পর্ব ১ ।

কর্মজীবন :

শায়খ আলবানীর পিতা নূহ নাজাতী সিরিয়ার বিশিষ্ট আলেম হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকতা ও গবেষণার পাশাপাশি জীবিকা নির্বাহের জন্য ঘড়ি মেরামত করতেন। তাই স্বীয় রীতি অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষাকালেই তিনি দ্বীন শিক্ষার সাথে সাথে জীবিকা অর্জনের জন্য আলবানীকে কাঠমিস্ত্রির কাজ শেখার ব্যবস্থা করেন। ৪ বছর তিনি এর উপর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।[1] পরবর্তীতে কাজটি কষ্টসাধ্য হওয়ায় পিতার পরামর্শে ও তত্ত্বাবধানে তিনি ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখেন। অতঃপর নিজের জন্য পৃথক দোকান নির্মাণ করে কাজ শুরু করেন এবং এটাকেই মূল পেশা হিসাবে গ্রহণ করেন।[2] এরপর ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি উক্ত পেশা ছেড়ে গবেষণাকর্মে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন।

নিজের এ পেশার ব্যাপারে আলবানী বলতেন, ‘আল্লাহর অশেষ রহমত যে, তিনি আমাকে প্রথম যৌবনেই ঘড়ি মেরামতের কাজ শেখার প্রতি আগ্রহী হওয়ার তাওফীক দান করেছিলেন। কেননা এটা এমন একটি স্বাধীন পেশা, যা ইলমে হাদীছে বুৎপত্তি অর্জনের ক্ষেত্রে আমার জন্য বাধা হ’ত না। আমি মঙ্গলবার ও শুক্রবার ব্যতীত প্রতিদিন মাত্র তিন ঘণ্টা এর পিছনে ব্যয় করতাম। এই সময়ের মধ্যে অর্জিত জীবিকা আমার নিজের, পরিবারের ও সন্তানদের জন্য যথেষ্ট ছিল। আর রাসূল (ছাঃ) এ দো‘আই করতেন যে, اللهُمَّ اجْعَلْ رِزْقَ آلِ مُحَمَّدٍ قُوتًا ‘হে আল্লাহ! তুমি মুহাম্মাদের পরিবারের জন্য পরিমিত রিযিক দান কর’।[3]

মূলতঃ তাঁর কর্মজীবনের প্রায় সময়টাই ছিল অধ্যয়ন, গবেষণা, লেখালেখি, শিক্ষকতা ও দাওয়াতী কার্যক্রমে পরিপূর্ণ। জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি সিরিয়ায় অতিবাহিত করেছেন। তবে শেষভাগে নানা প্রতিকুলতার সম্মুখীন হয়ে অবশেষে জর্দানের রাজধানী আম্মানে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানেই অবস্থান করেন। নিম্নে তাঁর কর্মময় জীবনের মৌলিক দিকসমূহ তুলে করা হ’ল-

হাদীছ গবেষণায় আত্মনিয়োগ :

শায়খ আলবানী (রহঃ) জীবিকা নির্বাহের সামান্য সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ব্যয় করতেন হাদীছ শাস্ত্রের নিরন্তর গবেষণায়। ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’ ছিল তাঁর জ্ঞানার্জনের মূল ঠিকানা। সেখানে তিনি এমনভাবে সময় অতিবাহিত করতেন যে, মনে হ’ত সেটা তাঁর চাকুরীস্থল। প্রতিদিন ছালাতের সময় বাদে বাকি সময়টুকু এমনকি কোন কোন দিন ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত একাধারে অধ্যয়ন, তাহক্বীক্ব ও তা‘লীকে ব্যাপৃত থাকতেন। যোহরের ছালাতের সময় নিজে আযান দিয়ে লাইব্রেরীতে অবস্থানরতদের সাথে নিয়ে ছালাত আদায় করতেন। অধিকাংশ সময় সেখানেই অল্প পরিমাণ রুটি ও পানি দিয়ে দুপুরের খাওয়া শেষ করতেন এবং এশার ছালাত আদায় করে লাইব্রেরী ত্যাগ করতেন। লাইব্রেরী কর্তৃপক্ষ এই নিরবচ্ছিন্ন জ্ঞানসাধনা দেখে তাঁর জন্য লাইব্রেরীতে একটি পৃথক কক্ষ বরাদ্দ করে দেন।[4]

প্রখ্যাত সঊদী সাংবাদিক ও পরিব্রাজক হামদ জাসির (১৯১০-২০০০ খৃ.) বলেন, ‘আমি ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় অধিক যাওয়া-আসার কারণে শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানীকে চিনতাম। তাঁকে সেখানকার বিছানা সদৃশ গণ্য করা হ’ত। তিনি সেখানে সংরক্ষিত বইসমূহের সূচীপত্র তৈরী করতেন এবং বিরল পান্ডুলিপিসমূহ নিয়ে গবেষণায় ব্যাপৃত থাকতেন’।[5]

সিরীয় মুহাদ্দিছ ড. মাহমূদ মীরা (১৯২৯ খৃ.-) বলেন, ‘শায়খ আলবানী ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় কোন গ্রন্থের পান্ডুলিপি নামানোর জন্য মইয়ে আরোহণ করলে কখনো মইয়ে দাড়িয়েই তা খুলে পড়তে থাকতেন। এভাবে কোন কোন সময় দেখা যেত যে, ৬ ঘণ্টা পার হয়ে গেছে, অথচ তিনি মইয়ের উপর দাঁড়িয়েই অধ্যয়নরত আছেন’।[6]

একবার আব্দুল কুদ্দূস হাশেমী নামক জনৈক আলেম মুসনাদে আহমাদকে ইমাম আহমাদ ইবনু হাম্বল (রহঃ)-এর রচনা হিসাবে গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। তিনি মত প্রকাশ করেন যে, মুসনাদের মূল বর্ণনাকারী আবূবকর কাতী‘ঈ মুসনাদের মধ্যে বহু মাওযূ‘ হাদীছ যুক্ত করেছেন। সঊদী আরবের সাবেক গ্রান্ড মুফতী শায়খ আব্দুল আযীয বিন আব্দুল্লাহ বিন বায (রহঃ) বিষয়টি গুরুত্বের সাথে নিয়ে শায়খ আলবানীকে এর প্রতিবাদে এগিয়ে আসার আহবান জানান।

আলবানী এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ গবেষণায় মনোনিবেশ করার সংকল্প করেন। প্রথমে তিনি শায়খ আহমাদ আল-বান্না কর্তৃক মুসনাদে আহমাদের অধ্যায়ভিত্তিক সংকলিত মোট ২৪ খন্ডে রচিত গ্রন্থ الفتح الرباني لترتيب مسند الإمام أحمد بن حنبل এর হাদীছসমূহ গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়ন করেন। সেখানে তিনি দশটির মত হাদীছ পান, যেগুলোকে শায়খ বান্না কাতী‘ঈ কর্তৃক সংযোজিত বলে অভিযোগ করেছেন। অতঃপর ঐ হাদীছগুলো নিয়ে সূক্ষ্ম গবেষণার মাধ্যমে তিনি নিশ্চিত হন যে, অভিযোগটি সত্য নয়। সেখানে কাতী‘ঈ কর্তৃক সংযোজিত কোন হাদীছ নেই।

