আমীন অনার্স-মাষ্টার্স পাশ একজন টগবগে যুবক। অন্যান্য
ছেলেদের মতো তাকে চাকরির জন্য দ্বারে দ্বারে হাঁটতে হয়নি বেশী দিন।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ছয় মাসের মধ্যে চাকরি জুটে গেল। খুব ভাল চাকরি।
বড় অফিসার পদে। বেতনও বেশ ভাল। কিন্তু পরিশ্রমটা একটু বেশী। সেই সকাল ৮-টা
থেকে রাত ৮-টা পর্যন্ত।
স্বতঃস্ফূর্ততা, কর্মচাঞ্চল্য ও সৃজনশীল
চিন্তাধারা দিয়ে সে অল্প সময়ের মধ্যে অফিসের ছোট-বড় সবার মন জয় করে ফেলে।
সে অফিসের কাজে খুবই যত্নশীল ও আন্তরিক। তার হাযিরা খাতায় কোনদিন লালকালির
দাগ পড়েনি।
পানির স্রোতের মতো দিন বয়ে চলল। ইতিমধ্যে চাকরি জীবনে তার
পঞ্চম বছরে পদার্পণ। সফলতার সাথে এ বছরটা চোখের পলকে কেটে গেল। ষষ্ঠ বছর
চলছে। সেদিনটির কথা আজো তার ভাল স্মরণ আছে। ভুলে যাবে কি করে? দিনটি ছিল
সোমবার। সকাল ৭-টায় ঘুম ভাঙ্গলো। জানালা দিয়ে বাইরে সোনাঝরা রোদ্দুর
চারিদিকে ঝলমল করছে। দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠে কোন এক অজানা আনন্দে নিজে নিজে
হাসল আমীন। তারপর গোসলের জন্য বাথরুমে ঢুকে সাবান-শ্যাম্পু মেখে খুব ভাল
করে গোসল করল। মিনিট দশেক ব্যয় হ’ল তাতে। এবার চিরুণী নিয়ে আয়নার সামনে
দাঁড়াল। আয়নায় চোখ পড়তেই ভীষণভাবে চমকে উঠল সে। হৃদপিন্ডটায় যেন হাতুড়ির
বাড়ি পড়ল। হাতুড়ী পেটানোর শব্দ যেন সে নিজের কানেও শুনতে পাচ্ছে। নিজের
অজান্তেই আর্তচিৎকার বেরিয়ে এলো তার মুখ থেকে। আয়নার কাছ থেকে ৭-৮ পা
পিছিয়ে আসল সে। তার সমস্ত শরীর অবশ হয়ে আসতে লাগল। মনে হ’ল শরীরের
শিরা-উপশিরায় রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল
না। ভূত দেখার মত মনে হ’ল। সেকি! তাজ্জব ব্যাপার।
নির্বাক পাথরের মত কত
সময় দাঁড়িয়ে ছিল সে তা বলতে পারবে না। নিজের মধ্যে শক্তি-সাহস সঞ্চয় করে
এক পা দু’পা করে আয়নার খুব কাছে চলে গেল সে। হাত দিয়ে ভাল করে দেখতে লাগল।
তাইতো নাক গেল কোথায়? হাওয়া হয়ে গেল নাকি? সে মনে করল যেন গত রাতে কেউ চুরি
করে নিয়ে গেছে। কিন্তু সেখানে তো রক্তের দাগ থাকবে। তাও তো নেই। তাকে কত
বীভৎস দেখাচ্ছে। কিন্তু এমন তো হবার কথা ছিল না।
এতক্ষণে নিজেকে সে
আবিষ্কার করল। সমস্ত শরীরে শীতের বরফ জমা বিশাল পাহাড়। শরীর এত ভারী মনে
হ’ল যে পা তোলার ক্ষমতা নেই। অস্বস্থিতে ছটফট করতে লাগল। সোজা চলে গেল
জানালার পাশে। রাস্তায় ভ্রাম্যমান সবারই তো নাক ঠিক জায়গায় আছে। তাহ’লে
তারটা গেল কোথায়?
