কাছে আসবেন না।

দু’হাত জোড় করে যারপরনাই বিনীত কন্ঠে আগন্তুক বলে, সে গাঁজার মামলার আসামী ছিল, আমি তাকে খালাস দিয়েছি। নির্জন মাঠে মাদকের এক আসামীর মুখোমুখি আমি। ভয় পাই ভীষণ। প্রমাদ গুণি। সংগে সংগে তাকে বলি, আপনি হয়তো ভুল দেখছেন। বলেই পিছন ফিরে হাঁটা শুরু করি। সেও আমার পিছনে পিছনে আসতে আসতে বলতে থাকে, না স্যার! আমি ভুল দেখছি না। আপনিই ম্যাজিস্ট্রেট। স্যার! আমি নেশা ছেড়ে দিয়েছি ...। আমার হাঁটার গতি দেখে সে আর এগোয় না। তার কন্ঠ একসময় বাতাসে  মিলিয়ে যায়।

সেই মিলিয়ে যাওয়া পুরুষ কণ্ঠ অনেকদিন আমার কানে বাজতে থাকে, স্যার আমি নেশা ছেড়ে দিয়েছি ... স্যার আমি নেশা ছেড়ে দিয়েছি ...

মতীউর রহমান, মেহেরপুর।






বিষয়সমূহ: হালাল-হারাম
দরদিনী - মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
দুরন্ত সাহসের এক অনন্য কাহিনী - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
পিতা-মাতার খেদমতে বরকত লাভ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
বিচ্ছেদ আবেদনের মধুর সমাপ্তি... - মুতীউর রহমান
পুত্রের প্রতি পিতার উপদেশ - আল-আমীন খান
মহিয়সী নারী - মুহাম্মাদ আতাউর রহমান
দুনিয়ালোভীর উদাহরণ - মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম
আল্লাহর উপরে ভরসার গুরুত্ব - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যেমন পিতা তেমনি সন্তান - হাফেয মুহাম্মাদ সাইফুয্যামান, মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সঊদী আরব
একজন বড় ছাহেব - আত-তাহরীক ডেস্ক
ক্বিয়ামতের সামান্য দৃশ্য - আত-তাহরীক ডেস্ক
আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.