কিন্তু এতে তিনি সন্তুষ্ট হ’তে পারলেন না। এবার শায়খ আহমাদ শাকির কর্তৃক তাহক্বীক্বকৃত মুসনাদে আহমাদ অধ্যয়ন শুরু করলেন। প্রতিটি সনদ সূক্ষ্মভাবে পর্যবেক্ষণ করলেন। তবে আহমাদ শাকির তার তাহক্বীক্ব শেষ করতে পারেননি। ফলে তা ১৫ খন্ডে সমাপ্ত হয়েছে। সবগুলো খন্ড পাঠ করার পরও তিনি কোন সংযোজন খুঁজে পেলেন না। অতঃপর তিনি শামসুদ্দীন ইবনুল জাযারী রচিত المصعد الأحمد في ختم مسند الإمام أحمد বইটি অধ্যয়ন করলেন। সেখানকার বিবরণ অনুযায়ী, কাতী‘ঈ কর্তৃক সংযোজিত বর্ণনাগুলো মূল আহমাদের প্রথম প্রকাশিত সংস্করণের ‘মুসনাদুল আনছার’ অধ্যায়ে রয়েছে। ফলে তিনি ঐ সংস্করণটি পাঠ করতে শুরু করলেন। নির্দেশিত অধ্যায়ে কিছু না পেয়ে পুরো সংস্করণটিই প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলেন। কিন্তু সংযোজিত কোন হাদীছ খুঁজে পেলেন না।

এতেও তিনি সন্তুষ্ট হ’তে পারলেন না। তিনি এবার হাফেয হায়ছামী রচিত ‘মাজমা‘ঊয যাওয়ায়েদ’ গ্রন্থটি পড়ার মনস্থ করলেন। যেখানে মুসনাদে আহমাদসহ কয়েকটি মুসনাদের হাদীছসমূহ সংকলন করা হয়েছে। তিনি এর ১০টি খন্ডের সবগুলো পড়লেন। ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় উক্ত গ্রন্থের আরেকটি কপি ছিল। সেটাও তিনি আদ্যোপান্ত পাঠ করলেন। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, মুসনাদে আহমাদের মধ্যে কাতী‘ঈ কর্তৃক কোন কিছু সংযোজিত হয়নি। আলবানীর ভাষায়, ‘ধৈর্যের সাথে দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরেও মুসনাদে আহমাদের মধ্যে কাতী‘ঈ সংযোজিত একটি হাদীছও আমি খুঁজে পাইনি। তিনি বলেন, যদিও একাজে আমার প্রচুর পরিশ্রম ও দীর্ঘ সময় ব্যয় হয়েছে। কিন্তু সেটা কোন বিষয় নয়। কেননা এ ব্যাপারে আমি দৃঢ় বিশ্বাসী যে, আমি মুসনাদে আহমাদের সত্যতা কেন্দ্রিক অভিযোগ খন্ডনের মাধ্যমে সুন্নাতে নববীর খেদমতে রত আছি’।[7] 

‘মাকতাবা যাহেরিয়া’ ছাড়াও আলবানী আলেপ্পোর ‘মাকতাবাতুল আওক্বাফ’ সহ আরো কয়েকটি লাইব্রেরীতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। এছাড়া দামেশকের দু’টি ব্যবসায়িক লাইব্রেরীর মালিকদ্বয়ের সাথে তাঁর সুসম্পর্ক তৈরী হয়। তারা অধ্যয়নের প্রতি আলবানীর আগ্রহ উপলব্ধি করে বিনা শর্তে বই ধার দিতেন। তিনি সেখান থেকে প্রয়োজনীয় গ্রন্থাবলী নিয়ে প্রয়োজন মিটিয়ে পুনরায় ফেরৎ দিতেন।[8]

হারানো পৃষ্ঠার কাহিনী :

আলবানী স্বীয় গবেষণাকর্মের মূল পীঠস্থান দামেশকের ‘মাকতাবাতুয যাহেরিয়া’য় সংরক্ষিত ইলমে হাদীছ সংক্রান্ত গ্রন্থ ও পান্ডুলিপি সম্পর্কে গবেষকদের উপকারার্থে বহুদিনের পরিশ্রমে একটি সূচী তৈরী করেন। পরবর্তীতে ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এটি প্রকাশিত হয়। উল্লেখ্য, সূচীপত্র তৈরীর ক্ষেত্রে আলবানীর বিশেষ কোন দক্ষতা ছিল না। এছাড়া হাদীছ শাস্ত্রে নিরন্তর গবেষণায় লিপ্ত থাকায় এক্ষেত্রে কিছু করার মত পর্যাপ্ত সময়ও তাঁর ছিল না। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা কাউকে দিয়ে কিছু করাতে চাইলে তার জন্য কারণ সৃষ্টি করে দেন। উক্ত সূচীটি রচনার পিছনেও মোড় পরিবর্তনকারী এক অনন্য প্রেক্ষাপট রয়েছে, যা قصة الورقة الضائعة ‘হারানো পৃষ্ঠার কাহিনী’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। কাহিনীটি নিম্নরূপ-

১৯৪৮ সালে একবার তিনি চোখের অসুখে পড়েন। এসময় ডাক্তার তাঁকে পড়াশুনা, লেখালেখি এবং ঘড়ি মেরামতের কাজ থেকে বিরত হয়ে ছয় মাসের জন্য বিশ্রামে থাকার পরামর্শ দেন। প্রথমদিকে তিনি পরামর্শ মেনে চললেও সপ্তাহ দুই পার হ’তেই এই বিরক্তিকর অবসরে কিছু করার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেন। এসময় ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় সংরক্ষিত হাফেয ইবনু আবিদ্দুনিয়া রচিত ‘যাম্মুল মালাহী’ গ্রন্থটির পান্ডুলিপির কথা তাঁর স্মরণ হয়, যা তখনো পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তাই তিনি এর একটি অনুলিপি লিখিয়ে নেওয়ার জন্য একজন লেখক ঠিক করেন। একদিকে লেখক নিয়মিতভাবে তা লিখতে থাকেন, অন্যদিকে আলবানী তা মূলকপির সাথে মিলাতে থাকেন এবং এর হাদীছসমূহ তাহক্বীক্ব ও তাখরীজ করতে শুরু করেন। কিন্তু বইটির মাঝামাঝিতে পৌঁছে তিনি বুঝতে পারেন যে, ৪ পৃষ্ঠার একটি পাতা হারিয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আলবানী যেকোন মূল্যে উক্ত পাতাটি খুঁজে বের করার মনস্থ করেন।

মূল রিসালাটি আরো কয়েকটি বইয়ের সাথে বাঁধাই করা ছিল। এরূপ কয়েকটি রিসালাসহ বাধাইকৃত বহু বড় বড় পান্ডুলিপি ‘মাজামী‘ শিরোনামে লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত ছিল। তাই তিনি হারানো পৃষ্ঠাটি বাঁধাইয়ের সময় ভুলবশত অন্য কোন বইয়ের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে ধারণা করে প্রবল আগ্রহে তা খুঁজতে শুরু করেন। খুঁজতে খুঁজতে আরো অনেক বিরল গ্রন্থ তাঁর নযরে পড়ে। অনেক মুহাদ্দিছ ও হাফেযগণের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিসমূহ পাঠ করার সুযোগ পান। এভাবে পড়তে পড়তে তিনি ১৫২টি পান্ডুলিপি সংকলন পড়ে ফেলেন। এর মধ্যে প্রয়োজনীয় বহু বইয়ের নামও তিনি লিখে নেন। কিন্তু এত পরিশ্রমের পরেও তিনি হারানো পৃষ্ঠাটি খুঁজে পেলেন না।