মেঘাচ্ছন্ন মুখ-চোখে কষ্টের লোনা জল নিয়ে আমীন একবার
খাটের উপর বসছে আবার উঠে আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছে। নিজেকে তার খুব অসহায় মনে
হ’ল। এমন ভয়ংকর ঘটনা দেখা তো দূরের কথা পত্র-পত্রিকায়ও তো কোনদিন পড়েনি সে।
অস্থির ছটফটানিতে কেটে যাচ্ছে সময়। ঘড়ির দিকে তাকাল সে। সকাল সাড়ে দশটা।
খাটের
উপর নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিল সে। তাও অস্বস্তি লাগছে তার। হঠাৎ তার বাড়ীর
কথা মনে পড়ল। মা-বাবা, ভাই-বোন আত্মীয়-স্বজন, কত বন্ধু-বান্ধব ওদের সামনে
সে এ অবস্থায় কিভাবে দাঁড়াবে? ঘামে সমস্ত শরীর ভিজে যাচ্ছে। হৃদয় মোচড় দিয়ে
উঠলো। কিছুই ভাবতে পারছে না। মাথা ঘুরপাক খাচ্ছে। চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ল
আমীন।
গত দু’দিন আগে আমীনের কাছে আসাদ ছাহেব এসেছিলেন একটা যরূরী কাজে।
তার সমস্ত কিছু শুনল। ঘাড় নেড়ে আসাদ ছাহেবকে বলল, ব্যাপারটা বড় গুরুতর।
তিনি পাশে এসে হাত ধরে বললেন, ভাই আমাকে উদ্ধার করেন নইলে...? গম্ভীর কণ্ঠে
বলল, পনের হাযার টাকা দিতে হবে। টাকার অংকটা শুনে তার চোখ ছানাবড়া। তিনি
একটু কম দিতে চাইলেন। আমীন একেবারে না করল। অবশেষে কি আর করা? পুরো টাকাটাই
দিয়ে গেলেন আসাদ ছাহেব। টাকাগুলো তাড়াতাড়ি নিয়ে আলমারির মধ্যে তালাবদ্ধ
করল আমীন। মনের ভিতরে অনাবিল আনন্দ বয়ে যেতে লাগল তার।
সেদিনের কথা আজ
শুয়ে চিন্তা করছে, এটা নিশ্চয়ই তার পাপের প্রতিফল। এমন নাজুক অবস্থায়
মনুষ্য সমাজে বাস করা সম্ভব নয়। লজ্জায় মুষড়ে পড়ল সে। জীবন থেকে সে পালিয়ে
বাঁচার সিদ্ধান্ত নিল। আজ রাতই হবে তার জীবনের শেষ রাত। ঘড়ির দিকে তাকাল।
সন্ধ্যা ৬-টা। আবারও আয়নার কাছে গেল। সিদ্ধান্ত নিল আগে এই পাপের টাকাগুলো
ফিরিয়ে দেবে, তারপর দুনিয়ার মায়াজাল ত্যাগ করবে।
তড়িৎ গতিতে উঠে হাত
মুখ ধুয়ে প্যান্ট-শার্ট পরে নিল। পাপের টাকাগুলো আলমারি থেকে বের করে থলে
ভর্তি করল। বড় একখানা রুমাল মুখ বরাবর চেপে ধরে বের হ’ল। একটি রিক্সা ডেকে
সরাসরি আসাদ ছাহেবের বাসার দিকে ছুটল। গিয়ে টাকার ব্যাগটা তার হাতে ধরিয়ে
দিয়ে বিদ্যুৎ বেগে চলে আসল আমীন। আসাদ ছাহেব মূর্তির মত তাকিয়ে রইল। কিছু
বলতে গেল কিন্তু...? রিক্সায় আবার চেপে বসল আমীন। রিক্সা আপন গতিতে চলছে।
মনের মধ্যে প্রশ্ন উদয় হ’ল সবাই তো বেশ সুখেই চলছে। কিন্তু আমার একি হ’ল?
পৃথিবী ছেড়ে যাবার পূর্ব মুহূর্তটি চারিদিকে ভাল করে দেখে নিচ্ছে সে।
আল্লাহ্র সৃষ্টি পৃথিবী কতই না সুন্দর। নিজের অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে
এলো। নিজের জীবনের জন্য একটু দুঃখিত হ’ল।
সামনে পাঁচ মিনিটের দূরত্বে
তার বাসা। রুমালের ভিতরে শক্ত অনুভূতি টের পেল। ছলকে উঠলো বুকের রক্ত। চমকে
উঠল সে আবার কি হ’ল? ভয় পেল কিছুটা। ভয়ে চুপচাপ বসে আছে। বুকের ভিতরে কি
যেন অনুভূতি জোরে জোরে লাফাচ্ছে। রিক্সা তার বাসার সামনে রাখল। রিক্সা
ওয়ালাকে ভাড়া দ্বিগুণ দিল। ড্রাইভার তার দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে থাকল।
সোজা
রুমে ঢুকে দরজার ছিটকিনী আটকে দিল আমীন। আয়নার সামনে গিয়ে ভয়ে ভয়ে রুমাল
সরাল। দেখেই আনন্দে নেচে উঠল তার মন, চিৎকার দিয়ে উঠল সে। এবার নাকতো ঠিক
জায়গায়ই আছে। সে নিখুঁতভাবে দেখতে লাগল। ঠিক জায়গায়ই তো নাক আছে। পরম সুখে
চোখের কোণে অশ্রু এসে গেল। মনে পড়লো তার আজ সোমবার। বৃহস্পতি ও সোমবার তওবা
কবুলের দিন। তাই সে তওবা করল। আর নয় পাপের পথে উপার্জিত টাকার লোভ। এখন
থেকে হালাল পথে উপার্জন করব; সৎ ও সুন্দরভাবে বাঁচবো। এটা আমীনের দৃঢ়
সংকল্প।
এম. মুয়াযযাম বিল্লাহ
কাকডাঙ্গা সিরিয়র ফাযিল মাদরাসা, সাতক্ষীরা।