গল্পটি একজন বাদশাহ ও ফকীরের। বাদশাহ প্রতিদিন প্রত্যুষে তার প্রাসাদের বাইরে কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করতেন। একদা প্রভাতে হাঁটার সময় এক অসহায় ভিক্ষুককে দেখে তার মনে দয়ার উদ্রেক হ’ল। তিনি ভিক্ষুকের নিকটে গিয়ে বললেন, আমি এদেশের বাদশাহ। তুমি যা ইচ্ছা আমার কাছে চাইতে পার। ভিক্ষুক বলল, আমার চাহিদা আপনি কখনোই পূরণ করতে পারবেন না।
ভিক্ষুকের কথায় বাদশাহ অপমানিত বোধ করলেন। তিনি দৃঢ়তার সাথে বললেন, আমি অবশ্যই তোমার চাহিদা পূরণ করব। তুমি তোমার চাহিদা পেশ কর। ভিক্ষুক শান্তস্বরে বলল, মহান বাদশাহ! আপনি আমাকে চাইতে বাধ্য করবেন না। কারণ আপনি কখনোই আমার চাহিদা পূরণ করতে পারবেন না।
বাদশাহ ছিলেন খুব যেদী। তিনি বললেন, তুমি চাও। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর বাদশাহ। আমি তোমার সকল চাহিদা পূরণ করতে প্রস্ত্তত আছি। তোমার পক্ষে এমন কিছু চাওয়া সম্ভব নয়, যা আমি দিতে পারব না। বাধ্য হয়ে ভিক্ষুক বলল, আপনি খুবই যেদী ও অহংকারী। অতঃপর সে তার ভিক্ষার থলে উঠিয়ে বলল, আপনি কি এটা কোন সম্পদ দিয়ে পূর্ণ করে দিতে পারবেন? বাদশাহ মুচকি হেসে বললেন, অবশ্যই পারব। অতঃপর তিনি তাঁর কোষাগারের একজন কর্মচারীকে ডেকে বললেন, তার থলেটি স্বর্ণমূদ্রা দিয়ে পূর্ণ করে দাও।
বাদশাহর আদেশ পেয়ে কর্মচারী কোষাগারের দিকে রওনা হ’ল এবং কিছুক্ষণ পর এক বস্তা স্বর্ণমূদ্রা নিয়ে ফিরে আসল। বাদশাহর আদেশে কর্মচারী ভিক্ষুকের থলেতে স্বর্ণমূদ্রা ভরতে শুরু করল। কিন্তু দেখা গেল, থলেতে কোন স্বর্ণমূদ্রা দেওয়ার সাথে সাথে তা হারিয়ে যায়। সব স্বর্ণমূদ্রা দেওয়ার পরও দেখা গেল থলেতে কিছুই নেই। কর্মচারী ফিরে গিয়ে আরো কয়েক বস্তা স্বর্ণমূদ্রা নিয়ে আসল। কিন্তু প্রতিবারই যখন থলেতে মূদ্রা দেওয়া হয়, তৎক্ষণাৎ মূদ্রা হারিয়ে যায় এবং থলে সব সময় খালিই পড়ে থাকে।
বাদশাহর সকল কর্মচারী তখন কোষাগার থেকে ঘটনাস্থল পর্যন্ত মূদ্রা আনয়নের কাজে নিয়োজিত। বাদশাহ ও ভিক্ষুককে ঘিরে জনগণের ভিড় জমে গেছে। একসময় কোষাগারের সকল সম্পদ শেষ হয়ে গেল। বাদশাহর যেদ তখন লজ্জায় পর্যবসিত হ’ল। কিন্তু তিনি একজন ভিক্ষুকের কাছে মাথানত করতে নারায। ফলে নিজের সম্মান রক্ষার্থে তিনি রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সম্পদ আনার নির্দেশ দিয়ে বললেন, আমার পুরো সাম্রাজ্য শেষ হয়ে গেলেও আমি তার জন্য প্রস্ত্তত আছি। তবু আমি ভিক্ষুকের কাছে পরাজয় বরণ করব না।
সারাদিন অসংখ্য স্বর্ণ-কংকন, মণি-মুক্তা থলেতে দেওয়া হ’ল। কিন্তু সকল মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে যেতে থাকল। আর থলে প্রতিবারই শূন্য পড়ে রইল। এভাবে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলে বাদশাহ নতি স্বীকার করে বললেন, তুমি বিজয়ী হয়েছ। কিন্তু চলে যাওয়ার পূর্বে আমাকে একটা কথা বল, এই থলের রহস্য কি?