এবার তাঁর মনে হয় যে, সম্ভবত পৃষ্ঠাটি হাদীছ সংক্রান্ত গ্রন্থসমূহের সাথে ভুলবশত বাঁধাই করা হয়েছে। তাই তিনি এবার সেগুলোর মধ্যে খুঁজতে শুরু করেন। কিন্তু না, সেখানেও পেলেন না। তাই তিনি এবার ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় সংরক্ষিত সমস্ত পান্ডুলিপি খুঁজে দেখার সংকল্প করেন। দিনের পর দিন পরিশ্রম করে লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত প্রায় ১০ হাযার পান্ডুলিপি পর্যবেক্ষণ করেন। কিন্তু এতোকিছুর পরেও পৃষ্ঠাটি খুঁজে পেলেন না। তবে এবারও তিনি প্রয়োজনীয় বইসমূহের নাম লিখে রাখেন। এরপর তিনি লাইব্রেরীতে স্ত্তপ করে রাখা বিভিন্ন বইয়ের হাযারো ছিন্ন পত্রের মাঝে অনুসন্ধান শুরু করেন। কিন্তু এই প্রচেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। তিনি নিরাশ হয়ে যান। 

কিন্তু না। না পাওয়ার বেদনার মধ্য দিয়েও আলবানী অনুধাবন করতে পারেন যে, আল্লাহ তা‘আলা এই নিরন্তর অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে তাঁর জন্য জ্ঞানার্জনের এক বৃহৎ দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছেন। তিনি খুঁজে পেয়েছেন এমন সব গ্রন্থরাজির অস্তিত্ব, যা বহু মানুষের অজানা ছিল। তাঁর ভাষায়, ‘মাকতাবা যাহেরিয়া আমাদের পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া বিভিন্ন উপকারী ইলম সমৃদ্ধ গ্রন্থ ও পুস্তিকাসমূহের ভান্ডার। যার মধ্যে রয়েছে এমন অনেক অপ্রকাশিত ও বিরল পান্ডুলিপি, যা বিশ্বের অন্য কোন লাইব্রেরীতে নেই’।[9]

তাই এবার তিনি নতুন পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হন। দ্বিতীয়বারের মত লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত সমস্ত পান্ডুলিপি অধ্যয়ন শুরু করেন। আগেরবার কিছু নির্বাচিত বইয়ের নাম লিখলেও এবার তিনি ইলমে হাদীছের সাথে সংশ্লিষ্ট যত গ্রন্থ তাঁর উপকারে আসতে পারে, এরূপ প্রচলিত-অপ্রচলিত সকল বইয়ের নাম লিখে নেন। এমনকি কোন বইয়ের একটি পাতা বা অপরিচিত অংশবিশেষ পেলে তাও নোট করেন। এভাবে তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ সমাপ্ত করতে না করতেই নতুন একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এবার হাদীছ সংশ্লিষ্ট সকল গ্রন্থাবলী গভীরভাবে অধ্যয়নের সিদ্ধান্ত নেন। শুরু হয় তাঁর গবেষণার তৃতীয় ও শেষ পর্যায়। প্রতিটি পাতা মনোযোগ সহকারে নযর বুলাতে থাকেন।

স্বীয় অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে আলবানী বলেন, ‘এসময় আমার এমনও দিন আসতো, যেদিন আমি লাইব্রেরীর উপরের শেলফে সাজিয়ে রাখা বইসমূহ পাঠ করার জন্য মই নিয়ে এসে তাঁর উপর চড়তে বাধ্য হ’তাম এবং সেখানে দাড়িয়েই দ্রুততার সাথে ঘন্টার পর ঘন্টা পাঠ করে যেতাম। অতঃপর সেখানে কোন অংশ গভীরভাবে অধ্যয়ন করার প্রয়োজন আছে বলে মনে হ’লে, লাইব্রেরীতে নিযুক্ত কর্মচারীকে তা নামিয়ে টেবিলে রাখার জন্য বলতাম’।

এভাবে দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে তিনি প্রভূত ইলমী ফায়েদা হাছিল করেন। এসময় তিনি যত হাদীছের সন্ধান পান, সবগুলো ধারাবাহিকভাবে পৃথক পৃথক খাতায় লিপিবদ্ধ করেন। এভাবে প্রত্যেক খন্ডে চারশ’ পাতা করে মোট ৪০ খন্ডে তাঁর এই কার্যক্রম সমাপ্ত হয়। যার প্রত্যেক পাতায় একটি করে হাদীছ উল্লেখ করে সকল হাদীছ আরবী অক্ষরের ধারাবাহিকতায় সংকলন করেন। তার সাথে যে সমস্ত গ্রন্থে হাদীছটি পেয়েছেন তার নাম সনদ ও তুরুক সমূহের বিবরণসহ পেশ করেন। আলবানী বলেন, ‘হাদীছ সংকলনের এই খন্ডগুলো থেকেই আমি আমার সকল লেখনী ও ইলমী প্রকল্পের রসদ যুগিয়েছিলাম’। এভাবে একটি হারানো পৃষ্ঠা খোঁজার অসীলায় আল্লাহ তা‘আলা ইলমে হাদীছের প্রভূত জ্ঞানের দুয়ার তাঁর জন্য উন্মুক্ত করে দেন।[10] 

তবে উক্ত সংকলনের হাদীছসমূহ জমা করার ক্ষেত্রে তিনি কেবল ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’র উপরেই নির্ভর করেননি। বরং বিভিন্ন দেশের লাইব্রেরীসমূহ থেকেও তা সংগ্রহ করেছেন। যেমন হালবের ‘মাকতাবাতুল আওক্বাফ আল-ইসলামিয়াহ’, মসজিদুন নববীর ‘মাকতাবাতুল মাহমূদিয়াহ’ এবং মদীনার ‘মাকতাবা ‘আরিফ হিকমাত’ প্রভৃতি। আলবানীর ভাষায়, ‘এসব মাকতাবায় হাদীছ, ইতিহাস, জীবনী ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট এমন সব মূল্যবান গ্রন্থরাজি সংরক্ষিত আছে, যার কোন কিছুই আজ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি।[11]

দাওয়াতী ময়দানে পদচারণা :

নিরন্তর গবেষণাকর্মের সাথে সাথে তিনি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন এলাকায় দাওয়াতী সফর ও ইলমী সমাবেশে বক্তব্য দান করতে শুরু করেন। এসময় তিনি বিশুদ্ধ শরী‘আতের সাথে ইসলামের নামে প্রচলিত প্রথাসমূহের অসংখ্য গরমিল দেখতে পান। স্থানীয় ওলামা-মাশায়েখদের মাঝে আক্বীদাগত বিষয়ে নানা ভ্রান্ত বিশ্বাস এবং আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে কৃত বহু আমল খুঁজে পান, যার কোন অস্তিত্ব পবিত্র কুরআন ও ছহীহ সুন্নায় নেই। তাই তিনি সমাজে প্রতিষ্ঠিত এসব ভ্রান্ত আক্বীদা ও আমলগত বিভ্রান্তিসমূহ দূরীকরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমতঃ তিনি প্রচলিত ভ্রান্ত বিশ্বাসসমূহ সংশোধনে আত্মনিয়োগ করেন। সাথে সাথে ফিক্বহী মাসআলা-মাসায়েলের ক্ষেত্রে যেসব জড়তা, অজ্ঞতা, গোঁড়ামি, অন্ধ অনুসরণ ও দলীল বিহীন বা দূর্বল দলীল ভিত্তিক ফৎওয়া স্থান পেয়েছে, তা দূর করার প্রয়াস পান।

যেমন উপসাগরীয় যুদ্ধকালীন (১৯৯০-৯১খৃ.) সময়ের একটি ঘটনা। শহরের কতিপয় বক্তা বিভিন্ন আলোচনা সভায় কানযুল ‘উম্মাল গ্রন্থে সংকলিত যুদ্ধের বাস্তবতা ও বিপদ সম্পর্কিত দীর্ঘ একটি হাদীছ রাসূল (ছাঃ)-এর নামে প্রচার করতে শুরু করলেন। মানুষ তা নিয়ে মশগূল হয়ে পড়ল। এদিকে আলবানীর ছাত্ররা তাঁকে হাদীছটির ব্যাখ্যা, উৎস ও বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্নবানে জর্জরিত করতে লাগলেন। হাদীছটির উৎসের সন্ধান করতে গিয়ে আলবানী (রহঃ) দেখলেন কানযুল ‘উম্মালের লেখক স্বীয় গ্রন্থে হাদীছটির উৎস হিসাবে হাফেয ইবনু আসাকির (রহঃ) রচিত তারীখু ইবনি আসাকির-এর নাম উল্লেখ করেছেন। সেসময় গ্রন্থটির ১০ ভাগের প্রায় ১ ভাগ প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র। বাকি অংশ হস্তলিখিত পান্ডুলিপি আকারে সংরক্ষিত ছিল। ফলে হাদীছটির খোঁজে তিনি ইবনু ‘আসাকিরের হস্তলিখিত কপিটির প্রক্যেকটি পৃষ্ঠা গভীরভাবে অধ্যয়ন করলেন। ৫ দিন একাধারে অধ্যয়নের পর ৬ষ্ঠ দিনে তিনি হাদীছটির সন্ধান পেলেন। জানতে পারলেন হাদীছটি একজন ছাহাবী থেকে দূর্বলসূত্রে বর্ণিত হয়েছে। উপরন্তু বর্ণনাটির মধ্যে বিকৃতি রয়েছে।[12]

এভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে শায়খ আলবানীর অব্যাহত সংস্কার প্রচেষ্টার ফলে তিনি একদল মানুষের চক্ষুশূল হয়ে ওঠেন। মাযহাবী, ছূফী ও বিদ‘আতী ওলামা-মাশায়েখগণ তাঁর দাওয়াত থেকে মানুষকে দূরে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা শুরু করেন। তাঁর বিরুদ্ধে নানা অপবাদ ছড়িয়ে দেন। তাঁকে وهابي ضال তথা ‘পথভ্রষ্ট ওয়াহহাবী’ বলে প্রচার করতে থাকেন। তবে ইতিমধ্যে তাঁর দাওয়াতের সাথে ঐক্যমত পোষণ করেছিলেন দামেশকের কয়েকজন পরিচিত আলেম। যেমন আল্লামা বাহজা বাইতার (১৮৯৪-১৯৭৬ খৃ.), শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ ইমাম (১৯৩৪ খৃ.-), হামেদ তাক্বী, তাওফীক বাযরা প্রমুখ। প্রতিপক্ষের মিথ্যা প্রচারণার জবাবে আলবানী (রহঃ) তাঁর বিরোধীদের মধ্যে দামেশকের কয়েকজন আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাদের সাথে আক্বীদা, মাযহাব ও বিদ‘আতী কর্মকান্ডসমূহ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করেন।[13]

এদিকে বিরোধীদের নানা অপপ্রচার সত্ত্বেও আক্বীদা, তাফসীর, হাদীছ, ফিক্বহ, উছূলে ফিক্বহ ও সাহিত্যসহ দ্বীনী ইলমের বিভিন্ন শাখায় তাঁর প্রদত্ত দরসসমূহের জনপ্রিয়তা দ্রুততার সাথে বৃদ্ধি পেতে থাকে। শিক্ষিত জনগোষ্ঠী বিশেষত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে তাঁর দাওয়াত প্রভূত সাড়া ফেলে। তারা তাঁর দাওয়াতের মূল বক্তব্য অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।[14] দামেশকের পাশাপাশি তিনি হালব, লাযিকিইয়াহ, ইদলীব, হিমছ, রাক্কা প্রভৃতি এলাকায় নিয়মিত সফর ও ইলমী সমাবেশে পাঠদান শুরু করেন। এসব হালাক্বায় ব্যাপক সফলতা আসে। বহু মানুষ তাঁর দাওয়াত গ্রহণ করেন। হাদীছের উপর আমলের প্রতি মানুষের আগ্রহ ক্রমাগত বৃদ্ধি পেতে থাকে।[15]

এসব দরসসমূহে যেসব গ্রন্থের উপর পাঠদান করা হ’ত তার মধ্যে ছিল ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ)-এর যাদুল মা‘আদ, ছিদ্দীক হাসান খান ভূপালীর আর-রওযাতুন নাদিইয়াহ, হাফেয মুনযেরীর আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, ড. ইউসুফ আল-কারযাভীর আল-হালাল ওয়াল হারাম, ইমাম নববীর রিয়াযুছ ছালেহীন, ইমাম বুখারীর আল-আদাবুল মুফরাদ, ইবনু হাজার আসক্বালানীর নুখবাতুল ফিকার ইত্যাদি।

শায়খ আলবানীর প্রত্যেকটি দরস ছিল ইলমী ফায়েদা ও শারঈ দিকনির্দেশনায় পূর্ণ। দরসগুলো সাধারণত ৪৫ থেকে ৬০ মিনিটের মধ্যে শেষ হ’ত। দরস শেষে ৩০ মিনিটের প্রশ্নোত্তর পর্ব থাকতো। যেখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের উপর জ্ঞানগর্ভ বিতর্ক জমে উঠতো। হাদীছ গ্রন্থ থেকে পাঠদানের সময় তিনি প্রত্যেক হাদীছের অর্থ, ব্যাখ্যা, তা থেকে গৃহীত মাসআলা ও তাঁর হুকুম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। যে গ্রন্থের পাঠদান করতেন, তা পুরোপুরিভাবে শেষ করতেন।

ইতিমধ্যে তিনি হাদীছ শাস্ত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হওয়ায় বিভিন্ন দেশ থেকে ওলামায়ে কেরাম, জ্ঞানপিপাসু শিক্ষক ও ছাত্রমন্ডলী তাঁর নিকটে ইলমী ফায়েদা হাছিলের লক্ষ্যে আগমন করতেন। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসার শিক্ষকগণ তাঁর দরসে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। এছাড়া যুবকশ্রেণীর উপস্থিতি সেখানে অনেক বেশী দেখা যেত। শায়বানী বলেন, ১৩৯৭ হিজরীর গ্রীষ্মকালে তাঁর সাথে সাক্ষাৎকালে আমি স্বচক্ষে এ দৃশ্য দেখেছি। ফিক্বহ ও হাদীছে পিএইচ.ডি ডিগ্রীধারী শিক্ষকগণ কিভাবে তাঁকে জটিল সব প্রশ্নবাণে জর্জরিত করছেন। আর তিনি দক্ষতা ও আস্থার সাথে গ্রন্থের নাম ও পৃষ্ঠা উল্লেখপূর্বক সেসব প্রশ্নের জবাব দিয়ে চলেছেন। অনেক সময় এমন সব গ্রন্থের নাম বলছেন, উপস্থিতগণ যার নাম কখনো শ্রবণই করেননি। কেননা সেসময় আলবানী ছিলেন ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় সংরক্ষিত পান্ডুলিপি ভান্ডার সম্পর্কে বিশেষত হাদীছ গ্রস্থসমূহের উপর সর্বাধিক অভিজ্ঞ ব্যক্তি। যার বহু পান্ডুলিপি এমন ছিল যে, লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত হওয়ার পর তা আর কখনো আলোর মুখ দেখেনি।[16]