কি এমন আছে যে কারণে একে পূর্ণ করা যায় না? এটা কি জাদুর থলে? ভিক্ষুক বলল, এটা কোন জাদুর থলে নয়। এখানে কোন গোপন রহস্যও নেই। বরং এটা মানুষের আকাঙ্ক্ষার বাস্তব চিত্র। যা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কখনো পূর্ণ হয় না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তোমাদের (পরকাল থেকে) গাফেল রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরস্থানে উপনীত হও’ (তাকাছুর ১০২/১-২)।
গল্পটির প্রকৃত অর্থ যদি আমরা উপলব্ধি করতে পারি, তাহ’লে আমরা একটি মহান শিক্ষা লাভ করব। যা আমাদের জীবন পরিবর্তন করে দিতে পারে। আমরা যখন কোন কিছু অর্জনের আকাঙ্ক্ষা করি, তখন আমাদের মধ্যে প্রচুর উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। যখন এটি অর্জনের সম্ভাবনা তৈরী হয়, তখন মনের মধ্যে একটি হৃদয়গ্রাহী অনুভূতি কাজ করে। মনে হ’তে থাকে, আমি দুর্লভ কিছু অর্জন করতে যাচ্ছি। শীঘ্রই নতুন কিছু ঘটতে চলেছে এবং আমি এটি ঘটার দ্বারপ্রান্তে রয়েছি। এরপর একদিন সেটি অর্জিত হয়। কিন্তু আমরা তৃপ্তি লাভ করতে পারি না। বরং তখন আমরা নতুন কিছুর জন্য লালায়িত হই।
সহজভাবে বললে, আপনি সবকিছু চান। আপনি একটি গাড়ি চান, আপনি একটি বাড়ি চান, আপনি সুন্দরী স্ত্রী চান, সম্মানজনক অবস্থান চান, আপনি সব চান। আপনি যখন এই সবকিছু অর্জন করেন, তখন সেগুলোর প্রতি উৎসাহ হারিয়ে ফেলেন। তখন আপনি আরেকটি নতুন গাড়ি প্রত্যাশা করেন। আরো অত্যাধুনিক বাড়ির স্বপ্ন দেখেন। আপনার স্ত্রীর চেয়ে সুন্দরী স্ত্রী কামনা করেন। প্রতিদিন নতুন কিছু পাওয়ার ইচ্ছা আপনাকে ব্যাকুল করে তোলে। এমনকি তখন আপনি হালাল-হারামের সীমারেখা ভুলে যান।
প্রয়োজনের তুলনায় সবকিছু অতিরিক্ত থাকার পরও মানুষ চায়। এমন মানুষও আছে, যে একটি রুমাল কিনতে হাযার টাকা খরচ করে। অথচ বিশ টাকার রুমালে প্রয়োজন মিটে যায়। ভিক্ষুকের থলের মত মানুষের অন্তর এক অবাক পাত্র, যার আকাঙ্ক্ষা কখনো পূর্ণ হয় না। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আদম সন্তানের যদি দু’টি মাঠ ভর্তি সম্পদ থাকে তাহ’লে সে তৃতীয় মাঠ ভর্তি সম্পদ প্রত্যাশা করবে। আদম সন্তানের পেট মাটি ছাড়া কোন কিছুই ভরাতে পারে না। তবে যে ব্যক্তি তওবা করে আল্লাহ তার তওবা কবুল করেন’ (মুসলিম হা/২৩০৫)।
অধিক পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা মানুষকে নেশাগ্রস্ত করে তোলে। সে এমন অনেক কিছুই অর্জনের চেষ্টা করে, যেটাতে আদৌ তার কোন প্রয়োজন নেই। ফলে দিনে দিনে তার অন্তর অতৃপ্ত হয়ে যায়। জীবনের পড়ন্ত বেলায় এসেও সে চায়। কিন্তু তখন সে জানে না, সে কি চায়! সে তখন জীবনের হারিয়ে ফেলা সময়গুলো ফিরে পেতে চায়। অর্জনের চেষ্টায় বিভোর আত্মা উপভোগের সময় চায়। আত্মার প্রকৃত তৃপ্তির সন্ধান চায়। সে একটি হৃদয় শীতলকারী অনুভূতি চায়। সে চিৎকার করে বলতে চায়,
প্রতিটি অর্জন ও ভোগ ক্ষণস্থায়ী
সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই কেবল চিরস্থায়ী।
প্রিয় পাঠক! আপনার জীবনসূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ার পূর্বেই সচেতন হোন। মনে রাখবেন, আল্লাহর বিধান পালনের মধ্য দিয়েই প্রকৃত আত্মতৃপ্তি লাভ করা যায়।
-মূল : মুহসিন জববার, অনুবাদ : নাজমুন নাঈম
* শিক্ষার্থী, আরবী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।