প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিছ ও ফক্বীহ শায়খ মুহাম্মাদ ঈদ আববাসী আলবানী প্রদত্ত দরস সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘তিনি দুই খন্ডে প্রকাশিত আল্লামা ছিদ্দীক হাসান খান রচিত الروضة الندية في شرح الدرر البهية গ্রন্থটি সকল অধ্যায় ও অনুচ্ছেদসহ পুরোটার উপরেই আমাদের পাঠদান করেন।... পাঠদানকালে তিনি তাহক্বীক্বসহ প্রজ্ঞাপূর্ণ ব্যাখ্যাদান করতেন। ছোট-বড় কোন মাসআলাই ছেড়ে দিতেন না। বরং পরিস্কারভাবে ব্যাখ্যা করতেন, অস্পষ্টতা দূর করতেন এবং তার পক্ষে-বিপক্ষের বক্তব্যসমূহ পর্যালোচনা করতেন। সকল ক্ষেত্রেই তিনি বিশুদ্ধ দলীল ও শক্তিশালী যুক্তির উপর নির্ভর করতেন’।[17]

সঊদী আরবের প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও ঐতিহাসিক শায়খ আব্দুললাহ বিন মুহাম্মাদ বিন খুমাইস (১৯১৯-২০১১ খৃ.) বলেন, দামেশকে আমি সালাফীদের খুঁজে পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষে এবং ওলামায়ে কেরামের সমাবেশ সমূহে। তাদের মধ্যে রয়েছে এমনও যুবক, যারা বিবিধ জ্ঞানের আলোয় সুশিক্ষিত; চিকিৎসা, আইন, সাহিত্য প্রভৃতি বিষয়ে অধ্যয়নরত...। একদিন তাদের মধ্যকার এক যুবক আমাকে বলল, আজকের দরসে আপনি উপস্থিত হবেন না? আমি বললাম, আমাকে নিয়ে চলো। অতঃপর যুবকটির সাথে আমি সেখানে গিয়ে দেখি দামেশকের মহান মুহাদ্দিছ সম্মানিত শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী। তাঁর চারপাশে বসে আছে চল্লিশের অধিক শিক্ষিত যুবক। সেখানে পাঠদান চলছে ইমাম মুহাম্মাদ ইবনু আব্দুল ওয়াহহাব রচিত ‘কিতাবুত তাওহীদ’ ও তাঁর নাতি (আব্দুর রহমান বিন হাসান) রচিত ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘ফাৎহুল মাজীদ’-এর حماية المصطفي صـ جناب التوحيد وسده طرق الشرك অনুচ্ছেদ থেকে। বিরল এ দৃশ্য দেখে আমি ভীষণভাবে বিস্মিত হ’লাম এবং দরস শ্রবণের জন্য নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলাম। তারপর শুনতে থাকলাম ইলমুত তাওহীদের উপর তাঁর তাহক্বীক্ব, সূক্ষ্ম গবেষণা ও বিশদ আলোচনা। অনুভব করলাম এ ব্যাপারে তাঁর গভীর পান্ডিত্য। শুনতে পেলাম ছাত্রদের শান্তিপূর্ণ ও গুরুগম্ভীর আলোচনা এবং জটিল সমস্যাসমূহের পর্যালোচনা। এভাবে একসময় তাওহীদের পাঠদান সমাপ্ত হ’ল।

এরপর তারা ছিদ্দীক হাসান খানের ‘আর-রাওযাতুন নাদিইয়াহ’ থেকে হাদীছের পাঠ শুরু করলেন। এখানেও আমি প্রভূত জ্ঞানসমৃদ্ধ তাহক্বীক্ব, উছূল ও ফিক্বহী আলোচনা শুনতে পেলাম। একসময় দরস শেষ হ’ল। পরবর্তীতে দামেশকে অবস্থানকালীন পুরো সময়ে শায়খের দরসে আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করতাম। এসময়ে তারা ফাৎহুল মাজীদ থেকে ইলমুত তাওহীদ অংশ শেষ করেন। অতঃপর শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) রচিত ‘ইক্বতিযাউছ ছিরাতিল মুস্তাক্বীম’ থেকে পাঠ শুরু করেন। ফলে প্রতিনিয়ত ছাত্রদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেত। তাদের আগ্রহ নবায়ন হ’ত। তারা লিখত ও প্রকাশ করত। যারা ‘আত-তামাদ্দুনুল ইসলামী’ পত্রিকাটি পাঠ করত, তারা সেখানে প্রকাশিত আলবানী ও তাঁর ছাত্রদের লেখনী বিপুল আগ্রহ নিয়ে অধ্যয়ন করত। আমি নিজেও বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজের উপর তাদের গভীর প্রভাব অনুভব করতাম। যা মূলতঃ এই বরকতময় দাওয়াতের তাৎপর্যপূর্ণ ভবিষ্যতের সুসংবাদ দিত।[18]

দারিদ্রে্যর কশাঘাত :

জীবনের মধ্যভাগে আলবানীকে চরম দারিদ্রে্যর মুকাবিলা করতে হয়েছিল। লেখালেখি-অধ্যয়নে অধিক সময় অতিবাহিত হওয়ার ফলে ঘড়ি মেরামতে প্রয়োজনীয় সময় দিতে পারতেন না। ফলে তাঁর জীবিকা নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়েছিল। দারিদ্রে্যর কারণে এসময় তিনি গবেষণাকর্মের জন্য প্রয়োজনীয় কাগজ ক্রয় করতে পারতেন না। তাই রাস্তায় পড়ে থাকা কাগজের সাদা অংশও কখনো তিনি লেখালেখির কাজে ব্যবহার করতেন। কখনো পরিত্যক্ত ছিন্নপত্র ক্রয় করে তাতেই প্রয়োজনীয় লেখালেখি সম্পন্ন করতেন।

শায়খ মাশহূর হাসান বলেন, ‘শায়খ আমাকে সিলসিলা যঈফাহ-এর কয়েকটি খন্ড প্রকাশের পূর্বে পুনর্নিরীক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেকারণ একদিন আমি তাঁর নিকট থেকে পঞ্চম খন্ডের পান্ডুলিপিটি গ্রহণ করলাম। অতঃপর তা ব্যাগ থেকে বের করে যা দেখলাম, তাতে আমি কেঁদে ফেললাম। তিনি পঞ্চম খন্ডটি চিনি, চাল প্রভৃতির সাধারণ প্যাকেট, ওযন করার লাল প্যাকেটসহ মানুষের দানকৃত পরিত্যক্ত কাগজে লিখেছেন। শায়খ বললেন, তোমার কি হয়েছে? আমি কথা বলতে পারছিলাম না। তারপর তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বললেন, দেখ আমার কাছে ভাল কাগজ ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ছিল না।[19] জীবনীকার শায়বানী বলেন, আমি শায়খের নিকটে এরূপ কাগজের উপর লিখিত বেশ কিছু বইয়ের পান্ডুলিপি দেখেছি। যার অধিকাংশই ছিন্নপত্র। একদিন তিনি আমাকে বলেন, ‘স্বল্প মূল্যের কারণে আমি পরিত্যক্ত কাগজ ওযন দরে ক্রয় করতাম’।[20]

মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা :

হাদীছ, ফিক্বহ, আক্বীদা প্রভৃতি বিষয়ে আলবানীর লেখনীসমূহ দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে যাওয়ার ফলে জ্ঞানী সমাজে তাঁর বিশেষ অবস্থান তৈরী হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দে মদীনা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর তাঁকে এর হাদীছ বিভাগে শিক্ষকতার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়। সঊদী আরবের তৎকালীন গ্রান্ড মুফতী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর শায়খ মুহাম্মাদ বিন ইবরাহীম আলে শায়খ (১৯৬৫-১৯৬৯ খৃ.) তাঁকে আমন্ত্রণপত্র পাঠান। অতঃপর সাথীদের পরামর্শে তিনি এতে সাড়া দেন এবং চাকুরীতে যোগদান করেন। সেখানে একদিকে তিনি শিক্ষাদানের সুযোগ লাভ করেন, অন্যদিকে স্বীয় দাওয়াত প্রচারের উত্তম পরিবেশ খুঁজে পান।[21]

সেখানে তিনি ‘ইলমুল ইসনাদ’ শিরোনামে হাদীছের সনদ সম্পর্কে শিক্ষাদানের জন্য পৃথক একটি বিষয় সিলেবাসভুক্ত করেন। ছাত্রদের বুঝানোর জন্য তিনি বোর্ডে সনদসহ হাদীছ লিখতেন। অতঃপর রিজাল সম্পর্কিত গ্রন্থসমূহ থেকে হাদীছ তাখরীজ ও রাবীদের সমালোচনার পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করতেন। তারপর কিভাবে হাদীছের হুকুম সাব্যস্ত করতে হয়, তা হাতে-কলমে দেখিয়ে দিতেন। এরূপ প্রায়োগিক পাঠদান পদ্ধতি শিক্ষার্থীদের গভীরভাবে প্রভাবিত করত এবং তাদের মাঝে প্রবল উৎসাহ সৃষ্টি হ’ত। সেইসময় মিসরের আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে পাঠদান করা হ’ত না। ফলে প্রথমবারের মত আলবানীর মাধ্যমে বিষয়টির উপর পাঠদান শুরু হয়। ৩ বছর শিক্ষকতার পর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিদায় নিলেও হাদীছ বিভাগের প্রধান হিসাবে তাঁর স্থলাভিষিক্ত ড. আমীন মিসরী (১৯১৪-১৯৭৭ খৃ.) ‘ইলমুল ইসনাদ’ শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে আলবানীর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন। ফলে সময়ের ব্যবধানে বিষয়টি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সমূহেও পৃথকভাবে পাঠদানের বিষয়ে পরিণত হয়।[22]

সেখানে শিক্ষকতাকালীন সময়ে তাঁর নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে। যেমন পাঠদানের মাঝে বিরতির সময়টুকু তিনি বিশ্রাম কক্ষে না গিয়ে ছাত্রদের নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বালুকাময় উন্মুক্ত ময়দানে হাদীছের দারস দানে বসে যেতেন। যেখানে হাদীছ বিভাগ ছাড়াও অন্যান্য বিভাগের ছাত্ররাও অংশগ্রহণ করত। এ অবস্থা দেখে অনেক শিক্ষক মন্তব্য করতেন যে, ‘এটাই তো প্রকৃত শিক্ষাদান’।

ছাত্রদের সাথে আলবানীর সম্পর্ক ছিল একান্ত বন্ধুত্বপূর্ণ। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের ক্ষেত্রে সবধরণের আনুষ্ঠানিকতা ও ব্যক্তিত্বের দূরত্ব পরিহার করে তিনি তাদের আস্থা ও ভালোবাসার পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থী যেন শিক্ষকের নিকটে যেকোন প্রশ্ন, বক্তব্য বা সমালোচনা পেশ করতে ইতস্তত না করে। তাই ছাত্ররা তাঁর সাথে যেকোন বিষয়ে আলোচনা করার সুযোগ পেত। এভাবে তিনি ছাত্রদের নিকটে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিয়তম শিক্ষকে পরিণত হন। সুযোগ পেলেই তারা তাঁর সান্নিধ্যে আসতে চাইত। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে আগমন ও প্রস্থানকালে তার গাড়ি ছাত্রদের দ্বারা পরিপূর্ণ থাকতো। আবার সকালে বিশ্ববিদ্যালয়ে উপস্থিত হ’লে তাঁর গাড়ি ঘিরে একদল ছাত্র জমা হয়ে যেত। তাদের সাথে যেতে যেতে তিনি নানা প্রশ্নের জবাব দিতেন।[23]

ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে তাঁর বিপুল জনপ্রিয়তা কিছু শিক্ষকের মাঝে ঈর্ষা সৃষ্টি করে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিকটে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু অসত্য অভিযোগ পেশ করে এবং তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে প্রশাসন তাঁর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে আলবানী দামেশকে ছুটি কাটিয়ে ফেরার পূর্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন চ্যান্সেলর শায়খ ইবনু বায (রহঃ)-এর পক্ষ থেকে তাঁর সাথে চুক্তি সমাপ্ত করার বিবরণ সম্বলিত পত্র পান। তবে সেখানে শায়খ ইবনু বায আলবানীকে সান্তনামূলক বেশ কিছু কথা লেখেন। ১৯৬৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেখানে অধ্যাপনা করেন।[24]

আলবানী বিষয়টি সহজেই মেনে নেন এবং স্বীয় ভাই মুনীর নূহ নাজাতী, অতঃপর ছেলে আব্দুল লতীফকে দোকানের সার্বিক দায়িত্ব দিয়ে একমুখী হয়ে নতুন উদ্যোমে গবেষণায় মনোনিবেশ করেন।[25] সাথে সাথে নিজ ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় পূর্বের ন্যায় দাওয়াতী সফর ও ইলমী মজলিসে বক্তব্য প্রদান শুরু করেন।

নানাবিধ ষড়যন্ত্র ও কারাভোগ :

অব্যাহত দাওয়াতী কার্যক্রমের ফলে দিন দিন তাঁর প্রতি একশ্রেণীর মানুষের বিদ্বেষ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে তিনি নানাবিধ ষড়যন্ত্রের সম্মুখীন হন। যেমন একবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা বিষয়ক প্রতিনিধি ইদলীব শহরের প্রধান মুফতীর পরামর্শক্রমে আলবানীকে ডেকে ইদলীব শহরে তাঁর দাওয়াতী কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। আরেকবার দামেশকের পুলিশ বিভাগ থেকে তাঁকে ডেকে শহরের প্রধান মুফতীর সাথে সাক্ষাৎ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আলবানী প্রধান মুফতীর অফিসে গিয়ে দেখেন যে, তা ওলামা-মাশায়েখদের ভিড়ে পরিপূর্ণ। মুফতী ছাহেব একটি ঘটনা বর্ণনা করে আলবানীকে শহরে ফিৎনা ছড়ানোর জন্য অভিযুক্ত করেন।

যার সারসংক্ষেপ হ’ল- জনৈক যুবক শহরের একটি মসজিদে জামা‘আতে ছালাত আদায় করার পর দেখল যে কিছু মুছল্লী জামা‘আতে যোগ দেয়নি। তারা তাদের মাযহাবের ইমাম আগমনের অপেক্ষা করছেন। অতঃপর ইমাম আসলে তারা দ্বিতীয় জামা‘আতের জন্য কাতারবন্দী হন। এ দৃশ্য দেখে যুবকটি ধৈর্যধারণ করতে না পেরে এর প্রতিবাদ করে এবং জামা‘আতের ক্ষেত্রে এরূপ পার্থক্যকরণ জায়েয নয় বলে তাদেরকে জানিয়ে দেয়। ফলে মসজিদের মধ্যেই মুছল্লীরা তাঁকে লাথি-ঘুষি মারতে উদ্যত হয়।

আলবানী উক্ত যুবককে চিনতেন না। তাই তিনি অভিযোগ অস্বীকার করেন। কিন্তু আলেমগণ শহরে নব্য হাদীছভিত্তিক ফিক্বহের জাগরণ সৃষ্টির জন্য আলবানীকে দায়ী করেন। অতঃপর নানা হুমকি-ধমকির মুখে তিনি জনসম্মুখে কখনো বক্তব্য দিবেন না মর্মে অঙ্গীকারপত্রে স্বাক্ষর করেন। যদিও প্রকাশ্য বক্তব্য প্রদানে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না।

আরেকবার ওলামা পরিষদ নামে একটি দলের প্রধান আলবানীর রক্ত হালাল বলে ঘোষণা দেন।[26]

শহরের একদল মাশায়েখ তাঁর বিরুদ্ধে একটি অভিযোগপত্র লিখে সেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের স্বাক্ষর গ্রহণ করে। অতঃপর শামের প্রধান মুফতীর নিকটে প্রেরণ করে। অভিযোগপত্রটির সারমর্ম ছিল এই যে, তিনি যে ওয়াহহাবী দাওয়াত প্রচার করছেন, তা মুসলমানদের মধ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টি করছে। মুফতী ছাহেব তা পুলিশ প্রধানের নিকটে পেশ করেন। অতঃপর তিনি আলবানীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠান। অবশেষে আল্লাহর অশেষ রহমতে তিনি এই ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তি পান।

আলবানী লেখনী ও বক্তব্যের মাধ্যমে ছূফীদের আচরিত বাতিল আক্বীদা ও আমলসমূহের ব্যাপারে মানুষের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টি করতেন। ফলে ছূফী তরীকার কিছু আলেম-ওলামা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে নানা মিথ্যা অপবাদ রটায় এবং হুমকি-ধমকি দেয়। শাসকের নিকটে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ পেশ করতে থাকে। ইতিমধ্যে আরব-ইসরাঈল যুদ্ধের প্রেক্ষিতে প্রশাসন শহরের আলেম-ওলামাদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করে। আলবানীর বিরুদ্ধে পূর্ব থেকে নানা অভিযোগ থাকায় ১৯৬৯ সালে তিনি প্রায় ৬ মাসের জন্য কারান্তরীণ হন। উল্লেখ্য, ১৯৬৭ সালেও ১ মাসের জন্য তিনি কারাগারে নীত হয়েছিলেন।[27]

সিরিয়ার হাসাকা যেলায় অবস্থিত বিশালকায় একটি কারাগারে তাঁকে বন্দী করা হয়। পরবর্তীতে তিনি দামেশকের বিখ্যাত কিল‘আ কারাগারসহ কয়েকটি কারাগারে স্থানান্তরিত হন। কাকতালীয়ভাবে এই কিল‘আ কারাগারে পথভ্রষ্ট আলেমদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে একসময় বন্দী জীবন কাটিয়েছিলেন শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ (১২৬৩-১৩২৮ খৃ.) ও তাঁর বিখ্যাত ছাত্র হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) (১২৯২-১৩৪৯ খৃ.)।

বাইরের ন্যায় কারাগারেও আলবানী দ্বীনের দাওয়াতে ব্যাপৃত থাকেন। সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে শিরকমুক্ত বিশুদ্ধ ঈমান, বিদ‘আতমুক্ত বিশুদ্ধ আমল এবং তাক্বলীদী বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার প্রতি আহবান জানান। বহু মানুষ তাঁর দাওয়াতে সাড়া দেয়। তিনি কারাগারে জামা‘আতের সাথে জুম‘আসহ সকল ছালাত আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণে নানাভাবে প্রচেষ্টা চালান। ফলে ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ)-এর পর তাঁর মাধ্যমেই কারাগারটিতে পুনরায় একত্রে জুম‘আর ছালাত চালু হয়।[28]

কারাগারে যাওয়ার সময় তিনি ছেলের নিকট থেকে ছহীহ মুসলিম-এর একটি কপি, পেন্সিল, কলম ও রাবার সাথে নিয়েছিলেন। অতঃপর কারাগারের অখন্ড অবসরে তিনি এর সংক্ষেপনের কাজ সম্পন্ন করেন। এটি মুনযিরীকৃত মুখতাছার ছহীহ মুসলিমের তাহক্বীক্ব নয়। বরং পৃথকভাবে সংক্ষেপায়িত। যদিও এর মূল পান্ডুলিপি পরবর্তীকালে হারিয়ে যায়।[29] 

কারান্তরীণ অবস্থায় তিনি সর্বদা কুরআনে বর্ণিত হযরত ইউসুফ (আঃ)-এর কথাটি বারবার পাঠ করতেন। যেখানে বলা হয়েছে, ‘হে আমার পালনকর্তা! এরা আমাকে যে কাজের দিকে আহবান জানাচ্ছে, তাঁর চাইতে কারাগারই আমার নিকটে অধিক প্রিয়’।[30]

কারগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পর তাঁকে একটি দ্বীপে আরো কয়েকমাস নির্বাসিত জীবন কাটাতে হয়। সেখানে তিনি দিনরাত পরিশ্রম করে তিন মাসের মধ্যে হাফেয মুনযিরী কৃত ‘মুখতাছার ছহীহ মুসলিম’-এর তাহক্বীক্ব সম্পন্ন করেন।[31] আলবানীর ভাষায়, ‘প্রায় তিন মাস আমি একাজেই নিবিষ্ট ছিলাম। কোন ক্লান্তি ও বিরক্তি ছাড়া দিন-রাত আমি কাজ করে যেতাম। ফলে কারান্তরীণ করার মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর শত্রুরা আমার উপর যে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, তা আমার জন্য আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহে পরিণত হ’ল। ...অতএব সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য, যার অনুগ্রহে সকল সৎকর্ম সম্পন্ন হয়ে থাকে।[32]

সর্বোপরি এসব নানাবিধ অত্যাচার দাওয়াতী ময়দানে তাঁর পদচারণায় কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করেনি। তাঁর নিরন্তর হাদীছ গবেষণাতেও অন্তরায় হয়নি। বরং তাঁর নৈতিক ও মানসিক দৃঢ়তা বৃদ্ধি করেছিল। আলবানী বলেন, আমার উপর তাদের এসব ষড়যন্ত্রের প্রভাব তাদের কামনার বিপরীত ছিল, কেননা তা আল্লাহ কর্তৃক ফরযকৃত এ দাওয়াতী খেদমতে আমার সংকল্পকে বহুগুণ বৃদ্ধি করেছিল।[33] (চলবে)


[1]. ছাফহাতুন বায়যা মিন হায়াতিল আলবানী, পৃ. ২১।

[2]. আলবানী; হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ১০।

[3]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৪৮।

[4]. আবুল হাসান হাফেয আব্দুল খালেক, মুজাদ্দিদে দ্বীন মুহাদ্দিছে কাবীর মুহাক্কিকে শাহীর মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রিয়াদ: মাকতাবাতু দারিস সালাম, ১ম প্রকাশ, ১৪২৯ হি.), পৃ. ৩৬-৩৭।

[5]. আহমাদ জাসির, ফিল ওয়াতানিল ‘আরাবী মিন রিহলাতি আহমাদ জাসির (রিয়াদ: মানশূরাতু মাজাল্লাতিল ‘আরাব, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯ খ্রি.), ২/২২১ পৃ.।

[6]. নূরুদ্দীন তালিব, মাক্বালাতুল আলবানী (রিয়াদ: দারু আতলাস, ১ম প্রকাশ, ২০০০ খ্রি.), পৃ. ২২০।

[7]. আলবানী, আয-যাববুল আহমাদ ‘আন মুসনাদ ইমাম আহমাদ (বৈরূত: দারুছ ছাদীক্ব, ১ম প্রকাশ, ১৯৯৯ খ্রি.), পৃ. ৪৩-৬৯।

[8]. ড. মুহাম্মাদ আব্দুর রাযযাক আসওয়াদ, আল-ইত্তিজাহাতুল মু‘আছারাহ ফী দিরাসাতিস সুন্নাহ আন-নাবাবিইয়াহ ফী মিছর ওয়া বিলাদিশ শাম (দিমাশক : দারুল কালিমাতিত ত্বাইয়িব, ১ম প্রকাশ, ২০০৮ খ্রি.), পৃ. ৩৫৫।

[9]. আলবানী, ফিহরিসু মাখতূতাতিদ দারিল কুতুবিয যাহেরিয়াহ (রিয়াদ: মাকতাবুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০১ খ্রি.), পৃ. ৮-১২।

[10]. আলী হাসান হালাবী বলেন, জনৈক গবেষক উক্ত হারানো পাতাটি তুরস্কের একটি লাইব্রেরী থেকে উদ্ধার করেন। অতঃপর তা সঊদী আরবের ‘মদীনা মুনাওয়ারা’ নামক একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। উক্ত পৃষ্ঠাটি আলবানীকে পড়ে শোনানো হ’লে তিনি খুবই খুশী হন। কারণ এর মাধ্যমে একদিকে তিনি নিশ্চিত হন যে, উক্ত পাতাটি আসলেই ‘মাকতাবা যাহেরিয়া’য় ছিল না। অন্যদিকে পাতাটির মধ্যস্থিত ইলমী ফায়েদা হাসিল করতে সক্ষম হন। -দ্র. ছাফহাতুন বায়যা, পৃ. ৩১-৩৩।

[11]. আলবানী, য‘ঈফুল জামে‘ (বৈরূত: আল-মাকতাবুল ইসলামী, ৩য় প্রকাশ, ১৯৮৮ খ্রি.), পৃ. ১/৮।

[12]. ড. আব্দুল আযীয আস-সাদহান, ইমাম আলবানী : দুরূস ওয়া মাওয়াক্বিফ ওয়া ‘ইবার, পৃ. ৬৩-৬৪।

[13]. মুহাম্মাদ হামিদ আন-নাছের, ওলামাউশ শাম ফীল কারনিল ‘ইশরীন (জর্দান : দারুল মা‘আলী, ১ম প্রকাশ, ২০০৩ খ্রি.), পৃ. ১৭৯।

[14]. আব্দুল্লাহ খুমাইস, শাহরুন ফী দিমাশক (রিয়াদ : ১৯৫৫ খ্রি.), পৃ. ৭৪।

[15]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৫৪-৫৫।

[16]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৭৩।

[17]. পূর্বোক্ত, পৃ. ১/৫৭-৫৮; ইবরাহীম আল-হাশেমী, ছাফাহাতুন মুশাররাফাহ মিন হায়াতিশ শায়খ আল-আলবানী (আরব আমিরাত: মাকতাবাতুছ ছাহাবা, ১ম প্রকাশ, ২০০০ খ্রি.), পৃ. ১৩২।

[18]. ড. ‘আছিম আল-কারয়ূত্বী, কাওকাবাতুম মিন আইম্মাতিল হুদা ওয়া মাছাবীহুদ দুজা (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০০ খ্রি.), পৃ. ১৯৬-৯৭; নাছিরুদ্দীন আল-আলবানী: মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ২৪-২৫।

[19]. ইসতামি‘ ইলাইহি মিন কালামিশ শায়খ আবী ওবায়দা, অডিও রেকর্ড থেকে সংগৃহীত। দ্র. http://www.mashhoor.net /inside/Lessons/muslim/m11-1-13.mp3, 15.03.2019

[20]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৪৩।

[21]. আলী আব্দুল ফাত্তাহ, আ‘লামুল মুবদি‘ঈন মিন ওলামাইল ‘আরাব ওয়াল মুসলিমীন (বৈরূত : দারু ইবনি হাযম, ১ম প্রকাশ, ২০১০ খ্রি.), পৃ. ১৪৪৯; ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ৩০-৩১।

[22]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৬১-৬২।

[23]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহূ, ১/৫৯-৬০।

[24]. ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ৩২-৩৩; হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/৬০।

[25]. ড. ‘আছিম আব্দুল্লাহ আল-ক্বারয়ূত্বী, তারজামাতুন মু’জাযাহ লি ফাযীলাতিল মুহাদ্দিছ নাছিরুদ্দীন আলবানী (জেদ্দা: দারুল মাদানী, তাবি), পৃ. ১৩।

[26]. ওলামা ওয়া মুফাক্কিরূন ‘আরাফতুহুম, ১/২৯৬।

[27]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, পৃ. ৫৬।

[28]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/২৮-২৯।

[29]. ইমাম আলবানী হায়াতুহু ওয়া দাওয়াতুহু, পৃ. ৩৭-৩৯; নাছিরুদ্দীন আলবানী; মুহাদ্দিছুল ‘আছর ওয়া নাছিরুস সুন্নাহ, পৃ. ২৮।

[30]. হায়াতুল আলবানী ওয়া আছারুহু, ১/২৮।

[31]. ‘ইছাম মূসা হাদী, হায়াতুল আল্লামা আলবানী (আম্মান: মাকতাবাতুল ইসলামিয়াহ, ১ম প্রকাশ, ১৪২২ হি.), পৃ. ১৪।

[32]. আলবানী, মুখতাছার ছহীহুল ইমাম আল-বুখারী, (রিয়াদ: মাকতাবাতুল মা‘আরেফ, ১ম প্রকাশ, ২০০২ খ্রি.), ভূমিকা দ্র., পৃ. ১/৮-৯।

[33]. ওলামা ওয়া মুফাক্কিরূন ‘আরাফতুহুম, ১/২৯৫।






শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ইমাম নাসাঈ (রহঃ) (২য় কিস্তি) - কামারুযযামান বিন আব্দুল বারী
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৭ম কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ আবুল কাসেম সায়েফ বেনারসী (পূর্ব প্রকাশিতের পর) - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারেকিছু আপত্তি পর্যালোচনা (শেষ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) - ড. নূরুল ইসলাম
শেরে পাঞ্জাব, ফাতিহে কাদিয়ান মাওলানা ছানাউল্লাহ অমৃতসরী (রহঃ) (৮ম কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) (২য় কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মাওলানা মুহাম্মাদ জুনাগড়ী (রহঃ) (শেষ কিস্তি) - ড. নূরুল ইসলাম
মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ)-এর ব্যাপারে কিছু আপত্তি পর্যালোচনা (৪র্থ কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
যুগশ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিছ মুহাম্মাদ নাছিরুদ্দীন আলবানী (রহঃ) (৫ম কিস্তি) - ড. আহমাদ আব্দুল্লাহ নাজীব
আরও
আরও
.